আর্কাইভগল্প

খোলস : সুব্রত বড়ুয়া

আবার পড়ি : সুব্রত বড়ুয়ার গল্প

এই অফিসে প্রথম যেদিন চাকরি করতে এসেছিলাম, সেদিনের কথা আজও আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে। কী বলব দিনটিকে ? আমার জীবনের খুব স্মরণীয় দিন ? এমন ছিমছাম ফিটফাট অফিসে কোনও দিন চাকরি করতে পারব—তেমন স্বপ্ন দেখার সাহসও আমি পাইনি কখনও। খুব মনে আছে—ঝকঝকে হোয়াইট ওয়াশ করা দেয়াল, চকচকে মসৃণ মেঝে—কোথাও ধুলো নেই, ময়লা নেই। মেইন রোড থেকে নেমে এসেছে কালো পিচের রাস্তা। দশ গজ পেরুলেই মেইন গেট। সেখানে চব্বিশ ঘণ্টা বসে পাহারা দেয় দারোয়ান। তারপর আরও প্রায় পাঁচশো গজের মতো পথ। দুপাশে ফুলের বাগান। গাছগুলো ঠিক যেন মেপে মেপে বসানো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘাস। আমি স্কুটার ছেড়েছিলাম বড় রাস্তায়। তারপর এইটুকু এসেছিলাম পায়ে হেঁটে। খুব নরম হালকা হাওয়া ছিল চারপাশে। শীতের দিনের সকাল নটার রোদ লাগছিল গায়ে। খুব ভালো লাগছিল আমার। নিজেকে সেই প্রথম আমার খুব অন্যরকম মনে হচ্ছিল। যেন আমার নিজের মধ্যে সেই চিরচেনা আমি ছাড়াও নতুন ‘আমি’র সূচনা টের পাচ্ছিলাম। বেশ ফ্রেশ লাগছিল নিজেকে।

সেদিন খুব সকালেই জেগে উঠেছিলাম আমি। বিছানা ছেড়ে ঘরের দরজা খুলে পেছনের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। তখনও বাসার আর কেই জাগেনি। বাথরুম থেকে ফিরে এসে একটি সিগারেট ধরিয়েছিলাম। রাতের বাসি প্যাকটের শেষ সিগারেট। কিন্তু বেশ ভালো লাগছিল আমার। টেবিলের ড্রয়ার খুলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারখানা আবার দেখেছিলাম। দামি কাগজে সুন্দর চাইপ করা চিঠি। অবিশ্বাস্য! হ্যাঁ, অবিশ্বাস্যই তো!

তারপর রেডিওটা অন করে বসেছিলাম শেভ করতে। নতুন ব্লেড। শেভ শেষ করে, গোসল শেষ করে, নাস্তা খেয়েছিলাম। খাওয়া মানে শুধু একটা পরোটা আর সামান্য তরকারি। তখনও আটটা বাজেনি। নিজের ঘরে এসে সিগারেট ধরিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখেছিলাম বার বার। মনে হচ্ছিল, খুব সেøা চলছে ঘড়িটা। তখন সবেচেয়ে ভালো শার্ট প্যান্ট পরে নিলাম, সদ্য কালি করানো জুতা পড়ে যখন আবার আয়নার সামনে দাঁড়ালাম তখন মনে হচ্ছিল, নিজেকে একটু অন্যরকম লাগছে। খুব স্মার্ট, বুদ্ধিদীপ্ত। বৌদি তো বলেই বসল—বাহ! বেশ স্মার্ট লাগছে তোমোকে। যেন এই স্মার্ট, তাজা হওয়ার জন্যই আমি বেঁচে ছিলাম। আমরা সবাই বেঁচে থাকি।

