আর্কাইভগল্প

গল্প : বিড়ালিনী : পাপড়ি রহমান

আতরজানবিবিকে আমি তুলে এনেছিলাম বটতলার মোড় থেকে। জায়গাটা ঠিক বটতলার মোড়ও নয়―সোজা চলে যাওয়া রাস্তার-ঢাল যেখানে নদীর সঙ্গে মিশেছে―ওরকম একটা জায়গা। তুরাগে তখন টানের মরশুম―জল শুকিয়ে বিশীর্ণ করে তুলেছে নদীর চেহারা। ওই ছপছপে জল-কাদার ভিতর বহু কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে নাকি হেঁটেই শুকনো মাটির সন্ধান করছিল ও। এই এক সমস্যা―বিড়ালেরা হাঁটে নাকি হামাগুড়ি দিয়ে চলে―এই ধন্দের সহসা কূলকিনারা করা যায় না। তাছাড়া কাদাজলে মাখামাখি হয়ে এতটাই কিম্ভূুতকিমাকার অবস্থা―ও যে একটা বিড়াল এটা বোঝাই মুশকিল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আমার সদা-সজাগ-কান বহু দূর হতেই আর্ত ও ক্ষীণস্বরে মিয়াঁও মিয়াঁও শুনছিল। এ দিকটা শহরতলি―চওড়া ও প্রায় যানবাহনশূন্য রাস্তায় রিক্সা চলছিল দ্রুত গতিতে। রিক্সার গতির সঙ্গে আমি পেরে না উঠলেও ছিলাম উৎসুক। এদিক-ওদিকে তাকাচ্ছিলাম ওই মিয়াঁওয়ের উৎস খুঁজে পাওয়ার জন্য। কোথায় ও ? কোথায় আছে ও এখন ? বহু বিষয়ে আনাড়ি হলেও বিড়ালদের গলার আওয়াজ আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারি। আমি জানি―বিষাদ, আনন্দ কিংবা বিপদে ওরা কখন কীরকমভাবে ডেকে ওঠে ?

বিড়াল-অভিজ্ঞতা আমার নতুন নয়। বালিকাবেলায় চিনি নামের একটা বিড়ালকে অত্যন্ত আদর-যত্নে বড় করেছিলাম। কিন্তু আমার আম্মা ছিল প্রচণ্ডরকম বিড়ালবিদ্বেষী। ফলত একদিন চিনিকে চটের বস্তায় বন্দি করে ফেলা হলো। বস্তায় বন্দি অবস্থায় ওকে নদী পার করে রেখে আসা হবে। আমি অসহায় হয়ে দেখছিলাম―সরু ও ধারালো নখগুলি দিয়ে চিনি চটের বস্তা আঁচড়াআঁচড়ি করছে। হয়তো দুনিয়া আন্ধার করে ফেলা ওই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশায় ও লড়ছিল। আমি ডাকছিলাম―‘চিনি’!

সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল―‘মিয়াঁও’।

আমার চোখ জলে ভিজে উঠছিল। আমার মনে হচ্ছিল এই ‘মিয়াঁও’ পৃথিবীর করুণতম শব্দ! কিন্তু আমার কিছুই করার ছিল না। আম্মার নিষ্ঠুরতা থেকে আমি চিনিকে উদ্ধার করতে পারলাম না। অথচ বস্তাবন্দি হয়েও চিনি অনবরত ‘মিয়াঁও’ ‘মিয়াঁও’ করে যাচ্ছিল।

আমি ভাবলাম―এই চিনি যদি বিড়াল না হয়ে বাঘ হতো ? তাহলে আম্মাই হয়তো বস্তা গায়ে দিয়ে পালিয়ে বাঁচত। ওই দিন থেকেই আমি জানি, আমার ক্ষমতা কী বা কতটুকু ? বিড়ালের মতো ছোট্ট একটা প্রাণিকে উদ্ধার করার সার্মথ্য আমার নাই―আমি আর কীসের জোরে লড়তে পারব ?

