আর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

ভারতবর্ষে শেক্সপিয়ারের সাহিত্যের আগমন ও চর্চা

মোহীত উল আলম

এই প্রবন্ধটি ইংরেজ কবি ও নাট্যকার উইলিয়াম শেক্সপিয়ার তাঁর সাহিত্য নিয়ে কীভাবে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ব্যবহৃত হয় তার একটি সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি। শেক্সপিয়ার এক দিকে যেমন ঔপনিবেশিক প্রশাসনযন্ত্রের মূল সাংস্কৃতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলেন, অন্যদিকে তাঁর সাহিত্য পাঠ করে পাঠকশ্রেণি পরাভবকে কীভাবে প্রতিবাদে রূপান্তর করা যায় সে সম্পর্কেও অনুপ্রেরণা লাভ করে। তাই তৎকালীন ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় এলিট সমাজ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠার মৌতাত শেক্সপিয়ার পাঠ করে পেয়েছে বলা যায়। শেক্সপিয়ার একদিকে যেমন সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ প্রচেষ্টার মূল ভিত্তি, অন্যদিকে  তিনি আন্তঃসাংস্কৃতিক সমন্বয়ের মূল লেখকও বটে। অর্থাৎ একদিকে তিনি ঔপনিবেশিক শক্তিকে মদত দেবার প্রেক্ষিতে সর্বজনীন শেক্সপিয়ার হিসেবে অভিহিত হয়েছেন, অন্যদিকে তাঁর সাহিত্যের সর্বজনীন গুণাবলি উপনিবেশিত লোকদের কাছেও আদৃত হতে থাকে। শেক্সপিয়ারকে নিয়ে এই দ্বৈরথ দৃষ্টিভঙ্গির আলোচনাই এই প্রবন্ধের বিষয়বস্তু। প্রবন্ধটি লেখার সময় অন্যান্য গ্রন্থ ও প্রবন্ধ থেকে প্রচুর তথ্য ব্যবহার করতে হয়েছে, সেসব উৎস-সূত্র টেক্সটের ভেতরে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রবন্ধটি অধ্যয়নিক গবেষণাপত্র হিসেবে লিখিত না হয়ে সাধারণ্যে সহজপাঠ্য প্রবন্ধ হিসেবে লেখা হয়েছে, এবং সে জন্যে পাদটীকার আনুষ্ঠানিকতা যথাসম্ভব পরিহার করা হয়েছে।

ইংল্যান্ডের কাব্যিক সাম্রাজ্য

শেক্সপিয়ারের, ১৬০৬ সালে রচিত অ্যান্টোনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা নাটকের শুরুতে রানি ক্লিওপেট্রা প্রেমিক অ্যান্টোনিওকে জিজ্ঞেস করছেন, যদি ভালোবাসো মোরে প্রিয়ে, তা হলে বল তার সীমানা।’১ `If it be love indeed, tell me how much’ (1.1.14)2 অ্যান্টোনি উত্তরে বললেন, ‘সে ভালোবাসা প্রিয়া ভিখারির, যার জানবে তুমি সীমানা।’ ক্লিওপেট্রা জিদ ধরেন। বলেন : ‘আমি দেব তার সীমান্ত এঁকে কতটুকু তুমি বাসবে ভালো।’ অ্যান্টোনি তখন বলেন, ‘তা হলে প্রিয়া, নতুন নতুন স্বর্গ আর পৃথিবী যোগ করতে হবে তোমার।’ `Then must thou find out new heaven, new earth’ (1.1.17).

অ্যান্টোনির নতুন স্বর্গ, নতুন পৃথিবী চাওয়ার রাজনৈতিক সমীকরণ হলো : শেক্সপিয়ারের মানসকল্পে সাম্রাজ্য বাড়ানোর তাগিদ সৃষ্টি হয়েছিল। এ ধরনের সাম্রাজ্যবিস্তৃতির স্বপ্ন রেনেসাঁ ইংল্যান্ডে শুধু যে একা শেক্সপিয়ার দেখেছিলেন তা নয়, সে সময়ে রানি এলিজাবেথের সুশিক্ষিত অমাত্যদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যাঁরা মনে করতেন যে ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্য হিসেবে বিস্তারের প্রচুর সম্ভাবনা আছে। অর্থাৎ, ইংল্যান্ড রাজনৈতিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হবার প্রায় দুশ বছর আগে থেকেই ইংরেজ বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে এই ধারণা প্রোথিত হয় যে ইংল্যান্ড একটি সাম্রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। এই ধারণা প্রথম দিকে কাব্যিক সাম্রাজ্যবাদ হলেও পরে সেটিই বাস্তবে রূপ নেয়, এবং প্রথমে ইংল্যান্ড আমেরিকায় এবং পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তার করে।

প্রাবন্ধিক লেসলি বি করম্যাক, তাঁর ১৯৯৮ সালে রচিত প্রবন্ধ, ‘ব্রিটানিয়া রুলস দ্য ওয়েইভস ? ইমিজিস অব এম্পায়ার ইন এলিজাবেথান ইংল্যান্ড’-এ তিনটি প্রত্যয়ের উল্লেখ করলেন যে কেন ইংল্যান্ড তার ভৌগোলিক অভিযাত্রাগুলো শুরু করার বহু আগে থেকেই নিজেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে রূপান্তরিত করার কথা ভেবেছিল। তিনি এলিজাবেথের সময়কার বিভিন্ন সচিত্র লোহার পাত, বিভিন্ন পুস্তকের প্রচ্ছদে অঙ্কিত ছবি এবং ভ্রমণবিষয়ক পুস্তকের প্রচ্ছদ, বইয়ের ভেতরের ছবি এবং মানচিত্র অবলোকন করে বললেন যে এলিজাবেথের সময়েই ইংল্যান্ডে একটি সাম্রাজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। প্রথমে ইংরেজদের মনে এ ধারণা জন্মায় যে অস্তিত্বমান এই  মাটির পৃথিবীকে পরিমাপ করা যায়, এর বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরণও করা যায়, এবং সেভাবে পৃথিবীটিকে আয়ত্তের মধ্যে এনে তাকে নিয়ন্ত্রণও করা যায়। দ্বিতীয়ত, ইংরেজরা মনে করতে থাকে যে তারা পৃথিবীর অন্যান্য জাতির চেয়ে উন্নততর, এবং সে কারণে তাদের অধিকার রয়েছে বিশ্বলোকের অন্যান্য অঞ্চলকে ভোগ করার। তৃতীয়ত তারা ভূগোল পাঠ করে জানল যে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যকে সংজ্ঞায়িত করার তাদের প্রয়োজন রয়েছে।

রানি এলিজাবেথের পিতা রাজা অষ্টম হেনরি দোর্দণ্ড প্রতাপ রাজা ছিলেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্যার টমাস ক্রমওয়েল। তিনিই বস্তুত প্রথম ইংরেজ যিনি ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্য হবার সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তাঁর এ আত্মবিশ্বাস জন্মায় যখন রাজা হেনরির সঙ্গে রোমে অবস্থানরত খ্রিশ্চান পোপের সঙ্গে ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রশ্নে বিরোধ চলছিল। ১৫৩৩ সালে খসড়াকৃত রাজার জন্য ভাষণ ‘অ্যাক্ট ইন রেস্ট্রেইনট অব অ্যাপিলস’র-এ তিনি ব্যাখ্যা করলেন কেন ইংলিশ চার্চ রোমের প্যাপাল চার্চ থেকে আলাদা হওয়া উচিত, এবং পরিশেষে বললেন যে ‘দিস রিয়্যালম অব ইংল্যান্ড ইজ অ্যান এম্পায়ার।’ (করম্যাক) এই ইংল্যান্ড রাজ্যটি একটি সাম্রাজ্য।

তবে সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় স্বপ্নবাজ সম্ভবত ছিলেন রানি এলিজাবেথের জনৈক অমাত্য ড. জন ডি। তিনি ছিলেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ। আরও ছিলেন অঙ্কশাস্ত্রবিদ, ভূগোলবিদ, এবং খানিকটা যাদুকর। তিনি এলিজাবেথের গণক হিসেবে কাজ করতেন এবং তাঁকে জলবিজ্ঞান ও ভূ-বিদ্যার ওপর পরামর্শ দিতেন। ১৫৭৭ সালে প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ জেনারেল অ্যান্ড রেয়ার মেমোরিয়ালস পারটেইনিং টু দ্য পারফেক্ট আর্ট অব নেভিগেশন-এ পরামর্শ দিলেন যে এলিজাবেথ যেন রয়্যাল নেভি প্রতিষ্ঠা করেন যাতে ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক জাহাজ জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পায়, ইংল্যান্ডের সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ যেন নিরাপদ থাকে, এবং ইংল্যান্ডের সামুদ্রিক সাম্রাজ্য যেন প্রতিষ্ঠা পায়। ডি-র বইটির প্রচ্ছদে খোদাইকৃত ছিল এলিজাবেথের একটি প্রতিকৃতি যেখানে তিনি ইউরোপা নামক জাহাজটিকে পরিচালিত করছেন। বলাবাহুল্য, ইংগিতটা হলো যে ইংল্যান্ডের রানি পুরো ইউরোপকে শাসন করছেন। জাহাজের মাস্তুলে ঝোলানো ছিল একটি সম্মানসূচক কোট অব আর্মস যার প্রতীকী অর্থ হলো যে ইংল্যান্ডের হাতে ইউরোপের নেতৃত্ব। আর টাইটেল পৃষ্ঠায় ডি একটি ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো বাণী লিখলেন যে যদি এলিজাবেথ ইংল্যান্ডকে নৌ-শক্তিতে পরিণত না করেন, তা হলে এর জন্যে তিনি ভবিষ্যতে অনুশোচনা করবেন।

এলিজাবেথকে সাম্রাজ্য গঠনে উৎসাহ দেবার দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন রিচার্ড হাকলুট। তিনি বিস্তৃত ভ্রমণ করেন এবং ১৫৯৮-১৬০০ সালের মধ্যে তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রকাশ করে জনপ্রিয়তা পান। তাঁর ভৌগোলিক বর্ণনায় ইংরেজদের সাম্রাজ্যের স্বপ্ন যেন ধরা পড়ে। তিনি লিখলেন, ‘বর্বর ক্যানোয়া ইন্ডিয়ানরা সমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করছে, আর পর্তুগিজ, সারাসিন মুসলমান এবং মুর জাতির লোকেরা অনবরত ভ্রমণ করছে জাপান থেকে চীনে, চীন থেকে মালাক্কা, আবার মালাক্কা থেকে মলুক্কেস; অথচ একজন ইংরেজের এর চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকার কথা। কাজেই আমাদের নৌবাহিনী যেন ঐসব অঞ্চলে দ্রুত গমন করে। তাদের ভয়ের কোনও কারণ নেই। কোন সমুদ্রটা আছে যে যেখানে জলদস্যুরা নেই, বিপদ ছাড়া কোন জাহাজটি ভাসতে পারে ?’ (করম্যাক)

এবং জন উলফ নামক আরেক ইংরেজ বললেন যে আবিষ্কারের মাধ্যমে ইংরেজরা নতুন ভূমিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। তিনি জ্যান হিউজেন লিনশটেন নামক একজন ওলন্দাজ অভিযাত্রীর ভ্রমণকাহিনি অনুবাদ করলেন ১৫৯৮ সালে। বইটির নাম ছিল ডিসকোর্স অব ভয়েজেস। অন্য এক দেশের ভ্রমণকারীর সাম্রাজ্যিক অভীপ্সাকে তিনি অনুবাদ করার অর্থ দাঁড়ায় যে তিনি নিজের  দেশের জন্যও সেরকম একটি সাম্রাজ্যিক পরিচয় তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তিনি লিখেেলন, ‘আমার নিজের কোনও আস্থা নেই, তবু আমি আশা করি যে এই দুর্বল অনুবাদ পড়েও আমার দেশবাসী উদ্বুদ্ধ হবে যে আমাদের জাতীয় মর্যাদা যেন পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর ওপর স্থাপিত হয়।’ (করম্যাক) কিন্তু ইংরেজ জাতি সাম্রাজ্যবাদী দেশ হবে কি না, সেটা নির্ভর করছে রানির ইচ্ছার ওপর। উলফ ভাবলেন, সাম্রাজ্য বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টান ধর্মেরও প্রসার ঘটানো যাবে।

সাম্রাজ্যের স্বপ্নধারী আরেকজন মুখ্য ব্যক্তিত্ব হলেন ক্রিস্টোফার স্যাক্সটন, যিনি ১৫৭৯ সালে একটি ভূচিত্রাবলী ছাপান। এ ব্যাপারে তিনি খরচপাতি পান স্যার টমাস সেকফোর্ড থেকে, যিনি ছিলেন রানির পক্ষে একজন কর্মাধ্যক্ষ। কাজেই ক্যাক্সটনের ভূচিত্রাবলি প্রকাশের পেছনে রানির উৎসাহ ও আনুকূল্য ছিল বলা যায়। এটিই প্রথম মানচিত্র যেখানে ইংল্যান্ডের ম্যাপে নিখুঁতভাবে কাউন্টি থেকে কাউন্টি (ইংল্যান্ডের প্রদেশ) পর্যন্ত আঁকা হয়। আর ভেতরের মলাটে থাকে এ বার্তা যে ইংল্যান্ড একটি শক্তিশালী দেশ, এবং ভৌগোলিক বিজ্ঞান ব্যবহার করে এ দেশটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সর্বক্ষমতাময় দেশ হতে পারে।

আর ঐ সময়কার অন্যতম অভিযাত্রী স্যার ওয়াল্টার র‌্যালি তাঁর ধ্রপদী গ্রন্থ দ্য হিস্ট্রি অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এ সৃষ্টির শুরু থেকে যিশু খ্রিস্টের জন্মকাল পর্যন্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ করলেও প্রারম্ভিক আধুনিক যুগের ইংল্যান্ডের জন্য সেটি প্রচুর অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করে। বইটি তিনি লিখেছিলেন ইংল্যান্ডের যুবরাজ হেনরি, প্রিন্স অব ওয়েলসকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য যাতে তিনি কল্পনাকৃত এল ডোরাডো রাজ্যের খোঁজ পান। কিন্তু হেনরির অকালমৃত্যুতে র‌্যালির ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হওয়া কিংবা স্পেইনকে টেক্কা দেওয়ার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়। করম্যাকের মতে সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাস্পৃষ্ট এই সব পুস্তক ইংরেজ তরুণ ছাত্রদের কল্পনায় প্রবল অভিঘাতের সৃষ্টি করে, এবং তারা কেউ কেউ পরবর্তী জীবনে উচ্চ আসনে আসীন হলে তাদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী মনস্তত্ত্ব আরও সুদৃঢ় প্রকাশ লাভ করে। স্যার জুলিয়াস সিজার নামক জনৈক অমাত্যের রোজনামচায় প্রতি পৃষ্ঠার শিরোনামে লেখা থাকে, ‘দ্য সিঙ্গুলারিটিজ অব ইংল্যান্ড’ বা ইংল্যান্ডের বিশেষত্ব। করম্যাকের তাই দৃঢ় প্রত্যয় হলো যে ইংল্যান্ড ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক অর্থে সাম্রাজ্যবাদী দেশ হবার পূর্বে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের মনস্তত্ত্বে প্রবেশ করেছিল।

তাই, অধ্যাপক জন গিলিস তাঁর ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত শেক্সপিয়ার অ্যান্ড দ্য জিওগ্রাফি অব ডিফরেন্স গন্থে বললেন, শেক্সপিয়ার সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত থাকার সময় ইংল্যান্ডের এই বুদ্ধিবৃত্তিক সাম্রাজ্যিক মনস্তত্ত্বকে ধারণ করেছিলেন বলে অনুমেয় হয়। এবং প্রাচীন গ্রিক ও রোমান কবিরা যেমন ভূগোলকে নৈতিকতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করতেন, বৈজ্ঞানিকভাবে ভাবে বা ভূগোলগতভাবে বিবেচনা করতেন না, তেমনি শেক্সপিয়ারও সেই ধারা অনুসারে ভূগোল বা ভৌগোলিক বিবরণে নৈতিকতার প্রভাব স্বীকার করে নেন। অর্থাৎ, ব্যাখ্যাটা এমন হতে পারে যে ইংল্যান্ড, কিংবা সম্প্রসারিত অর্থে পুরো ইউরোপের লোকেরা হলো বর্ণগত এবং জাতিগতভাবে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের লোকজনের চেয়ে নৈতিক চরিত্রে উন্নত। গিলিস আরও উল্লেখ করেন যে সমালোচক জে, ডি, রোজার্স ১৯১৬ সালে এ মর্মে সিদ্ধান্ত জানান যে শেক্সপিয়ারের ভূগোল জ্ঞান খুব সীমিত পর্যায়ের ছিল। অর্থাৎ, তখনকার জানা সভ্য জগতের বাইরে তাঁর ভূগোল জ্ঞান ছিল না। তিনি হয়তো ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ শব্দগুচ্ছের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, এবং ১৬১০ সালে রচিত তাঁর নাটক দ্য টেম্পেস্ট-এ তিনি যে দ্বীপটি কল্পনা করেছেন সেটি ইতালিরই একটি ক্ষুদ্র অংশকে একদিন, দুদিনের জন্য নিউ ওয়ার্ল্ড হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন।

দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পত্তন

শেক্সপিয়ারের বয়স তখন ৩৬। তিনি সবেমাত্র তাঁর অতি সফল মিলনান্তক নাটক অ্যাজ ইউ লাইক ইট শেষ করে অতি সফল বিয়োগান্তক হ্যামলেট নাটকটি লিখতে শুরু করেছেন, তখন ১৬০০ সালের শেষ দিন, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর লন্ডন নগরীর কয়েকজন বণিক মিলে রানি এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করলেন। হাতে তাঁদের একটি আবেদনপত্র। তাঁরা ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যপোত চালানোর জন্য একটি কোম্পানি গঠন করবেন, এবং সে মর্মে রানির অনুমোদন প্রয়োজন। রানি তাঁদেরকে কোম্পানি গঠনের সনদ দিলেন, এবং এ কোম্পানিটিই বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি,’  ব্যবসার নামে যে কোম্পানিটি বস্তুত সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার অগ্রগামী সংগঠনে পরিগণিত হয়।

আমরা যে প্রথম অংশে ইংল্যান্ডের কাব্যিক সাম্রাজ্যের আলোচনা করেছি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গঠন ও কার্যক্রম অনেকটা সেটিরই বাস্তবায়ন, যদিও কোম্পানিটির উদ্দেশ্য ছিল অনেকটা বর্তমানে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর মতো। তারা বণিকদল, ব্যবসা তাদের ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। তারা রাষ্ট্রীয় অনুমোদন সহকারে ভারতে বাণিজ্য সম্প্রসারিত করতে চায়। রিচমন্ড বার্বোর তাঁর ‘দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জার্নাল অব অ্যান্টোনি মার্লো, ১৬০৭-১৬০৮’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে জানাচ্ছেন যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকাংশ পরিচালক আগে লেভান্ট কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এবং এলিজাবেথ ১৫৮১ সালে তাঁদেরকে বাণিজ্য করার অনুমতি দেন। লেভান্ট কোম্পানি ডাচ এবং পর্তুগিজদের মতো ভারতে বাণিজ্য করতে সচেষ্ট হয়। রানি এলিজাবেথের আমলেই কিন্তু প্রথম যে ইংরেজ ভারতবর্ষে পদার্পণ করেন তাঁর নাম জন মিল্ডেনহল। তিনি লেভান্ট কোম্পানির পক্ষে হেক্টর নামক একটি জাহাজে করে ১৫৯৯ সালে ভারতের পথে পাড়ি দেন, এবং তুরস্ক হয়ে স্থলপথে ১৬০৩ সালে আগ্রায় মোগল সম্রাট আকবরের রাজদরবারে পৌঁছান। তিনি সঙ্গে করে উপঢৌকন হিসেবে সম্রাটের জন্য খুব তরতাজা ঊনত্রিশটি ঘোড়া নিয়ে যান। সম্রাট তাঁকে তাঁর সাক্ষাতের উদ্দেশ্য জিজ্ঞেস করলে, তিনি উত্তর দেন যে ইংল্যান্ডের রানি ভারতেশ্বরের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক চান, এবং ইংল্যান্ডের লোকেরা পর্তুগিজ এবং ক্যাথলিক ধর্মীয় জেসুইটদের চেয়ে অনেক ভালো ক্রিশ্চান। আকবর প্রাথমিকভাবে বাণিজ্য করতে সম্মত হলেও পর্তুগিজ এবং জেসুইটদের (জেসুইটরা হলো উগ্র ক্যাথলিক ক্রিশ্চানদের একটি উপদল) বিরুদ্ধে যেতে রাজি হলেন না। তবে মিল্ডেনহল এতটুকু সুবিধা নিতে পারলেন যে মোগল দরবারে একজন ইংরেজ প্রতিনিধি যাতায়াত করতে পারবে। এর পরপর আকবরের মৃত্যু হলে সম্রাট জাহাঙ্গির যাঁকে ইংল্যান্ডের প্রতিনিধি হিসেবে পেলেন, তিনি ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্স, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, যাঁর প্রসঙ্গে একটু পরেই আমরা আসছি।

ইতিমধ্যে দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, এবং ১৬০১ সালেই এই কোম্পানির তরফ থেকে দক্ষিণ ভারত মহাসাগরে প্রথম সমুদ্রযাত্রা করা হয়, এবং জাহাজটি জাভা দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছায়। এটির নৌ-অধিপতি ছিলেন স্যার জেমস ল্যাংকাস্টার। রানি এলিজাবেথের মৃত্যুর পর ১৬০৪ সালে স্যার হেনরি মিডলটনের নেতৃত্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দি¦তীয় সমুদ্রযাত্রা সংঘটিত হলেও তখনও তারা ভারতে পৌঁছাতে পারেনি। তারা জাভার ব্যান্টাম নামক স্থানে একটি বাণিজ্য-শিবির স্থাপন করে মাত্র। এর মধ্যে ১৬০৪ সালে রাজা প্রথম জেমস স্পেনের সঙ্গে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করলে, এবং জলদস্যুদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০৭ থেকে ১৬১০ সালের মধ্যে ভারত অভিমুখে বাণিজ্যপোত পাঠায় কয়েক দফা। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন উইলিয়াম হকিন্সের নেতৃত্বে সেই আগের হেক্টর নামক জাহাজটি করে ১৬০৮ সালে সুরাতের অদূরে নোঙ্গর ফেলে। অর্থাৎ মিল্ডেনহল তুরস্ক থেকে লাহোর হয়ে আগ্রায় প্রবেশ করলেও, হকিন্স পুরোটা পথই সমুদ্রপথে যান। হকিন্সের যাত্রাকে সাধারণত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তৃতীয় যাত্রা হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই জাহাজে বণিক দলের প্রধান হিসেবে যান অ্যান্টোনি মার্লো, যিনি একটি দিনপঞ্জি লিখতেন, এবং তাঁর বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে বার্বোর দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আগমনের ওপর উল্লিখিত প্রবন্ধটি লেখেন।

হকিন্স ভালো তুর্কি জানতেন, যে ভাষাটি ছিল সম্রাট জাহাঙ্গীরের পৈতৃক ভাষা, যদিও মোগল দরবারের রাজভাষা ছিল ফার্সি। এর আগে মিল্ডেনহল যেমন প্রকৃত অর্থে ইংল্যান্ডের রানির নিয়োগকৃত দূত ছিলেন না, ছিলেন বস্তুত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দূত, তেমনি হকিন্সও ছিলেন কোম্পানির দূত, রাজা জেমসের নয়। তবে রাজা জেমস থেকে একটি চিঠি কৌশলে রচনা করতে কোম্পানি সমর্থ হয় যেটিতে লেখা ছিল, ‘অমিত পরাক্রমশালী যুবরাজ আকবরিয়া, কিং অব সুরাট’। আকবর তখন মারা গেছেন তিন বছর হয়, এবং তিনি সুরাটের রাজা ছিলেন না।

যাই হোক, হকিন্সের ভাগ্যে সফলতার চেয়ে বিড়ম্বনা জোটে বেশি। সম্রাটের অন্যতম অমাত্য, বাণিজ্যমন্ত্রী মুকারব খান হকিন্সের মূল্যবান পণ্যগুলো জব্দ করে নিজের নামে সম্রাটের কাছে উপঢৌকন হিসেবে পাঠান। আবার গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পর্তুগিজরা হেক্টর জাহাজ থেকে সমস্ত দ্রব্যাদি লুট করে নেয়। জাহাঙ্গির তাঁকে বিশ্বাস করতে না পারলেও হকিন্সের তুর্কি ভাষার ওপর আধিপত্য থাকার ফলে দুজনের মধ্যে খানিকটা বোঝাপড়া তৈরি হয়। জাহাঙ্গির তাঁকে রাজকীয় উপাধি দেন, দান করেন চারশটি ঘোড়া, এবং তাঁর হারেম থেকে একজন আর্মেনিয়ান ক্রিশ্চান রমণীকে স্ত্রী হিসেবে দান করেন। আগ্রার দরবারখানায় হকিন্স ‘ইংলিশ চাঁদ’ হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তারপরও নানা বিক্ষিপ্ত কারণে হকিন্সকে জাহাঙ্গির দীর্ঘদিন সুরাতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করার অনুমতি দেন না। তারপর একটি ঘটনায় সম্রাট হকিন্সের ওপর অতিশয় বিরক্ত হন। জাহাঙ্গির নিজে যদিও পানাসক্ত ছিলেন কিন্তু কেউ দরবারে পানাসক্ত অবস্থায় প্রবেশ করার ওপর চরম বিধিনিষেধ ছিল। হকিন্স একবার দরবারে উপস্থিত থাকলে তাঁর নিঃশ্বাসে মদের গন্ধ পাওয়া গেলে সম্রাটের হুকুমে তাঁকে চরম অপমানের সঙ্গে দরবার থেকে বহিষ্কার করা হয়।  সে সঙ্গে হকিন্সের যে মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজা জেমসের চিঠির একখানা জবাব সম্রাটের কাছ থেকে নেওয়া, সেই উদ্দেশটিও বাধাগ্রস্ত হয়। হকিন্স এই ঘটনাটি লিপিবদ্ধ করেন, যার অনুবাদ আমরা করে দিচ্ছি: ‘আবদেল হাসান রাজার কাছ থেকে আমার কাছে ছুটে এলেন, এবং খুব তুচ্ছ ভাষায় বললেন এত বড় সম্রাটের পক্ষে কোনও একজন পুঁচকে রাজার কাছে চিঠি দেওয়া দস্তুরের মধ্যে পড়ে না।’ (রিচমন্ড বার্বোর, ‘আর্লি ইংলিশ “অ্যামবাসেডরস” ইন মোগল ইন্ডিয়া’) এতদসত্ত্বেও হকিন্স সুরাটে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি পান। 

সে যাই হোক হকিন্সের বিতাড়নের খবর লন্ডনে পৌঁছালে হকিন্সের বদলে আরেকজনকে আনুষ্ঠানিকভাবে দূত হিসাবে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। তিনি হলেন স্যার টমাস রো, যিনি বস্তুত ইংল্যান্ডের রাজা কর্তৃক অনুমোদিত ভারতে প্রথম নিয়োগকৃত দূত। রো ধীরস্থির প্রকৃতির লোক ছিলেন, এবং অ্যাংলো-মোগল সম্পর্ক উন্নয়নে নিজের কূটনৈতিক প্রতিভাকে কাজে লাগান। সম্রাট জাহাঙ্গির যদিও তাঁকে জানান যে ‘আমি আপনাকে দূত হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, বস্তুত অবাক হই, কী করে আপনার রাজা এত অল্প উপঢৌকন দিয়ে আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন।’ (বার্বোর)

রো জাহাঙ্গির থেকে জেমসের জন্য প্রতুত্তর পত্রটি সংগ্রহ করতে সমর্থ হন, যেখানে জাহাঙ্গির লেখেন যে রো ‘আপনার যথেষ্ট বিশ্বস্ত অনুচর।’ (বার্বোর) কিন্তু  রোকে ভারতের আবাসিক ইংরেজ রাজদূত হিসেবে পাঠানোর ব্যাপারে রাজা জেমসের আনুষ্ঠানিকতার বাইরে বিশেষ কোন আগ্রহ ছিল না। এ দিকে জাহাঙ্গির ইংরেজদের তরফ থেকে দেওয়া বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপঢৌকন নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। তিনি এগুলিকে খেলনা আখ্যা দিয়েছিলেন। রো চেয়েছিলেন এই ধারণাটি ভাঙতে। তাই তিনি ১৬১৫ সালে কোম্পানিকে লেখা এক চিঠিতে বললেন, ‘আপনারা উপঢৌকনের নামে ছয়শত পাউন্ড মূল্যের যে শকটটি পাঠিয়েছিলেন সেটির জাজিম জায়গায় জায়গায় ফেঁসে গেছে, তাতে এখানকার লোকেরা খুব তামাশা করেছে। সে যা হোক, জাহাঙ্গির শকটটিতে চড়েন, যেটি দু’জন ইংরেজ টেনে নেন, এবং রো’র দেওয়া তরবারি তিনি উত্তোলিত ভঙ্গিতে নাচানও। কিন্তু রো ঐ স্থান ত্যাগ করার পর জাহাঙ্গির তাঁর জেসুইট সঙ্গীদের জিজ্ঞেস করেন, ‘ইংল্যান্ডের রাজা কোনও বড় রাজা কিনা, কিন্তু তা হলে তিনি এত নগণ্য উপহার কিভাবে পাঠান! সোনাদানা কেন পাঠান না!’ (বার্বোর)

ব্যাপারটা এখানে থেমে থাকলো না। জাহাঙ্গির আদেশ দিলেন ঐ ইংলিশ শকটের নুমনায় যেন আরেকটি শকট তাঁর কারিগরেরা তৈরি করেন। সেটি তৈরি হলো, সম্রাট তাতে তাঁর বিদূষী রানি নূর জাহানকে নিয়ে চাপলেন। তিনি প্রমাণ করলেন যে ইংরেজদের তৈরি শকটের চেয়ে তাঁর তৈরি শকটটি অনেক উন্নত মানের। প্রতীকী অর্থে তখনও মোগলদের প্রতিপত্তি ইংরেজদের ধারণার বাইরে ছিল। রো সহসা আরেকটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়লেন। ১৬১৬ সালে পারস্যের দূত মুহম্মদ রিজা বেগ মোগল দরবারে উপস্থিত হলেন অসংখ্য বাছাই করা পারস্য আর আরবীয় ঘোড়া আর গর্দভ সহকারে। আরও ভেটের মধ্যে রইল সাতটি উটের পিঠে জাজিম আর রেশমি বস্ত্র, পারস্য অতি উচ্চ মূল্যের ঝোলান পর্দা, চল্লিশটি বন্দুক, পাঁচটি ঘড়ি, স্বর্ণখচিত পোশাকাদি, রেশমি কার্পেট আটটি, মূল্যবান পাথরসামগ্রী, একুশটি উঠের পিঠে করে আঙ্গুর থেকে তৈরি মদ্য, বিশোধিত পানির আধার, গোলাপজল, সাতটি পাথরখচিত  ছোরা, পাঁচটি পাথরখচিত তরবারি, সাতটি ভেনেশীয় কাচের আয়না, আরও কত কি।

রো তাঁর বর্ণনায় এই ব্যাজোক্তিও করলেন যে এত কিছু দিয়েও পারস্যের দূত সে সম্মানটুকু পেলেন না, যেটি তিনি পেয়েছিলেন। বার্বোর অনুমান করছেন যে ইংরেজরা উপঢৌকনের পথে না গিয়ে সোজাসুজি কূটনীতির মধ্যে দিয়ে গেলে সম্রাটের মন পেতেন। জাহাঙ্গিরের অন্যতম অমাত্য আসফ খান এ দিকটির ব্যাপারে রোকে পরামর্শও দিয়েছিলেন। রো পরামর্শটি নিয়ে কোম্পানিকে লিখলেন যে জাঁকজমক দেখিয়ে সম্রাটকে অভিভূত করার প্রয়োজন নেই, বরঞ্চ বাহুল্য পরিহারপূর্বক কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বন করাই শ্রেয় হবে। এবং রো শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গিরের নিকট থেকে ইংরেজদের পক্ষে বাণিজ্যিক অধিকার আদায় করতে সমর্থ হন। তবে বার্বোর উল্লেখ করছেন যে জাহাঙ্গির তাঁর আত্মজীবনী তুজক-ই-জাহাঙ্গিরিতে মুহম্মদ রিজা বেগের উল্লেখ করলেও স্যার টমাস রোর কোনও উল্লেখ করেননি। এবং এটাও উল্লেখযোগ্য যে, যখন জাহাঙ্গির জিজ্ঞেস করেছিলেন রোকে যে তিনি কোনও ইংলিশ ঘোড়ার চালান দিতে পারবেন কি না, রো সম্রাটকে সেটি অসম্ভব বলে জানিয়েছিলেন। ১৬১৯ সালে রো তাঁর দায়িত্ব শেষ করে ইংল্যান্ডে ফিরে যান। 

