বিশেষ রচনা : কবির কাব্যশৈলী : ঘন রাত আর শুধু ডানাহীন ওড়া : তুষার কবির
অন্য এক কাব্যভাষার খোঁজে
অন্য এক কাব্যভাষা, অন্য এক স্বরের খোঁজে কবি সাজ্জাদ শরিফ কবিতার পথে হেঁটেছেন নিমগ্ন এক সাধকের মতন! বাগ্দেবীর পেছনে ছুটেছেন ধ্যানস্থ এক সন্তের মতন! ভিন্ন শব্দঅভিধায়, ভিন্ন লিখনভঙ্গিমায় তিনি পাঠকদের নিয়ে গেছেন ইমেজ ও ইল্যুশনভরা এক কাব্যপ্রতিবেশে। সাজ্জাদ শরিফের কবিতায় পাঠক কখনওবা পৌঁছে যান চিত্রকল্পের চুল্লির ভেতর, ঘুরপাক খান এক অধিবাস্তব কুহক জগতে! আবার কখনওবা তাঁর কবিতায় পাঠক সম্মোহিত হন ইশারালিখনের এক মায়াবি বিভ্রমে! সাজ্জাদ শরিফ-এর জ্বলজ্বলে ইমেজারি পাঠকের সংবেদনে টুকরো টুকরো প্রিজমের মতো আছড়ে পড়ে, যা থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকে অগণিত সংকেত ও শিহরণ! ছুরিচিকিৎসা—মাত্র একটি কবিতার বইতেই সাজ্জাদ শরিফ তৈরি করেছেন স্বতন্ত্র এক কাব্যভাষা; রেখেছেন তাঁর নিজস্ব সিগনেচার! যাপিত জীবনের ষাটতম জন্মদিনে কবিকে অভিবাদন। ষাটটি ডানার উন্মীলনে কবিকে অভিনন্দন।
গাণ্ডীব, বাঁকবদলের ইশতেহার
গাণ্ডীব—এই ছোটকাগজটিকে ঘিরে, আশির দশকের কতিপয় কবি বাঁকবদলের ইশতেহার নিয়ে শুরু করেছিলেন একটি মুভমেন্ট! কবিতায় স্লোগানধর্মিতা, বিবৃতিময়তা, উচ্চকিত ক্যাকোফোনি, যুদ্ধধ্বস্ত জনপদের আর্তি, থরোথরো প্রেমময়তা, প্রেমাস্পদের জন্যে ক্রমাগত তুমি তুমি করা—এগুলো থেকে দূরে সরে আসতেই ‘গাণ্ডীব’Ñএর কবিরা শুরু করলেন কাব্যভাষা বিনির্মাণের একটি আন্দোলন! প্রচল কবিতার বিরুদ্ধে ঘোষণা করলেন তাঁদের পোয়েটিক মেনিফেস্টো! আর এই ‘গাণ্ডীব’ আন্দোলনের অন্যতম পুরোহিত ছিলেন কবি সাজ্জাদ শরিফ!
হরপ্পার ছড়ানো মোহর
ছুরিচিকিৎসার পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায়, পঙ্ক্তিগুলোর ভেতর থেকে, জ্বলে ওঠে চিত্রকল্পের এক মৌন ঝাড়বাতি! লহমায় পাঠকের সংবেদনে আছড়ে পড়ে রাতপ্রহরীর সিগনাল, নির্জন তাঁবুর মধ্যে পারদমাখানো নারীদেহ, আঁতুড়ঘরে শিশুডাকাত, সহস্র সাপিনী, বর্শা হাতে ছুটে আসা নররাক্ষস, শ্বাসরুদ্ধ মাতাল সাগর, প্রাচীন সমুদ্রতীর, অশ্মীভূত খুলি আর হরপ্পার ছড়ানো মোহর :
হরপ্পার ছড়ানো মোহর জ্বলে মাথার ওপরে
পায়ের ধুলোর নিচে সোডমের বিচূর্ণ প্রাসাদ,
লবণ, শিশুর হাড়, অশ্মীভূত খুলি।
বাতাসে তরঙ্গ নেই―পরাগ, পাখির ডানা নেই
কোথায় রক্তাভ গন্ধ? তবু বলি, তবু, হে মকর,
যেথা খুশি চলে যাও; অবিমৃশ্যকারিতার দিন শুরু হলো।
(ছাড়পত্র)
প্রতীক-প্রতিমার গোধূলিকুহেলিকায়
সাজ্জাদ শরিফ-এর এই কাব্যযাত্রা নিয়ে গাণ্ডীব-এর আরেক কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ তুলে ধরেছেন তাঁর নিজস্ব বয়ান; ‘সাজ্জাদ শরিফ যাত্রা শুরু করেছিলেন বাংলা কবিতার স্বর্ণমন্দিরে চিরস্থায়িত্বের প্রস্তুতি ও প্রতিশ্রুতিসহ। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে অতি বাচাল ভাষ্য-বিবৃতির যে-মরুপথে স্রোতোধারা হারিয়ে বসেছিল কবিতা, সেখান থেকে আশির দশকে যে-কাব্যপ্রকৌশলীরা চিরন্তন বাংলা কবিতার ভাবসুষমাকে চালিয়ে নিয়ে আসেন তার স্ব-খাতে, সাজ্জাদ তাঁদের অন্যতম শুধু নন, একজন পথিকৃৎও বটে। অবশ্য সুমিতি, পরিশীলন এবং বিবৃতিবিতৃষ্ণাই যে তাঁর কবিতায় একচ্ছত্র, তাও নয়। সাজ্জাদ আগাগোড়া হেঁটেছেন প্রতীক-প্রতিমার গোধূলিকুহেলিকায়’ৃ
ডানা মেলা কাব্যভাষা; প্যারাডাইম শিফট
কেমন ঝাপটে এলে, ডানা, এই জলাভূমি থেকে
আমাকে নখরে গেঁথে, ও স্বতঃপ্রকাশ,
তুলে নেবে? রাত্রি এলে কেন দূর বনে চলে গেলে
অচেনা জন্তুর ঘায়ে ন্যুব্জ হয়ে থাকি, আমি জলে ডুব দিয়ে
কাটাই দিবসযাম।… (ডানা)
কবি সাজ্জাদ শরিফ এবং আশির আরও কতিপয় কবিদের এই বাঁকবদলটি মূলত ভাষাকে ঘিরে! গাণ্ডীব অনুগামী কবিগণ প্রচলিত সিনট্যাক্সের বাইরে অন্য এক কাব্যভাষা নির্মাণে সক্রিয় ছিলেন। তাঁদের এই অভিযাত্রা, বলা যায়, বাংলা কবিতায় একটি প্যারাডাইম শিফট! কবি শান্তনু চৌধুরীর লব্ধস্বর প্রবন্ধগ্রন্থের ‘ভাষাপর্বে কবির লড়াই’ নিবন্ধে উঠে আসে সে সময়ের কবিতার সারাৎসার; ‘গত শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের কবিতায় যে পালাবদল আমরা খেয়াল করি তা মূলত ভাষাকে ঘিরেই। এর আগ পর্যন্ত কবিদের লেখায় ভাষাকেন্দ্রিক যে প্রণোদনা ছিল, আমরা দেখি, সে ভাষা-বলয় থেকে সচেতনভাবে বেরিয়ে আসার চেষ্টা শুরু হয় এ সময়। এ সময়ের বাংলা কবিতায় ভাষার পাশাপাশি যে বিষয়টি বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল তা হচ্ছে এর বিষয়ের বিভিন্নতা। কালের ধারায় এ রূপবদল ছিল স্বতঃসিদ্ধ’। কবি সাজ্জাদ শরিফ তাঁর এই ডানা মেলা কাব্যভাষার নীরিক্ষা করেছেন মূলত ছোটকাগজে। তপন বড়ুয়া সম্পাদিত গাণ্ডীব-এ তিনি বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। গাণ্ডীব ছাড়াও অনিন্দ্য, সংবেদ—এই ছোটকাগজগুলোতে তিনি নীরিক্ষাধর্মী কবিতা লিখেছেন।
চামড়া-ছাড়ানো দগদগে আদিমতা; রক্তের ফেনময় ঘূর্ণিনাচ
বাঁকবদলের দুর্মর অভীপ্সা নিয়ে কবি সাজ্জাদ শরিফ, শোয়েব শাদাব ও শান্তনু চৌধুরী গাণ্ডীব-এ ঘোষণা করেছিলেন এক সমগ্রবাদী ইশতেহারের! তাঁরা কবিতায় চেয়েছিলেন আতীব্র বোধের চূর্ণিত জগত, চামড়া-ছাড়ানো দগদগে আদিমতা আর রক্তের ফেনময় ঘূর্ণিনাচ! তাঁদের স্বাক্ষরিত ইশতেহারে ছিল :
১. প্রচলিত পঙ্কস্রোত থেকে মুক্তি দিতে হবে কবিতাকে।
২. কবিতার শব্দ হবে এমন, যা পাঠকের চেতনায় আছড়ে পড়বে হাতুড়ির মতো; গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেবে চৈতন্যের ইট।
৩. আমরা, এবং একমাত্র আমরাই নির্মাণ করবো শব্দের অতিব্যক্তিক সংরক্ত চরিত্র।
৪. পাঠকের জন্যে কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা হবে মৃত্যুযন্ত্রণার মতো। কবিতা শাণিত কৃপাণের মতো ঢুকে যাবে পাঠকের মনোরাজ্যে; আর পাঠক আর্ত ঘোড়ার মতো ছুটতে ছুটতে দেশকাল পেরিয়ে পৌঁছে যাবে এক আতীব্র বোধের চূর্ণিত জগতে।
৫. থুতু ছুঁড়ি তথাকথিত সুন্দর ও কুৎসিতের স্থূল কাব্যবন্দনায়। কেবল আমাদেরই অভিজ্ঞানে রয়েছে রহস্যময় সংবেদনের আবর্ত।
৬. এইমাত্র জন্মান্তর ঘটেছে প্রাজ্ঞ অশ্বত্থের, তার অনন্ত শিকড় শুষে নেবে প্রতিটি রসকুম্ভের আত্না—আর তার মহাবিস্তৃত প্রশাখার করতল অধিকার করে নেবে সমগ্র বিশ্ব এবং অবিশ্বকে।
৭. চাই চামড়া-ছাড়ানো দগদগে আদিমতা আর রক্তের ফেনময় ঘূর্ণিনাচ।
৮. ক্ষেত্রবিশেষে ব্যকরণ অগ্রাহ্য করে কবিতায় প্রয়োগ করতে হবে বিন্দুবাদী প্রক্রিয়া।
আরণ্যিক ও প্রত্নসংবেদনময় কাব্যপ্রতিবেশ
সাজ্জাদ শরিফ-এর কবিতায় বারবার উঠে আসে এক আদিম-আরণ্যিক-প্রত্নসংবেদনময় কাব্যপ্রতিবেশ! সেই সাথে ফুটে ওঠে এক মন্দ্রিত ইন্দ্রিয়আচ্ছন্নতা! এই আদিম আরণ্যিক প্রতিবেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে বহুবর্ণিল উপমা, রূপক, চিত্রকল্প:
(ক.) নির্জন তাঁবুর মধ্যে খুঁজে পাই পারদমাখানো নারীদেহ
(অধর্মবাতাস)
(খ.) কোমরে পালক গোঁজা দ্বীপবালিকারা ফেনার জোয়ারে ভাসে
(উপাখ্যান)
(গ.) টগবগে এই লাভার ওপরে/ সন্ন্যাস ভেঙে লক্ষ বছর/ ঝরাচ্ছি বীজ ঝরিয়ে চলেছি (ধর্মবনানী)
(ঘ.) জন্তুর খুরের তৃণে বিষ্ঠা ও লালায় ভরেছে সমস্ত দেহ (ডানা)
(ঙ.) দু পায়ে মাড়িয়ে লতা, বুনো ঝোপ, গুল্ম ও হাড়/ খুঁজে যাই মাংসচূড়া…(রূপকথা)
মিথ; প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কাব্যঅনুষঙ্গ
সাজ্জাদ শরিফ-এর আরেকটি কাব্যপ্রবণতা হচ্ছে মিথনির্ভরতা। পৌরাণিক উপাখ্যান তাঁর বেশ কিছু কবিতায় দেখা যায়। ছুরিচিকিৎসার ‘কথোপকথন’ কবিতাটিতে এসেছে গ্রিক পুরাণের পাতালপুরী হেডিসের কথা যার সীমানায় স্টিকস নদীর অবস্থান— গ্রিকরা যে নদীতে শপথ নিত। গ্রিক পুরাণে বর্ণিত আছে স্টিকস নদীর পানির অলৌকিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে থেটিস অ্যাকিলিসের গোড়ালি ব্যতীত সমস্ত শরীরকে অমর করেছিলেন! ‘কথোপকথন’ কবিতাটিতে এসেছে গ্রিক পুরাণের এই হেডিসের স্রোতের কথা :
‘কীভাবে এলি রে? তুই এলি কোথা হতে?’
‘ছিলাম প্রাণ নিয়ে বেঁচে বরফশিলায় বেঁধে ঘর
এসে গেছি ভেসে ভেসে হেডিসের স্রোতে।’
(কথোপকথন)
‘কথোপকথন’ কবিতাটিতে আরও রয়েছে সুন্দরী মেডুসার প্রেমগাথা। মেডুসার প্রেমে পড়েছিলেন সমুদ্রের দেবতা পোসাইডন। তাতে দেবী অ্যাথিনি ক্রোধান্বিত হয়ে তাকে অভিসম্পাত করেন। আর সেই অভিসম্পাতে মেডুসার চুল সহস্র সাপিনীতে পরিণত হয় :
‘সহস্র সাপিনী কেন চুলে, বল, তোর?’
‘প্রজার ধিক্কার সব গ্রহণ করেছি মাথা পেতে
নিলাম তাদের এই শাস্তি ঘনঘোর।’
(কথোপকথন)
কেবল পৌরাণিক উপাখ্যানই নয়; প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কাব্যঅনুষঙ্গের সম্মিলন আর পাশাপাশি লোকজ অনুষঙ্গের ঠাসবুনটও দেখা যায় তাঁর কবিতায়; যেমন মড়াটানা চৌকি, মফস্বল থেকে কলকলিয়ে আসা বেশ্যা, মাজারের মানত, বুদ্ধপূর্ণিমায় শানানো চাকু; ‘বাঙ্গালা মা’ ‘বাঙ্গালা মা’ বলে ক্রন্দনরত নীলচাষিদের আর্তনাদ :
মফস্বল থেকে কলকলিয়ে আসছে বেশ্যারা
মাজারে তাদের মানত, সন্তানভাগ্যের
যেন নিজেরই কাঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সবাই রেলিং থেকে…
আসলে মরা চোখ থেকেই ঠিকরে পড়ছে অতর্কিত দ্যুতি
যেমন হেস্টিংসের ভূত চলে যেতে
‘বাঙ্গালা মা, বাঙ্গালা মা’ কেঁদেছিল নীলকৃষকেরা
(অন্নপ্রাশন)
হাউল, হাংরি ও বিট জেনারেশন
সাজ্জাদ শরিফ-এর কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় এক ক্ষুৎকাতর প্রমত্ততা! পঞ্চাশ দশকের শেষে ক্যালিফোর্নিয়ার তরুণ কবিদের ‘বিটনিক’ আন্দোলনের পুরোহিত ছিলেন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। বিট প্রজন্মের কবিরা হাইডেগার-সার্ত্রের দর্শনে মোহগ্রস্ত ছিলেন; এরা যথার্থ পৃথিবীকে দেখেছিলেন ‘কেওস’-রূপে, এরা ছিলেন অতীত ভবিষ্যৎহীন, আত্মাহীন দেশকালের পাপে অবিশ্বাসে বিক্ষত, সমস্ত প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এদের আস্থা ছিল কেবল ‘ভায়োলেন্স’ এবং ধ্বংসে! কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘আধুনিক কবিতার ইতিহাস’-এ এদের কাব্যপ্রবণতা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এই অবক্ষয়প্রেমী ও ধ্বংসকামী কবিদের বিষয়ে গিন্সবার্গ তাঁর ‘I saw the best mind of my generation destroyed by madness, starving hysterical naked…’। ‘হাউল’-এর এই অভূত প্রমত্ততা ভর করেছিল কলকাতার ‘হাংরি জেনারেশন’ বা হাংরিয়ালিস্টদের কবিতায়—কৃত্তিবাস পত্রিকায় স্ফূরণ ঘটল এই ক্ষুধিত প্রজন্মের কবিদের! কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, মলয় রায়চৌধুরী, বিনয় মজুমদার, সমীর রায়চৌধুরী—এরা কবিতায় লিখে চললেন ‘inexorability of poetic violence’ বা ‘ক্ষুৎকাতর বুনো অসভ্য মুখোশহীন সত্য’! কবি সাজ্জাদ শরিফ-এর কবিতায়ও খুঁজে পাওয়া যায় এই ক্ষুৎকাতর প্রমত্ততা :
(ক.) ‘…দু’ফাঁক যোনির
ভেতরে সাপের মোচড়ানো লেজ,
গহ্বরে ছোটা।…’ (ছুরিচিকিৎসা)
(খ.) ঘুম থেকে স্খলিত কিরীট
ঝরে আছে পাঁচ ধাপ দূরে,
তার নিচে নিথর শরীর—(গুমঘর)
(গ.) ফের চোরাটান, মহাপ্রলয়,
মহাগ্রাস আর করাতদাঁত
নিয়ে আসে জলদানোর ভয়। (জলচর)
(ঘ.) ‘ঘুমের মধ্যে অস্ত্রোপচার—
পোড়া ছাই, ধার অস্ত্রের ফলা,
সুতো, যকৃৎ; সুনসান ফাঁকা’ (ছুরিচিকিৎসা)
(ঙ.) ‘রেশমি রুমালে আধখানা টকটকে
কম্পিত লাল হৃৎপিণ্ডের ফালি’ (রাত্রি)
শব্দসমবায়, প্রগল্ভ বাক্প্রতিমা
শব্দসমবায়—কবি সাজ্জাদ শরিফ-এর কবিতার ক্র্যাফটস্ম্যানশিপের আরেকটি দিক; একটি শব্দের সাথে আরেকটি শব্দের মেধাদীপ্ত সংযোগে নতুন আরেকটি শব্দের উন্মীলন : নিঘুমজাগর, সমাধিমহল, রাততরবারি, ভিখিরিভ্রমণ, অধর্মবাতাস, ধ্বংসলণ্ঠন, আবহবাতাস, নর্তকীমুদ্রা, মোমসমুদ্র, ধর্মবনানী, মৎসপুরাণ, স্বপ্নজাতিস্মর—এই শব্দসমবায় তাঁর কবিতায় সৃষ্টি করেছে এক প্রগল্ভ বাক্প্রতিমা!
ভিন্ন নিরীক্ষাধর্মিতা ও প্রকরণকৌশল
আবার ভিন্ন নিরীক্ষাধর্মিতাও আছে তাঁর কবিতায়; যেমন ‘ঘোড়া’ শিরোনামে এক পঙ্ক্তির একটি কবিতা ‘ঘন রাত আর শুধু ডানাহীন ওড়া’ আবার ‘বিপ্রতীপ’ শিরোনামে দু’পঙ্ক্তির একটি কবিতা ‘বিজলির ঝলকানি/ শিরায় শিরায় গাঢ় ছায়া এঁকে যায়’। ছন্দ ও আঙ্গিকের ভিন্নতায় লেখা ‘প্রতিবেশী’ কবিতাটিতে ধরা পড়েছে তন্দ্রালস এক কাব্যপ্রতিবেশ :
তুমি নর্তকীমুদ্রায়
কেন দিচ্ছ অপ্রণামি?
কেউ বুঝি না তো এই রাতে
তুমি তুমি, নাকি তুমি আমি
(প্রতিবেশী)
সাজ্জাদ শরিফ তাঁর কবিতায় উপমা বা ‘সিমিলি’র ব্যবহার করেছেন দৃশ্যকল্পের বিষ্ফার ঘটিয়ে! উপমায় মাঝে মাঝেই তিনি প্রয়োগ করেছেন ‘মতন’ বা ‘মতো’:
(ক.) মোমের মতন চাঁদ গলে পড়া মন্দির
যেন এ গর্ভ, (জঠরবন্দী)
(খ.) ছড়ানো তাসের মতো ঘুরে
ধাপে ধাপে নেমে গেছে সিঁড়ি; (গুমঘর)
(গ.) … মেঘ এসে উদরে চেপে রাখে
ধাতুর ডিমের মতো এই জতুগৃহ, (উপাখ্যান)
তবে একটি বিষয়ে সাজ্জাদ শরিফ মনে হয় কোনও নিরীক্ষাই করেননি আর তা হচ্ছে প্রেমাস্পদের জন্য তাঁর ব্যক্তিগত কাতরতা। প্রেম কোনওভাবেই তাঁর কবিতার বিষয় হয়ে ওঠেনি; মনে হয় কবিতায় হৃদয়বৃত্তির সনাতন অথচ নিরন্তর এই প্রক্রিয়াটিকে তিনি এড়িয়ে গিয়েছেন অনেকটা সচেতনে; বরং ‘অন্ধকার হলে প্রণয়ীর গলা মুচড়ে সব রক্ত শুষে নিতে হয়’—এভাবে প্রণয়ীর প্রতি এক রকম রোমহর্ষক ও স্যাডিস্ট মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়!
অনুবাদ, প্রবন্ধ, সম্পাদনা ও অন্যান্য
সাজ্জাদ শরিফের কবিতার পাঠকদের অভিযোগ তিনি খুব কম সংখ্যক কবিতা লিখেছেন! কবিতার গোলাঘরে তিনি তুলতে পারতেন আরও কিছু কাব্যশস্য! তবে খুব কম লিখেও অনেক কবি তাঁর নিজস্ব স্বর নির্মাণ করেছেন, রেখেছেন স্বতন্ত্র ছাপ। মালার্মে, হিউম—এদের কবিতার সংখ্যা খুবই কম; কিন্তু প্রভাব অতলস্পর্শী! সমর সেনের কথাও এ প্রসঙ্গে বলা যায়। সাজ্জাদ শরিফ কবিতা ছাড়াও অনুবাদ, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, সম্পাদনাসহ করেছেন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ! তাঁর অনুবাদকর্মের মধ্যে রয়েছে ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকার নির্বাচিত কবিতা রক্ত ও অশ্রুর গাথা, সোলেমান-গীতিকা, টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ড, ফ্রাঙ্ক বায়েসের কবিতা নির্ঘুম দ্বীপের পদাবলি। এছাড়াও অ্যালেন গিন্সবার্গের কবিতা, মাহমুদ দারবিশের কবিতা, বব ডিলানের কিছু গীতিকবিতার অনুবাদও করেছেন সাজ্জাদ শরিফ। কলকাতার কবি রণজিৎ দাশের সাথে যৌথ সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কবিতা। যেখানে লিবার্টি মানে স্ট্যাচু—তাঁর রাজনীতি-দর্শন বিষয়ক বই। ঈশ্বর দর্শন অবাক থেকে বাক ছাপিয়ে— সাহিত্য-শিল্পকলায় ভাষা ও চেতনার সম্পর্ক নিয়ে লেখা বই। সাজ্জাদ শরিফের নেয়া সাক্ষাৎকারের বই আলাপে ঝালাতে। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে একাধিক গ্রন্থ। এ কাজগুলোর পাশাপাশি দীর্ঘ চার দশক ধরে সাজ্জাদ শরিফ বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতির জগৎ প্রত্যক্ষ করছেন গাঢ় অভিনিবেশে!
আনন্দধারা বহিছে ভুবনে, ৬০তম জন্মদিনে প্রীতিসম্মিলনী
পুরনো ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে কবি সাজ্জাদ শরিফের জন্ম ১৯৬৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর। কবির এই ৬০তম জন্মদিনের ঠিক আগের দিন গত ২৩ সেপ্টেম্বরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনু্িষ্ঠত হয়ে গেল একটি মনোরম প্রীতিসম্মিলনী। দেশের সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, শিল্প, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতা অঙ্গনের আলোকিত ব্যক্তিত্ব ও প্রতিভাবানদের শুভেচ্ছায় সাজ্জাদ শরিফ প্রীতিসিক্ত হলেন! এ প্রীতিসম্মিলনীতে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ ও ঋদ্ধ করেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, কবিভ্রাতা কবি ফরিদ কবির, চিত্রশিল্পী দিলারা বেগম জলি, কবি শান্তনু চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম, কবিপুত্র শরণ্য শিখর। ভিডিও বার্তায় শুভেচ্ছা জানান অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কলকাতার কবি মৃদুল দাশগুপ্ত ও কবি গৌতম চৌধুরী। প্রীতিসম্মিলনীটির প্রাণবন্ত সঞ্চালনা করেন কবি জাফর আহমদ রাশেদ! কবি আলতাফ শাহনেওয়াজের গ্রন্থনায় নাসিব আহসান নির্মিত সাজ্জাদ শরিফকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি উপস্থিত সকলকে সম্মোহিত করে! ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ গানটি দিয়ে মালা পারভেজ অনুষ্ঠানটি শুরু করেন। আর ওয়ার্দা আশরাফের কণ্ঠে সাজ্জাদ শরিফ অনূদিত জোয়ান বায়েজের ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি দিয়ে এই প্রীতিসন্ধ্যাটি শেষ হয়।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক