আর্কাইভপ্রবন্ধ

ভবিষ্যতের নজরুল

জুলফিকার মতিন

মানুষের কাজই হলো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। ঘটে যাওয়া বিষয়গুলির প্রেক্ষাপট থেকে তার যে অর্জন, যাকে আমরা ইতিহাস বলতে পারি, ঐতিহ্য হিসেবে নির্ধারিত করে থাকে, কিংবা উত্তরাধিকার রূপে গণনা করি, তারই সময়োচিত সম্প্রসারণ, এই এগিয়ে যাওয়ার কাজটি যথোচিত করে তোলে। বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োগের দ্বারা এটি যেমন সম্ভব, অন্য দিকে জীবন-প্রবাহের অনিবার্য তাগিদ থেকেও তা ঘটতে পারে। তবে প্রায় সময়েই দুটির উপস্থিতি সমান্তরাল। আসলে যে কোন জনগোষ্ঠীতেই উৎপাদন-ব্যবস্থ্ াএকটি মৌলিক বিষয়। মানুষের পারস্পারিক সম্পর্ক, পারিবারিক বন্ধন কিংবা সামাজিক অবস্থান,―সবই স্থিরীকৃত হয়ে থাকে এই উৎপাদন ব্যবস্থারই দ্বারা। আর এটাও সত্যি যে, সম্পদের উৎপাদন নয়,  মালিকানার ভিত্তিতে, তার বণ্টনের প্রক্রিয়াই সমাজে শ্রেণি বৈষম্যের কারণ। হতে পারে এগুলো পুরানো কথা, কিন্তু তা পুনরুক্ত করার কারণ, এটাই হলো সমাজ কাঠামোর বাস্তবতা। সম্পদের মালিকেরাই সৃষ্টি করে কায়েমি স্বার্থবাদের,―পরিণত হয় সুবিধাভোগী শ্রেণিতে। এর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপরে যে নির্যাতন ও নিগ্রহ, তা থেকে জন্ম নিতে থাকে মুক্তি লাভেরও অদম্য বাসনা। এটিকেই, বলা যেতে পারে, ঐতিহাসিক অনিবার্যতা। এটাও দেখা যায়, সমাজে নতুন চিন্তার উন্মেষ ও প্রগতিশীল পরিবর্তনের ধারা কায়েমি স্বার্থবাদীদের কাছে সব সময়েই অগ্রহণযোগ্য হয়। তবে, এ বিষয়ে মানুষ যে সব সময় সচেতন, তা নয়। এই সচেতনতার কাজে তখনই আসে ব্যক্তির ভূমিকা। অন্যভাবেও, বোধ করি, কথাটা বলা যেতে পারে, তা হল, সময়ই তাকে দিয়ে এই কাজটি করিয়ে নেয়। তার সৃজনশীলতাই বিকশিত করে বুদ্ধিবৃত্তিকে। আর আমাদের জনগোষ্ঠীতে, একটি বিশেষ ঐতিহাসিক কালে, নজরুলও, করেছেন তা।  

এটা ঠিক যে, মানুষের বেড়ে ওঠার কোনও সরল পথ নেই। তার জন্ম-গ্রহণ ইচ্ছা নিরপেক্ষ। কেউ-ই তো আর ঠিক করে আসতে পারে না, কোথায়, কোন সময়, কিভাবে জন্ম নেবে। হতদরিদ্রের গৃহে জন্ম নেয়াটা অভিশাপ বলে বিবেচনা করা ছাড়া অন্য কোন উপায়ও থাকে না। আবার অনেকে মুসলমান কিংবা হিন্দু হয়ে কিংবা আরও কিছু হয়ে পৃথিবীতে আসাটা গৌরবের ব্যাপার বলেও ঘোষণা করতে কসুর করে না। এ সবই অবশ্য বয়োবৃদ্ধি কালের ফলাফল। বরং প্রতিনিয়ত প্রতিকূলতার মুখোমুখি স্বস্তিহীনতার শিকার হয়ে থাকাটাই যেন নিয়তি। নজরুলই বা তার ব্যতিক্রম হবেন কি করে ? যে বঙ্গভূমিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার শাস্ত্রশাসিত ধর্মীয় বিভাজন একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়। এখন কথা হলো, ধর্ম ঠিকই আছে। তার আধ্যাত্মিকতা―তার মঙ্গলামঙ্গলের বিধান কিংবা মানবসমাজে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অনুশাসন―এগুলো নিয়ে বিতর্কেরও কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব সমস্যা হল, তার অনুসারীদের বিভাজন। ইহলৌকিক জগতে এই সব অনুসারীদের আধিপত্য বিস্তারের উদগ্রতা মুখ্য করে তুলেছে বল প্রয়োগকেই। শুধু আন্তঃধর্মের ক্ষেত্রে নয়, অন্তঃধর্মের বেলাতেও এটা সত্য। খ্রিস্টান-মুসলমানদের ধর্মযুদ্ধ যেমন ইতিহাসকে করেছে কলঙ্কিত, তেমনই ইসলামে শিয়া-সুন্নিদের অন্তর্কলহ কসুর করছে না রক্তপাত ঘটাতে। এই ভারতবর্ষেরই এক দল আলেম বলেছিলেন দারুল হরবের কথা। তার অর্থ ধর্ম-কর্ম করাটাও হয়ে উঠেছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আবার আরেক দল আলেম বলেছিলেন দারুল ইসলাম। কোন সমস্যা নেই ধর্ম পালনের। মোদ্দা কথা হলো, এই সব অনুসারীদের উন্মত্ততার জন্যই নানা শাস্ত্রশাসিত ধর্ম নিয়ে কথা বলাটা এমনিতেই স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। নানাজন নানাভাবে তার ব্যাখ্যা দিয়ে কোনটা সঠিক, আর কোনটা বেঠিক, তা নিয়েও সৃষ্টি করে রেখেছেন ধূম্রজালের। ধর্ম পবিত্র জিনিষ। তা নিয়ে কোন কথা নেই, কিন্তু আমি যা বলতে চাই, তা হল, এই ধর্মীয় বিবেচনা থেকেই সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য বোধ যেমন নির্দিষ্টতা পেয়েছে, শিল্প-সাহিত্যের ভাগাভাগিতে উৎসাহিত করেছে, আবার রাজনৈতিক ধারাতে রাষ্ট্র গঠনও ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। যদিও এ দুটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকজনের জাতিত্ব এক এবং ভাব প্রকাশের মাধ্যমও এক―বাংলা ভাষা। বলা যেতে পারে, এই ভাষাই নির্ধারণ করে দিয়েছে জাতিত্ব―বাঙালি।

এখানে, মনে হয়, আরেকটি বিষয়ও বিবেচনার মধ্যে আনা, অন্যায্য নয়। সাধারণভাবে, বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের প্রসঙ্গটাই আমাদের আলোচনাতে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। কিন্তু এ দেশে বসবাসরত অবাঙালি মুসলমানের ভাষা ও সংস্কৃতি বাঙালি মুসলিম মানসে কতটা আধিপত্য বিস্তার করে যৌক্তিক চিন্তার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে, তা অনালোচিতই থেকে যায়। এটার একটা কারণ হলো, ধর্মীয় সংস্কৃতি ব্যতিরেকে বহিরাগত মুসলমানদের আনা অন্যান্য সংস্কৃতিকেও বিবেচনা করা হয় ইসলামি সংস্কৃতি বলে। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ কিংবা খাদ্যাভ্যাসকেও অনেকে পরিগণনা করে থাকেন ধর্মীয় পবিত্র বিষয় হিসেবে। ভাষার ক্ষেত্রে তো ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আরও মারাত্মক। আরবি ভাষাতে নাজেল হয়েছিল কোরান শরিফ। মুসলিম সমাজে এই ভাষার আলাদা মর্যাদা নিয়ে বিতর্ক করার কিছু নেই। কিন্তু আরবি ছাড়া অন্যান্য বহিরাগত মুসলমানদের ভাষাকেও মনে করা হয় ইসলামি। এ প্রসঙ্গে আমি আর যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো, ভাষিক কিংবা অন্যান্য সংস্কৃতির সংমিশ্রণ খুবই সাধারণ ঘটনা। এক জনগোষ্ঠীরর সঙ্গে আরেক জনগোষ্ঠীর দেওয়া-নেওয়া সংস্কৃতিগত সমৃদ্ধিরই পরিচায়ক। বাংলা ভাষাতে আরবি-ফারসির ব্যবহার আমাদের প্রকাশভঙ্গীকে কতটা শক্তিশালী করেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলারও  কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু সেটাকে যদি ধর্মীয় দায়িত্ব পালনের অঙ্গীভূত করা হয়, কিংবা নজরুল, তাঁর কবিতাতে এ সব শব্দ ব্যবহার করে একই কাজ করেছেন, তার যৌক্তিক ব্যাখ্যাই বা কীভাবে দেওয়া সম্ভব ? 

এখন প্রশ্ন হল, এ ধরনের মনোভাব তৈরির একটা উত্তর, বোধ করি, এভাবে দেওয়া যেতে পারে। অবাঙালি পির-ফকির-আউলিয়া-দরবেশগণ ইসলাম প্রচারের জন্য এ দেশে এসেছিলেন, এটা একটা দিক। কিন্তু রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের ঘটনাটা যখন শুরু হয়, তখন থেকে প্রবলভাবে বদলে যায় এখানকার সামাজিক প্রেক্ষাপট। যার সূচনা তুর্কি মুসলমানদের দ্বারা। হাতে, ছড়িই বলি, আর তলোয়ারই বলি, থাকার সুবিধাই অন্য রকম। সুতরাং গোটা মধ্যযুগজুড়ে ক্ষমতা ছিল যাদের কাছে, সামাজিক নেতৃত্বও ছিল তাদের। আর তারা তো বাঙালি ছিল না। আধুনিক যুগে এসেও, ইংরেজ আমলে, মুসলিম লীগের নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি পরিচালিত হতে থাকে অবাঙালিদের দ্বারাই। এই অবাঙালি মুসলমানেরা বাঙালি মুসলমানদের সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করত, তার একটা ধারাবাহিক পরিচয়, বোধ করি, পাওয়া যায়, একবারে বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে আইযুব খানের লেখা প্রভু নয় বন্ধু গ্রন্থেও। সুতরাং,

সামাজিক প্রতিষ্ঠাহীন বাঙালি মুসলমানের মানসিক জাড্যত্ব এ ভাবে গড়ে ওঠা, বিচিত্র কি!

এ কথাগুলো বলছি, তার কারণ হলো, শিল্প-সাহিত্যের রস সৃষ্টির জায়গাটাতে নজরুল কিভাবে আসেন, সে প্রশ্ন তো পরের; কিন্তু তিনি তো হয়ে উঠেছেন, একটি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে তাঁর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা, স্বসমাজের ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আপোষহীনতা, সামাজিক অসাম্যের বিপরীতে তাঁর দৃঢ় অবস্থান, কিংবা শোষণ ও নির্যাতনের বিপক্ষে প্রতিবাদী উচ্চারণ,―সবই তাঁকে রূপান্তরিত করেছে মানব মুক্তির দিশারি হিসেবে। বাঙালি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে, মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র দিনেও তাঁর উপস্থিতি ছিল সতত উজ্জ্বল। কিন্তু এমনটি হয়ে উঠবার পথে যে চাপ তাঁকে নিতে হয়েছে, যে ধরনের প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করতে হয়েছে, কেবল তার বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনাই তাঁকে আমাদের সামনে করে তুলতে পারে পূর্ণাঙ্গ। ধর্ম, সমাজ, কিংবা সংস্কৃতি চিন্তার ক্ষেত্রে যে বিভ্রমতা এখনও আমাদের জনজীবনকে ঘিরে রেখেছে, তা থেকে উত্তরণের পথও এটাই।

