আর্কাইভধারাবাহিক রচনাবিশ্বসাহিত্যভাষা গবেষণা

ভাষা-গবেষণা ধারাবাহিক : শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু : মানবর্দ্ধন পাল

তৃতীয় পর্ব

[প্রাচীন ভারতীয় আলংকারিকেরা শব্দকে ‘ব্রহ্ম’ জ্ঞান করেছেন―শব্দ যেন ঈশ্বরতুল্য। পাশ্চাত্যের মালার্মেসহ নন্দনতাত্ত্বিক কাব্য-সমালোচকদেরও বিশ্বাস, শব্দই কবিতা। যা-ই হোক, শব্দের মাহাত্ম্য বহুবর্ণিল ও বহুমাত্রিক। বাংলা ভাষার বৃহদায়তন অভিধানগুলোর পাতায় দৃষ্টি দিলেই তা প্রতিভাত হয়। আগুনের যেমন আছে অসংখ্য গুণ তেমনই ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দেরও আছে অজস্র অর্থের সম্ভার। কালস্রোতে ও জীবনের প্রয়োজনে জীবন্ত ভাষায় আসে নতুন শব্দ, তা বিবর্তিতও হয়। পুরোনো শব্দ অচল মুদ্রার মতো ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে মনি-কাঞ্চনরূপে ঠাঁই নেয় অভিধানের সিন্দুকে।

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সমুদ্রসম―মধুসূদনের ভাষায় : ‘ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। বৈঠকি মেজাজে, সরস আড্ডার ভঙ্গিতে লেখা, এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’। ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক―সবকিছু মিলিয়ে শব্দের ভেতর ও বাইরের সৌন্দর্য-সৌগন্ধ এবং অন্তর্গত আনন্দধারার ছিটেফোঁটা ভাষিকরূপ এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’ ধারাবাহিক।]

পান

‘পান’ শব্দটি উচ্চারণ করলেই তাম্বুলবিলাসী এবং তরল আগুনপায়ীদের কথা মনে পড়ে। ‘সুরা’ শব্দটির চমৎকার শিল্পিত রূপ ‘তরল আগুন’―লাগসই প্রকাশ হিসেবে শব্দটি একদা পেয়েছিলাম ড. হায়াৎ মামুদের লেখায়। যা-ই হোক, প্রারম্ভের প্রথম ‘পান’ হচ্ছে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় একপ্রকার লতাজাতীয় উদ্ভিদের পাতা। সংস্কৃত ‘পত্র’ শব্দ থেকে পাতা। পাতার আরেকটি সংস্কৃত প্রতিশব্দ ‘পর্ণ’। পর্ণ থেকে তদ্ভব রূপ পান―পর্ণ>পন্ন>পান। পানের দ্বিতীয় অর্থ, যা পেয়―অর্থাৎ গিলে খাওয়া যায় এমন। পানে রস আছে―পান সরস। আর যা পানযোগ্য তা কেবল সরসই নয় সম্পূর্ণই রস। যা-ই হোক―কোমল বা ঝাঁঝাল―সবই তরল! ওই মাতাল-করা ‘পাগলা পানি’রই সুভদ্র―শৈল্পিক নাম দিয়েছিলেন সম্ভবত হায়াৎ মামুদ―‘তরল আগুন’। ইদানীং ফেনসিডিল অপব্যবহারকারী তরুণদের মুখে ওই ড্রাগটিকে যেমন ‘ডাইল’ বলতে শুনেছি তেমনই নেশাখোরদের মুখেও মদকে বলতে শুনেছি ‘পাগলা পানি’। মান্না দে’র গানে যাকে বলা হয়েছে―‘বিপিনবাবুর কারণ সুধা/মিটায় জ্বালা মিটায় ক্ষুধা।’ সুধা মানে অমৃত―যা পান করলে মানুষ অমর হয়। সুধা পারমার্থিক জগতের বস্তু। কিন্তু ইহলৌকিক জগতে সুধা আর সুরা অনেকের কাছে একাকার। কিন্তু ‘মৃতসঞ্জীবনী সুরা’ একধরনের আয়ুর্বেদিক ওষুধের নামও।