ম্যাকলের ভারতকে ইংরেজিকরণ প্রচেষ্টা

তারপরও  শেক্সপিয়ারের, অর্থাৎ শেক্সপিয়ারের সাহিত্যের ভারতে আসতে প্রায় দুশ বছর সময় নেয়। দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কি করে একটি বণিক সংগঠন থেকে সক্রিয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হলো এটা ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি বিস্ময়কর অধ্যায়। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ্ দৌল্লার পতনের পর, ১৭৯৯ সালে মহিশুরের টিপু সুলতানের পতন হয়। ১৮০৩ সালে দিল্লির সন্নিকটে প্যাতপারগঞ্জের পতন হলে মোগল সাম্রাজ্যের পতন প্রায় অবধারিত হয়ে ওঠে। বিদ্রোহী রাজপুতদের ইংরেজরা নানা সন্ধিচুক্তির মাধ্যমে বশে রাখে। এবং ১৮৫৭ সালে দিল্লির পতন হলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত শাসনের নিয়ামক হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমান প্রবন্ধের বিষয় ইতিহাস বর্ণনা নয়, বিধায় আমরা বরং সে জায়গায় মনোসংযোগ করি যে ভারতবর্ষ ব্রিটিশ প্রজাতন্ত্রে পরিগণিত হবার পর ভাষার ব্যাপারে ইংরেজরা কি করল। তারা কিন্তু প্রথমে ভারতীয় ভাষাগুলোকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নির্বাচন করেছিল। ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ কর্মকর্তাদের বাংলা সহ অন্যান্য ভারতীয় ভাষা শেখানো। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক হরিশ ত্রিবেদী তাঁর ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত কলোনিয়াল ট্রানজেকশনস: ইংলিশ লিটের‌্যাচার ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থে এ সম্পর্কে লিখলেন যে ইংরেজদেরকে ভারতীয় ভাষা শেখানোর অভিপ্রায়ে ভারতীয় ধ্রুপদী সাহিত্য থেকে বাছাই করে ভগবৎ গীতা এবং অভিজ্ঞান শকুন্তলা পড়ানো হতো। এই ঐতিহ্য ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত চালু থাকে। ঐ সময়ে অংকিত একটি চিত্রে দেখা যায় উইলিয়াম কেরি, যিনি ছিলেন ইংরেজ মিশনারিগুলি সহ ফোর্ট উইলিয়ামের অধ্যক্ষ, তিনি খুব কড়া চাহনীর একজন স্থানীয় পণ্ডিতের নিকট থেকে সংস্কৃত ভাষার ওপর পাঠ গ্রহণ করছেন। কিন্তু এই ঐতিহ্য রাতারাতি বদলে যায় যখন, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৫ সালে, লর্ড টমাস বেবিংটন ম্যাকলে তাঁর বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত ‘মিনিট অন ইন্ডিয়ান এজুকেশন’ শীর্ষক প্রস্তাবনা গর্ভনর-জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের কাছে পেশ করেন। তাঁর এক যুক্তিতে বললেন, ইংল্যান্ডের তুলনায় ভারতবর্ষ ছিল হাতিসম। তাই এটাকে ইংল্যান্ড থেকে ইংরেজ প্রশাসক এনে শাসন করা সম্ভব নয়। যে কাজটি করতে হবে সেটি হলো ভারতীয়দের মধ্য থেকে এমন একটি শ্রেণি তৈরি করতে হবে, যারা গাত্রবর্ণে আর রক্তে থাকবে ভারতীয়, কিন্তু রুচিতে, মতামতে, নৈতিকতায় এবং বৃদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংরেজ: ‘a class of persons Indian in blood and colour, but English in taste, in opinion, in morals, and in intellect.’

ম্যাকলে যখন তাঁর প্রস্তাবনা লেখেন, তখনও তাঁর ভারতে আসার এক বছর পূর্ণ হয়নি। তিনি সরল স্বীকারোক্তি করেন যে তিনি না জানতেন আরবি, না সংস্কৃত। তবে তিনি অসম্ভব ধী-শক্তি সম্পন্ন লোক ছিলেন, এবং পশ্চিমা সাহিত্য ছিল তাঁর নখদর্পণে। তিনি দান্তেকে বড় কবি মনে করতেন, যদিও স্বীকার করতেন যে একমাত্র শেক্সপিয়ারই তাঁকে ছাড়িয়ে গেছেন। তাঁর একটি পত্রে তিনি শেক্সপিয়ারের নাটক দ্য টেম্পেস্ট থেকে ট্রিনকুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন যে একজন ভালো ইন্ডিয়ান হচ্ছে একজন ‘ডেড ইন্ডিয়ান’৩। বলা বাহুল্য ট্রিনকুলোর ‘ডেড ইন্ডিয়ান’ হচ্ছে আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান, কিন্তু ম্যাকলে তাঁর চিঠিতে উদ্ধৃতিটির পরিপ্রেক্ষিত বদলে ভারতীয় ইন্ডিয়ান হিসেবে চালিয়ে দেন। তাঁর এই রসিকতার পেছনে ভারতীয় তথা প্রাচ্যের জ্ঞানসমৃদ্ধি নিয়ে তাঁর গভীর অবজ্ঞা লুকিয়ে আছে। ঐ প্রস্তাবনার শেষের দিকে এই আত্মম্ভরিতাপূর্ণ উচ্চারণ তিনি করলেন যে “a single shelf of a good European library was worth the whole native literature of India and Arabia”—‘ইউরোপের কোন ভালো একটি পাঠাগারের এক তাকের পরিমাণ বই পুরো আরবদুনিয়া এবং ভারতের সাহিত্যের চেয়ে সমৃদ্ধ হবে।’ 

মাইকেল হ্যানচার কর্তৃক ২০১৪ সালে  রচিত ‘কলেজ ইংলিশ ইন ইন্ডিয়া: দ্য ফার্স্ট টেক্সটবুক’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে আমরা স্যার টমাস বেবিংটন ম্যাকলের ভারতকে ইংরেজীকরণ প্রচেষ্টার একটি বিস্তারিত আলোচনা পাই। হ্যানচার গৌরি বিশ্বনাথনের যুগান্তকারী গ্রন্থ মাস্কস অব কনকুয়েস্ট : লিটারারি স্টাডি অ্যান্ড ব্রিটিশ রুল ইন ইন্ডিয়া (১৯৮৯) থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলছেন যে ম্যাকলের প্রচেষ্টায়  খোদ ইংল্যান্ডে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যপাঠ একটি অধ্যয়নিক বিষয় হিসেবে পঠিত হবার আগেই ভারতে প্রতিষ্ঠা পায়। ১৮৫৭ সালে কলকাতা, বোম্বে এবং মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজি ভাষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চ পর্যায়ে স্বীকৃতি দেওয়া।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় ছাড়াও ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতের সরকারি স্কুলগুলোতে কয়েকটি পাঠ্যবই নির্দিষ্টকৃত হয়। ১৮৫৩ সালে হাউজ অব লর্ডসের একটি সভার প্রতিবেদন অনুযায়ী ডেভিড লেস্টার রিচার্ডসন (১৮০১- ১৮৬৫) সম্পাদিত পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস  (যেখানে অর্ন্তভুক্ত ছিল গোল্ডস্মিথ, গ্রে, অ্যাডিসন, পোপ এবং শেক্সপিয়ার প্রমুখের কাব্যনিচয়), ওটওয়ের ভেনিস প্রিজার্ভড, শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট, ওথেলো, এবং ম্যাকবেথ, পোপের অনূদিত হোমারের ইলিয়াড, এবং মিল্টনের প্যারাডাইজ লস্ট-এর প্রথম চারটি বই।

রিচার্ডসন ১৮৩৬ সাল থেকে কলকাতাস্থ হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ এবং ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। হিন্দু কলেজে তখন কেবলমাত্র ভদ্রঘরের হিন্দু ছেলে, বয়স ৫ থেকে ২২ পর্যন্ত, ভর্তি করা হতো। রিচার্ডসনের সম্পাদিত পাঠ বইটির সম্পূর্ণ নাম ছিল সিলেকশনস ফ্রম দ্য ব্রিটিশ পোয়েটস ফ্রম দ্য টাইম অব চসার টু দ্য প্রেজেন্ট ডে উইদ বায়োগ্রাফিক্যাল অ্যান্ড ক্রিটিক্যাল নোটিসেস। এই বৃহৎ সংকলনটির দুটি  বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য: এটিতে লেখকক্রম ছিল লেখকের জন্ম সাল অনুযায়ী ক্রম সাজানো, আর পুরো খণ্ডটি ছিল এক ভল্যুমের, অনেকটা আধুনিক যুগের নর্টন অ্যান্থোলোজিগুলোর মতো। রিচার্ডসন ছিলেন ম্যাকলে এবং বড় লাট লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংকের মতো অ্যাঙলিসিস্ট বা ইংরেজি-পরায়ণ। সে দিক থেকে রিচার্ডসনের পাঠ্য বইটি ছিল ভারতকে ইংরেজিকরণের প্রচেষ্টার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

এর মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৮৩৫ সালে লর্ড বেন্টিংক একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেন। তিনি রাষ্ট্রীয় খাত থেকে প্রাচ্য ভাষা যেমন আরবি ও সংস্কৃত চর্চার টাকা সরিয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের চর্চার জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত দেন। এই সিদ্ধান্তটি বস্তুত মুসাবিদা করেন ম্যাকলে যিনি তখন সুপ্রিম কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার সদস্য ছিলেন। এই মুসাবিদাটিই ম্যাকলের সেই বিখ্যাত ‘মিনিট’ যেটির কথা আগেই বলেছি। ম্যাকলে নিজে কখনও তাঁর ‘মিনিট’ ছাপানোর উদ্যোগ নেননি, কিন্তু তাতে কি, তাঁর কথাগুলোই আজকে যে কোন ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিক আলোচনায় রণিত এবং অনুরণিত। প্রাচীন ভাষাগুলোর পেছনে অর্থ খরচ না করে তিনি বললেন যে ‘ইংরেজি জানাটাই এখন আরবি আর সংস্কৃত জানার চেয়ে জরুরি’ এবং ‘ইংরেজি সাহিত্যের গুণাবলি তিনশ বছর আগের চালু ভাষাগুলোর সম্মিলিত গুণের চেয়ে শক্তিশালী।’ ভাষা শিক্ষার ওপর ঐ সিদ্ধান্ত বেন্টিংকের ভারতবাসের শেষ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। তিনি ভগ্নস্বাস্থ্যে ১৮৩৫ সালের ২০ মার্চ ভারত ছাড়েন।

রিচার্ডসন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষের পদটি পান ম্যাকলের কাছে তদ্বির করে। ১৮৩৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কমিটি অন পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের একজন সদস্য হিসেবে ম্যাকলে হিন্দু কলেজ পরিদর্শনে আসেন এবং নিজেই একুশজন সিনিয়র ছাত্রের লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা নেন। তিনি তাদের কৃতকার্যতায় মোটামুটিভাবে সন্তুষ্ট হন, কিন্তু বললেন যে ছেলেগুলো সাহিত্যে প্রচুর দখল প্রদর্শন করলেও ইংল্যান্ডের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের জ্ঞান দুর্বল। রাজনারায়ন দত্ত নামক একজন ছাত্রের খুব প্রশংসা করলেন। এবং বললেন যে ক্যাপ্টেইন রিচার্ডসন নিশ্চয় উল্লেখ্য খামতির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবেন। এই কারণে রিচার্ডসন পোয়েটিক্যাল সিলেকশনস সম্পাদনার উদ্যোগ নেন, যেটি ১৮৪০ সালে প্রকাশিত হয়। তবে এর মধ্যে ১৮৩২ সালে জে ই ডি বেথুন পোয়েটিক্যাল রিডার্স নামক কয়েকটি সংকলন তৈরি করেন, যেগুলি কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি পুনঃ পুনঃ প্রকাশ করে।

রিচার্ডসনের সিলেকশনস ফ্রম বৃটিশ পোয়েটস-এর পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১০৪০। এটি ছাপা হয়েছিল ডাবল কলামে। এটির একটি কপি বৃটিশ কাউন্সিলে সংরক্ষিত আছে, আরেকটি আছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হটন লাইব্রেরিতে। হার্ভার্ডে সংরক্ষিত বইটির উৎসর্গপত্রে লেখা আছে ‘প্রেজেন্টেড টু / দ্য রাইট অনারেবল টি বি ম্যাকলে / বাই দ / জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন / বেঙ্গল / কলকাতা / ফার্স্ট মার্চ ১৮৪১।’ রিচার্ডসন নিজে সনেট লিখতেন এবং সংকলনটিতে তাঁর নিজের কবিতাও অন্তর্ভুক্ত করেন। কিছুদিনের মধ্যে রিচার্ডসনের সঙ্গে যুক্ত হন ম্যাকলের শ্যালক চার্লস এডওয়ার্ড ট্রেভেলিয়ান, যিনি ম্যাকলেকে উদ্বুদ্ধ করেন যে পোয়েটিক্যাল সিলেকশন্সের পাশাপাশি একটা প্রোজ সিলেকশনসও প্রকাশ করা দরকার। অবশ্য সেটি শেষ পর্যন্ত রূপ নিতে পারে নি। রিচার্ডসনের সংকলনের শেষ ভাগে ‘মিসেলেনিয়াস’ নামক অংশে ম্যাকলের ‘দ্য আর্মাডা’ শীর্ষক কবিতাটি ছাপা হয়। 

পোয়েটিক্যাল সিলেকশসন ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে একটি দক্ষভাবে সম্পাদিত সংকলন হলেও, শ্রেণিকক্ষে এটির কার্যকারিতা স্পষ্ট হয় না। তবে এটি সম্পাদনার পেছনে ম্যাকলের সক্রিয় চিন্তা কার্যকর ছিল, যেটি রিচার্ডসন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। অর্থাৎ, সংকলনটি লেখকের জন্ম-ক্রমানুসারে ছাপা হলেও এটির একটি উদ্দেশ্য ছিল যে ভারতীয়রা যেহেতু নৈতিকভাবে দুর্বল (‘আ ওয়ান্ট অব মর‌্যাল’) এবং সে জন্য কবিতাকে মানসিক চিকিৎসা হিসেবে গণ্য করা হয়। রিচার্ডসন ভূমিকায় লিখলেন, ‘মিল্টন এবং শেক্সপিয়ার তরুণ ভারতীয় নেইটিভসদের শিখিয়ে দিক ঐশ্বরিক সৌন্দর্য যার প্রভায় মানুষের চিত্ত কেমন শুদ্ধ হয়। যাদেরকে এই কবিদের পড়ানো হবে তারা এক অফুরন্ত আনন্দের নির্ঝরধারায় স্নাত হবে।’অর্থাৎ, শুরুতে যেমন বলেছি যে শেক্সপিয়ারের ভূগোল-দর্শন। নৈতিকতার দ্বারা উদ্বোধিত ছিল, তেমনি বেন্টিংক, ম্যাকলে, রিচার্ডসন ও ট্রেভেলিয়ানরা মনে করতেন যে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য হলো নৈতিক শিক্ষার বাহন। তারপর রিচার্ডসন বললেন, ‘এ ছাড়া তারা ইংরেজিটা শিখতে পারবে। ভারতীয় নেইটিভসরা ইংরেজ কবিদেরকে পড়বে, যেভাবে ইংরেজ ছাত্ররা গ্রিক এবং রোমান কবিদের পড়ে, যার ফলে তারা শুধু কবিদের ভাবধারা ও আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হবে না, কবিরা যে ভাষায় লিখেছেন সে ভাষার সঙ্গেও পরিচিত হবে।’ বস্তুত রিচার্ডসন যে পদ্ধতিতে ভারতীয় নেইটিভসদের ইংরেজি সাহিত্য ও ভাষা শেখানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সে পন্থায় প্রায় একই সময়ে কবি ম্যাথু আর্নল্ডের পিতা ড. টমাস আর্নল্ড ইংরেজি শেখানোর চিন্তা করেছিলেন। ১৮৩৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর একটি চিঠিতে তিনি এ অভিমত ব্যক্ত করলেন যে ‘এটি কি যে আনন্দের ব্যাপার হতো যদি আধুনিক এথেন্সে একদল গ্রিক যুবাকে শেক্সপিয়ার পড়াতে পারতাম, লাইন বাই লাইন, ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড, এমনভাবে যেটি অনুবাদের মতোই সহায়ক হতো।’ (হ্যানচার)

কিন্তু না ইংরেজি সাহিত্য, না ইংরেজি ভাষা এইভাবে শেখা বিদেশিদের পক্ষে সম্ভব! রিচার্ডসনের সংকলনটিতে পাদটীকা ছিল খুব কম অথবা অন্যান্য তথ্যও ছিল যৎকিঞ্চিৎ। ফলে ভারতীয় ছাত্রদের জন্য এটি অবশ্য পাঠ্য থাকলেও সহজপাঠ্য ছিল না। সাধারণভাবে বিষয়টির প্রতি নজর দিয়ে এলফিনস্টোন কলেজের ইতিহাস এবং সাহিত্যের অধ্যাপক আর টি রিড ১৮৫০ সালে বললেন যে ‘এটি অতি জরুরি যে বিদেশি ছাত্র, বিশেষ করে, এশিয়ার ছাত্রদের অসুবিধা অনুধাবণ করা। তারা যেহেতু ভাষা বা প্রেক্ষাপটের সঙ্গে যুক্ত নয়, তাদেরকে সকল ব্যাখ্যার জন্য শিক্ষকের সাহায্য নিতে হয়। তা না হলে তারা ইউরোপীয় প্রাচীন ইতহাস, ভূগোল এবং পুরাণ কিছুই বুঝতে পারবে না।’ (হ্যানচার)

