আর্কাইভগল্প

গল্প : সন্দেহ : হরিশংকর জলদাস

রাবণ নিহত হলো।

রাবণের স্ত্রীরা কাঁদতে কাঁদতে যুদ্ধক্ষেত্রে এল। স্ত্রীদের বিলাপ আর থামে না। প্রধান মহিষী মন্দোদরী তার বিলাপে বারবার রাবণের সীতাহরণের মতিভ্রমের কথা বলে গেল।

রাবণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হলো। রাবণের সৎকার করতে বিভীষণ প্রথমে রাজি হয়নি। পরে রামের উপদেশে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মুখাগ্নি করেছে।

এর পর বিভীষণের রাজ্যাভিষেক হলো। লঙ্কার সিংহাসনে বসল বিভীষণ। বহু আত্মীয়স্বজন আর অজস্র রাক্ষসের রক্তের বিনিময়ে এই সিংহাসনের প্রাপ্তি―মনে রাখল না বিভীষণ। সরমাকে ফিরে তো পেলই পেল, রাবণমহিষী মন্দোদরীকেও রাক্ষসপ্রথানুসারে শয্যাসঙ্গিনী করতে পারল।

চারদিকে বানরসৈন্যদের উল্লাস শোনা গেল। বানরসেনাধ্যক্ষরা একটা বিষয়ে প্রশ্নাকুল হয়ে উঠল―রাবণনিধন থেকে বিভীষণকে রাজা নির্বাচন, সবকিছু করে গেল রাম, কিন্তু সীতা সম্পর্কে একেবারে নিশ্চুপ কেন ? সীতার সঙ্গে কখন, কোথায়, কীভাবে দেখা করবে রাম ? এই প্রশ্নটি সুগ্রীব-অঙ্গদ-হনুমান প্রভৃতিকে ব্যাকুল করে তুলল।

সুগ্রীব হনুমানকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘আমাদের তুলনায় তোমার সঙ্গেই রামের সম্পর্ক গভীর। এখন তো সীতামিলনে কোনও বাধা নেই রামচন্দ্রের। সব বাধা সরে যাবার পরও এমন নিস্পৃহ কেন রাম ? জানো কিছু তুমি হনুমান ?’

হনুমানও যে এই কথাটা নিয়ে ভাবছে না, তা নয়। সুগ্রীব ও অন্যান্যের মতো সেও কোনও কিছু অনুমান করতে পারছে না। সেও বিহ্বল রামচন্দ্রের এই আচরণে। সেই কথাটাই বলল সে সুগ্রীবকে, ‘আপনার মতো আমিও কিছু আন্দাজ করতে পারছি না মহারাজ। যে সীতা মায়ের জন্য তিনি এরকম হাহাকার করলেন, রাবণকে নির্বংশ করলেন, স্বর্ণলঙ্কা ধ্বংস করলেন, সেই সীতামাকে দেখবার জন্য তেমন আগ্রহ দেখছি না কেন রামচন্দ্রের মধ্যে―বুঝতে পারছি না রাজন।’

অঙ্গদ বলল, ‘শ্রীরামকে একবার জিজ্ঞেস করলে কেমন হয় ?’

‘তা জিজ্ঞেস করা এই মুহূর্তে ঠিক হবে না। আর যদি জিজ্ঞেস করতেই হয়, পরে করলে চলবে। তার আগে তুমি এক কাজ করো হনুমান, সীতার সঙ্গে গিয়ে দেখা করো। রাবণবধের সংবাদ দাও তাঁকে।’ বলল সুগ্রীব।

হনুমান গিয়ে সীতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করল। রাবণবধের সংবাদ দিল। সীতা আনন্দাশ্রু বিসর্জন দিতে লাগল। নিজেকে সামলে সীতা জিজ্ঞেস করল, ‘আর্যপুত্রের সঙ্গে আমার কখন দেখা হবে হনুমান ? তার সঙ্গে দেখা করতে আমি যে ব্যাকুল হয়ে আছি বৎস!’

হনুমানের কাছে সীতার এ প্রশ্নের উত্তর নেই। সে সীতাকে বলে কী করে রামের নিস্পৃহতার কথা ? সীতাকে নিজের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাম যে কোনওই তোড়জোড় করছেন না, তা মুখ ফুটে কী করে বলে হনুমান!

কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে হনুমান বলল, ‘খুব শিগগির শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ ঘটবে মা।’ বলে সীতাকে প্রণাম করে বিদায় নিল হনুমান।

হনুমান রামের সামনে উপস্থিত হলো। তার কণ্ঠস্বর আবেগহীন, ‘যার জন্য এত বড় যুদ্ধ করলেন আপনি, যাকে পাবার জন্য রাবণকে বংশশূন্য করলেন, সেই সীতামাকে আর দূরে ফেলে রাখবেন না। শোকসন্তপ্তা সীতা দেবীকে আপনি এবার দর্শন দান করুন। আপনাকে দেখার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে আছেন তিনি।’

হনুমানের কথায় রামের মধ্যে কোনও আগ্রহ-উত্তেজনা দেখা গেল না। প্রথম সাক্ষাতের সময় হনুমান রামের মধ্যে যে আর্তনাদ-আগ্রহ দেখেছিল, তার ছিটেফোঁটাও রামের মধ্যে না দেখে হনুমান স্তম্ভিত হয়ে গেল।

হনুমানের কথা শুনে রাম গম্ভীর হয়ে গেল। দীর্ঘ একটা শ্বাস ত্যাগ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর হঠাৎ করেই তন্দ্রা থেকে জেগে উঠল যেন রাম।

বলল, ‘বিভীষণকে ডেকে আনো হনুমান।’

বিভীষণ এলে রামচন্দ্র বলল, ‘সীতাকে ভালো করে স্নান করিয়ে উত্তম অঙ্গরাগে সজ্জিত করে আমার সামনে নিয়ে এসো বিভীষণ।’

সীতাকে কেন ভালো করে স্নান করানোর কথা বলল রাম ? স্নানে মানুষের দেহ পবিত্র হয়। রাম কি ভেবেছে, সীতার দেহ অপবিত্র হয়ে গেছে ? কেন এই ভাবনা ?

