অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

লাইব্রেরিয়ান : নাইয়ার মাসুদ

অনুবাদ গল্প

অনুবাদ : নাহার তৃণা

[নাইয়ার মাসুদ (Naiyer Masud) একজন খ্যাতিমান উর্দু ও পারসিক ভাষার পণ্ডিত, গল্পকার। ১৯৩৬ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশের লখনৌতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম মাসুদ হাসান রিজভী এবং মা হুসনে জাহান। বাবা মাসুদ হাসান রিজভি লখনৌ বিশ্ববিদ্যায়লের শিক্ষক ও পারসিক ভাষার একজন পণ্ডিত ছিলেন। বাবার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে নাইয়ার মাসুদও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যুক্ত হন। লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্সি ভাষার অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণের পর তিনি তাঁর বাবার তৈরি বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। বাড়ির নাম ‘আদাবিস্তান’, যার অর্থ সাহিত্যের আবাস। সাহিত্যে সঙ্গে তাঁদের বন্ধনটা নিবিড় ছিল।  নাইয়ার মাসুদ অসংখ্য ছোট গল্প লিখেছেন। বিভিন্ন ভাষায় তা অনূদিতও হয়েছে। পাশাপাশি প্রচুর প্রবন্ধ লিখেছেন। কাফকার অনুবাদক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত। তার লেখায় কাফকা, বোর্হেস প্রমুখদের প্রভাব লক্ষণীয়। ‘৭০-এর দশক থেকে তিনি ছোট গল্প প্রকাশ শুরু করেন। ‘দ্য স্নেক ক্যাচার (The Snake Catcher),’ ‘এসেন্স অফ ক্যামফর (Essence of Camphor)’ তাঁর সর্বাধিক পঠিত গল্পগ্রন্থ। বাবার মতো পদ্মশ্রী না পেলেও সাহিত্যিক জীবনে তিনি অসংখ্য পুরস্কার লাভ করেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো উর্দু একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৩), সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৩), গালিব পুরস্কার (২০০১), প্রেসিডেন্ট অফ ইন্ডিয়া পুরস্কার (২০০৩)। ২০০৭ সালে সরস্বতী সাহিত্য সম্মানে তাঁকে ভূষিত করা হয়―তাঁর ছোট গল্পের সংকলন, ‘তাউস চমন কি ময়না’র জন্য তিনি এই পুরস্কার পান। ২০১৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।]

লাইব্রেরিটার জন্য কখনও কোনও বই কেনা হয়নি। তারপরও একেবারে শুরু থেকে লাইব্রেরি ভরতি শুধু বই আর বই। সব ধরনের বই। আর থাকবেই না কেন। বিভিন্ন পাঠরুচির লোকজন ওখানে দেদারসে বই দান করতেন। আসলে এই লাইব্রেরি ছিল একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। বিশাল বিল্ডিঙের লাইব্রেরি। ভবনের একপাশ দিয়ে লম্বা একটা সিঁড়ি উপরের তলায় চলে গেছে। সিঁড়ির শেষপ্রান্তে এক চিলতে সমতল জায়গা। সেখান থেকে দুই কদম হাঁটা দূরত্বে বিশাল একটা কক্ষ। যার তিনদিকে তিনটা দরজা। এই কক্ষটি ঘিরেই লাইব্রেরি। ঘরে সরি সরি দেয়াল-আলমারি। সবগুলো আলমারি বই ঠাসা। বইগুলো মোটেও অপরিচ্ছন্ন বা ছেঁড়াখোঁড়া নয়। বেশির ভাগ বই শক্তপোক্ত বাঁধাই করা। দেখলে বোঝা যায়, বেশিদিন হয়নি বইগুলো বাঁধাই করা হয়েছে। এই কক্ষের দুটা দরজায় সবসময় তালা ঝোলে। তৃতীয় দরজাটা আসা-যাওয়ার জন্য খোলা থাকত। তাও পুরাটা নয়―অর্ধেক। ঘরজুড়ে বেশকিছু জানালা ছিল। কিন্তু একটা বাদে বাকিগুলো সারাক্ষণই বন্ধ থাকত। ঘরের একমাত্র খোলা জানালাটা ছিল পূর্বমুখী। যেটা ছিল আবার লোহার জালি দিয়ে ঘেরা। জাল দিয়ে বাইরের কিছু বাড়ির পেছন দিক আর একটা বেকারি দোকান দেখা যেত। বেকারির চারপাশে  প্রায় সারাক্ষণ কিছু কুকুর ঘুরঘুর করত।