চলন্ত রিক্সায় বসেও আমি উশখুশ করছিলাম―‘মিয়াঁও’ যত সন্নিকট হচ্ছিল, আমি ততই উত্তেজনা বোধ করছিলাম। আমার পাশে বসা এখলাস জোরে ধমক দিয়ে বলল―

‘এমুন করতাছো ক্যান ? পইড়া যাইবা তো।’

আমি প্রায় পড়তে পড়তে রিক্সায় সিট ধরে নিজেকে সামলে নিলাম। যেন আদতেই পড়ে যাওয়ার মতো কোনও ঘটনাই ঘটে নাই―সেই রকম ভালোমানুষী চেহারা বানিয়ে বললাম―

‘আরে নাহ―পড়ব ক্যান ? শুনতে পাইতেছো না একটা বিড়ালের বাচ্চা আকুল হয়ে কানতেছে ?’

‘কানতেছে, না ডাকতেছে―তুমি সেইটা ক্যামনে বুঝতেছো ?’

‘আমি বুঝতে পারি―সেইটা তুমিও জানো।’

এখলাস বাম হাতের শক্ত কনুই দিয়ে আমাকে একপাশে ঠেলে বলল―

‘জানবাই তো। ওইডা তো মাইনষের বাসা না―বিলাইয়ের আখড়া। আমি ক্যামনে সহ্য কইরা থাকি ?’

এখলাস মিথ্যা কিছু বলে নাই। বালিকাবেলায় চিনিকে দ্বীপান্তরে পাঠনোর দুঃখ ভুলতে আমি আরও নয়টা বিড়ালকে পালাপোষা করছি।

এখলাস আর আমার সংসার নয়টা বিড়ালের কীর্তিকলাপে ঠাসা। তবে ওদের পালাপোষার জন্য এখলাস এক পয়সাও খরচ করে না। বিড়ালের খাওয়াদাওয়া, ভ্যাকসিন, লাইগেশন, ভ্যাসেকটমির খায়খরচা বাবদ যে টাকা লাগে, সেসব আমিই রোজগার করি।

আমার রোজগার বলতে ফুড সাপ্লাই করা। প্রতিদিন একশ জনের লাঞ্চবক্স টাইমলি পৌঁছে দেওয়া। দুইটা কাজের বুয়া সকাল থেকে বিকাল অবধি আমার এই বিজনেসে সাপোর্টার হিসেবে নিয়োজিত আছে। শুক্র আর শনিবার দুই দিন আমার বিড়াল-দিবস। এই দুই দিন আমি ক্যাটারিংয়ের সমস্ত সার্ভিস বাদ রাখি। বিড়াল লালনপালন করতে করতে এই দুইদিন ঝড়ো হাওয়ার মতো উড়ে যায়।

এখলাসের কনুইয়ের ধাক্কা খেয়ে আমি ফের পড়ে যাওয়া অবস্থার ভিতর―পতন সামলে বললাম―

‘মামা, এইখানে একটু দাড়াঁন।’

রিক্সা থেমে গেল। নাকি একটা যুদ্ধবিমান ধসে পড়তে পড়তে রানওয়ে স্পর্শ করল ? যেটাই হোক―আমি লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে পড়লাম। তারপর তড়িঘড়ি করে দৌড় দিলাম ‘মিয়াঁও’-এর উদ্দেশে। কিন্তু কাছে গিয়ে আমি নতুন করে বিভ্রান্ত হলাম। প্রাথমিকভাবে মনে হলো কাদায় মাখামাখি হয়ে কোনও মাছ আচানক জলশূন্য অবস্থায় ভিতর পতিত হয়েছে। দিক-দিশা না পেয়ে হেঁচড়ে বেড়াচ্ছে নদীর পার ধরে। কিন্তু ‘মিয়াঁও’ ডাক আসছে তাহলে কোত্থেকে ? রিক্সায় বসে থাকা এখলাস একাধারে কীসব বলে যাচ্ছে―আমি সেসব শুনতে চাই না। ওর যা ইচ্ছে বলুক। বিয়ের পাঁচ বছর ধরে এরকমই শুনছি। সারাদিনই গালিগালাজ করা ওর স্বভাব। একগ্লাস পানি ভরে খেতেও এখলাসের আলসেমি লাগে। ডাইনিং টেবিলের জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে আমাকে গালি দেয়। এমনকী সকালের চা খেয়ে খালি কাপ সিঙ্কের ওপর জোরে শব্দ করে রাখতে রাখতেও আমাকে গালি দেয়। কেন ও গালাগালি করে, কী আমার দোষ―আমি সেসবের আগামাথা খুঁজে পাই না।