হ্যানচার তাই সঠিক মন্তব্য করলেন এই বলে যে এই ধরনের সংকলন পড়ে ছাত্ররা খুঁটিনাটিগুলো বুঝতে পারে না, মোটামুটি একটা ধারণা করে মাত্র। ১৮৪৪ সালে হেনরি কার টাকার নামক একজন শিক্ষা কর্মকর্তা পরামর্শ দিলেন যে মোটা মোটা বই না দিয়ে হালকা পাতলা টেক্সট দিলেই বরঞ্চ ভালো। কেউ কেউ বললেন যে রিচার্ডসনের সংকলনটি বিকন (আলো) হবার বদলে পেপারওয়েট হয়ে গেছে। তারপরও ম্যাকলে রিচার্ডসনের সংকলনটি এবং তাঁর ছাত্রদের ইতিবাচক শিক্ষা গ্রহণের কথা ভুললেন না। ম্যাকলে ২১ জানুয়ারি ১৮৩৮ সালে ভারত ছেড়ে যান, কিন্তু এর কুড়ি বছর পর, অক্টোবর ৭, ১৮৫৮ সালে তাঁর বাসভবন হোলি লজ, কেনসিংটন থেকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি রিচার্ডসনকে লিখলেন যে ‘আমি এখনও স্পষ্ট মনে করতে পারি যে বোর্ড অব এডুকেশনের আমরা কয়েকজন নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করেছিলাম যখন হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে আপনাকে নিয়োগ দিতে পেরেছিলাম, এবং ইংরেজি সংকলনটার সম্পাদনার দায়িত্ব আপনাকে দিয়েছিলাম। আমি এটাও মনে করতে পারি যে আমি ভারত ছাড়ার কিছু পূর্বে আমি আপনার কলেজের কয়েকজন ছাত্রের পরীক্ষা নিয়েছিলাম এবং অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছিলাম তাদের ইউরোপের ওপর জ্ঞানের গভীরতা দেখে।’

এভাবে ম্যাকলে ভারতের প্রথম ইংরেজি টেক্সট বই প্রণিধানের ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তাকে ব্যাপৃত করেন। ভারতে ইংরেজি শিক্ষা প্রবর্তনের ফলে মূল অসুবিধাটা হয়ে গেল যে স্থানীয় যে প্রকাশভঙ্গিগুলো ছিল সেগুলি বিনষ্ট হয়ে গেল, এবং নতুন যে প্রকাশভঙ্গিগুলো তার জায়গায় এল―যেমন ইংরেজি কথন, পঠন এবং লিখন, সেগুলিই স্বাভাবিক  হিসেবে গৃহীত হলো। এই সংকলনটি শেক্সপিয়ারের চর্চার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়।

ভারতবর্ষে শেক্সপিয়ারের সাহিত্য চর্চার দ্বিধান্বিত রূপ

ম্যাকলের ভাষাগত রূপরেখা দু’ধরনের স্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি করে। ম্যাকলের ইংরেজি-কেন্দ্রিক ভাষাচিন্তা রাজনৈতিক সমীকরণে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্বরই প্রচারণার স্বরূপ। এবং এই ধারণায় দীক্ষিত হয়ে ইংরেজি-শিক্ষিত ভারতীয়রা যেন নিজেদেরকেই ইংরেজি-জানা লোক নয়, ইংরেজ সাহেব হিসেবেই ভাবতে লাগল। এই অটোকথনোস আইডেন্টিটি৪ বা উৎকেন্দ্রিক জাতীয়তা বোধসম্পন্ন মানসিকতার সম্ভাব্য চিত্রকল্প হতে পারে এরকম যে একটি পিরামিডের চূড়ায় তারা অবস্থান নিল, এবং তারা যেন সকল জ্ঞানের আধার হয়ে রইল, আর তাদের থেকে যেন জ্ঞান নীচের দিকে চুঁইয়ে পড়বে। সমালোচকেরা তাদেরকে বাদামি সাহেব নাম দিল, বা আধুনিক যুগে সম্ভবত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ইংরেজি শিক্ষিত নাক-উঁচু সম্প্রদায়কে ম্যাকলের সন্তান বলে অভিহিত করলেন। বস্তুত সাম্প্রতিক গবেষকেরা যেমন গৌরী বিশ্বনাথন, জ্যোৎস্না সিং, হোমি ভাবা প্রমুখ বলছেন যে বৃটিশেরা ভারতীয় ‘এলিট’ গ্রুপকে এই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার টার্গেট করেছিল। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পুরোটাই বৃটিশ স্টাইলে হতে লাগল। এ ধারার শিক্ষিতজনের মধ্য থেকে বাছাইকরণের মাধ্যমে আই সি এস প্রশাসক নিয়োগ হতে লাগল, এবং এদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের কোন অর্থপূর্ণ সম্পর্ক রইল না।৫ ম্যাকলের বিখ্যাত কিংবা কুখ্যাত উক্তিটি আরেক বার স্মতর্ব্য : এই ইংরেজি শিক্ষিত প্রশাসকেরা হবেন, ‘Indian in blood and colour, but English in taste, in opinions, in morals and in intellect.’ সুদীপ্ত ব্যানার্জি, জ্যোৎস্না সিং প্রমুখ লক্ষ্য করলেন যে এলিট গ্রুপের মধ্যে বাঙালি শিক্ষিত পরিবারগুলোই বেশি এগিয়েছিল। জ্যোৎস্না সিংএর ভাষায়, ‘তারা নিজেদের জন্য একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় খুঁজে নিতে আগ্রহী ছিল। হোমি ভাবা এই প্রক্রিয়াটির নাম দিলেন “হাইব্রিডাইজেশন”, অর্থাৎ একটি মিশ্রণ, যার ফলে ঔপনিবেশিক শক্তি এই চাতুর্যের অবতারণা করতে পারল যে ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয় এলিট বা অভিজাত শ্রেণির সঙ্গে ঔপনিবেশিক শাসকপক্ষ বৃটিশদের কোন পার্থক্য রইলো না, আবার অন্যদিকে প্রজাদের মধ্যে জাত-প্রথার পার্থক্যটা ঠিকই রয়ে গেল। অর্থাৎ কৌশলটা হলো এমন যে ইংরেজ শাসকেরা ভারতীয় জনগোষ্ঠীর খুব বাছাই করা একটি সমশ্রেণির মর্যাদা দিয়ে যেন পুরো ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে মর্যাদা দিচ্ছে এমন একটি তরিকার সৃষ্টি করল। যেন আইসিএসরা সারা ভারতের প্রতিনিধি, যেটাকে ইংরেজি ভাষার রূপকল্পে সিনেকডোকি বলা যায়। অর্থাৎ একটি অংশকে (পার্ট) মর্যাদা দিয়ে যেন পুরো জনগোষ্ঠীকে মর্যাদা দেওয়া হলো। অথচ কার্যত ঔপনিবেশিক শাসনের প্রক্রিয়াটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। শাসনভার নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ঔপনিবেশিক শাসকের প্রয়োজন ছিল ভারতে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, জাতগত, গোত্রীয়, এবং প্রশাসনিক ভিন্নতাগুলো জিইয়ে রাখা। এই হাইব্রিডাইজেশন বা মিশ্রণ যে আসলে একটি মিথ্যা চক্র সেটিই হোমি ভাবার সংজ্ঞা, এবং সেটিই সাধারণভাবে বিখ্যাত “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতি হিসেবে কথিত হয়। এর থেকে অনুমান করা যায় যে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা সম্ভবত এটি প্রচার করতেন যে ভারতীয়দের তাদের কোন তফাৎ নেই, এবং ভারতীয়দের নিজেদের মধ্যেও তারা কোন তফাৎ দেখে না।’

দ্বিতীয় একটি সমস্যা তৈরি হলো, যেটি যতটা না ভারতীয়দের জন্য তার চেয়ে বেশি ইংরেজ শাসকশ্রেণির জন্য। সেটি হলো, একটি দ্বি-ফলা পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। এক দিকে ইংরেজি শিক্ষিত হয়ে উঠে একটি শ্রেণি যেমন ইংরেজদের প্রতি প্রবল আনুগত্য প্রকাশ করছিল, অন্য দিকে ইংরেজি শিক্ষিত হয়ে অনেকের মধ্যে ইংরেজ তথা ইংরেজ শাসনের প্রতি বিরোধিতা তৈরি হতে লাগল। এই দ্বিফলা রীতি―যেখানে একই সঙ্গে আনুগত্য এবং প্রতিরোধের সংঘর্ষ হয়, সেই রীতি কিন্তু, আমরা দেখি, বহু আগেই শেক্সপিয়ার আন্দাজ করেছিলেন। যেমন দ্য টেম্পেস্ট নাটকে―ঔপনিবেশিক যুগের শুরুর বহু আগে―একটি ঔপনিবেশিক পরিস্থিতি শেক্সপিয়ার আন্দাজ করে এঁকেছিলেন। নাটকের মূল চরিত্র প্রসপেরো যে দ্বীপে শিশুকন্যা মিরান্ডাকে নিয়ে নির্বাসিত হোন, সে দ্বীপটির মালিকানা ছিল সাইকোরাক্সের যার মৃত্যুর পর তার ছেলে ক্যালিবান ছিল প্রকৃত  মালিক। কিন্তু প্রসপেরো শুধু দ্বীপটিতে আশ্রয় নিলেন না, তিনি এটি দখলে নিয়ে নিলেন এবং ক্যালিবানকে তাঁর ভৃত্যে পরিণত করলেন। তারপর প্রসপেরো ক্যালিবানকে তাঁর ইউরোপীয় ভাষা শেখালেন। এক পর্যায়ে ক্যালিবানের মধ্যে প্রসপেরোর প্রতি বিরাগ জন্মায় এবং সে প্রসপেরোকে বলে যে ‘তুমি আমাকে তোমার ভাষা শিখিয়েছ, এবং এত আমার লাভ হয়েছে এই যে আমি তোমাকে তোমার ভাষায় গালাগাল করতে পারি। আমাকে তোমার ভাষা শেখানোর অপরাধে যেন ভয়াবহ প্লেগ রোগ তোমাকে নিকেশ করে দেয়।’ ‘You taught me language, and my profit on’t / Is I know how to curse. The red plague rid you / For learning me your language’ (1.2.364-66)

ম্যাকলের সুবিখ্যাত সমসাময়িক রাজনীতিজ্ঞ ও লেখক টমাস কার্লাইল তাঁর ১৮৪০ সালে প্রকাশিত দ্য হিরো অ্যাজ পোয়েট গ্রন্থে একটি অবিশ্বাস্য তুলনা আনলেন। তিনি ব্রটেনের উপনিবেশ ভারতের সঙ্গে অদ্ভুত উপায়ে শেক্সপিয়ারের সঙ্গে তুলনা টেনে বললেন যে একদিন আসবে যখন ব্রিটিশ রাজকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে তারা কি ভারত ছাড়বে নাকি ছাড়বে না। ভারত হয়তো তারা ছাড়বে, কিন্তু শেক্সপিয়ারকে তারা কখনও ছাড়তে পারবে না। তিনি তাঁর স্বজাতির প্রতি এ প্রশ্নটি ছুঁড়লেন, যেটি আমি এখন হরিশ ত্রিবেদীর বই থেকে উদ্ধৃতি করে দিচ্ছি:

Consider now, if they [‘foreign nations’—Trivedi] asked us, Will you give-up your Indian Empire or your Shakespeare, you English; never have had any Indian Empire, or never have had any Shakespeare ? Really it was a grave question. Official persons would doubtless answer in official language; but we, for our parts, should not we be forced to answer; Indian Empire or no Indian Empire: we cannot do without Shakespeare! Indian Empire will go, at any rate some day; but this Shakespeare does not go, he lasts forever with us; we cannot give-up our Shakespeare!

অনুবাদ : বিবেচনা করুন, যদি বিদেশিরা আমাদেরকে জিজ্ঞেস করে, হে ইংরেজ, তোমরা কি ভারত সাম্রাজ্য ছাড়বে নাকি শেক্সপিয়ারকে ছাড়বে ? ধরো, তোমাদের কোনওদিন ভারত সাম্রাজ্য ছিল না, বা ছিল না শেক্সপিয়ার। গুরুতর প্রশ্ন। সরকারি কর্মকর্তারা সরকারিভাবে জবাব দেবেন। কিন্তু আমাদেরকে প্রশ্নটা করা বাতুলতা। ভারতীয় সাম্রাজ্য আমাদের থাক বা না থাক, কিন্তু আমরা শেক্সপিয়ারকে ছাড়া থাকতে পারব না। ভারতীয় সাম্রাজ্য একদিন আমাদের হাত থেকে চলে যাবে, যে কোন ভাবে, কিন্তু এই শেক্সপিয়ার যাবে না। সে আমাদের সঙ্গে থাকবে চিরদিন; আমরা আমাদের শেক্সপিয়ারকে ত্যাগ করতে পারি না।

কার্লাইলের তুলনা থেকে এটি স্পষ্ট হয় যে উপনিবেশবাদের শুরুর দিকে ভারত এবং শেক্সপিয়ার বৃটিশ সাম্রাজ্যের অতি লোভনীয় দু’টো প্রাপ্তি হিসেবে গণ্য হয়েছিল। শেক্সপিয়ার অবধারিতভাবে বৃটিশ সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক আইকনে পরিণত হোন। কার্লাইলের ভারত-শেক্সপিয়ার যুগ্মতা অগ্রসরমান দশকগুলোতে নানা প্রকরণে কবি লেখকদের মনে কাজ করতে থাকে। যেমন বৃটিশ কবি ও ইহুদিবাদের নেতা ইসরায়েল জ্যানগুইল (১৮৬৪-১৯২৬) একটি সনেটে শেক্সপিয়ারকে সমগ্র জাতিগুলির একক অধীশ্বর হিসেবে চিত্রিত করে বললেন যে বৃটিশ সাম্রাজ্যও সেরকম বিশ্বের অধিপতি।

Gentle Will Shakespeare . . .

[Holding ] the world in thrall

Imperial Bard of Briton, Roman, Gaul

Jew, Gentile, white or black

তারপর ষষ্ঠীতে গিয়ে শুরু করছেন `Such too is England’s Empire.’

`The Dream Imperial’ শীর্ষক কবিতার কবি ডব্লিউ পি রিভস (১৮৫৭-১৯৩২) নামক নিউজিল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী কিন্তু ইংল্যান্ডের স্থায়ী নিবাসী তাঁর কবিতায় বৃটিশ সাম্রাজ্যের বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শেক্সপিয়ারের অগ্রযাত্রার তুলনা করলেন। লিখলেন :

Then, as our warring, trading, reading race

Moved surely outward to imperial space,

Beyond the tropics to the ice-blink’s hem,

The mind of Shakespeare voyaged forth with them.

উইলিয়াম ওয়াটসন (১৮৫৮-১৯৩৫) নামক আরেকজন কবি শেক্সপিয়ারের সঙ্গে এভারেস্টের তুলনা করলেন:

Here are the heights, crest beyond crest

With Himalayan dews impearled

And I will watch from Everest

The long heave of the surging world.

ওপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলো দিলাম শেক্সপিয়ারের বিশ্বজনীনতার ভাবমূর্তি বোঝানোর জন্য, যেটি ভারত শাসনের শুরুতে ইংরেজরাও ভারতীয়দের মনে প্রোথিত করার চেষ্টা করে। শেক্সপিয়ারের অসামান্য প্রতিভাকে, তাঁর বিশ্বজনীন স্বীকৃতিকে ক্ষুরধার ইংরেজ রাজনীতিকেরা ইংল্যান্ডের বিশ্ব-স্বীকৃত অগ্রমানতার সঙ্গে তুল্যমূল্য করে ফেলে। অর্থাৎ, যেখানে কার্লাইল ইংল্যান্ডের দু’টো অসামান্য সম্পদ হিসেবে ভারত এবং শেক্সপিয়ারকে দেখেছিলেন, সেখানে ইংরেজ কূটনীতির ঔপনিবেশিক পরিচালনে শেক্সপিয়ার হয়ে পড়েন ভারত শাসনের মূল সাংস্কৃতিক উপকরণ বা অস্ত্র। আগে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলাম, যেগুলিতে মানবিক বিষয় অধীত হবার জন্য পাঠ্যক্রমে শেক্সপিয়ার সহ অন্যান্য প্রাগ্রসর ইংরেজ লেখক ও কবির ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য, সেটির উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছিল কিন্তু ভারত শাসনের প্রথম দিকে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকদের ব্যর্থতার পর। অর্থাৎ, ভারত উপনিবেশকালের শুরুর দিকে ইংরেজ শাসকেরা চেয়েছিল ধর্মের পথে শাসন করতে। অর্থাৎ, ভারতীয় জনগণকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত করে শাসনের পালা তার শুরু করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটি প্রথম কয়েক দশকের মধ্যেই ব্যর্থ হয়। তখন তারা মানবতার জয়গান-সমৃদ্ধ ইংরেজি সাহিত্য পঠনপাঠনের ওপর জোর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলে, এবং ম্যাকলের ১৮৩৫-এর প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে এ চিন্তাটি―অর্থাৎ ইংরেজি সাহিত্য ও ভাষা পঠনপাঠনের ভিত্তিতে ভারতীয়দের ঔপনিবেশিক শাসনে প্রতি অনুরক্ত রাখা―পূর্ণতা লাভ করে, এবং অবশ্যম্ভাবী শেক্সপিয়ার হয়ে পড়েন প্রচারণামূলক এ অভিব্যক্তির শিখণ্ডী।

উইলিয়াম মিলার (১৮৩৮-১৯২৩) নামক একজন অধ্যাপক দক্ষিণ ভারতের একটি কলেজে শেক্সপিয়ার পড়াতেন। তাঁর কাছে শেক্সপিয়ার ছিলেন, পূর্বে উল্লেখিত রিচার্ডসনের ধারণার মতোই, নৈতিকতার মানদণ্ড, যেটির মাধ্যমে তিনি ভারতীয় শিক্ষার্থীদের চরিত্র সংশোধনে ব্রতী ছিলেন। তিনি বলতেন যে শেক্সপিয়ারকে একবার অনুধাবণ করতে পারলেই বাকি জীবনে আর অসুবিধায় পড়তে হবে না। বিখ্যাত ইংরেজ শেক্সপিয়ার পণ্ডিত এ. সি. ব্র্যাডলি তাঁর বিশ্বনন্দিত গ্রন্থ শেক্সপিয়ারিয়ান ট্র্যাজেডি প্রকাশ করেন ১৯০৪ সালে, যেটিতে তিনি শেক্সপিয়ারের চারটি নাটককে শেক্সপিয়ারের গ্রেট ট্র্যাজেডি বললেন: হ্যামলেট, ওথেলো, কিং লিয়ার এবং ম্যাকবেথ। কিন্তু সাল বিবেচনায় অনুমিত হয় যে মিলার ব্র্যাডলির আগেই অনুধাবণ করতে পেরেছিলেন যে শেক্সপিয়ারের অমর সৃষ্টি বলতে কোন নাটকগুলি হবে, কেন না তিনি দ্রুততার সঙ্গে শেক্সপিয়ারের পাঠের ওপর যে কয়টি বই প্রকাশ করলেন, বইগুলোর শিরোনাম সেটিরই ইঙ্গিত দেয়: King Lear and Indian Politics (1900), Macbeth and the Ruin of Souls (1901), Othello and the Crash of Character (1901), এবং সব শেষের বইটি, Hamlet and the Waste of Life (1902).

মিলার যে কি পরিমাণে শেক্সপিয়ারকে নৈতিকতার শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করতেন, সেটি বোঝা যায় যখন ১৯০৫ সালে তিনি উপরোক্ত গ্রন্থগুলির একটি পূর্ণাঙ্গ খণ্ড প্রকাশ করলেন, আর শিরোনাম দিলেন: Shakespeare’s Chart of Life.

কিন্তু এরপর দ্রুত পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়, তার প্রতিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘স্যার’ উপাধি বর্জন করেন, গান্ধিজি ১৯২০-২১ সালে স্বাধীনতার  দাবিতে পুরো ভারত জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেন, এবং রবীন্দ্রনাথের সতীর্থ ও জীবনীকার এডওয়ার্ড টমসন (১৯৮৬-৪৬) ইংরেজদের নির্যাতন লক্ষ্য করে মর্মাহত হয়ে বললেন, এটি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ নামক মেডেলটির অপর দিক―’other side of the medal’.

তখন শেক্সপিয়ারকে নিয়ে যে বিতর্কটা উঠল, যেটি প্রথম দিকে কেবল আমেরিকা ও ভারত উপনিবেশ নিয়ে চালু ছিল, কিন্তু যেটি এখন পুরো বিশ্বময় হয়ে গেছে, সেটি হলো শেক্সপিয়ার কি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণের বা কালচারাল ইম্পেরিয়ালিজমের প্রতিনিধি নাকি সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের বা ইন্টারকালচারিলজমের প্রতিনিধি!

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর পর গান্ধির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে, তার বিপরীতে শেক্সপিয়ারকে তখন অনেকেই ঔপনিবেশিক নিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে লাগলেন। স্মরজিৎ দত্ত নামক একজন লেখক ১৯২১ সাল থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে ম্যাকবেথ, ওথেলো এবং হ্যামলেটের ওপর তিনটি প্রবন্ধ ছাপলেন, প্রত্যেকটির শিরোনামে এই উপ-শিরোনাম An Oriental Study রাখলেন। দত্ত করলেন কি প্রতিটি নাটক থেকে বিখ্যাত উদ্ধৃতিগুলো বাছাই করে দেখালেন যে এইগুলি প্রত্যেকটির চেয়ে উন্নততর সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে সংস্কৃত সাহিত্যে। অর্থাৎ, দত্তের শেক্সপিয়ারের পাঠ ছিল এই বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিবেদিত যে শেক্সপিয়ার সর্বজনীন ও ঔপনিবেশিক শক্তির পুরোধা সাহিত্যিক হলেও তাঁর চেয়ে শক্তিশালী সাহিত্য ভারতভূমিতে পূর্বেই রচিত হয়েছিল। প্রকাশিত গ্রন্থগুলির একটিতে তিনি এপিগ্রাফ হিসেবে একটি সংস্কৃত শ্লোকের অনুবাদ করে দেন: ‘Slavery enforced by brute force is degrading enough, Your Majesty! / But slavery of the mind is truly a hundred times more deplorable’—‘যে দাসত্ব শারীরিকভাবে প্রয়োগকৃত তা নিশ্চয় অবমাননাকর, জাঁহাপনা / কিন্তু মানসিক দাসত্ব এরচেয়ে শতগুণে নিকৃষ্ট।’ যে কথাটি আরও স্পষ্ট ভাষায়,  প্রায় ছয় দশক পরে, ১৯৮৬ সালে, আফ্রিকার লেখক আনগুজি ওয়া থিওঙ্গ তাঁর ডিকলোনোইজিং মাইন্ড (১৯৮৬) গ্রন্থে বললেন, ‘The bullet was the means of the physical subjugation. Language was the means of the spiritual subjugation’—‘বুলেট হলো শারীরিক বশ্যতা আনয়নের অস্ত্র আর ভাষা হলো মানসিক বশ্যতা নিশ্চিত করার অস্ত্র।’

স্মরজিৎ দত্তের চেয়েও শেক্সপিয়ারকে কঠিন ভাষায় আক্রমণ করলেন রঞ্জি জি শাহনি। তিনি বহুবছর ধরে বিলাতে বসবাস করছিলেন। ১৯৩২ সালে তিনি Shakespeare Through the Eastern Eyes শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করলেন, এবং বললেন, ভারতে শেক্সপিয়ারকে খুব ভুলভাবে পড়ান হয়েছে। এমনকি ইংরেজ অধ্যাপকেরাও সঠিকভাবে পড়াননি। তাঁর নিজের কলেজের অধ্যক্ষের প্রসঙ্গ টেনে বললেন, তিনি এমনভাবে পড়াতেন যেন শেক্সপিয়ার ছিলেন শত-মনা, ঈগলচক্ষু বিশিষ্ট, ঐশ্বরিক, উপাদেয় একজন মহৎ ইংরেজ। তারপর বললেন, শেক্সপিয়ারের রচনায় এবং চরিত্রচিত্রণে এত বেশি ঘাটতি আছে যে তা ভালো শিক্ষক দিয়েও পূরণ করার মতো নয়। তিনি লিখলেন, শেক্সপিয়ারের সঙ্গে প্রাচ্যের বিরোধ হচ্ছে রহস্যময়তায় ও ধর্মীয়বোধে: ‘The first quarrel of the Oriental with Shakespeare is on the mystical and religious ground; the second and perhaps more pervasive may be termed as intellectualist. Briefly, we may sum it up in the query: Was Shakespeare a thinker ?’

অনুবাদ: ‘শেক্সপিয়ারের সঙ্গে প্রাচ্যের প্রথম বিরোধটা হলো রহস্যময়তায় ও ধর্মীয়বোধে। দ্বিতীয়ত, যেটি সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সেটি হলো বুদ্ধিবৃত্তিক বিন্যাসে। সংক্ষেপে, আমরা এই প্রশ্নটির মধ্য দিয়ে বিতর্কটির সার বুঝতে পারি: শেক্সপিয়ার কি চিন্তাশীল লেখক ছিলেন ?’

বস্তুত বইটির প্রতিক্রিয়ায় ইংরেজদের প্রতিক্রিয়াও ছিল বক্রোক্তিপূর্ণ। জে মিডল্টন মারির মতো যশস্বী লেখক বইটির ভূমিকায় লিখলেন, ‘এই বইটির বিষয়ের সঙ্গে আমি খুব অল্পই একমত হয়েছি। তবে বলতে পারি, আল্পস পর্বতের এক পার্শ্বের সত্য যে অন্য পার্শ্বের মিথ্যা সেটিই আমার জন্য সান্ত¦নাব্যঞ্জক। টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্টের আলোচক বইটিকে “প্রটেস্ট” বই হিসেবে নিলেন, এবং অনেকটা প্রধান শিক্ষকের দুষ্ট ছাত্রকে দমন করার ভাষায় বললেন’, ‘এটি ভালোই হলো যে অবশেষে শিকারদের একজন বিদ্রোহের পতাকা উত্তোলন করেছেন।’ অধ্যাপক এমিল লিগুইজ বললেন, ‘শাহনির বইটিতে সম্ভবত সে সময়কার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উষ্মার কিছুটা রেশ পাওয়া যায়, কিন্তু, আমি আশা করি, অবস্থা নিরুত্তেজিত হয়ে পড়লে শেক্সপিয়ারের মূল্যায়ন আরও স্থিতিশীল মানসিকতা থেকে উঠে আসবে।’ (হরিশ ত্রিবেদী)

শেক্সপিয়ারের মূল্যায়নের আড়ালে শেক্সপিয়ার কি বৃটিশ এজেন্ট নাকি বিরোধিতার উৎস বিতর্কে রাজনীতির যে অভীপ্সা খেলা করেছিল, সেটি শেক্সপিয়ারের কাজ অনুবাদের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। ১৮৭০ সাল নাগাদ বলা যায় ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় শেক্সপিয়ার অনূদিত হতে শুরু করে। ত্রিবেদী বলছেন, শুধু হিন্দী ভাষায় ঐ সময়ে ৭০টি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ এবং তাঁর নাটককে ভিত্তি করে সাহিত্য রচিত হয়, আবার সংক্ষিপ্তাকারে প্রায় শ খানেকের বেশি অনুবাদ হয়। কিছু কিছু প্রকাশনা হয় সরল গদ্যে তাঁর নাটকের অনুবাদ। অনুবাদের ক্ষেত্রে নাট্যকারের প্রতি অনুবাদকের স্বাভাবিক শ্রদ্ধা থাকলেও, শেক্সপিয়ারের অনুবাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় নানা বিচিত্র ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে, যেগুলি শেক্সপিয়ারের নয়, কিন্তু অনুবাদকের। প্রাথমিকভাবে শেক্সপিয়ারের প্রতি আনুগত্য ও সমীহ প্রকাশ পেলেও, কৌণিক এবং ব্যাজোক্তিসমৃদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গিরও যথেষ্ট প্রকাশ মেলে।

শেক্সপিয়ারের নাটকের অনুবাদের মধ্যে প্রারম্ভিক পর্যায়ে, ১৮৮৮ সালে, দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিসের অনুবাদের সাক্ষাৎ পাই। আরিয়া, অর্থাৎ আ লেডি কতৃক অনূদিত এই নাটকটি স্পষ্টত একাধিক ইংরেজের উৎসাহে রচিত। রেভারেন্ড জি, টি, কারুথারস বস্তুত এই অনুবাদ সিরিজের পেছনে ছিলেন। আর স্যার এডইউন আর্নল্ড, যিনি পরিচিত ছিলেন গৌতম বুদ্ধের জীবনী নিয়ে দ্য লাইট অব এশিয়া শীর্ষক দীর্ঘ কবিতাটি লেখার জন্য, তিনি অনুবাদটির জন্য একটি ভূমিকা লিখে দেন। স্যার এডউইন বললেন যে নাটকটি, তাঁর মতে, বিশ্বস্ততার সঙ্গে মূলের অনুবাদ করেছে, তবে নাট্যকার ভালো করতেন যদি এপিগ্রাফ বা প্রারম্ভিক উক্তি হিসেবে পোর্শিয়ার অন্যতম পাণিপ্রার্থী মরোক্কোর যুবরাজের উক্তিটি উদ্ধৃত করতেন।

Mislike me not for my complexion,

The shadowed livery of the burnish’d sun,

To whom I am a neighbour, and near bred. (2.1.1-3)

অনুবাদ: ‘আমার গাত্রবর্ণের কারণে আমাকে অপছন্দ করবেন না।

প্রখর সূর্যালোকে মাজা গায়ের রং যেন আমার পোশাক,

সূর্যের অতি নিকট প্রতিবেশী আমি, তার নিচেই বেড়ে উঠেছি।’

স্যার এডউইনের এই প্রসঙ্গটা টানার উদ্দেশ্য হলো শেক্সপিয়ার যে জাত-বর্ণ-গোত্র-ধর্মের ভেদাভেদের ওপরে উঠে সর্বজনীন মানবতার জন্য লিখতেন সেটা প্রমাণ করা। গায়ের রং কোন ব্যাপার নয়, ভিতরের মানুষটাই প্রধান।

ভারতেন্দু হরিশচন্দ্র (১৮৫০-৮৫) উপমহাদেশে প্রথম শেক্সপিয়ারের নাটকের এডাপ্টেশন করেন। দ মার্চেন্ট অব ভেনিস অনূদিত হয় দুর্লভ বন্ধু হিসেবে ১৮৮০ সালে। তিনি সেখানে ধর্মীয় বিরোধটা দেখান ক্রিশ্চান আর ইহুদির মধ্যে নয়, বরঞ্চ হিন্দু আর জৈন ধর্মের মধ্যে। বাংলায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দ্য কমেডি অব এররস নাটকটি অনুবাদ করলেন ভ্রান্তিবিলাস নামে।   

একই সময়ে, ১৮৮২ সালে, মুনশি রত্ন চাঁদ দ্য কমেডি অব এররস অনুবাদ করলেন পুরোটাই ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে রেখে। ফলে সিরাকিউজ আর এফিসাস হয়ে গেল হিন্দুস্তান আর চীন, আর চরিত্রের নামগুলিও হয়ে গেল ভারতীয়। রত্ন চাঁদ কিছুটা স্বাধীনতাও নিলেন। তৃতীয় অংকের দ্বিতীয় দৃশ্যে সিরাকিউজের ভৃত্য ড্রমিও অ্যান্টিফোলাসের ভৃত্য ড্রোমিওকে পাচিকা নেল-এর শারীরিক বর্ণনা দেবার সময় বলে তার শরীরটা পৃথিবীর মতো উতল, বিভিন্ন দেশের মানচিত্র যেন ফুটে উঠেছে। কিন্তু শেক্সপিয়ারে আছে নেল-এর পাছায় আয়্যারল্যান্ড, ইংল্যান্ড তার গণ্ডদেশে, আর ইন্ডিজ আর আমেরিকা তার নাকে অলংকারে অলংকারে খচিত হয়ে আছে। কিন্তু রত্ন চাঁদের অনুবাদে প্রথম দেশটি ফুটে ওঠে হিন্দুস্তান, কেন না হিন্দুস্তান যেমন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশ, তেমনি নেল-এর মুখমণ্ডলও হলো শ্রেষ্ঠ। আর ইংল্যান্ড নেল-এর শরীরে দেখা যায় কি না যায়, কেন না এত ছোট দেশ সেটি। অশ্লীল ইঙ্গিতটি কি সেটা বোঝাই যাচ্ছে। এবং ইঙ্গিতটি মূূল শেক্সপিয়ার থেকে নেওয়া। শেক্সপিয়ারে আছে, অ্যান্টিফোলাসের ভৃত্য ড্রোমিও জিজ্ঞেস করছে, ‘Where stood Belgia, the Netherlands ?’ (3.2.37) সিরাকিউজের ভৃত্য ড্রোমিও উত্তর দেয়, ‘O, sir, I did not look so low’ (3.2.38).. অর্থাৎ, আমি শরম পেয়েছিলাম, ওর নিম্নাঙ্গের দিকে তাকাইনি। ইংল্যান্ডের ব্যাপারে রত্ন চাঁদের ইঙ্গিতটি তাঁরই উদ্ভাবন এবং ইংল্যান্ড-বিরোধী মানসিকতা পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।

পরবর্তী প্রজন্মে লালা সীতারাম (১৮৬১-১৯৩৭) শেক্সপিয়ারের অনুবাদক হিসেবে উল্লেখযোগ্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে ডিগ্রি নেবার পর তিনি দ্রুত কৌলীণ্য পান এবং রায় বাহাদুর খেতাব লাভ করেন। ম্যাকলে তাঁকে দেখলে অবশ্যই খুশি হতেন যে তাঁর পরিকল্পনা সফল হয়েছে। সীতারাম কেন শেক্সপিয়ারের ছ’টি নাটক উর্দুতে এবং চৌদ্দটি নাট হিন্দিতে অনুবাদ করলেন তার ব্যাখ্যা দিলেন তাঁর ইংরেজিতে রচিত ভূমিকায়:

An attempt to publish a translation of Shakespeare, the chief glory of English literature, does not stand in need of any apology… Need I then say that an English drama has always its value for my countrymen as throwing a flood of light on the social customs and modes of thoughts of those whom Providence, in His Infinite Goodness, has been pleased to place in authority over us ? Could there be a better mode of bringing home to the idlers of India the tenderness of Cordelia, the fortitude of Edgar, the fidelity of Kent and the heroism of Henry V ?