এই ‘পান’ শব্দটি নিয়েও বাংলায় প্যাঁচ ও প্যাঁচালের অন্ত নেই―বলতে পারেন প্যানপ্যানানি বা পাঁচালিও! প্যাঁচাল বা পাঁচালি যা-ই হোক―শিক্ষিতজন মাত্রই জানেন, আমাদের জাতীয় কবি নজরুল খুব পান খেতেন। তাঁর মতো তাম্বুলবিলাসী কবি, একালে কবি আসাদ চৌধুরীর কথা মনে রেখেই লিখছি, বাংলা সাহিত্যে আর নেই―একথা বাজি ধরেই বলা যায়। চা আর পান দিয়ে তাঁকে সারাদিন বসিয়ে রাখা যেত―করিয়ে নেওয়া যেত অনেক সৃষ্টিশীল কাজ। পান খাওয়া দেখে একদিন তাঁর বন্ধু নলিনীকান্ত সরকার  ঠাট্টার ছলে খোঁচা দিয়ে বললেন, ‘তুমি নাকি খুব পানাসক্ত!’ নজরুল এই সূক্ষ্ম টিপ্পনীর অর্থ বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন― ‘আমি কেবল পানাসক্ত নই, বেশ্যাসক্ত!’ বাংলা ব্যাকরণে সন্ধির নিয়ম মনেই নজরুল এমন রসসিক্ত কথা বলেছেন। ‘পানাসক্ত’ শব্দটির অর্থ : মদমত্ত,সুরাপায়ী―মাতাল করা ঝাঁঝাল পানীয়ের প্রতি আসক্তি। তা পান খাওয়ার প্রতি আসক্তি নয়। পান খাওয়ার প্রতি অনুরাগ মানে পানে আসক্তি। তাই নজরুল সন্ধির নিয়ম মেনে বলেছেন―বেশ্যাসক্ত। সন্ধির নিয়মে যেমন অভি+আগত=অভ্যাগত তেমনই বেশি+আসক্ত= বেশ্যাসক্ত। সন্ধিতে ই এবং আ মিলে য-ফলা আকার হয় (ই+আ=্যা)। উভয়ের এই বুদ্ধিদীপ্ত সরস মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, নলিনীকান্ত ও নজরুলের মধ্যে নামের আদ্যক্ষরেই কেবল মিল নয়―দুজনেই রসিক―যেমন বুনো ওল তেমন বাঘা তেঁতুল!

‘পান’ শব্দের সঙ্গে ‘ই’ প্রত্যয় যুক্ত করে (পান+ই) হয়েছে ‘পানি’ আর ‘ঈয়’ যুক্ত করে (পান+ঈয়) হয়েছে ‘পানীয়’। দুটিই সংস্কৃত শব্দ। একটির অর্থ ‘জল’ অন্যটির অর্থ―পান করার যোগ্য যা। ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’―এর মত শব্দ দুটির উৎস এবং অর্থ এক বলে তা নিয়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানি অর্থহীন। তবে জল ও পানি সমার্থক হলেও উল্টাপাল্টা করে জলের বদলে পানি এবং পানির বদলে জল ব্যবহার করা চলে না। তাই পানিফলকে ‘জলফল’ কিংবা পানিহাটিকে ‘জলহাটি’ বলা যাবে না। জলপানকে ‘পানিপান’ বলা গেলেও জলপাইগুড়িকে ‘পানিপাইগুড়ি’ আর জলখাবারকে ‘পানিখাবার’ বলা যাবে না নিশ্চয়ই।

পানপত্র ও পানপাত্র―খুব কাছাকাছি দুটি শব্দ। কেবল একটি  আ-কারের বেশ-কম। কিন্তু অর্থের তফাৎ আকাশ-পাতাল! ‘পানপত্র’ মানে বাঙালি-সমাজে বিয়ের পাকা কথা। আর ‘পানপাত্র’ মানে সুরাপানের পাত্র―সরাবের সুদৃশ্য গেলাস। পানপাত্রের কথা মনে হলেই স্মরণ হয় জীবনবাদী ফারসি কবি ওমর খৈয়ামের কথা! নজরুল তাঁর একটি  কবিতার অনুবাদ করেছিলেন এরকম :

‘এইখানে এই তরুতলে

আমরা দুজন কুতুহলে               

আর ক’টা দিন কাটিয়ে যাব প্রিয়ে।

সঙ্গে থাকবে পানপাত্র

আর কিছু খাদ্যমাত্র

আরেকখানি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে। ’

পানবিলাসী ও পানাসক্তের মধ্যে অর্থের যেমন বিস্তর ব্যবধান তেমনই তফাৎ পানবিপণী ও পানশালার মধ্যে। শৈশবে আমরা মায়ের মুখে কে না-শুনেছি শিশুতোষ সেই ঘুমপাড়ানি ছড়া : ‘বাটাভরা পান দেব/গালভরে খেয়ো।/খোকার চোখে ঘুম নাই/ঘুম দিয়ে যেয়ো।’ পান থেকে চুন খসলেই যারা মুখগোমরা করেন তারাও কিন্তু সুকুমার রায়ের ‘অবাক জলপান’ নাটকটি দেখে না-হেসে পারেন না! মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের শিশুতোষ হাসির ছড়াটি : “ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ি পাঁচবোন থাকে কালনায়/… টাকাকড়িগুলো হাওয়া খাবে বলে রেখে দেয় খোলা জানলায়/নুন দিয়ে তারা সাঁচিপান সাজে/চচুন দেয় তারা ডালনায়।’

বাঙালির লৌকিক প্রবাদ আছে―‘পান-পানি-পিঠা/শীতের দিনে মিঠা।’ পিঠার যেমন রকমফের আছে তেমনই পানিরও আছে বৈচিত্র্য―সাদা পানি, কোমল পানি, পাগলা পানি! পান করার সঙ্গে যেমন পানীয়-র সম্পর্ক তেমনই পানির সঙ্গে ‘পানসা’ ও ‘পান্তা’ শব্দের মিতালি। স্মরণ করুন, শৈশবে শোনা সেই প্রচলিত ছড়াটি : ‘পান্তা খেয়ে শান্ত হয়ে চাদর দিয়ে গায়/পাঁচন হাতে রাখাল ছেলে গোরু চরাতে যায়।’ লোক-ঐতিহ্যের সেই পান্তা একালে নববর্ষে নাগরিক সমাজে পান্তা-ইলিশে পরিণত হয়েছে।  ভাতে পানি দিলে পান্তা হয় আর ব্যঞ্জনে পানি বেশি পড়লে হয় পানসা। পানসি নৌকার সঙ্গেও কিন্তু পানিরই সখ্য। দুই ‘পান’-এ প্রচুর প্রভেদ―একটি পেয় অন্যটি চর্ব্য―গিলে খাওয়ার ও চিবিয়ে খাওয়ার। লৌকিক বাংলায় পান সুজনতা ও ভদ্রতার প্রতীক। পান লোকজ সংস্কৃতিতে আদর-আপ্যায়নের অপরিহার্য অঙ্গ―বিয়ে-শাদিসহ নানা শুভকর্মেরও প্রতীক। তাই পানসুপারি, পান-তামাক, পানচিনি, পানখিলি―এই জোড়া শব্দগুলো এখনও গ্রামবাংলায় শুভ অনুষ্ঠান, আপ্যায়ন ও বিয়েশাদির সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে।

মুখমণ্ডল লজ্জায় কামরাঙা যেমন হয় বদন তেমনই পান-রাঙাও হয়। রাজা-বাদশারা নাকি মৃগনাভি দিয়ে পান খেতেন। প্রাচীনকালে নারীদের রূপচর্চার অন্যতম উপাদান পান। ঠোঁট-পালিশের তখন তো আর রঙিনাযুত লিপস্টিক ও লিপলাইনার ছিল না! একমাত্র পানই ছিল অধর-রাঙানোর উপকরণ। তাই মধ্যযুগের কবিদের নায়িকার রূপচর্চার বর্ণনায় অনিবার্যভাবে এসেছে পান খাওয়ার প্রসঙ্গ। কবি আলাওল পদ্মাবতীর রূপবর্ণনায় লিখেছেন : ‘তাম্বুল রাতুল হইল অধর পরশে।’ কবির বর্ণনার কী মাধুর্য আর পদ্মাবতীর রূপের কী মহিমা! পান ঠোঁটকে রাঙায়নি বরং ঠোঁটই যেন পানকে রাঙিয়েছে!

এই পান-খাওয়া প্রসঙ্গে বাঙালি কবিরা কত বাক্যমাণিক্য ও গানের চরণ রচনা করেছেন তার ইয়ত্তা নেই! ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন : ‘পান বিনা পদ্মিনীর মুখে ওড়ে মাছি।’ পানভক্ষণ বাঙালির লোকজ সংস্কৃতির অঙ্গ বলেই লোকগানে পানের প্রচুর গুণকীর্তন। “পান খাইয়া ঠোঁট লাল করেছি―বন্ধুর দেখা পাইলাম না!’ ‘বকশির হাইট্টা পানের খিলি বন্ধু, তোরে খাওয়াইতাম।’ লোকসাহিত্য সংগ্রাহক অধ্যাপক-বন্ধু তফিল উদ্দিন মণ্ডল মনে করিয়ে দিলেন বিয়ের আসরে বরের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নিতে শ্যালিকাদের পান-পরীক্ষার কথা। তাঁর সংগৃহীত ছড়াটিতে বাটায় পানের খিলি তৈরি করে বলা হচ্ছে :

‘পান খাও মহাশয় কথা বোঝ ঠারে

 পান-চুনের জন্ম হয় কীসের প্রকারে ?

পান-চুনের জন্মকথা/ যদি না কইবার পাও/ছাগল হইয়া শেওড়াপাতা চিবাইয়া খাও।’

এই পানও আছে নানা প্রজাতির, নানা আকৃতির,  ভিন্ন স্বাদের, নানা স্থানের―বাংলা পান, বরিশালি পান, খাসিয়া পান, মিষ্টি পান―আরও কত কী! যে-পানই হোক, পানপ্রিয়দের কাছে সব পানই প্রাণপ্রিয়। নজরুলকে না-দেখলেও এই প্রজন্মে যারা কবি আসাদ চৌধুরীকে একান্তে দেখেছেন তারা সেকথা উপলব্ধি করবেন। তাঁর পান-মশলা আসে সুদূর আমেরিকা থেকে পুত্রের সৌজন্যে। তাঁর প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থেও আছে পানপ্রীতির পরিচয়। সেটির নাম রেখেছিলেন তবক দেওয়া পান। পান সবাই সেবন করেন না। কিন্তু পানতোয়াতে তো আপত্তি নেই কারও―ডায়াবেটিস রোগী ছাড়া! পানকৌড়ি নামে মাছখেকো জলচর এক পাখি আছে খাল-বিল-নদীর দেশ বাংলাদেশে। মনে পড়ে কবি আল মাহমুদের প্রথম গল্পের বইয়ের নাম পানকৌড়ির রক্ত―সেই কবে, অন্তত চল্লিশ বছর আগে পড়েছিলাম।

পান থেকেই তো ‘পানা’ এবং ‘পানে’। আমরা কেউ পানাপুকুরে ডুব দিতে চাই না! কিন্তু চাঁদপানা মুখের দিকে তাকাতে কার-না ভালো লাগে ? আর রবীন্দ্রনাথের গানে যখন শুনি : আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনি/বাহির পানে চোখ মেলেছি হৃদয়পানে চাইনি’―তখন এই ‘পানে’ সম্পূর্ণই ভিন্ন অর্থ ধারণ করে। পান থেকে চুন খসলে অনেকেই অগ্নিশর্মা হন কিন্তু প্রেমিকার পানে সারাদিন অপলক তাকালেও কারও চোখ টাটায় না!

