আর্কাইভগল্প

রহস্যময় দীর্ঘশ্বাস : হরিশংকর জলদাস

গল্প

সেলিম সম্রাট আকবরের একমাত্র পুত্র। যুবরাজ সেলিমকে বড় ভালোবাসতেন আকবর। বলতেন- ‘সেখুবাবা’। এই সেখুবাবাই একদিন আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসলেন। দিল্লির সিংহাসন চাই তাঁর। তবে সেটা বেশ পরের ঘটনা, তার আগেও কাহিনি আছে।

বাদশা হবার পর আকবরকে বেশ কয়েকটি বিয়ে করতে হয়েছিল। তাঁদের একজন মানমতী। সম্রাট আকবরের সবই ছিল, ছিল না কেবল সন্তান। সন্তান জন্মায় আর মরে। বিমর্ষ জীবন, বিষণ্ন মন আকবরের। দরবারের কেউ কেউ বাদশার মনোবেদনার কথা জানতেন।

একদিন এক ওমরা বললেন, ‘বাদশাহ নামদার, একটি কথা বলতে চাই, যদি গোস্তাকি না ধরেন।’

বাদশা তাঁর ফ্যাকাসে মুখটি ওমরার দিকে ফিরিয়েছিলেন। ওমরা বলেছিলেন। আগ্রার কাছে সিক্রি গাঁয়ে সেলিম চিস্তি নামে এক ফকির বাস করেন। অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন বলে শুনেছি। আপনি একবার তার সঙ্গে মুলাকাত করুন। আপনার কষ্ট কমতেও পারে হুজুর।

ওমরার কথাটি মনে ধরেছিল আকবরের। ছুটে গিয়েছিলেন ফকিরের কাছে। ফকিরের বয়স তখন প্রায় নব্বই। কোনো কাকুতিমিনতি নয়, শুধু সেলিম চিস্তির সামনে বসে থাকে। বসে থাকতে থাকতে একদিন আকবরের মন বিপুল এক প্রশান্তিতে ভরে গেল। ওইদিনই তাঁর কাছে সংবাদ এল রাজপুতানী মহিষী মানমতী গর্ভবতী। পুত্রসন্তান হলো। ফকিরের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আকবর তাঁর পুত্রের নাম রাখরেনÑ সেলিম।

এই সেলিমকে ঘিরেই বাদশা আকবরের জীবন আবর্তিত হতে লাগল। সেলিম তাঁর কলজের টুকরা যেন। স্নেহের আতিশয্যে সেলিম ধীরে ধীরে বেঁকে যেতে শুরু করলেন। ছেলের বেয়াড়াপানা আর অস্থিরমতির কথা আকবরের কানে আসে। পুত্রসংশোধনের কোনও ব্যবস্থা নেন না বাদশাহ। বাৎসল্য যে অন্ধ! অল্প বয়েসে সুরাসক্ত হয়ে পড়েন সেলিম। আকবর সে আগুনে ঘি ঢাললেন। চৌদ্দবছর বয়সে সেলিমকে বিয়ে করিয়ে দিলেন। সেলিমের মা মানমতীর ভাইঝি মানবাঈ-ই হলো সেলিমের প্রথম স্ত্রী। চৌদ্দবছর বয়সেই নারীদের স্বাদ পেয়ে গেলেন সেলিম। নারী আর মদের জীবন সেলিমের তখন, হুল্লোড়ের জীবন। এক বছর পড়ে সেলিম আবার বিয়ে করলেন। তিনি যোধপুরী বেগম। ইতিহাসে তিনি যোধাবাঈ নামে খ্যাত। এই যোধাবাঈয়ের গর্ভে খসরু জন্ম হয়েছিল। এই পুত্র সেলিমের প্রথম আলো এবং প্রতিদ্বন্দ্বী।

খসরুর জন্মের পর যোধাবাঈকে সেলিম বলেছিলেন, ‘আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ যোধা। তুমিই আমাকে পিতৃত্বের স্বাদ দিয়েছ। আমার পৃথিবী আবার আনন্দে ভরে গেছে।’

সেলিমের কথা শুনে বড় তৃপ্তি পেয়েছিলেন যোধাবাঈ। কিন্তু তাঁর তৃপ্তি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। সেলিম খসরু পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন। খসরু যত বড় হয়েছেন, বাদশা আকবর ততই তাঁকে আঁকড়ে ধরেছেন। এ যেন এক নিঃস্ব পিতার নাতির মধ্যে অবলম্বন খোঁজা। সেলিমের অন্যান্য ছেলেমেয়ের প্রতি। সেলিমের তা অসহ্য লাগতে শুরু করল।

যোধবাঈয়ের কাছে গিয়ে একদিন ফেটে পড়লেন সেলিম, ‘তোমার ছেলের প্রতি বাদশার এত আদিখ্যেতা কীসের, হ্যাঁ ? আমার চেয়ে খসরুকেই বেশি পাত্তা দেওয়া শুরু করেছেন বাবা। তুমি তোমার শ্বশুরকে বলে দিয়োÑ এটা আমি সহ্য করব না।’

যোধবাঈ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘আমাকে বলছেন এসব ? সাহস থাকলে বাদশার সামনে গিয়ে বলুন।’

সম্রাটের নাম শুনে কেন জানি কুঁকড়ে গেলেন সেলিম! মাথা নেড়ে বললেন, ‘বাবাকে তো তা আমি বলতে পারব না! যা বলবে, তুমিই বলবে।’

‘সেটাই কথা! বলবেন কী করে? আপনি যে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে বসে আছেন!’

‘কী বললে? আত্মবিশ্বাস হারিয়েছি! ঠিক আছে, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমিই বলব।’ সেখানে আর থাকলেন না সেলিম। তাঁর স্ত্রীর শেষ কথাটিও শুনলেন না।

ধীরে কণ্ঠে যোধবাঈ তখন বলছেন, ‘যে পুরুষ শুধু নারী আর সুরা নিয়ে দিনরাত পার করে। তার আবার আত্মবিশ্বাস!’

সেলিম আকবরের সামনে খসরু বিষয়ে আপত্তি তোলেনি কিন্তু গুমরে মরেছে।

দিন দিন মদ্যাসক্তি বেড়েছে সেলিমের, পাল্লা দিয়ে বড়েছে নারীলালসা। স্থায়ীভাগ্য যথেষ্ট উজ্জ্বল সেলিমের। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে একের পর এক বেশ কয়েক বিয়ে করতে হয়েছে। সম্রাট আকবরের উদ্যোগেই বিয়েগুলো সম্পন্ন হয়েছে। মেধা বাঈয়ের পর তিব্বতের রাজকন্যা, তারপর খান্দেকোর অধিপতি রানা আলি খানের মেয়ে―পরপর স্ত্রী হয়ে মুঘল রাজপ্রাসাদে আসেন। স্ত্রীতে স্ত্রীতে সেলিমের অন্দরমহল ভরে যায় সত্য কিন্তু সেলিমের মনমন্দির থাকে শূন্য। প্রেমিক পুরুষ সেলিম। স্ত্রী তো কখনও প্রেমিকা নয়Ñ বিশ্বাস করেন সেলিম। প্রেমিকার জন্য তীব্র হাহাকার সেলিমের হৃদয়তলে। কোনও নারী যে তাঁর প্রেমিকহৃদয়কে উন্মাতাল করতে পারেনি, তা নয়। যতবার কোনও মেয়েকে সেলিম ভালোবেসেছেন প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছেন স্বয়ং আকবর। সম্রাটের কারণেই বারবার সেলিমের প্রেম ভেসে গেছে।

কিন্তু এবার ক্ষেপে উঠেছেন যুবরাজ সেলিম। যেভাবেই হোক জৈনখান থোকার মেয়েকে বিয়ে করবেন। এক নজর দেখেই তিনি তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছেন। আকবর এই বিয়েতে মত দিলেন না। সেলিম প্রেমোমত্ত তখন। বাদশাহকেও পরোয়া করেন না। আকবর শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। হিন্দুস্থানের ভাবীবাদশাহ শেষ পর্যন্ত কোনও কেলেঙ্কারি করে না বসেন! বাধ্য হয়ে বিয়েতে সম্মতি দিলেন আকবর।

