আমার দেখা নয়াচীন : আব্দুল্লাহ আল হাদী

উন্নত মানবের মন সে জন্মগ্রহণ করেই জীবনের সন্ধান করে, যে জীবনে তাঁর জন্য রাখা থাকবে মুক্তির স্বাধীনতা, মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদার সৌহার্দ, মানবতার অনুভূতি।
প্রথম পড়াতে, বইটি পড়েই মনে হয়েছে আমাদের দেশের মানুষের দেশপ্রেমের অনেক অভাব, যেমন অভাব রয়েছে অনেক বোঝাপড়ার।
প্রত্যেকজন পিতা-মাতা তার সন্তান জন্মদানের পর স্বপ্ন দেখেন আমার সন্তান যেন স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে মানুষ হয়ে উঠতে পারে, হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীর মানুষ।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জাতির জন্য প্রথম থেকেই বারবার খুঁজে দেখতে চেয়েছেন এমন কোনো প্রণালি যেখানে মানবতা আর মর্যাদা একই জীবনে সমান্তরাল দৈর্ঘ্য ছুঁয়ে যায়। ছুঁয়ে যায় ভাটিয়ালি বাঁশির সুর মেহনতি মানুষের প্রশান্তি হয়ে। ব্রহ্মপুত্র-মাতামুহুরি-ধলেশ্বরী- মধুমতী-রূপসা নদীর ঢেউ মানুষকে জীবন দিয়ে তারা যেভাবে বৃহৎ বঙ্গোপসাগর চিনে নিয়েছে, চিনে নিয়েছে মহাসমুদ্র।
তরুণ জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের অক্টোবর মাসে পিস কনফারেন্স অব দি এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক রিজিওন্স-এ পাকিস্তান প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নয়াচীন সফর করেন। সেই সময়ের স্মৃতিনির্ভর এ ভ্রমণকাহিনী ১৯৫৪ সালে কারাগারে রাজবন্দি থাকাকালে তিনি রচনা করেন।
সে সময় তাঁর সাথে প্রতিনিধিদলে অনেকেই ছিল এবং তাঁদের সাথে থাকা অনেকেই অনেক কিছুই দেখেছিলেন কিন্তু বঙ্গবন্ধু দেখেছিলেন এমন কিছু যার বর্ণনা তাঁকে জাতি-রাষ্ট্র বিনির্মাণের কবি হিসেবে উপস্থাপন করে। উপস্থাপন করে নতুন কোনো উৎসাহের, যা মানুষকে কল্যাণের দিকে নতুন হয়ে উঠতে সাহায্য করে প্রাণবন্তভাবে।
খুব অল্প বয়সেই কবি সুকান্ত হয়তো পৃথিবীর ভালো কবিতাগুলো লিখে ফেলেছিলেন, অল্প বয়সেই জেন অস্টিন হয়তো তার ভালো উপন্যাসটি লিখে ফেলেছিলেন, তরুণ বয়সেই হয়তো জোয়ান অব আর্ক ঈশ্বরের নাম জেনেছিলেন,
তরুণ বয়সেই হয়তো যীশু পৃথিবীর সত্য জেনে গিয়েছিলেন, তরুণ বয়সেই হয়তো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রাঞ্জল জাতি গঠনের তৃষিত ন্যায্য দৃষ্টি পেয়েছিলেন।
গ্রন্থের আরম্ভের শুরুটা দেখেই তাঁর সেই দৃষ্টির যেমন অনুমান করে নেওয়া যায়, তিনি লিখছেন :
‘১৯৫২ সালে জেল থেকে বের হলাম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর। জেলে থাকতে ভাবতাম আর মাঝে মাঝে মওলানা ভাসানী সাহেবও বলতেন, “যদি সুযোগ পাও একবার চীন দেশে যেও।” অল্পদিনের মধ্যে তারা কত উন্নতি করেছে। চীন দেশের খবর আমাদের দেশে বেশি আসে না এবং আসতে দেওয়াও হয় না। তবুও যতটুকু পেতাম তাতেই মনে হতো যদি দেখতে পেতাম কেমন করে তারা দেশকে গড়েছে!’
বঙ্গবন্ধু নয়াচীন ভ্রমণে যাচ্ছেন কম্যুনিস্ট চীনের বয়স তখন মাত্র তিন বছর। বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখার শুরুতে নিজেকে নিজে প্রথমেই বলছেন এভাবে :
‘অনেকে বলতে পারেন কম্যুনিস্টদের শান্তি সম্মেলনে আপনারা যোগদান করবেন কেন? আপনারা তো কম্যুনিস্ট না। কথাটা সত্য যে আমরা কম্যুনিস্ট না। তথাপি দুনিয়ার আজ যারাই শান্তি চায় তাদের শান্তি সম্মেলনে আমরা যোগদান করতে রাজি।’
পাঁচজনের একটি প্রতিনিধিদল (আতাউর রহমান খান, তফাজ্জল হোসেন, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, ইউসুফ হাসান আর লেখক নিজে) যাবেন নয়াচীনে, সকলেই পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করেছেন শুধু বঙ্গবন্ধুর দরখাস্ত করা হয় নাই এবং তিনি অনিশ্চিত তাঁকে সরকার পাসপোর্ট দিবে কিনাÑ কেননা সরকার তাঁকে সন্দেহ করে, যদি পাছে তিনি কোথাও সভা করে সরকারের অভ্যন্তরীণ জুলুমের কথা প্রকাশ করে দেন, তবুও শেষ পর্যন্ত তৎকালীন আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ইয়ার মোহাম্মদ খানের পরামর্শে দরখাস্ত করলেন। কিন্তু পাসপোর্ট অফিসে তাঁর দরখাস্ত পৌঁছায় নাই। তিনি পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে পেলেন শুকুর সাহেব নামক এক কর্মচারীর, এবং শুকুর সাহেবের দক্ষতা ও আন্তরিকতা দেখে বঙ্গবন্ধু তাঁর নোটে লিখছেন এভাবে :
‘তাঁর মতো কর্মচারী হলে দেশের উন্নতি হতে বাধ্য।’
অর্থাৎ বন্ধবন্ধু খুঁজছেন দেশ গঠনের উপায়, আর দেখে দেখে তুলনা করে নিচ্ছেন উৎকৃষ্ট উন্নতির উপাদান। এবং তাঁর এ উৎকৃষ্টতার সন্ধান আমরা আরও দেখি তাঁদের দল যখন চীনের পথে রেঙ্গুনে যাত্রাবিরতিকালে সেখানকার পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের বাসায় যান, সেখানে রাষ্ট্রদূতের জাঁকজমকপূর্ণ জীবন দেখে তিনি মন্তব্য করছেন এভাবে- ‘দেখে মনে হলো, যাদের টাকা দিয়ে এত জাঁকজমক তাদের অবস্থা চিন্তা করলেই ভালো হতো ।’ অর্থাৎ তিনি সাধারণ জনগণের অবস্থা নিয়ে ভাবছেন।
এভাবে এ ভ্রমণের যতদূর আগানো যায় দেখা যায় তিনি সকল ক্ষেত্রেই উৎকৃষ্ট অন্বেষণে নিবেদিত পর্যবেক্ষক হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রতিটি ভ্রমণ স্থানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে প্রকৃতির সবুজ, ধর্ম থেকে মানবের ধর্ম, অবুঝ মানবের মনের অন্তর্নিহিত কারণ, ইতিহাস থেকে ঐতিহাসিক সত্যতা। এবং তাঁর সাথে সফরসঙ্গী প্রতিজন ব্যক্তির খুঁটিনাটি মিত্রতাও।
এরপর রেঙ্গুন থেকে তাঁরা গেলেন ব্যাংককে, তার আগে বঙ্গবন্ধু রেঙ্গুনের গৃহযুদ্ধ প্রসঙ্গে বিশ্লেষণ করে সেখানকার বিপ্লবের ব্যর্থতার কারণ খুঁজে দেখলেন। এবং তিনি তাদের এ বিপ্লব প্রসঙ্গে বললেন এভাবে :
‘কম্যুনিস্ট ও কারেন সম্প্রদায়ের লোকেরা যুদ্ধ করছে সরকারের বিরুদ্ধে, দেশকে নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য। উ ন্যু সরকারও তাদের সাথে ভীষণ যুদ্ধ চালাচ্ছে; কিন্তু ৫/৬ বৎসরেও বিদ্রোহীদের দমন করতে পারছে না। তার প্রধান কারণ এটা একটি জঙ্গলময় দেশ। বিরাট বিরাট বন, পাহাড়; নদীর সংখ্যাও খুব বেশি। কখনও বিদ্রোহীরা সম্মুখযুদ্ধে আসে না। গেরিলারা যুদ্ধ চালায়। হঠাৎ আক্রমণ করে গভীর বনে পালিয়ে যায়। কার সাধ্য তাদের খুঁজে পায়! তবে বিদ্রোহীরা কিছু করতে পারছে না। এর কারণ কী? কারণ জনগণের সমর্থন ছাড়া বিপ্লব হয় না।’
এরপর ব্যাংকক থেকে তাঁদের হংকংয়ে যাত্রা। যাত্রাপথের বর্ণনা, সেখানে তাঁদের পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের নেতৃবৃন্দের সাথে মিলিত হয়ে হংকং দেখতে বেরিয়ে পড়া এবং সেখানকার নানা সামাজিক বর্ণনা, হংকংয়ে ব্যবসারত সিন্ধু প্রদেশের হিন্দুদের দেশে ফেরার আকুতি, সেখানকার মানুষদের নানা জিজ্ঞাসা, নয়াচীন সম্পর্কে সেখানকার মানুষের নানা সতর্ক বার্তা এবং সে সকল মানুষের চীন বিরোধী মনোভাবাপন্ন হয়ে ওঠার পেছনের কারণও তিনি খুঁজে বর্ণনা করেছেন স্বল্পভাষায় অথচ বিস্তর অর্থসহ। সেখানকার তাদের একজন বঙ্গবন্ধু মুজিবকে জিজ্ঞেস করল- ‘আপনি কম্যুনিস্ট? জবাবে বঙ্গবন্ধু বলছেন এভাবে :
‘বললাম না। আমাদের স্বতন্ত্র দল আছে, ম্যানিফেস্টো আছে।’
বঙ্গবন্ধু আরও বললেন :
‘আইন করে কারও কণ্ঠরোধ করার উদ্দেশ্য আমাদের দলের নাই। আমরা দেশের সম্পদ এবং ন্যায়ভিত্তিক আদর্শ নিয়ে দেশ গড়তে চাই। ভাড়া করে কোনো আদর্শ আমরা গ্রহণ করতে প্রস্তুত নই। আবার মিছামিছি কোনো আদর্শকে লোকের চোখে হেয় করতেও চাই না। মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতায় আমরা বিশ্বাস করি।’
অচেনা লোকটি আরও নানা প্রশ্ন করলেন বঙ্গবন্ধু সেগুলোকে লিখছেন এভাবে-
‘সে অনেক কিছু জানতে চাইল, যতটুকু উত্তর দেওয়া যায় দিলাম। যেখানে দেওয়া যায় না, হ্যাঁ, না বলেই শেষ করে দেই। কারণ দেশের ভিতরে আমাদের সরকারের অন্যায়-অত্যাচার সম্বন্ধে বললেও বিদেশে বলার পক্ষপাতী আমরা নই।’
এবং পুরো ভ্রমণের শেষ পর্যন্ত আমরা দেখি বঙ্গবন্ধু কোথাও নিজের দেশের শত অত্যাচারের কথা তিনি দাঁতের ফাঁক হতে দেননি।
অচেনা লোকটি একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধুকে বলছেন, সতর্ক থাকবেন ওরা আপনাদের মোহিত করে ফেলবে, তার প্রতিউত্তরে বঙ্গবন্ধু মনে মনে বলছেন এভাবে :
‘আমি ভাবলাম, লোকটা অন্ধ। আমরা রাজনীতি করি, আমাদের লোভ মোহ দিয়া ভুলানো সোজা না। তাহলে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগওয়ালারা তা পারতো।’
হংকং থেকে চীনে ঢোকার আগ দিয়ে বঙ্গবন্ধু আরও কতগুলো বিষয় নজরে আনলেন যেমন সেখানকার জিনিসপত্রের মূল্যমান এবং তা তাঁর নিজের দেশের তুলনায় কত সস্তা কিংবা কোনটা কোনটা সমান্তরাল, পাশাপাশি তিনি আরও নজরে আনলেন, এক জাতি থেকে আর এক জাতি কেমন, ইংরেজ জাতির বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নানা বিষয় তিনি তুলে ধরেছেন সংক্ষেপে কিন্তু নিরেট প্রতিচ্ছবির মতো।
এরপর চীনের সীমান্ত পার হয়ে তাঁরা ঢুকলেন চীনে, প্রথম গেলেন ক্যান্টন এবং এ সময়ে অতিবাহিত দৃশ্যচারিত, বইয়ের দোকান, ক্যান্টন শহরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, মানিক ভাইয়ের সাথে খাবার নিয়ে রসিকতা, ট্রেনের কামরার বর্ণনা, ট্রেনের নরম ক্লাস- শক্ত ক্লাস, ব্যবস্থাপনা, জনসাধারণের বিনা টিকিটে ভ্রমণ না করা অভ্যাস, এবং এর পিছনের কারণ ইত্যাদি ইত্যাদির বর্ণনা দিতে দিতে তিনি ট্রেনের বাহিরের দিকে তাকালেন এবং তিনি ব্যক্ত হলেন এভাবে :
‘আমি বাইরের দিকে চেয়ে দেশটাকে ভালো করে দেখতে লাগলাম। মনে হলো এ তো আমার পূর্ব বাংলার মতো সকল কিছু।’
সন্ধ্যায় ক্যান্টনে পৌঁছার পর সেখানে বাচ্চাদের অভ্যর্থনা লাইন, তাঁদের স্লোগানের ভাষা, রাতের খাওয়া, মুসলিম-অমুসলিমদের খাদ্য তালিকা কোনো কিছুই বাদ দেননি তিনি, তবে খুবই পরিমিতি বোধসহ বর্ণনা করেছেন। এরপর তিনি একজন ছাত্রের কাছে জানতে চাইলেন, চীন বিপ্লবের সময়ে ঘটে যাওয়া সেখানকার অবস্থাটুকু কেমন ছিল, কি পরিমাণ ক্ষয়-ক্ষতি ঘটেছিল, প্রাণহানি ছিল কোন পর্যায় পর্যন্ত, ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি মিটিয়ে নিচ্ছিলেন বোধ হয় নিজের মনের মধ্যকার একটি প্রস্তুতি। পরদিন পিকিং পৌঁছানো পর্যন্ত যা যা দেখেছেন সবই তিনি তুলে ধরেছেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাক্যে কিন্তু বড় ভাবাবেগে।
তারপর এরোড্রামে করে পিকিং হোটেলে পৌঁছা পর্যন্ত পিকিং শহরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, পিকিং হোটেলে খাবার ব্যবস্থা, ভারতীয় মনোজ বসুর সাথে পরিচয়, শান্তি সম্মেলন শুরু হওয়া, রাজনীতিতে সান ইয়াৎ-সেনের সামনের সারিতে থাকার কারণ। ৩৬৭ জন ডেলিগেট Ñ৩৭টি দেশের পর্যবেক্ষক তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত আপ্যায়ন, এবং তাঁদের জন্য ৭০ দিনে একটি বিরাট ভবন মেরামত এবং তা কীভাবে সম্ভব সবই তিনি জানতে চেষ্টা করেছেন অনবরত উৎসাহ নিয়ে, বুঝে দেখতে চেয়েছেন তাঁদের বক্তৃতার বিষয়-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা কীভাবে হওয়া উচিত, কোরিয়া যুদ্ধে জীবাণু অস্ত্রের ভয়াবহতা, সকলে কেন শান্তি চাই, বা কীভাবে চাই সে সকল বিষয়ে ডিবেট, ভারতের কাশ্মীর দখল এবং উদ্বিগ্নতা এবং এ বিষয়ে আলোচনায় ভারতীয় ডেলিগেটদের শৈথিল্য তবুও গণভোট প্রস্তাব সামনে আনা, তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের কবিতা পাঠ, ইরান- ইন্দোনেশিয়া-ব্রহ্মদেশ-সিংহল-থাইল্যান্ড- ইন্দোচীন-অস্ট্রেলিয়া-নিউজল্যান্ড-ফিলিপাইন -আমেরিকা-দক্ষিণ আমেরিকা- কানাডা- জাপানসহ সকলের শান্তির পক্ষে উপস্থাপিত মতামত, রাতে থিয়েটার গান ও নৃত্য অনুষ্ঠানের বর্ণনা, ভারতীয়দের উপহার তালিকায় আব্বাসউদ্দিনের গানের রেকর্ড স্থান পাওয়া, এবং তাঁর নিজের বাংলায় বক্তৃতা করার কারণ ইত্যাদি নানা বিষয়। বাংলা ভাষায় বক্তৃতার বিষয়ে তিনি বিধৃত করেছেন এভাবে :
‘আমাদের সভা চললো, বক্তৃতা আর শেষ হয় না। এত বক্তৃতা দেওয়ার একটা কারণ ছিল। প্রত্যেক দিন সভায় যে আলোচনা হয় এবং যারা বক্তৃতা করেন তাদের ফটো দিয়ে বুলেটিন বাহির হয়। এই লোভটা অনেকেই সংবরণ করতে পারেন নাই।
‘আর আমার বক্তৃতা দেওয়া ছিল এই জন্য যে, বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিব।’
এরকমভাবে কনফারেন্স যখন চলছিল, এরইমধ্যে মাঝে মাঝে তাঁরা সেখানকার বিখ্যাত জায়গা, বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি স্কুল, মসজিদ, শ্রমিকদের অবস্থা দেখতে যেতেন। ওখানকার রিকশাওয়ালাদের দেশপ্রেম যাচাই, ট্রেড ইউনিয়ন ব্যবস্থা, ওখানে থাকা বাঙালি পরিবারগুলো কেমন আছে তাও তিনি জেনে দেখতে চেয়েছেন।
জেনে দেখতে চেয়েছেন চীনের মানুষের দেশপ্রেম; ভয়ে, না স্বপ্রণোদিত? কিংবা তাদের নতুন সিস্টেমের পরিধি কত দূর পর্যন্ত সবল? শ্রমিকদের বাসস্থানের কামরাগুলো কেমন? ধর্মীয় স্বাধীনতা গ্রামের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত কীভাবে কাজ করে? জিনিসপত্রের দামের সাথে আয়ের সঙ্গতি তাদের সন্তুষ্টির কতদূর পর্যন্ত।
পিকিং, তিয়ানজিং, নানকিং, ক্যান্টন, হ্যাংচো প্রায় সকল শহরে তিনি দেখতে চেয়েছেন নতুন স্বাধীনতার সাথে তারা কতদূর পর্যন্ত সন্তুষ্ট, এবং কীভাবে, এবং কেন? সম্পূর্ণ দেশি পণ্যে বাজার ঠাসা কীভাবে সম্ভব হলো, কীভাবে সম্ভব হলো এই দেশপ্রেমের গাঁথুনি বুনে দেওয়া, কেননা তিনি দেখলেন সেখানে ক্রেতারাই বিদেশি পণ্য কেনে না। বঙ্গবন্ধু এক দোকানিকে জিজ্ঞেস করলেন আপনাদের এই বেরসিকতার কারণ কী? আপনারা বিদেশি পণ্য কেন আনেন না, রাশিয়া এ সমস্ত জিনিস আপনাদের দেয় না?
দোকানদার উত্তর দিলো এভাবে :
‘দেখুন চিয়াং কাইশেকের আমলে আমেরিকানরা এসব বহু দিত। সেগুলো কেবল শেষ হয়ে গেছে। রাশিয়ায় শুনেছি এগুলো বেশি হয় না, তাই আমরা শিল্প গড়তে যে কলকব্জা দরকার তাই আনি। রাশিয়া কাউকেও এই সমস্ত জিনিস দেয় না। আর দিলেও আমরা আনি না। আমাদের দেশ আমরা গড়বো, যারা শিল্প গড়তে সাহায্য করবে তারাই আমাদের বন্ধু।’
বঙ্গবন্ধু মনে মনে বললেনÑ ‘বাবা সবাই রাজনীতিবিদ!’
এরপর তিনি (বঙ্গবন্ধু) মাও সে তুং এর সাথে এক ভোজসভার বর্ণনা দিতে গিয়ে মাও সে তুং এর দীর্ঘ ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবন মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ৬০ কোটি মানুষের স্বাধীনতার নেতা হিসেবে তিনি তাকে দেখছেন। সেখানে মসজিদের ধর্মীয় নেতাদের উপস্থিতি, তাও তাঁর চোখ এড়ায়নি। মাও এর বিষয়ে বঙ্গবন্ধু লিখছেন এভাবে :
‘এই মাও সে তুং! ৬০ কোটি লোকের নেতা। দেশের লোক এত ভালোবাসে এঁকে! হবেই তো, ত্যাগী, দেশকে ও জনগণকে তিনি ভালোবাসেন বলে জনগণও তাঁকে ভালোবাসে ও বিশ্বাস করে।’
এরপর ১লা অক্টোবর চীনের স্বাধীনতা দিবস পালনের বর্ণনা, পরের দিন হাসপাতাল দেখতে যাওয়ার বর্ণনা, বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে দেখার উপলব্ধি- মাত্র ৪ বছরে তারা কীভাবে শতকরা ৩০ জন লোককে শিক্ষিত করে ফেলেছেন। শিশুদের প্রিভিলেজড ক্লাসের মর্যাদা কীভাবে তাদের অন্যান্য দেশ থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য এনে দিয়েছে তাও তিনি দেখেছেন ভবিষ্যৎ নিয়ে। বঙ্গবন্ধু এই সকল প্রিভিলেজড শিশুদের নিয়ে লিখছেন এভাবে :
‘নতুন মানুষের একটা জাত গড়ে তুলেছে নয়াচীন। ১৫/২০ বৎসর পরে এরা যখন লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়ে দেশের জন্য কাজ করবে তখন ভেবে দেখুন নয়াচীন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?’
সেখানে তিনি এক শিক্ষকের কাছ থেকে আবারও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনলেন কী করে পিকিং শহর কম্যুনিস্টরা দখল করল, এবং সেই সময়ের বর্ণনা। আমেরিকানদের জীবাণু অস্ত্র বিস্ফোরণের একটি বীভৎস স্থান পরিদর্শনের বর্ণনা, তারপর বিষণ্ন মনে তাঁদের পিকিং ছাড়ার প্রস্তুতি।
পরের দিন তিয়ানজিং শিল্প শহরে পৌঁছাবার আগে তিয়ানজিং শহর উত্থানের কাহিনি, শহরের জীবন ব্যবস্থাপনা, হাসপাতাল, শিল্পকারখানা, আবহাওয়া, ইত্যাদির মধ্যে তিনি বারবার দেখতে চেয়েছেন কতটুকু সম্ভাবনা তিনি এখান থেকে নিয়ে যেতে পারেন।
তার পরের দিন নানকিংয়ে সান ইয়াৎ-সেনের কবর পরিদর্শন এবং সে শহরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, প্রকৃতির মহিমান্বিত রূপ, সেখানকার কৃষি ফার্ম গঠন প্রণালি মনোযোগ দিয়ে বোঝা। এখানে বঙ্গবন্ধু তাঁর লেখায় উল্লেখ করছেন এভাবে :
‘আমার কিন্তু পুরোনো আমলের ভাঙা বাড়ি দেখার ইচ্ছা ছিল না । কারণ আমি দেখতে চাই কৃষির উন্নতি, শিল্পের উন্নতি, শিক্ষার উন্নতি, সাধারণ মানুষের উন্নতি ।’
আসলেই তো তাই, তিনি তো খুঁজে দেখতে গিয়েছেন জীবন। এবং এখানে নানকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সময় পার করে বিদায় নেওয়ার সময় শিশুদের সাথে তিনি যেভাবে মজে উঠেছিলেন তাও তিনি বাদ দেননি অনুভূতিসহ ব্যাখ্যা করতে। এবং শিশুদের জন্য তাঁর যে ভালোবাসা পাঠক অনায়েসে এইখানটাই অন্তত বুঝে নিতে পারবে।
এর পরের দিন সাংহাইতে কাপড়ের কল পরিদর্শন। সেখানে পরিদর্শনের সময় তিনি শ্রমিকদের সন্তুষ্টির চেহারাগুলোও যাচাই করে দেখতে চাইলেন, লক্ষ করলেন মেয়ে শ্রমিকরা যখন কাজে যায় তখন তাদের ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করার জন্য মিলের সাথে নার্সিং হোম আছে। অন্যদের জন্য অন্যান্য ব্যবস্থা বিরাজমান করা আছে, অর্থাৎ উৎপাদনের পেছনের ব্যবস্থাপনা নির্ণয় করে দেখলেন। বঙ্গবন্ধু সেখানে একজন শ্রমিকের বাড়ির ভিতরটা দেখতে চাইলেন এবং সেখানে যে পরিবারটিতে তিনি গেলেনÑ তারা সদ্য বিবাহিত। বঙ্গবন্ধু সবকিছু দেখলেন এবং তিনি সেখান থেকে বিদায় নেওয়ার সময় নিজের দেশের মর্যাদার কথা চিন্তা করলেন, চিন্তা করে বাড়ির নববধূটিকে একটা কিছু উপহার দেওয়ার কথা ভাবলেন। কিন্তু তাঁর কাছে কিছুই তেমন নাই, তিনি হঠাৎ তাঁর নিজের হাতের দিকে তাকালেন এবং নিজের হাতের আংটিটি খুলে সেই শ্রমিকের স্ত্রীকে উপহার দিলেন।
সেখান থেকে রাতে হোটেলে ফিরে এলেন, সকালে হোটেলের সেলুনে চুল কাটাতে গিয়েও তিনি খুঁজতে থাকলেন- এদের এত ঐক্যের পেছনের কারণ কী? সেখানে সেলুনঅলার সাথেও কথা বললেন, কথোপকথনের একপর্যায়ে সেলুনঅলা বঙ্গবন্ধুর পরিচয় জানতে চাইল, নিজের পরিচয় গোপন করে বঙ্গবন্ধু তার উত্তর দিলেন এভাবে :
‘এমনি ঘুরে বেড়াই, দেশ বিদেশ দেখি।’
বঙ্গবন্ধুর তাদের দেশ নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তরের পর সেলুনঅলা এবার বঙ্গবন্ধুর দেশ নিয়ে জানতে চাইলেন, এবং তিনি (বঙ্গবন্ধু) তার উত্তর দিলেন আরও রহস্য নিয়েÑ
‘বহু বছর পরাধীন ছিলাম, কয়েক বৎসর হলো স্বাধীন হয়েছি। এখন পর্যন্ত বেশি কিছু করতে পারি নাই, তবে অনেক কিছু করবার পরিকল্পনা হয়েছে। আর সম্ভাবনাও আছে। আশা করা যাইতেছে।
বঙ্গবন্ধু মনে মনে আরও বললেন :
‘বেচারা বোধ হয় আমার কথা বুঝতে পারলো না।’
প্রশ্ন হচ্ছে, কার সাধ্য ছিল জানা। ঐ সময়ে তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) মনের অন্তর্নিহিত গাঁথুনির মর্মকথা।
যাই হোক তিনি আরও মানুষের সাথে কথা বলে বুঝতে চাইছিলেন তাদের এই পরিচ্ছন্ন জীবনের উৎস জ্ঞান। লাইব্রেরি, মিউজিয়াম সব জায়গায় তিনি মেলাচ্ছেন কতদূর যাওয়া যায় উন্নত বিশ্ব ছুঁয়ে দেখতে।
দেখতে দেখতে হঠাৎ তিনি দেখলেন সাংহাইতে কিছু বিদেশি সাইকেল একটি দোকানে রাখা, কিন্তু জনগণ সেগুলো কেনে না, বরং তারা বেশি দাম দিয়ে হলেও নিজের দেশের পণ্য ক্রয় করছে। এবং তিনি সেখান থেকে জানতে পারলেন, সেখানে হঠাৎ করে কোনো জিনিসপত্রের দাম বাড়ে না। বঙ্গবন্ধু এর কারণ জিজ্ঞেস করলে দোকানি উত্তর দিলÑ এখানে জনগণ খুব সজাগ, এখানে কারওর বেশি দাম নেওয়ার উপায় নাই, এখানে ছেলে বাপকে ধরায়ে দিছে। স্ত্রী স্বামীকে ধরাইয়ে দিছে, এ রকম বহু ঘটনা নয়াচীন সরকার কায়েম হওয়ার পরে হয়েছে।
ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু আর একটা জিনিস লক্ষ্য করলেন তাঁরা চীনের যেখানেই গিয়েছেন প্রতিটি জায়গাতেই তাঁদেরকে ফুল উপহার দেওয়া হচ্ছিল, প্রচুর ফুলের সমারোহ দেখে বঙ্গবন্ধু এক জায়গায় মন্তব্য করছে এভাবে :
‘এত ফুল কোথায় পায় বুঝতে পারি না। তবে কি কম্যুনিস্ট দেশেও ফুলের আদর হয়! আগে জানতাম না।’
এরপর তাঁরা হ্যাংচো শহরে পৌঁছালেন কো-অপারেটিভ ফারমিং দেখতে, সেখানকার প্রকৃতির মুগ্ধতা যেন বঙ্গবন্ধুকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। সেখানে তিনি মানুষের কাজকর্মের ধরনের খোঁজখবর নিতে থাকলেন। তিনি সেখান থেকে একটি হাতপাখা ক্রয় করলেন, আর একটি উপহার পেলেন। টাকার অভাবে অনেক কিছু পছন্দ হলেও কিনতে পারলেন না। এবং এরপর হোটেলে এসে দেশে ফেরার প্রস্তুতি।
পরদিন সকালে তাঁরা রওনা হবেন দেশের দিকে।
ভ্রমণ শেষ করে এ পর্যায়ে এসে বঙ্গবন্ধু আবার লিখছেন তাঁর নোটে :
‘নয়াচীনে আমি কী কী দেখলাম তার আলোচনা করার চেষ্টা করবো- তাদের শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন, বেকার সমস্যা দূর করা, ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ, উন্নয়ন কাজ যা যা ওরা তিন বৎসরে করেছে।’
আরেক জায়গায় তিনি উল্লেখ করলেন :
‘সত্য কথা বলতে কি- নতুন দেশ, নতুন মানুষ, নতুন তাদের ব্যবহার। মনে হয় সকল কিছুর মধ্যেই নতুনত্ব।
বঙ্গবন্ধু চীনে গিয়ে চীনাদের আফিম খাওয়া বন্ধ হওয়ার উপায়গুলোও জানতে চেয়েছিলেন, ডাকাতি বন্ধ হওয়ার উপায় খুঁজে দেখেছিলেন, তাদের ধর্মের ব্যবহারে নিরপেক্ষতায় কতদূর পর্যন্ত তারা সত্য, নারীদের পতিতাবৃত্তি থেকে পুনর্বাসনের পদ্ধতিসমূহ, কোনো কিছুই যেন তিনি বাদ দিতে চাননি তাঁর জানার তৃষ্ণা থেকে।
পাশাপাশি বর্ণনা দিয়েছেন নিজের দেশের তুলনামূলক খণ্ডচিত্র, যেখানে উঠে এসেছে স্বদেশী আন্দোলন, পূর্ববাংলার জমিদারি প্রথা, দুর্ভিক্ষ কারণ, গোঁড়ামিভিত্তিক ধর্মীয় প্রচার-প্রচারণা, দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের নাভিশ্বাস, জেলখানায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ঘুষ গ্রহণের চিত্র, ছেলে ঘুষ খায় বাবা তা গর্বের সাথে বলে বেড়ায়, ইত্যাদি ইত্যাদি নানা বিষয়সমূহ।
এবং এগুলো বর্ণনার পাশাপাশি তাঁর লেখায় আরও উঠে এসেছে নারীদের অধিকারের জন্য এক অনবদ্য জীবন দর্শন বোধ। তিনি সেখানে পূর্ববাংলার সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা ভেঙে দিতে জোরালো আহ্বান করেছেন এদেশের নারী সমাজের প্রতি। নারীদের দুরবস্থা লাঘবে উপায় খুঁজেছেন নানা বিশ্লেষণের সাহায্যে, তিনি এ বিষয়ে লিখছেন এভাবে :
‘পুরুষ শ্রেষ্ঠ আর স্ত্রী জাতি নিকৃষ্ট’ এই পুরোনো প্রথা অনেক দেশে বহুকাল থেকে চলে আসছে, তা আর নয়াচীনে নাই।’
এবং তিনি আরও মন্তব্য করছেন এভাবে :
‘সত্য বলতে গেলে, একটা জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ না করে তা হলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনো দিন বড় হতে পারে না।’ তিনি এক্ষেত্রে ইসলামের প্রসঙ্গ টেনে বলেন ‘দুনিয়ায় ইসলামই নারীর অধিকার দিয়েছে’।
চীনের বৈপ্লবিক কৃষি ব্যবস্থা দেখে তিনি তা নিয়ে লিখছেন এভাবে :
‘নয়াচীনে একখণ্ড জমি দেখলাম না, যা অনাবাদি পড়ে আছে।’
এবং তাঁর লেখায় আরও উঠে এসেছে সেখানকার কৃষির বণ্টন ব্যবস্থার সাথে উৎপাদন ব্যবস্থার সমন্বয়ে নিয়ন্ত্রিত বাজার, যা কৃষককে উৎসাহিত করেছে উৎপাদনমুখী হতে।
ইতোমধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতনের খোঁজ খবরও তিনি নিয়েছেন, এবং ঘুষ খাওয়ার অভিযোগে এক সরকারি কর্মচারীর ফাঁসি হওয়া, সে ঘটনাও তিনি উল্লেখ করেছেন। কেউ না খেয়ে থাকলে সরকারি কর্মচারীর জবাবদিহিতা কীভাবে কার্যকর হবে তাও দেখতে বাদ দেননি।
উল্লেখ করেছেন হোয়াং হো নদীতে বাঁধ তৈরি করার সময় গণজাগরণের স্ফুরণে কীভাবে অসাধ্য সাধন করেছিল চীনারা। দেখিয়েছেন একসময় না খেতে পারা চীনারা অতি অল্প সময়ে কীভাবে খাদ্যে উদ্বৃত্তের দেশ হয়েছে। কীভাবে সুশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে চীনারা সুষ্ঠু কর্মপন্থা অর্জন করেছে।
শেষে তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন এভাবে :
‘জাতির নৈতিক পরিবর্তন ছাড়া ও সুষ্ঠু কর্মপন্থা ছাড়া দেশ থেকে দুর্নীতি ও ঘুষ বন্ধ করা সম্ভব হবে না।’
ভ্রমণ কাহিনি শেষ হওয়ার আগে সেখানে আরও উল্লেখ করছেন :
‘নয়াচীন থেকে ঘুরে এসে আমার এই মনে হয়েছে যে, জাতির আমূল পরিবর্তন না হলে দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করা কষ্টকর। নতুন করে সবকিছু ঢেলে সাজাতে হবে। ভাঙা দালানে চুনকাম করে কোনো লাভ হয় না-বেশি দিন টিকে না। আবার ভেঙে পড়ে। পুরান দালান ভেঙে ফেলে দিয়ে নতুন করে গড়ে তুললে, ঘুণ ধরতে বা ভেঙে পড়তে অনেক সময় লাগে। সাথে সাথে ভিত্তিটা মজবুত করতে হয়। ভিত্তি মজবুত না হলে সামান্য বাতাসে ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই, নয়াচীনে দেখেছি তারা ভিত্তি মজবুত করে কাজ শুরু করেছে।’
বিপ্লবোত্তর একটি রাষ্ট্রে আগত পরিবর্তনসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করে কীভাবে জীবিত সঞ্জীবনী হয়ে উঠতে হয় তা বঙ্গবন্ধু জেনে নিতে চেয়েছিলেন খুব আপন করে। এবং একটি বিপ্লব সফল হওয়ার দিকগুলো তিনি যেভাবে আগে থেকেই জানতেন। অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে এসেছে, বেরিয়ে এসেছে যেমন বাঙালির অজানা হৃদয়।
বইটি প্রকাশের পর আমার কয়েকজন তরুণ সহকর্মীকে বইটি পড়তে দিয়েছিলাম প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য, তাঁদের মধ্য থেকে একজন আমাকে বলেই ফেলল ‘আমার বাড়ির কেউ যদি কোন অপরাধ করে তবে তাও কি আমি প্রকাশ করে দিব?’
আমার এই সহকর্মীর বক্তব্য শুনে আমি আশাবাদী হয়েছি এই দেখে যে বাঙালির মন এখনও উর্বর। এখনও এ মানব জমিনে আবাদ করে সোনার ফসল ফলানো সম্ভব। বর্গা চাষিদের আগাছা চাষে তা পুরোপুরি অবান্তর হয়ে যায় নাই।
এবং জাতি পরম্পরায় জীবনের অনেক মরে থাকা প্রশ্নের সমাধান এই বইয়ে পেয়েছি। বাঙালির অনুতাপ কিংবা আফসোস করার জন্য জীবন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে এতদিন অপ্রকাশিত এই বইটি।
সুন্দর একটি ভূমিকা নতুন শুধু এতে সংযোজিত হয়েছে, যা পাঠককে সংযুক্ত করেছে হৃদয়সম্পন্ন চিন্তার বিকাশে। বইটির শেষে কতগুলো আলোকচিত্রও সংযোজিত হয়েছে যা সেই ১৯৫২, ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধুর চীন সফরের সময় তোলা। এবং সবশেষে টীকাভাষ্য- নির্ঘণ্ট দিয়ে বইটি শেষ হয়েছে।
কিন্তু রেশ রয়ে গিয়েছে যেন মানুষের নতুন হয়ে যাওয়ার মতো ভাবনায়। কাব্যের মধ্যে কবিতা সঞ্চিত হয়ে থাকলে তা ভাবনার হৃদয় হয়ে থাকে যেমন।
লেখক : কবি ও সাহিত্যিক