বইটির তীব্রতা সামলে উঠতে আমাকে যথেষ্ট কষ্ট সইতে হয়েছে। যখন আমার কান্না পায়, মাথার তালু থেকে একটু পেছন দিকে একটা তীক্ষ্ম যন্ত্রণা হয়। দৃষ্টি হয় বাধাগ্রস্ত। এ বই পড়াকালে বারবার ওটা সহ্য করতে করতে এক সময় আমি স্বাভাবিক দেখার ক্ষমতা হারিয়েছি। আর সারাক্ষণ বুক ধড়ফড় করত। কারণ একটু পরপর বইয়ের পাতা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
১৯৭১ গণনির্যাতন গণহত্যা : কাঠামো, বিবরণ ও পরিসর শক্ত নার্ভের পড়ার বই। সম্পাদনায় আফসান চৌধুরী। সঙ্গে ছিলেন তাঁর গবেষণা-সহকারীবৃন্দ। বইটি গবেষণা শাখায় এ বছর ব্রাক ব্যাংক সমকাল সাহিত্য পুরস্কার জয় করেছে।
মন মানে না। মন শুধু নিজের পরিবারের সঙ্গে সব মেলাতে চায়। যত নৃশংসতার কথা আছে তার সবকটার শিকারের জায়গায় নিজের প্রিয়মুখগুলো বসাতে চায়। এখনও তার সঙ্গে যুদ্ধ করছি।
বইয়ের প্রকৃতি
১.
এ বই একটা কারণে বিশেষত্বপূর্ণ।
বিশ্বে যুদ্ধের ইতিহাস বলতে যা আমরা সচরাচর জানতে পারি তা রাজনৈতিক টাইমলাইনের মতো। অধিকাংশ সময়ে যার মুখপাত্র রাজনৈতিক দললগ্ন কেউ। বিশেষ করে বিজয়ী দল। ইতিহাস-বইয়ের সারিতে এরা বোধহয় প্রথম। এর বাইরে যুদ্ধের দ্বিতীয় ইতিহাস থাকে। আর তার বড় অংশ অনিবার্যভাবে চির-অলিখিত এবং কালক্রমে বিস্মৃত হয় এ ইতিহাস।
ভারত বিভাগ হলো, বাংলাদেশ স্বাধীন হলো―এ বিশ্বকোষে লেখা থাকে। কিন্তু পলায়নপর মানুষের স্রোতের ভেতর কোনও মায়ের হাত থেকে ভিড়ের ভেতর কখন তার মেয়েটা চিরতরে হারিয়ে গেল, সেসব কথা বিশ্বকোষে কোথায় ? এর ভারটা অনেকটাই উপন্যাস বহন করে।
‘১৯৭১ গণনির্যাতন গণহত্যা : কাঠামো, বিবরণ ও পরিসর’ বইটিতে ইতিহাসের এই চির-অব্যক্ত প্রশ্নের খানিকটা-মাত্র হলেও, ব্যক্ত করার জন্যে আফসান চৌধুরী ও তাঁর দলের কাছে কৃতজ্ঞতা।
প্রথম ধরনের বইগুলো আমাদের তথ্যে এগিয়ে দেয়। তর্কে শক্তি দেয়। বিশ্লেষণ ধারালো করে। আর দ্বিতীয় ধাঁচের বইগুলো আমাদের আবেগকে মন্থন করে। কখনও অমৃত উঠে আসে, কখনও বিষ। তর্কের শক্তি কেড়ে নেয়, চুপ করিয়ে দেয়।
‘১৯৭১ গণনির্যাতন গণহত্যা’ বারবার আমার বোধ ও বাকশক্তি কেড়ে নিয়েছে। বহুবার এমন হয়েছে যে বইটা নামিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে বহুক্ষণ স্পষ্ট কিছু দেখতে পাইনি। আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে কিছু কিছু লাইনের পাশে পয়েন্ট রেখে পড়ছিলাম। একসময় হাল ছেড়ে দিই।
হয়ত এই হওয়ার কথা। একটা ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস’ যা দেয়, হয়ত একটা ‘অ্যানি ফ্রাঙ্কের ডায়রি’ তারও বেশি কেড়ে নেয়। প্রথমটা দিয়ে ঋণী করে। দ্বিতীয়টা কেড়েও ধনী করে।
২.
