
বৃত্ত
বৃত্তের বাইরে কিছুই হলো না,
অতীত বিচ্ছুরিত রশ্মি
বিগত পাণ্ডুলিপির উন্মোচনে
বর্ণমালা পোড়ে আগুন আয়োজনে।
বিষাদ লেগে থাকে চোখে।
দূরের কিছু মেঘ ঝলকে উঠে
বলে, রোদ আছে অদূরে।
অনেক শূন্যতা আকাশ হয়ে
ছড়িয়ে পড়ে বুকের পাঁজরে।
বৃত্তের বাইরে হাত বাড়াই
বিষাদ লেগে থাকে নখে।

বিষণ্ন
আমার একাকিত্বের পাশে
দাঁড়িয়ে আছো তুমি,
হে বিষণ্ন হৃদয়
ঝরাপালক পাতার ভিড়ে
দুঃখ বাজিয়ে উড়ো,
দিগন্তের শেষ স্রোতে
ডানা মেলো
পলকা হওয়ার প্রত্যয়ে,
যেন এক ভঙ্গুর বনভূমি।
আমার একাকিত্বের পাশে
গোধূলি ঝরে
হে বিষণ্ন জীবন
ঘুণে খাওয়া গৃহস্থ ঘরে
শূন্যতারে ধরো
যেন কিছু নীল, মেঘের পঙ্ক্তি
থেকে যায় ঘাঁটি গেড়ে।

কুয়াশা
কুয়াশা জমেছিল বুকে,
তাই
কপালটা কুঁচকে ছিল
নুইয়েছিল চোখ কাশের ভারে।
শরৎ ফেরি করা ভৈরবী
নগর ঢেকে দিয়েছিল পোস্টারে।
গোধূলি ঘুরে গুচ্ছ আকাশ
কৃষ্ণ মেঘের মফস্বলে
নীল না ছড়াতে পেরে আড়ালে
ঘোলাটে চিত্রকল্পে।
শূন্যের নিমন্ত্রণে অনেক অন্ধকার
ছড়িয়ে আঙুলে
ঝরার বন কুণ্ডলী পেকেছিল
দীর্ঘশ্বাসের দীর্ঘায়িত ঝড়ে।
কুয়াশা জমেছিল বলে
অনেক রাত দিগন্ত জুড়ে
দীর্ঘ হয়েছিল পথে,
দেখতে পাইনি; তুমি এসেছিলে ?

নাগরিক বিভ্রম
শূন্যের শরীরে জলের প্রসাধনী,
আমাদের নাগরিক চোখ দুঃখ ভেবে
সমস্ত শহরে সেঁটে দিয়েছিল
কংক্রিটের ছাউনি।
ঝলসে যাওয়া রাস্তার পিচে
স্পষ্ট ছিল কালের অবক্ষয়,
মৃতপ্রায় বৃক্ষ-সমাজ নুইয়েছিল
নাগরিক উষ্ণতা পাঠে।
অপরিকল্পিত আভিজাত্যে সবুজ মুছে
জরাগ্রস্ত তৃষ্ণার পিছনে ছুটে
আমাদের নাগরিক হৃদয়
জড়ো করেছিল গাঢ় কার্বন,
ক্লান্তি ব্যর্থতার উষ্ণ জীবন
ছায়ার লোভে তুমুল বিভ্রমে
নতজানু ছিল ধূসরে।
ঘোরগ্রস্ত গোধূলির আয়োজনে
রঙিন রোদে ওড়া পাখির পালকে
আমাদের নাগরিক স্বপ্ন
গন্তব্য খুঁজে বিষাদ এনেছিল
অন্ধকারের প্রস্তুতি পর্বে।

শুশ্রুষা
অনেক রোদ থেকে ছায়া তুলে
গোড়ালির ক্ষয়ে
কাদার পৃথিবীতে হেঁটে বেড়িয়েছি,
আকাশ হবার নেশায়
শূন্যতা জমিয়ে নীল হয়েছি ভেতরে।
মেঘের প্রলোভনে
চোখে দুটো সমুদ্রের বাষ্পায়নে।
একটু শুশ্রƒষার জন্য
সন্ধ্যাকে রেখেছি শরীরে,
ঘন হয়ে আসা গোধূলির ভারে
শীত পুষেছি পাঁজরে।
শুধু একটু শীতলতার জন্য
অনেক বেদনা অশ্রু বানিয়ে
ঝরাতে চেয়েছি বর্ষাঋতুর রোমন্থনে,
দীর্ঘক্ষণ জলের নগরে দাঁড়িয়ে
ঢেউ তুলেছি দীর্ঘশ্বাসে।

প্রসাধনী
গ্লাস গ্লাসে গোধূলি, রঙের ঘোরে
অন্ধকারের প্রস্তুতি,
নীরবতাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে।
দিগন্তের শূন্যে দিকভ্রম পাখিটির
ডানার কম্পনে
অঝোরে ঝরে শোকের আলেখ্য,
যেনো চিরকুটের চিঠি কৃষ্ণ অক্ষরে
চক্রাকারে ঘুরে ঘূর্ণাবর্ত পালকে।
এক বিকেলের ঝড়ো হাওয়ায়
শস্যশূন্য মাঠের প্রতিধ্বনি
ঝরার বনে হলুদ স্মৃতির প্রতিবেদনে
বুকের ভেতর পরিশ্রান্ত কণ্ঠস্বর।
প্রত্ননদীর বিষাদ ফুটেছে দিনের
অবয়বে।
মেঘের অন্তরালে স্ফুলিঙ্গ স্ফুরণে
দিগন্তের নির্নিমেষ অন্ধ আলো
গুমোট রেখেছে অন্তর্গত মফস্সল।
সমস্ত প্রসাধনী সাজানো রয়েছে
রাতের আয়োজনে।

অনুবাদক
কুয়াশার অনুবাদ করতে জানি
সূর্য না দেখেও
রোদের স্তুতি করি,
আমার কবিতায় পাখি আসে,
পালকে পালকে থাকে
বিস্তৃত বিষণ্ন।
ওড়ার ক্লান্তিতে দিগন্তে
রচিত হতে থাকে
দীর্ঘ শোককাব্য, অদেখা
গন্তব্যের দীর্ঘশ্বাস।
এক জীবনের প্রশ্নবোধকে
এক অভিজ্ঞ অনুবাদকের মতো
চোখে জ্বলে প্রাজ্ঞ অভিলাষ।
বোধের মফস্সলে গৃহস্থালি গড়ে
নিসর্গের প্রতিটি অক্ষরে
অর্থ দানা বাঁধাই মগ্ন পাঠে।

রঙিন গোধূলি
যদি অনেক আলোর অনুপস্থিতিতে
শোনা না হয় ভোরের গান,
স্মৃতির ভারে তাড়িত অবসাদে
পিছলে পড়ি অগোচরে,
ঝরার স্বরে পাতা জড়ো করে
বৃক্ষটির শেকড়ে,
যদি শীত পুষি বুকের পাঁজরে।
হাওয়ায় ওড়া তুলো তুষার
তুলে নিই চোখের করিডোরে।
যদি মেঘের ঘর্ষণে সেøাগানমুখর
স্ফুলিঙ্গ ছড়ায় বিদ্যুতায়িত অন্তরে।
তবু একদিন বসন্ত আসবে
অনবগুণ্ঠিত পরাগ ছুঁয়ে
নীল ফড়িং উড়বে তোমার শহরে,
তবু একদিন দেয়ালে দেয়ালে
সূর্য-পোস্টারে,
বিষাদ ভুলে হেলে রবে তুমি
দিগন্তে ছুঁয়ে থাকা রঙিন গোধূলি।

বিচ্ছেদ
এখানকার এই মৃত বনে
শুষ্ক শেকড়ের ব্যথা নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে একসারি বৃক্ষ।
দিনের চিরকুটে অন্ধকার লিখে
এলোমেলো অনুচ্ছেদে
দুঃখী হয়ে থাকে জীর্ণটা ধরে।
জড়ো হওয়া ঝরার মনস্তাপে
একগুচ্ছ বর্ণের খসড়া গড়ে
স্মৃতিরা ঝুলে হলুদাভ ডালে
পরিযায়ী গোধূলি আলোর বিভ্রমে
ঘুরেফিরে ফিরে যাবার কালে
মাটির রন্ধ্রে সন্ধ্যার বীজ বোনে।
বাতাসের সাথে উড়ন্ত পাতারা
শব্দ শ্বাসে ওড়ার কৌশলে
দিগন্তমুখী পাখি যেনো,
এখানকার এই মৃত বনে
বৃক্ষ পাতার সম্পর্ক বিচ্ছেদে।

দীর্ঘশ্বাস
এখানে একটি বনভূমি
কিছু বৃক্ষ বাকলের অবক্ষয়ে
ঝুলন্ত ডাল ঝরার পটভূমি,
হাওয়ায় ওড়া তুলা, তুষার সদৃশ।
হলুদ পাতার সংসারে মর্মরে
ঝড়ের বিজ্ঞপ্তি তুলে
লুকিয়ে পড়ে পরিযায়ী।
এখানে একটি আকাশ
অনেক যন্ত্রণার নীল রঙে
বিস্তৃত হয় শূন্যে,
যে পাখিরা উড়তে এসে
পালক ছড়ায় ডানার অসুখে
তারাও দিগন্ত ছুঁতে না পেরে
ব্যর্থতা ঘেঁষে মাটিতে ফেরে।
সমুদ্র থেকে সুর তুলে
জলের ঘর্ষণে বিদ্যুৎ চমকায়।
বিষণ্ন বলয়ে অশ্রুর ফোঁটা
নিসর্গ সমেত ঝরে অবিরত।
এখানে একটি আকাশ
মেঘের দীর্ঘশ্বাস।
———————-
সচিত্রকরণ : রজত