এই প্রেম অচিরেই সেলিমের কাছে ফিকে হয়ে গেল তারপর তিনি আনারকলিতে জড়িয়ে পড়লেন। কিন্তু আনারকলিকে স্ত্রী হিসেবে পাননি সেলিম। সম্রাট আকবরই বাধ সেধেছিলেন।

আনারকলিতে ব্যর্থ সেলিম নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকেননি। বসন্তকাল যেমন ঋতুচক্রের আবর্তে পৃথিবীতে ঘুরে ঘুরে আসে, প্রেমও সেলিমের জীবনে ঘুরে ঘুরে আসতে থাকল। সেলিমের জীবনে আরও একবার প্রেম এল।

বসন্তকালে নওরোজ উৎসবের সময় মুঘল হেরেমের ভেতর মেলা বসে। এই মেলার ধরনটি বড় অদ্ভুত। সেই বিকিকিনির বাজারে বিক্রেতা হেরেমের নারীরা আর আমির-ওমরার পত্নী-পুত্রবধূ-কন্যারা। আর ক্রেতা থাকতেন স্বয়ং বাদশাহ এবং শাহজাদারা। পণ্যদ্রব্যগুলোও বিচিত্র― ফুল-লতা-পাতাতোলা রেশমি কাপড়, সূচের নানা কারুকাজ, সোনার কাজকরা শিরস্ত্রাণ, দামি মসলিন এসব। বিক্রিবাট্টাই এই মেলার আসল উদ্দেশ্য নয়, হাস্য-পরিহাস, দরদস্তুরের অভিনয়টাই এই মেলার মূলপ্রাণ।

সেবার নওরোজের মেলায় গেলেন সেলিম। এক সুন্দরীর কাছ থেকে দুটি সাদা পায়রা কিনলেন। পায়রা দুটি বড় ছটফট করছিল। এক সুন্দরী বিক্রেতার কাছে পায়রাগুলো জমা রেখে অন্য দোকানে ঘুরতে গেলেন সেলিম।

কেনাকাটা শেষ করে সেলিম সেই সুন্দরীর কাছে ফিরে এলেন। পায়রা জমা রাখার সময় তাড়াহুড়োয় সুন্দরীর দিকে ভালো করে তাকাননি সেলিম। এখন তাকিয়ে মাথা ঘুরে গেল তাঁর। এমন রূপসী জীবনেও দেখেননি তিনি।

পাশ থেকে একজন চাপাকণ্ঠে বলল, ‘মির্জা গিয়াস মুহম্মদ বেগের কন্যা হুজুর। মেহেরউন্নিসা।’

সেলিমের ভেতরটা থর থর করে কেঁপে উঠল। সেলিম জানেন, এর নাম শিহরন। অনেক চেষ্টায় নিজেকে সংযত করে বললেন, ‘আমার পায়রাগুলো কোথায়? দাও।’

মেহেরউন্নিসা নির্দ্বিায় বলল, ‘একটা আছে, একটা নেই।’

‘একটা নেই মানে!’ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন সেলিম।

মেহেরউন্নিসা হাত দুটো উড়ার ভঙ্গি করে বলল, ‘উড়ে গেছে।’

‘উড়ে গেছে মানে কী! কীভাবে গেল? ভারীমুখে জিজ্ঞেস কররেন সেলিম।

লাজুক একটু হাসি হেসে মেহেরউন্নিসা হাতের পায়ারাটি আকাশে উড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই ভাবে।’

সেলিম রাগ করবেন কী, মেহেরউন্নিসার সহজতায় মুগ্ধ হলেন ভীষণ। এই মুগ্ধতা থেকে প্রেম। প্রাগাঢ় প্রেম আপ্লুত হলেন সেলিম। এবারও তাঁর প্রেমের কথা বাদশাকে জানালেন সেলিম। বিয়ে করতে চাইলেন মেহেরউন্নিসাকে। আকবর এই বিয়েতে সম্মতি দিলেন না। মেহেরউন্নিসার বিয়ে আলিকুলি খানের সঙ্গে ঠিক হয়ে আছে। মেহেরউন্নিসার বাবা মির্জা গিয়াস আর দাদা আসফাক খান আকবরের রাজদবারের প্রভাবশালী দুই অমাত্য। এঁদের রাগাতে চাইলেন না বাদশাহ। তাঁরা কিছুতেই সেলিমের সঙ্গে মেহেরউন্নিসার বিয়ে মেনে নেবেন না। সেলিমের বহুচারিতা কথা মদ্যাসক্তির বৃত্তান্ত তাঁদের অজানা নয়।

বাবার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করেননি সেলিম। কিন্ত মনের মধ্যে মেহেরউন্নিসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে গিয়েছিল। সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেন সেলিম।

বাদশাহ আকবরের প্রিয়পুত্র সেরিম, সেলিমের প্রথম পুত্র খসরু। পিতার দুটি আসক্তির কোনওটাই ছিল না খসরুর। তিনি ছিলেন উদার ও বিনয়ী। প্রজারা সেলিমের চেয়ে খসরুকেই বেশি পছন্দ করতে। আকবরের রাজসভার অধিকাংশ অমাত্যের সমর্থন ছিল থসরুর প্রতি। তাঁরা চান আকবরের পর মুঘল সিংহাসনে খসরুই বসুন। সব খবর রাখেন সেলিম। ক্রদ্ধ ও ত্রস্ত হয়ে ওঠেন সেলিম। ক্রদ্ধ এই জন্য যে তাঁর সন্তান তাঁরই প্রতিদ্বন্দ্বী ভীত এই জন্য যে আকবর… বদলে খসরুকে সিহাসনে বসিয়ে দেন! সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে পিতাপুত্রের সম্পর্কের কোনও মূল্যই নেই। সেলিম খসরুকে শত্রু ভাবতে শুরু করলেন।

এদিকে সেলিমের বিরুদ্ধে সকলে খসরুকে গোপনে উস্কাতে শুরু করলেন। খসরুর বয়স তখন মাত্র উনিশ বছর। প্ররোচনায় মাথা ঠিক রাখতে পারলেন না খসরু। বাবা বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বসলেন। খসরুর মামা মধো সিং এই বিদ্রোহের মদতদাতা।

লাহোরের যুদ্ধে খসরুর বিদ্রোহকে কঠোর হাতে দমন করলেন সেলিম।

পিতার বিরুদ্ধে পুত্রের এই বিদ্রোহকে কোনওভাবেই মেনে নিতে পারেননি মানবাঈ। এদিকে স্বামী সেলিম তাঁকে ভুলবুঝে বসে আছেন। কারণে অকারণে কটু কথা শোনাতে দ্বিধা করেন না সেরিম। এই অপমান, এই অবিশ্বাস অসহনীয় হয়ে উঠল মানবাঈয়ের কাছে। একদিন অফিম খেয়ে আত্মহত্যা করে বসলেন মানবাঈ। সেলিমকে অকপট ভালোবাসতেন মানবাঈ। পুত্র এবং ভাইয়ের আচরণে বড় গ্লানি বোধ করতেন তিনি। পুত্রকে বহু চিঠি লিখেও সঠিক পথে আনতে পারেননি মানবাঈ। শেষপর্যন্ত রাজপুত চরিত্রের স্বাভাবসিদ্ধ তেজের প্রাবল্যে প্রাণত্যাগ করাই মনস্থ করেছিলেন তিনি।

মায়ের আত্মহত্যায় খসরুর বোধোদয় হয়। বিদ্রোহের পথ থেকে সাময়িকভাবে সরে আসেন। কিন্তু পিতাপুত্রের রেষারেষিটা থেকে গিয়েছিল পুরোদমে।

বাদশাহ আকবর তখন নিবুনিবু। বার্ধক্য আর জ্বরে তাঁকে প্রায় দখল করে ফেলেছে। সেলিম তখন বেশ আত্মস্থিত হয়ে উঠলেনÑ যদি বাবা তাঁকে বঞ্চিত করে খসরুকে সিংহাসনে বসিয়ে দেন! তার মাত্রাতিরিক্ত মাদ্যাসক্তি মোটেই পছন্দ করেন না সম্রাট। কিন্তু সেলিমকে মোটেই বঞ্চিত করতে চাননি আকবর। শুধু বলেছিলেন, ‘সিংহাসনে বসতে চাইলে মদ খাওয়া কমাতে হবে তোমার।’ পিতার কথা পছন্দ হয়নি সেলিমের। মুঘল সিংহাসন দখল করার জন্য সহজ পথটি বেছে নিয়েছিলন। পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসেছিলেন।

আকবর ধীরস্থির মানুষ। উত্তেজিত না হয়ে পুত্রকে একটি চিঠি লিখলেন তিনি। সেলিম তখন এলাহাবাদ দুর্গে। চিঠিতে আকবর লিখলেনÑ এই সিংহাসন তো তোমারই সেলিম! আমি শুধু এতদিন সিংহাসনটিকে পাহারা দিয়ে রেখেছি। তুমি আগ্রায় ফিরে এসো সেখুবাবা। এসে তোমার সিংহাসন বুঝে নাও।

সেলিমের প্রিয়বন্ধু সরিফের হাত দিয়ে চিঠিটা সেলিমের কাছে পাঠালেন আকবর।

শরিফ এলাহাবাদে পৌঁছালে সেলিম সোৎসাহে বলে উঠলেন, ‘আরে সরিফ! তুমি!’

‘হ্যাঁ, আমিই তো! তা আমাকে দেখে এত উচ্ছ্বসিত কেন তুমি?’

‘আরে ভাই! এতদিন ধরে আমি তোমাকেই তো খুঁজে বেড়াচ্ছি!’

‘আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছ ? বুঝলাম না!’ হতভম্বের কণ্ঠে বলল সরিফ। সেলিম ঘাড় ফুলিয়ে উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল, ‘বারে! এবার তো আমিই হব বাদশাহ, আর তুমি হবে আমার প্রধান উজির।’

‘প্রধান উজির!’ লোভে সরিফের চোখ চকচক করে উঠল।

বাদশহর চিঠি নিয়ে সেলিমকে সমঝবার জন্য এসেছিল সরিফ। কিন্তু সেলিম তাকে লোভাতুর করে তুলল। আমির নয়, সেনাপতি নয়, একেবারে প্রধান উজির প্রস্তাব! একি আর না করা যায়, না না করা উচিত! জেব থেকে আকবরের চিঠিটা আর বের করল না সরিফ।

কয়েকদিন যেতে না যেতেই বাদশাহর কাছে সরিফের বেইমানির সংবাদ চলে এল। তিনি বুঝলেন, অল্পবয়সি সরিফের হাত দিয়ে চিঠি পাঠানো ঠিক হয়নি। বাদশাহ ঠিক করলেন― ঠাণ্ডা মাথার আবুল ফজল। পথিমধ্যে আবুল ফজলকে হত্য করলেন সেলিম। খবর পেয়েই আগুনের মতো জ্বলে উঠলেন বাদশাহ আকবর―  এতদিনের বিশ্বস্ত পণ্ডিত মানুষটিকে হত্যা করাল সেলিম। আকবর― আদেশ দিলেন, ‘সৈন্য সাজাও। আমি নিজে যাব এলাহাবাদের। সেলিমকে দেখে নিতে চাই আমি।’

বাদশহি সেনা স্থ’লপথে রওনা দিল। বাদশাহ রওনা দিলেন জলপথে―  ময়ূরপঙ্খী বজরায়। যাত্রার কিছুদিনের মধ্যে বাদশহর বজরাটি যমুনার চরে আটকে গেল। ওই সময় আগ্রা থেকে খবর এল― আকবরজননী হামিদা বানু মৃত্যু-শয্যায়। প্রথমে ভাবলেন, মা বুঝি তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফন্দি করেছেন। হামিদাবানু নাতির বিরুদ্ধে আকবরের অভিযানকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁর ধারণা― এই অভিযানের পরিণতি ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের কাউকে হারানো। প্রথমে দোনামনা করলেন বাদশাহ। তারপর রাজধানীতে ফিরে এলেন দেখলেন মায়ের অবস্থা সত্যি সত্যি সংকটাপন্ন। কয়েকদিন পরেই হামিদাবানু মারা গেলেন।

দাদির মৃত্যুসংবাদ সেলিমের ভিতরটা নাড়িয়ে দিল। বিদ্রোহ থেকে সরে এলেন সেলিম।  আগ্রায় ছুটে এলেন প্রাণপ্রিয় দাদির মৃত্যদেহ শেষবারের মতো দেখার জন্য। প্রকাশ্য দরবারে বাদশাহর পায়ে মাথা নামিয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলেন সেলিম। আকবর বিচক্ষণ রজনীতিজ্ঞ। কঠোর এক সংযমে নিজেকে বেঁধে রাখলেন সেই মুহূর্র্তে। মন্ত্রী-অমাত্যের সামনে কোনোরূপে উত্তেজনা দেখালেন না বাদশাহ।

দরবারে কিছু না বললেও অন্দরমহলে এসে রেগে ফেটে পড়লেন আকবর। ‘বেজন্মা, বেইমান’ বলে সেলিমের গালে কষে এক চড় কষালেন। আচমকা চড় খেয়ে মেঝেতে ঘুরে পড়ে গেলেন সেলিম। চড় খেয়ে একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন তিনি। কোনওরকমে মেঝে থেকে নিজেকে টেনে তুলে মাথা নিচু করে পিতার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন সেলিম।

পিতার মন মুহূর্তে গলে গেল। হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে সেলিমকে গোসলখানায় নিয়ে গেলেন আকবর। বাহির থেকে হুড়কো দিয়ে বিশ্বস্ত এক প্রহরীকে আদেশ দিলেন, ‘সেলিম দশদিন এই গোসলখানায় বন্দি থাকবে। খেয়াল রাখবে, বাইরের কেউ যেন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পা পারে। আর হ্যাঁ, এই ঘরে যেন এক ফোঁটা মদ বা আফিম না ঢোকে।’ তারপর কণ্ঠকে আরও কঠোর করে বাদশাহ বললেন, ‘এই আদেশের ব্যত্যয় ঘটলে কী হবে নিশ্চয়ই জান তুমি। সবাইকে হাতির পায়ের তলায় ফেলে পিষে মারব আমি।’

বাদশাহ আকবরের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছিল দশদিন। দশদিন পর সেলিমকে মুক্তি দিয়েছিলেন আকবর। তাঁর ভেতরে তখন প্রচণ্ড আলোড়ন। বয়স হয়ে গেছে তাঁর। এখন তিনি কী করবেন? কাকে বানাবেন পরবর্তী সম্রাট? দরবারের অমাত্যরা দুভাগে বিভক্তি। কেউ সেলিমের দিকে, কেউ সিলিম পুত্র খসরুর দিকে। খসরুর দিকেই পাল্লা ভারী। ওদিকে সেলিমের আরেক ছেলে খরুর সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তলে তলে সে আখের গোছাতে শুরু করেছে। ভাবতে ভাবতে ভীষণ অস্থির হয়ে উঠলেন আকবর। অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি।  কঠিন রোগ রক্ত আমাশায়। বড় বড় হেকিমের কিকিৎসাতেও ভালো হলেন না বাদশাহ।

এক বিষণ্ন বিকেলে বাবার বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালেন সেলিম। অনেক কষ্টে চোখ মেললেন আকবর। অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, ‘বাবা, সেখুবাবা।’ তারপর চোখ বুজলেন বাদশাহ। সেলিম দেখলেন, পিতার ফ্যাকাসে চোখমুখ, সেখানে গভীর এক বেদনা থমকে আছে। হুহু করে উঠল সেলিমের প্রাণ।

অতিকষ্টে শয্যায় উঠে বসলেন সম্রাট। দেহরক্ষীকে উদ্দেশ করে ক্লান্ত স্বরে বললেন, ‘আমার তাজটা সেলিমের মাথায় পরিয়ে দাও।’

দেহরক্ষী আদেশ পালন করল।

সম্রাট কোমরবন্ধ থেকে গদেরন্তের হাতওয়ালা সোনার আলংকৃত বাগদাদি ছবিটি টেনে বের করলেন। ছুরিটি সেলিমের হাতে দিয়ে আকবর বললেন, ‘সেখুবাবা, ছবিটি একদিন আমি আমার বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলাম। এটি মহামূল্যবান। রাজকীয়। মুঘল ঐতিহ্যবাহী ছবিটি আমি আজ তোমাকে দিয়ে গেলাম। তুমি এর মর্যাদা রক্ষা কর সেখুবাবা। আজ থেকে তুমি আর সেলিম নও, জাহাঙ্গীর। মুঘল সম্রাট  জাহাঙ্গীর তুমি। পরম শান্তির চোখ বুজেছিলেন আকবর। এর কিছুদিনের মধ্যে আকবরের ইন্তেকাল হয়েছিল।

বাদশাহ হবার পর মেহেরউন্নিসার স্বামী আলিকুলিকে হত্য করালের জাহাঙ্গীর। ছলে-কৌশলে রাজপ্রাসাদের তুলে আনলেন মেহেরউন্নিসাকে। প্রৌঢ় বয়সি পিতার এই অন্যায়, অনাচার সহ্য করতে পারেননি খসরু। আরেকবার বিদ্রোহ করে বসলেন জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। আগে যা হয়েছে হয়েছে। তখন তিনি সম্রাট ছিলেন না বলে আকবরের কারণে খসরুকে ক্ষমা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন আকবর নেই এবং তিনিই বাদশাহ। খসরুকে কিছুতেই ক্ষমা করা যাবে না। জাহাঙ্গীর স্বয়ং খসরুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান করলেন। যুদ্ধে খসরু পরাজিত ও বন্দি হলেন।

যে অপরাধে বাদশাহ আকবর পুত্র সেলিমকে সামান্য শাস্তি দিয়েছিলেন, একই অপরাধে বাদশাহ জাহাঙ্গীর পুত্র খসরুকে ভয়ংকর এক শাস্তি দিলেন। মর্মান্তিক যন্ত্রণা দেওয়ার পর খসরুর দুটো চোখ উপড়ে নিলেন জাহাঙ্গীর। খসরুকে অন্ধ করে দেওয়ার আগে আরেকটি কাজ করেছিলেন বাদশাহ। খসরুর সাতশত অনুচরকে শূলে চড়িয়েছিলেন। শূলবিদ্ধ মুমূর্ষু অনুচরদের মাঝখান দিয়ে হাঁটানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। মৃত ষাঁড় আর গাধার ছাল ছাড়িয়ে তার ভেতর খসরুর দুই সেনাপতিকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন।

এত কিছুর পরও অন্ধ খসরুকে আগ্রায় রাখার সাহস পাননি জাহাঙ্গীর। কাবুলের কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তবে খসরুর স্ত্রী আর পুত্রকে হাতছাড়া করেনি তিনি। পাছে তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এই ভয়ে মুঘল হেরেমে একপ্রকার বন্দি রেখেছিলেন তাদের।

এখানেই থামেননি জাহাঙ্গীর। একদিন খসরুকে কাবুলের কারাগার থেকে মেজছেলে র্খুরমের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন র্খুরম। খসরু বেঁচে থাকলে তো জাহাঙ্গীরের পর তিনি বাদশাহ হতে পারবেন না। সঙ্গে সঙ্গে বুরহানপুর দুর্গে নিয়ে গেলেন খসরুকে। ওখানেই গুপ্তঘাতক দিয়ে হত্যা করালেন। জাহাঙ্গীরকে র্খুরম বার্তা পাঠালেনÑ সিঁড়ি ডিঙাতে গিয়ে টাল রাখতে পারেননি।

সংবাদ পেয়ে বিশাল একটা শ্বাস জাহাঙ্গীরের বুক চিড়ে বেরিয়ে এসেছিল। এ দীর্ঘশ্বাস তৃপ্তির, না শোকেরÑ একমাত্র বাদশাহ জাহাঙ্গীরই বলতে পারেন। এই দীর্ঘশ্বাস রহস্যময়ই থেকে গেছে।

 সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ  

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button