আর্কাইভকথাসাহিত্য

প্রতিশোধ : মূল : ইসাবেল আয়েন্দে : বাংলা অনুবাদ : মাজহার জীবন

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প

[ইসাবেল আয়েন্দে চিলিতে জন্মগ্রহণকারী একজন আন্তর্জাতিক পরিচিতিপ্রাপ্ত সাহিত্যিক। তাঁর তেইশটিরও বেশি বেস্টসেলার বই এবং জীবিত লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রশংসিত, পঠিতদের একজন। তাঁর বই পঁয়ত্রিশের অধিক ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং সত্তর লক্ষের বেশি বিক্রি হয়েছে।]

আনন্দ উপচে পড়া এক দিন। দুলসে  রোসা ওরেইয়োনোকে তারা কার্নিভাল-কুইন হিসেবে জুঁই ফুলের মুকুট পরিয়ে দিল। এতে অন্য প্রতিযোগীর মায়েরা গুঞ্জন শুরু করে দিল। তাদের কাছে তার এ পুরস্কার প্রাপ্তি পক্ষপাতদুষ্ট। তাদের ধারণা মূলত এ পুরস্কার তাকে দেওয়া হয়েছে সে সিনেটর আনসেলমো ওরেইয়োনোর মেয়ে বলে। এই সিনেটর রাজ্যজুড়ে সবচেয়ে ক্ষমতাধর। তবে তারা এটাও স্বীকার করে যে মেয়েটি বেশ লাবণ্যময়ী এবং অন্যদের চেয়ে ভালো নাচতে আর পিয়ানো বাজাতে পারে। তারপরও তারা মনে করে আরও প্রতিযোগী ছিল যারা এই পুরস্কারের জন্য বেশি যোগ্য। সকলে তাকে জমকালো সিল্কের পোশাক পরে স্টেজে দেখল। ফুলের মুকুট পরে দর্শকের দিকে সে হাত নাড়াচ্ছিল। এ দৃশ্য দেখে তারা গোপনে মেয়েটিকে অভিশাপ দিচ্ছিল। বেশ কয়েক মাস পরে ওরেইয়োনো পরিবারে যখন বিপর্যয় নেমে এল তখন তাদের অনেকে একদমই অখুশি হয়নি। সে ঘটনা ছিল এক মহাদুর্যোগ আর অনেক মৃত্যুর কারণ। এই বিপর্যয় চূড়ান্ত পরিণতি পেতে পঁচিশটি বছর লেগে যায়।

কুইন নির্বাচনের রাতে, সান্তা তেরেসার সিটি হলে ডান্স পার্টি হয়েছিল। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা যুবকেরা দুলসে রোসাকে দেখার সুযোগ পায় সেখানে। সে খুব খুশি আর হালকা মেজাজে ছিল বলে অনেকে বুঝতেই পারেনি যে সে সেখানে সবচেয়ে সুন্দরী ছিল না। তারা নিজ নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে বলা শুরু করল জীবনে তারা এত সুন্দর চেহারার কাউকে দেখেনি। এভাবেই সে সুন্দরীর অপ্রত্যাশিত তকমা পেয়ে গেল। পরবর্তীকালে কেউ আর তা অস্বীকার করতে পারেনি। তার ধবধবে ত্বক আর স্বচ্ছ চোখের অতিরঞ্জিত বর্ণনা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। প্রত্যেকে তার নিজের মাধুরী মিশিয়ে নতুন কিছু যোগ করতে থাকল। দূর দূরান্তে নগরের কবিরা দুলসে রোসা নামের এক মোহময়ী তরুণীকে কল্পনা করে কবিতা লিখতে শুরু করল।  

সিনেটর ওরেইয়োনোর প্রাসাদে বেড়ে উঠা সেই সুন্দরীর জনশ্রুতি একসময় তাদের সেস্পেদের কানেও পৌঁছে গেল। এই মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে সে কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি। কারণ মেয়েটার সুনাম ছড়িয়ে পড়ার সময় কবিতা আওড়ানো কিংবা মেয়েদের দিকে নজর দেওয়ার সময় তার ছিল না। সে তখন গৃহযুদ্ধে পুরোপুরি ব্যতিব্যস্ত। গোঁফদাড়ি কামানো শুরুর বয়স থেকে তার হাতে উঠেছে বন্দুক। তারপর দীর্ঘদিন ধরে তার বসবাস গানপাউডারের ধোঁয়ায়। মায়ের চুম্বনও ভুলে গেছে সে। এমনকি সাধারণ গানবাজনাও। যদিও তার সব সময় যুদ্ধ করার দরকার হতো না। সাময়িক যুদ্ধবিরতি কালে তার সৈন্যদের সামনে কোনও শত্রু থাকত না। এমনকি জোরপূর্বক শান্তির সময়ও তার যুদ্ধ করার প্রয়োজন হতো না। কিন্তু সব সময় তার জীবনযাপন দস্যুর মতো। যুদ্ধ বাধানোই তার স্বভাব। কোনও শত্রুর খবর পেলে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে সে চষে বেড়ায়। এমনকি ছায়াশত্রু আবিষ্কার করেও সে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। যেমন যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার দল হেরে যায় তবে সে বিরুদ্ধ দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে দেবে। হঠাৎ রাতারাতি গোপন আস্তানা থেকে বের হয়ে এসে সে তার শত্রুদের যুদ্ধে পরাস্ত করে দেয়।   

তাদের সেস্পেদের শেষ মিশন ছিল সান্তা তেরেসাতে দমনমূলক অভিযান। বিরোধী নেতাদের নিশ্চিহ্ন করে সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য রাতের বেলা এক শত বিশ জন সৈন্য নিয়ে সে শহরে প্রবেশ করে। তারা সরকারি ভবনের জানালা চুরমার করে, চার্চের দরজা গুঁড়িয়ে দেয় এবং ঘোড়ায় চড়ে উঁচু বেদিতে উঠে পড়ে এবং তাদের সামনে পড়া ফাদার ক্লেমন্তের ভাস্কর্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলে। তারপর পাহাড়ের ওপরে গৌরবের সঙ্গে দণ্ডায়মান সিনেটর ওরেইয়োনোর ভিলার দিকে এগিয়ে যায় এবং ভীষণ দম্ভে পাহাড়ে অবস্থান নেয়। 

সিনেটর বাড়ির কুকুরগুলো ছেড়ে দিলেন এবং মেয়েকে বাড়ির শেষ প্যাটিওর শেষ রুমে আটকে রেখে ডজনখানেক বিশ্বস্ত চাকর সঙ্গে নিয়ে তাদের সেস্পেদেসকে মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হলেন। এ সময় বরাবরের মতো তিনি আক্ষেপ করছিলেন তাকে আর তার পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য তার সঙ্গে হাতে অস্ত্র তুলে নেবার মতো কোনও পুরুষ উত্তরাধিকারী নেই। নিজেকে খুব বয়স্ক অনুভব করলেন। কিন্তু এসব ভাবার এখন সময় নেই তার হাতে। কারণ তিনি দেখলেন, অন্ধকার ভেদ করে পাহাড়ের ঢাল থেকে একশ বিশটি টর্চের তীব্র আলো এগিয়ে আসছে ধীরে ধীরে, যার ফলে রাতের বেলা এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নীরবে তিনি শেষ অস্ত্রটিও বিতরণ করে ফেললেন। সবাইকে বলা হয়েছে আর তারা সবাই জানে যে প্রয়োজনে ভোরের আগে একজন বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে মারা যাবেন তিনি।

‘শেষ জীবিত ব্যক্তি চাবিটা নিয়ে আমার মেয়ে যে রুমে লুকিয়ে আছে সেখানে যাবে এবং অবশ্যই যা করার তা-ই করবে’, প্রথম গুলির শব্দ শুনে সিনেটর বললেন।

দুলসে রোসাকে সবাই জন্মের সময় থেকে দেখে এসেছে। সবে যখন সে হাঁটতে শিখেছে তখন সবাই তাকে কোলে নিয়েছে। শীত রাতের ভূতের গল্প শুনিয়েছে। পিয়ানো শেখার সময় থেকে তারা তার পিয়ানোর সুর শুনে আসছে। কার্নিভাল কুইনে ভূষিত হওয়ার দিন সবাই পাগলের মতো হাততালি দিয়েছে। তার বাবা নিশ্চিন্তে মরে যেতে পারেন, কারণ তিনি জানেন তার মেয়ে জীবন্ত অবস্থায় কখনওই তাদের সেস্পেদেস তাকে নিয়ে যেতে পারবে না। তবে একটা মাত্র বিষয় সিনেটর ওরেইয়োনো কখনওই ভাবেননি, সেটা হলো, যুদ্ধে সে বেপরোয়া হওয়া সত্ত্বেও সর্বশেষ ব্যক্তি হিসেবে তাকেই মরতে হবে। তিনি দেখলেন তার সহযোদ্ধারা একের পর এক মরে পড়ে আছে। শেষে বুঝতে পারলেন প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া বোকামি হবে। তার পেটে বুলেট বিদ্ধ। চোখ ঝাপসা। জমির উপর উঁচু দেয়ালের ছায়া তিনি প্রায়  চিনতেই পারলেন না। কোনওরকমে বাড়ির তৃতীয় প্যাটিওতে হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছাতে পারলেন। ঘামের গন্ধ, রক্ত আর কষ্টে তিনি ভারাক্রান্ত। কুকুরগুলো এসব দেখে তাকে চিনতে পারল এবং তাদের সামনে দিয়ে তাকে চলে যাওয়ার রাস্তা করে দিল। তিনি ঘরের তালাতে চাবি  ঢোকালেন। বিশাল দরোজা খোলার জন্য ধাক্কা দিলেন। ঝাপসা চোখে দেখতে পেলেন তার মেয়ে দুলসে রোসা তার জন্য অপেক্ষা করছে। মেয়েটা সেই কার্নিভাল পার্টির সিল্কের জমকালো পোশাক পরা। আর ফুলের মুকুট দিয়ে চুল স্টাইল করে সাজানো।

‘এখনই সময়, মামনি’ বন্দুকের নল তাক করে তিনি বললেন। এ সময় তার পায়ের কাছে রক্তের ছোপ ছোপ  দলা। 

‘আমাকে মেরো না, বাবা’, দৃঢ় কণ্ঠে সে বলল। ‘আমাকে বাচঁতে দাও। তোমার আর আমার জন্য প্রতিশোধ নিতে’। সিনেটর আনসেলমো ওরেইয়োনো তার পনেরো বছর বয়সী মেয়ের মুখ খেয়াল করলেন এবং ভাবলেন তার সঙ্গে তাদের সেস্পেদেস কী করতে পারে। কিন্তু দুলসে রোসার স্বচ্ছ চোখে এক দুর্দান্ত শক্তির বিচ্ছুরণ দেখলেন। বুঝতে পারলেন মেয়ে বেঁচে থেকে তার হত্যাকারীকে শাস্তি দিতে পারবে। মেয়ে তখন বিছানায় বসা। দরজার দিকে বন্দুক তাক করে তিনি মেয়ের পাশে গিয়ে বসলেন।

মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে থাকা কুকুরগুলোর শেষ ঘেউ ঘেউ থেমে গেল। কাঠের খাম্বাগুলো ভেঙ্গে পড়েছে। দরোজার সিটকিনি ভেঙ্গে গেছে। এরকম পরিস্থিতিতে ঘরে প্রথমজন ঢোকার পর সিনেটর জ্ঞান হারানোর আগ পর্যন্ত ছয় রাউন্ড গুলি চালাতে সক্ষম হলেন। জুঁই ফুলের মুকুটে সজ্জিত এক স্বর্গীয় দেবীর বাহুতে মৃত পথযাত্রী এক ব্যক্তি আর তার সাদা পোশাক ধীরে ধীরে রক্তে ভিজে যাচ্ছে―এমন দৃশ্য দেখে তাদের সেস্পেদেস ভাবল সে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু সে দ্বিতীয়বার আর সেদিকে দৃষ্টি দিতে পারল না। কারণ তখন খুনোখুনি করে সে উন্মত্ত আর কয়েক ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ করে পরিশ্রান্ত। তার লোকেরা মেয়েটার দিকে হাত বাড়ানোর আগেই সে বলল উঠল, ‘এই তরুণী আমার’।  

শুক্রবারের ভোর। আগুনের আভায় ঘোলাটে আকাশ। পাহাড়ের উপর শুনশান নীরবতা। শেষ গোঙানির শব্দ বন্ধ হয় যখন দুলসে রোসা দু পায়ে ভর করে হাঁটতে সক্ষম হয়। বাগানের ফাউন্টেনের দিকে হেঁটে যায় সে। এক দিন আগেই যা ম্যাগনেলিয়া ফুলে ঘেরা ছিল এখন তা ভাঙাচোরা ইটপাথরের মধ্যে একটা পুল। তার পোশাকের ছেঁড়া অংশ ঝুলে আছে। ধীরে ধীরে তা খুলে ফেলে নগ্ন হয়ে গেল সে। এরপর ঠান্ডা পানিতে নেমে পড়ল। ব্রিচ গাছের ভেতর দিয়ে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। দুলসে রোসা দেখল তার দু পায়ের মাঝের রক্ত আর লম্বা চুলে লেগে থাকা তার বাবার রক্তে পানি গোলাপি রঙের হয়ে গেছে। চোখের পানি আগেই শুকিয়ে গেছে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর শান্ত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়িটাতে ফেরত এল। নগ্নতা ঢাকার জন্য কিছু একটা খুঁজল।  আলমারি থেকে লিনেনের একটা কাপড় বের করল। এরপর বাবার দেহাবশেষ খোঁজার জন্য বাইরে বের হয়ে গেল। দস্যুরা তার বাবার পা বেঁধে পাহাড়ের ওপর থেকে নিচের দিকে রাস্তায় ছেঁচড়াড়ে ছেঁচড়াতে টেনে নিয়ে গেছে। ফলে তার চেহারা পুরো বিকৃত হয়ে একতাল মাংসপিণ্ডতে পরিণত হয়ে যায়। কিন্তু বাবার প্রতি ভালোবাসার কারণে মেয়ের চিনে নিতে সময় লাগেনি। সে বাবার দেহাবশেষ একটা কাপড়ে মুড়ে তার পাশে বসে থাকল দিনের আলোর অপেক্ষায়। এভাবেই সান্তা তেরেসার লোকজন তাকে দেখতে পেল যখন ওরেইয়োনো ভিলাতে তারা সাহস করে উঠল। মৃতদেহের সৎকার করতে দুলসে রোসাকে সাহায্য করল এবং শেষ কয়লার টুকরাটি পর্যন্ত আগুনে পুড়ে গেল। তাকে তার গডমাদারের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিল যিনি আরেক শহরে বাস করেন। সে শহরে তার এই ঘটনার কথা কেউ জানতে পারবে না। মেয়েটি সেখানে যেতে অস্বীকার করলে নগরবাসী বাড়িঘর ঠিকঠাক করার জন্য লোকবলের একটা দল তৈরি করল। নিরাপত্তার জন্য ছয়টা হিংস্র কুকুর দিল।

বাবাকে জীবিত অবস্থায় তার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের সেস্পেদেস দরজা বন্ধ করে চামড়ার বেল্ট খোলার মুহূর্ত থেকে দুলসে রোসা প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে। এই দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে মেয়েটির নিদ্রাহীন রাত আর দিন কেটে যেতে থাকে। তারপরও তার মুখের হাসি কিংবা বিনয়ী আচরণ ফুরিয়ে যায় না। এদিকে তার সুন্দরী খ্যাতি দিন দিন বাড়তে থাকে। শিল্পীরা গান গেয়ে রূপের গুণগান ছড়িয়ে দিতে থাকে। এভাবে তারা তাকে জীবন্ত কিংবদন্তি করে তোলে। প্রতিদিন ভোর চারটায় সে ঘুম থেকে ওঠে। ক্ষেত আর বাড়িঘরের কাজ দেখভাল করে। তার সম্পত্তির খোঁজখবর রাখে। সিরিয়ানদের মতো দরকষাকষি করে কেনাবেচা করে। হাঁসমুরগি ও গবাদি পশু পালে। ফুল বাগানে জুঁই আর ম্যাগনোলিয়া ফুলের চাষ করে। সন্ধ্যা গড়িয়ে এলে সে তার বাইরে যাওয়ার পোশাক-পরিচ্ছদ, বুট এবং পিস্তল ছেড়ে রাজধানী থেকে ভেষজের সুগন্ধ ভরা ট্রাঙ্কে করে আনা অপূর্ব গাউন পরে। রাত নেমে এলে তার কাছে আগত অতিথিরা তাকে পিয়ানো বাজাতে দেখে আর তখন চাকর-বাকরেরা ট্রেতে পেস্ট্রি আর ঠান্ডা পানির গ্লাস সাজায়। প্রথম দিকে মানুষ ভাবত কেন সে পাগল হয়ে কোনও স্যানিটরিয়ামে স্ট্রেইট জ্যাকেট পরে চিকিৎসা নেয়নি কিংবা কার্মেলাইট নানদের শিক্ষানবিশ হয়নি। যেহেতু ওরেইয়োনো ভিলাতে মাঝেমাঝেই পার্টি হতো, তাই সময় গড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ট্রাজেডির কথা এবং সিনেটরকে হত্যার কথা লোকজনের স্মৃতি থেকে ক্রমে মুছে গেল। দুলসে রোসার সৌন্দর্যের খ্যাতি  আর সংবেদনশীল হৃদয় দেখে ধর্ষণের কলঙ্ক ভুলে বেশ কয়েকজন অবস্থাপন্ন সুপাত্র বিয়ের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সে প্রত্যেককে এক এক করে ফিরিয়ে দেয়। কারণ এই দুনিয়ায় তার একমাত্র লক্ষ্য―প্রতিশোধ নেওয়া। 

অন্যদিকে তাদের সেস্পেদেস সেই দুঃসহ রাতের স্মৃতি ভুলতে পারেনি। হত্যাযজ্ঞে বয়ে যাওয়া ঢেউ এবং ধর্ষণের উচ্ছ্বাস উবে গেল যখন রাজধানীতে ফেরার পথে সে হিসাব কষছিল কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ সে তার শত্রুর বিরুদ্ধে চালিয়েছে। এরপর তার বলগাউন আর সুগন্ধি জুঁই ফুলের মুকুট পরা মেয়েটার কথা মনে এল যে বারুদের গন্ধে ভরা অন্ধকার রুমে নীরবে সব সহ্য করেছিল। মেয়েটিকে যেভাবে ফেলে এসেছিল সেটা সে আবার চিন্তা করে―রক্তাক্ত ছেঁড়া কাপড়ে হাত পা ছড়িয়ে অর্ধনগ্ন হয়ে পড়েছিল মেঝেতে। শেষে অজ্ঞান হয়ে অসহায় ঘুমে ঢলে পড়েছিল। তাদের সেস্পেদেস ঘুমোতে গেলেই এই দৃশ্য তাকে সারাজীবন তাড়া করে এসেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠা, সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণ এবং ক্ষমতা চর্চায় সেস্পেদেস একজন পরিশ্রমী এবং শান্তিবাদী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গৃহযুদ্ধের স্মৃতি ধূসর হতে থাকে। মানুষজন তাকে শ্রদ্ধাভরে ডন ডাকা শুরু করে। পাহাড়ের অপর প্রান্তে সে একটা খামারবাড়ি কিনেছে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছে। এক সময় সে মেয়র নির্বাচিত হয়। যদি দুলসে রোসা ওরেইয়োনোর নিরবচ্ছিন্ন ভূত তার ওপর ভর না করত তাহলে হয়তো সে শান্তিতে বাস করতে পারত। কিন্তু সান্ত¦না পাওয়ার জন্য জীবনে সে যত নারীর সংস্পর্শে এসেছে―বছরের পর বছর যে ভালোবাসা পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়েছে সেখানেই কার্নিভাল কুইনের চেহারা ভেসে উঠেছে। এই যন্ত্রণার সঙ্গে যুক্ত হয়―মাঝেমধ্যেই সে মেয়েটির নাম শুনতে পায় বিভিন্ন কবির কবিতায়। যার ফলে হৃদয় থেকে সেই নাম মুছে ফেলা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তরুণীর ইমেজ তার মনে গড়ে উঠতে থাকে―তাকে পুরোপুরি দখল করে নেয়। এটা সে আর সহ্য করতে পারে না। একদিন একটা লম্বা বাঙ্কুইট টেবিলে মধ্যমণি হিসেবে তার সাতান্নতম জন্মদিন পালন উপলক্ষে বসা ছিল সে। বন্ধু ও সহকর্মীরা তাকে ঘিরে ছিল। সে সময় কল্পনায় একজন নগ্ন মেয়েকে জুঁই ফুলের মাঝে টেবিলক্লথের ওপর শুয়ে থাকতে দেখল। তখন সে বুঝতে পারল এই দুঃস্বপ্ন তাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। এমনকি মৃত্যুর পরও তার পিছু ছাড়বে না। সে টেবিলের ওপর একটা ঘুষি মারল। এতে টেবিলে থাকা ক্রোকারিজগুলো কেঁপে উঠল। লোকজনকে তার হ্যাট এবং ছড়ি এগিয়ে দিতে আদেশ করল।

‘কোথায় যাচ্ছেন ডন তাদের ?’ প্রিফেক্ট জিজ্ঞাসা করলেন।

‘পুরাতন এক ক্ষত সারাতে যাচ্ছি’ এই বলে কাউকে বিদায় না জানিয়ে সে বের হয়ে গেল।

দুলসে রোসাকে খুঁজতে হয়নি তার। কারণ সে সব সময় জানত মেয়েটার জীবনে যে বাড়িতে দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল সেখানেই তাকে পাওয়া যাবে। সেদিকেই সে গাড়ি চালাতে লাগল। ইতোমধ্যে সারা দেশে ভালো মানের হাইওয়ে নির্মিত হয়েছে, তাই দূরত্ব অনেক কমে গেছে বলে মনে হলো। গত পঁচিশ বছরে ল্যান্ডস্কেপেরও বেশ পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু যখন সে পাহাড়ের শেষ প্রান্ত অতিক্রম করল, ওরেইয়োনো ভিলাটি তার নজরে এল। তার সৈন্যরা পাহাড়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল সেসব কথা মনে পড়ল তার। সেখানে নদী থেকে আনা পাথরের শক্ত দেয়াল ছিল যা সে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। ছিল কালো কাঠের বিম যা আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। অনেক গাছ ছিল যেখানে সে সিনেটরের লোকজনকে হতাহত করেছিল। খোলা প্রান্তর ছিল যেখানে সে কুকুরগুলোকে জবাই করেছিল। দরোজা থেকে একশ মিটার দূরে সে গাড়ি থামাল। আর সামনে এগুতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল তার বুকে হৃৎপিণ্ডের বিস্ফোরণ ঘটবে। যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফেরত যাওয়ার জন্য সে প্রায় উদ্যত হচ্ছিল এমন সময় গোলাপের ঝোঁপের মাঝে একটা স্কার্টের নড়াচড়া দেখতে পেল। সে কাঁপতে লাগল―সকল শক্তি দিয়ে ভাবতে লাগলো যেন সে তাকে চিনতে না পারে। সে দেখল বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় দুলসে রোসা ওরেইয়োনো বাগানের পথ ধরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার চুল, তার উজ্জ্বল চেহারা, ছন্দোময় চলা, ঢেউ খেলানো পোশাক নজরে এল। তার মনে হলো সে যেন পঁচিশ বছর ধরে যে স্বপ্ন দেখা স্থগিত করে রেখেছিল এবার তা তার সামনে তা উন্মোচিত হয়ে গেল।

‘অবশেষে এলেন, তাদের সেস্পেদেস’, তাকে দেখে সে বলল। তার কালো মেয়র স্যুট কিংবা একজন ভদ্রলোকের ধূসর চুল তাকে ধোঁকা দিতে পারেনি; তার দস্যুহাতের আজও কোনও পরিবর্তন হয়নি।

‘নিরন্তর তুমি আমাকে তাড়া করে চলেছো। আমার সারাটা জীবনে আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারিনি।’ সে লজ্জাবনত হয়ে কথাগুলি ভাঙ্গা কণ্ঠে উচ্চারণ করল।

দুলসে রোসা ওরেইয়ানো পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বছরের পর বছর সে তাকে রাত দিন প্রত্যাশা করেছে মনে মনে। অবশেষে লোকটি তার কাছে এসেছে। এখন তার সময় এসেছে। তার চোখের দিকে তাকালো কিন্তু ঘাতকের লেশমাত্র তার ভেতরে দেখতে পেল না। কেবল অশ্রু দেখতে পেল। তার মনের গভীরে পুষে রাখা এতদিনের ঘৃণা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু কোনওভাবেই তার খোঁজ পেল না। সেই দিনের কথা মনে করার চেষ্টা করল যেদিন ভবিষ্যতে একটা কর্তব্য পালনের সুযোগ দেওয়ার জন্য তাকে জীবিত রাখতে পিতাকে অনুরোধ সে করেছিল। তার মনে পড়ে গেল সেদিন সেই ভয়ঙ্কর আলিঙ্গন যার জন্য সে এই ব্যক্তিকে প্রায়শই অভিশাপ দিত। আর তার কারণে পরের দিন ভোরে তার বাবার অসহায় দেহাবশেষ লিনেনের কাপড়ে সে মুড়েছিল। মেয়েটি এতদিন ধরে ভেবে রাখা প্রতিশোধের নিখুঁত পরিকল্পনা পর্যালোচনা করল, কিন্তু তাতে কোনও আনন্দ অনুভব করল না। উল্টো সে গভীর দুঃখ অনুভব করে মনে। তাদের সেস্পেদেস মেয়েটির হাত ধরে এবং তালুতে আলতো করে চুমু খায়―আর চুম্বন ভিজে গেল চোখের জলে। আর মেয়েটি আতঙ্কিত হয়ে অনুভব করল, লোকটিকে নিয়ে এতদিনের চিন্তার ফলে তার অনুভূতির বৃত্ত পূর্ণ হয়ে তাকে শাস্তি দেওয়ার বদলে বরং ভালোবেসে ফেলেছে তাকে সে।

এর পরের দিনগুলোতে তারা দু জন অবদমিত ভালোবাসার বাঁধ, যা তারা এতদিন অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, তা উন্মুক্ত করে দিল। প্রথমবারের মতো তাদের দুর্ভাগ্যময় জীবনে একে অপরের কাছাকাছি এল। তারা বাগানে ঘুরে বেড়াল। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে লাগল সেই দুঃসহ রাতের কথা না এড়িয়ে যা তাদের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। সন্ধ্যায় হয়তো দুলসে রোসা পিয়ানো বাজায় তখন তাদের সেস্পেদেস ধূমপান করে। যখন পিয়ানো শোনে তখন সে মনে মনে ভাবতে থাকে তার বয়স হয়ে গেছে। তবু কম্বলের মতো তার সুখেরা খুলে যেতে থাকে। ভুলে যায় আগের সমস্ত দুঃস্বপ্নের কথা। রাতের খাবার সেরে গাড়ি চালিয়ে সে সান্তা তেরেসা থেকে ফেরত যায় যেখানে আর কারও সেই দুঃসহ ঘটনার কথা মনে নেই। শহরের সবচেয়ে বড় হোটেলে রুম ভাড়া করে সে। সেখানে তাদের বিয়ের পরিকল্পনা করে। সম্ভাব্য সকল প্রকার জাঁকজমক, আড়ম্বরপূর্ণ আর আনন্দঘন করে বিয়ের অনুষ্ঠানটির আয়োজন করতে চায় যেখানে শহরের সকল মানুষ অংশগ্রহণ করবে। যে বয়সে মানুষ জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে সেই বয়সে ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে সে। ফলে তার যৌবনের উদ্দীপনা ফিরে এসেছে আবার। ভালোবাসা আর সৌন্দর্য ঘিরে সে দুলসে রোসার সঙ্গে থাকতে চায়। অর্থ দিয়ে যত বৈভব আনা যায় তা সে দুলসে রোসার জন্য কিনতে চায়। একটা তরুণীর যে ক্ষতি সে করেছিল একদিন, মেয়েটার বাকি জীবনে তা পরিশোধ করে দিতে চায়। মাঝে মাঝে যদিও সে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মেয়েটির মুখে সে বিদ্বেষের চিহ্ন খোঁজে, কিন্তু সেখানে কেবল পারস্পরিক ভালোবাসা দেখতে পায়। এতে সে আশ্বস্ত হয়। 

বিয়ের অনুষ্ঠানের দুই দিন আগে, বাগানে যখন বিয়ের পার্টির জন্য টেবিল সাজানো হচ্ছিল, ভোজনের জন্য শূকর আর হাঁসমুরগি জবাই করা হচ্ছিল এবং বাড়ি সাজানোর জন্য ফুল কাটা হচ্ছিল, তখন দুলসে রোসা তার বিয়ের পোশাক পরে ট্রায়াল দিচ্ছিল। আয়নায় সে নিজেকে দেখে―অবিকল কুইন কার্নিভালের সেই দিনটার মতো লাগছিল তাকে। নিজেকে আর সে প্রতারিত করতে চায় না। বুঝে গেছে যে সে আর তার পরিকল্পনামতো প্রতিশোধ নিতে পারবে না, কারণ সে এখন হত্যাকারীর প্রেমে পড়েছে। কিন্তু এরপরও সে সিনেটরের আত্মাকে স্তব্ধ করতে পারছে না। সে মেয়েদর্জিকে ঘর থেকে বের করে দিল। কাঁচি হাতে নিয়ে বাড়ির তৃতীয় প্যাটিওতে অনেক দিনের পরিত্যক্ত একটা ঘরে ঢুকল।

তাদের সেস্পেদেস তার প্রেমিকাকে বাড়ির সবখানে খুঁজে বেড়াতে থাকে। মরিয়া হয়ে ওর নাম ধরে ডাকতে আরম্ভ করে। তার ডাকের প্রত্যুত্তরে কুকুরের ডাক শুনে বাড়ির অন্য প্রান্তে গেল সে। আর বাগানের মালিদের সাহায্যে তালাবদ্ধ দরজাটি ভেঙ্গে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম হলো যেখানে সে জুঁই ফুলের মুকুট পরা এক স্বর্গীয় দেবীকে দেখেছিল। সেখানে সে দুলসে রোসা ওরেইয়ানোকে দেখতে পেল, যাকে সে তার জীবনে প্রতিটি রাতের স্বপ্নে দেখে এসেছে এতদিন। সেই একই রক্তাক্ত রেশমের পোশাক পরা নারী। তাদের সেস্পেদেস জানে, সে হয়তো নব্বই বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকবে তার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য, একমাত্র নারী যে তার হৃদয় ছুঁতে পেরেছিল, তার স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে।  

Margaret Sayers Peden কর্তৃক এবং  Penguin থেকে প্রকাশিত আরেকটি ইংরেজি ভার্সন থেকে অনূদিত। ফলে কোনও ভার্সনের সঙ্গে অনুবাদে হুবহু মিল পাওয়া যাবে না।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button