অনুবাদ: শেক্সপিয়ার, যিনি কিনা ইংরেজি সাহিত্যের প্রধান গর্ব, তাঁকে অনুবাদ করার প্রচেষ্টা নিতে কোন ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। আমার কি এই কথা বোঝানোর প্রয়োজন আছে যে একটি ইংরেজি নাটক তার মূল্যবোধ নিয়ে আমাদের সামাজিক আচার আর চিন্তার পরতে পরতে যে আলোর ছটা নিক্ষেপ করে, যাদেরকে ঈশ্বর অসীম অনুগ্রহ করে আমাদের ওপরে প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য নির্বাচন করেছেন। এর চেয়ে [এই অনুবাদের চেয়ে] কি আর ভালো কোন পন্থা আছে অলস ভারতীয়দের কাছে কর্ডেলিয়ার কোমলতা তুলে ধরা, এডগারের দৃঢ়চিত্ততা, কেন্টের আনুগত্য এবং পঞ্চম হেনরির বীরত্ব অনুধাবন করা ?

হরিশ ত্রিবেদী এটিকে ঠিকই দাস্যবৃত্তি মনোভাবের চরম প্রকাশ বললেন। উইলিয়াম মিলারের নৈতিক ধারণাকে এই ভারতীয় পুঙ্গব শুধু অন্তর্জাতই করলেন না, তিনি নিজেকে এই দুর্ভাগা ‘অলস ভারতীয়দের কাছ থেকে দূরেও সরিয়ে নিলেন।’

১৯১২ সালে জয়াবিজয় নারায়ণ সিং শর্মা চার্লস ল্যামের বিখ্যাত টেইলস ফ্রম শেক্সপিয়ার হিন্দিতে অনুবাদ করলেন। তিনি ভূমিকায় শেক্সপিয়ারকে ইংরেজি সাহিত্যের আত্মা বললেন, ল্যামকে পণ্ডিত এবং সাহেব বললেন, কিন্তু তাঁর অবস্থান ছিল সীতারামের বিপরীতে, বরঞ্চ পরবর্তী সময়ের স্মরজিৎ দত্তের জাতীয়তাবাদী অবস্থানের কাছাকাছি, যাঁর কথা আমরা পূর্বেই বলেছি।

Shakespeare is regarded as supreme in English literature and is described as the Kalidasa of English… Kalidasa was a poet of India and Shakespeare of Europe. Shakespeare lived in the time of Elizabeth, i.e., in the fifteenth [sic] century of Christ, and Kalidasa at least one thousand years before him.

অনুবাদ: শেক্সপিয়ারকে ইংরেজি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ বিবেচনা করা হয়, এবং বলা হয় তিনি ইংরেজি সাহিত্যের কালিদাস। কালিদাস ছিলেন ভারতের কবি এবং শেক্সপিয়ার ইউরোপের। শেক্সপিয়ার বেঁচেছিলেন রানি এলিজাবেথের সময় পঞ্চদশ শতাব্দীতে৬, আর কালিদাস তার চেয়ে কম পক্ষে এক হাজার বছরের আগের কবি।

ভারতীয় জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে কালিদাসকে ভারতের শেক্সপিয়ার বলা ঔপনিবেশিক সাহিত্যামলে মোটামুটি একটি রীতি হয়ে যায়। ইংরেজি সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিকে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ কবির সঙ্গে তুলনা করার মধ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে একটি সন্তোষজনক প্রতিবিধান হয় তা’তে আস্থা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও। বলা যায়, শেক্সপিয়ার একজন সর্বজনীন বিশ্বকবি এই ভাবমূর্তির চেয়েও স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে যে তিনি হচ্ছেন একটি যুদ্ধক্ষেত্রস্বরূপ যেখানে ঔপনিবেশিক শক্তির সঙ্গে উপনিবেশিতদের বিরোধ মূর্তিমান হচ্ছে। একদিকে তাঁকে নিয়ে যেমন ভেঁপু বাজানোর প্রবণতা চলছে, অন্যদিকে তাঁর রচনাকে আশ্রয় করেই ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধতা করা সম্ভব হয়ে উঠছিল। শেক্সপিয়ারকে অনুবাদের সময় এ দু’টো পরস্পরবিরোধী প্রবণতাই রূপ পেতে আমরা দেখি। আবার অন্য ভাবেও বলা যায় যে ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে ভারতীয়রা দুই ধরনের পরিচিতি লাভ করে―ভালো নেইটিভ এবং খারাপ নেইটিভ। শেক্সপিয়ার পণ্ডিত ফ্রাঙ্ক কারমোড ১৯৫৪ সালে নিউ আর্ডেন শেক্সপিয়ারের সিরিজে দ্য টেম্পেস্ট সম্পাদনা করলে অ্যারিয়েলকে ‘গুড নেইটিভ’ এবং ক্যালিবানকে ‘ব্যাড নেইটিভ’ আখ্যা দেন।

এরপর বিশ্ব রাজনীতিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঢোকে, তখন আবার শেক্সপিয়ারের অবস্থান নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু হয়। সাংবিধানিকভাবে ইংল্যান্ডে শেক্সপিয়ারকে ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়, আর যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে একজন যশস্বী ইংরেজ পণ্ডিত ই, এম, ডব্লিউ টিলইয়ার্ড তাঁর দ্য এলিজাবেথান ওয়ার্ল্ড পিকচার (১৯৪২) এবং শেক্সপিয়ার্স হিস্ট্রি প্লেইজ (১৯৪৬) গ্রন্থে এই রাজনৈতিক অবস্থান নিলেন যে শেক্সপিয়ার হলেন প্রকৃতির কবি, শৃঙ্খলার কবি, রাজতন্ত্রের কবি ও সর্বোপরি ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্বের কবি। কিন্তু এই সময়ে ভারতের স্বাধীনতার সময় এগিয়ে আসে এবং ইতিহাস বিচারে দেখা যায় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের কিছু আগে এবং কিছু পরে শেক্সপিয়ারকে নিয়ে সবচেয়ে কম মাতামাতি হয়। যেখানে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে ১৪টি শেক্সপিয়ারের নাটকের অনুবাদ হয়, এবং ১৯০১ থেকে ১৯৩১ পর্যন্ত ২৩টি নাটকের, সেখানে ১৯৩২ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে মাত্র একটি শেক্সপিয়ারের নাটক অনূদিত হতে দেখি।

অবশ্য স্বাধীনতার সময়কার জাতীয়তাবাদী চেতনার খানিকটা উত্তাপ কমলে, শেক্সপিয়ারের দিকে আবার অনুবাদকেরা ঝুঁকে পড়েন। স্বাধীন ভারতে হিন্দি ভাষায় ২৩টির মতো নাটক অনূদিত হয়। এঁদের মধ্যে একজন অনুবাদক রঙ্গিয়া রাঘব, যিনি খুব দ্রুত পনেরটি নাটক অনুবাদ করে ফেললেন (১৯৫৭-৫৮), এবং ঘোষণা দিলেন যে যে ভাষায় অনুবাদে শেক্সপিয়ার পাঠ করা যায় না, সে ভাষাকে উন্নত ভাষা বলা যায় না। অর্থাৎ, তিনি হিন্দি ভাষার উন্নতিকল্পে শেক্সপিয়ারের অবদানকে স্বীকার করে নিলেন। হিন্দি ভাষার সম্ভবত সবচেয়ে রোম্যান্টিক কবি হরিভাঁস রাই বচ্চন শেক্সপিয়ারের ‘গ্রেট ট্র্যাজেডিজ’ হিসেবে হ্যামলেট, ওথেলো, কিং লিয়ার এবং ম্যাকবেথ অনুবাদ করে (১৯৫৭-৭২) ভূমিকায় লিখলেন যে, ‘আমার বিশ্বাস, শেক্সপিয়ার হলেন পশ্চিমা সভ্যতার সবচেয়ে সুন্দর দান পৃথিবীর প্রতি।’ রঘুবীর সাহয়, অত্যন্ত চমৎকারভাবে অনুবাদ করে মঞ্চস্থ করলেন ম্যাকবেথ ১৯৭৯ সালে, যেটি ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি বললেন, তিনি নাটকটি অনুবাদ করার সময় ইচ্ছে করেই ভারতীয়করণ করেননি।

একটা মজার ব্যাপার লক্ষণীয়, পূর্বে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার আগে যেমন শেক্সপিয়ারকে তাঁর সাহিত্যের গুণাগুণ বিচারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল ঔপনিবেশিক ভারতে তাঁর রাজনৈতিক মূল্যায়ন করা, অর্থাৎ তিনি কি সাম্রাজ্যবাদ সম্পসারণের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি নাকি সাংস্কৃতিক সমন্বয় সাধনের বড় প্রতিভূ, বা তিনি কি সাম্রাজ্যবাদী অস্ত্র নাকি উপনিবেশিতদের হাতে বিদ্রোহের ত্রিশূল এই দ্বিমুখী দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল তাঁকে মূল্যায়নের যষ্টিপাথর। আর গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে যে কারণে আবার শেক্সপিয়ার তাঁর সাহিত্য গুণাগুণের চেয়েও অন্য যে কারণে মূল্যায়িত হোন, তা হলো ইংরেজি ভাষা শেখানোর ব্যাপারে তিনি কতটুকু কার্যকর। আগে ছিল বৃটিশ এম্পায়ার আর এখন প্রাধান্য বিস্তার করেছে ভাষা সাম্রাজ্যবাদ, যার অনেকগুলি প্রকরণের মধ্যে ই এল টি, ই এস এল ইত্যাদিত আছেই, আরও আছে টোইফেল, জি আর ই (ইংলিশ), আইলটস ইত্যাদি।

বস্তুত ইংরেজি অত্যন্ত অগ্রসরমান বিশ্ব ভাষা (কোন কোন হিসেবে ১ নম্বর আর্ন্তজাতিক ভাষা) রূপে গৃহীত হলে, এবং কম্প্যুটার প্রযুক্তির ভাষা ইংরেজি হওয়াতে, এবং ভারতবর্ষ ভারত, পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশ হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করার পর যে বোধদয়টি এইসব দেশের হয়েছে, সেটি হলো ইংরেজির সঙ্গে ঐতিহাসিক কারণে যে সম্বন্ধটি হয়েছিল সেটি স্বদেশী আবেগের বশে পরিত্যাজ্য করার বদলে সেটাকে গ্রহণ করে নিয়ে উন্নততর চর্চা করা দরকার। ভারত, পাকিস্তান, এবং বাংলাদেশ এখন এই রীতিটি অনুসরণ করছে।

আমি ২০০৩ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক শেক্সপিয়ার সম্মেলনে পেপার পড়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে যাই। তখন ইংরেজির প্রবীণ অধ্যাপক রুপম ডব্লিউ দেশাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। জানলাম যে হ্যামলেট স্টাডিজ শীর্ষক একটি বার্ষিক র্জানাল তিনি ১৯৭৯ সাল অর্থাৎ পঁচিশ বছর ধরে প্রকাশ করে আসছেন। আমার ঠিক মনে নেই, কিন্তু সে বছরেই ছিল পঁচিশ বছর, এবং অধ্যাপক দেশাই সিদ্ধান্ত নেন যে এরপর তিনি জার্নালটি আর বের করবেন না। আবার হরিশ ত্রিবেদীর বইয়েও দেখলাম এ জার্নালটির উল্লেখ আছে, এবং তিনি আরও লিখছেন যে অধ্যাপক দেশাই দাবি করেন যে এটিই সারা বিশ্বে একমাত্র অধ্যয়নিক (একাডেমিক) জার্নাল যা শেক্সপিয়ারের একটি মাত্র নাটকের ওপরে নিয়মিত প্রকাশিত হয়।

অধ্যাপক সি. ডি. নরসিমাইয়াহ ১৯৬৬ সালে একটি ভূমিকায় বললেন যে,

Why Shakespeare for our [language] students… because Shakespeare made the English language what it is and I study English because of him and men like him; otherwise I would read German, Japanese or Russian or better still, open a teashop and make my living.

অনুবাদ : কেন আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য শেক্সপিয়ার দরকার ? কারণ আজকের যে ইংরেজি ভাষা সেটা শেক্সপিয়ারের হাতে তৈরি, এবং আমি তাঁর কারণে বা তাঁর মতো লোকদের কারণে ইংরেজি পড়ি। নচেৎ আমি জার্মান, জাপানিজ বা রাশিয়ান পড়তাম, অথবা একটা চায়ের দোকান খুলে পেট চালাতাম।

এ নরসিমাইয়াহ শেক্সপিয়ারের মৃত্যুর চারশ বছর পালন উপলক্ষে ১৯১৬ সালে একটি সংকলন সম্পাদনা করেন, শেক্সপিয়ার কেইম টু ইন্ডিয়া এবং প্রায় কার্লাইলের উক্তির প্রতিধ্বনি করে বললেন, ইংল্যান্ডের ব্যবসা-বাণিজ্য, সাম্রাজ্যবাদ, নিবর্তনমূলক আইন কিছুই রইল না, কিন্তু ‘the imperishable Empire of Shakespeare will always be with us.’ (শেক্সপিয়ারের অক্ষয় সাম্রাজ্য সবসময় আমাদের সঙ্গে থাকবে।) আবার উল্টোদিক থেকে ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত উপমন্যু চ্যাটার্জির উপন্যাস ইংলিশ, অগাস্ট : অ্যান ইন্ডিয়ান স্টোরি-তে একটি গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘনি:শ্বাস আছে। তিনি লিখছেন : ‘That a young man in Azamganj [the small provincial town he comes from] should find it essential to study something as unnecessary as Hamlet, that is absurd, no, but also inevitable …’ (অনুবাদ: আজমগঞ্জ নামক একটা ছোট শহর থেকে একজন তরুণ এসে দেখবে যে তাকে বাধ্য হয়ে পড়তে হচ্ছে এমন অপ্রয়োজনীয় জিনিষ যেমন হ্যামলেট, এটি একবারে অবাস্তব, না, অবাস্তব হলেও অবশ্যম্ভাবী।)

শেক্সপিয়ারকে নিয়ে দোটানা পরিচিতি সংকটের দু’টি উদাহরণ: শেক্সপিয়ার ওয়ালা ও বাসন্তিকাস্বপ্নম

শুধু ভারত কেন বিশ্বব্যাপী শেক্সপিয়ার চর্চায় এই দ্বন্দ্বটি সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিকভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে একদিকে থাকছে তাঁকে নিয়ে, কোপেলিয়া কান কথিত, অটোকথনাস আইডেনটিটি নীতি, অর্থাৎ শেক্সপিয়ার শুদ্ধ অর্থে একজন ইংরেজ-পরিচিতি বহনকারী লেখকই, আবার অন্যদিকে থাকছে তিনি যুগে যুগে সকল সংস্কৃতিরই প্রতিভূ―এই সংঘাতটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন ১৮৬৪ সালে শেক্সপিয়ারের তিনশত বছর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি এবং ১৯১৬ সালে তাঁর তিনশত বছর মৃত্যু উপলক্ষে আরেকটি সংকলন বের হয়। এই দু’টো সংকলন নিয়ে শেক্সপিয়ার পণ্ডিত ওয়ার্নার হ্যাবিস্ট ২০০১ সালে প্রকাশিত শেক্সপিয়ার সার্ভে জার্নালে ‘শেক্সপিয়ার সেলিব্রেশন ইন টাইমস অব ওয়ার” শীর্ষক প্রবন্ধে বললেন যে যদিও ১৮৬০ সালে ইংল্যান্ড ও জার্মানির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল, কিন্তু জার্মানরা শেক্সপিয়ারকে অত্যন্ত কদর করত। এবং ১৮৬৪ সালে স্ট্রাটফোর্ডে অনুষ্ঠিত শেক্সপিয়ারের ত্রিশতবর্ষ উদ্যাপন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ফ্রাঙ্কফুটের একজন শেক্সপিয়ার জার্মান পণ্ডিত এও দাবি করেছিলেন যে শেক্সপিয়ার ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করলেও সেটি ছিল একটি দুর্ঘটনা। তিনি আসলে ছিলেন প্রকৃতিতে জার্মান, এবং জার্মানির জাতীয় কবি।৭  ১৯১৫ সালে প্রফেসর জোসেফ কোলার নামক আরেকজন জার্মান অধ্যাপক বললেন, ‘আমরা জানি তারা [ইংরেজরা] আসলে শেক্সপিয়ারকে বোঝে না। অন্য দিকে আমরা সেই দিকপালকে হজম করেছি, এবং আমাদের নিজস্ব লেখক বানিয়ে ফেলেছি।’ (হ্যাবিস্ট) বস্তুত ১৮২৫-৩৩ সময়ে শ্লেগেল আর টিক অনূদিত জার্মান ভাষার শেক্সপিয়ার জার্মান জাতির কাছে গ্যেয়টে আর শিলারের পরে অবস্থান নিয়ে নেন।