মনে মনে বলেছিলাম—লাগবেই তো। অমন অবিশ্বাস্য রকমের লোভনীয় একটি চাকরিতে জয়েন করতে যাচ্ছি আমি। সমস্ত ব্যপারটাই ছিল আমার কাছে অবিশ্বাস্য, আকস্মিক এবং অস্বাভাবিক। অবিশ্বাস্য! হ্যাঁ, প্রায় অবিশ্বাস্যভাবেই চাকরিটা হয়েছিল আমার। আমি ভাবতেই পারিনি, এমন একটা সাংঘাতিক চাকরি জুটে যাবে আমার কপালে, এমনকি কল্পনাও না! আমার বন্ধুরা শুনে আনন্দ প্রকাশ করেছিল আমার এমন সৌভাগ্যে, কিন্তু আমি ওদের সবার চোখের কোণে ঈর্ষার কালো মেঘটিও ঠিকই দেখেছিলাম। আমি জানি, তবু ওরা আমার বন্ধু। ভালোবাসা ও ঈর্ষা দুই মিলেই বন্ধুত্ব। ওদের কাছেই আমাকে ফিরে যেতে হবে বার বার। শুধু এইটুকু ছাড়া ওরা তো সবসময়েই আমার শুভানুধ্যায়ী, আমার ভালো-মন্দের সাথি। আমার ভাবতে বেশ মজাই লাগে—ঠিক এই রকম হচ্ছে আমাদের জীবন।

খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করেছিলাম, যদিও মনে প্রায় আশি পার্সেন্ট নিশ্চিত ছিলাম, উত্তরে নিশ্চয়ই একটি রিগ্রেট লেটার আসবে শুধু। বিদেশি কোম্পানিগুলো অন্তত একটি চিঠি দিয়ে ওদের অপারগতার সংবাদটুকু জানায়—অনন্তকাল প্রতীক্ষার ঝামেলা থেকে নিষ্কৃতি দেয়। আর বিজ্ঞাপনে তো উল্লেখ ছিলই একটি বিদেশি কোম্পানির প্রচার বিভাগের জন্য একজন জুনিয়র এক্সিকিউটিভ ইত্যাদি। আমি তখন একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরি করি। বেতন নগণ্য। এবং আমার আত্মীয়-স্বজনরা তখন একরকম নিশ্চিত হয়ে গেছেন যে, আমার জীবনে এর চাইতে ভালো কোনও চাকরির সম্ভাবনা আর নেই। অতএব স্বাভাবিক কর্তব্যের খাতিরেই তাঁরা নিত্য দুবেলা আমার প্রায় অবসরপ্রাপ্ত পিতার কাছে আমার মতো একজন সম্ভাবনাময় ছেলের এরূপ অন্ধকার ভবিষ্যতের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেন। সে যাই হোক, ওতে আমার কোনও দুঃখ ছিল না কারণ ওদের কারুরই কোনও বিবাহযোগ্যা কন্যার প্রেমে আমি পড়িনি।

দরখাস্ত করার পরই, বলতে গেলে, আমি কথাটা ভুলে গিয়েছিলাম। এর মাঝে দুমাস চলে গেল আর তারপরই আমার সমস্ত ভাবনা ও আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত করে দিয়ে এল ইন্টারভ্যু কার্ড। সেখানে প্রতিষ্ঠানটির নাম দেখে আরও নিশ্চিত হয়ে গেলাম—এ চাকরি আমার হচ্ছে না। ভীষণ রকম পরিচিত ও বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান। বেশকিছু নিত্য প্রয়োজনীয় প্রোডাক্টস আছে এদের। আর বাজারে সেগুলোর চাহিদা সাংঘাতিক। চিঠিতে লেখা ছিল—ইন্টারভ্যু লিখিত হবে। তারপর মৌখিক।

প্রথমে ভেবেছিলাম—যাব না। শুধু শুধু যাওয়ার কোনও অর্থ নেই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে কাজ করার জন্যে যে ব্যাকগ্রাউন্ড চাই—আমার তা মোটেই নেই। ব্যাকিংও নেই। পরে আবার মত পাল্টে ফেললাম নিজে নিজেই। ভাবলাম—চাকরি না হলেও একটা অভিজ্ঞতা তো হবে। সেটাই বা কম কি! সবকিছু ছিল আমার নিজের মধ্যেই। কেননা এই দরখাস্তের কথাটা আমি কাউকে জানাইনি। এমন কি কোনও বন্ধুকেও নয়। ওদের বললে ওরা নিশ্চয়ই হেসে উঠত। আমার মতো আনস্মার্ট অকেজো ছেলের পক্ষে এ চাকরির আশা করাটাও অন্যায়। আর আমি তো জানতাম—এ চাকরি আমার কস্মিনকালেও হবে না। আমাকে ‘ব্যাক’ করার কেউ নেই। আর সুপারিশ ছাড়া চাকরি হয়—এ কথা কখনও শুনিনি।