কিন্তু সমস্যা তো আমাদেরও রয়েছে। যেমন ধরুন, নজরুলকে, বিশেষ ভাবে, বলা হয়, বাঙালির কবি। কিন্তু আমাদের এই বাঙালিত্ব নির্ণয়ের মাপকাঠি কী ? একটা উত্তর হতে পারে, যাদের মাতৃভাষা বাংলা। এটা তো, একটা কমন সংস্কৃতি। এর বাইরে সাংস্কৃতিক ভিন্নতাও তো রয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতি পালনের সূত্রে এর পরিধি সম্পূর্ণ আলাদা। পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে এই ভিন্নতা অনেকটাই কমে এসেছে, কিন্তু এক সময় ধুতি-লুঙ্গি দিয়েই  হিন্দু-মুসলমান চেনানো হতো। খাদাভ্যাসের ব্যাপারও তাই। সুতরাং ভাষা এক হলেও, ধর্মসূত্রে প্রধানত দুই সম্প্রদায়ের লোক নিয়েই বাঙালী জনগোষ্ঠী গঠিত। আর নজরুল এক সম্প্রদায়ের লোকের জন্য ইসলামী গান লিখেছেন এবং অন্য সম্প্রদায়ের লোকের জন্য শ্যামাসঙ্গীত। এখন কথা হল, দুধরনের দুটো মাছের ভাগ পাশাপাশি রেখে দিলেই কি তা এক হয়ে গেল ? আর নজরুলও হয়ে গেলেন বাঙালির কবি। দুটো ভাগকে অর্থাৎ অস্তিত্বের স্বাতন্ত্র্যকে অতিক্রম করে তার ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে কি একীভূত হওয়া সম্ভব ? আসলে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সমন্বিত অবস্থানের ভেতর দিয়ে জাতীয়তাবোধের যে বিকাশ, তার আবেগগত দিকটা ধারণ করাই বাঙালিত্ব। নজরুলের ভেতর এই জিনিসটা কীভাবে হয়েছিল, তার সূত্র ব্যাখ্যা কিন্তু আমরা কখনও করি না। আসলে, আমাদের সমাজ-দর্শনে মানুষকে ধ্যেয় করার প্রসঙ্গটি অনালোচিতই থেকে যায়। সার্বজনীন মানবিক বোধটাও যথার্থ ভাবে ধরা পড়ে না। গান, তা সে ইসলামিকই হোক, আর যাই হোক, তার ভেতর দিয়ে মানব মনের যে আনুভূতিক উৎসারণ ঘটে, তা যথার্থ অর্থেই পাত্র-নিরপেক্ষ। তখন আর এটি ধর্মীয় বিবেচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। সংকীর্ণ অর্থে তাকে গ্রহণ করারও সুযোগ নেই। ধর্মেরও যে সার্বজনীনতা রয়েছে, মানব কল্যাণের যে পরিশুদ্ধতা, তারই প্রকাশ ঘটে তার মধ্যে। শুধু গান নয়, নজরুল সাহিত্যের অন্যান্য শাখাতেও লক্ষ করা যায় একই ব্যাপার। ধর্মীয় ও পৌরাণিক উপাদান, তিনি যেখান থেকেই নিন, কিংবা যে ভাবেই তার উল্লেখ করুন, তার রূপকায়িত ভাবটাই সেখানে হয়ে ওঠে প্রধান। খলিফা ওমর হয়ে ওঠেন সাম্যের প্রতীক। সেনাপতি খালেদ হন নির্যাতিত মানুষের মুক্তিদাতা। এমন কি দেবী দুর্গাও হন পারধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার উপলক্ষ। বিশেষ কালের কিংবা বিশেষ সীমার মধ্যে এগুলো আর সীমাবদ্ধ থাকে না। ধর্মের স্বাতন্ত্র্যবাদিতা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে অন্য অর্থেও। কেন না, নতুন ধর্ম আসার যেমন সুযোগ নেই, তেমনই কোন সম্ভাবনাও নেই, বোধ হয়, ধর্মীয় পুনর্জাগরণেরও। আমাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাও এটা প্রমাণ করে যে, ধর্মীয় পুনর্জাগরণের আন্দোলনের দ্বারা বিরাজমান ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্মাচরণের পরিবর্তন কতটা হয়েছে, তা বলা মুশকিল। তবে তা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সৃষ্টি করেছে নতুন বিভাজনের, এটা স্পষ্ট। কাজেই, নজরুলকে বাঙালির কবি হিসেবে চিহ্নিত করার আগে আমাদের বাঙালিত্বের বোধটাকে নতুন করে ঝালাই করে নেওয়া দরকার।

এখন প্রশ্ন হলো, এই এগিয়ে যাওয়ার কাজটি নজরুল কীভাবে করেছেন ? আমাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাটা এ কারণে পর্যালোচনা করা জরুরি। মানবসৃষ্ট সভ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেয় তার হাতিয়ারের ব্যবহার। এই হাতিয়ারের ব্যবহারের ভেতর দিয়েই তার বিজ্ঞান-বুদ্ধিও বিকশিত হতে থাকে। একবারে প্রাথমিক স্তরে এই বিজ্ঞান বুদ্ধি সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা কতটুকু ছিল, আজকে তা নিয়ে বড়জোর আন্দাজ করা যেতে পারে। এখনও যে মানুষের বিজ্ঞান-বুদ্ধি পরিণত হয়েছে, সে কথাও কি বলা যাবে ? তবে, এ ঠিক যে, তার কার্যকারিতা সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা সে অর্জন করেছে। ইতিহাসের একটা স্তরে দেখা যায়, বিজ্ঞান-বুদ্ধির কার্যকারিতার অস্পষ্ট বোধ থেকেই সমাজে মানসে জন্ম নিয়েছে অদৃষ্টবাদ। নিজের যখন কিছু করার থাকে না, তখনই আসে ভাগ্যের হাতে সব কিছু সঁপে দেওয়ার। নিয়তি বলে একটা কথার চলও, বোধ করি, এখান থেকেই। আপনারা তো জানেনই, পাঠ্য বইয়ে এ সময়টাকে বলা হয়েছে, বিশ্বাসের যুগ। সেখান থেকে যুক্তির যুগের সূচনা কীভাবে হয়েছে, তা-ও আপনাদের অজানা নেই। বঙ্গদেশীয়, তথা ভারতবর্ষীয় জীবনে এই ধাক্কাটা এসেছিল ঔপনিবেশিকতার সূত্রে। আমাদের অদৃষ্টবাদী সমাজে ইংরেজি ভাষাবাহিত শিক্ষার ফলাফল এটা। তবে, এই শিক্ষা প্রয়োগের প্রকৃতি, হিন্দু ও মুসলমানদের ভেতর, বোধ করি, এক রকম নয়। আর নয় বলেই, এক দেশে থেকেও, রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা অক্ষয়চন্দ্র দত্তের, ন্যূনধিক, একশ বছর পরে আমরা পেলাম মহিয়সী রোকেয়া, নজরুল কিংবা মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিনকে;―ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজের সারথিদের।

ব্যাখ্যা এর একটা আছে নিশ্চয়ই। এখন হয় কি না, তবে, বাল্যকালে আমাদের শেখানো হয়েছে, দেশের রাজা ছিল মুসলমানেরা, তাদের কছে থেকে ইংরেজেরা রাজ্য কেড়ে নিয়েছে। আমরা ছিলাম রাজার জাত, আর এখন পথের ভিখারী,―এই রকম আর কি! একটা স্বপ্নময় অতীতচারিতার ভেতর শামুকের মতো রাখার ব্যবস্থা। প্রথম কথা,―বিজিতদের পরিচয় ধর্মকেন্দ্রিক, বিজয়ীদের জাতিক। এই পরিচয় কন্ট্রাডিক্টরি। তারপর ইংরেজদের রাজ্য বিস্তারের কালে ভারতবর্ষে কোন কেন্দ্রীয় শাসন ছিল না। আবার বিভিন্ন অঞ্চলে যারা শাসক―সামন্ত নরপতি ছিল, তারা সবাই মুসলমানও নয়। দ্বিতীয় কথা, ―ইংরেজরা নিয়ে এসেছিল, ঔপনিবেশিক হলেও, একটা নতুন উৎপাদন ব্যবস্থা, যা সূচনা করেছিল একটা নতুন সভ্যতার। ভারতীয় সমাজ পুরনো ব্যবস্থা, কি হিন্দুর, কি মুসলমানের, এতটা প্রাণশক্তি ছিল না যে তা প্রতিরোধে সক্ষম। কাজেই এই পরাজয় শুধু ব্যক্তির নয়, সামগ্রিক অবস্থারই। কাজেই ইংরেজবিরোধী বিভিন্ন সশস্ত্র সংগ্রামে স্বদেশ প্রেমের যত পরাকাষ্ঠাই লক্ষ্য করা যাক না কেন, কিন্তু যুগোপযোগী হবার নয়। পরবর্তী সময়ে ইংরেজ বিতারণ সম্ভব হয়েছিল নতুন প্রাণশক্তি আহরণ করেই, এটাই আমার কথার বড় প্রমাণ।