রাগ

‘রাগ’ শব্দটির সহজ-সরল ও সর্বজনবোধ্য অর্থ―ক্রোধ, রোষ, কোপ, ক্ষোভ। গ্রামবাংলায় একে বলে, গোস্বা। সমার্থক যমজ শব্দ হিসেবে তাই বলা হয় ‘রাগ-গোস্বা’। কিন্তু অভিধান সাক্ষ্য দেয়, ‘রাগ’ শব্দটির অর্থ বহুমাত্রিক। বহু বিচিত্র অর্থ বুকে ধারণ করে আছে ‘রাগ’ শব্দটি। এর সাধারণ ও সুপ্রচলিত অর্থগুলোই আমরা জানি কিন্তু অপ্রচলিত অর্থগুলো আমাদের অধিকাংশেরই অজানা। অথচ ভাষার বৈচিত্র্য ও ভাবপ্রকাশের অলিগলি চিনতে এবং সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি প্রকাশ করতে গেলে এসব জানা থাকা দরকার। তা না-জানলে-যে জীবন চলে না, তা নয়। তবে জানলে ভাষার প্রকাশভঙ্গি সুন্দর হয়―কথার লালিত্যগুণ বৃদ্ধি পায়। অভিধান হল শব্দের সিন্দুক কিংবা আকর। সিন্দুকভরা টাকা থাকলেই যেমন এর সদ্ব্যবহার করা যায় না তেমনই শব্দের বিপুল সঞ্চয় থাকলেও কথায় ও লেখায় তার লাগসই প্রয়োগ সকলের দ্বারা হয় না। এখানেই শৈলীর মহত্ত্ব।

‘রাগ’ শব্দটির যেমন কিছু সুপ্রচলিত জানা অর্থ আছে তেমনই আমাদের মতো সাধারণের জন্যে  অজানা-অপ্রচলিত এবং  অল্প-প্রচলিত অর্থও আছে। আসুন, একটু অভিধান দেখে নিই―কী কী অর্থে ব্যবহার করা যায় এই ‘রাগ’ শব্দটি! জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের সুবৃহৎ  অভিধান বলছে ‘রাগ’ শব্দের অর্থ নিম্নরূপ :

রাগ= ক্রোধ বা রোষ। ভারতচন্দ্র  রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গলে পাই :  ‘হর দেখ টানিয়া ফেলিল শালগ্রাম/ রাগে মত্ত হইয়া ছাড়িল হরিনাম।’ রাগের মাথায় এসব কটূক্তি। তাতে হরিনাম ভক্তরা নিশ্চয়ই রাগ করবেন না।

রাগ= রক্তবর্ণ বা রঞ্জন দ্রব্যাদি অথবা

 রঙচূর্ণ। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রূপের বর্ণনায় বলেছেন : ‘অধরে বিদ্রুম দ্যুতি তাম্বুলের রাগ…।’ কিংবা ‘বেড়েছে কপোল রাগ অধর বিভায়।’ (কবিকঙ্কণ)। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের ‘১৪০০ সাল’ কবিতাটি : ‘আজিকার কোন ফুল, বিহঙ্গের কোন গান/বসন্তের কোন রক্তরাগ/অনুরাগে সিক্ত করি/ পারিব না পাঠাইতে তোমাদের করে/আজি হতে শতবর্ষ পরে।’

রাগ= মায়া-মমতা।

অন্নদামঙ্গল কাব্যেই পাওয়া যায় : ‘চণ্ডী করে গণ্ডগোল/ ভূত-ভৈরবের রোল/কোন সুখে আছ কোন রাগে।’

রাগ= প্রেম, ভালোবাসা।

গোবিন্দ দাসের বৈষ্ণব পদাবলিতে পাই : ‘রাগে ডগমগ প্রভু দেয় সন্তরণ/

পাড়ে দাঁড়াইয়া যত ভক্তগণ।’

রাগের আরও বহুবিচিত্র অর্থ আছে। রাগ মানে―লোভ, কাম, বিরক্তি, হিংসা, শত্রুতা, অভিমান, উৎসাহ, চন্দ্র, রাজা―আরও কত কী! ইংরেজিতে রাগ (জঁম) অর্থ মোটা কম্বল। যতই আপনি রাগ করে রাগ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকুন না কেন, রাগ-ভাঙনোর মতো কোনও রাগরাঙা মুখ ঘরে না-থাকলে লাভ নেই!