লাইব্রেরির ভেতরে বই পড়বার জন্য খোলা জানালার কাছাকাছি খানকতক আসনের ব্যবস্থা ছিল। জানালা দিয়ে বিনা বাধায় বাইরের আলো ঘরের কোনে এসে পড়ত। কিন্তু সমস্যা হতো তখন, যখন জানালাটি বন্ধ থাকত। বাইরে থেকে তখন হুট করে কেউ লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকে পড়লে বিপদে পড়তেন। কারণ আলো না থাকায় চট করে কিছু ঠাহর হতো না। কাগজের গন্ধ থেকে অনুমান করে নিতে হতো বই ঠাসা একটা ঘরে আছেন তিনি। ঘরের স্বল্প আলো চোখ সয়ে গেলে বইয়ের আলমারিগুলো চোখে পড়তে দেরি হতো না। ডানদিকে বসে থাকা লাইব্রেরিয়ানকেও তখন দিব্যি দেখা যেত।

খুব তরুণ বয়সে লাইব্রেরিয়ান এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েছিলেন। লাইব্রেরির হাল তখন খুব ভালো ছিল না। কারণ সেই সময় প্রচুর পাঠক লাইব্রেরিতে আসত। সবার লাগাতার এবং যত্ন না নিয়ে পড়বার কারণে বইগুলোর দফারফা হয়ে যায়। কিছু বইয়ের সেলাই ছিঁড়ে পাতাগুলো আলগা হয়ে গিয়েছিল। কিছু বইয়ের বাঁধাই খুলেটুলে মলাট আর বইয়ের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। বইয়ের যত্নের দিকে নজর দেবার কেউ তেমন ছিল না। লাইব্রেরির বইগুলোর তদারকির জন্য একজন বুড়ো কর্মচারী ছিলেন। তিনি কোনওভাবে বইগুলো মেরামত করতেন। কাজে যোগ দেবার পরপরই তরুণ লাইব্রেরিয়ান বেহাল বইগুলো মেরামতের ব্যবস্থা নিলেন। তিনি প্রথমেই বই বাঁধাই, সেলাই ইত্যাদির জন্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র কর্মচারীকে জোগাড় করে দিলেন। তারপর তাকে তার তত্ত্ববধানে রেখে বইপত্র যত্নের কাজ শুরু করলেন। প্রয়োজনীয় জিনিস আর উৎসাহ পেয়ে কর্মচারীর মধ্যেও কাজের আগ্রহ জন্মাতে দেরি হলো না। কর্মচারীটি  কাজে বেশ দক্ষ ছিলেন। নিজের কাজটা তিনি ভালোভাবে করতেন। যদিও কাজে বসে সর্বক্ষণ বকবক করা ছিল তার স্বভাব। অধিকাংশ সময়ই তিনি তার অসুস্থ মেয়ের কথা বলতেন। গালগল্প করলেও বুড়ো কাজে মোটেও ফাঁকিবাজি করতেন না। কাজের গতিও শ্লথ হতো না। মুখের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার হাত চলত সমানে। দিনে তিনি অনেকগুলো বই সেলাই, বাঁধাই করে ফেলতেন। লাইব্রেরিয়ান একদিন জানতে পারলেন বুড়ো কর্মচারীটি অসুস্থ। পরে জানা গেল তার শারীরিক অবস্থা ভালো না। লাইব্রেরিয়ান তাকে দেখতে গেলেন। বুড়োর অবস্থা তখন আরও খারাপ। কিন্তু সেই অবস্থাতেও তিনি তার মেয়ের চিকিৎসা, ওষুধপত্র ইত্যাদি নিয়ে উৎকণ্ঠিত ছিলেন। তিনদিন পর বুড়ো কর্মচারীর মৃত্যুর খবর পেলেন লাইব্রেরিয়ান।

