আর্কাইভবিশেষ সংখ্যা

বঙ্গবন্ধুর ৫০ বছরের বাংলাদেশ

মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা

সাহিদা বেগম

বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলাকে সোনার বাংলা হিসেবে দেখতে এবং গড়তে চেয়েছিলেন। এই গড়তে চাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে তিনি ‘ছয় দফা’ দিয়েছিলেন শাসকের সামনে। সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসনের দাবি থেকে দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে। বাংলাদেশের বয়স আজ ৫০ বছর। এই অর্ধশত বর্ষে দেশের অর্জন এবং ব্যর্থতা গণনের সময় হয়েছে। কিছু অসফলতা বা ব্যর্থতার পাশে স্বাধীন বাংলায় আমাদের অর্জনের ঝুড়িটাও পূর্ণতার কাছাকাছি। বাঙালি আজ গর্বিত বাংলাদেশকে নিয়ে। যদিও পূর্ণতার জন্যে আমাদের আরও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে।

অর্জনটা কাক্সিক্ষত ছিল। এই কাক্সিক্ষত অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্যেই যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম। দেশ স্বাধীন হয়েছে আজ ৫০ বছর। অর্ধশত বর্ষ। এটা কম নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা নতুন দেশের জন্ম, বেড়ে ওঠা, টিকে থাকা এবং সমৃদ্ধি অর্জন কম কথা নয়। বাংলাদেশের এই অর্জনটা অনেক বড়। এত বড় যে এটাকে সেলিব্রেট করাই যায়। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তি এবং বাংলাদেশের জনকের জন্মশতবার্ষিকী, দুটোই বাংলাদেশির জন্য, বাঙালির জন্য বড় উপহার। এর চেয়ে বড় উপহার আর হতে পারে না। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের দ্বারপ্রান্তে।

৫০ বছর সময় খুব একটা হেলাফেলা সময় নয়। একটা মানুষ যখন তার ৫০ বছরে পা দেয়, আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব তার জন্মতিথিকে সেলিব্রেট করে। আনন্দ করে, কারণ ধরেই নেওয়া হয় যে, সে মানুষ তার প্রাপ্তি এবং অর্জনে অনেকটাই পূর্ণ হয়েছেন। সে শুধু তার বয়সে নয় বরং জ্ঞান, প্রজ্ঞা, শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্জন এবং প্রতিদানে সক্ষম হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশকে নিয়েও এই তুলনাটা করা যায়। কারণ একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, প্রশাসন থেকে অর্থনীতি, যোগাযোগ, কৃষি, শিল্প সকল কিছু বিধ্বস্ত। প্রাপ্তি শুধু সাড়ে সাত কোটি মানুষ আর একটি ভূখণ্ড। একটি স্বাধীন পতাকা। এটি-ই ছিল আমাদের আবেগমথিত বাস্তবতা। পৃথিবীর অনেক দেশ আশঙ্কা করেছিল, বাংলাদেশ টিকবে না। টিকে থাকার মতো অবস্থা এ দেশের নয়। আশঙ্কার মুখে ছাইচাপা দিয়ে বাংলাদেশ টিকে আছে। টিকে আছে ৫০ বছর। সমৃদ্ধি আর যোগ্যতায় বিশ্বে আজ বাংলাদেশ অনেক দেশের রোলমডেল। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে অনুন্নত দেশ থেকে ধীরে ধীরে স্বল্পোন্নত দেশ এবং আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের দ্বারপ্রান্তে। জাতিসংঘের প্রয়োজনীয় দুই দফা সুপারিশ পাওয়া গেছে। আসছে ২০২৬ সাল থেকে বুক ফুলিয়ে বিশ্বকে বলতে পারব আমরা, বাংলাদেশ আর দরিদ্র বা স্বল্পোন্নত দেশ নয়, বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ এবং আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে উন্নত দেশের পথে। এ পথেই আমরা একদিন পৌঁছে যাব আমাদের চরম এবং পরম লক্ষ্যে। উন্নয়নের দীপ্তসূর্য এখন বাংলাদেশের মধ্যগগনে। যদি দেশে আগামীতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আর সামাজিক প্রশান্তি বজায় থাকে তবে দ্রুত শৈনঃ শৈনঃ উন্নতিতে পৌঁছে যাবে দেশ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানার সীমাবদ্ধতা আছে। বিপুল জনসংখ্যার বোঝা রয়েছে। তবে গত ৫০ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে জনগণের বুদ্ধি ও কৌশল রপ্ত করে চলেছে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে, ভালো থাকার লড়াইয়ে। তাই আজ বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠী দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে বোঝা নয়। জনবোঝা আজ জনসম্পদে রূপান্তর ঘটেছে। বাংলাদেশের এই উন্নয়ন কোনও অটোপ্রমোশন নয়। দেশের জনগণের তথা সাধারণ মানুষের কঠোর পরিশ্রম, মেধা, নানা উদ্ভাবনী শক্তি কাজে খাটিয়ে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটিয়েছে, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সরকারের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা, সরকারের প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও নীতি সহায়তার প্রচেষ্টাতেই এসেছে দেশের এই সফলতা। ৫০ বছর বয়সি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন। এই উন্নতিটা একদিনের প্রচেষ্টার ফল নয়। যাত্রাটা ছিল দীর্ঘ ৫০ বছরের। সকল ক্ষেত্রে একটু একটু অর্জন আর সফলতার সাফল্য আজ আমাদের বাংলাদেশ। একাত্তরের স্বাধীনতার পর থেকে ’৭৫ পর্যন্ত ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের লড়াই। ’৭৫-এর পর থেকে আশির দশকটা ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক অস্থিরতার আর সরকার অস্থিতিশীলতার সময়কাল। সামরিক শাসনামল, সঙ্গে ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঝড়, ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, অতিলোভী দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ আর ব্যবসায়ীদের আগ্রাসনে রাজনীতি এবং অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা।

হত্যা, গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে রক্তারক্তি প্রতিহিংসাপরায়ণ দিশাহীন ছিল দেশের সাধারণ মানুষ। বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য প্রতিটি সরকারেরই প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল। সরকারগুলোর প্রচেষ্টা এবং আবেদনে সাড়া দিয়ে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অকুণ্ঠ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসেছিল। বিশেষ করে আশির দশক থেকে শুরু হয়ে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নত দেশ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের হাজার হাজার কোটি টাকা নগদ সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। এই সময়কালে বাংলাদেশে বিদেশি সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে শত শত এনজিও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। সাহায্যদাতা দেশগুলোর উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তি পরিচালনাধীন এসব এনজিওর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল বিশেষ করে গ্রামগঞ্জে সাধারণ এবং দরিদ্র মানুষকে দারিদ্র্যমুক্তিতে সহায়তা করা। তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন করা। প্রথম দিকে এনজিও কর্মকর্তারা তাদের উদ্দেশ্য এবং কাজে বেশকিছু সফলতা দেখায় সাহায্যদাতা দেশের কাছে। তাদের সফলতায় দাতা দেশও আরও বেশি সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু লোভ! সীমাহীন লোভ এনজিও-র কর্তাদেরও গ্রাস করে। ধীরে ধীরে এবং দিনে দিনে এনজিওগুলোর নানামুখী অপতৎপরতার কথা প্রকাশ পেতে থাকে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে ঋণ বিতরণ কর্মসূচির মাধ্যমে মহাজনি ব্যবসায় রূপান্তরিত হতে থাকে এক একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি এনজিওর কর্তারাও দেশ ও জনগণের উন্নয়নের চেয়ে আত্মোন্নয়নে মত্ত হয়ে ওঠে। বড় এনজিওগুলো এক একটা বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। তাদের এই রূপান্তরে সাহায্যদাতা দেশগুলোও তাদের সাহায্যের হাত গুটিয়ে নেয়। ততদিনে অবশ্য দেশের আর্থ-সামাজিক, সামান্য হলেও, পরিবর্তন এসেছে। হতদরিদ্র মানুষগুলো এনজিওগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নিজেদের প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমে ভাগ্যের কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনতে পেরেছে। গ্রামগঞ্জে-হতদরিদ্র, অতিদরিদ্র কিছু কিছু মানুষ ছনের ঘর ফেলে টিনের ঘর তুলতে পেরেছে। ভিটাহীন দিনমজুর বসতভিটা কিনেছে ঋণ নিয়ে। উঠানে হাঁস-মুরগি, গরু, ছাগল কিনে লালনপালনে ব্যস্ত থেকে নিজের অবস্থার পরিবর্তন এনেছেন।