যুদ্ধজয়ের পর রামের মন স্থিত হয়েছে। লঙ্কার সমুদ্রতীর ছেড়ে তার মন চলে গেছে অযোধ্যায়। অযোধ্যার সমাজমানুষেরা তাদের সংকীর্ণতা নিয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াতে শুরু করেছে। তাদের চোখে প্রশ্ন, তাদের তর্জনীতে প্রশ্ন―সীতা কি আদৌ সতী আছে ? পবিত্র আছে তার দেহ ? রাবণ…! না না, আর কিছু ভাবতে পারছে না রাম। এই সকল প্রশ্ন রামের মস্তিষ্কে রাবণবধের পর থেকে হুল ফুটাতে শুরু করেছে। হুলের আঘাতে রাম আর স্বচ্ছ বিশ্বাসে, সীতার অকৃত্রিম প্রেমে স্থিত থাকতে পারছে না। এই অস্থিরতা থেকে রাম বলেছে―সীতাকে ভালো করে স্নান করিয়ে…।

সীতাহরণের পর রাম মরণান্তিক যন্ত্রণায় ছটফট করেছে। অরণ্যে এসে সীতার প্রতি রামের ভালোবাসা দ্বিগুণ বেগে উছলে উঠেছে। রাবণ কর্তৃক সীতা হরিত হলে রাম প্রেমোš§ত্ত হয়ে গেছে। সেই উত্তাল প্রেম লোকনিন্দার ভয়ে এখন স্তব্ধ। রামের সামনে এখন মস্ত বড় প্রশ্ন―অযোধ্যায় ফিরলে সীতা সম্পর্কে লোকে কী বলবে ? সমাজ কী বলবে ?

বিভীষণ রামের নির্দেশে সীতাকে গিয়ে বলেছে, ‘আপনি স্নানান্তে দিব্য আবরণে-আভরণে সজ্জিত হোন। তারপর রাম সাক্ষাতে চলুন।’

বেঁকে বসল সীতা, ‘কেন আমি সজ্জিতা হয়ে আর্যপুত্রের কাছে যাব ? আমি যেমন আছি, তেমনভাবেই যাব।’

বিভীষণ সীতাকে অনেক বুঝিয়ে সজ্জিতা হতে সম্মত করাল। সীতা বিভীষণের অত্যাগ্রহে নানা ভূষণে সজ্জিতা হয়ে শিবিকারোহণ করল। সীতাসহ শিবিকা চলল রাম সন্নিধানে।

সীতার রামের কাছে আসার ঘটনার মধ্য দিয়ে সীতা জীবনের আরেকটি অধ্যায়ের সূচনা হলো। অধ্যায়টা বড় অবহেলার, বড় উপেক্ষার। সীতা জীবনের এ অংশে স্বপ্নভঙ্গের কাহিনি রচিত হয়েছে। সীতা প্রথম জীবনে রাজপুত্রী, বৈবাহিক জীবনে রাজপুত্রবধূ এবং ভবিষ্যৎ-জীবনে অযোধ্যার রাজমহিষী। তার জীবনে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা হয়তো জোটেনি, কিন্তু আদর-সোহাগ-ভালোবাসা জুটেছে অগাধ। বালিকাবয়সে পিতা-মাতার স্নেহ, বৈবাহিক জীবনে শ্বশুর-শাশুড়ির আদর এবং স্বামী সান্নিধ্যে অপার ভালোবাসা পেয়েছে সীতা। অযোধ্যার প্রাসাদাভ্যন্তে স্বামী সোহাগের মাত্রা সীমায়িত ছিল। চারদিকের নানা চোখ এড়িয়ে রাম সীতার প্রতি বন্যপ্রেম দেখাতে পারেনি। স্বামীপ্রেম দুর্বার হয়েছে অরণ্যজীবনে এসে। বনবাসকালে রাম সীতার প্রতি বাঁধভাঙা ভালোবাসা দেখিয়েছে। দিনে-রাতে, পলে-মুহূর্তে সীতা সেই প্রেমে ভেসে গেছে। দুর্মতি রাবণ হরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর সীতার প্রতি রামের ভালোবাসা প্রবলতর হয়েছে। সীতা ছাড়া রামজীবন তখন অন্ধকারে ঢেকে গেছে। প্রতি মুহূর্তে সীতার প্রতি অগাধ ভালোবাসার কথা ঘোষণা করে গেছে রাম।

অশোকবনে বন্দি জীবনযাপন করতে করতেও রামের কথা মুহূর্তকালের জন্য ভোলেনি সীতা। রাবণের মানসিক নির্যাতন, রাক্ষসীদের শারীরিক অত্যাচার শুধু রামের কথা ভেবেই সয়ে গেছে সীতা। রাবণের শত ভয় প্রদর্শনেও বিন্দুমাত্র টলেনি। বিপুল আগ্রহ নিয়ে সীতা অপেক্ষা করে থেকেছে, কখন রাবণনিধন হবে, কখন প্রিয়তম স্বামী রাম এসে তাকে সসম্মানে অশোকবন থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে।

কিন্তু কল্পিত স্বপ্ন চুরমার করে দিল রাম। রাবণ সবংশে নিহত হলো ঠিক, রাম এল না অশোকবনে। একদিন যায়, দুদিন যায়। সীতার অপেক্ষার দিন শেষ হয় না। একবেণীধারী সীতা অশোকবনে পথ চেয়ে বসে থাকে, কিন্তু রামের দর্শন মেলে না। পরে রামের পরিবর্তে হনুমান আসে, আসে বিভীষণ। রামের আদেশ শোনায় বিভীষণ―স্নান করে পরিশুদ্ধ হয়ে বসনে-ভূষণে বিভূষিতা হয়ে নাকি রামের কাছে যেতে হবে! কেন, সুসজ্জিতা হয়ে যাবে কেন সে ? তার সঙ্গে দেখা করার জন্য রাম কি রাজবেশে সুসজ্জিত হয়ে আছে ? নাই তো ? তাহলে সীতার জন্য এ আদেশ কেন ? রামবিহনে সীতাকে কী কঠোর জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে তার জীবন কী পরিমাণ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে এই বন্দিজীবনে, তা কি রাম দেখতে চায় না। মহার্ঘ ভূষণে সজ্জিত হলে তো এতদিনের নির্যাতনের চিহ্নগুলো ঢাকা পড়ে যাবে। তাই তো সীতা যেমন আছে, তেমন বেশে রামের কাছে যেতে চেয়েছে। রাম সেখানে বাধা দিল! আর সে যাবে কেন রামের কাছে ? রামেরই তো তার কাছে আসার কথা! এল না রাম। উপেক্ষা করল তাকে ? তার প্রতি উপেক্ষা দেখিয়ে কী বোঝাতে চাইছে রাম ?

শিবিকায় আসতে আসতে এরকম করেই ভেবে গেল সীতা। সীতা জানে না, তার জন্য আরও কত বড় উপেক্ষা অপেক্ষা করে আছে।

সীতা আসছে রামের কাছে―দেখবার জন্য চারপাশে লোকজন জমায়েত হয়ে গেল। দর্শকদের মধ্যে বানর-ভল্লুক জনজাতির মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে রাক্ষস জনগোষ্ঠীর মানুষ। সাধারণ রাক্ষসরা এতদিন ধরে শুনে এসেছে―এক আর্যরমণীর জন্য রাম-রাবণে যুদ্ধ লেগেছে। এক সমুদ্র রক্ত ঝরেছে এই যুদ্ধে। তারা কিন্তু সেই নারীটিকে চোখে দেখেনি। রাবণের হাতে বন্দি ছিল সেই নারীটি এতদিন। সেই সীতাকে দেখার সুযোগ এসেছে আজ তাদের হাতে। এই সুযোগ তারা হারাতে চায় না। তাই সীতা আসছে প্রকাশ্য রাজপথ বেয়ে খোলাস্থানে রামসন্নিধানে―এই কথা প্রচার হবার সঙ্গে সঙ্গে গোটা লঙ্কাপুরী ভেঙে পড়েছে বেলাভূমিতে। সীতাকে দেখতে হবে তাদের, রাম-সীতার মিলনক্ষণও তারা দু চোখ ভরে উপভোগ করতে চায়।

কিন্তু বিভীষণের পছন্দ হলো না তা। জনসাধারণের এই জমায়েত সরাতে হবে, পথের ধারের তাদের বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে হবে। ঝাঁঝরা বাজিয়ে, বেত্রাঘাত করে জনমানুষকে হঠিয়ে দেওয়ার আদেশ দিল বিভীষণ। সৈন্যরা বেত মারার কাজে লেগে গেল।

বিভীষণের এই উদ্যোগ রামের মোটেই পছন্দ হলো না। রুক্ষ কণ্ঠে বলল, ‘এটা কী হচ্ছে বিভীষণ ? আমি কি এরকম করতে বলেছি ? তুমি সাধারণ মানুষকে এরকম করে পেটানোর আদেশ দিলে কেন ? যাদের পেটাচ্ছো, তারা তো তোমারই আত্মীয়স্বজন! দর্শকদের মধ্যে রাক্ষসই তো বেশি! না না, এ ব্যাপারটা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না।’

বিভীষণ ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল, ‘সীতা দেবী আসছেন আপনার কাছে। বহুদিন পর দেখা হবে আপনাদের মধ্যে। সীতা দেবী রাজপুত্রবধূ, আপনার অর্ধাঙ্গিনী। তাঁরও তো বিশেষ একটা মর্যাদা আছে! এই বিশাল বিশৃঙ্খল জনসমক্ষে তিনি আপনার সামনে এসে দাঁড়াবেন কী করে!’

‘এটা কী বলছো তুমি বিভীষণ!’ যেন আকাশ থেকে পড়ল রাম। ‘সীতার এত আব্রুর প্রয়োজন কী ? এতদিন কি সে পর্দার অন্তরালে ছিল ? ছিল না তো ? আজ জনগণের সামনে দিয়ে আমার কাছে আসতে সীতার অসুবিধা কোথায়! আমি তো কোনও সমস্যা দেখছি না!’

হতবাক হয়ে রামের দিকে তাকিয়ে থাকল বিভীষণ। লক্ষ¥ণ-হনুমান-অঙ্গদ-সুগ্রীব-জাম্ববানরা বাক্যহারা। ওর সংবিতে ফেরার আগেই রাম গম্ভীর কণ্ঠে আদেশের সুরে বলল, ‘সীতা পালকি চড়ে আমার সম্মুখভাগ পর্যন্ত আসবে না। ওই দূরে পালকি থেকে নেমে যেতে হবে তাকে। সেখান থেকে হেঁটে আসবে আমার কাছে। বনবাসী বানরবন্ধুরা, লঙ্কাবাসী তোমার স্বজনরা চক্ষু মেলে দেখুক সীতাকে।’

‘তাতে সীতা দেবীর মর্যাদা কি ক্ষুণ্ন…।’

বিভীষণের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কর্কশ কণ্ঠে রাম বলে উঠল, ‘মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে কেন ? স্ত্রীলোক বলে কি ঘরের মধ্যে অসূর্যম্পশ্যা হয়ে থাকবে ? বস্ত্রের আবরণে অথবা প্রাচীরের অন্তরালে সারাজীবন কাটাবে ? এটা তো স্ত্রী লোকের প্রকৃত মর্যাদা নয়! স্ত্রীলোকের প্রকৃত মর্যাদা তো তার চরিত্রের পবিত্রতায়।’

দুই.

চরিত্রের পবিত্রতায়! হঠাৎ করে চরিত্রের পবিত্রতা নিয়ে কথা বললেন কেন শ্রীরাম! তাহলে কি সীতাদেবীর চরিত্র নিয়ে তার মনে কোনও সন্দেহ জেগেছে ? আর নিজে রাজপুত্র হয়ে নিজের স্ত্রী সম্পর্কে এরকম উপেক্ষার কণ্ঠে কথা বলছেন কেন রাম ? আর্যসমাজ দূরে থাক, বানর, ভল্লুক, নাগ, পক্ষী, রাক্ষস―এরকম অনার্যসমাজের রাজকন্যা, রাধবধূরাও বিশেষ শ্রদ্ধা ও সমীহের পাত্রী। এরা কখনও এরকম জনসাধারণের মধ্য দিয়ে হেঁটে যায় না। যদিও রাজকার্যের অংশ হিসেবে জনসান্নিধ্যে আসতে হয় তাদের, তখন নিরাপত্তাবাহিনী থাকে। রক্ষীরা রাজপরিবারের মানুষদের নিরাপত্তা বিধান করে। সেই প্রথা অনুসরণ করে বিভীষণও জনগণকে দূরে হঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা নিয়েছিল। হঠিয়ে দেওয়া মানে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দেওয়া। রাম সেটা করতে দিলেন না। উপরন্তু সাধারণ মানুষকে সীতার কাছাকাছি আসবার সুযোগ করে দিলেন। এতে তো যে কোনও মুহূর্তে সীতাদেবীর আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা! ওই যে রাক্ষসরা দাঁড়িয়ে আছে, সীতা দেবীকে দেখবে বলে, তাদের অনেকেই তো যুদ্ধে পিতা অথবা ভাই অথবা পুত্র বা স্বামীকে হারিয়েছে। স্বজন হারানোর ব্যথা তো তাদের বুকের তলা থেকে দূরীভূত হয়ে যায়নি! নৈকট্যের সুযোগ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাক্ষসরা সীতা দেবীকে তো আক্রমণ করতেই পারে! কারণ এই সীতাদেবীর জন্যই তো লঙ্কায় রক্তগঙ্গা বয়ে গেছে! তিনি যে কোনও মুহূর্তে তাদের হাতে নিহত হতে পারেন। এই সম্ভাবনার কথা রামের আন্দাজ করতে না পারার কথা নয়। আমি নিশ্চিত―রাম সেটা বিলক্ষণ অনুমান করেছেনও। অনুমান করে যেন তিনি সীতা দেবীকে মৃত্যুঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন ? ইচ্ছে করেই দিচ্ছেন তিনি ? স্ত্রীর মৃত্যু হলে ক্ষতি নেই তাঁর―এরকমই কি ভাবছেন তিনি ? কিন্তু কেন ভাবছেন এরকম ? তিনি কি ভেবেই নিয়েছেন―রাবণ সীতার সতীত্বে হস্তক্ষেপ করেছে ? এ যে ভুল! মস্ত বড় ভ্রান্ত ভাবনা রামের! ভাবতে ভাবতে বিভীষণ সিদ্ধান্ত নেয়―পরের ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করে যাবে।

রামের আদেশমতো দূরে, জনসাধারণের জটলার সন্নিকটে, শিবিকা থেকে অবতরণ করল সীতা। লজ্জায় মাথাটা মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চাইল তার। কিন্তু রঘুনাথকে বহুদিন পর আবার কাছে পাবে, এই উচ্ছ্বাসে সকল লজ্জা ভুলে সামনে এগিয়ে এল সীতা।

রাম তখন রাজার মতো উঁচু আসনে আসীন। তার সামনে সীতাকে সামান্য একজন কৃপাপ্রার্থী বলে মনে হলো। রাম কোথায় উচ্ছ্বাসে-আনন্দে ফেটে পড়বে, তা না। কী রকম অদ্ভুত এক চেহারা করে রাখল রাম। তার চেহারায় তখন দৈন্য আর রাগের উপস্থিতি।

রাম তখন সামাজিক ভাবনায় ব্যাকুল। এতদিন পরে গভীর অনুরক্তা স্ত্রীর সঙ্গে তার দেখা হচ্ছে, আনন্দে-উদ্বেলিত হয়ে উঠার কথা। কিন্তু রামের চেহারা বিকৃত, বিব্রত। সে এমন একটা সমাজে বাস করে, যেখানে নারীর মর্যাদা তেমন সুদৃঢ় নয়। তার সমাজে বিবাহিত বা অবিবাহিত কোনও নারী পরপুরুষের ঘরে থাকলে সেই নারীর চরিত্র নিয়ে কথা ওঠে। সবাই ওই নারীর চরিত্রে সন্দেহ করে। অযোধ্যার সমাজব্যবস্থা এই দীনতায় ক্লিষ্ট। সীতাও দীর্ঘদিন রাবণের নিবাসে ছিল। স্বাভাবিকভাবে সীতার চরিত্র নিয়েও কথা উঠবে অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে এবং আর্যসমাজে। তাদের মুখ বন্ধ করবে কীভাবে রাম ? ওদের কথা বাদ দেওয়া যাক। খোদ রামের মনেই তো এই বিশ্বাস জন্মেছে যে সীতা দুশ্চরিত্রা, রাবণ কর্তৃক ধর্ষিতা। তাই সীতার প্রতি এমন নির্বিকার রাম।

রামের এমন আচরণ লক্ষ¥ণ, হনুমান, সুগ্রীব, অঙ্গদ―কারও ভালো লাগছে না।

রাম সীতার প্রতি এমনভাবে তাকাল, যেন সীতা মস্ত বড় অপরাধ করে ফেলেছে। তার দৃষ্টিতে উৎফুল্লতার পরিবর্তে উপেক্ষা ঘৃণামিশ্রিত অবহেলার আগুনে ছাই করতে পারলেই যেন রামের সুখ!

প্রেমমিশ্রিত কোনওরূপ সম্বোধন করল না রাম সীতাকে। উপরন্তু প্রীতিহীন কণ্ঠে বলল, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে রাবণকে সবংশে ধ্বংস করে তোমাকে উদ্ধার করেছি আমি। তোমাকে অপহরণ করে রাবণ যে অপরাধ করেছিল, সেই অপরাধের কঠোর শাস্তি দিয়েছি আমি রাবণকে। আমি ঘরে না থাকা অবস্থায় রাবণ তোমার কাছে এসেছিল। নারীসুলভ উদ্বেগে তুমি লক্ষ¥ণকে কটুকাটব্য করে আমার কাছে পাঠিয়েছিলে। মস্ত বড় ভুল করেছিলে তুমি লক্ষ¥ণকে পাঠিয়ে। একাকীত্বের সুযোগ নিয়েছে রাবণ। যাক সে কথা। রাবণকে অধর্মের দণ্ড দিয়ে আমি স্বামীর দায়িত্ব পালন করেছি।’ একাক্রমে শুধু নিজের কৃতিত্বের কথাই বলে গেল রাম। সীতার প্রতি কোনও সহমর্মিতা প্রকাশ করা দূরে থাক, একবারের জন্যও জিজ্ঞেস করল না―সীতা তুমি কেমন ছিলে ? আমাকে ছাড়া তুমি দিন আর রাতগুলো পার করেছ কী করে ? এমনকি সীতার মুখের দিকে ভালো করে তাকাল না পর্যন্ত!

ওই সময়ে লোকাপবাদ রামকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। সেই লোকনিন্দার সামনে সীতাকে বড় ক্ষুদ্র মনে হতে লাগল রামের। সে দ্বিধান্বিত―সীতাকে প্রিয়া সম্বোধনে গ্রহণ করবে, না লোকাপবাদের ভয়ে সীতাকে দূরে ঠেলে দেবে। লোকনিন্দারই জয় হয়েছে শেষ পর্যন্ত। হৃদয়সর্বস্ব ধন যে সীতা, সেই সীতার প্রতি শ্রুতিকটু কথা বলতে রাম দ্বিধা করেনি।

‘রাবণ তোমাকে ধর্ষণে উদ্যত হয়েছিল। দশরথপুত্র আমি। ব্যাপারটা আমার সম্মানে লেগেছিল খুব। এক্ষেত্রে স্বামী হিসেবে আমার দায়িত্ব রাবণকে শায়েস্তা করা। বধ করেছি আমি রাবণকে।’ এই কথাগুলোই কিছুক্ষণ আগে রাম একবার বলেছে। দ্বিতীয়বার কেন বলছে, সীতা বুঝতে পারছে না। রামের দিকে বাষ্পাকুল চোখে তাকিয়ে থাকল সীতা।

রামের আরও কথা বাকি ছিল। বলল, ‘তুমি জেনে রাখো সীতা, ওই যে সমুদ্রলঙ্ঘনের মতো দুঃসাধ্য কাজ করেছি আমি, যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করেছি, তা কিন্তু তোমার জন্য করিনি।’

দাদার কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে গিয়ে লক্ষ¥ণ নিজেকে সংযত করেছে। হনুমান-সুগ্রীব-জাম্ববানের চোখে বোবাচাহনি। তারা কিছুতেই রামের এই মুহূর্তের কথার মর্মার্থ ধরতে পারছে না।

রামকে থামিয়ে দিয়ে তারা উচ্চৈঃস্বরে জিজ্ঞেস করতে চাইছে―কেন আপনি এরকম অসদাচরণ করছেন সীতা দেবীর সঙ্গে ? কিন্তু নিজেদের সংযত রাখল সবাই।

সীতার চোখ থেকে তখন অশ্রু গড়াতে শুরু করেছে। তা দেখে লক্ষ¥ণ অসংযত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠেছে, ‘তা হলে কার জন্য যুদ্ধ করেছো দাদা ? কার জন্য সোনার লঙ্কা জ্বালিয়ে দিয়েছো ? কার জন্য রাবণকে নির্বংশ করেছো ?’

লক্ষ¥ণের প্রশ্নগুলো রামের কানেই ঢুকল না। আগের মতো নিরাবেগ গলায় সীতার উদ্দেশে বলল, ‘তোমার চরিত্রের ওপর সন্দেহ জন্মেছে আমার সীতা। রাবণ তোমার দেহকে পবিত্র রাখেনি।’ হঠাৎ কণ্ঠকে আরও চড়াল রাম, ‘যাও যাও। তুমি আমার চোখের সামনে থেকে এক্ষুণি সরে যাও। তোমাকে দেখে আমার চোখ জ্বালা করছে খুব। চক্ষুরোগীর সামনে প্রদীপ জ্বালালে যেমন অস্বস্তি হয়, তোমাকেও আমার তেমন করে অসহ্য মনে হচ্ছে।’

সীতা স্তম্ভিত। হতবাক। স্তব্ধ। নিথর। পাথর যেন সে। স্রোতস্তব্ধ নদী হয়ে রামের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল সীতা। তার ভেতরের আনন্দ আবেগ দ্রুত ফুরাতে শুরু করল। রামকে মাপার তার সকল ইন্দ্রিয়যন্ত্র বিকল হয়ে গেছে। এ কোন রাম ? কী রাম ? এ রাম, না রাবণ ? এ আর্য, না রাক্ষস ? ভেবে কূল পেল না সীতা। তার হঠাৎ ঘৃণা করতে ইচ্ছে করল। রামকে ঘৃণা।

চোখ কুঁচকে রামের প্রতি তাকিয়ে থাকল সীতা। সীতা খুব লজ্জা পেতে লাগল। নিজের জন্য লজ্জা, না রামের জন্য লজ্জা ধরতে পারল না সীতা। সীতার মন বলে উঠল―এ তো লজ্জা নয় সীতা। এ তো অপমান! রাম তোমাকে উপেক্ষা করতে শুরু করেছে। রামের এই অপমান শুধু তোমার জন্য নয়, এ অপমান সমস্ত নারীজাতির জন্য।

মন যা-ই বলুক, সীতা অপমানটা বুঝছে না। বুঝছে না বলেই রামের দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সীতার মুখমণ্ডল থেকে ঘৃণাভাবটা উবে গেল। প্রণয়স্নিগ্ধতা সীতার মুখখানিকে আবার আবৃত করল। তার স্বামীর মনের মধ্যে সমাজ-রসানের বিষক্রিয়া শুরু হয়েছে ধরতে পারল না সীতা।

রাম আবার বলল, ‘যে সতীত্ব আর পাতিব্রত্য তোমার চরিত্রের অলংকার ছিল, তা রাবণের ঘরে গিয়ে তুমি হারিয়ে ফেলেছো সীতা। আমার কাছে তোমার প্রয়োজন নেই। তোমার সামনে দশটি দিকই খোলা রয়েছে। যেদিকে ইচ্ছে তোমার, চলে যাও।’

রামের কথা শুনে লক্ষ¥ণ ছটফট করতে শুরু করল। একবার দৌড়ে সীতার কাছে গেল, আরবার রামের কাছে। কই মাছে ছাই মিশিয়ে ছেড়ে দিলে, কই মাছ যেমন করে তড়পাতে থাকে, লক্ষ¥ণও সেরকম করতে থাকল। একবার মনে হলো অসিতে হাত দিলে কেমন হয় ? আবার দাদার মুখটা চিপে ধরতে ইচ্ছে করল তার। সীতার সামনে মাটিতে লুটিয়ে গড়াগড়ি যেতে ইচ্ছে করল। মাথার দু দিক থেকে দু হাত দিয়ে থাপড়াতে থাকল। আবার দু হাতের তালু দিয়ে নিজের দু’ চোখ চেপে ধরল।

লক্ষ¥ণের এই ছটফটানিকে কোনও মূল্য দিল না রাম। আরও কিছু একটা বলতে চাইল।

বিভীষণ বলে উঠল, ‘অযোধ্যায় ফিরে গেলে আপনিই রাজা হবেন শ্রীরাম। সেই রামের মুখে এ কী অশ্রবণীয় কথা! সীতা দেবীকে যা বলছেন, ভেবে বলছেন তো ? যে সীতার জন্য লক্ষ লক্ষ প্রাণ ঝরে পড়ল, সেই সীতাকে চলে যেতে বলছেন! কোথায় যাবেন তিনি ?’

রাম এবার মুখ থেকে সকল শোভনতার আড়াল সরিয়ে নিল, ‘কোথাও যাবার দরকার কী সীতার ? সামনে লক্ষ¥ণ আছে, অযোধ্যায় ভরত আছে। তুমি আছো বিভীষণ, সুগ্রীব আছে। এদের যে কোনও একজনকে বিয়ে করুক সীতা। আমার কোনও আপত্তি নেই এতে।’

রামের কথা শুনে সমগ্র বেলাভূমি নিথর হয়ে গেল। সমবেত সকল মানুষ নিস্পন্দ হয়ে গেল।

সবাই ভাবল, এ কেমন রামচন্দ্র! যে লোক-অপবাদের ভয়ে নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে এরকম করে অপমান করতে পারেন! সবাই আবার এও ভাবল, রামের এরকম মর্মান্তিক ব্যবহারের কোনও জবাব দিচ্ছেন না কেন সীতা ? তিনি কি বোবা হয়ে গেলেন ? তিনি কি ইন্দ্রিয়শক্তি হারিয়ে বসলেন ?

এই সময় সমবেত সাধারণ রাক্ষস-বানররা গর্জে উঠল, এ কেমন অপমান! এ অপমান অসহ্য! সীতার এই অপমান আমরা সহ্য করব না।

রামের কদর্য কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল, ‘এমন অসম্ভব সুন্দরী সীতা! এই সীতাকে হাতের মুঠোয় পেয়ে রাবণ ছেড়ে দিয়েছে, তা আপনারা বিশ্বাস করলেও আমি বিশ্বাস করি না। রাবণ ওকে ভোগ করেছে। ধর্ষণ করেছে।’

এই কথায় দর্শক-জনতার মধ্যে বড় একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলো। তারা রামের দিকে ছুটে আসতে চাইল। বিভীষণের অঙ্গুলি নির্দেশনায় সৈন্যরা সক্রিয় হলো। জনরোষ কিছুটা কমলেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া একেবারে বন্ধ হলো না।

এই সময় সবাই সীতার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, ‘নীচ ইতর লোকরা তাদের স্ত্রীর সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলে, সে ভাষাতেই তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছো আর্যপুত্র। হনুমানকে যখন আমার খোঁজে লঙ্কায় পাঠালে, তখন আমাকে বর্জনের কথাটি জানিয়ে দাওনি কেন ? তখনই আমি আত্মহত্যা করতাম। তখন তোমাকে সীতা-উদ্ধারের উদ্যোগ নিতে হতো না আর। আর এত শত সহস্র মানুষও নিধন হতো না।’

এরপর নিজের ভেতরটা গুছিয়ে নিল সীতা। দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘এত দিন আমার দেহটা অশোকবনে পড়েছিল, কিন্তু হৃদয়টা তোমার কাছেই ছিল। আজ সেই স্বামী অনুগত হৃদয়টাকে দুমড়ে দিলে তুমি! লোকনিন্দা তোমার কাছে বড় হলো! বংশমর্যাদার কাছে সীতার প্রেম দলিত-অপমানিত হলো!’

তিন.

যে-সীতাকে আগে কখনও দেখেনি, তার বর্ণনা শুনেছে শুধু, সেই সীতাকে দেখতে পাবার আশায় বানর-রাক্ষসরা ভিড় জমিয়েছে। সেই সীতার সতীত্ব নিয়ে রামচন্দ্র যখন প্রশ্ন তুলল, তখন সবার মনের মধ্যে ধাক্কা লাগল। তারা তো সীতার স্বামীনিষ্ঠার কথাই শুনে এসেছে এতদিন, রামকথিত নোংরা কথা তো শোনেনি কখনও!

সমবেত জনমানুষের বিশ্বাসের সামনে রামচন্দ্র যখন সীতাকে চরিত্রদূষণের অপবাদ দিচ্ছে, তখন সীতার মাটিতে মিশে যাওয়ার ইচ্ছে জাগল। রামের কথাগুলো তো শুধু শব্দ নয়, শব্দগুলো তপ্ত শলাকা হয়ে তার কানে বিঁধল। অপমানে-উপেক্ষায় তার চোখে অশ্রুর ধারাপাত বইল। এত এত মানুষের মধ্যে রাম তাকে আপন পথ দেখতে বলছে! পরপুুরুষের গললগ্ন হতে বলছে! কত আর অপমান সয়ে যাবে সীতা ?

সীতা বলল, ‘তুমি যে নোংরা ভাষায় আমার চরিত্রে দোষারোপ করে গেলে, তা তো আমি নারী বলেই করলে ? শোন আর্যপুত্র, তুমি যেমন রঘুবংশে জন্মেছো, তেমনি আমিও ইক্ষ¡াকুবংশের সন্তান। আমাকে তুমি এত হীন চোখে দেখছো কেন ? আমারও যে একটা পবিত্র চরিত্র আছে, তোমার ওপর আমার যে অগাধ ভক্তি-ভালোবাসা আছে―কোনওটারই মূল্যায়ন করলে না তুমি! এক ফুৎকারে সবটাই উড়িয়ে দিলে!’

তারপর সটান লক্ষ¥ণের দিকে ফিরল সীতা। তখনও তার দু চোখে অশ্রু ঝরছে। ওই অবস্থাতেই লক্ষ¥ণকে লক্ষ করে বলল, ‘তোমার দাদার এরকম জঘন্য মিথ্যে অপবাদ আমি আর সইতে পারছি না লক্ষ¥ণ। মিথ্যে অপবাদ মাথায় নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে চাই না। এতগুলো মানুষের সামনে আমাকে তোমার দাদা যেভাবে ত্যাগ করল, তার পর আমার বেঁচে থাকার দরকার নেই। আমি মরতে চাই লক্ষ¥ণ। আগুনে পুড়ে মরা ছাড়া আমার আর কোনও পথ নেই। তুমি চিতা সাজাও সৌমিত্র। স্বামী পরিত্যক্তা ও অপবাদগ্রস্তা আমি আগুনে প্রবেশ করব।’

সীতার কথা শুনে লক্ষ¥ণ সক্রোধে রামের দিকে তাকাল। সারা জীবন যে লক্ষ¥ণ রামের সকল কর্মকে সমর্থন করে গেছে, সেই লক্ষ¥ণ এই মুহূর্তে কোনওক্রমেই রামকে সমর্থন করছে না। সে আশা করল―সীতার আত্মহত্যার কথা শুনে রাম তার ভুল ধরতে পারবে। অনুশোচিত হয়ে পূর্বসিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। সানুনয় কণ্ঠে সীতাকে বলবে, তুমি আত্মহননের কথা বলো না সীতা। আমি তোমাকে এমনি এমনি পরীক্ষা করছিলাম। দীর্ঘদিনের অদেখায় আমার প্রতি তোমার প্রেমের কোনও ঘাটতি ঘটেছে কিনা, তা-ই পরখ করতে চেয়েছি আমি। সেই পরীক্ষায় তুমি পাস করে গেছো সীতা। আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করছি―তোমার চরিত্র পূতপবিত্র। তোমার এই শুভ্র চরিত্রের জন্য পৃথিবীর সকল মানুষ তোমার প্রশংসা করবে প্রিয়তমা।

লক্ষ¥ণের ভাবনার ধারেকাছে গেল না রাম। উপরন্তু সীতার আত্মহননের কথা শোনার পরও কীরকম মৌন হয়ে থাকল। এতে লক্ষ¥ণ আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠল। তবে যতই রেগে থাক, রামকে দু কথা শোনানোর মতো আত্মশক্তি নেই লক্ষ¥ণের। আজন্মের বাধ্যতা, সারা জীবনের আনুগত্যকে অতিক্রম করে কী করে লক্ষ¥ণ ?

রামের দিকে আবার তাকাল লক্ষ¥ণ। দেখল―রামের মুখমণ্ডল কঠিন। কোনও ভাবান্তর নেই সেখানে, কোনও অনুতাপও নেই। সেই আফসোসহীন চোখমুখ যেন বলছে―সীতা আগুনে পুড়ে মরলে আমার কী ? এই সীতার প্রয়োজন আমার জীবন থেকে ফুরিয়ে গেছে লক্ষ¥ণ। তুমি দাঁড়িয়ে থেকে আর সময়ক্ষেপণ করো না। যত শিগগির সম্ভব চিতা সাজাও।

একটা আস্ত গোঁয়ারের মতো মাথা নিচু করে থাকল রাম। রামের মৌন-সম্মতি লক্ষ করে লক্ষ¥ণ সেই দ্বিপ্রহরে সমুদ্র-উপকূলে সীতার জন্য মরণচিতা সাজাল। চারদিকে হায় হায় রব উঠল। সীতা অগ্নিপ্রবেশের জন্য প্রস্তুত হলো।

সীতা অধোমুখে-উপবিষ্ট রামকে প্রদক্ষিণ করল। চিতায় তখন দাউ দাউ আগুন।

সেই আগুনকে সাক্ষী রেখে সীতা বলল, ‘রামচন্দ্র ছাড়া অন্য কাউকে আমি যদি হৃদয় না দিয়ে থাকি, যদি আমি শুদ্ধ চরিত্রের হই, তাহলে প্রজ্বলিত এই অগ্নি আমাকে পোড়াতে পারবে না। এই আগুন থেকে আমি সশরীরে বেরিয়ে আসব।’

‘শুনুন আপনারা।’ উদ্দিষ্ট শ্রোতা সুগ্রীব-অঙ্গদ-হনুমান-জাম্ববান এবং সমবেত রাক্ষস-বানররা। ‘এই রাঘব যাকে নষ্টচরিত্রা বলছে, সেই আমার চরিত্রে কখনও কলঙ্ক স্পর্শ করেনি। সতী আমি। অপাপবিদ্ধা আমি।’ অকম্পিত কণ্ঠে বলে গেল সীতা।

তারপর নিঃশঙ্কচিত্তে আগুনে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হলো সীতা। ঠিক সেই সময়, সীতার চিতায় আত্মাহুতি দেওয়ার আগ মুহূর্তে লক্ষ কণ্ঠ একটি কণ্ঠস্বর হয়ে গর্জে উঠল, ‘না―।’ সেই যৌথ কণ্ঠস্বরে সমবেত জনতার কণ্ঠ যেমন ছিল, ছিল লক্ষ¥ণ-সুগ্রীব-হনুমান প্রভৃতির বজ্রকণ্ঠও।

শত সহস্র কণ্ঠধ্বনি আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। সম্মিলিত ধ্বনি সহস্র সহস্র বাহু বিস্তার করে আকাশের দিকে ধেয়ে গেল। এই ‘না’ ধ্বনি সমুদ্রকূলে দাঁড়িয়ে থাকা পর্বতদেহে অজস্র ‘না’ হয়ে প্রতিধ্বনি তুলল। এই ‘না’ ধ্বনিটি বাতাসে ভেসে সমুদ্র ছাড়িয়ে গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ল।

রাক্ষস-বানর-মুনি-ঋষি-গন্ধর্ব সবাই একযোগে সীতার অগ্নি প্রবেশের উদ্যোগে তীব্র-তীক্ষè কণ্ঠে একযোগে হাহাকার করে উঠল। এই হাহাকার ধ্বনি ‘না’ ধ্বনি হয়ে রামের কানে প্রচণ্ড ধাক্কা দিল। সে তার অধোবদন ওপর দিকে তুলল। দেখল, লক্ষ¥ণ ঝাঁপিয়ে পড়ে সীতাকে অগ্নিপ্রবেশ থেকে বিরত করছে।

সুতীব্র ‘না’ ধ্বনি শুনে সীতা ভেবাচেকা খেয়ে গিয়েছিল। কী হলো! হঠাৎ এরকম ইন্দ্রের বজ্রনিনাদের মতো প্রচণ্ড আওয়াজ হলো কেন ? প্রথমে ভেবে কোনও কূল পেল না সীতা। পরে বুঝতে পারল―তার আত্মাহুতির উদ্যোগে জনগণ ক্ষিপ্ত-ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। সেই ক্ষুব্ধতা ‘না’ শব্দ হয়ে তাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। একটু ইতস্তত করল সীতা। তারপর চিতার দিকে বাম পা-টা এগিয়ে দিল।

ঠিক ওই সময়, সীতার মরণ-উদ্যোগের সময়টিতে লক্ষ¥ণ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। এক লাফে সীতার আর চিতার মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। তার গায়ে চিতার তীব্র আগুনের আঁচ লাগছে তখন। লক্ষ¥ণের সেদিকে খেয়াল নেই। ঝুপ করে সীতার পা দুটো ঝাপটে ধরেছে লক্ষ¥ণ।

‘না, না বউদি। তুমি কিছুতেই আগুনে ঝাঁপ দিতে পারো না। দাদা তোমাকে মরতে প্ররোচিত করতে পারে, আমি তোমাকে মরতে দিতে পারি না।’ কাঁদতে কাঁদতে বলে গেল লক্ষ¥ণ।

সীতা শান্ত সমাহিত গলায় বলল, ‘আমার পা দুটো ছাড় লক্ষ¥ণ। আমাকে মরতে দাও।’

লক্ষ¥ণ বলল, ‘তুমি মরলে আমি মা কৌশল্যাকে কী জবাব দেব ? মা সুমিত্রাকে কী কৈফিয়ত দেব ? মা সুমিত্রা বনবাসে আসার সময় আমাকে বলেছিল, লক্ষ¥ণ রে, আমাকে যে-চোখে দেখিস তুই, যেমন করে যত্ন নিস, শ্রদ্ধা করিস, ঠিক তেমন করেই সীতাকে শ্রদ্ধা করবি, যত্ন নিবি। তুমি যদি বউদি আগুনে আত্মহত্যা করো, আমার মা যে সারা জীবন আমার মুখ দেখবে না! তুমি তোমার শাশুড়িদের কথা স্মরণ করে দাদা রামকে ক্ষমা করে দাও। আমাকে ক্ষমা করে দাও বউদি, আমাকে ক্ষমা…।’ কথা শেষ করতে পারল না লক্ষ¥ণ। কাঁদতে কাঁদতে সীতার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল। সমবেত জনসাধারণকে সৈন্যরা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। সৈন্যদের ঘের ভেঙে বন্যার জলের মতো সবাই সীতা-সন্নিকটে চলে এসেছে। সবাই চিৎকার করে বলছে, ‘তুমি রামকে ক্ষমা করে দাও মা। তুমি যথার্থ একজন সতী। সতীরাই পারে শুধু এরকম করে আত্মাহুতি দিতে।’