বুড়োর জায়গায় তার ছেলেকে কাজ দেওয়া হলো। বাবার মতো সে কাজে অতটা দক্ষ ছিল না। তবু নাই মামার চেয়ে কানা মামা হিসেবে তার কাজই মেনে নেওয়া হলো। একমাসের মাথায় ছেলেটি স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ পেয়ে সেখানে চলে গেল। তারপর থেকে কর্মচারীর পদটা শূন্যই থেকে যায়। লাইব্রেরিয়ান বুড়ো কর্মচারীর কাজ তদারকি করতে গিয়ে নিজেও তার কাজগুলো শিখে ফেলেছিলেন। এরপর থেকে কাজের অবসরে তিনি নিজেই বই মেরামত করতে শুরু করেন। যার ফলে ছেঁড়াখোঁড়া বইগুলো মেরামত হয়ে সুন্দর সাজে আলমারিতে ফিরে গেল। বই মেরামত আর সাজানোর কাজ করতে গিয়ে প্রায় প্রত্যেকটা বই লাইব্রেরিয়ানের চেনা হয়ে গেল। চেহারা দেখে বইটির বিষয়বস্তু কী সেটা তিনি অনায়াসে বলে দিতে পারতেন। বইয়ের ক্যাটালগিং আর শ্রেণিবিভাগের জন্য তার নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। খুব সহজে তিনি যেকোনও বই খুঁজে বের করায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। লাইব্রেরিতে আগত অনেকেই হয়তো তাদের পছন্দের বইটা খুঁজে পেতে হিমশিম খেতেন। অথচ তাদের ওভাবে নাকানিচুবানি খাওয়ার কোনও মানেই ছিল না। কারণ বইয়ের নামখানা তার কানে তুলে দিলেই কেল্লাফতে। বইয়ের নাম শোনা মাত্র লাইব্রেরিয়ান বলে দিতেন সেটা আদৌও লাইব্রেরিতে আছে কি নেই। পাওয়া সম্ভব হলে পলকেই বইখানা পাঠকের সামনে হাজির করতেন।

সে-সময় সব ধরনের লোকের আনাগোনা ছিল লাইব্রেরিতে। প্রচুর শিক্ষার্থীও আসত। লাইব্রেরিয়ান দেখামাত্রই বুঝে নিতেন ওরা শিক্ষার্থী। শুধু যে সব শিক্ষার্থীকে দেখেই বুঝতেন এমন নয়। আগত অন্যদের দেখে কার কী ধরনের বই পছন্দ সেটা বুঝে নিতেও তার জুড়ি ছিল না। একদিন এক লোক এল যাকে দেখে তার মনে হলো না পড়াশোনার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক আছে। লোকটি লাইব্রেরিয়ানের হাতে কাগজের একটি টুকরো ধরিয়ে দিল। কাগজে বেশ কিছু বইয়ের নাম লেখা। যার মধ্যে একটি ছিল সুপরিচিত ধর্মীয় বই। অন্যটি সেই বইতে উল্লিখিত প্রশ্নোত্তরের বই। দুটি বই ছিল শিল্পকলা-বিষয়ক। অন্য আরেকটি বই কোনও এক উচ্ছৃঙ্খল লোকের জীবনী। যে এক বেপরোয়া-অনৈতিক জীবন কাটানোর পর ক্রমাগত কয়েক রাত একই স্বপ্ন দেখে নিজেকে সংশোধন করেছিল। বইগুলো লাইব্রেরিতেই ছিল। এছাড়াও কাগজে আরও কিছু বইয়ের নাম লেখা ছিল। লাইব্রেরিয়ান কিছুক্ষণ তালিকার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনে মনে তিনি লোকটি সম্পর্কে একটা ধারণা দাঁড় করাতে চেষ্টা করলেন। তারপর যেসব বই পাওয়া সম্ভব সেগুলোতে দাগ দিয়ে কাগজটা লোকটিকে ফেরত দিলেন। লোকটি নির্লিপ্তভাবে সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘দয়া করে সবগুলো বই নিয়ে আসুন।’ লাইব্রেরিয়ান লোকটির দিকে তাকালে সে বলল, ‘সবগুলো একই সঙ্গে আনবেন। বার বার যাওয়া আসার ঝঞ্ঝাট তাতে এড়াতে পারবেন।’

বইগুলো সংগ্রহ করে লাইব্রেরিয়ান সেগুলো একটা আসনের উপর রাখলেন। বই রেখে ফিরে যাওয়ার সময় তিনি লক্ষ করলেন লোকটি দ্রুত একটা বই নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করেছে। ঘন্টা দেড়েক পর সে সবগুলো বই এনে লাইব্রেরিয়ানের সামনে রাখল। তারপর ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে গেল।

পরদিন আরেক লোক এসে একই বইগুলো চাইল। একই কায়দায় বইগুলো দেখেশুনে চলে গেল।

ওই সময় লাইব্রেরিতে দুজন শিক্ষার্থীও উপস্থিত ছিল। লোকটা চলে যাওয়ার পর একজন বলল, ‘শব্দজব্দে আসক্তরাও দেখি লাইব্রেরিতে হানা দিচ্ছে।’

এরপর দুজনে নিজেদের আলাপে ডুবে গেল। ওরা খুব নিচুগলায় কথা বলছিল। লাইব্রেরিতে উঁচু গলায় কথা বলা নিষেধ ছিল না। তারপরও লাইব্রেরিতে আগতেরা সবাই নিজেদের মধ্যে নিচুগলায় কথা বলতেন। শিক্ষার্থীদের আলাপ লাইব্রেরিয়ানের কান এড়ালো না। ওদের আলাপের ভিত্তিতে তিনি ধারণা করলেন জনপ্রিয় শব্দজব্দের সমস্ত সূত্র সম্ভবত ওই বইগুলো থেকে নেওয়া হয়েছিল। সেগুলো সমাধানের মতলবেই ওই লোক দুজন লাইব্রেরিতে এসেছিল। বইয়ের বিষয়বস্তু কিংবা অন্যকিছু নিয়ে তাদের মাথাব্যথা ছিল না। এমন কী তারা বাক্যগুলোর অর্থ সম্পর্কেও আগ্রহী ছিল না। তাদের আচরণে সেটা বুঝতে তার কষ্ট হয়নি। তারা শুধু একটা বাক্যের পর নির্দিষ্ট যে শব্দ বসবে তার খোঁজেই হন্য ছিল।