১৯৭১ গণনির্যাতন গণহত্যা : কাঠামো, বিবরণ ও পরিসর- বই থেকে পাঁচটা ঘটনাসূত্র তুলে ধরছি :
ক. মোহাম্মদপুরের এক বাঙালি-বাড়ি বিহারীরা ঘিরে ফেলেছে। গুলি ছুড়ছে। বাড়ির কাচ ভেঙে পড়ছে। যে কোনও সময় ঢুকে পড়বে হামলাকারীরা। ঢুকলে সবার রক্ত বয়ে যাবে কোনও সন্দেহ নেই। বাড়ির ছেলেটি হঠাৎ ছিটকিনি খুলে ফেলে বললেন, মা বাবা, কোনও অপরাধ থাকলে ক্ষমা কোরো। আমি চললাম ওদের কাছে। যদি আমাকে কেটে সাধ মেটে, তোমাদের যেন ছেড়ে দেয়। ছেলেটার আশা পূরণ হয়েছিল।
খ. খুলনায় নদী থেকে কিছু নৌকাযাত্রীকে তুলে এনে দাঁড় করানো হয়। প্রত্যকে সনাতনী মানুষ। তাঁদের মেরে ফেলা হবে। দূর থেকে স্থানীয় একজন হাজীসাহেব ছুটে গেলেন। ‘ওদের মেরো না!’ সৈন্যরা বলল, তুমি মুসলমান না ছদ্মবেশী হিন্দু। বৃদ্ধ বললেন, আমি মুসলমান। ওরা বলল, বেশ, নামাজ পড়ে দেখাও। দূর থেকে মানুষ দেখল, অস্ত্র তাক করা অবস্থায় বৃদ্ধ নামাজের নিয়ত বাঁধছেন। তীব্র ভয়ে তাঁর নার্ভাস ব্রেকডাউন হলো। কয়েকবার ভুল করে বসলেন। সনাতনী মানুষগুলোর সঙ্গে তাঁকেও ব্রাশফায়ার করা হলো।
গ. একজন মুক্তিযোদ্ধা দেশীয় বিশ্বাসঘাতকদের হাতে ধরা পড়েছেন, নারী, সঙ্গে তাঁর ছোট্ট সন্তান। যখন তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পথে এক পরিচিত মানুষকে ভাগ্যক্রমে পেয়ে তার হাতে সন্তানকে তুলে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। পরে ভাইয়েরা জেনেছিলেন, গাড়ির সঙ্গে বেঁধে টেনে নিতে নিতে তাদের মুক্তিযোদ্ধা বোনকে হত্যা করা হয়েছিল।
ঘ. এক সনাতনী পরিবারের দুটো মেয়েকে সেনারা ধর্ষণ করে রেখে গেল। সেই পরিবারটির সমাজজীবন বিষিয়ে তুলল সমাজের মানুষেরা। পরিবারের সদস্যরা তাঁদের সাথে খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করল। কারণ তাঁরা কলঙ্ক এনেছেন! শেষে মেয়ে দুটো শান্ত হয়ে নিজেদের ভেতর এক সমঝোতায় পৌঁছালেন। আত্মহত্যা করলেন।
ঙ. কুমিল্লায় নিরাপত্তার জন্যে বাবা অন্যত্র পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন দুই মেয়েকে। পথে একজন সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে যৌন নির্যাতন করা হয়নি, তবে অদ্ভুতভাবে, অশুচি হয়ে থাকতে বাধ্য করা হতো।
বোধয় ভাঙা কুলো হিসেবে রাখা হয়েছিল তাঁকে। একবার এক পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তার বন্ধুকে হারায়। ক্যাম্পে ফিরে এসে সেই সৈন্য তাঁকে উপর্যুপরি মারতে থাকে যতক্ষণ না তিনি জ্ঞান হারান। যখন জ্ঞান ফিরল বীভৎস হয়ে গেছে মুখ। অনেকগুলো দাঁত নেই। তাঁর মনে হয়েছিল এরচেয়ে যদি ধর্ষণ করা হতো, হয়ত কম কষ্ট পেতেন।
পড়া যায় না। তবু পড়ে যেতে হয়।
আত্মোৎসর্গের যে সমুদ্র বাঙালি সাঁতরেছে, এ তো তার মাত্র কয়েক ফোঁটা জল। ব্রাশফায়ারের লাশের স্তূপ, অগ্নিদগ্ধদের স্তূপের কথা না বলা থাকল। ক্যাম্পগুলোয় ধর্ষিতা নারীদের বেয়নেটে ছিন্ন যোনী (এর কথা আমি ফেনীর দ. কুহুমা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব আব্দুল মজিদের কাছে শুনেছি), শিশুদের পিষ্ট দেহ আর বেয়নেটে বিদীর্ণ করা নাড়ি, উহ্য থাকল।
কিছু সংস্কারের অবকাশ আছে
ভুক্তভোগী ও নিহতের স্বজনদের কথা সরাসরি উক্ত হয়েছে, এটা ভালো। তবে উক্তিগুলো লিখিতভাবে ব্যক্ত হওয়ায় অনেকটা সম্পাদনার কিছু অবকাশ তৈরি হয়েছে মনে করি। নইলে কিছু ক্ষেত্রে বেশ খাপছাড়া শোনায়। বক্তারা যেহেতু বেদনার্ত, এবং স্মৃতিচারণ করছেন, অনেক সময় অনেক ঘটনাপরম্পরা নষ্ট হয়েছে। পাঠক হিসেবে বোঝায় খানিকটা হলেও সমস্যা হয়েছে। প্রান্তিক মানুষদের উক্তিগুলোয় প্রচুর পুনরাবৃত্তি রয়েছে। কিছু আঞ্চলিক শব্দ ও ভাবের পাদটীকা দিলে হয়ত ভালো।
