ওমর কায়সার
কখনও কখনও পথও মরে যায়। নদীর মতো। এ রকম একটা কথা মাকে কেউ একজন বলেছিল। মা বলেছিল, নদীও মরে না। পথও মরে না। মরে শুধু মানুষ। আর কেউ মরে না। লোকটি তার শক্ত মুঠো দিয়ে মায়ের হাত ধরে বলেছিল, চল, একটি পথের মৃত্যু তোমাকে দেখাই।
হরিণপুরা আর ফুলপুরা গ্রাম। এই দুটি গ্রামের সীমারেখার মতো চলে গেছে একটি পথ। সেই পথের পাশে নয়নধারা খাল। গ্রামের শেষ সীমানায় এসে একটি মোড়। ওই মোড়ে এসে মিলেছে তিন দিক থেকে আসা তিনটি পথ। নয়নধারা এখানে এসে উত্তরে চলে গেছে আরও বড় কোনও জলপ্রবাহের দিকে। সেই প্রবাহের নাম কর্ণফুলী। নয়নধারার জমজের মতো পথটি তার পাশাপাশিই ছিল। কিন্তু কোনও এক শ্রাবণের অঝোর ধারায় নয়নধারা উপচে পড়ে দুই কূল ভাসিয়ে দিয়েছিল। তাতে সাঁতার না জানা পথটি পানিতে ডুবে হাবুডুবু খেয়েছিল। সেবার বর্ষা শেষে হরিণপুরার মানুষ দেখে পথের একটা বড় অংশ নয়নধারার বুকে হারিয়ে গেছে। সেই থেকে ধীরে ধীরে মানুষ আর যান চলাচল রহিত হয়েছে সেখানে। সে কমপক্ষে দেড় দশকেরও বেশি আগের ঘটনা। এই দিকটায় মানুষের ঘরবাড়ি নেই, শুধু দূর দিগন্তজোড়া খোলা ধানখেত। এই ক’বছরে নতুন নতুন কত রাস্তা তৈরি হয়েছে। পুরনো সংকীর্ণ সড়ক প্রশস্ত হয়েছে। সেতু হয়েছে। কিন্তু এটির দিকে আর কারও নজর পড়েনি। বিকল্প সহজ পথ পাওয়া গেছে। তাই আর কেউ এই পঙ্গু অর্ধেক ডুবে যাওয়া সড়কে পা ফেলে না। মানুষের পদধ্বনি বঞ্চিত এই পথে তাই অনায়াসে স্বাধীনভাবে নির্বিঘ্নে বেড়ে উঠেছে ঘাস, ঝোপঝাড়সহ বিচিত্র সব গাছপালা।
লোকটি সেই সবুজ ঘন জঙ্গলে আবৃত পথের কাছে মাকে নিয়ে গিয়ে বলল, গাছপালা, শুকনো ঝরে পড়া পাতার আড়ালে একটু পথ লুকিয়ে রয়েছে। বিলুপ্ত একটি পথের ওপর আমরা দাঁড়িয়ে আছি। চল, আমরা দুজন এই পথকে আবার জাগিয়ে তুলি। আমাদের পদধ্বনি বাজুক এখানে। আমাদের নিঃশ্বাসের বাতাসে, আমাদের হৃৎপিণ্ডের বাজনায় পথের ঘুম ভাঙিয়ে দিই।
নতুন পথের দিকে না গিয়ে, কেন একটা লুপ্ত পথের নিশানা দেখাল লোকটা। মানুষের কোলাহল থেকে দূরে, নির্জন, নিরিবিলি এই পথের ওপর নয়নধারার পাশে সেদিন কেন মাকে নিয়ে এসেছিল লোকটা ? আজ নিজেই বুঝতে পারছে না মা। পথের এই রহস্যের ভেতর আরও একটা রহস্য যেন জন্ম নিল মায়ের মনে। মা এখন নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করছে, আমি কেন এসেছিলাম সেদিন এখানে ?