লাইব্রেরিয়ান কিছুক্ষণ কী একটা ভাবলেন। তারপর একটা বড়সড় কাগজে মোটা মোটা অক্ষরে লিখতে শুরু করলেন। ‘মহাদয়গণ, যারা শব্দজব্দে অভ্যস্ত দয়া করে…’ এরপর তার কলম থেমে গেল। কলম হাতে ধরে তিনি বহুক্ষণ ভাবনায় ডুবে থাকলেন। ততক্ষণ, যতক্ষণ না আরেকজন লোক লাইব্রেরিতে এসে ঢুকলেন। লাইব্রেরিয়ান তাকে চিনতে পারলেন। এই লোক প্রায় নিয়মিত লাইব্রেরিতে আসেন এবং নির্দিষ্ট দশাসই একটা বই থেকে বসে বসে কাগজে টুকে নেন। লোকটা চলে যাবার পর লাইব্রেরিয়ান বইটা আলমারিতে তুলে রাখতেন না। আসনের উপরই রেখে দিতেন। আজ যখন লোকটি লাইব্রেরিতে ঢুকল তিনি তার হাতের কাগজটা সরিয়ে রেখে লোকটিকে লক্ষ্য করতে লাগলেন। লোকটি সোজা ওই আসনের দিকে হেঁটে গিয়ে বসেই বই খুলে টুকতে শুরু করলেন। অনেকটা সময় পর তিনি মাথা তুলে উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললেন এখনও অনেক টোকা বাকি। তারপর আবার টুকে নেওয়ায় মন দিলেন। পরদিন লোকটা এলেন না, তার পরের দিনও না। শেষমেষ লাইব্রেরিয়ান বইটা তুলে আলমারিতে রেখে দিলেন।

লাইব্রেরিতে আগতদের মধ্যে এমন অনেকেই আসতেন যাদের জন্য লাইব্রেরিয়ান রীতিমত আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতেন। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন ভীষণ খোদা ভক্ত। বহুদূর থেকে তার গলা শোনা যেত। বেশির ভাগ সময় তিনি নিজের সঙ্গে কথা বলতেন। অথবা কুকুরদের সতর্ক করতেন যেন তাকে দেখে তারা ঘেউ ঘেউয়ে না মাতে। কিন্তু লাইব্রেরিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার গলার স্বর খাদে নেমে যেত। লাইব্রেরিয়ানকে দেখে খুব বিনয়ের সঙ্গে তিনি সম্ভাষণ জানাতেন। কুশল বিনিময়ের পর সোজা আধ্যাত্মিকতাবাদ বিষয়ক বইয়ের আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। অনেক সময় তিনি অন্যান্য বইও চাইতেন তারপর চুপচাপ পড়ায় ডুবে যেতেন। পড়তে বসে প্রায় তিনি কাগজে কিছু লেখাজোখা করতেন। মাঝে মাঝে পড়তে বসে আচমকা তিনি কেমন বিচলিত হয়ে পড়তেন। তখন যেন তিনি মুঠি আঁকড়ে ভেতরের উদগত আবেগকে সংযত করতে চাইতেন। খুববেশি হলে বইটা নিয়ে উঠে পড়তেন এবং লাইব্রেরিয়ানের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেন। লাইব্রেরিয়ান যদি কাজে ব্যস্ত না থাকতেন তাহলে লোকটির দিকে তাকিয়ে হাসতেন। লোকটি তখন সংক্ষেপে তাকে আত্মা নিয়ে তার ধ্যান ধারণার কথা শোনাতেন। তারপর আবার গিয়ে পড়তে বসতেন। লোকটি চলে যাওয়ার পর লাইব্রেরিয়ান লোকটির লেখা কাগজ তুলে নিয়ে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিতেন। নামি সাহেবের ভাষ্য মতে আত্মা বা আধ্যাত্মিকতা নিয়ে অতিরিক্ত পড়াশোনার কারণে ওই লোকের মাথা আউলে গেছে। তার নিরাময়ের উপায় হিসাবেই তিনি বেছে বেছে ওই বিষয়ক বই পড়েন। লোকটি উপস্থিত থাকতে থাকতে যদি নামি সাহেব লাইব্রেরিতে আসতেন, তিনি সোজা গিয়ে তার কাছে গিয়ে বসতেন। গলা নামিয়ে দুজনে অনেকক্ষণ নিজেদের মধ্যে গুজুর গুজুর করতেন। এক সময় লোকটি লাইব্রেরিতে আসা বন্ধ করে দিলেন। নামি সাহেব জানালেন তার আত্মীয়রা তাকে নিয়ে অন্য শহরে চলে গেছেন।

নামি সাহেব নিয়মিত লাইব্রেরিতে আসতেন। লাইব্রেরিয়ান নিযুক্ত হওয়ার অনেক আগে থেকে এই প্রতিষ্ঠানে তার আসা-যাওয়া। লাইব্রেরিতে যতগুলো আলমারি আছে সবগুলোর সববই পড়ে ফেলার পরিকল্পনা তার। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে কয়েকটা আলমারির বই সাবাড় করেছেন। মানুষ হিসেবে তিনি অত্যন্ত মিশুকে। শহরের প্রায় সবার সঙ্গেই তার সখ্য। হাসিখুশি নামি সাহেবের উপস্থিতি ছিল নিস্তরঙ্গ লাইব্রেরিতে আলোর ঝলকানি মতো। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হলে লাইব্রেরিয়ানের কাছে চলে আসতেন। তার খোঁজ খবর নিতেন। তারপর নিজের এবং শহরের বিভিন্ন গালগপ্পো শুরু করতেন। এক সময় উঠে গিয়ে আবার কোনও বইয়ের পাতায় ডুবে যেতেন। যতক্ষণ না তাকে নিতে তার বন্ধু আসতেন ততক্ষণ তিনি পড়ায় মগ্ন থাকতেন। লাইব্রেরিয়ান নামি সাহেব এবং তার বন্ধুর উপস্থিতি উপভোগ করতেন। তিনি নামি সাহেবের সঙ্গে অনায়াসে আলাপ করতে পারতেন। কিংবা সোজা ভাষায় বলা ভালো নামি সাহেবই তাকে নিঃসঙ্কোচে আলাপে উৎসাহী করতেন। এই নামি সাহেবই তাকে প্রথম ‘লাইব্রেরিয়ান’ ডাকা শুরু করেছিলেন। যদিও তার নিযোগ পত্রে তাকে ‘বইয়ের তত্ত্বাবধায়ক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। লাইব্রেরিয়ান শব্দের সঠিক অর্থ না জানা সত্ত্বেও সম্বোধনটা তার ভালো লাগতো। নামকরণের জন্য নামি সাহেবকেও তিনি পছন্দ করতেন।

ছোট একটি ছেলেও নিয়মিত লাইব্রেরিটাতে আসত। সে যেকোনও ধরনে বই চেয়ে নিত তারপর মন দিয়ে অনেকক্ষণ সেটা পড়ত। তার বয়স যখন দশ কি এগারো তখন থেকেই সে লাইব্রেরিতে নিয়মতি যাতায়াত করত। দুর্বল শরীর স্বাস্থ্যের ছেলেটির মুখটা সবসময় লাল হয়ে থাকতো। নামি সাহেব ওই ছেলের সঙ্গেও খোশগল্প করতেন। তিনি সম্ভবত ছেলেটির কোনও মুরুব্বির বন্ধু ছিলেন। পনেরো―কী ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেটি নিয়মিত লাইব্রেরিতে এসেছিল। এরপর তার আর আসা হয়নি। কারণ ততদিনে সাধারণ মানুষের জন্য লাইব্রেরিটি বন্ধ হয়ে যায়।

লাইব্রেরিয়ান সুলুকসন্ধানে জানতে পারেন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কিছু বিরোধের কারণে সাধারণের জন্য লাইব্রেরিটি বন্ধ করা হয়। তবে তার চাকরিতে তাতে কোনও প্রভাব পড়েনি। তাকে বলা হয়েছিল  শুধু ট্রাস্টিদের অনুমতি প্রাপ্তরাই এরপর থেকে লাইব্রেরিতে আসার সুযোগ পাবেন। যদিও লাইব্রেরিয়ান সেরকম কোনও অনুমতিপত্র চোখেও দেখেননি। এই চক্করে পড়ে লাইব্রেরিতে লোকজনের আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল।

এর মধ্যে লাইব্রেরিয়ানের জীবনেও অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। একের পর এক মৃত্যু দেখেন চোখের সামনে। প্রথমে তিনি স্ত্রীকে হারান। এরপর তার দুই মেয়ে পরপর মারা যায়। তার স্ত্রী না হয় বহুদিন ধরে অসুস্থতার জন্য শয্যাশায়ী ছিলেন। কিন্তু তার দুই মেয়েই ছিল বিলকুল সুস্থ সবল। ছোট মেয়েকে তিনি খুব ভালোবাসতেন। মেয়েটিও ছিল বাবা-অন্তপ্রাণ। মেয়েকে হারিয়ে তিনি বাড়িতে থাকা একেবারেই কমিয়ে দিলেন। স্মৃতির তাড়া থেকে বাঁচতে লাইব্রেরিতে বেশির ভাগ সময় কাটানো শুরু করেন। লোক সমাগম না হওয়ায় তার কাজের চাপ কমে গিয়েছিল। কাজ কমে শুধু বইয়ের দেখভালে ঠেকেছিল। তখন পর্যন্ত লাইব্রেরিটির হালহকিকত ভালোই ছিল। অতিরিক্ত আর্দ্রতায় স্যাঁতসেঁতে হওয়া থেকে লাইব্রেরি সুরক্ষিত ছিল, উইপোকার হামলাও ছিল না মোটেও। তবে ছোট ছোট পোকাদের বইকাটা থেমে থাকেনি। পোকায় কাটা বইগুলো তিনি নিয়মিত মেরামত করতেন।

তবে তার নিজের অবস্থা এমন দাঁড়াল যে নির্ধারিত বেতন তিনি নিয়মিতভাবে পেতেন না। যদিও তার খরচ খুব বেশি ছিল না। শুধু খাবারের জন্য যেটুকু লাগতো। তবে খাবারও তিনি আর নিয়মিত খেতেন কোথায়। প্রায় না খেয়ে কাটিয়ে দিতেন। খিদেই পেত না তার। কাজেই বেতন নিয়ে দেনদরবারের চিন্তা তাকে একদমই ব্যতিব্যস্ত করল না। একদিন রাতের খাওয়ার জন্য তিনি বাইরে বেরিয়েছিলেন। তখন ঝকঝকে পোশাকের এক ভদ্রলোককে তিনি লাইব্রেরির দিকে আসতে দেখলেন। লোকটি তাকে সম্ভাষণ জানালেন এবং হেঁটে তারপাশে এসে থামলেন।

‘আমাকে চিনতে পারছেন না ? একসময় এই লাইব্রেরিতে অনেক আসতাম।’ বহুকষ্টে লাইব্রেরিয়ান তাকে চিনতে পারলেন। দেখেই বোঝা যায় লোকটি বড় চাকুরে। ‘আমি এখানে প্রচুর বই পড়েছি।’ লোকটি বললেন, ‘এই পথে অনেকদিন আসা হয়নি। আজ এলাম। মনে হলো আপনাকে ‘হ্যালো’ বলে যাই। এরপর তিনি তার কাজকর্ম নিয়ে অনেক কিছু বললেন। আলাপ সেরে হাত মিলিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

সময় গড়ানোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লাইব্রেরির বইগুলো খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। সেটা বুঝতে তার দেরি হলো না। বিষয়টা নিয়ে তিনি মহা চিন্তায় পড়লেন। পোকায় কাটা ফুটোফাটা তিনি আগের মতো ভালো দেখতে পেতেন না। দৃষ্টিশক্তি কমেছে তার। বইপত্রের  অবস্থা  কতটা শোচনীয় পরীক্ষার জন্য তাকে বইগুলো জানালার কাছে নিয়ে যেতে হতো। তাও চোখের খুব কাছে না নিলে পোকাদের কারুশিল্প স্পষ্ট দেখতেন না। প্রতিষ্ঠানের হর্তাকর্তাদের তিনি চিঠি লিখেছিলেন। বইপত্র দেখভালের জন্য যেন একজন নতুন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ দেওয়া হয়। বিষয়টা নিয়ে বার বার তাগাদা দিলেও কোনও ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি।

লাইব্রেরিয়ান দূরের জিনিস এখন আর স্পষ্ট দেখতে পান না। এমনকি লাইব্রেরির ছাদের নালাগুলো দেখতেও তার কষ্ট হতো। ওসব নালা দিয়ে বৃষ্টির পানি অনায়াসে বাইরে বেরিয়ে যেত। কিছু নালা ছাদের সামনের দিকে সরে গিয়ে আবর্জনায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জমে থাকা পানি নালা দিয়ে ক্রমাগত ভেতরের দিকে পড়ে ভবনটিকে দ্রুত স্যাঁতসেঁতে করে ফেলেছিল। ভাঙা নালা বেয়েও পানি দেয়াল চুঁইয়ে লাইব্রেরির নিচে পড়তে শুরু করেছিল। দিন দিন কেমন গা ছমছমে হয়ে উঠেছিল গোটা লাইব্রেরি ভবন।

বর্ষাকাল চলছিল তখন। বর্ষাস্নাত একদিন, জানালা দিয়ে আসা আলোতে বইপত্র খুঁটিয়ে দেখছিলেন লাইব্রেরিয়ান। নিরীক্ষণ শেষে আলমারিতে বইগুলো রাখার জন্য হেঁটে যাওয়ার সময় তিনি নামি সাহেবকে দেখতে পেলেন। নামি সাহেব খানিকটা দূরে একটা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে। অতিমাত্রায় ব্যস্ত ব্যাকুল হয়ে লাইব্রেরিয়ান তার দিকে এগোতে চাইলেন। নামি সাহেবও লাইব্রেরিয়ানের দিকে দ্রুত এগোতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কয়েক পা এগোতেই তিনি কেমন হোঁচট খেলেন। পড়েই যাচ্ছিলেন প্রায়। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। লাইব্রেরিয়ান থমকে দাঁড়ালেন। তার হাত ফস্কে বই মেঝেয় পড়ল। নামি সাহেব সেটা দেখলেন। বই ধরার জন্য তিনি এগোতে চেষ্টাও করলেন। কিন্তু আবারও তিনি হোঁচট খেলেন। তারা দুজনই চুপচাপ দাঁড়িয়ে দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না কাছাকাছি অন্য আলমারির দিক থেকে নড়াচড়া শুনতে পেলেন ততক্ষণ দুজনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। আলমারির ওই দিক থেকে নামি সাহেবের বন্ধু এগিয়ে এলেন। ঠিক তখন দুম করে গাঢ় একটুকরো মেঘ বাইরের সূর্যটাকে ঢেকে দিল। ঘরের ভেতরটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। হুট করে যেভাবে ঘর অন্ধকার হয়েছিল। সেভাবই কিছুক্ষণ পর মেঘ সরে বাইরের আলো ঘরে এসে পড়লো। ঘরের ভেতর তখন দ্বিতীয় কারও অস্তিত্ব দেখা গেল না। একা দাঁড়িয়ে লাইব্রেরিয়ান। কিংবা ওটাও হয়তো লাইব্রেরিয়ান নন।

গল্পসূত্র: The Librarian গল্পটি নাইয়ার মাসুদের উর্দু গল্পগ্রন্থ ‘গঞ্জেফা’র (Ganjifa) অন্তর্গত ‘কিতাবদার’-এর ইংরেজি অনুবাদ। উর্দু থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জেন শাম (Jane Shum) এবং মুহাম্মদ উমর মেমন (Muhammad Umar Memon)।

 লেখক : অনুবাদক, কথাশিল্পী

যুক্তরাষ্ট্রে শিকাগো থেকে

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button