ব্যক্তিগত ভাবনা
আমার চোখে মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর নৃশংসতম গণহত্যাকেন্দ্রিক ভূ-রাজনৈতিক যুদ্ধগুলোর একটি। যে যুদ্ধের প্রস্তুতি, আমার বিশ্বাস, অন্তত এক দশক ধরে নেওয়া হয়েছে। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে কেন্দ্রীয় শাসনদণ্ড যারা গায়ের জোরে নিজের হাতে রাখতে চাইছিল, তাদের ক্রমবিবর্তন লক্ষ্য করুন। তাদের অন্যায্য শাসনাভিমানকে কিন্তু এখানকার মানুষ ভোটের শক্তি দিয়ে বারবার ব্যর্থ করে দিয়েছে। এখানকার সংখ্যার কাছে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কোনও দর্প টেকেনি। বিনিয়োগ সব বানের জলে ভেসে যেত। তাই কেন্দ্রকে দুই দশকজুড়ে বারবার শুধু গায়ের জোরে গণপরিষদ বাতিল করতে হয়েছে।
পূর্ববাংলার শক্তি এই জনসংখ্যাধিক্য অকার্যকর করার পরিকল্পনাটা ওদের ছিল। সেটা যে নেতাহত্যা থেকে শুরু করে ক্রমশ নির্বিচার গণহত্যার দিকেও এগোতে পারে তার পূর্বাভাস পাই স্বাধীনতাপূর্ব একটি বইয়ে। ‘পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর’। ষাটের দশকের শেষপাদে মৃত্যুর আগে তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া লিখে রেখে যান।
গণহত্যা দেখে যেতে হয়নি ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদককে। তাঁর লেখা ভূমিকায় আশা ব্যক্ত করেছিলেন, যেন ভবিষ্যতের রাহু ঠেকাতে পারি। জিন্নাহ থেকে শুরু করে শেষমেষ ইয়াহিয়ায় পর্যবসিত শাসন। কেন্দ্রীয় জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতির প্রায় চব্বিশটি বছরের প্রত্যেকটি দিন, আমরা পায়ে পায়ে গণহত্যার দিকে এগিয়েছি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান―আমাদের ট্রাজিক জননায়কেরা শত চেষ্টাতেও তা রুখতে করতে পারেননি।
অবশেষে মুক্তিযুদ্ধটা পূর্ণ সামরিক রূপ পাওয়ার আগেই পৃথিবীর গণহত্যার ইতিহাসে নতুন আঁচড় যুক্ত হয়ে গেল।
একটা জাতিগত গণহত্যা কিন্তু তাৎক্ষণিক বা ক্ষণিকের সিদ্ধান্তের ফল নয়। এর দীর্ঘ প্রস্তুতি প্রয়োজন। অস্ত্রের প্রস্তুতির চেয়ে বড় প্রয়োজন পলিসি তৈরির প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতির একটা বড় অংশজুড়ে থাকে জন ও কূটনৈতিক পর্যায়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন তৈরির বিষয়। আমার বিচারে, কেন্দ্রের উদ্যোগে পশ্চিম পাকিস্তানে গোটা ষাটের দশকজুড়ে এর নানান ধাপ সম্পন্ন হয়। আর ধর্ম ও দাসবৃত্তির আফিম খাইয়ে কিছু মিথ্যে লোভ জাগিয়ে এ দেশের কিছু দুর্বল নেতাদের ব্যস্ত রাখা হয়। তারাও কেউ প্রতিশ্রুত ক্ষমতা পায়নি। লাখো মানুষকে হত্যা করিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতননামার কাছে যতবার আসি, একটা কথা বারবার মনে হয় প্রায়ই। হত্যাচিন্তায় ইয়াহিয়া খান লোকটা এডলফ হিটলার দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে যায় না। স্পিলবার্গের চার ঘণ্টার অনবদ্য চলচ্চিত্র শিন্ডলার’স লিস্ট। এ ছবি দেখে কেউ হিটলারকে ছুঁড়ে ফেলতে উদ্যত হবে, কেউ যত্নে টুকে রাখবে ভবিষ্যৎ গণহত্যার ছক। প্রকৃতি এই দ্বান্দ্বিকতা যত্নে রক্ষা করে।
আমরা এ দ্বান্দ্বিকতার বলি হয়েছি, গণহত্যায়। আর উপহার পেয়েছি স্বাধীনতায়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক