আর্কাইভগল্প

গল্প : করোনাকাল : ইশরাত শিউলি

দুদিন যাবত খুশখুসে কাশি হচ্ছে রাহেলার, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে কাশি আটকে রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু কাশির সঙ্গে পেরে উঠছে না কিছুতেই। মাঝে মাঝে বেগ এতটা বেড়ে যায়, মুখের ভেতর কাপড় গুঁজেও লাভ হয় না! কী যে যন্ত্রণা হলো! পাশের ঘর থেকে ছেলে ছেলের বউয়েরা কাশির শব্দ শুনলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, চায়না দেশ থেকে নাকি কী একটা রোগ সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে! ঠান্ডা জ্বর হাঁচি কাশি হলেই মানুষ মরে যায়! ছোঁয়াচে রোগ, একজন থেকে আরেকজনে ঢুকে যায়। এ রোগের কোনও ঔষধ নাই! রাহেলা খাতুন যেখানে থাকে সেটাকে ঠিক ঘর বলা চলে না, একচিলতে বারান্দায় চকি ফেলে দেওয়া হয়েছে, অপরদিকে ছোট্ট একটা প্লাস্টিকের র‌্যাক তার মধ্যে কাপড়চোপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা আছে, ঝড় বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে বারান্দার চতুর্দিক কাঠ ও ভাঙ্গা টিন দিয়ে আটকে দিয়েছে, যার ফলে প্রাকৃতিক হাওয়া ঢুকতে পারে না! মাথার ওপরে একটা খাঁচা লাগানো ফ্যান, সুইচ দিলেই ঘড়ঘড় আওয়াজ করে! ফ্যানের শব্দে ঘুম আসে না, বড় ছেলেকে অনেকবার বলেও লাভ হয়নি! তিন বেডরুমের একতলা বাড়ি, সামনে বসার আর খাওয়ার রুম, জায়গাটা তার স্বামীর ভিটাবাড়ি, আগে টিনের ঘর ছিল, কয়েক বছর হলো ছেলেরা বিল্ডিং করেছে চারতলা ফাউন্ডেশন। রাহেলা খাতুনের চার ছেলে মেয়ে, দুই মেয়ে শশুরবাড়ি ঘর-সংসার করছে, বড় মেয়ের আর্থিক অবস্থা বেশি ভালো না, জামাই ছোটখাটো ব্যবসা করত, একবার চালানে লস করায় অভাবে পড়ে গেছে! ছোট মেয়ের অবস্থা মাশাল্লাহ ভালো, জামাই বড় চাকরি করে, আবার পারিবারিক ব্যবসায় আছে, বেশ সচ্ছল পরিবার, দুই ছেলের মধ্যে বড়জন দলিল লেখক, আয়-রোজগার ভালোই, ছোট ছেলে উকিল তার অবস্থাও রমরমা! বড় মেয়ে মাঝে মধ্যে ভাইদের কাছে এসে টাকা-পয়সা নিয়ে যায়, তখন তার কাছে এসে সুখ দুঃখের কথা বলে, মায়ের টুকটাক সেবাযত্ন করে, মায়ের কষ্ট দেখে মেজাজ খারাপ হলেও ভাইদের কিছু বলতে পারে না, রাহেলা খাতুনের হাতে যখন যা টাকাপয়সা থাকে বড় মেয়েকে দিয়ে দেয়!

ছোট মেয়েও ভাইদের কাছে আসে ভাবিদের সঙ্গে গল্পগুজব করে, তার দিকে খুব একটা আসে না, তিনি ওদিকটায় গেলে দেখা হয়ে যায়! ছোট মেয়ের মায়ের প্রতি তেমন টান নেই। তবে মাঝেমধ্যে কিছু টাকাপয়সা হাতে ধরিয়ে দেয়, কথাবার্তা খুব একটা বলে না। তার চলনেবলনে অহংকার ঝরে ঝরে পড়ে!

ছোট বোনের জন্য ভাইদের মমতাটা একটু বেশি, সে বেড়াতে এলে বাড়িতে ভালোমন্দ রান্নাবান্না হয়, ভাবিরা তাকে এটা সেটা উপহার দেয় গল্পগুজব করে, বাড়িটা আনন্দে ঝলমল করে!