১৯৮০ সালে আমি নরওয়ের একটি সাহায্য সংস্থায় চাকরি নিয়ে দুই মাস কাজ করেছিলাম সিলেট জেলার হবিগঞ্জের পাঁচটি থানায়। সেই চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে ঘরে ঘরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। কী ভয়ঙ্কর ভয়াবহ দারিদ্র্য চোখে দেখেছিলাম। সেই হবিগঞ্জে গিয়েছিলাম আবার এক বছর আগে। হবিগঞ্জ সদর, শায়েস্তাগঞ্জ, শাহজিবাজার, চুনারুঘাট, বানিয়রচং গ্রামের উন্নয়ন আর পরিবর্তন দেখে আমার চোখ বিস্ময়ে বিমূঢ়। ’৮০-এর দশকে বিদেশি সাহায্য সংস্থাগুলো বাংলাদেশের হতদরিদ্র এলাকা হিসেবে উত্তরবঙ্গের রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, এদিকে সিলেটকে প্রাধান্য দিয়েছিল। ৪০ বছর পর আজ সেই সিলেটের মৌলভিবাজারে বিশ্বমানের পাঁচতারকা হোটেল ‘গ্র্যান্ড সুলতান’ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা করছে। সারা দেশেই একই চিত্র। ভিক্ষার হাত কর্মীর শক্ত পেশিতে রূপান্তরিত হয়েছে।

এ দেশের সাধারণ মানুষের নিজস্ব অর্জন। নিজ নিজ উদ্যোগের পরিবর্তন। এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য শ্রম-মেধা নিজেদের অফুরন্ত সম্ভাবনা উজাড় করে দেয়। কঠিন পরিশ্রম করে, তিল তিল করে ভবিষ্যতের সিঁড়ি বির্নিমাণ করে। এ দেশের যুবক নৌকায় আটলান্টিক, আরব সাগর পাড়ি দিয়ে কর্মের খোঁজে বিদেশে পৌঁছায়। বাংলার গ্রামগঞ্জের কাদাজলের কৃষক-মজুরের ছেলে ’৭১-এ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল―সেই কৃষকের ছেলেরাই এই ৫০ বছরে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে শক্ত ভিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে বাংলাদেশের জিডিপি আজ আটের ঘর ছুঁই ছুঁই। আজ যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তিতে আমরা আমাদের অর্জনের গল্প করি বা শুনি তখন মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্জন বা প্রাপ্তি কী ? খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, গার্মেন্ট বিপ্লব, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সকল ক্ষেত্রে নারী উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা, কমিউনিটি ক্লিনিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন সেনিটেশন, পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু, উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগের অভূতপূর্ব উন্নয়ন, যুদ্ধাপরাধের বিচার, ডিজিটাল বাংলাদেশ। দেশের উন্নয়নের আর একটি প্রধান উপকরণ হচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থার। যে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা যত উন্নত, সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তত দ্রুত বিস্তার লাভ করে। যেটা আমাদের দেশের সরকারগুলো ধারাবাহিকভাবে করেছে। পিছিয়ে পড়া উত্তরাঞ্চলকে প্রভূত উন্নয়নের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে যমুনা সেতুর বাস্তবায়নের কারণে। ঢাকা মেগাসিটি। মেট্রোরেল চালু হলে নিত্যদিনের যানজটের নাকাল থেকে রক্ষা করবে। রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টের ফ্লাইওভারগুলোর সুফল পাচ্ছে ঢাকাবাসী। শুধু রাজধানী বা উত্তরবঙ্গ নয়, দক্ষিণের জেলাগুলো সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন হাওর এলাকার যোগাযোগের একমাত্র উপায় ছিল―

‘বানে নাও

উন্নায় পাও’

সেসব হাওর এলাকায় আজ বড় বড় সুপ্রশস্ত পাকা রাস্তা। গাড়ি নিয়ে বাড়ির দরজায় নামে-ঢাকা থেকে গিয়ে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছরের বেশি, যা যুক্তরাষ্ট্রের কিছু এলাকার মানুষের গড় আয়ুর চেয়ে বেশি। মাতৃ এবং শিশুমৃত্যুর হার অনেক কমেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে, দেশে বর্তমানে ৯৮ শতাংশ শিশু বিদ্যালয়ে যায়। লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রের চেয়ে ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। শিক্ষাক্ষেত্রে ফলেও মেয়েরা অনেক এগিয়ে। বাংলাদেশ তাদের মেয়েদের শিক্ষিত করায় এখন তারাই দেশ ও পরিবারের অর্থনৈতিক স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ তার অপরিশোধিত সম্পদে বিনিয়োগ করেছে। বাণিজ্য উদারীকরণ এবং মুক্তবাণিজ্যের দেশ হওয়াতে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের উচ্চহার।