আর কোপেলিয়া কান ১৯১৬ সালে প্রকাশিত আ হোমিজ টু শেক্সপিয়ার গ্রন্থ নিয়ে শেক্সপিয়ার সার্ভে (২০০১)-এ প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘রিমেমবারিং শেক্সপিয়ার ইম্পরিয়ালি : দ্য ১৯১৬ সেন্টেনারি’-তে বললেন যে সংকলনটিতে যদিও শেক্সপিয়ারকে নিয়ে ‘অটোকথোনাস আইডেন্টিটি’রই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, কিন্তু তারপরও এই সংকলনটিতে শেক্সপিয়ারকে ঘিরেই অ-ইংরেজ জাতীয় পরিচয় ফুটে উঠেছে। অর্থাৎ, কানের বক্তব্য হলো পৃথিবীর বিভিন্ন জাতীয় সত্তা সাংস্কৃতিকভাবে শেক্সপিয়ারকে তাদেরই একজন মনে করে সেভাবেই বিকশিত হয়েছে।

ভারতবর্ষে শেক্সপিয়ার চর্চার এই দ্বান্দ্বিক চরিত্র, একদিকে প্রেম, আরেকদিকে বিরাগ, যে প্রবণতাটি উত্তরাধুনিক সমালোচক আনিয়া লুম্বা ‘কমপ্লেক্স রেসিপ্রোসিটি’ বা জটিল দেয়ানেয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন, তারই প্রমাণ হিসেবে আমরা দু’টো কাজের উল্লেখ করব। একটি হলো চলচ্চিত্র এবং আরেকটি হলো অনুবাদ। চলচ্চিত্রটি হচ্ছে শেক্সপিয়ার ওয়ালা আর অনুবাদটি হচ্ছে বাসন্তিকাস্বপ্নম, শেক্সপিয়ারের নাটক আ মিডসামার নাইটস ড্রিম-এর হিন্দি এডাপটেশান।

ড্যান ভেনিং এশিয়ান থিয়েটার জার্নালে ২০১১ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘কালচারাল ইম্পিরিয়ালিজম অ্যান্ড ইন্টারকালচারাল এনকাউন্টার ইন মার্চেন্ট আইভরিস ‘শেক্সপিয়ারওয়ালা’” প্রবন্ধে মৌলিক প্রশ্নটি তুললেন যে চলচ্চিত্রটি কি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণমূলক অভিব্যক্তি নাকি আন্ত-সাংস্কৃতিক লেনদেনের সাক্ষী! অর্থাৎ যে প্রশ্নটি আমরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি বা যেটি কান বলেছেন অটোকথোনাস পরিচিতি বনাম অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন বা সমন্বয় সাধন সে দ্বিবিধ সংকটকেই ছবিটি চলচ্চিত্রায়ন করেছে কিনা।

জিওফ্রে কেনডল (১৯১০-১৯৯৮) ছিলেন শেক্সপিয়ার অভিনেতা এবং নাট্যকার। তাঁকে শেক্সপিয়ারওয়ালাও ডাকা হতো। ১৯৪৭ সালের আগে তিনি ভারতে তাঁর নাট্যদল ‘শেক্সপিয়ার থিয়েটার কোম্পানি’ নিয়ে এসে শেক্সপিয়ারের নাটক মঞ্চস্থ করতেন। তিনি দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ম্যাকলের কাছাকাছি লোক ছিলেন এই অর্থে যে তিনি মনে করতেন ইংল্যান্ডের অভিভাবকত্ব অনৈকিতাপূর্ণ চারিত্রের ভারতীয়দের প্রয়োজন আছে। তাঁর ডাইরির শিরোনাম ছিল শেক্সপিয়ারওয়ালা। এই ডায়রিটি জেমস আইভরির হস্তগত হয় ১৯৬৩ সালে, এবং ১৯৬৫ সালে ইসমাইল মার্চেন্টের সঙ্গে মিলে মার্চেন্ট আইভরি প্রোডাকশনস কোম্পানি খোলেন এবং ১৯৬৫ সালে নির্মাণ করেন শেক্সপিয়ারওয়ালা চলচ্চিত্রটি, যেটি সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে, কারণ চলচ্চিত্রটি শেক্সপিয়ার চর্চা নিয়ে যে দ্বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলে আসছি, তারই চলচ্চিত্রায়ন বলে ধরা যায়। আপাতদৃষ্টিতে ছবিটিকে ইংল্যান্ডের (বা বৃটিশের) সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণ বলে প্রতীয়মান  হলেও, সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যাজোক্তিও থাকে যে ভারতে শেক্সপিয়ারের আবেদনের অবসান হওয়া ঘটনার স্বাভাবিক ঐতিহাসিক পরিণতি, এবং হয়তো প্রয়োজনও, যদিও এই হারানোর জন্য বেদনা থাকবে। চলচ্চিত্রটির কাহিনির যে অংশটুকুুতে বাকিংহ্যাম গ্রুপ সংশ্লিষ্ট আছে সেটিতে আছেন টনি আর ক্লারা বাকিংহ্যাম, যাঁরা ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন, এবং শেক্সপিয়ারের নাটক মঞ্চস্থ করে পেশা চালাতেন। কিন্তু ভারত স্বাধীনতা পাবার পর তাঁরা  উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এই জন্য যে শেক্সপিয়ারের গ্রহণযোগ্যতা হয়তো আর থাকবে না। সাম্রাজ্যবাদের প্রতিবেশ আর রইলো না সে জন্যও তাঁরা শংকিত হয়ে উঠলেন। কিন্তু এটির প্রেম-কাহিনি পর্বে একটি নিটোল ত্রিভুজ কাজ করছে। সেখানে আছে ভারতীয় প্লেবয় মার্কা চরিত্র সঞ্জু (শশী কাপুর, যিনি বাস্তব জীবনে জিওফ্রে কেনডলের মেয়ে জেনিফারের স্বামী ছিলেন) এবং তাঁর ইংরেজ প্রেমিকা লিজি (ফেলিসিটি কেনডল, কেনডল দম্পতির দ্বিতীয় মেয়ে) বাকিংহ্যাম দম্পতির মেয়ে। আবার সঞ্জুর সঙ্গে একই সঙ্গে প্রেমে পড়েছে মঞ্জুলা (মাধুরি জেফ্রি) যে কিনা ছবিটির চরিত্র অনুযায়ী বোম্বাই ফিল্ম জগতের দাপুটে অভিনেত্রী। কিন্তু সঞ্জু গভীর প্রেম থাকলেও লিজিকে গ্রহণ করতে ইতস্তত করতে থাকে যার ফলে লিজি ইংল্যান্ডে ফিরে যায়, যে দেশে তার বাবা-মা জন্মালেও সে জন্মেছিল ভারতে, এবং ফলে ইংল্যান্ড ছিল তার জন্য সম্পূর্ণ নতুন একটি দেশ। আবার মঞ্জুলা সঞ্জুর লিজির প্রতি আসক্তি দেখে ভীষণ ক্ষেপে যায় এবং একবার যখন তাদের কোম্পানি শেক্সপিয়ারের ওথেলো নাটকটির মহড়া করছিল, সে নাট্যমঞ্চের সেটটি রাগের মাথায় সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেয়। মাধুরি জেফ্রি তাঁর অভিনয়ের জন্য বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরষ্কার পান।

এই ছবির আরেকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করেন উৎপল দত্ত, তাঁর অভিনীত চরিত্রটি হলো মহারাজা, অক্সেফোর্ড শিক্ষিত, অনর্গল সিগার খান, যিনি মোটরগাড়ি সম্পর্কে যেমন প্রচুর উৎসাহ রাখতেন, তেমনি অনর্গল উদ্ধৃত করতে পারতেন শেক্সপিয়ারের নাটক থেকে, আর ইংরেজি বলতেন ইংল্যান্ডের অভিজাত মহলের ন্যায়। উৎপল দত্ত পরে নিজেই নাট্যকার এবং পরিচালক হন এবং ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ নামক ১৯৪৭ সালে কলকাতায় একটি নাট্যদল গঠন করেন। তিনি পুরোপুরি মার্ক্সবাদে দীক্ষা নেন এবং ব্রত নেন যে শেক্সপিয়ারের নাটককে তিনি সাধারণ জনগণের মাঝে নিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, সম্ভবত তাঁর কেনডলের দলের সঙ্গে অভিনয়ের দিনগুলি মনে রেখে, যে ‘আমি আগে ভদ্রজনদের সামনে শেক্সপিয়ারের নাটকে অভিনয় করে প্রচুর সময় নষ্ট করেছি, আসলে শেক্সপিয়ারকে নিয়ে আসতে হবে জনগণের কাছে।’ (ভেনিং) উৎপল দত্তের আজকের শাহজাহান নাটকটি হলো কিং লিয়ারের রূপায়ন। এটির একটি চলচ্চিত্র রূপায়ন করেন ঋতুপর্ণ ঘোষ দ্য লাস্ট ইয়ার নামে, যেটি ২০০৭ সালে ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার লাভ করে।

সমালোচকদের মধ্যে বেশিরভাগ মন্তব্য হলো যে পুরো ছবিটিতে জেওফ্রে কেনডলের ঔপনিবেশিক মানসিকতারই রূপায়ন হয়েছে। অর্থাৎ, এটি একটি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণের জন্য সাংস্কৃতিক অস্ত্র। লুবনা চৌধুরী এবং সাবা খটক বলছেন যে ছবিটিতে ঔপনিবেশিক যুগের জন্য প্রলম্বিত টান লক্ষ করা যায়। তাঁরা লিজির প্রতি সঞ্জুর উদাসীনতাকে ভিত্তি করে বললেন যে লিজির প্রতি সহানুভূতি উদ্রেক করার মাধ্যমে ছবিটিতে যা কিছু ইংলিশ তারই গৌরব করা হয়েছে। আরেকজন সমালোচক, ভ্যালেরি ওয়েইন ছবিটির মধ্যে উত্তর-ঔপনিবেশিক উপাদানের উপস্থিতিকে প্রাধান্য দিয়ে বলেেলন, ছবিটিতে প্রকৃতপক্ষে সাংস্কৃতিক হাইব্রডিটি বা সমন্বয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি বিশেষভাবে মঞ্জুলার ওথেলো নাটকের সেট ভেঙে দেবার মধ্য দিয়ে সেই প্রতীকী সমন্বয়টা দেখলেন যে এর ফলে পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে আর কোন পার্থক্য রইল না, এবং এটাই সাংস্কৃতিক সমন্বয়তা। কিন্তু নান্দী ভাটিয়া চরম অবস্থান নিয়ে বললেন, সঞ্জু লিজিকে গ্রহণ করল না, তার অর্থ হচ্ছে ভারত ইংল্যান্ডকে তথা শেক্সপিয়ারকে বর্জন করল। তিনি জোর দিয়ে বললেন শেক্সপিয়ারের ইউনির্ভাসিলিটি বা বিশ্বজনীনতা যে একান্তই ভঙ্গুর একটি ধারণা সেটিই দেখানো হয়েছে এই ছবিটিতে।

ছবিটিকে একই সুরে বিচার করলেন দু’জন প্রসিদ্ধ উত্তরাধুনিক সমালোচক। আনিয়া লুম্বা এবং গৌরি বিশ্বনাথন উভয়ে বললেন যে স্কুল  টেক্সটে হোক বা সাংস্কৃতিক উপায়ে হোক, শেক্সপিয়ারকে ব্যবহার করার অর্থ হলো ঔপনিবেশিক প্রবণতাকে উসকে দেওয়া। কারণ এর ফলে এমন একটি সাহিত্যিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয় যার ফলে যে কোন ভারতীয় নিজেকে অবরুদ্ধ মনে করতে পারে, এবং ইংরেজি না জানলে এক ধরনের বিষময় অনুভূতি হয়। এঁদের বিপক্ষে জ্যোৎস্না সিং আরেকটু বাস্তববাদী কথা বললেন। তিনি প্রথমে স্বীকার করলেন যে ‘বিশ্বজনীন শেক্সপিয়ারের’ ধারণাটি অবশ্যই পরিষ্কার একটি ঔপনিবেশিক প্ররোচনা, কিন্তু এটিও লক্ষ রাখতে হবে যে ভারতের সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষার জগতের সঙ্গে শেক্সপিয়ার ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এবং তাঁর সাহিত্য থেকে প্রতিবাদী মনোভাব সৃষ্টি হয়েছে, এবং ফলে ‘সর্বজনীন ঔপনিবেশিক বার্ড’-এর স্বীকৃতি সত্ত্বেও তাঁর প্রতি প্রকৃত নিরপেক্ষ শ্রদ্ধা লক্ষ্য করা যায়। এবং সর্বত্র শেক্সপিয়ারের নাটকে অভিনয় করছেন এমন শিল্পীদের কদর সর্বত্র, যার ফলে মনে হয় না যে ভারতীয়রা শেক্সপিয়ারকে শুধু ইংল্যান্ড বা ইউরোপের শিখণ্ডী মনে করে না, মনে করে উচ্চতর সাহিত্য রস ও মানবিকতা আস্বাদন করার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। কাজেই, ভেনিংএর মতে স্বাধীনতার পরেও যে ভারত শেক্সপিয়ারকে ঝেড়ে ফেলে দিল না, যদিও সে বৃটিশ শাসন ত্যাগ করেছে, এই রহস্যঘন আকর্ষণই হচ্ছে শেক্সপিয়ারওয়ালা শীর্ষক চলচ্চিত্রটির মূল আবেদন। সংশ্লিষ্ট চরিত্রগুলোর সকলই এই দোটানা আকর্ষণের ভিতর দিয়ে চরিত্রায়িত হয়েছে। অর্থাৎ ছবিটি একদিকে যেমন ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের সম্প্রসারিত প্রতিভূ, তেমনি আবার আন্ত:সংস্কৃতির বিরাট সমন্বয়কও বটে।  

ইংরেজি সমালোচনা সাহিত্যে শব্দটা ‘এপ্রোপ্রিয়েশন’, বাংলায় আমরা বলতে পারি ‘গ্রহণ করা’―অর্থাৎ, শেক্সপিয়ারের সাহিত্য কিভাবে আমরা গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে গ্রহণ করি, সেটাই এপ্রোপ্রিয়েশন। তাই এখন যে কাজটির আলোচনায় যাচ্ছি সেটি আর, কৃষ্ণমাচারির সংস্কৃত ভাষায় আ মিডসামার নাইটস ড্রিম-এর বাসন্তিকাস্বপ্নম (১৮৯২) নামে অনুবাদ, যেটা আক্ষরিক অনুবাদ নয় কিন্তু এপ্রোপ্রিয়েশন, একটি শিথিল অনুবাদ। ডেভিড ভি ম্যাসন তাঁর একটি প্রবন্ধ ‘হু ইজ দ্য ইন্ডিয়ান শেক্সপিয়ার’ ? এপ্রোপ্রিয়েশন অব অথরিটি ইন আ সংস্কৃত ‘মিডসামার নাইটস ড্রিম’ ছাপেন নিউ লিটারারি হিস্ট্রি নামক জার্নালে ২০০৩ সালে। সেখানে তিনি এই বক্তব্য দিচ্ছেন যে ভারতীয়দের কাছে শেক্সপিয়ার হচ্ছে শকুন্তলার স্রষ্টা কালিদাসের সঙ্গে। ঠিক শেক্সপিয়ারওয়ালা চলচ্চিত্রটি যেমন একটি মধ্যবর্তী অবস্থানে শেক্সপিয়ারকে নীত করেছিল, এই অনুবাদটিও এমনতরো ধন্ধের সৃষ্টি করেছে দেখতে পাই।