তবু শুধু অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্যই ইন্টারভ্যু দিতে গিয়েছিলাম। ঝাড়া এক ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা। কম্পোজিশন, ক্যুইজ, সুইটেবল শব্দ নির্বাচন এবং হ্যাপি ইউজ। চাকরি হবে না বলে নিশ্চিত জেনেই খুব স্বাধীনভাবে সবকিছু লিখেছিলাম। এমন কি যা লিখেছি সে কথা খাতা জমা দেয়ার পরই বেমাল্যম ভুলে গিয়েছিলাম। অতএব আজ এতদিন পর সেসব কিছু খুঁটিনাটি মনে পড়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। পনেরো জন প্রার্থীর মধ্যে আমার ক্রমিক নম্বর ছিল আট। অতএব মৌখিক ইন্টারভ্যু দেয়ার আগে ভিজিটরস রুমে বসে দুটো সিগারেট টানার সময় পেয়েছিলাম। আর তখন নিজের অই অবস্থার কথা চিন্তা করে হেসেছিলাম মনে মনে। ভাগ্যিস, প্রার্থীদের মধ্যে পরিচিত কেউ নেই। তাহলে বন্ধুরা শুনলে নিশ্চয়ই খুব হাসাহাসি করত। অতএব বেশ বোল্ডলিই সিগারেট টানলাম। কিন্তু অন্য প্রার্থীদের দিকে তাকিয়ে নিজের বেশ সংকোচ লাগছিল। পনের জনের মধ্যে বারো জনেরই নিখুঁত কমপ্লিট স্যুট। সঙ্গে রং মেলানো টাই। অন্য দুজনের একজনের গায়ে চমৎকার বিদেশি জ্যাকেট এবং বাকি একজনের গায়েই শুধু আমার মতো হাফ-হাতা সোয়েটার। ফলে আমার নিজের সবচেয়ে ভালো পোশাক পরেও বেশ অস্বস্তি লাগছিল আমার। তবে ইতোমধ্যেই সেই হাফ-হাতা সোয়েটারের সঙ্গে বেশ আলাপ-টালাপ জমে গিয়েছিল। সদ্য এমএ পাশ করে বেরিয়েছে। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট। আমি সিগারেট অফার করেছিলাম। সে বলেছিল, থ্যাংকস, খাই না।

এর মাঝে ইন্টারভ্যু শুরু হয়ে গিয়েছিল। এক একজন ঢুকছিল ভেতরে আর অন্য সবাই তড়বড়ানি বাদ দিয়ে কেমন চুপসে যাচ্ছিলাম আমরা। আমার নিজের পালা এসেছিল প্রায় ঘণ্টাখানেক পর। প্রতি বারই একজন প্রার্থী বেরিয়ে আসার দুতিন মিনিট পর ম্যানেজারের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এসে পরবর্তী লোকটিকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন।

আমার নাম বলতেই আমি উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। ভেতরে ঢূকে দেখলাম—জনা পাঁচেক লোক একটি টেবিলের সামনে বসে। আমি ঢুকেই নড করে উইশ করেছিলাম—গুড মর্নিং। মাঝখানের মোটা বিদেশি ভদ্রলোকটি উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বলেছিলেন—প্লিজ, সিট ডাউন মাই বয়।

আমি ‘থ্যাংকইউ’ বলে খুব সন্তর্পণে চেয়ারে বসেছিলাম। তারপর ঝাড়া পনেরো মিনিট কীভাবে কেটেছিল আমার তা পুরোপুরি মনে নেই। প্রধানত বিদেশি লোকটিই নানা কথা জিগ্যেস করেছিলেন। ঠিক প্রশ্ন নয়, যেন অনেকটা আলাপ করছিলেন তিনি আমার সঙ্গে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমার নিজের স্টিফ ভাবটা কেটে গিয়েছিল। মোটা মুটি ভালোই লাগছিল আমার। ওঠার আগে ভদ্রলোক জিগ্যেস করছিলেন, চাকরি পেলে কখন জয়েন করব। উত্তরে বলেছিলাম—আপনারা যখন চান।

 বাইরে বেরিয়ে চলে আসব কি না ভাবছিলাম—এমন সময় ম্যানেজার সাহেবের পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট এসে বলেছিলেন—আপনি একটু অপেক্ষা করবেন।

সেই সকাল নটায় এখানে পৌঁছে ছিলাম। তখন প্রায় একটা। মাঝখানে সাড়ে দশটার সময় লিখিত পরীক্ষা শেষ হলে প্রায় ঘণ্টা খানেক বসেছিলাম আমরা। তখন একবার চা আর কেক খাইয়েছিল সবাইকে।

ইন্টারভ্যু রুম থেকে বেরিয়ে এসে ঠিক টের পেয়েছিলাম—খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। এদিকে আবার অপেক্ষা করার নোটিশ। অতএব অই অবস্থায় আবার গা এলিয়ে সোফায় বসে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম। কিন্তু তখন অদূরে রিসেপশন কাউন্টারের সুন্দরি মহিলাটিকেও তেমন আর শান্তিদায়িনী বলে মনে হচ্ছিল না। কেননা তিনি ঠিক তখনই গোটা দুই পরম লোভনীয় স্যান্ডইউচ আর এক কাপ চা খাচ্ছিলেন বেশ আয়েশ করে। কবে কখন যেন শুনেছিলাম—খাওয়ার সময়ই মেয়েদের নাকি সবচেয়ে কুশ্রী দেখায়। সেই মুুহূর্তে মিসেস সাবেথকে আমার দুনিয়ার কুৎসিততম মহিলা বলে মনে হচ্ছিল। পরে জেনেছিলাম, ভদ্রমহিলার নাম রুকসানা সাবেথ।

কিন্তু সে কথা থাক। ম্যানেজার সাহেবের ঘর থেকে দ্বিতীয়বার আহ্বান এসেছিল আরও প্রায় ঘণ্টাখানেক পর। আমার দারুণ খিদে পেয়েছল সত্য কিন্তু উঠতে পারিনি। মধ্যবিত্ত বাঙালির সন্তান, খিদের চেয়ে চাকরির টান অনেক বেশি, এ জ্ঞান প্রায় বুদ্ধি হবার পর পরই অর্জন করেছি। অতএব দ্বিতীয়বার ডাক আসতেই সুড় সুড় করে আবার হাজির হয়েছিলাম ম্যানেজারের কক্ষে।

এবারও সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন— ‘কনগ্র্যাচুলেশনস্। আই থিংক ইউ আর অন্ ইউর ওয়ে টু এ নিউ জব, মাই বয়। ইউ উ’ল গেট দ্য লেটার সুন, আই হোপ।’

আমি প্রায় অভিভূতের মতোই ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলাম—ইউ আর কাইন্ড এনাফ টু মি স্যার। সাহেব সঙ্গে সঙ্গে হেসে বলেছিলেন, ওহ, ডোন্ট মেনশন ইট, মাই বয়। উই অলওয়েজ লাইক দ্য বেস্ট।

এরপর ম্যানেজার সাহেবের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর ঘরে। তিনি আমাকে একজন ডাক্তারের ঠিকানা দিয়ে বলেছিলেন পরদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে মেডিক্যাল চেকআপের জন্যে। আমি তখন খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সেই সাংঘাতিক ক্ষুধার কথাও বুঝি আমার আর মনে ছিল না তখন।