রাহেলার আবার কাশি আসছে, গা-টাও গরম, একটু গরম পানি খেলে হয়তো কাশিটা কমত!

ওদিকটায় যেতেই ভয় করছে, ছোট ছোট নাতি-নাতনিরা আছে, যদি তাকে বিদেশি রোগটা ধরে থাকে! তাহলে তো ওদের সামনে যাওয়া ঠিক হবে না, রোগটা তো নাকি ছোঁয়াচে!

কাশির দমক বেড়েই যাচ্ছে, সঙ্গে হাঁচি, আল্লাহ মাফ কর, নাক মুখে কাপড় বেঁধে রান্নাঘরে আসলে কলের নিচে পাতিল রাখতে গিয়ে শব্দ হলো, সঙ্গে সঙ্গে রাহেলার বুকটা কেঁপে উঠল এখন যদি তাকে কেউ রান্নাঘরে দ্যাখে নির্ঘাত ধমক খেতে হবে!

রাহেলা চোরের মতো উঁকি দিয়ে দেখে নিল কেউ এদিকে আসে কি না, নাহ দুপুরে খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমাচ্ছে, অন্যসময় দুপুর বেলা ছেলেরা বড় একটা বাসায় থাকে না, কয়দিন যাবৎ দুই ছেলের কেউ বাসা থেকে বের হচ্ছে না। অফিস-আদালত সব বন্ধ, সরকার হুকুম জারি করেছে, বাইরে বেরোনো নিষেধ, সবাইকে ঘরে থাকতে হবে!

ঘরবন্দি হওয়ার আগে দুই ছেলে মিলে বছরের বাজার-সদাই একবারে করে রেখেছে। স্টোর রুম বোঝাই জিনিসপত্র!

গরম পানিটা মগে ঢেলে পেছন ফিরতেই দেখল বড় বৌমা যমের মতো সামনে দাঁড়িয়ে আছে! তাকে দেখে হাত কাঁপুনির চোটে মগটা পড়ে গেল। ফুটানো গরম পানি পায়ে পড়ে পাটা পুড়ে গেছে। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে কিছু একটা বলতে নিচ্ছিল মুখে আঁচল গোঁজার কারণে শোনা যাচ্ছিল না! বড় বউমা ঝাঁঝিয়ে উঠল, কী করেন আম্মা ? রাহেলা নির্বাক, উত্তর না পেয়ে বড় বউ আরও জোরে খ্যাজব্যাজিয়ে উঠল, কথা কন না ক্যান ? আবার চুরি কইরা ভাত খাইলেন! আপনেরে না কতক্ষণ আগে থাল ভইরা ভাত দিলাম! প্যাটে কি রাক্ষস ঢুকছে! হ্যাহ্ কি জিগাই উত্তর দ্যান না ক্যান! আকালের সময় মানুষ বুইঝা শুইনা হিসাব কইরা চলে, কয়দিন পর তো দুর্ভিক্ষ লাগব তখন খাইবেন কি ? এখন চৌদ্দবার খাওন লাগে! বড় বৌমার গালি খেতে খেতে মেঝেটা মুছে, দৌড়ে বারান্দায় চলে আসল। গলার মধ্যে প্রচণ্ড ব্যাথা, কে যেন গলার ভেতর হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে, পায়ের পোড়া জায়গাটা জ্বালা করছে, একটু পেস্ট দিতে পারলে হতো! ইশ পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে, সে বিড়বিড় করে বলছে আল্লাহ মাফি আল্লাহ সাফি হে আল্লা তুমি মরণ দ্যাও ভোগাইওনা, আল্লাহ মাফি আল্লা সাফি!

সে চৌকির উপর শুয়ে পড়ল। এখন আর কাশি আসছে না, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে! তার কোনও অনুভূতি কাজ করছে না, অচেতন অবস্থায় বিছানায় পড়ে রইল!

তার যখন জ্ঞান ফিরেছে চারদিক অন্ধকার, শরীর ঘামে ভিজে ল্যাতল্যাতে হয়ে গেছে! প্রচণ্ড পানির পিপাসা, গলাটা কি ফুলে গেছে ? মনে হচ্ছে বিছায় কামড়াচ্ছে, গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না, আল্লা মাফ কর! আল্লাহ আমি তোমার পাপি বান্দা, আমারে সাজা দ্যাও সাজা দ্যাও বিড়বিড় করতে করতে আবার জ্ঞান হারাল!

