অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

বাঈয়ের রুদালিরা : নাইয়ার মাসুদ

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প

বাংলা অনুবাদ : প্রতিভা সরকার

[নাইয়ার মাসুদ (Naiyer Masud) একজন প্রখ্যাত উর্দু ও পারসিক ভাষার পণ্ডিত, গল্পকার। ১৯৩৬ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের লখনৌতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মাসুদ হাসান রিজভী এবং মা হুসনে জাহান। বাবা মাসুদ হাসান রিজভি লখনৌ বিশ্ববিদ্যায়লের শিক্ষক এবং পারসিক ভাষার একজন পণ্ডিত ছিলেন। বাবার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে নাইয়ার মাসুদও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্সি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণের পর তিনি তাঁর বাবার তৈরি বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। বাড়ির নাম ‘আদাবিস্তান’, যার অর্থ সাহিত্যের আবাস। সাহিত্যে সঙ্গে তাঁদের বন্ধনটা যে নিবিড় ছিল, এ থেকে স্পষ্ট। নাইয়ার মাসুদ অসংখ্য ছোটগল্প লিখেছেন। বিভিন্ন ভাষায় তা অনূদিতও হয়েছে। পাশাপাশি প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। কাফকার অনুবাদক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। তার লেখায় কাফকা, বোর্হেস প্রমুখদের প্রভাব লক্ষনীয়। ’৭০-এর দশক থেকে তিনি ছোটো গল্প প্রকাশ শুরু করেন। ‘দ্য স্নেক ক্যাচার (The Snake Catcher)’, ‘এসেন্স অফ ক্যামফর (Essence of Camphor)’ তাঁর সর্বাধিক পঠিত গল্পগ্রন্থ। বাবার মতো পদ্মশ্রী না পেলেও সাহিত্যিক জীবনে তিনি অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উর্দু একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৩), সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৩), গালিব পুরস্কার (২০০১), প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়া পুরস্কার (২০০৩)। ২০০৭ সালে সরস্বতী সাহিত্য সম্মানে তাঁকে ভূষিত করা হয়। তাঁর ছোটগল্পের সংকলন, ‘তাউস চমন কি ময়না’র জন্য তিনি এই পুরস্কার পান। ২০১৭ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।]

কেউই বোধহয় জানে না, ছোটবেলায় আমি নতুন বউ দেখলে আঁতকে উঠতাম। আতঙ্কে সাদা হয়ে যেতাম। ভয়টার জন্ম হয়েছিল আমাদেরই পরিবারের বহু প্রজন্ম আগের এক নববধূর কাহিনি থেকে।

গল্পটা শোনার আগে কিন্তু নতুন বউদের প্রতি আমার আকর্ষণের কিছু কমতি ছিল না। বিয়েবাড়ি গেলে নববধূর কোল ঘেঁষে বসবার চেষ্টা করতাম। হেনারঞ্জিত হাত ছুঁয়ে দিতাম, বারবার তাকাতাম তার ঝকঝকে লাল শাড়ি আর গয়নাগাটির দিকে। বধূর শরীর থেকে ভেসে আসা ফুল, আতর আর অজানা গন্ধের ঢেউ আমাকে তার দিকে টেনে নিত, গয়নার রিনিঝিনি কানে আসত যেন পৃথিবীর মধুরতম সঙ্গীত। অবাক হয়ে ভাবতাম পৃথিবীর সব নারীই কি বধূ হলে নরম সৌন্দর্যে সেজে ওঠে! আমি যেন অল্প সময়ের জন্য হলেও প্রতিটি নতুন বউয়ের প্রেমে পড়ে যেতাম আর সে বরের সঙ্গে রওনা হয়ে গেলে বঞ্চিত প্রেমিকের মতো বেদনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতাম।

কিন্তু এসবই যে প্রবল বৃষ্টির সন্ধ্যায় আমাদের পরিবারের সেই নতুন বউয়ের গল্প আমি শুনেছিলাম, তার আগের কথা।

নিকা হয়ে যাবার পর বাপের ঘর থেকে তাকে বিদায় নিতে হল। কিন্তু বরের বাড়িতে যখন তাকে পালকি থেকে নামাবার সময় হল, সবাই সবিস্ময়ে দেখল পথেই তার মৃত্যু হয়েছে। নিজের অধর মৃতা এত জোরে কামড়ে ধরে আছে যে তা থেকে তখনও ফোটা ফোটায় রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। শরীর শক্ত কাঠ হয়ে গেছে। একটা প্রকাণ্ড বিছে তার পায়ের পেছন দিকটায়, উরুসন্ধির নিচে, মাংস ভেদ করে অনেক ভেতরে ঢুকে গেছে। তখন সবাই জানত এই মারাত্মক বিছেগুলো তাদের বড়শির মতো বাঁকানো দাড়া শিকারের চামড়ার ওপর একবার এঁটে বসাতে পারলে, মাংস ভেদ করে হাড় অব্দি পৌঁছে যেত খুবই অল্প সময়ে। শিকার বিষ ও ব্যথা দুইয়ের মিলিত আক্রমণে মারা যেত খুব তাড়াতাড়ি।

এই নববধূর মৃতদেহ দেখে মনে হচ্ছিল সে মারা গেছে তীব্র ব্যথায়। একবার জানান দিলেই তো তাকে এভাবে মরতে হতো না! কিন্তু সেই সময়ে চেঁচিয়ে ওঠা নতুন বউদের জন্য একেবারেই বারণ ছিল, সব সহ্য করার নিয়ম ছিল। বউটিও সব সহ্য করতে করতে চিরদিনের মতো চুপ হয়ে গেছে।

যে মহিলা গল্পটা বলছিলেন তিনি বললেন, ইসস বউটা যদি কাউকে বলত। একটা গরম সাঁড়াশি দিয়ে বিছেটাকে বার করে আনা যেত, নাহলে এক মুঠো চিনি ছুঁড়ে দিলেই ওটা গলে হেজে যেত।

একথা সত্যি যে বিছে চিনিতে গলে যায়। আমাদের বাড়িতে কোথাও বিছে দেখলেই চিনি ছুঁড়ে দিতাম আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওটা গা মোড়াতে মোড়াতে গলে জল হয়ে যেত।

কথা-না-বলা বউটার জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু গল্পের শেষটা তখনও জানি না। আমার আত্মীয়া তখনও বলে যাচ্ছিল, উৎসবের বাড়িতে প্রবল কান্নাকাটির কথা। দুটো পরিবার একমত হলো যে নতুন শাড়ি গয়না সুদ্ধ বউটিকে দাফন করবে। গয়নার হলদে কমলা আভা নতুন বউয়ের ত্বকে প্রতিফলিত হওয়া শেষ না হতেই তাকে সবাই মিলে কবরের অন্ধকারে নামিয়ে দিল।

কিন্তু কপালে কী শান্তি আছে! কে একজন রাতের অন্ধকারে কাঁচা কবরের মাটি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। ভেতরে যে কী হয়েছিল কে জানে, লোকটার চিল চিৎকারে আশেপাশের লোকজন ছুটে এসে দেখল সে মৃতদেহের পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। নতুন গয়নার দাগছাপে ভর্তি তার হাত আর মুখ। আরও বিস্ময়, লোকটাকে ওপরে তুলে আনা হলে আলোয় তার মুখ দেখতে পেল সবাই, সে হল মৃতার নব বিবাহিত বর। তাকে তোলার সময় যেন আঠা দিয়ে তার শরীরের সঙ্গে লাগানো মৃতদেহটিও কিছু দূর অব্দি উঠে এসেছিল, তারপর ধপ করে আবার ওটা নিচে পড়ে যায়।

তাড়াতাড়ি নিয়ম কানুন পালন করে আবার গোর দেওয়া হলো মেয়েটিকে। এবার সবাই বরটিকে নিয়ে পড়ল। সে তো জ্ঞান ফেরা অবধি আবোল-তাবোল বকেই যাচ্ছিল, প্রথমে বলে বউয়ের গয়নাগাটিই নাকি তাকে ঠেসে রেখেছিল, তাই গায়ে অমন দাগ বসে গেছে। তারপর বলে―না, না, বউয়ের গোটা শরীরটাই আমাকে টেনে রেখেছিল।

তুই নামতে গেছিলি কেন ? এই প্রশ্নের উত্তরে সে কখনও বলে শেষ দেখা দেখতে গেছিলাম, কখনও অন্য কিছু। তবে শেষমেষ সত্যি কথাটাই বলে, সে গা থেকে গয়নাগুলো খুলে নিতে গেছিল।

তারপর কিছু দিন পাগলের মতো ঘুরে বেড়াবার পর ছেলেটা লাপাত্তা হয়ে গেল। এইবার তার মৃতদেহটি শুয়ে থাকতে দেখা গেল তারই নতুন বউয়ের কবরের ভেতরে। সেই থেকে কবরে অনেক গয়না আছে, এ কথা সবাই জানলেও সে মাটি স্পর্শ করার সাহস কেউ দেখায়নি। কোনও চোর ডাকাত ওদিকে তাকাবার সাহস অবধি করত না। এভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কবরটিই কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

গল্পটা শোনার পর থেকেই আমার নতুন বউ দেখলেই ভয় হত। বৃষ্টির রিমঝিমের মধ্যে আমি গয়নার রিনিঝিনি শুনতে থাকলাম। একদিন আমার আমার এক বড় ভাই বলে বসল, আরে বউটা মোটেই মরেনি রে। লোকেরা মরা ভেবে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিয়েছে। লজ্জায় মরমে মরে থেকে সে বলতেই পারেনি যে সে তখনও বেঁচে আছে।

কেউ কেউ এই কথা শুনে হাসল কিন্তু মা এসব নিয়ে হাসিঠাট্টা করার জন্য দাদাকে বকল। বউটাকে জ্যান্ত কবর দেওয়া হয়েছিল শুনে আমি আরও ভীত হয়ে পড়লাম। নিজেকে অনেক বোঝালাম যে না না মরে যাবার পরই নতুন বউকে কবর দেওয়া হয়েছিল কিন্তু আমার ভয় যেন বেড়েই চলল।

ঐ চিন্তা আমাকে কিছুদিন খুব ভাবাল। কখনও মনে হতো ও জ্যান্ত ছিল, আবার ভাবতাম, না মৃত। জ্যান্ত মৃত দুই নারীকেই ভয়াবহ লাগত, সবচেয়ে ভয়ের ছিল ওর গয়নাগুলো। আর কোনও বিয়েবাড়িতে বউয়ের কাছে ঘেঁষতাম না। বিয়েবাড়িগুলোই ক্রমে বিভীষিকা হয়ে উঠল আমার কাছে। যাই হোক, কিছুদিন পর ভয় একটু কমলেও নতুন বউয়ের প্রতি আকর্ষণ আর ফিরে আসেনি।

এর মধ্যেই বাড়ির উল্টো দিকে বিয়ে লাগল, সেখানে না গিয়ে উপায় ছিল না। বিয়েবাড়িটার নাম ছিল ব্যালকনি হাউজ, কেননা ঘরগুলো বেড় দিয়ে একটা বারান্দা রাস্তার ওপর ঝুঁকে পড়েছিল। বিয়ের কনের পরিবারের সঙ্গে আমাদের খুব হৃদ্যতা ছিল, ওর দুটো ছোট ভাই ছিল আমার বন্ধু। মেয়েটা ছিল খুব বলিয়ে―কইয়ে আর চঞ্চল। সবসময় আমাকে খেপাত আর এমন সব কথা বলত যাতে আমি একটু নার্ভাস হয়ে পড়তাম, আমার লজ্জা লজ্জা লাগত। যাই হোক ওকে আর ওর ক্ষেপানো আমার বেশ ভালো লাগত।

বন্ধুদের সঙ্গে বিয়ের আয়োজনে আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। অনেকবার মনে হয়েছে কনের কাছে যাই, একটু ছুঁয়ে দেখি, কিন্তু আগুনের শিখার মতো সে ইচ্ছা নির্বাপিত হতেও বেশি সময় লগেনি। নিকা হয়ে যাবার পর বাপের বাড়ি থেকে চির বিদায় নেবার সব নিয়মকানুন মানা হচ্ছিল যখন, আমি কেটে পড়ার অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু আমার বন্ধুরা জোর করে দাঁড় করিয়ে রাখল। নিচের হলটা মহিলাতে বোঝাই ছিল, আমি কোনওমতে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

নববধূকে ওপরের ঘর থেকে নামানো হচ্ছিল। বাইরে ঘোড়ার গাড়ি অপেক্ষায়। নিচের হলে এক এক করে মহিলারা কনেকে বিদায় জানাচ্ছিলেন। সবাই জড়িয়ে ধরছিলেন, সবাই বিলাপ করছিলেন। মনে হচ্ছিল যেন কেউ মরেছে এবং বিলাপকারীরা কান্নাকাটির খেলা খেলছে, কে কার থেকে কত বেশি চিৎকার করে দুঃখ প্রকাশ করতে পারে, সেই খেলা। কারও মুখ কান্নার সময় এত বিকৃত, যে আমার হাসি চেপে রাখা দায় হয়ে পড়েছিল। নিঃশব্দে ওদের অনুকরণ করবার চেষ্টা করছিলাম, যাতে পরে ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে অন্যদের দেখাতে পারি।

এমন সময় একটা ভারী পুরুষ কণ্ঠ মহিলাদের আদেশ দিল একদম চুপ করে যেতে এবং বধূকে বাইরে জুড়িগাড়িতে তুলে দিতে। ট্রেন পাওয়া যাবে না নইলে।

নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে মহিলা পরিবৃতা কনে গাড়ির দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল, হাত দুটো ছিল ছোট দুই ভাইয়ের কাঁধে আর সর্বাঙ্গের অলংকার থেকে একটা সুমিষ্ট রিনিঝিনি শব্দ উঠে আসছিল যেন। কনের পেছনে লম্বা পোশাকের ছেঁচড়ে যাওয়া অংশ দুহাতে মাটি থেকে উঁচুতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল দুটি মেয়ে। টকটকে লাল পোশাক, মাথার লম্বা ওড়না নববধূর মুখ দেখতে দিচ্ছিল না। শুধু নকশা করা স্লিপারের ঠিক ওপরে যেখানে মোটা মল দেখা যাচ্ছিল, তার একটু ওপরে সাদা পায়ের গোছ অল্প দৃশ্যমান ছিল।

আমি মহিলাদের পেছন থেকে কনেকে দেখবার জন্য উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলাম। একসময় কী করে যেন ডবল ঘোমটা এবং ফুলের তৈরি মুখাবরণের পেছন থেকেও সে আমায় ঠিক দেখে ফেলল। তার শরীর কেঁপে উঠল, তার সঙ্গে সঙ্গে যাওয়া মহিলা দুজনকে নস্যাৎ করে দিয়ে তার সমস্ত গয়নার ভার নিয়ে সে আমায় জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। আতর, ফুলের গন্ধ, শরীরের ভাপ, সব আমায় একসঙ্গে আক্রমণ করলে আমি অনুভব করলাম তার পাথর বসানো ব্রেসলেট আমার কাঁধের মাংস কেটে বসে যাচ্ছে, যন্ত্রণায় ওর শরীরের নরম মধুর স্পর্শও আমি বিস্মৃত হচ্ছি। সঙ্গের মহিলারা ওকে ছিঁড়ে নিয়ে যেতে চাইল যেন কিন্তু যাবার সময় ওর সোনার হারের একটি ফিনফিনে অংশ আমার জামার কলারে আটকে গেল। শত টানাটানিতেও তা যেন খোলেই না। আমার হঠাৎ সেই মরে যাওয়া নতুন বউকে মনে পড়ে গেল… তার গয়না ‘গয়নাগুলোয় এঁটে যাওয়া পুরুষ মানুষটি’। যেন ছোটবেলায় শোনা সেই কাহিনির বউটি পাংশু মুখে আমার দিকে তাকিয়ে, যেন এগিয়ে আসছে সে, শিগগিরই তার শরীর এঁটে যাবে আমার সঙ্গে। সেই বিশাল হলঘরটা হঠাৎ একটা সদ্য খোঁড়া নির্জন কবরের রূপ নিল, একটা আঁকাবাঁকা গাছের ডাল যেন ঝুঁকে আছে সেই গভীর শূন্যতার ওপর।

আমিও বেঁকেচুরে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করতে করতে একসময় কলারে হারের ছিন্ন টুকরোটা নিয়েই ছুটে পালালাম। বাইরের রাস্তায় পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে নিজের বাড়িতে ঢুকে পড়লাম।

কাউকে বলিনি এই ঘটনার কথা, যদিও আমি মানসিকভাবে খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম। বাড়ির ভেতরও একটু একা হলেই আমার মনে হতো যেন কোনও নববধূ আমার দিকে এগিয়ে আসবে। রাতে অস্পষ্ট আওয়াজে ঘুম ভেঙে যেত, নাকে আসত সুন্দর গন্ধ। এমনকি ঘুম ভেঙে যাবার পরও তারা আমাকে ঘিরে থাকত। এক নাগাড়ে ঝরে পড়া বৃষ্টি এবং অন্য যেকোনও নিরবচ্ছিন্ন আওয়াজ আমার কানে আনত ফোঁপানি এবং গয়নার রিনিঝিনি। ব্যবহার করা হয় না এরকম ঘরের দরজা খোলা থাকলে তার সামনে দিয়ে যেতে ভয় করত, যেন দেখতে পেতাম কার পায়ের মসৃণ সাদা অংশ, একটা মরণ কামড়ে লেপ্টে থাকা বিছেকে নিয়ে ঘরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

ঐ বিয়ের পর পরই ব্যালকনি হাউজের মালিকানা বদল হলো, এক বৃদ্ধ দম্পতি ওখানে থাকতে এলেন। আস্তে আস্তে আমার অদ্ভুত ভয় আবছা হতে শুরু করল। জানতাম সবই মনের ভুল। তবে কাল্পনিক দৃশ্য চিরকালই বাস্তবের থেকে বেশি জীবন্ত লেগেছে আমার, উদ্ভট চিন্তাকে স্থান দিয়েছি চোখে দেখা অভিজ্ঞতার ওপরে।

এখন পারিবারিক আলোচনায় বউটির কথা এলে আমি গল্পটার মধ্যে অনেক ত্রুটি খুঁজে পেতে লাগলাম আর তাকে একসময় অত ভয় পেয়েছি বলে লজ্জা পেতে শুরু করলাম। ভয়টা বেমালুম হারিয়ে গেল বলে একটু একটু দুঃখও হতো। কারণ সেই নববধূর মৃত স্মৃতি এবং সেই স্মৃতিকে ঘিরে থাকা আমার মৃত ভয় আর কখনও ফিরে আসবে না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম।

কিন্তু মুশকিল হলো কি এই মাত্র কিছুদিন আগে দুটোই আমার কাছে ফিরে এল।

আমার এক আত্মীয় মারা যেতে আমরা দেহ গোরে নামাবার বাঁশের ধাঁচাটা যখন নিয়ে কবরখানায় এলাম, কবরটি তখনও পুরো তৈরি হয়নি। তিনবার খোঁড়া হয়েছে, তিনবারই পুরনো কবরের চিনহ মিলেছে। চতুর্থ বারের জায়গাটা হয়তো সেরকম হবে না, কবর-খুঁড়িয়ে মাটি তুলতে তুলতে এইরকমই বলেছিল।

কিছু করার নেই, তাই আমরা সবাই এলোমেলো ঘুরতে লাগলাম। এটা আমাদের পারিবারিক কবরখানা, যদিও গোরের মৃতদেহগুলো বেশির ভাগই বাইরের লোকের। আমাদের পরিবারের অনুমতি সাপেক্ষে ওখানে যে কাউকেই সমাহিত করা যেত।

অনেকদিন পরে আসায় আমি দেখছিলাম গাছের সংখ্যা কত কমে এসেছে! যেগুলো আছে সেগুলোও কেমন শুকিয়ে যাওয়া, মরা মরা! তীব্র রোদ গায়ে এসে বিঁধছিল। আমাদের সামনের ত্রিভঙ্গ গাছটির কালো শাখাগুলো কেমন যেন ব্যাঁকাত্যাড়া, ভয়-ধরানো। শুধু একটি মাত্র শাখা গুড়ি থেকে বেরিয়ে গাঢ় সবুজ পাতায় নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছে, ছায়া দিচ্ছে নিচের এক টুকরো মাটির ওপরে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম আর কিছু দিনের মধ্যেই এটাও নিশ্চয়ই শুকিয়ে যাবে। ঠিক তখনই আমাদের দলের একজন বলে উঠল ‘গাছটা চিরকাল এই রকমই দেখলাম, অন্য ডালগুলো শুকনো হাড়ের মতো কিন্তু এই ডালটা চিরসবুজ।’

আমরা সবাই তার কথা মন দিয়ে শুনছি দেখে সে আবার বলল, ‘মনে হয় এখানে কোনও নববধূকে গোর দেওয়া হয়েছিল। ঠিক ডালটার নিচে। কথায় বলে, শ্বশুর বাড়িতে পা দেবার আগে যদি কোনও নতুন বউ মারা যায়, তাহলে তার গোরে ছায়া দেওয়া গাছের ডাল কখনও শুকিয়ে যায় না।’

আবার, আবার সেই ছোটবেলার নতুন বউয়ের কথার ফিরে ফিরে আসা! সঙ্গের লোকেরা এগিয়ে গেছে, কিন্তু মাটিতে পা এঁটে থাকা অবস্থায় আমি খুব টের পাচ্ছিলাম নিচের মাটি নড়েচড়ে উঠছে আর একটা ফাটল যেন ক্রমশ বড় হচ্ছে।

আবার সেসব! ভয় পাব কী, মাটির নিচ থেকে যেন দুঃখের প্লাবন উঠে এসে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইল। আমি ধপ করে রোদে পোড়া মাটির ওপর বসে পড়লাম।

কয়েক মুহূর্ত এভাবে কাটলে আবার সব ঠিক হয়ে গেল। কানে এল অন্যদের কথা, কবর তৈরি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সবাই যেন জড়ো হয়ে যায়। আমিও উঠে চলতে শুরু করলাম কিন্তু ভাবছিলাম কী আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেল আমার চারপাশে!

তখন বুঝিনি কিন্তু এখন মনে হয়, ঐরকম ঘটেছিল কারণ এখানে এই কবরখানাতেই বাঈ চিরনিদ্রায় শায়িত আছে।

ব্যালকনি হাউজে যে বয়স্ক দম্পতি বসবাস করছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা আরও বুড়ো হতে লাগল। আমি প্রায়ই ওদের হাঁ করা বাইরের দরজা দিয়ে দেখতাম ঢোকার মুখের হলটাতে তখতে হেলান দিয়ে একজন বয়স্ক মানুষ বসে আছেন। তখতের পাশের ছড়ানো ছেটান চেয়ারগুলোতে কখনও কখনও পাড়ার বুড়ো মানুষেরা বসত। দাবা খেলত। ঐসময়ে পড়ায় মন দেবার জন্য আমি প্রায়ই চিলেকোঠায় চলে যেতাম, সেখান থেকে উল্টো দিকে ওদের বাইরের দরজাটা এবং ওপরের আরও দুটো ঘর স্পষ্ট দেখা যেত। ওদের ব্যালকনিতে ফুল হয়না, শুধুই পাতার বাহার এরকম টব লাইন দিয়ে সাজান থাকত আর প্রত্যেক দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে ভারী রুপার গয়নায় সজ্জিত একটি মেয়ে এসে সেগুলোতে জল দিয়ে যেত। আমাদের দুটি বাড়ির মাঝখানে শুধু রাস্তাই ছিল না, আমাদের বাগানটাও ছিল। দূর থেকে মেয়েটাকে খুবই কম বয়সি মনে হতো।

পরে জেনেছিলাম মেয়েটি বয়স্ক দম্পতির পরিচারিকা, তার নাম খানম। পরে দেখেছিলাম এলাকার যত প্রতিবেশী আর দোকানদার, সবার সঙ্গে তার হাসি ঠাট্টার সম্পর্ক। খানম ছিল পাহাড়ি মেয়ে, বয়সে বৃদ্ধ দম্পতির থেকে বড়ও হতে পারে  কিন্তু দৈর্ঘ্যে সে ছিল একটা নয় দশ বছরের মেয়ের সমান। এই জন্যই তার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলত লোকে, যেন একটা ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। ঝাঁকুনি দিয়ে হাঁটত খানম, কথাও বলত সেইভাবে, যেন মুখের ভেতর আটকে থাকা একটা শব্দ আর একটা শব্দ ধাক্কা মেরে বার করে দিচ্ছে। তাকে ভ্যাঙালে মাঝে মাঝে সে খুব রেগে যেত, চেঁচিয়ে বলত, ‘পুলিশ ডাকব কিন্তু।’

ইতোমধ্যে সবাই জেনে ফেলেছিল যে সে নিজেই পুলিশকে সবচেয়ে বেশি ডরায়। যাই হোক প্রতিবেশীদের বাড়িতে তার অবাধ গতি ছিল, তাদের কাজের লোকের সঙ্গে সারাদিন তার বকবকানির ফলে সবাই ঐ বৃদ্ধ দম্পতির হাঁড়ির খবর পেয়ে যেত।

মালকানিকে খানম বাঈ বলে ডাকত আর মালিককে সাহেব। ওদের কোনও সন্তান-সন্ততি ছিল না। বাঈয়ের ইহজগতেই কেউ ছিল না, সাহেবের দু-চারজন দূর সম্পর্কের আত্মীয় একই শহরে বাস করত কিন্তু আসা-যাওয়া ছিল না মোটেই। তাদের কেউ অসুস্থ হয়ে মারা গেলে একা সাহেব দেখা করে আসত।

বাঈকে কেউ বাড়ির বাইরে যেতে দেখেনি, হাঁটুর বাত ছিল তার, সিঁড়িতে ওঠানামা ছিল অসম্ভব।

একবার খানম আমার আম্মিকে বাঈয়ের হাঁটুর ব্যথার কথা বলতে, আম্মি ওকে একটা মালিশ করবার তেল ব্যবহারের পরামর্শ দিল। কিন্তু তেলটায় বিভিন্ন জিনিস কোনটা কী হারে মেলাতে হবে মনে না থাকায় আব্বা বাড়ি ফিরে এলে, তাকে জিজ্ঞাসা করে বসল। তখনই দেখা গেল আমার আব্বা বাঈ এবং সাহেব সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। বাঈ নাকি বাবার যৌবনে দারুণ নাম করা গাইয়ে ছিল, যদিও তখন তাকে কী নামে ডাকা হত, আব্বা মনে করতে পারল না। সাহেব ছিল খুব সম্ভ্রান্ত কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু পরিবারের ছেলে, যে বাঈয়ের সঙ্গীতকলায় মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ে করে বসে।

‘তুমি যেতে ওর গান শুনতে ?’ আম্মি জিজ্ঞাসা করল। আব্বা হেসে বলল, ‘অভিজাত বংশের ছেলে বা সঙ্গীতের তেমন সমঝদার তো আমি ছিলাম না আর তখন আমি ছিলাম ছাত্র। না ছিল টাকা, না সময়। সামনাসামনি গান গাইতে শুনিনি বটে কিন্তু খ্যাতির কথা কানে এসেছিল।’

সাহেবকে দেখতাম সবসময় হলো ঘরের ভেতর বসে থাকতে, মাঝে মাঝে অবশ্য বাইরে কোথাও যেত, ফিরে আসত। তখন হাতে থাকত মেহগনি রঙের হাঁটার ছড়ি। প্রাচ্যের অভিজাত পুরুষের প্রাচীন পোশাক পরত সে কিন্তু মাথায় সবসময় থাকত ইংরেজ শিকারিদের টুপি। খুব আস্তে ছড়ি ঠুকে ঠুকে হাঁটা সাহেবকে আমি কাছ থেকে কখনওই দেখতে পাইনি। বাজারে কখনও-সখনও দেখা হলেও ঐ ছড়ি আর টুপিতেই তাকে চিনতে পারতাম।

বাঈকে তো দেখেছি আরও কম। একটা ঘরের দরজা তো সবসময়ই বন্ধ আর একটা খুলে খানম গাছে জল দিতে আসত। তবে মাঝে মধ্যে খুব গরম বা প্যাঁচ-প্যাঁচে আবহাওয়া হলে খোলা বাতাসের জন্য বন্ধ দরজা খুলে যেত, তখন বাঈকে দেখতে পেতাম। বিছানার ওপর বসে আছে, হয় খানম বাঈয়ের চুল আঁচড়ে দিচ্ছে, নয় তো উলটো। দূর থেকে বাঈয়ের চেহারা ঠিক কেমন বুঝিনি তবে মনে হতো মোটাসোটা শক্তপোক্ত বয়স্ক মহিলা।

আমি ভাবতাম সাহেব নিচের তলাতেই থাকে। কিন্তু এক দিন দরজা খোলা থাকায় দেখলাম সাহেব বাঈয়ের বিছানার ওপর বসে আছে, বারবার কিছুর ওপর নুয়ে পড়ছে আর খানম ব্যস্ত হয়ে আসা-যাওয়া করছে। মনে হলো বাঈ ও সাহেব একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করছে। একদিন দেখলাম সাহেব বাঈকে জোর করে কিছু খাওয়াবার চেষ্টা করছে। বাঈ মুখ এদিকে ঘোরাচ্ছে, ওদিকে ফেরাচ্ছে, যেন কিছুতেই খাবে না কিন্তু সারাক্ষণ খিলখিল করে হাসছে। ঠিক তখনই জল নিয়ে খানম ঢুকল। বাঈ তার পিঠে চাপড় মেরে কিছু বলল, খানমও হাসতে হাসতে বাইরে চলে গেল।

কতদিন ধরে বাঈ আর সাহেব ব্যালকনি হাউজে আছে, আমার পরিবার তার হিসেব রাখতে পারে কিন্তু আমার ও নিয়ে কোনও কৌতূহল ছিল না। ঐ দম্পতি আমার কাছে আমার রঙহীন একঘেয়ে প্রতিবেশের অঙ্গ ছিল, ওদের দিকে তাকিয়ে দেখাও যা, না দেখাও তাই। এজন্যই বোধহয় ওপরের ঘরের এবং হলঘরের বন্ধ দরজাগুলো যে অনেক দিন খুলছে না সেটা আমি খেয়ালই করিনি। যেদিন খানম মায়ের কাছে হট ওয়াটার বটল্ চাইতে এল, সেদিনই শুনলাম কিছুদিন হলো বাঈ খুব অসুস্থ কিন্তু সাহেব শহরের বাইরে। কে দেখাশোনা করছে তাহলে, এই প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল যে আজকেই সাহেবের দুজন মহিলা আত্মীয়ার আবির্ভাব হয়েছে তাদের বাড়িতে।

সন্ধেবেলায় দেখলাম বাঈয়ের ঘরের দরজা হাট করে খোলা, ভেতরে ঘোরাঘুরি করছে দুজন অচেনা মহিলা। তারপর দিন আরও জনা ছয়েক নতুন মহিলা এল, এরপর তো আরও অনেক জন। চতুর্থ দিনে ব্যালকনি হাউজ থেকে প্রবল কান্নার রোল ভেসে এল।

আমি তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এলাম বাড়ির সবাইকে জানাবার জন্য। দেখি আমাদের উঠোনে বসে খানম কাঁদছে। কিছুক্ষণ আগে বাঈ মারা গেছে। বাড়ি ভর্তি মহিলারা মৃতদেহের পাশে জ্বালাবে বলে কিছু ধূপকাঠি যোগাড় করতে বলেছে তাকে। আম্মি খোঁজার জন্য কাডবোর্ড হাটকাচ্ছিল আর বাঈয়ের কী হয়েছিল সে সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিচ্ছিল। সেসব বলার পর খানম জানাল যে সাহেব আজও ফেরেনি। তার যাবার সময় বাঈ একেবারে ঠিকঠাক ছিল আর সে ছাড়া কেউই জানত না সাহেব কোথায় গেছে।

আমি নিজের ঘরে ফিরে গেলাম। কান্নার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল কিন্তু শুরু হলো অজস্র জুড়ি গাড়ির আনাগোনা। তারা দলে দলে মেয়েদের উগরে দিচ্ছিল বাড়ির সামনে, সঙ্গে আসা অচেনা পুরুষেরা দাঁড়িয়ে থাকছিল নিচের হলঘরে। হঠাৎ কান্নার শব্দ প্রবল হয়ে উঠল, কিছুতেই কমে না! এমন চিৎকার যে আমি উঠে দরজার সামনে এলাম। দেখি বাঈয়ের ঘরের ভেতর কুরুক্ষেত্র চলছে। কান্না কোথায়, এখন প্রচণ্ড চিৎকার ভেসে আসছে আর সবার ওপরে খানমের গলা শুনতে পাচ্ছি। মেয়েরা ধাক্কাধাক্কি করছে, বিলাপ করতে করতে এ ওর গায়ের ওপর গিয়ে পড়ছে। প্রচণ্ড অশান্ত তারা আর খানম সেই ভিড়ের মধ্যে তীব্র আলো চোখে পড়া একটা বাদুড়ের মতো যেন ডানা মেলে পালাতে গিয়ে প্রত্যেকের গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে।

এরপরই নিচ থেকে পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এল। আমি ব্যালকনিতে ঝুঁকে দেখি বাঈয়ের বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া পুরুষেরা ক্রুদ্ধ কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়ছে। পাড়া-প্রতিবেশী কেউ কেউ তাদের শান্ত করার চেষ্টা করছে। এই রকম বহুক্ষণ চলার পর ওপর থেকে মহিলারা নেমে এলে সঙ্গের পুরুষেরা যে যার ঘরমুখো হলো। কিন্তু যেতে যেতে মহিলারাও প্রচণ্ড উত্তেজিত অবস্থায় চ্যাঁচামেঁচি করছিল। হলোটা কী! অবাক হয়ে ব্যালকনি হাউজের দরজাগুলোর দিকে তাকাই। সেগুলো এখন শান্ত আর নিপাট বন্ধ, যেন কোনও কিছুই ঘটেনি এর মধ্যে, যদিও তখনও বাতাসে ধূপের গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

নিচে গিয়ে দেখি খানম সেখানে উপস্থিত। গোটা কাহিনি বাড়ির মেয়েদের তার বলা হয়ে গেছে। তার বক্তব্য, গত কয়েকদিন যাবত বাঈ অর্ধ অচেতন হয়ে ছিল। কখনও জ্ঞান এলে সে খালি সাহেবের কথাই জিজ্ঞাসা করছিল। কিন্তু গতকাল তার পূর্ণ জ্ঞান ফিরে আসে, সে কিছু খেতে চায় এবং খানমকে বলে তার গয়নার বাক্স নিয়ে আসতে। তারপর সমস্ত গয়না পরে সে খানমকে হুকুম করে ঘরের দরজা হাট করে খুলে রাখতে। তার সাহেব আসবে।

সারারাত সে ঐভাবে জেগে বসে থাকে। সকালে আবার সাহেব এসেছে কি না খোঁজ নিয়ে সে খানমকে বলে চুল আঁচড়ে, কাজল পরিয়ে তাকে সাজিয়ে দিতে। কাজললতা নিয়ে ফিরে এসে খানম দেখে বিছানার ওপর বাঈয়ের নিষ্প্রাণ দেহ পরে আছে।

তারপর তো সাহেবের মহিলা আত্মীয়রা পালে পালে ধেয়ে এল। কাঁদতে কাঁদতেই তারা নাকি বাঈয়ের শরীরের ওপর শোকে আছড়ে পড়ছিল। একজন হঠাতই দেখে বাইয়ের এক কানের দুল গায়েব। আরেকজনকে দুল কোথায় জিজ্ঞাসা করলে সে তৃতীয় এক মহিলাকে দেখিয়ে বলে, ‘যেখানে আংটি গেছে, সেখানেই।’ সত্যিই বাঈয়ের আঙুলে একটা আংটি কম! এবার শুরু হলো তুলকালাম কাণ্ড। সবাই সবাইকে চুরির অপবাদ দিতে লাগল আর গলা তুলে প্রমাণ করতে চাইল বাঈয়ের সঙ্গে প্রত্যেকের আত্মীয়তা কত গভীর! শেষতক তারা মৃতদেহের ওপর ঝাঁপিয়ে শেষ গয়নাটা অবধি ছিঁড়ে নিল। মেয়েদের ভাষায়, এভাবে বাঈকে পুরো ‘ন্যাংটো’ করে দেওয়া হলো।

ভাবলাম খানম নিশ্চয়ই বাড়িয়ে বলছে। আমি তো দূর থেকে সবই দেখেছি, এরকম লুটপাট তো দেখিনি। খানম আমাকে পাত্তাই দিল না। সে তো ঘটনাটা নিজের চোখের সামনে ঘটতে দেখেছে। সে এখন বাঈয়ের মৃতদেহ পড়শি মহিলাদের জিম্মায় রেখে বলতে এসেছে আমরা কোনওভাবে সাহেবকে খুঁজে বার করতে পারি কি না।

আব্বাকে ডেকে আনা হলো। তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। তবে একটা কাগজে কিছু লিখে চাকরের হাত দিয়ে মহল্লার মাতব্বরদের কাছে পাঠালেন, যদি কেউ সাহেব কোথায় জেনে থাকে। হঠাৎ দেখি খানমের নাক আর কানের লতি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্তের ফোটা আর যে ভারী রুপোর গয়নাগাটি সে পরত তার একটাও নেই। আম্মি চেঁচিয়ে উঠল, ‘ওরা কি তোমার গয়নাও লুটে নিয়ে গেছে ?’

ঘটনা হয়েছিল কী, লুটেরা মহিলাদের সবাইকে ধরে ধরে গয়না ফেরত পাবার চেষ্টা করছিল খানম কিন্তু তাদের সঙ্গে পেরে ওঠা কি সম্ভব ? তাই শেষমেষ নিজের গয়না খুলে ওদের দিকে ছুড়ে দেয় সে, ‘এগুলোও নিয়ে যা।’

‘ওগুলো তো আমাকে বাঈই দিয়েছিল, বল!’ আবার খানম কাঁদতে শুরু করল।

অনেক চেষ্টা করে তাকে শান্ত করা হল, ক্ষতে ওষুধ লাগিয়ে তাকে কিছু খাবার দেওয়া হলো। সে প্রত্যাখ্যান করেনি, মাথা নিচু করে সবটাই খেয়ে নিল।

চাকরেরা ফিরে এসে বলল, কেউ সাহেবের গতিবিধি সম্বন্ধে কিছুই জানে না। খানমের চলে যাবার সময় হলে আবার নতুন খবর এলো। কেউ পুলিশকে রিপোর্ট করেছে যে বাঈকে খুন করে সমস্ত গয়না লুটে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ মৃতদেহ নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে আর খানমের জবানবন্দি নেবে বলে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। পুলিশকে খানম তো যমের মতো ডরাত, এবার তার মুখ একেবারে সাদা হয়ে গেল। মৃতের মতো চোখ তুলে সে একবার ওর মুখের দিকে তাকায়, আরেকবার এর মুখের দিকে।

আরও ঝামেলা হলো কী, আমার এক আইনজ্ঞ মামা ওকে আরও ভয় দেখিয়ে দিল এই কথা বলে যে সাক্ষী হিসেবে তাকে নিয়ে পুলিশ ও এটর্নিরা প্রবল টানহ্যাঁচড়া করবে। ফলে যখন সাক্ষ্য দেবার জন্য তাকে পুলিশের কাছে যেতে বলা হলো, খানম আছাড়ি-পিছাড়ি খেতে লাগল। এ ঘর থেকে ও ঘরে দৌড়ে দৌড়ে লুকোবার চেষ্টা করছিল মেয়েটা। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে চাকর ডেকে তাকে আমাদের বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। খানম তার ছোট ছোট পা ছুঁড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল, চিৎকার করছিল কিন্তু তাকে পাঁজাকোলা করে বাইরে না পাঠিয়ে উপায় ছিল না।

আমি দেখলাম আমার সেই মামু আম্মি আব্বাকে চুপি চুপি কী যেন বোঝাচ্ছে। আমাকে হাতের ইশারায় ডেকে নিয়ে সে বলল, আমাকে নাকি তখনই কানপুর যেতে হবে।

‘মনে রেখ’, সে জোর দিয়ে বলল, ‘কাউকে বলা চলবে না যে তুমি কিছু দেখেছ। নাহলে ওরা তোমাকেও কোর্টে টেনে নিয়ে যাবে।’

আম্মি তাড়াতাড়ি আমার ব্যাগ গুছিয়ে দিল। পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা সরু গলি ধরে আমরা স্টেশনের দিকে হাঁটা দিলাম।

কলকাতা থেকে

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button