এই কথা মা কাকে জিজ্ঞেস করছে ? কার কাছে জানতে চাইছে মা ? তার চারপাশে তো কেউ নেই। আছে দীর্ঘশ্বাসের মতো বাতাস, গাছের পাতা, দেখা অদেখা অজস্র পতঙ্গের নীরব চলাচল। এরা তো মানুষের ভাষা বোঝে না। আমাকে বলছে মা ? হয়ত আমাকে বলছে। আমি তো শুনতে পাচ্ছি। তার নাড়ি জড়িয়ে আমি তো রয়েছি তার ভেতরেই। কিন্তু আমি সেই প্রশ্নের জবাব দেব কী করে ? আমি তো এখনও ভূমিষ্ঠ হইনি।
আমার এখনও জন্ম হয়নি। জন্ম না হলে আমি আমার মায়ের শ্বাস বুঝতে পারি কী করে ? তার কান্নার ধ্বনি শুনতে পাই কী করে ? আমার হৃৎস্পন্দন মাকে ক্লান্ত করে কীভাবে ? আমার নড়াচড়া তার রক্তের ভেতর আতঙ্ক ছড়ায় কীভাবে ? আমার মা তার নরম কোমল হাত দুটো আমার গায়ের ওপর বোলায় কী করে ? কখনও মধ্যরাতে গোপনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার স্ফিত উদরের দিকে ভেজা চোখ রেখে আমাকে মায়া দেয় কী করে ? না না আমার জন্ম হয়েছে। তবে আমি মায়ের পৃথিবীটা এখনও দেখিনি। যে পৃথিবী একদিন আমারও হবে। মা আমার দিকে তাকিয়ে বলে, অজাত প্রকৃতি তুমি জীবন্ত মানুষ হয়ে বেরিয়ে আসবে। আবৃত উৎসবের শামিয়ানা ফুলে উঠছে দিন দিন। ছায়াপথের কালো গ্রহগুলো তোমার বিন্যাসের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। তোমার বাবার চেহারা নিয়ে আসবে একটি ভয়ংকর রাত। তুমি নক্ষত্র পতনের শব্দে কেঁদে উঠবে। আমাকে মা বলে ডাকবে একবার। তুমি কি আসবে ? মা বলে ডেকে হৃৎপিণ্ডে দেবে টান ? আসবে না কেন ? এক লুটেরার অট্টহাস্যে কম্পিত লুপ্ত এই পথে কেন আসবে ? তুমি এলে আমি সন্ধ্যার সঙ্গে মিশে যাব।
আমার মা একবার জানতে চাইছে, তুমি কি আসবে ? আবার বলছে, কেন আসবে ? আমি যদি পৃথিবীতে যাই, আমার মা সন্ধ্যার সঙ্গে মিশে যাবে। আমি তা হলে কার কাছে থাকব ? কাকে মা ডাকব ? জন্মের শুরু থেকেই আমি মা হারা হব ? বাবা তো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। নয়নধারার জল প্রবাহের পাশে বিলুপ্ত সেই পথের মতো। আমার মা সেই দিনের পর থেকে আর তাকে পায়নি। সে শুধু নানাভাবে মাকে আশ্বাস দিয়েছে, স্বপ্ন দিয়েছে, আর দিয়েছে অপেক্ষা। এই অপেক্ষাতে অপেক্ষাতেই মায়ের রক্তের ভেতর আমি সংকেত দিয়েছি, মা তুমি কেঁদো না। আমি এসে গেলাম। এর পর তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত হলো আতঙ্ক। আমার আগমনি বার্তা মা কাকে জানাবে ? কীভাবে জানাবে ? কেন জানাবে ? কখন জানাবে ? দ্বিধা, সংশয়, ভয়, কাঁটালতার মতো মাকে জড়িয়ে ধরেছে। মা বাবাকে খবর দেয়। বাবা যেন মৌসুমি পাখি। শীতের মৌসুমে একবার এসেছিল। কয়েকদিন এখানে নয়নধারার পানিতে ভেসে ভেসে সাঁতার কেটে ফিরে গেছে নিজের ভূমিতে। মা তাকে কোথায় পাবে ? এখন তবে উপায় কী। এই অমীমাংসার সমাধান কারও কাছে চাইতে পারে না। কারও কাছে যেতে পারে না। পৃথিবীতে কখনও কখনও এ রকম সময় আসে। তখন একমাত্র নিজের কাছে ছাড়া আর কারও কাছে যাওয়া যায় না। আমার মা তাই রাতে একা জেগে থাকে। ভাবে। কাঁদে। শরীরের ভেতর থেকে স্রোতের তোড়ে ঘৃণা উথলে ওঠে। সেই ঘৃণা বমির মতো বের হয়ে আসে শরীর থেকে। এত ঘৃণা, এত ঘৃণা উঠে আসে বমি হয়ে। আমার মাকে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত করে। চোখ বুজে আসে। অবশ হয়ে আসে দেহ। সেই অবশ শরীরকে আমি ধাক্কা দিই। আমি ভয় পাই। আমার ভয় আতঙ্ক হয়ে মার ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। মা চিৎকার করে ওঠে। বলে কুত্তার বাচ্চা। আমাকে গালি দেয় ? নাকি আর কাউকে ? আমি বুঝতে পারি না।