সীতা দু কদম পিছিয়ে এল। ততক্ষণে চিতার আগুন বানর-রাক্ষসরা মিলে নিবিয়ে ফেলেছে।

রাম নির্বিকার চোখে সব ঘটনা দেখে গেল। কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না তার চোখেমুখে।

রামের পাশে সুষেণ বসেছিল। বানর সমাজের সবচাইতে বিজ্ঞ, সবচাইতে বয়স্ক ব্যক্তি সে। যুদ্ধক্ষেত্রে সে অসাধারণ অবদান রেখেছে। আহত যোদ্ধাদের চিকিৎসা করেছে। মুমুর্ষু যোদ্ধাকে ঔষধিগুণে মৃত্যু থেকে বাঁচিয়ে তুলেছে। তারই চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে হাজার হাজার আহত বানর পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যেতে পেরেছে। তার সবচাইতে বড় অবদান―রাবণের শক্তিশেলের আঘাত থেকে লক্ষ¥ণকে বাঁচিয়ে তোলা। এসব কারণে রামের কাছে সুষেণ অত্যন্ত সমীহের পাত্র।

রামকে লক্ষ করে সুষেণ কঠিন কণ্ঠে বলল, ‘কী দেখলেন আপনি রামচন্দ্র ? দেখলেন তো আপনার দৃষ্টিতে অসতী বউয়ের কাণ্ড! যদি সীতা দেবী অসতী হতেন, তার শরীরে যদি পাপস্পর্শ করত, তিনি কখনও অগ্নিতে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হতেন না। জীবনে অনেক নারী দেখেছি আমি। সীতা দেবীর মতো স্বামীপরায়ণ কোনও নারী আমি দেখিনি। তিনি পুণ্যবতী নারী। পবিত্রতা তাকে ঘিরে রেখেছে―এই কথাটা ভুলবেন না কখনও।’ রামচন্দ্র কিছু একটা বলতে চাইল।

সুষেণ তাকে থামিয়ে দিল, ‘অনেক বলেছেন আপনি এতক্ষণ ধরে। চুপচাপ শুনে গেছি সব। এখন আপনার শোনার পালা। সীতাদেবীর চরিত্র নিয়ে আপনি আর একটি কথাও বলবেন না। শুধু তাকে মাথায় তুলে অযোধ্যায় রওনা দিন। সেখানে সীতা দেবীর অপেক্ষায় আছে গোটা রাজপ্রাসাদ। মনে রাখবেন, সীতা দেবী রাজৈশ্বর্য হেলায় ত্যাগ করে আপনার সঙ্গে এসেছিলেন বলেই আপনার অরণ্যজীবন মধুময় হয়ে উঠেছিল।’ এতটুকু বলে বৃদ্ধ সুষেণ হাঁপাতে শুরু করলেন।

রাম কী বলে, শুনবার জন্য সবাই উৎসুক চোখে রামের দিকে তাকিয়ে থাকল।

রাম আমতা আমতা করে বলল, ‘সীতার চরিত্র যে পবিত্র আছে এবং সে যে হৃদয়ে আমাকে ছাড়া আর কাউকে স্থান দেয়নি, তা ভালো করেই জানি আমি।’

বিভীষণ বলে উঠল, ‘ভালো করেই জানতেন! তাহলে ভালো করে জেনেও সীতা দেবীর ওপর এরকম নিষ্ঠুর আচরণ করলেন কেন ?’

রাম বলল, ‘আমি যদি এতকাল রাবণের ঘরে থাকা সীতার সতীত্বের পরীক্ষা না নিয়ে তাকে ঘরে তুলতাম, তাহলে লোকে আমাকে ছাড়ত না। বলত, দশরথের এই ছেলেটি মূর্খ এবং কামুক।’

‘কেন ? কেন আপনাকে মূর্খ এবং কামুক বলত মানুষে ?’ প্রশ্ন না করে থাকতে পারল না বানরাধিপতি সুগ্রীব।

রাম বলল, ‘প্রথমে বলত, রামের কোনও বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই। কোনও যুবতী অন্যের হস্তগত হলে অক্ষত থাকে নাকি! কোনও যাচাই-পরীক্ষা না করে সীতাকে গ্রহণ করে বসেছে রাম! মূর্খ ছাড়া কে করে এরকম কাজ ?’

‘আর ?’ বলল সুগ্রীব।

‘আর কামুক এজন্য যে, স্ত্রীকে ফিরে পেলেই হলো, সে সতীসাধ্বী কিনা বিচার করল না রাম! কামাসক্ত বলেই এরকম করেছে সে। তাই বিনা পরীক্ষায় সীতাকে ঘরে তুলতে চাইনি আমি।’ সাফাই গাইতে রামের গলা কাঁপল না একটুও।

এই কথাগুলো সীতাকে চিতার দিকে ঠেলে দেওয়ার আগে বলেনি রাম। সীতার সামনে কণ্ঠকেও কোমল করেনি। যদি করত, তাহলে সীতা মৃত্যুতেও সুখ পেত। এখন জীবিত থেকেও মৃত্যুর স্বাদ তিলে তিলে পেতে থাকল সীতা।

পুরুষের চিরকালীন চারিত্র―সন্দেহ। জোর করে একজন দুর্বৃত্ত একজন নারীকে ধরে নিয়ে গেছে। অতএব সেই নারী দূষিত এবং পতিত। রামও সে চরিত্রদোষ থেকে মুক্ত নয়। সীতা যতই বলুক না কেন, রাবণ তাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে, নারী বলে শারীরিক দুর্বলতার কারণে রাবণকে বাধা দিতে পারেনি, কিন্তু তার দৈহিক পবিত্রতা শত নির্যাতনের পরও রক্ষা করেছে সীতা, বিশ্বাস করেনি রাম।

রাম আর সীতার দাম্পত্যজীবনে সন্দেহ নামক এই যে বিষবৃক্ষটি রোপিত হয়েছিল, সীতার মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তা আর উৎপাটিত হয়নি।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button