কৃষ্ণমাচারি একজন ইংরেজি শিক্ষিত ভারতীয়, এবং তিনি যখন শেক্সপিয়ারের একটি নাটক সংস্কৃত ভাষায় অনুবাদ করলেন, ধরে নেওয়া যায় প্রকারান্তরে তিনি বৃটিশ সাম্রাজ্যের ইংরেজি শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে ইংরেজিতে শিক্ষিত হয়ে সেই সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির প্রধান কবিকে নিজের ভাষায় অনুবাদ করে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণই ঘটালেন। শেক্সপিয়ারকে শেক্সপিয়ার হিসেবেই অধিষ্ঠিত করলেন। তেজস্বিনী নিরঞ্জনা তাঁর গ্রন্থ সাইটিং ট্রান্সলেশন-এ এ ধরনের একটি মতও দিলেন যে অনুবাদের ক্ষেত্রে যখন একটি ঔপনিবেশিক টেক্সট উপনিবেশিত ভাষায় অনুবাদ  করা হয় সচেতনভাবে বা অচেতনভাবে ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতিনিধি হয়ে পড়েন অনুবাদক। যেমন কৃষ্ণমাচারির বাসন্তিকাস্বপ্নম অনুবাদটি ঔপনিবেশিক ভারতে শেক্সপিয়ারের স্বীকৃত শীর্ষ অবস্থানের কারণে শেক্সপিয়ার অতি-আবশ্যকভাবে সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ সম্প্রসারণের অংশ হয়ে পড়েন। অর্থাৎ, যখনই শেক্সপিয়ার হচ্ছে বিষয় তখনই ইংরেজি ভাষাটা হয়ে পড়ছে এর বাহন, এবং প্রকারান্তরে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ হয়ে পড়ছে এর অংশ। বস্তুত, আগে বলা কথাটা আবার বলতে হচ্ছে, ঔপনিবেশিক সময়ে শেক্সপিয়ার শুধু যে বৃটিশ সংস্কৃতির মূল স্তম্ভ ছিলেন তাই নয়, তিনি বৃটিশ নৈতিকতারও ধারক ছিলেন। ম্যাকলে এবং তাঁর শ্যালক চার্লস ট্রেভেলিয়ন বাইবেলের পাশাপাশি শেক্সপিয়ারকে নৈতিক শিক্ষা প্রদানের প্রধান বাহক মনে করতেন। এবং কৃষ্ণমাচারির বাসন্তিকাস্বপ্নম এক অর্থে শেক্সপিয়ারের অনুবাদের মাধ্যমে বৃটিশ ইংরেজি শিক্ষানীতিকে এগিয়ে দিয়েছিলেন বলা যায়।

কিন্তু দ্বিমুখি একটি প্রকরণও লক্ষ্য করা যায়। শেক্সপিয়ারকে উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে স্থান দিয়ে এবং অনুবাদের মাধ্যমে তাঁকে একটি লোকজ প্রথার মধ্যে ফেলে দিয়ে অনুবাদক বৃটিশ সুপ্রেমেসিকে যেন চ্যালেঞ্জ করলেন, এবং এপ্রোপ্রিয়েশনের মাধ্যমে কালিদাসকে শেক্সপিয়ারের ওপর স্থান দিলেন।

কৃষ্ণমাচারীর এই পন্থাটি, অর্থাৎ কালদাসকে শেক্সপিয়ারের ওপর স্থান দেওয়া,  কিংবা শেক্সপিয়ারকে ভারতের কালিদাস বলা এ জন্যই সম্ভব হয়েছে যে তিনি হোমি ভাবা কৃর্তক নির্দেশিত ‘হাইব্রিডাইজেশনের’ অন্য একটি পথে গেলেন। ভাবার তত্ত্বটি যদিও ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের স্বরূপ বোঝার জন্য সহায়ক, কিন্তু এর মধ্যে ভারতের প্রাচীন যে সভ্যতা ছিল, যেটি ম্যাকলে অনেকটা স্পর্ধা ভরে অস্বীকার করেছিলেন, তার কোন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। কিন্তু ভারতের প্রকৃত অবস্থা ছিল ম্যাকলে কর্তৃক ধারণাকৃত বা ভাবা কর্তৃক তাত্ত্বিকায়িত ধারণার বিপরীত। বস্তুত যে এলিট শ্রেণিটি ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেছিল তারা সারা ভারতবর্ষে, এবং বিশেষ করে বাংলায় ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত সাধারণ বা বণিক পরিবারের ছেলেরা, যাদের ভারতের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে কোন প্রভাব ছিল না। অথচ ইংরেজ দখলের পর ভারতের নিজন্ব সংস্কৃতিতো হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়নি কিংবা সংস্কৃত জানা পণ্ডিতেদেরও অবসান হয় নি, যাদের কাছে ইংরেজি ভাষা ছিল অপরিজ্ঞাত। অন্তত মাদ্রাজের সংস্কৃত জানা পণ্ডিতদের কাছে ১৮৯২ সালে শেক্সপিয়ার ছিল অজানা। ঠিক এঁদের কাছে কৃষ্ণমাচারি শেক্সপিয়ারকে উদ্বোধন করার দায়িত্ব নেন। কৃষ্ণমাচারী বলতে চান যে যদিও সাধারণভাবে ইংরেজি শিক্ষা পঠন-পাঠনের জন্য শেক্সপিয়ারকে পুরোধা হিসেবে গ্রহণ করার রীতি ১৮৩৫ সাল থেকে শুর হয়, কিন্তু দেখা যায় শেক্সপিয়ারকে ঔপনিবেশিক শাসনের বাহন হিসেবে না নিয়েও শেক্সপিয়ারের সাহিত্যের প্রতি আকর্ষিত হয়ে তাঁকে নিয়ে ভারতে চর্চা শুরু হয়ে গেছিল, যেটির সঙ্গে ম্যাকলের ইংরেজিকরণের প্রচেষ্টার সম্পর্ক ছিল না।

কৃষ্ণমাচারীর অনুবাদকর্মের মধ্যে এই দ্বিধান্বিত দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণরূপে স্থান পায়। তিনি বাসন্তিকাস্বপ্নমে শেক্সপিয়ারকে সংস্কৃত নাটকের পোশাক পরিয়ে দেন। সংস্কৃত নাটকের রীতি অনুযায়ী তিনি ‘প্রলোগ’ সংযোজন করেন যে অর্থে শেক্সপিয়ার তাঁর নাটকে ব্যবহার করেছিলেন সে অর্থে নয়। শেক্সপিয়ার তাঁর নাটক রাজা হেনরি ৫ম-এ ‘প্রলোগে’ কিংবা আ মিডসামার নাইটস ড্রিম-এ ‘পিরামাস অ্যান্ড থিসবি’ নাটিকা শুরু হবার আগে পিটার কুইন্স যেমন দর্শকদের অনুরোধ করেন যে তারা যেন মঞ্চায়িত নাটকটিকে কবি কল্পনাপ্রসূত ধরে নেয়, যার সঙ্গে বাস্তব দুনিয়ার কোন সম্পর্ক নেই, ঠিক সে অর্থে কৃষ্ণমাচারী তাঁর প্রলোগটি দিলেন না। তিনি ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী এই মুখরাতে বললেন যে এই বিশ্বটাই হচ্ছে একটা মায়া বই কিছু নয়। মূল নাটকের মধ্যে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে একাধিকবার, যেখানে পরীদের রাজা ওবেরন আর রানি টাইটানিয়া কয়েকবার ভ্রমণে গেছিলেন। কিন্তু কৃষ্ণমাচারী ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটা ব্যবহার না করে করলেন ‘মধ্যশ্যাম’। এই পরিবর্তনটি উল্লেখযোগ্য। ম্যাসনের মতে মূল নাটকের অভিঘাত অনুযায়ী ‘ইন্ডিয়া’ প্রতীক হয়ে পড়ে একটি যাদুর দেশ হিসেবে, যেন এটি হচ্ছে ডাইনি আর পরিদের একটা অবাস্তব দেশ, এটার আকাশে বাতাসে আছে মাদকোত্তেজক পরিবেশ। ঠিক যেমন এডওয়ার্ড সাইদ তাঁর ওরিয়েন্টালিজম গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছিলেন যে পাশ্চাত্যের লেখকেরা প্রাচ্য বলতে তাঁদের কল্পিত কোন রাজ্যকে প্রাচ্যের দেশ হিসেবে বর্ণনা করতেন, যার সঙ্গে প্রকৃত প্রাচ্য দেশগুলির কোন মিল ছিল না। মোট কথা কৃষ্ণমাচারীর অনুবাদে আ মিডসামার নাইটস ড্রিম প্রকৃত অর্থে একটি ভারতীয় সংস্কৃত নাটকে রূপান্তরিত হলো, যার ফলে বাসন্তিকাস্বপ্নম-কে এমন একটি অনুবাদকর্ম বলা যায় যার মধ্যে ঔপনিবেশিক শাসনের সাংস্কৃতিক প্রভাবকে চ্যালেঞ্জ করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। 

বাংলাদেশে শেক্সপিয়ার চর্চা

মার্জনা ভিক্ষা করে বলতে  চাই এ বিষয়ে লেখাপড়া করার সময় আমি এখনও করে উঠতে পারি নি। সামনে কোন এক সময় হয়তো এই প্রসঙ্গটিকে আমি পূর্ণতা দিতে পারব। আপাতত আমার সহকর্মী সহকারি অধ্যাপক শাহনাজ পারভিন সিঁথির একটি প্রকাশিতব্য প্রবন্ধ ‘এডাপ্টেশন অব শেক্সপিয়ারস প্লেইজ ফ্রম বাংলাদেশ পার্সপেক্টিভ’ থেকে যৎসামান্য তথ্য দিয়ে বর্তমানের প্রবন্ধটি শেষ করছি।

সিঁথির মতে বাংলাদেশে শেক্সপিয়ার চর্চায় অগ্রগণ্যদের মধ্যে আছেন মুনীর চৌধুরী, কবির চৌধুরী, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমতিয়াজ হাবীব, সেলিম সারোয়ার, ফকরুল আলম, কাজী মোস্তায়ীন বিল্লাহ এবং মোহীত উল আলম। এঁরা সবাই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন বা আছেন। প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ হাবীব অবশ্য আমেরিকায় অধ্যাপনা করার সময় মারা যান। কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ্ খান এবং কবি আবু হাসান শাহরিয়ারও শেক্সপিয়ার অনুবাদ করেছেন। মুনীর চৌধুরী ১৯৭০ সালে দ্য টেইমিং অব দ্য শ্রু-র অনুবাদ করেন মুখরা রমণী বশীকরণ নামে। মুনীর চৌধুরী ওথেলো নাটকের অনুবাদও শুরু করেছিলেন, কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর তাঁকে আল-বদর বাহিনী আরও অনেক বৃদ্ধিজীবীর সঙ্গে হত্যা করে। পরে তাঁর বড় ভাই কবীর চৌধুরী ঐ নাটকটির অনুবাদ সম্পন্ন করেন। আবু হাসান শাহরিয়ার অনুবাদ করেন হ্যামলেট এবং অ্যান্টোনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা। হ্যামলেট নাটকের একটি এডাপ্টেশন করেন সৈয়দ সাজ্জাদ হুসেন ১৯৭৪ সালে। শামুসর রাহমান হ্যামলেট অনুবাদ করেন। সৈয়দ শামসুল হক যথাক্রমে ম্যাকবেথ এবং দ্য টেম্পেস্ট অনুবাদ করেন, এবং মঞ্চায়নে এগুলি তুমূল জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিডা এবং জুলিয়াস সিজারও অনুবাদ করেন। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এবং সেলিম সারোয়ার শেক্সপিয়ারের সনেটের অনুবাদ করেন। মোহীত উল আলম শেক্সপিয়ারের দশটি নাটক গদ্যে অনুবাদ করেন: যথাক্রমে রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট, দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস, জুলিয়াস সিজার, অ্যাজ ইউ লাইক ইট, হ্যামলেট, ওথেলো, কিং লিয়ার, ম্যাকবেথ, অ্যান্টোনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা এবং কোরিওলেনাস। সিঁথি বলছেন এই  অনুবাদগুলিতে মূল নাটকের হুবহু অনুবাদ হয়েছে। এ ছাড়া তিনি ঢাকাস্থ অ্যালবেট্রস ক্লাসিক্স প্রকাশনা থেকে যথাক্রমে অ্যাজ ইউ লাইক ইট, হ্যামলেট এবং ম্যাকবেথ-এর সম্পাদনা করেন ইংরেজিতে, প্রতিটিতে দীর্ঘ ভূমিকাসহ। ২০১০ সালে দ্য ডেইলি স্টার-এ প্রকাশিত মোহীত উল আলমের হ্যামলেট ইন লাভ শীর্ষক রম্য নাটকটির প্রশংসাসূচক মূল্যায়ন করেন র্সিথি। তাঁর প্রবন্ধটি শেষ হয় ওথেলো এবং ওথেলো ও ওথেলো সিনড্রোম নামক দু’টো টিভি নাটকের মূল্যায়ন করে।

আমি একজন শেক্সপিয়ার অনুরাগী হিসেবে বলতে চাই যে কোনরকম ঔপনিবেশিক ট্যাগ ব্যতিরেকে শেক্সপিয়ার পাঠ করা যায়। তাই যে বিসংবাদ নিয়ে এই প্রবন্ধটি লিখলাম যে শেক্সপিয়ার কি সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যিক সম্প্রসারণের প্রতিভূ নাকি আন্তঃসংস্কৃতির লেনদেনের একজন এভারেস্ট, আমার সহমত পরের প্রত্যয়টির সঙ্গে।

পাদটীকা

১ এ্যান্টোনি এ্যান্ড ক্লিওপেট্রা, অনুবাদ: মোহীত উল আলম (ঢাকা: অনুপম প্রকাশনী, ২০১০)। এ ছাড়াও এই প্রবন্ধে শেক্সপিয়ারের সকল উদ্ধৃতি এবং প্রাবন্ধিকদের সকল ইংরেজি উদ্ধৃতির অনুবাদ বর্তমান লেখকের। 

২ শেক্সপিয়ারের সকল উদ্ধৃতি নিম্নোক্ত গ্রন্থ থেকে: The Arden Shakespeare: Complete Works; Revised Edition; Eds. Richard Proudfoot, Ann Thompson and David Scott Kastan, Consultant Editor Harold Jenkins (London: Thomas Nelson and Sons Ltd, 1998).

৩ ট্রিনকুলো এই উক্তিটি করে যখন সে ক্যালিবানকে প্রথম দেখে: “What have we here, a man or a fish ? Dead or alive ? A fish: he smells like a fish, a very ancient and fish-like smell, a kind of – not of the newest –poor-John. A strange fish! Were I in England now (as once I was) and had but this fish painted, not a holiday fool there but would give a piece of silver. There would this monster make a man; any strange beast there makes a man. When they will not give a doit to relieve a lame beggar, they will lay out ten to see a dead Indian” (2.2.24-33). অনুবাদ: ‘কী দেখছি, এখানে আমরা ? মানুষ না মাছ ? মাছের মতোই তো গন্ধ ছড়াচ্ছে, পচা, পুরোনো একটা গন্ধ। গরীব একটা! একটা অদ্ভুত মাছ! যদি আমি এখন ইংলান্ডে থাকতাম (যেমন আগে ছিলাম) আর যদি এই মাছের ছবি আঁকতে পারতাম, যে কেউই সেটা দেখে একটা রৌপ্যমুদ্রা ছুঁড়ে দিত, আর এই দানবটা সেখানে পয়সা কামানোর বিরাট উৎস হবে। যখন তারা কোন খোঁড়া লোককে এক পয়সা দেবে না, কিন্তু এর দশ গুণ দেবে একটা মড়া ইন্ডিয়ানকে দেখতে।’    

৪ শব্দগুচ্ছটি প্রাবন্ধিক কোপেলিয়া কান থেকে ধার করেছি। তিনি অন্যত্র এটি ব্যবহার করেছেন।

৫ অমিতাভ ঘোষের উপন্যাস দ্য গ্লাস প্যালেস এ ধরনের ইংরেজিমনস্ক চরিত্র একটি আছে যিনি পরে হতাশা থেকে সমুদ্রে গিয়ে জলমগ্ন হয়ে আত্মহত্যা করেন। 

৬ শেক্সপিয়ার (১৫৬৪-১৬১৬) রানি এলিজাবেথ (১৫৩৩-১৬০৩) এবং রাজা জেইমস প্রথম (১৫৬৬-১৬২৫) এই দুজন নৃপতির অধীনে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগ এবং সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত বেঁচেছিলেন।

৭ এ প্রসঙ্গে আমার প্রবন্ধ “বিশ্বসাহিত্য” দ্রষ্টব্য। প্রবন্ধটি প্রথমে শব্দঘর, এবং পরে আমার গ্রন্থ সাহিত্যপাঠ: তত্ত্ব ও তালাশ (২০২২)-এ ছাপা হয়।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button