আমার মনে হয়, মুসলমানদের ইংরেজি ভাষাবাহিত শিক্ষা গ্রহণের মাঝেও একটা বড় রকমের ফাঁকি ছিল। এটা ঠিক যে, এক দল আলেম যেমন বলেছিলেন, ইংরেজি শিক্ষা হারাম; আবার আরেক দল আলেম এই শিক্ষা গ্রহণের স্বপক্ষেও মত দিয়েছিলেন। এটা একটা ব্যাপার তো ছিলই। কিন্তু সিপাহি বিদ্রোহের পরে সৈয়দ আহমেদ খান মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা বিষয়ে যে ঘোষণা দেন, সেখানে প্রতিবেশী হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার প্রসঙ্গটি এসেছে মুখ্য হয়ে,―জ্ঞান চর্চার নয়। ভাষা শিক্ষা করা এক জিনিস, আর ভাষাবাহিত জ্ঞানভাণ্ডার আয়ত্ত করা অন্য জিনিস। রাজা রামমোহন রায় কিংবা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো কেউ বলেছেন, টোল-চতুষ্পাঠীর শিক্ষা নয়, একটি আলোকপ্রাপ্ত সমাজ গঠনের জন্য যে শিক্ষা দরকার, তাই দিতে হবে। উত্তর ভারতীয় অবাঙালি মুসলিম নেতৃত্বের প্রভাব এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, সাধারণ বাঙালি মুসলমান, যারা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠাহীন, তাদের অবকাশই ছিল না অন্যভাবে চিন্তা করার।   

জ্ঞান চর্চার ব্যাপারটা তো গেল এ রকম, বাংলা ভাষা চর্চার ক্ষেত্রটিও ছিল না প্রতিবন্ধকতাহীন। আরবি ছিল কোরআন শরিফের ভাষা। ফারসি ছিল মুসলিম সংস্কৃতির ভাষা। আর উর্দু ছিল উত্তর ভারতীয় তো বটেই, বাংলাদেশে বসবাসরত অবাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা। এর বাইরে অন্য ভাষার চর্চার বিষয়টি ছিল অপ্রত্যাশিত ও কার্যত অনুমোদনহীন। ইংরেজদের কাছ থেকে নবাব উপাধি পাওয়া বাঙালি আবদুল লতিফ পর্যন্ত বলেছেন, বাংলা নিম্ন শ্রেণির মানুষের মাতৃভাষা। তবে, একটা কথা আছে না, আল্লার মার দুনিয়ার বার। সেই রকম একটি ঘটনাই ঘটতে থাকে তৎকালীন বাংলাদেশে। খ্রিস্টান মিশনারিরা শুরু করে খ্রিস্টধর্মের প্রচার। সেটাকে আরও ভালোভাবে করার জন্য নিয়ে আসে মুদ্রণ যন্ত্র। বাংলা ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ তো বটেই, আরও আরও ধর্মীয় মাহাত্ম্য প্রচারের বাহন হয়ে ওঠে তা। এ অবস্থায় ধর্মান্তরকরণ প্রচেষ্টা ঠেকানোর জন্য যেমন তৎপরতা শুরু হয় হিন্দু সমাজে তেমনই মুসলিম সমাজেও। মাতৃভাষা বাংলাই হয়ে ওঠে তার মাধ্যম। বাঙালি মুনশি-মওলানারা এগিয়ে আসে এগিয়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর, বিশেষত শেষ দুই দশকে দেখা যেতে থাকে বাঙালি মুসলিম সম্পাদিত ও পরিচালিত নানাবিধ পত্রপত্রিকা। এভাবেই সাধারণ বাঙালি মুসলিম সমাজে তৈরি হয় বাংলা ভাষাচর্চার একটি শক্ত ভিত্তি। বাঙালি মুসলিম লেখকেরাও বিতর্ক এড়িয়ে ঘোষণা দিয়ে মাতৃভাষা বাংলাকেই তাদের শিল্পসাহিত্যের মাধ্যম করে তোলেন। বলা যেতে পারে, এই একটি জায়গায় অন্তত অনুকূল ক্ষেত্র পেতে তারা সমর্থ হয়েছিলেন।

মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৬ সালে। নজরুলের তখন একবারেই বাল্যকাল। সাধারণভাবে অবিভক্ত বেঙ্গলের মুসলমানদের মধ্যে সামাজিক প্রাধান্য ছিল অবাঙালি সামন্ত ভূস্বামী, বিশেষ করে ঢাকার নবাব পরিবারের হাতে। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নেতৃত্বও দেয় তারাই। ততদিনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপটের বিস্তার ঘটতে থাকে। কলিকাতা কেন্দ্রিক ব্যবসাবাণিজ্যের সূত্রে এক শ্রেণির বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে ইংরেজদের একটা সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি হয়। ব্রিটিশ আধিপত্য-বিস্তার প্রক্রিয়ার প্রথম একশ বছর ধরে তার মধুচন্দ্রিমাও চলে। এই সময়ে যেমন ইংরেজি ভাষাবাহিত শিক্ষা অর্জনের ভেতর দিয়ে তাদের মনোজগতের একটা আধুনিক ভিত্তি স্থাপিত হয়, অনুরূপভাবে পুুঁজিরও সঞ্চয় ঘটে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলেও সেই পুজি বিনিয়োগের দ্বারা তাদের মধ্যে একটা ধনিক শ্রেণির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তবে ঔপনিবেশিক অর্থনীতির কারণে দেশীয় পুঁজি বিকাশের পথ ছিল রুদ্ধ। এবং মূলত পুঁজি বিকাশের প্রয়োজনেই, বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা দানা বাঁধতে থাকে। সে সময়ে ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি’ বলতে তো শুধু বর্তমানের বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বঙ্গ প্রদেশ তার অন্তর্ভুক্ত ছিল না, বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ ও আসামের কিছু অংশের অন্তর্ভুক্তি ছিল তাতে। এর লোকসংখ্যা ছিল সমগ্র ভারতবর্ষের এক-তৃতীয়াংশ। ফলত তখনকার ব্রিটিশবিরোধী চেতনাকে মোকাবেলা ও প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানোর কথা ভেবেই নতুন একাধিক ইউনিট করার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। ব্রিটিশ সরকার ১৯০৫ সালে, যার নাম ছিল বেঙ্গল প্রভিন্স ভাগ করে পূর্ববঙ্গের সাথে আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বিহার ও উড়িষ্যার কিছু অংশজুড়ে দেয়। এই ঘটনাকেই ইতিহাসে বঙ্গভঙ্গ বলে খ্যাত করা হয়েছে। একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, নব গঠিত দুটো প্রদেশের সঙ্গেই অবাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল যুক্ত করা হয়েছিল। কেবল বাঙালি মুসলমানদের কথা ভেবে এটা করা হয়নি। কিন্তু কার্যত ব্রিটিশ সরকার তাদেরকে এতটাই মোহগ্রস্ত করতে সক্ষম হয়েছিল, যাতে, হিন্দু ও মুসলিম―এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে রোপিত হয় বিরোধের বীজ। ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ বলে যে কথাটি প্রচলিত আছে, তার বাস্তব প্রয়োগের সূচনা ঘটে এখান থেকেই। আর মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাই হলো তার তাৎক্ষণিক ফলাফল।

এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা, বোধ করি, উল্লেখ করা যায়। তা হলে, অনেকেই বলে থাকেন, ১৯০৫ সালে যে বঙ্গভঙ্গ, তারই ধারাবাহিকতা রয়েছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এটাকে আসলে গ্রহণ করা যায় না এ কারণে যে, শুধু মুসলমানদের বসবাসের জন্য বাংলদেশের সৃষ্টি হয়নি। বাংলাদেশ তো একটা অর্জন। আর এই অর্জনকে ঘিরে রয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতার চেতনা। আবার আসাম প্রদেশও এর অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

ওপরের এই কথাগুলো বলার কারণ হল, হিন্দু ও মুসলিম,―এই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের স্বাতন্ত্র্যবাদী চেহারার উগ্র প্রকাশের যে রাহুগ্রস্ততা, তা কেটে যেতে থাকে নজরুলের অপরিণত বয়সেই। ফলে, তার কোনও প্রভাবও পড়েনি তার মনে। বরং পরবর্তী সময়ে হিন্দু-মুসলিম মৈত্রীর সুবাতাসই তিনি গায়ে মেখেছেন বেড়ে উঠবার কালে। এটা দেখা যায়, শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরু থেকে ভারতীয় মুসলিম সমাজে বৃটিশ বিরোধিতার আভাস স্পষ্ট হতে থাকে। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহকেও হিন্দু-মুসলিম মিলনের অগ্রদূত উপাধি দেওয়া হয়। মুসলমানদের একই সঙ্গে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগে থাকাটাও ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বিশেষ করে, প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী কালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন আর মওলানা শওকত আলি ও মোহাম্মদ আলির খেলাফত আন্দোলনও চলে যুগপৎভাবে। সুতরাং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই আবহাওয়াটা হয়ে ওঠে তাঁর বাকি জীবনের পথপ্রদর্শক। দুই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাদানকে তিনি শিল্পে নিয়ে আসেন সংকীর্ণ ধর্মীয় অর্থে নয়, রূপ দেন মানবিকতার সার্বজনীন সম্পদে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের রাজনীতিও ছিল এই ধারার একটা বড় পরিপূরক। বলাবাহুল্য, পরবর্তীকালের মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ-র দ্বিজাতিতত্ত্ব কিংবা মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাব,―কোনওটাই তাঁকে কোনওভাবে প্রভাবিত করতে পারেনি। উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাও এই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিরই যোগ ফল। এ ভাবেও তিনি বাঙালির কবি।

তবে এরই সঙ্গে আশঙ্কার ব্যাপারটিও যে থেকে যায় না, তা নয়। মানুষের সমাজই বলি, তার জীবন প্রবাহের কাঠামোই বলি, তার উচ্চাকাক্সক্ষাই বলি,―সবই সতত পরিবর্তনশীল। এক জন জীবিত মানুষকে পাওয়া, আর তার ইতিহাস হয়ে যাওয়া,―দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে নিশ্চয়ই। বিশেষ করে ইতিহাস হয়ে যাওয়াটাই মহাকালের ধর্ম। নজরুলের সৃজনশীল জীবনের দিকে তাকালে, তা যে ইতিমধ্যেই অনেকটা সময় অতিক্রম করে ফেলেছে, সে কথা বলাই যায়। এই সময়ের মধ্যে জাতি, রাষ্ট্র, কিংবা বৈশ্বিক তত্ত্ব ইত্যাদিতেও ঘটেছে নানান পালাবদলের। জাতিত্বের কথাটাই ধরা যাক। নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যকেই একদা জাতিত্বের সূচক বলে মনে করা হত। সংস্কৃতিগত কারণে যখন বিভিন্নতা আসতে থাকে, তখন নতুন করে নির্ধারণের প্রয়োজন পড়ে জাতিত্বের সংজ্ঞার। এ থেকে আবার এক জাতি―এক রাষ্ট্রের অনিবার্যতাও দেখা দিতে থাকে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাও, বলা যেতে পারে,এই জাতিত্ববোধেরই প্রতিফলন। রাষ্ট্রের ব্যাপারটা তো আগে ছিল আরও আলাদা। কৌতুক করে হলেও, অন্ততঃ, মধ্যযুগ পর্যন্ত, অর্থাৎ সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার ধারা যত দিন বলবৎ ছিল, এটাকে তলোয়ার ঘোরানোর দাপট বলেও আখ্যায়িত করা যায়। এর পর তো ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ব্যক্তিতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। তখন ব্যক্তিতন্ত্রের মানেটা দাঁড়িয়েছিল একক মানুষের মুক্তি,―তার ব্যক্তি-স্বাধীনতার নিশ্চিতি,―তার অধিকার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। এর সঙ্গে আরও আরও যে বিষয়গুলি যুক্ত হতে থাকে, তার সূত্র ধরেই বলা যায়, যেমন ধরুন, ব্রিটিশ আমলে এ দেশের মানুষ প্রথম উপলব্ধি করে যে, তারা একটি ঔপনিবেশিক শাসন দ্বারা শৃঙ্খলিত। তার আগেও তো বহিরাগত মানুষেরা এসেই এ দেশ শাসন করেছে, কিন্তু নিজেদেরকে তো মনে করেনি পরাধীন। তার কারণ, সমাজ-মানসের বোধই তখন ছিল অন্য রকম।

আমার মনে হয়, ধনবাদী সমাজে ব্যক্তিতান্ত্রিকতার বোধ শুধু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকেই চিহ্নিত করেনি। সমাজ-পীড়িত মানুষকে তা যেমন মুক্তি দিতে থাকে, একই সাথে তা ধ্যেয় করে তোলে মানুষকেও। আর সামাজিক শ্রেণি বৈম্যের কারণে মানুষের কল্যাণকামিতার বিষয়টিও যুক্ত হয় এর সঙ্গে। সমাজতন্ত্রের শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের কথাটি তো আসে আরও পরে। তার আগে অধিকতর মানুষের জন্য অধিকতর কল্যাণ সাধনই হয় সামাজিক কমিটমেণ্টের বিষয়। নজরুল-মানসে এর একটা যোগসূত্র তো রয়েছেই। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তির, তা যেমন রাজনৈতিক, একই ভাবে তা সামাজিক মঙ্গল সাধনেরও। এটি তো আছেই, আবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনও। তাই বলা যেতে পারে, তাঁর ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, আর হাতে রণতূর্য’―কোন ভিন্ন ব্যাপার নয়। তা সামগ্রিকতা বোধেরই একটা অংশ। তিনি যখন ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া ওঠেন’, তার ভেতর দিয়ে যেমন দুষ্প্রধর্ষ রোমাণ্টিক চেতনার প্রকাশ তাঁর আত্মার মুক্তি ঘটায়, অনুরূপভাবে ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’-এর মধ্যে যে সামাজিক কমিটমেণ্টের পরিচয় পাওয়া যায়, তা-ও অংশ হয়ে ওঠে ওই অখণ্ড সত্তারই।  

যা হোক, জাতি কিংবা রাষ্ট্র,―এগুলো নিয়ে আমা এত কথা বলার উপলক্ষ্য হল, বর্তমান সময়ে আমরা এই প্রেক্ষাপটটাকে সম্ভবত অতিক্রম করতে চলেছি। এটা ঠিক যে, আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখন অনেক আগ্রাসী। ব্যক্তির বেড রুম পর্যন্ত ধাওয়া করতে সে পরাক্সমুখ হচ্ছে না। কিন্তু জাতি ও রাষ্ট্রের যে ধারণা, আমরা, যা প্রায়, তিনশ বছর ধরে লালন করে আসছি, তার আনুভূতিক নির্ভেজ লতাই বলি, আর উদগ্রতাই বলি, ব্যক্তি পর্যায়ে সেটা ধীরে ধীরে কমেই আসছে। রুটি-রুজির অর্থাৎ জীবিকার হিংস্র ছোবল থেকেই হোক, আর উন্নত জীবন যাপনের স্বাচ্ছন্দ্য থেকেই হোক, ―জাতিত্ব যাই হোক, বদলে ফেলছিল রাষ্ট্রীয় জাতীয়তা। এটা এখন হয়ে গেছে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। বঙ্গ সন্তানের আর অস্ট্রেলিয়ান কিংবা কানাডিয়ান ইত্যাদি হতে চেষ্টা-চরিত্রে কমতি দেখা যাচ্ছে না। এটাও হয়ত ঠিক যে, বাংলা ভাষা-সাহিত্য কিংবা বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি তাদের অনুরাগেরও শেষ নেই, কিন্তু বাস্তববতা তো ভিন্ন জিনিস। এগুলো যে এক সময় শো কেসে রাখার সামগ্রী হয়ে উঠবে, সেটাও তো প্রায় অবধারিত। রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল সেখানে কোথায় থাকবেন, কিংবা থাকবেন কি না, তাই বা বলা যায় কী করে ? আমাদের দেশেও তো আরব-ইরান থেকে আসা লোকের অভাব নেই। তাদের ক্ষেত্রেই বা কি দেখছি ?

এ সব তো গেল, না হয়, দূর দেশের ব্যাপার হয়ে! কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিয়টা কি দাঁড়াচ্ছে ? নজরুলকেই নেওয়া যাক, কেস-স্টাডি হিসেবে।

পূর্বেই বলেছি, ঔপনিবেশিক শাসন কালের সে সময়টা ছিল ভৌগোলিক সাম্রাজ্যবাদের। ইংরেজদের শাসন ও খবরদারি ছিল নিত্যদিনের। এ রকম একটা শোষক শক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের সংগঠিত করার জন্য অতীতকে সোনালি করে পুনরুজ্জীবিত করার প্রশ্নটি এসে গিয়েছিল স্বাভাবিকভাবেই। এ জন্যই, বোধ করি, বাঙালি বঙ্কিমচন্দ্রও রাজপুত বীরপুরুষদের হিরো বানিয়ে ফেলেছিলেন অবলীলাক্রমে। বাঙালি মুসলমানদের কাছেও তুর্কি-আফগান-মুঘলেরাও অভিষিক্ত হয়েছিল একই মর্যাদায়। ঐতিহাসিক তথ্যগত বিভ্রান্তিও দমাতে পারেনি সে আবেগকে। যেমন, সিরাজদ্দৈালা। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব হিেেসবেই এসেছিলেন আমাদের কাছে। এবং এখন আছেন সে রূপেই। অথচ ইতিহাস বলে, তখনকার বাংলার নবাবী ছিল মুঘল সম্রাটের সনদ প্রাপ্ত। আর মির কাসিমই ছিলেন বাংলার শেষ নবাব। তা-ও সেটা এসেছিল, একবার তাঁর শ্বশুর মির জাফর, এক বার তাঁর শ্যালক, আরেক বার তাঁর শ্বশুর পুনরায় নবাব হবার পর। বক্সার(১৭৬৪)-এ ইংরেজদের কাছে তিনি পরাজিত হবার পরই শুরু হয় সরাসরি ইংরেজ শাসন। রবার্ট ক্লাইভ, পরে লর্ড, প্রথম গভর্ণর জেনারেল। তার আগে তো, পলাশির যুদ্ধ(১৭৫৭)-এর পর তারা লাভ করেছিল বাংলার দেওয়ানি। তা-ও ঐ মুঘল সম্রাটেরই সনদে।

আসলে এ কথাগুলো আমি বলছি, ইতিহাসের সত্যমিথ্যা নির্ধারণের জন্য নয়। তখন জাতীয় জীবনের প্রয়োজনটাই ছিল মুখ্য। আর তা কার্যকরও হয়েছে প্রচণ্ড রূপে। নজরুলও করেছেন এই কাজটি। আবার তিনি এখানেই থেমে থাকেননি। তাঁর সময়ের তুর্কি বীর কামাল পাশা কিংবা আফগান সম্রাট আমানুল্লা―তাঁদেরকে নিয়েও লিখেছেন কবিতা। এদের এক জন তুরস্ককে নিয়ে নস্যাৎ করে দেন ব্রিটিশ চক্রান্ত। আরেক জন, অন্তত, এক বারের জন্যে হলেও, ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন সরাসরি যুদ্ধে।

আবার এটাও দেখা যায়, ব্রিটিশ শাসন ও তার বিরোধিতা করার শুধু অতীতকে পুনরুদ্ধার করে নিজেদের কাজে লাগানোটাই নয়, তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন তার সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষজনও হয়েছেন তাঁর সৃজনশীলতার উপাদান। সে গিয়েছে বটে, একটা সময়! কিন্তু আজকের প্রজন্ম এটাকে কি ভাবে দেখে, কিংবা আরও আরও পরের প্রজন্ম কি ভাবে দেখবে ? এখন তো আর ভৌগোলিক সাম্রাজ্যবাদ নেই। তার ভয়াবহতার ছোবলও আর প্রত্যক্ষগোচর নয়। সময়ের বাস্তবতা থেকেই গড়ে ওঠে পাঠক রুচি। তখনকার আকাক্সক্ষা ও উচ্চাভিলাষের যে মূর্ত প্রকাশ নজরুলের রচনা থেকে আপন মনের দর্পণে প্রতিফলিত হত, তা এখন আর সম্ভব ? অসহযোগের যে মর্মবাণী ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বুদ্ধদেব বসুর কাছে ফুটে উঠেছিল, সেই বাণীর সন্ধান আজ কজন পাবে ? এ ভাবে দেখলে, সবই ইতিহাস হয়ে গেছে,―নজরুলও হয়ে গেছেন তাই। তা হলে কি, সবাইকে ইতিহাস মুখস্থ করিয়ে ছেড়ে দিতে হবে ?  তাতে, হয়ত, বমন ক্রিয়াটা নিয়মিত হবে। কিন্তু কাজটা হবে কী ?

আর নজরুল তো শুধু নিজেকে রাজনৈতিক আকাক্সক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে রাখেননি। স্বসমাজটাও ছিল তাঁর শিরঃপীড়ার একটা বড় কারণ। ধর্মীয় বিধিনিষেধের নামে প্রচলিত ব্যবস্থাদি, শিল্পসাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ একমুখিতা, নৃত্যগীত―চিত্রাঙ্কন নিয়ে সংরক্ষণশীলতা,―এই রকম আরও আরও বিষয়ে তাঁর মনোভাব কি ছিল, তাও আমাদের অজানা নেই। ব্যক্তি-আত্মার মুক্তির সঙ্গে সমষ্টির কল্যাণও ছিল তাঁর প্রার্থিত। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাও ছিল―তা পরিত্যাজ্য। এই বিষয়গুলিও আর আমাদের মাঝে আগের মতো নেই। এবং এ কথা বলতে কোন দ্বিধাও নেই,  সে সব কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে নজরুলই ছিলেন পথপ্রদর্শক। আর এটাও দেখার বিষয়, শুধু এই মর্যাদাটুকুই তার প্রাপ্য ?

এখন কথা  হলো, নির্দিষ্টভাবেই বলি, যে দুটো বিষয় নিয়ে আমি কথা বললাম, তা তো বস্তুজগতের। নশ্বরতাই তার ধর্ম। এগুলো নিয়ে কথা বলে,―কবিতা লিখে,―গল্প উপন্যাস রচনা করে, নজরুল সময়ের প্রয়োজন মিটিয়েছেন মাত্র। প্রয়োজন মিটে গেছে,―শেষ হয়ে গেছে ও সবও। ব্যাপার অনেকটা এ রকম,―হোটেলে গিয়ে ভাত খেয়ে নিলাম। ঘটনা তো আর তা নয়। এর সাথে এসে যায় আরেকটি প্রশ্নও। তা হল, সাধারণভাবে, মানুষের প্রবৃত্তিগত বিষয়ের একটা চিরায়াত রূপ আছে। প্রেম-ভালোবাসাই বলি, আর করুণা মমতার কথাই বলি, কিংবা হিংসা-বিদ্বেষ-জিঘাংসাও তো বাদ যাওয়ার কথা নয়। এগুলো ধ্বংসও হয় না কালের কুঠারাঘাতে। হৃদয়বৃত্তির এই অবিনাশী রূপটাই প্রবহমান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চিরন্তন হয়ে থাকে। নজরুলের সৃজনশীল প্রতিভায় উজ্জ্বল হয়ে আছে সে সবও। এক জনমে ভালবেসে তাঁর সাধ মেটেনি, ভালোবাসার জন্য তিনি আবারও আসতে চেয়েছেন ধরায়। এ রকম আরও আরও অনেক কিছুই হীরক দ্যুতির মতোই বিচ্ছুরিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনেকে হয়ত বলতে পারেন, আর দরকার কী ? অন্য সব কিছু ঝেড়ে মুছে ফেলে দিলেও তাঁর কালোত্তীর্ণতা নিশ্চিত হয়ে রয়েছেই। কিন্তু এটা তো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেন না, যে কোন সৃজনশীল মানুষকেই প্রেক্ষাপট হিসেবে নিতে হয় তার সময়কে। উপাদান সংগ্রহ করতে হয় তার অবস্থান থেকে। তার চার পাশের মানুষ, পরিবেশ ও সমাজই নির্ধারণ করে দেয় তা। মানুষের স্বপ্ন-কামনা-উচ্চাভিলাষের রূপটাও ফুটে ওঠে সেখানে। এটাকে যদি প্রয়োজন মেটানো বলেন, গড় অথের্, হয়ত, তা ঠিকই আছে। কিন্তু কথা হল, এই প্রয়োজন মেটানোর ভেতর দিয়ে, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটাও হয় চিরচলিঞ্চু। সেটিও একটি সার্বজনীন বিষয়। আর এই সার্বজনীনতা পাওয়া যায় নতুন অর্থের সন্ধান করে। তাকে যুগোপযোগী 

করার ভেতর দিয়ে। অনবরত জীবন প্রবাহের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়ার জন্যই এটা জরুরি। নজরুল আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এখন আমাদের কাজ হল, তাঁকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া।