আমি কারও আমন্ত্রণ ছাড়াই মায়ের শরীরে এসেছি। আমি অনাহূত। নিজের ইচ্ছায় আসিনি। আমি আমার মায়ের অনিচ্ছায় এসেছি। পৃথিবীতে কেউ কি নিজের ইচ্ছায় আসে ? কোনও প্রাণীই তো না। তবু তাদের প্রত্যেকের আগমন এক একটা উৎসবের জন্ম দেয়। কিন্তু আমার আগমন শোকের আর সর্বনাশের। আমাকে কী ফেলে রেখে চলে যাবে মা, হাসপাতালের বেডে, ডাস্টবিনে, অথবা পথের ধারে। আমার কান্নার স্বরে পৃথিবী কি আঁৎকে উঠবে ? কী করবে আমাকে নিয়ে ? আমাকে কেন রাখবে ? আমার জন্ম কী অনর্থক ? এ রকম অনর্থক জন্ম কেন তবে ? এরকম কত যে প্রশ্নের জন্ম হয়েছে আমার জন্মের আগে। আমাকে নিয়ে এক ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে। মায়ের শরীর এখন একটা যুদ্ধক্ষেত্র। মা যেন দুর্বাসা মুনির বর পাওয়া মহাভারতের কুন্তি। যাকে মনে মনে চাইবে সেই চলে আসবে তার কাছে। দুর্বাসা মুনির ইচ্ছা ছিল কুন্তি বিয়ে করেই তার ইচ্ছা পূরণ করবে। কিন্তু বর দেওয়ার সময় তিনি কুন্তিকে সে কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। আর তাই দুর্বাসা বর দিয়ে চলে যাওয়ার পর মন্ত্রের ক্ষমতায় কুন্তি সবচেয়ে সুন্দর দেবতাপুরুষ সূর্যকে কামনা করেন। তারপরই এই পৃথিবীতে আসে সূর্য কুন্তির পুত্র কর্ণ। কর্ণের জন্মের আগে কুন্তিও কি মায়ের মতো এ রকম নিজের সঙ্গে নিজের যুদ্ধে নেমেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো কর্ণ ভূমিষ্ঠ হয়েছিল। কর্ণ মহাবীর। পঞ্চপাণ্ডবের সঙ্গে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে নামার সাহস তার ছিল। আমিও কর্ণ হব। বীর হবো। আমার মায়ের নামে লেখা হবে আরও এক মহাকাব্য। মা তুমি আমাকে আসতে দাও তোমাদের পৃথিবীতে।
মা তুমি কী শুনতে পাচ্ছ ? মা নয়নধারা খালের দুই ধারে দেখ কী বিপুল জ্যোৎস্নায় পুরো পৃথিবীটা ভেসে যাচ্ছে। চাঁদের আলোর সঙ্গে মিশে দুপাশের বিস্তৃত সবুজ তার নিজের রঙ হারিয়ে অন্য এক অলৌকিক রঙে রূপ নিয়েছে। দূর দেশ থেকে আসা বাতাস কান্নার মতো হু হু করছে। কিসের একটা নীরবতা যেন জগতটাকে আড়াল করে রেখেছে। তারপরও কী ভয়ানক সুন্দর এই সবকিছু। মা তুমি কেন এখানে এসেছ। এই মধ্যরাতে ? কেন এই ঘুমন্ত পথের ওপর আবার ফিরে এসেছ ? যেদিন প্রথম এসেছিলে সেদিন ছিলে তোমরা দুজন। আজ কতদিন পর আবার এলে। আজও তুমি দুজন। তুমি আর আমি । একটা লুপ্ত পথ তোমাকে দেখাবে বলে, একটা ঘুমন্ত পথকে জাগাবার কথা বলে যে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল, সেখানে এসে কী করতে চাও ? এই পথকে জাগাতে ? তুমি কি ভাবছ একটা নিথর প্রাণহীন শরীরের ভেতর আরও একটা শরীর শুয়ে আছে মরা পথে। সেটি দেখতে মানুষ আসবে ? শবের পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়বে পুরো জনপদে ? আর পুরো সমাজ কৌতূহল নিয়ে এই পথে তার পদধ্বনি ফেলবে। আর তাতে জেগে উঠবে পথ। সেই আশায় ? মৃতসড়কের পুনরুত্থানের বলি তুমি কেন হবে মা ?
কথা শোনো । মা কথা শোনো। আমার আগমনি-ধ্বনি শোনো। একবার জন্মের সাধ নিতে দাও আমাকে তোমার মতো। আমি আসি। আমার নাম তুমি কর্ণ রেখো। আগে তোমার গাঁয়ের পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধে নামার সুযোগ দাও মা। কুরুক্ষেত্রে যাওয়ার পথটি রুদ্ধ করো না মা।
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