দুই

হয়তো মানুষের জীবন হচ্ছে এই রকমই। যখন সে যা চায়, ঠিক তখন সে তা পায় না। আর যখন পায়, তখন মনে হয় এ আর এমন কি। আমার বাবা বলতেন—মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো—কথাটার আসল অর্থ যে কী তা আমি নিজে কখনও ঠিকভাবে বুঝতে পারিনি। সংসারে পোড় খাওয়া মানুষ বলতে যা বোঝায় বাবা ছিলেন ঠিক তাই। দারিদ্র্য তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছিল সেই ছোটকাল থেকেই। এই দারিদ্র্যের কারণেই স্কুলের পড়া শেষ করতে পারেন নি। জীবন ও জীবিকার তাগিদেই মাত্র পনের বছর বয়সে গ্রাম ছেড়ে এসেছিলেন শহরে। তখন তো সবই সস্তাগন্ডার দিন। তবু দিন চলে না। শহরে এসে চাকরি নিয়েছিলেন এক দোকানে। দোকানের কেনাবেচা থেকে শুরু করে মায় হিসাবের খাতাটি পর্যন্ত ঠিক রাখার কাজ। অই করেই শুরু করেছিলেন তিনি তাঁর জীবন। আর পাঁচ বছর পর নিজেই ছোট একটা দোকান নিয়ে শুরু করেছিলেন পাইকারি মালের ব্যবসা।

বাবা তাঁর জীবনের এসব কাহিনি বলার সময় খুব উদাস হয়ে যেতেন। বলতেন, সে যে কি খাটুনির কাজ ছিল তা তোরা চিন্তাও করতে পারবি না।

আমরা সবাই গ্রামে থাকতাম। বাবা থাকতেন শহরে। দু-এক মাস পর বাড়ি যেতেন। আর বাবা বাড়ি এলেই আমরা খুব খুশি হয়ে উঠতাম। বাবা নিয়ে আসতেন কাপড়-চোপড় আর মচমচে বিস্কিটের টিন। বাবা যে কয়দিন বাড়ি থাকতেন সে কদিন বেশ ভালো খাওয়া-দাওয়া হতো। সকালের নাস্তার সঙ্গে উপরি তৈরি হতো চা। আমাদের তখন আর পায় কে। বাবার কাছে চেয়ে-চিন্তে দুচার আনা পয়সাও পাওয়া যেতো। রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে বাবা নানা আলাপ করতেন।

আমি যখন ক্লাস ফোরে উঠলাম, সে বছরেই বাবা আমাদের সবাইকে নিয়ে এলেন শহরে। তার আগের বছরই বিয়ে হয়েছিল আমার বড়দির। বড়দি ছিল সবার বড়। তারপর আমরা দুভাই। শহরে এসে আমরা নতুন বাসায় উঠলাম। নতুন বাসা মানে তিন কামরার ছোট বাড়ি। উপরে টিন, পাশে বাঁশের বেড়া, নিচে খুব খসখসে সিমেন্টের মেঝে। ভেতরে বারান্দা আর এক চিলতে উঠোন। পানি আনতে হতো রাস্তার কল থেকে।

আমরা এসে নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম। শহরের স্কুল। স্কুলে যাওয়ার সময় মা বলতেন—খুব সাবধান, রাস্তার একপাশে হেঁটে যাবি।

আহ! সেসব দিন। দিনগুলোর কথা আমার এখনও খুব স্পষ্ট মনে আছে। আমরা দুভাই স্কুলে যেতাম। সন্ধের সময় পড়তে বসতাম একসঙ্গে। মা থাকতেন রান্নাঘরে। সেখান থেকে আসত নতুন রান্নার সুবাস। বাজার থেকে মাছটাছ এলে কান খাড়া করে বসে থাকতাম কখন মার রান্না শেষ হবে, কখন ডাক আসবে খেতে যাওয়ার।

শহরে এসে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হয়েছিল মার। আশেপাশের কারও সঙ্গে তেমন ভালো করে মা মিশতেই পারতেন না। বলতেন—দুর! এখানে আমার মোটেই ভালো লাগে না। আমার সেই দেশের বাড়িই ভালো।

বাবা দোকানটোকান বন্ধ করে, হিসাবপত্র শেষ করে আসতেন সেই রাত এগারোটার দিকে। খেতে খেতে গল্প করতেন। যেদিন বিক্রিটিক্রি ভালো হতো, সেদিন মার হাতে খুচরো দু-এক টাকা দিতেনও তুলে। আর যেদিন বাবা খুব গম্ভীর থাকতেন সেদিন বুঝতে পারতাম বেচাবিক্রি তেমন সুবিধের হয়নি। আমারা দুভাই সুড়সুড় করে শুয়ে পড়তাম। আর সেদিন রান্নার একটু ওদিক-ওদিক হলে বাবা ভীষণ রাগ করতেন। মা খুব চুপচাপ থাকতেন সেদিন। আর ভাগ্য তেমন খারাপ হলে আমাদের কপালেও দু-একটা চড়-চাপড় জুটত।

এই ছিল আমাদের জীবন। আমার সেই বাবাকে এখন আমার খুব অসহায় বলে মনে হয়! বছর তিনেক ধরে অসুখে ভুগে কেমন মিইয়ে গেলেন বাবা। দাদা তখন বিএ পাশ করে দোকানে গিয়ে বসতে শুরু করলেন। আমি ভর্তি হয়েছিলাম অনার্সে।

সেই জীবন! মনে হয় মাত্র সেদিনের সব ঘটনা। আর এখন কিনা আমি চাকরি করছি। বাবা আরও ভগ্নস্বাস্থ্য। মায়ের চুল অনেকখানি শাদা হয়েছে। বাসার খরচটরচের সব ভার চলে গেল বৌদির হাতে।

তো আমার সেই চাকরি! শুরু তো করেছিলাম আমার সেই চাকরি থেকেই। সেদিন সেই ইন্টারভ্যু শেষ করে বাসায় ফিরতে চারটে বেজেছিল। বাসায় ফিরে আমি কাউকে কিছুই বলিনি! বৌদি বলেছিলেন—তোমার ভাত আছে টেবিলে। এসে দেখি—মা তরকারিগুলো আবার সব গরম করে নিয়ে এসেছে।

বাবা বারান্দায় বসেছিলেন রোদে। বললেন—এতক্ষণ কোথায় ছিলি ?

আমি বাবার কথার কোনও জবাব দিলাম না।

এরপর নিজের ঘরে এসে আমি অভ্যেসমতো একটি সিগারেট ধরিয়েছিলাম। আর সেই মুহূর্তেই যেন রাজ্যের যত ক্লান্তি এসে অধিকার করেছিল আমাকে। বাইরে শীতের বিকেল খুব দ্রুত শেষ হয়ে আসছিল। আমি জোড়া বালিশ চেপে আধশোয়া হয়ে পা দুটো টান টান করে দিয়েছিলাম। তখন যেন আমার চারপাশের সমস্ত শূন্যতা এসে গ্রাস করেছিল আমাকে। মনে হচ্ছিল, আমার নিজের আর কিছু করার নেই। যেন এই রকম শান্ত নিস্পন্দভাবে সময়গুলো কাটিয়ে দেওয়ার মতো আর কিছুই নেই—কোনও কিছু নেই।

সেদিন সন্ধের পর বেরিয়ে অনেকক্ষণ একা একা হেঁটেছিলাম রাস্তায় রাস্তায়।

পরদিন যথারীতি সেই নাম-ঠিকানা দেওয়া ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে অনেকক্ষণ ধরে নানারকম যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা-টরিক্ষা করলেন আর একটি ফর্মে সেসব টুকে নিলেন। চেক-আপ শেষ হলে একটা রিকশা নিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলাম আমার স্কুলে। আমি জানতাম বিকেলে ব্রাদার অফিসে বসে একা কাজ করেন। আমাকে দেখে ব্রাদার অবাক হয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম—ব্রাদার, আপনার সঙ্গে আমার কিছু আলাপ আছে।

বাইরে তখন চমৎকার বিকেল। ব্রাদার বসেছিলেন, উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো। বাইরে গিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আলাপ করি। আমি ব্রাদারের পাশে হাঁটতে হাঁটতে সব কথা খুলে বলেছিলাম। আমার কথা শুনে ব্রাদার একটু যেন গম্ভীর হয়েছিলেন। তারপর একটু চুপ থেকে বলেছিলেন—সো ইউ হ্যাভ ডিসাইডেড টু লিভ।