আমি বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল ‘বেপজা’-এর বাংলাদেশের প্রথম মীমাংসাকারী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলাম ২০০৬ সালে। প্রাথমিকভাবে দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের এক বছরের কাজের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশে বিশ্বমানের পণ্য তৈরি এবং শতভাগ রপ্তানি দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। আমেরিকার চোখ ধাঁধানো আলো ঝলমলে বিশাল শপিংমল থেকে পোশাক কিনে এনে বাসায় খুলে যখন দেখা যায়, ‘মেড ইন বাংলাদেশ’, তখন বুকের ভেতরে গর্বের উচ্চতা কোথায় উঠে যায় সেটা সে-ই জানেন, বাংলাদেশি হিসেবে।

এত এত প্রাপ্তির পাশাপাশি কিছু মানুষের লোভ-লালসা, দুর্নীতি বাংলাদেশকে অনেকখানি পিছিয়ে রেখেছে। নয়ত বাংলাদেশ এই ৫০ বছরে পৌঁছে যেত আর একটা সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো উন্নত দেশে।

বাংলাদেশে সকল দলেরই নেতাকর্মীদের সীমাহীন লোভ-লালসা, সরকারি দলের নেতাদের উগ্র এবং সীমাহীন হিংস্র লালসা উন্নতির পথে বড় অন্তরায়। সেইসঙ্গে সরকারি দলের মন্ত্রী, আমলাদের দুর্নীতি, চৌর্যবৃত্তি দেশের অগ্রগতিকে অনেকটা পেছনে টেনে রাখে।

স্বাধীনতা পর ৭২ থেকে ৭৫ এই সময়ে সরকারি আমলা, মন্ত্রীদের দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘মানুষ পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’। বঙ্গবন্ধু ছিলেন কোমল মনের মানুষ। তিনি বাঙালিকে ভালোবাসতেন। তাঁর পক্ষে হার্ডশিপ কোনও পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের ঝানু রাজনীতিবিদদের একজন হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। তারপরও বলব তাকে, দেশের শত্রু এবং আন্তর্জাতিক শত্রুদের সম্পর্কে আরও সচেতন থাকতে। দেশের সবাই এখন আওয়ামী লীগের, বিরোধী কোনও কণ্ঠস্বর নেই। এটা শুভ নয়। ক্ষমতার লিপ্সা আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে হবে। তার জন্য যোগ্য নেতৃত্বেরও কোনও বিকল্প নেই। বাংলাদেশকে নিয়ে যখন বিদেশিরাও উচ্চ প্রশংসা করে তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়। নিজের ১৬ বছরের তরুণ জীবনকে যখন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম, মনে ভালোলাগার স্ফীতভাব জন্ম নেয়―সেই যুদ্ধে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কত সঠিক ছিল। সম্প্রতি দুনিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নব্য প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সামনে যুক্তরাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের জন্য বাংলাদেশই হতে পারে অনুপ্রেরণা। পত্রিকাটির খ্যাতনামা কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ লিখেছেন, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর সংবাদ কভার করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশে ১ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল সেই ঘূর্ণিঝড়ে। সেই প্রতিবেদনে তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে হতাশাই ব্যক্তি করেছিলেন। পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত এই সাংবাদিক লিখেছেন, ৫০ বছর আগে গণহত্যা ও অনাহারের মধ্যে বাংলাদেশের জন্ম। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেছিলেন, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। সেই বাংলাদেশ ৫০ বছরে অবিশ্বাস্য উন্নতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে অর্জিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে চলমান মহামারীর বছরের আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৭ থেকে ৮ শতাংশ বেড়েছে, যা চীনের চেয়েও এগিয়ে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তিন দশক আগে হতাশা ব্যক্ত করা একজন প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিকের এ মূল্যায়ন স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির প্রাক্কালে জাতির জন্য অনেক বড় অর্জন। এখন বাঙালি জাতিকে সম্মিলিতভাবে দেশের এই অর্জনকে ধরে রাখতে হবে, আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে আগামীর পথে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

————————————

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button