সংগীত-জগতের সঙ্গে সুগভীর সম্পর্ক আছে রাগের। রাগারাগির সঙ্গে এই রাগের সম্পর্ক নেই―সম্পর্ক আছে রাগরাগিণীর। রাগ ও রাগিণী দুটি আলাদা শব্দ―অর্থও ভিন্ন। তবে এ-দুয়ের মধ্যে সম্পর্ক গভীর। যে-সুর মানুষের মনোরঞ্জন করে, চিত্তকে করে দোলায়িত তাকেই বলে রাগ। সংগীতবোদ্ধারা বলেন, রাগ ছয় প্রকার। এই ছয় প্রকার রাগের প্রতিটির আছে ছয়টি করে বিভাগ বা শাখা। সেগুলোকে বলে রাগিণী। রাগিণী মানে রাগের ডালপালা―শাখা-প্রশাখা। সংগীতের অ আ ক খ যারা জানেন তারাও বলেন ছয় রাগ ছত্রিশ রাগিণীর কথা।

সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক না-থাকলেও মূল ছয়টি রাগের নাম নিয়ে সংগীতের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ আছে। ভারতীয় সংগীতশাস্ত্রে ছয়টি রাগ নির্ধারণ করা হয়েছে প্রধানত ছয়টি ঋতুর ওপর ভিত্তি করে। ব্রহ্মার মতে, যে-রাগ গ্রীষ্মে গাওয়া হয় তার নাম ‘পঞ্চম’। বর্ষায় গাওয়া রাগের নাম ‘মেঘ’। শরৎকালে গাওয়া রাগের নাম ‘ভৈরব’। ‘নটনারায়ণ’ রাগ গাওয়া হয় হেমন্তে। শীতকালে গেয় রাগের নাম ‘শ্রী’। আর ঋতুরাজ বসন্তে গাইবার উপযুক্ত রাগের নাম ‘বসন্ত’।

এই রাগগুলোর নামের মধ্যেও আছে মতান্তর। তাও আবার একটি-দুটি নয়; চারপাঁচটি। এরকমভাবে ছত্রিশটি রাগিণীর নামের মধ্যেও আছে ভিন্ন-ভিন্ন মত। সেসব রাগরাগিণীর নামের উল্লেখ করলে পাঠকেরা কেবল রাগারাগি করবেন না―শুরু করবেন গালাগালিও। তাই বিরত থাকলাম। অবিরত অক্ষুণ্ন থাকুক গলাগলি, আলিঙ্গন ও মনোবন্ধন।

যে-রাগকে আমরা ক্রুদ্ধতা অর্থে ব্যবহার করি, তা আসলে মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ। ক্রোধের তীব্রতা মানুষের মানবিক গুণকে বিনষ্ট করে―মানুষের ভেতরে জাগে পাশবিক হিংস্রতা। রাগের মাথায় আমরা কত অপকর্মই-না করে ফেলি―গ্লাস-প্লেট ভাঙা থেকে বউ-পেটানো কিংবা খুন করা থেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত! রাগ পুষে রাখাও মানসিক ক্ষতির কারণ! তাই রাগ ঝেড়ে ফেলা উচিত। একশ’ থেকে উল্টো করে এক-দুই গুনলে নাকি রাগ কমে যায়। কে জানে, সত্যি কি না মনস্তত্ত্বের এই সুগভীর তত্ত্বকথা! ‘রাগে’ মানুষ অগ্নিশর্মা হয় আবার অন্য ‘রাগে’ বিগলিতও হয়। অনুরাগে গলে জলও হয়ে যায় মানুষ। আমরা পুষ্পরাগে রঞ্জিত হই, প্রেমরাগে পুলকিত হই, প্রীতিরাগে প্রণত হই কিন্তু করোটির বিক্ষুব্ধ রাগে হই বিধ্বস্ত-বিভ্রান্ত। বাংলা ভাষায় ক্রোধ অর্থে রাগ নিয়ে একটি প্রবাদ আছে। প্রবাদটি নারী-বিদ্বেষী কিংবা লিঙ্গ-বৈষম্যের চেতনা ধারণ করে তাতে কোনও সন্দেহ নেই! এতে বলা হয়েছে : ‘পুরুষের রাগে ব্যবসা, নারীর রাগে বেশ্যা।’ পুরুষ মানুষ রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে উন্নতি আর নারীরা রাগ করে বাইরে বেরুলে বিপদের কূলপাড় নেই! তবে একুশ শতকের নারী বাঙালিনারী সংখ্যায় স্বল্প হলেও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে যেমন সচেতন তেমনই সব ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণেও সক্ষম।

মহাজনেরা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ইত্যাদিকে বর্জন করতে বলেছেন। এগুলো মনুষ্যত্বের শত্রু। তবে মহাপুরুষেরা যা-ই বলুন, রাগহীন মানুষ কি আছে পৃথিবীতে ? ‘অনসূয়া’ শব্দটি অভিধানে আছে, যার অর্থ―যে নারীর রাগ নেই। বিদ্যাসাগরের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’-এ শকুন্তলার এক সখীর নাম অনুসূয়া। তাদের যে রাগ নেই তা হলফ করে বলা যায় না। বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুকে মাথা ফাটিয়ে দেবার পরও তিনি বলেছিলেন : ‘মেরেছ কলসির কানা/ তাই বলে কি প্রেম দেব না ?’ বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, অপসংস্কৃতির ধারক বলে সংস্কৃতিমান মানুষেরা যাকে ব্যঙ্গ করে বলেন ‘ছিঃ  নেমা’―সেখানেও নায়িকাদের গোমরামুখো রাগ নিয়ে প্রচুর গান আছে। ‘সুন্দরী গো, রাগ কোরো না’; ‘লোকে বলে রাগ নাকি অনুরাগের আয়না’ ইত্যাদি। সেসব কথা না-হয় না-ই বললাম। তাতে এ লেখার মান ক্ষুণ্ন হবে বলে মনে হয় না।