এ বিষয়টাকে কি, এভাবে দেখা যেতে পারে ? যেমন উপনিবেশবাদের আগের চেহারাটা আর তেমন নেই। ভূমি দখল করে ঘাড়ের ওপর দৃশ্যমান হয়ে থাকার দিন চলে গেছে। প্রত্যেক জনগোষ্ঠীরই সংস্কৃতিগত সচেতনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যে স্বাতন্ত্র্যবোধই হয়ে উঠেছে প্রবল। কেন এটা হয়েছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা দেয়ার সুযোগ এখানে নেই। শুধু বলা যায়, ধনতন্ত্রের নিজস্ব সংকট থেকেই তা ঘটেছে। পণ্যোৎপাদন ও তা থেকে মুনাফা অর্জনই ছিল পুঁজি বিকাশের প্রাথমিক চাহিদা। সে জন্য প্রয়োজন ছিল বাজার দখলের। সেটা করতে গিয়েই অনিবার্য হয়ে উঠেছিল ভৌগলিক সাম্রাজ্যবাদ। তবে তা শেষ পর্যন্ত, শ্রেণি বৈষম্যকে এতই তীব্রতর করে তোলে যে পুরো উৎপাদন ব্যবস্থাকেই ফেলে দেয় হুমকির মুখে। পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনও গতি পেতে থাকে। যা সুযোগ এনে দেয় ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে থাকা জনগোষ্ঠীর আত্মপ্রতিষ্ঠার। একটা পর্যায়ে তো মনে হয়েছিল ধনতন্ত্র এখন চির বিদায়ের পথে। কিন্তু সমাজতন্ত্রের পার্টি বুরোক্র্যাসী পথ তৈরি করে নিতে থাকে আত্মহননের। এই দুর্বলতাকে সামনে রেখে ধনতন্ত্রও পূরণ করে নেয় নিজের ফাঁকফোকরগুলো। তারই ফলাফল হল নব্য উপনিবেশবাদ। এখন ওয়াশিংটনে বসে  থেকেই অদৃশ্য জাল পেতে রাখা যাচ্ছে সারা দুনিয়ায়। আর এই জালকেই, বোধ করি, বলা যেতে পারে বিশ্বপুঁজি। এই বিশ্বপুঁজির আওতায় সারা পৃথিবীটাই কীভাবে নর্তনকুর্দন করছে, তা কি বলে দেবার ? সাদা সাহেবের হাতের বিনি লোহার শিকল বাংলাদেশের কৃষকের পায়েও কি বাঁধা নেই ? এই ব্যবস্থা আগের চেয়েও পাকাপোক্ত। কারণ, দেশীয় পাহারাদারেরাই নিযুক্ত আছে, তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। মালটিন্যাশনাল বলে একটা ইংরেজি শব্দও উচ্চারিত হচ্ছে বেশ আভিজাত্যের সঙ্গে। এই অবস্থাটা নজরুল, নিশ্চয়ই, মেনে নিতে পারতেন না।

আবার দেশীয় সমাজটাকে দেখুন। অঅগাপাস্তলা পরিবর্তনের ঢেউ এসে দোল খাচ্ছে অবিরত তার দেহে। এই পরিবর্তন যতটা পোশাক-পরিচ্ছদের, অর্থাৎ বহিরঙ্গের, অন্তর্জগতের দিকটা সে তুলনায় কতটা উজ্জ্বল, সে বিচার আপনারাই করুন। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ছেয়ে ফেলেছে দেশ, কিন্তু তার বিজ্ঞানটা কি এসেছে আমাদের অভ্যাসের মধ্যে ? ভরসাও তো বেড়ে চলেছে অদৃষ্টবাদী দর্শনের ওপর। ধর্মীয় কুসংস্কার হয়ত কমে এসেছে, কিন্তু নৈতিকতার চেহারাটা দাঁড়িয়েছে কী ? বোধ করি, মানুষের যত অধঃপতন ঘটতে থাকে, ততই প্রয়োজন পড়ে ছিদ্র বন্ধ করার। ধর্মের আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জনের ব্যর্থতা থেকেই, বুঝি, ধুম পড়ে যায় তার আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরের। সামাজিক শৃঙ্খলাও শূন্যতে পৌঁছে যায় বলেই আদি রূপে ফেরার আন্দোলন। এগুলো তো আছেই, এর সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার,―ধর্ম প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বল প্রয়োগের ঘটনা। নজরুল হয়ে আছেন আমাদের জাতীয় কবি, আবার আমরা উস্কানিও দিচ্ছি ধর্মীয় রাজনীতির। আপনি; হয়ত, দিচ্ছেন না, কিন্তু আমি তো দিই! নজরুলের সারা জীবনের অর্জন আমরা ধূলিসাৎ করে দিচ্ছি এ ভাবেই। তাঁর যা অর্জন,এখানেও যদি আমরা তা সঙ্গে না রাখি, তবে আমাদের উত্তরণ ঘটবে কীভাবে ?

নজরুল তো আমাদের জাতীয় জীবনের অংশ। তিনি হয়ে আছেন ইতিহাস। কিন্তু এ বলেই কি তাঁকে ছেড়ে দিলে চলবে ? শুধু প্রশংসা করে করে আলঙ্কারিক ভূষণে মুড়িয়ে রেখে দিলেই কি সব হবে ? আরেকটি কথা হল, শুধু শুধু মৃত মানুষকে প্রশংসা করে লাভ কী ? হতে পারে জীবিত মানুষদের আত্মতুষ্টি। আর কেবল মৃত মানুষের কথাই বা বলছি কেন ? প্রশংসা জিনিসটাই  হলো, একটা তাৎক্ষণিক মূল্যায়নের বিষয়। তার ভেতর দিয়ে একজনের অমরতার উপাদানগুলিকে চলমান জীবনের সাথে জড়িয়ে নেয়া যায় না। আর নজরুলের ক্ষেত্রেও, এই অমরতার উপাদানগুলি যদি আমরা ধরতে না পারি, তবে, কথায় কথায় তাঁকে বিদ্রোহী কবি,―সাম্যের কবি,―প্রেম ও দ্রোহের কবি―মানবতার কবি,―এসব বানিয়ে কি লাভ ? তাঁর বিদ্রোহ, তাঁর সাম্য, তাঁর প্রেম ও দ্রোহ, তাঁর মানবতা,―এসব কিছুকেই আমাদের দরকার। তবে তার একটা প্রায়োগিক দিক রয়েছে। আর এই প্রয়োগটা ঘটাতে হবে আমাদের পরিবর্তনশীল জীবন ও জগতের উপাত্তে। এবং তা থেকে গড়ে ওঠা পাঠক রুচির প্রেক্ষাপটে। সুতরাং তিনি যে ইতিহাস হয়ে রয়েছেন, তার পুনর্পাঠ গ্রহণ করতে হবে বার বার। 

আপনারা এটা নিশ্চয়ই মানবেন যে, বস্তুজগতের ছায়া নিয়েই গড়ে ওঠে মানুষের ভাবজগৎ। সেই ভাবজগতের রঙ-রস-রূপের ভেতর দিয়ে কালের সীমাকে অতিক্রম করে যাওয়ার একটা ব্যাপার থাকে। আর থাকে বলেই বাল্মীকি-ব্যাস-হোমার থেকে শুরু করে আরও কত নাম জানা ও অজানা কবি-লেখকেরা আমাদের সামনে জাজ্বল্যমান হয়ে রয়েছেন। কিন্তু তাদের সৃষ্টি ? সেটা,হয়ত, ঠিকই আছে। কিন্তু বদলে গেছে তাৎপর্য। হোমার হেলেনকে সৃষ্টি করেছিলেন―হেক্টরকে…। কিন্তু আমরা তো তাদেরকে করে নিয়েছি আমাদের মতো করে। কিংবা আমাদের পরের মানুষেরাও তেমনই করে নেবে বদলে। এই রকমই তো সব। নজরুলের ব্যাপারটাও সেই রকম। তাঁর সৃষ্টির মৌল ধর্মের আলোকে বার বার বদলে যাওয়া বস্তু জগৎকে করে তুলতে হবে উদ্ভাসিত। তার রঙ-রস-রূপ, হয়ত, এক থাকবে না। কিন্তু মানব মুক্তির বাণীটি হবে চিরকালীন।

 লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button