কখনও মনে হয়―আমাদের কোনও সন্তান হয় নাই বলেই হয়তো ও গালাগালি করে। কিংবা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খাওয়ার পরিশ্রমটুকুর জন্য এখলাস আমাকে গালি দেয়। গালাগালির সঠিক কারণ খুঁজে না পেলেও আমি জানি―এখলাস অত্যন্ত অলস প্রকৃতির পুরুষ। সারাদিন শুয়ে-বসে, সিনেমা দেখে কাটাতে পারলেই সে প্রফুল্ল থাকে।

যে প্রাণিটিকে আমি হেঁচড়ে বেড়ানো মাছ বলে বিভ্রমে ছিলাম―ও আদতে একটা বিড়ালছানা। আমাকে দেখামাত্রই ওর মিয়াঁও মিয়াঁও আরও উচ্চকণ্ঠ হলো। আমি দেখলাম কাদার গোল্লার ভিতর হীরক খণ্ডের মতো উজ্জ্বল চোখ―যার চাহনিতে আকুতি মাখামাখি।

‘কে তুমি এমন দয়াবতী ? চলন্ত রিক্সা থামিয়ে ঝপ করে নেমে পড়লে আমাকে দেখে ? এখন আমাকে উদ্ধার করো। তোমার সঙ্গী করো।’

একটা বিড়ালকে কী করে ধরতে হয় আমি তা জানি। ঘাড়ের ওপরের চামড়াটা দুই আঙুল দিয়ে আলতো করে ধরে দুই কদম এগিয়ে গেলাম। প্রায় মরোমরো নদীর জলে ওকে ভালোমতন চুবিয়ে নিলাম। কাদামাটির প্রলেপ ধুয়ে গিয়ে বিড়ালের আসল রঙ প্রস্ফুটিত হলো। ভিজে চুপচুপে হয়ে ভেতরের গোলাপি-ত্বক দেখা যাচ্ছে। জমাট হয়ে থাকা লোমগুলি দেখে আমি বুঝতে পারলাম―ও একটা সোনালি রঙের বিড়াল। আরও বার তিনেক জলে চুবিয়ে ওকে ওড়নায় পেঁচিয়ে ঢাল বেয়ে উপরে উঠে এলাম। রিক্সায় চড়তেই এখলাস খেঁকিয়ে উঠল―

‘ফের আরেকটা বিলাই ? তুমার কি হায়ালাজ নাই ? বিলাই দেখলেই এক্কেরে বেহুঁশ হইয়া যাও কিয়েরে ?’

আমি নির্বিকার থেকে বললাম―

‘মামা―এইবার উল্টা দিকে যান। যেইখান থিকায় আসছিলাম সেইখানে যান।’

আমার কথামতো রিক্সা ঘুরতেই এখলাস জোরে চিৎকার করে উঠল―

‘এইসবের মানে কী শারমিন ? তুমার মনে যেটা ইচ্ছা হইব সেইটাই করবা নাকি ? অনেক সহ্য করছি―আর না। এইবার সবকিছুর বিহিত করমুই। তুমার আত্মীয় গো ডাইক্যা বিহিত করতে হইব।’

আমি আগের মতোই নির্বিকার থেকে বললাম―

‘হ বিহিত করো। আমি কি মানা করছি বিহিত করতে ?’

আমার বলা কথাগুলি কি জোর-বাতাসে উড়ে গেল ? এখলাসের কানে গেল কিনা বুঝতে পারলাম না। রিক্সাওয়ালা মিচকে-শয়তানের হাসি হেসে একবার পেছনে তাকাল। পরক্ষণেই মুখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। রিক্সাওয়ালা মামার পায়ে এত জোর এল কী করে ? এত জোরে প্যাডেল মারছে সে, মনে হলো আমরা উড়ে যাচ্ছি। রাস্তার দুই পারের ঘন-সবুজ আর নদীর গন্ধের ভিতর দিয়ে আমরা তির-বেগে উড়ে যাচ্ছি।