কপট রাগও কিন্তু হয়। কপট রাগের শৈল্পিক নাম ‘অভিমান’। ‘রাগ’ শব্দটির আগে ‘বি’ উপসর্গ যুক্ত করলে ‘বিরাগ’ হয়।  বিরাগ মানে বিরক্তি। আমরা কেউ তো কারও বিরাগভাজন হতে চাই না! পেতে চাই সবার প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা। তাই রাগ চাই না―অনুরাগ চাই। ‘অনুরাগ’ মানে অল্প রাগ নয়―ছোট্ট অভিমানও নয়! অনুরাগ মানে প্রেম। অনুরাগ মানে ভালোবাসা। চণ্ডস্বভাবী রাগ দিয়ে মহাদেবের মতো বিরাট দক্ষযজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করা যায় কিন্তু প্রেম দিয়ে জয় করা যায় পূর্ণ পৃথিবী।

রস

কোনও আপাত-কঠিন বস্তুর ভেতরে যে জলীয় বা তরল জিনিস থাকে তার নামই সাধারণ অর্থে ‘রস’। এই ‘রস’ শব্দটিরও আছে বহু অর্থান্তর এবং অনেক রূপ-রূপান্তর। সরস বস্তুতে রসের মাত্রাগত তফাত থাকতে পারে, থাকতে পারে ঘনত্বের ভিন্নতা। কিন্তু সরস বস্তুমাত্রই তরলের আধিক্য। পদার্থবিজ্ঞান বলে, যে-বস্তুর অণুকণা যতবেশি অসংলগ্ন ও পরস্পরের গা-ছাড়া সে-বস্তু ততবেশি তরল। জলকণা বেশি অসংলগ্ন বলেই তরল।এজন্যই বলা হয়, ‘জলবৎ তরলং।’ আর কঠিন পদার্থের অণুগুলো একে অপরের সঙ্গে কাছাকাছি ও ঠাসাঠাসি করে থাকে এবং সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ। তরল পদার্থের অণুকণা অসংলগ্ন কিন্তু কঠিন পদার্থের অণুকণা সংলগ্ন ও দৃঢ়সংবদ্ধ।

সাধারণ অর্থে রস হল আপাত-কঠিন পদার্থ থেকে নির্গত নির্যাস। খাদ্যদ্রব্যের সারভাগই হলো রস। ইক্ষুরস, গোরস (গোরুর দুধ) তালরস, খেজুররস, তামরস(মদ্য), জারকরস ইত্যাদি নানারূপের বিভিন্ন স্বাদের রসের সন্ধান পাওয়া যায়। রসনা সরস হয় এইসব রসের সংযোগে। আবার দেহ-নিঃসৃত বর্জ্যও নানারকম রসেরই আধার―মল-মূত্র, রক্ত-বীর্য-শ্লেষ্মা-পুঁজ ইত্যাদিও একপ্রকার রসই। এসব জলবৎ তরল ঈষৎ ঘনবস্তু কখনও জীবনবিনাশী, কখনও প্রাণপ্রদায়ী আবার কখনও প্রাণসত্তা প্রতিষ্ঠার নিয়ামক। তাই কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সংস্কৃত ভাষায় বলেছেন : ‘রসঃস্বাদে জলে-বীর্য্যে শৃঙ্গারাদৌ বিষে দ্রবে…।’

জানা যায়, পদার্থবিজ্ঞানের মতে রসের মূল স্বাদ ছয় প্রকার : অম্ল, মধুর, তিক্ত, কষা, কু ও লবণ। স্বাদ যা-ই হোক সমস্ত রসের আধার রসনা। রসগোল্লা, রসমালাই, রসবড়া, রসগজা রসকদম্ব, রসমঞ্জরী―এসব মিষ্টান্নের নাম শুনলেই রসনা সরস হয় না কার ? কেবল ‘রস’ শব্দটিরই আছে বিবিধ অর্থের বাহার। যেমন :

রস= মধু। ‘তো মুহ চুম্বী কমলরস পীবমি।’ (চর্যাপদ–৪)

রস= রঙ্গ। ‘অন্ত নাই নাগরের রসে।’ (বৈষ্ণব পদাবলি)।

রস= নির্যাস। ‘কাটিল ঘাঅত লেম্বুরস দেহ কত।’ (বড়ু চণ্ডীদাস)

রস= প্রেমকাহিনি। ‘বৃন্দাবনদাস রস গায়।’ (বৃন্দা)

রস= আনন্দ। ‘শ্রীমতি রাধার ভাবে রসের তরঙ্গ।’ (মানিকরাম)

রস= সৌন্দর্য। ‘দিনে২ অতিরস হইল বিকাশ।’ (কবীন্দ্র পরমেশ্বর)

রস= প্রাণ বা ম্রমশক্তি। ‘প্রজাদের শরীরে রস থাকিতে ছাড়ে না।’ (দর্পণ)

রস= বীর্য। ‘কামের ঘরে কপাট মেরে উজান মুখে চালাও রস।’ (লালন)

রস= ইক্ষু বা খেজুরগাছ-নিঃসৃত সুমিষ্ট তরল। ‘রস জ্বাল দিলে লালি গুড় হয়।’ (বর্তমান লেখক)।