স্বামী মরেছে বিশ বছর, সন্তানদের বুকে নিয়ে এতটা বছর কাটিয়ে দিয়েছে রাহেলা। ওদের বাপ যখন মারা গেল রাহেলার বয়স তখন তিরিশ ছুঁই ছুঁই। আত্মীয়স্বজনরা আবার বিয়ে দেয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল রাহেলার এক কথা আমি বিয়া বইলে আমার পোলাপানগো কে দেখব ? আমি বিয়া বসব না! তার এই সিদ্ধান্তে ভাইয়েরা বিরক্ত হয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তাদের ভয়, বোন যদি বাচ্চা-কাচ্চাসহ বাড়িতে এসে ওঠে এদের দায়িত্ব নিতে হবে, তার চাইতে যোগাযোগ না রাখলেই অহেতুক দায়িত্ব থেকে পার পাওয়া যাবে।

রাহেলা সব বোঝে, তাই তো হন্যে হয়ে কাজ খোঁজে।

ছেলেমেয়েরা ছোট ছোট। সবাই স্কুলে পড়াশোনা করে। সে নিজে বেশিদূর লেখাপড়া করতে পারেনি। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় বিয়ে দিয়ে দেয় তারপর সংসারে ঢুকে…

প্রথমে কিছু দিন মেসে রান্না করে ছেলেমেয়েদের নিয়ে পেট চালায়। আত্মীয়স্বজনরা চারদিক থেকে ছিছি করতে থাকে। মা বাবা তখনও বেঁচে ছিলেন, তারা বৃদ্ধ মানুষ ছেলেদের সংসারে তারাও বোঝা, মেয়ের জন্য চোখের পানি ফেলা ছাড়া কিছু করতে পারে না! ভাইয়েরা পরিচয় দেয় না। চার সন্তান নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটে রাহেলার!

এর মধ্যে মেসের একজন সদস্যর সহযোগিতায় মেলামাইন কোম্পানিতে চাকরি পায় রাহেলা খাতুন।

পাঁচ কাঠা জমির ওপর স্বামীর রেখে যাওয়া ভিটায় টিনের চৌচালাঘর, ঘরের চারপাশের জমিতে আরও কয়েকটি ঘর তুলে ভাড়া দেয়। জেলা শহর, মেইন রোডের পাশেই বাড়িটি, ভাড়াটিয়া পেতে অসুবিধা হয় না, এভাবে চলতে চলতে জীবন এগিয়ে চলে।

বড় ছেলে মইনুদ্দিন ম্যাট্রিক পাস করে, সে একজন দলিল লেখকের সহকারী হিসেবে কাজে জয়েন করেছে যা আয় করে মায়ের হাতে তুলে দেয়। রাহেলার ইচ্ছে ছিল ছেলে পড়াশোনাটা করুক কিন্তু ছেলের পড়াশোনার চাইতে আয়রোজগারের প্রতি ঝোঁক বেশি।

ছোট ছেলে রহমত লেখাপড়ায় ভালো স্বভাবের, বেশ চালাক চতুর, সে বি এ পাস করে ওকালতি পড়বে বলে স্থির করে। দুই মেয়ে লতা আর পাতা পড়ালেখায় মোটামুটি, লতা কলেজে উঠেতেই বিয়ের সম্বন্ধ আসতে থাকে, তার গায়ের রংটা একটু চাপা তাই তাকে নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা ছিল, মোটামুটি ভালো ঘরের প্রস্তাব আসতেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ছেলে ছোটখাটো ব্যবসা করে, পরিবারে বাবা-মা আর এক বোন, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার!

ছোট মেয়ে পাতার চেহারা-সুরত ভালো, গায়ের রংটা উজ্জ্বল-স্বভাবেও চটপটা। এখনও ছোট তবে অনেক ভালো ভালো পরিবার থেকে সম্বন্ধ আসতে শুরু করেছে, ভাইদের মনমতো হচ্ছে না বলে অপেক্ষা করছে সুন্দরী বোনের জন্য উপযুক্ত পাত্র হতে হবে তো!

এদিকে মইনুদ্দিনের বিয়ের বয়স পার হয় যাচ্ছে। মা বড় ছেলের বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, সখিপুরে ভালো একটা মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে, মেয়ে উচা লম্বা দেখতে শুনতেও ভালো!

সাত পাড়া দাওয়াত দিয়ে ঘটা করে বড় ছেলের বিয়ে দিল রাহেলা খাতুন। বউটা শুরুতে খারাপ ছিল না, ঘরের কাজ করত শাশুড়ির ভালোমন্দ খোঁজখবর নিত কিন্তু সমস্যা বাঁধাল নিজের পেটের সন্তান!

ছেলে এতটাই বউপাগলা হয়ে গেল, বউকে ঘর থেকে বেরুতে দেয় না, ঘরের কাজ করতে নিষেধ করে, রান্না করলে বউয়ের নাজুক শরীর আগুনে ঝলসে কালো হয়ে যাবে না! রান্ধন ঘরে যাওয়া বারণ। কাজেই ঘরের সব কাজ রাহেলাকেই করতে হয়, রেঁধেবেড়ে ছেলের ঘরে খাবার দিয়ে আসে!

ছোট মেয়ে তো কুটোটি নাড়ে না তাকে কিছু বল্লে ভাইরা রাগ করে। খাটুনিতে তার কষ্ট নাই, এতকাল তো সে ঘরে বাইরে একসাঙ্গে সামলেছে! বড় মেয়েটা অবশ্য তাকে কাজে অনেক সাহায্য করত! যাক এখন তো চাকরি করতে হয় না, শুধু ঘরের কাজ টুকুতো তা সে এক হাতে সামলে নিতে পারবে!

আল্লাহর রহমতে দুই ছেলের আয়-রোজগার ভালোই, সংসারটা সচ্ছল ভাবে চলছে।

ভাইদের পছন্দমতো ছোট বোনকে পাত্রস্থ করল!

ছোট ছেলে নিজের পছন্দমতো বউ নিয়ে আসল!

টিনের ঘরের জায়গায় বিল্ডিং উঠল, তিন বেডের বাসা, দুই ছেলের দুইরুম। প্রথম দিকে তাকেও থাকার জন্য একটি ঘর দেওয়া হয়ছিল। নাতি-নাতনিদের জন্মের পর তাকে বারান্দায় থাকতে দেওয়া হয়েছে। বাচ্চাদের খেলাধুলার জন্য আলাদা ঘর দরকার। তাছাড়া মেহমান এলেও তো একটা রুমের দরকার হয়!

বোনেরা জামাই নিয়ে আসে, দুই ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ির মেহমান আছে, একটা রুম তো অতিরিক্ত লাগেই!

ধীরে ধীরে দুই বউ সংসারের দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে। রাহেলাকে আর সংসারের কিছু নিয়ে ভাবতে হয় না।

সমস্যা হলো সবাই ভুলে যায় সংসারে তার মতো একজন মানুষ আছে!

খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নাই, বউদের মন চাইলে দেয় না হলে না খেয়ে থাকতে হয়, নিজের হাতে নিয়ে খেতে গেলে কথা শুনতে হয়―এইসব যন্ত্রণা আর ভালো লাগে না!

মাঝে মাঝে মনে হয় কোথাও চলে যাওয়া যেত!

দূরে কোথাও কেউ খুঁজে পাবে না!

সকালবেলা নাস্তা দিতে এসে ছোটবউ দেখে শাশুড়ি মার চোখ বন্ধ, কোকাচ্ছে। রাতে দেওয়া খাবারের প্লেট সেভাবেই পড়ে আছে, বুড়ি মরে যায়নি তো!

কাছে গিয়ে ডাক দেয় আম্মা আম্মা, রাহেলা চোখ মেলে তাকায়, বিড়বিড় করে বলে, পানি পানি খামু পানি দেও। কী হইছে আপনার! জ্বর! শোনা মাত্র ছোট বউ ছিটকে সরে যায়, সর্বনাশ বলে কি, চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তোলে―আম্মারে করোনায় ধরছে। তোমরা কই, ঘরে করোনা ভাইরাস ঢুকছে, হায় আল্লা এখন কী হবে গো!

তার চিৎকারে সবাই চলে আসে, সে একনাগাড়ে চিল্লিয়ে যাচ্ছে―

ছোট ছেলে রহমত ধমক লাগায়, থামো কী হইছে বুঝায়ে বলো। স্বামীর ধমক খেয়ে ধাতস্থ হয় সে, তোমার মারে করোনায় ধরছে! সারা বাড়িতে করোনার ভাইরাস কিলবিল করতেছে এখন আমাদের কী হবে গো ?

কেমনে বুঝলা মারে করোনায় ধরছে!

তোমার মার জ্বর, মাঝে মধ্যে কাশির শব্দ শুনছিলাম! মইনুদ্দিন বলে ঘটনা যদি সত্য হয় তাইলে তো ব্যবস্থা করতে হবে! কী করা যায় এখন! বড় বউ বলে, কী করবা আবার, হাসপাতালে ফালায়া আসো, মঈনুদ্দিন আবার বলে―না! হাসপাতালে নিলে সমস্যা আছে। এমন কিছু করতে হবে যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙ্গে!

ছোট ভাই লতাকে ফোন করে, ‘সর্বনাশ হইছে বইন, মারে তো করোনা ধরছে, কী করি ক এখন ?’

আমি তো ভাই আসতে পারব না, লকডাউন, তোমরা যা ভালো হয় করো। পাতাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। চারজনে মিলে পরামর্শ করে। তারপর সিদ্ধান্তে আসে, সিদ্ধান্ত যা হলো এর চাইতে ভালো কিছু এই মুহূর্তে মাথায় আসছে না। যাই হোক মাকে নিয়ে বেরোতে হলে একটা গাড়ির প্রয়োজন। করোনার কথা শুনলে গাড়ি পাওয়া যাবে না। কী করা যায় এখন ?

মাকে বোনের বাসায় দিতে যাবে বলে গাড়ি ভাড়া করে, বোনের বাচ্চাটা কান্নাকাটি করতেছে, লকডাউনের মধ্যে বাচ্চারা ঘরে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে। এখন নানি ছাড়া কেউ কান্দন থামাতে পারবে না, কী আর করা বাধ্য হয়ে লকডাউনের মধ্য বেরুতে হলো…

দুই ভাই মাস্ক লাগিয়ে গ্লাভস পরে মাকে নিয়ে গাড়িতে ওঠে। এর মাঝে মঈনুদ্দিনের মোবাইলে ছোট বোনের ফোন আসে, সে বলে ভাই ভাবিদের কাছে সব শুনলাম, তোমরা যে সিদ্ধান্ত নিছো আমি তাতে একমত। ভালোমতো কাজটা সেরে আসো, দোয়া রইল।

গাড়ি ছুটছে শালবনের পাশ দিয়ে, একটু জঙ্গলমতো জায়গায় আসতেই ছোট ছেলে বলে থামেন ভাই, ঐ সামনেই বোনের বাসা আমরা মাকে দিয়াই ফিরে আসতেছি একটু বসেন। ঘন বনের ভেতর ঢুকে ছোট ছেলে মাকে বলে… মা গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে বুজছো, তুমি এইখানে একটু বসো গাড়িটা ঠিক হইলেই তোমারে আমরা নিয়া যামু!

মা মাথা দুলিয়ে সায় দেয়। তার কথা বলার মতো শক্তি নেই, প্রচণ্ড পানির পিপাসা, ছেলেদের কাছে পানি চাইতে সাহস হয় না। কাল রাত থেকে পেটে দানাপানি পড়েনি, খিদেটাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে! পায়ের পোড়া জায়গাটা ঘায়ে দগদগ করছে। তাতে অসম্ভব জ্বলা করছে। সেখানে মাছি ভ্যান ভ্যান করছে!

মাকে বড় একটা গাছের নিচে বসিয়ে রেখে ছেলেরা গাড়িতে এসে ওঠে!

মা চোখ জুড়ে তৃষ্ণা নিয়ে ছেলেদের শেষ বিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকে!

অবশেষ রাহেলা খাতুন গা ভরা করোনা ভাইরাস আর বুক ভরা পিপাসা নিয়ে বনের মধ্যে সন্তানদের জন্য অপেক্ষা করে!

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button