বাসায় ঢুকে আমি বিড়ালছানাটাকে নিয়েই পড়লাম। বিড়ালদের গোসল করানোর জন্য আমি আলাদা করে বাচ্চাদের বাথটাব কিনেছিলাম। ওই বাথটাব জলে পূর্ণ করে বডিওয়াশ গুলিয়ে দিলাম। ভালো মতন জল ফেনায়িত হলে ছানাটাকে ওতে ফেলে নরম-ব্রাশ দিয়ে ঘষে গোসল করিয়ে দিলাম। নরম টাওয়েল দিয়ে চেপে চেপে মুছে দিতেই ওর সোনালি-লোম চকচক করে উঠল। আমার এত সব কায়কারবারের ভিতর ওর মিয়াঁও মিয়াঁও একবারের  জন্যও থামে নাই। মোছা শেষ করে ফ্লোরম্যাটের ওপর ছেড়ে দিলাম। ও নিজ থেকেই দুই-চারবার গা ঝাড়া দিল। হয়তো আড়মোড়া ভাঙলো। মিয়াঁও ডাক বন্ধ করে আমার দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। লেজটা উঁচু করে বৃত্তাকারে ঘুরল। আমি খেয়াল করলাম লক্ষেèৗর দামি আতরের মতো ওর গায়ের বরন। বাথটাবে ঘষামাজার সময়ই দেখেছিলাম ও কন্যাশিশু। আতরজানবিবি ওর নাম।

আতরজান ও কন্যাশিশু―এই দুটো বিষয়ই আমি এখলাসের কাছে গোপন করে গেলাম। কী দরকার খামোখাই অন্যের গালাগালি শোনার ? সরল বিশ্বাস নিয়ে কাউকে কিছু বললে কত যে ঠকতে হয়―তা আমার মতো ভুক্তভুগি ছাড়া আর কে জানে ?

বিড়ালদের রাখার জন্য স্টোর রুমটাতে আমি আতরজানবিবিকে নিয়ে এলাম।

এই ঘরে আরও পাঁচটা মর্দা ও চারটা মাদী বিড়াল বসবাস করে। এরা নানা বয়সী।

আতরজানবিবির বয়সই সবচাইতে কম হবে। আগন্তুক দেখে ওই নয়টা বিড়াল দেয়াল ঘেষে লাইন করে দাড়াঁল। ফ্লোরে নাক ঠেকিয়ে গন্ধ শুঁকতে লাগল। হয়তো বোঝার চেষ্টা করল―

নতুন প্রাণিটা ওদের জন্য খতরনাক কিনা ? কমবয়সী বন্টুমিয়াকে দেখলাম সর্ন্তপণ পায়ে এগিয়ে এসে আতরজানের নাকের ওপর আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিল। আতরজান কিছুটা ভয় পেয়ে পিছু হটলো। বন্টুমিয়া লেজ খাঁড়া করে পেট দিয়ে ধাক্কা দিল আতরজানকে। আমি নিশ্চিত হলাম―আগন্তুকের সঙ্গে এদের আর মারামারির সম্ভাবনা নাই। ওই নয়জন এসে আমার পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। এতক্ষণ বাদে আমার খেয়াল হলো―

সেই কোন দুপুরে আমি ওদের খাবার দিয়ে বেরিয়েছিলাম। এতক্ষণে ওরা সকলেই ক্ষুধার্ত। আমি কোলে তুলে নিলাম আতরজানবিবিকে। মাথার ওপর মমতার আঙুলে বিলি কেটে দিলাম। ও খুশি  হয়ে চোখ বুজে ফেলল। আতরজানবিবি এখন আমার ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছে। হয়তো ভাবতে পারছে―ওর বিড়াল-জীবনে আমি আর হানিকর নই।

তুলা আর নারকেলের ছোবড়া দিয়ে বানানো গদির ওপর ঘুমন্ত আতরজানকে শুইয়ে দিলাম। নিঃশব্দে বের হয়ে এসে বাইরে থেকে টেনে দিলাম দরজা।

এখন আমার অনেক কাজ। ডিপ-ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে ডিফ্রস্ট করতে হবে। অতঃপর লবণ আর হলুদে সেদ্ধ করে ঠান্ডা করতে হবে। এরা বড়ই আদুরে প্রাণি। খাবার সামান্য গরম থাকলেও মুখে তুলবে না।

আতরজানকে খুঁজে পাওয়ার পর থেকেই আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে আছে। আজ মাছের পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়ে দিতে হবে নতুন সদস্যের জন্য। আহারে! কতদিন যেন খেতে পায় নাই বাচ্চাটা!