রস= ঘা থেকে নির্গত তরল বর্জ্য। ‘ঘা পচিয়া লালচে রস গড়াইতে আরম্ভ করিয়াছে।’ (‘প্রাগৈতিহাসিক’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)।

রসকষ= সৌন্দর্য। ‘রসকষ মানুষটার মধ্যে যথেষ্টই আছে।’ (ঐ)।

রসবহ্নি= রসের আগুন। ‘যে রূপবহ্নি নয়নে জ্বলিছে যে রসবহ্নি বুকে।’ (অন্নদামঙ্গল)।

রসময়= লাবণ্যমণ্ডিত। ‘রসময় সকল শরীর তোর ভইল নহুলী যৌবনে।’ (বড়ুচণ্ডীদাস)।

রসাক্রান্ত= জলভরা মেঘ। ‘আষাঢ়ের মেঘ যখনই আসে তখনই তাহার নতুনত্বে রসাক্রান্ত…।’ (রবীন্দ্রনাথ)।

রসরঙ্গ= যৌবন উপভোগ। ‘যৌবন থাকিতে ধনি কর রসরঙ্গ।’ (দৌলত উজির বাহরাম খাঁ)।

রসবোধ= সৌন্দর্য উপভোগের ক্ষমতা। ‘কেশ বেঁধে বেশ করলে কী হয় রসবোধ না যদি রয়!’ (লালন)।

রসিক= রস গ্রহণকারী। ‘প্রতি গ্রাসে গ্রাসে হয় রসনা রসিক।’ (ঈশ্বর গুপ্ত)।

রসাঞ্জন= সুরমা। ‘এই তোমার টাটকা-ভাঙা রসাঞ্জনের মতো উজ্জ্বল-নীল কান্তি।’ (নজরুল)।

রসাতল= পাতাল। হেফাজতিরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রসাতলে পাঠাবার অপচেষ্টা করছে। (বর্তমান লেখক)।

রসের বাতি= কামনা। ‘নিভে যাবে রসের বাতি ঘুচে যাবে সব নাট্যা।’ (লালন)।

রসের বাদল= আবেগের উচ্ছ্বাস। ‘রসের বাদল নামিল না কেন তাপের দিনে।’ (রবীন্দ্রনাথ)।

রসিক চাঁদ= প্রাণবায়ু।  ‘যেদিন যাবে রসিক চাঁদ সরে/হাওয়া প্রবেশ হবে না ঘরে।’ (লালন)।

রসবাস= গর্ভিণীর সাত মাসের মঙ্গলানুষ্ঠান। ‘সাত মাসে রসবাস দিল ধর্মকে।’ (কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম)।

রসবতী= কামকলায় সুনিপুণ। ‘তুহুঁ জৈসে রসবতী কানু রসকন্দ।’ (বিদ্যাপতি)।

রসনা= জিহ্বা। ‘রসনারে করে বশ/শ্যামা নামামৃত রস।’ (রামপ্রসাদ)।

মহাজনদের রচনায় রসের এমন বিচিত্রবিধ অর্থের প্রায়োগিক উদাহরণের অন্ত নেই!

রবীন্দ্রনাথ প্রচুর ঋতুভিত্তিক গানের স্রষ্টা। গ্রীষ্মঋতু-সম্পর্কিত তাঁর একটি গানে পাই : ‘নাই রস নাই দারুণ দহন বেলা/খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা।’ এই গানে ‘রস’ বলতে তাপিত গ্রীষ্মের তৃষিত আত্মার জলাকাক্সক্ষা ও বৃষ্টির প্রার্থনাই ব্যক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আরেকটি প্রেমের গানে বলেছেন :

‘আমার সকল রসের ধারা

তোমাতে আজ হোক না হারা।।

জীবনজুড়ে লাগুক পরশ

ভুবনব্যাপে জাগুক হরষ।

তোমার রূপে মরুক ডুবে

আমার দুটি আঁখিতারা।।’

রবীন্দ্রনাথের এই ‘রসের ধারা’ মানে প্রেমপিয়াসী বাঞ্ছাকল্পতরুর মনোবীক্ষণই রূপায়িত হয়েছে। কিংবা নববর্ষের গণনন্দিত বৈশাখী গানে তিনি যখন বলেন, ‘রসের আবেশ রাশি/শুষ্ক করে দাও আসি’―তখন তাপদগ্ধ গ্রীষ্মের নীরসতাই প্রতিভাত হয়ে ওঠে রেটিনার বায়স্কোপে।

অবাক হতে হয় রসের বিচিত্র অর্থ ও বহুবিধ ভাবপ্রকাশের কথা অনুধাবন করলে! ‘রস’ শব্দটির সঙ্গে বাংলা ব্যাকরণের নিয়মে সন্ধি, সমাস, প্রত্যয়, উপসর্গ যুক্ত করে শতশত শব্দ তৈরি করা যায়! সেসব থেকে বিকশিত হয় অজস্র ভাবসম্পদ ও অর্থের বৈচিত্র্য। সঞ্চয় করি কয়েকটি সুপ্রচলিত উদাহরণ :

সরস, নীরস, বিরস, রসনা, রসায়ন, রসাল, রসিক, রসিয়া, রসিকতা, রসা, রসদ, রসকন্দ, রসকুম্ভ, রসাত্মক, রসকুঞ্জ, রসগ্রাহী, রসবন্ত, রসবোধ, রসব্যঞ্জনা, রসজ্ঞ, রসবচন, রসরাজ, রসশ্রেষ্ঠ, রসবিদ্যা, রসসিন্ধু, রসসিঞ্চন, রসবেত্তা―এরকম অজস্র শব্দ সঞ্চয় করা যায়।

বাংলার লোকসাহিত্যে ‘রসিয়া বন্ধু’ ও ‘রসের নাগরদের’ কদমতলায়, পাটখেতে, ইক্ষুখেতে, কলাবাগানে রসের অভিসারের কথা না-হয় না-ই বললাম।

কিন্তু বৈষ্ণব-সাহিত্যের রসশাস্ত্রের কথা তো বলতেই হয়। তা কাব্য বা সাহিত্যের অন্তর্গত প্রাচীন ভারতীয় শিল্পের দর্শন। কোনও বিষয় দেখলে, শুনলে বা পড়লে মানুষের মনে যে ভাব বা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তাকেও বলা হয় ‘রস’। তা অনেক সময়ই অনির্বচনীয়―ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তাকে মনের বিকারও বলা যায়। যেমন আনন্দ-বেদনা, কাম-ক্রোধ, সুখদুঃখ, উল্লাস-উৎসাহ, রাগ-ক্ষোভ, অভিমান-অনুরাগ, প্রেমপ্রীতি, বিস্ময়, বৈরাগ্য ইত্যাদি। এইসব ভাবের অনুষঙ্গ মানবমনে নিত্যবহমান। এসব অনুভূতির স্থায়ী রূপকে অলংকারশাস্ত্রে ‘রস’ বলে। এই রস নয় প্রকার। খুব সংক্ষেপে এগুলো উদাহরণসহ নিম্নরূপ :

শৃঙ্গার বা আদিরস= যাতে নারী-পুরুষের কামচেতনা প্রকাশিত। ‘উতরো নেকাব, হাঁকে মোর দুরন্ত কামনা।’ (নজরুল)।

বীররস= যাতে বীরত্ব প্রকাশ পায়। ‘বল বীর―বল উন্নত মম শির।’ । (নজরুল)।

করুণরস= বিষাদচেতনা। ‘হা পুত্র, হা বীরবাহু! কেমনে ধরিব প্রাণ তোমার বিহনে!’ (মধুসূদন)।

অদ্ভুতরস= বিস্ময় করা চেতনা। ‘সূর্যের লুঙ্গিতে ঘাম।’ (সৈয়দ হক)।

হাস্যরস= হাসি উদ্রেককারী।

‘প্রোফাইল করিয়া লক

দুয়ারে দিয়াছো নক।

কী করিয়া বুঝিবো তুমি

কাউয়া না বক ?’ (প্রচলিত)।

ভয়ানকরস= ভীতিকর চেতনা। এমন সময় হা রে রে রে রে রে/ঐ যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে।‘ (রবীন্দ্রনাথ)।

বীভৎসরস= ঘৃণা উৎপাদক ভাব।

‘ওকে ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছি

ও যে চণ্ডালিনীর ঝি―

নষ্ট হবে যে দই

সে কথা জান না কি ?’ (রবীন্দ্রনাথ)।

রৌদ্ররস= ক্রোধ উৎপাদক ভাব। ‘আমি চির দুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,/মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন আমি ধ্বংস।’ (নজরুল)।

শান্তরস= শান্তি উৎপাদক ভাব। ‘দুইজনে হৃষ্টমনে ক্রীড়া করে কুঞ্জবনে/নানা রস জানে নানা মায়া।’ (অন্নদামঙ্গল)।

এই নয়টি রস ছাড়াও আরেকটি অন্যতম রসের নাম ‘বাৎসল্য রস’। সন্তানের প্রতি স্নেহময়তার নাম বাৎসল্য রস। ‘একদিন শ্রীহরি মৃত্তিকা ভোজন করি/ধূলায় পড়িয়া বড় কাঁদে। যশোদা দেখিয়া তারে/ মৃত্তিকা বাহির করে/ বড়শি গিলেছে যেন চাঁদে।’ (হরু ঠাকুর)।

পণ্ডিতেরা বলেন, উগ্রগন্ধী ‘রসুন’ শব্দটির উৎপত্তিও রস থেকে। এর প্রাচীন বানান ‘রসূন’ (রস+ঊন)। এর মানে তাতে একটি স্বাদের ঊনতা আছে। আর তা হলো টক স্বাদ।

মানবহৃদয় অনন্ত ভাবের খনি। তাই রসের রূপও অন্তহীন। প্রাচীনকাল থেকে এই আধুনিককাল পর্যন্ত বাংলা কাব্য-জগতে আছে অমৃত কুম্ভের মতো অজস্র রসের কলস―অপেক্ষা কেবল হৃদয়বান মানুষের আস্বাদনের। এইসব রসের খোঁজ-খবরের পরেও যাদের হৃদয় এখনও রসকষহীন তাদের শুনতে অনুরোধ করি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা মান্না দে-র সেই জনপ্রিয় প্রেমের গানটি। যার শেষের কথা এরকম :

‘যখন সবকিছু যায় রসাতলে

কেউ আমাকে ফকির বলে।…

তুমি যখন ফকির বলো

রসের অতলে যে তলাই আমি।’

[চলবে]

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button