ফ্রিজ থেকে মাছ বের করে কলের তলায় রাখতেই চমকে উঠলাম―আমার পেছনে কীসের ছায়া ? তাকিয়ে দেখি ছায়াটায়া কিছু নয়―এখলাস দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার সমস্ত শরীর ভয়ে কেঁপে উঠল। এখলাসকে দেখলেই আজকাল আমার ভয় লাগে। কী এক অজানা আতংক আমাকে একেবারে আধমরা করে ফেলে। এখলাসকে আমার হিংস্র কোনও প্রাণি বলে মনে হয়। যেন সে এক্ষুনি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জিঘাংসা চরিতার্থ করবে। আমি ভেবে পাই না―এ কেমন দাম্পত্য ? নিজের স্বামীকে হিংস্র কোনও প্রাণি বলে ভ্রম হয় ? সঙ্গীর ভয়ে সারাক্ষণই তটস্থ হয়ে থাকা―এ কেমন জীবন ?

আর আমিও বা কেন এই জীবনে আটকা পড়ে আছি ? যাকে দেখে ভয় পাই, তার সঙ্গেই কিনা দিনরাত বসবাস করি ! সেক্সচ্যুয়েলি মিলিত হই! মানুষের মতো রহস্যময় কোনও প্রাণি হয়তো এই পৃথিবীতে আর নাই।

এখলাস আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে―আতংকে আমার হৃৎপিণ্ড দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠছে।

কিন্তু এখলাসের দৃষ্টি সিঙ্কের কলের দিকে―ঝরনাধারার মতো জল পড়ছে বরফ করে রাখা মাছের ওপর।

এখলাস হয়তো এক্ষুনি বলে বসবে―

‘কলডা খুইলা থুইছো ক্যান ? পানির বিল কত আসবে তাল নাই ? বিল কি তোমার বাপে দেয় ?’

ঠোঁট খোলার আগেই আমার মৃত বাপ এসে পড়ে। আমি কিছু বললেই বলে ওঠে―‘তোর বাপেরটা খাই ? তোর বাপে দিছে ?’ ‘তোর বাপরে গিয়া জিগায়া আয়।’

আমি বুঝি না আমার মৃত বাবার প্রতি এত আক্রোশ কেন এখলাসের ? আমার বাবা যতদিন বেঁচে ছিল―ততদিন ছিল আমার সুখের দিন। আমার পছন্দ বা অপছন্দ সবই বাবা মনে রাখত। কিন্তু দুই দশক আগে মরে যাওয়া বাবার ওপর এত রাগ কেন এই লোকের ?

আমি ভয়ে ভয়ে পেছনের দিকে সরে গিয়ে প্যাঁচ ঘুরিয়ে জলপতন বন্ধ করি।

কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার―ওয়াসার বিলের কথা না বলে এখলাস কিনা অন্য কথা বলে!

‘যেইডারে আনলা সেইটা মর্দা না মাগী ?’ বলেই অশ্লীলভাবে বাম চোখ টিপে দেয়। মুখ ফুলিয়ে ফু ফু শব্দ করে। এতে বিন্দু বিন্দু থুতু ছিটকে এসে আমার গায়ে পড়ে। যখন কোনও আদি বিষয়াদি নিয়ে এখলাস কথা বলে, তখন এরকম একটা ভঙ্গি করে। আমার তখন ইচ্ছা করে ওর গালের ওপর প্রচণ্ড একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিই। এখনও আমার সেরকম ইচ্ছা হয়। কিন্তু বরাবরের মতোই আমি স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। খানিক বাদে কিচেন থেকে বের হয়ে যেতে বলি―‘একটা লোক এত নোংরা হয় কী করে ? অবোধ-প্রাণিদের নিয়েও যে অশ্লীল ইঙ্গিত করে ?’

আমার এই কথায় এখলাসের আসল স্বভাব স্পষ্ট হয়। ও লাফ দিয়ে এসে আমার পথরোধ করে দাঁড়ায়। নাক-চোখ খিঁচিয়ে বলে―

‘কল ছাইড়া পানি ফেলতেছিস―বিলডা কি তর বাপে দ্যায় ? যত সব আজাইরা খরচ―কত মানুষ ভাত খাইতে পারে না―আর উনি কিনা বিলাই পালেন! কিছু কইনা বইল্যা মাথায় উইঠা গেছস―কাইলকাই সব কয়ডারে বাসার বাইরে তাড়ায়া দিবি।’

আতরজানবিবিকে উদ্ধার করে বাসায় আনার পর থেকেই কীসব অদ্ভুতুড়ে ঘটনা ঘটতে শুরু করল। আমার পালাপোষা আর নয়টা বিড়ালের খিদা যেন দুই গুণ বেড়ে গেলে। ওরা ক্ষুধার জ্বালায় আমাকে একেবারে জ্বালিয়ে মারতে লাগল। ক্রমাগত মিয়াঁও ডেকে পাড়া সরগরম করে তুলল। বিড়ালদের খাবার কিনতে কিনতে আমার প্রায় ফতুর হওয়ার অবস্থা। ইদানীং শরীরেও কিছুটা গড়বড় ঘটছে টের পাই। অল্প পরিশ্রম করলেই হাঁপিয়ে উঠি। ভাবলাম এই বিড়ালদের দেখভাল করেই হয়তো ক্লান্তি বোধ করছি। একদিন দাঁড়ানো অবস্থায় আমার চারপাশ অন্ধকারে ভরে উঠল। চোখের পলকে ঘরের চারটা দেয়াল পরোটার মতো ভাঁজ হয়ে আমার সামনে লুটিয়ে পড়ল। এ কী বিপদ ? এরকম ঘটনা আমার জীবনে কস্মিনকালেও ঘটে নাই। সামান্য ধাতস্থ হতেই দেখলাম―ঘরের দেয়াল যে যার জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাহলে ওরকম দৃশ্য দেখার অর্থ কী ? হতে পারে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে আমার মাথা ঘুরে উঠেছে। কয়েক দিন রেস্টে থাকলেই হয়তো এসব বিড়ম্বনা এড়ানো যাবে। কিন্তু বিষয়টা আমি যত সহজ করে ভাবলাম―সেরকম ঘটল না। বরং উল্টাটাই ঘটতে লাগল। হরহামেশাই আমি এটা-ওটাকে ভাঁজ হয়ে লুটিয়ে পড়তে দেখতে লাগলাম। যেমন শোবার ঘরের কাবার্ড, খাট, ড্রেসিং টেবিল। এমনকী একদিন ড্রেসিং টেবিলের আয়না খুলে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল আমার সম্মুখে। আর আমার শরীর আগের চাইতেও খারাপ হতে লাগল। আমি যেন হাঁটা-চলার শক্তিও হারিয়ে ফেলতে লাগলাম।

এদিকে পিরিয়ডের নির্ধারিত তারিখে সাত-আট ফোঁটা রক্ত দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল।

আমি বুঝতে পারলাম না―শরীরের অভ্যন্তরে কী এমন রদবদল হলো ? প্রতিদিনই মনে মনে ভেবে রাখি―আজ টানা ঘুম দিব। রেস্ট নেওয়া দরকার। কিন্তু ওই ভাবা পর্যন্তই―আমি ঘুমালে কাস্টমারদের খাবার কে রান্না করবে ? বিড়ালগুলো যেরকম হাভাতে হয়ে উঠেছে―একবেলা খেতে না পেলে হয়তো আমাকেই আক্রমণ করে বসতে পারে। ফলত আমি হাড়িপাতিল ভাঁজ হওয়া দেখতে দেখতে রান্না করতে লাগলাম। রান্না করে ওয়ানটাইম বক্সে ভরে ঠিকানা মোতাবেক পৌঁছানোর ব্যবস্থাও চলতে লাগল।

চোখের সামনে যখন-তখন জিনিসপত্র ভাঁজ হয়ে যাওয়া দেখার সঙ্গে নতুন উপসর্গ যুক্ত হলো। আমার দুই স্তনে চাপ-ধরা বেদনা। এমনকী কাজ করতে করতে  নিজের হাতের স্পর্শ লাগলেও আমি ব্যথায় মরে যেতে লাগলাম। এদিকে ওই সাত-আট ফোঁটা রক্ত ঝরার পর আর পিরিয়ডের দেখা নাই। সেটাও প্রায় তিন মাসের উপরে।

পাড়ার ফার্মেসিতে বসে কৃষ্ণ প্রামাণিক―সে এতদিনে আমার বেশ চেনাজানা হয়ে উঠেছে। জ্বর-মাথাব্যাথা-এসিডিটি হলে ওর ডাক্তারিতেই আমি চালিয়ে দিই। কৃষ্ণের কাছেই একবার যাব স্থির করলাম।

শুক্র আর শনিবার এই দুই দিন আমার ফুড সাপ্লাই বন্ধ থাকে। এই দুই দিন এখলাসেরও ছুটি। ও বাসায় থাকে। এখলাসের দিবানিদ্রার সুযোগ নিয়ে কৃষ্ণের ফার্মেসিতে চলে গেলাম। আমার ইদানীং যে সমস্যাগুলি হচ্ছে খুলে বললাম। সব শুনেটুনে কৃষ্ণ আমার হাতে ‘গেট শিওর’ লেখা একটা লম্বাটে প্যাকেট ধরিয়ে দিল। বাসায় এনে দেখি এটা প্রেগন্যান্সি টেস্ট করার কিট। ‘গেট শিওরের’ কথা আমার কেন মনে হয় নাই―এই ভেবে সামান্য লজ্জা বোধ করলাম। সন্ধ্যার পর এখলাস চা-নাস্তা খেয়ে টিভির সামনে দুই-পা ছড়িয়ে বসল। ‘গেট শিওর’ নিয়ে আমি ঢুকলাম বাথরুমে।

ইউরিনে ডুবিয়ে স্টিকটা আলোতে ধরতেই হতবাক হয়ে গেলাম―দুইটা লাল দাগ স্পষ্ট হয়ে ভেসে আছে!

এইটা কীভাবে সম্ভব হইল ? গত পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে একটা মাসেও পিরিয়ডের তারিখ গরমিল হয় নাই। নির্দিষ্ট তারিখের এক বা দুই দিন আগে-পরে রক্তের ঢল নেমেছে।

এত বড় সুসংবাদটা এখুনি এখলাসকে দেওয়া দরকার। বাথরুম থেকে বের হতে হতে আমার মনে পড়ল গত রাতে এখলাস বড়সড় একটা ইলিশমাছ কিনে এনেছে। মাছের টুকরাগুলি ভেজে আমি নরমাল-ফ্রিজে রেখে দিয়েছি। এখন পেঁয়াজ আর টমাটো দিয়ে রান্না করে ফেলি। এখলাস যখন রাতের খাবার খাবে―ইলিশের তেলতেলে টুকরাগুলি আনন্দ নিয়ে মুখে পুরলেই সুসংবাদটা জানাব।

ফ্রিজের দরোজাটা খুলতেই সেটা উপুড় হয়ে আমার সম্মুখে পড়ে গেল! আমি ভয় পেয়ে চোখ বুজে ফেললাম। ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখি শিরদাঁড়া সোজা রেখে ফ্রিজটা আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। ভেজে রাখা ইলিশমাছের বাটিটা বের করে কিচেনে রাখলাম। তখন দশটা বিড়াল একযোগে মিয়াঁও মিয়াঁও করে ডেকে উঠল। বিড়ালদের খাবার দেবার সময় হয়ে গেছে। আমি ফের ফ্রিজের কাছে গেলাম। ডিপ-ফ্রিজ থেকে মুরগির প্যাকেট বের করে সিঙ্কের ওপর ফেলে কল খুলে দিলাম।

দশটা বিড়াল এখন আরও জোরে চিৎকার করছে। কী হলো ওদের ? মারপিট লাগালো নাকি ? ওদের ঘরে ঢোকামাত্রই ওরা আমার পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি করতে শুরু করল। এই তিন-চার মাসে আতরজানবিবি খানিকটা যুবতী হয়ে উঠেছে। ওর বাদামি লোমগুলি থেকে যৌবন ঝরে পড়েছে। কোলে নিয়ে আমি ওর কানের কাছের মুখ নিয়ে বললাম―বিবি আতরজান―তুমি তো ভারী পয়মন্ত! আমারই ভুল হইছে―তুমার নাম আতরজান না রেখে ‘গুড নিউজ’ রাখা দরকার ছিল।

বিড়ালদের ছেড়ে এসে দেখি এখলাস তখনও টিভির পর্দায়। আমার ইচ্ছে করছে ওকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরি। বুকে মুখ ঘষে বলি―

‘আজ আমি শিওর হয়েছি’।

আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এখলাস সন্দেহ নিয়ে তাকাল। ফের টিভি পর্দায় ঢুকে পড়েই উৎকর্ণ হলো। কী যেন শোনে সে!

তারপর তড়িঘড়ি উঠে কিচেনের দিকে হাঁটা দিল। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমিও ওর পিছু নিলাম। এখলাস হঠাৎ কিচেনে যাচ্ছে কেন ? এই প্রশ্ন চারভাঁজ হয়ে আমার সামনেই লুটিয়ে পড়ল। যে দৃশ্য এখন আমাকে দেখতে হচ্ছে―তা দেখার পূর্বে আমার মৃত্যু হলে হয়তো ভালো ছিল। বিড়ালদের মহাভোজ চলছে―ইলিশ ভাজাগুলি সাবাড় করে ওরা কাঁটা চিবুচ্ছে। আমি কি ভুল দেখছি নাকি সত্যি ? সত্যমিথ্যা বোঝার আগেই এখলাস আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এলোপাথাড়ি মার চলে―শত আঘাতে জর্জরিত অবস্থার ভিতর আমি দেখি কয়েকটা বিড়াল কিচেনের ছাদে টিকটিকির মতো ঝুলে রয়েছে। ঝুলন্ত বিড়ালদের মাঝে আতরজানবিবিকেও দেখি।

কত ঘণ্টা, নাকি কত দিন, নাকি সপ্তাহ―থইথই অন্ধকারে ডুবে আছি ? আবছা-আবছা-আলো এসে পড়ছে চোখের পাতার ওপর। তলপেটে তীব্র যন্ত্রণায় আমি ছিন্নভিন্ন হয়ে আছি। ওই যন্ত্রণা আমার যোনিদেশ অবশ করে দিয়েছে। তবু আমি সেখানে উষ্ণ-তরল অনুভব করছি। বলকে বলকে রক্ত কিংবা জল কিছু একটা বের হয়ে আসছে। আমি জানি না ওই উষ্ণ-স্রোত রক্ত নাকি জলের ? এরকম আলো-আঁধারির দোলাচলে থেকেও অনুভব করছি―ছোট অথচ ধারালো দাঁত আমার পায়ের পাতা কামড়ে চলেছে। পলকা অথচ নরম কোনও প্রাণি আমার সালোয়ারের ভেজা-অংশ ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে।

ওদের মাঝ থেকে কেউ কেউ আমার তলপেট বেয়ে বুকের ওপর উঠে এসেছে। বেদনা-জর্জর স্তনবৃন্ত চুষে চলেছে।

আমি কি মরে গিয়েছি ?

অথবা আধমরা অবস্থায় বেঁচে আছি ?

আমার মাথার ভেতর নিñিদ্র-অন্ধকার।

সালোয়ারের ভেজা-অংশ কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে। উষ্ণ-তরল-পূর্ণ যোনি অনাবৃত হয়ে পড়েছে। ছোট ছোট জিভ লেহন করছে―বাধা দেয়ার ক্ষমতালুপ্ত হয়েছি আমি। এরকম সংগীন দশার মাঝে কে বা কারা এমন করছে সেটাও বুঝতে পারছি না।

এখলাস, নাকি আমার পালপোষা বিড়ালেরা ? কিংবা কোনও ক্ষুধার্ত-বাঘ―হাড়গোড় চুরচুর-হয়ে-যাওয়া যন্ত্রণার ভিতর কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না…!

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button