আমি বলেছিলাম—ব্রাদার, আই থিংক আই শ্যুড নট মিস দিস চান্স।

ব্রাদার পরমুহূর্তেই আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। খুব আবেগের সঙ্গে বলেছিলেন—গড ব্লেস ইউ।

আহ! ব্রাদারের সেই মুহূর্তের সমস্ত অভিব্যক্তি যেন আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। মনে হচ্ছিল যেন সেই শ্বেত শুভ্র পোশাকে সজ্জিত মানুষটির সমস্ত অন্তর থেকে উচ্চারিত হয়েছিল অই আশির্বাণী। একটু পরই আমি ব্রাদারের কাছ থকে বিদায় নিয়ে চলে এসে ছিলাম। সোজা এসেছিলাম আমাদের নিত্যদিনের আড্ডায়। একটি রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন সন্ধ্যেয় জমতো আমাদের আড্ডা। সেখানে এসে আবার নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম সেই তুমুল তুখোড় আড্ডায়।

এরপর কদিন কেটেছিল শঙ্কা আর উত্তেজনায়। বাসায় ধীরে ধীরে আমি কথাটা বলেছিলম। বাবা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু জিগ্যেস করেছিলেন। দাদা জিজ্ঞেস করেছিলেন সম্ভাব্য বেতনের কথা। মা বলেছিলেন—তোর যা ভালো মনে হয় তাই কর।

আমার নিয়োগপত্রটি এসেছিল আরও প্রায় আট-দশ দিন পর। আর সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই আমি জয়েন করতে এসেছিলাম এই অফিসে। আমি জানতাম, শুরুতেই চার অঙ্কের বেতন পাচ্ছি আমি। আমার স্কুলে যে বেতন আমি পাচ্ছিলাম, এখানে পাব তার প্রায় চার গুণ। টাকার কথাটা চিন্তা করতে গিয়ে নিজেই আমি খুব অবাক হচ্ছিলাম মনে মনে। এত টাকা দিয়ে আমি কী করব এখন!

এই ঘটনার প্রায় পাঁচ মাস আগে বিয়ে হয়েছিল বীথির। আমার প্রেমিকা বীথি। আমি বীথিকে সেজন্যে মোটেই দোষ দেইনি। বলা যায়, খুব যুক্তিসম্মতভাবেই আমি আমার ও বীথির জীবনের এই রকম একটি পরিণতি মেনে নিয়েছিলাম। তো শেষ পর্যন্ত নিতান্ত অল্প মাইনের এক সামান্য স্কুল মাস্টারকে বিয়ে করে বীথি পরিবারের অন্য সকলের কাছে হেয় হতে পারেনি। বীথির স্বামী ভালো রোজগেরে মানুষ। সম্ভবত পিতা-মাতার পছন্দ করা লোকটিকে বিয়ে করার আগে বীথি নিজের মনে এই রকম একটি সান্ত্বনা খুঁজে নিয়েছিল। আমি কোনও বাধা দেইনি, বাধা দিতে পারিনি—বাধা দেওয়ার মতো মুখও আমার ছিল না। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুবার পরও অন্তত দুবছর বীথি অপেক্ষা করেছে আমার জন্যে। এর চেয়ে বেশি প্রেমের পরাকাষ্ঠা কী আর দেখাতে পারে সে! আসলে সমস্ত ব্যর্থতা তো ছিল আমারই। আমি তাই প্রায় নিঃশব্দেই সরে দাঁড়িয়েছিলাম বীথির কাছ থেকে। ভেবেছিলাম—এই আমার নিয়তি। জীবনে সবাই সবকিছু পায় না। না, কারও কাছে আমার কোনও অভিযোগ ছিল না; করো কাছে কোনও অভিযোগও আমি করিনি। বীথি আমার চোখের সামনে দিয়েই স্বর্ণালংকারে সুসজ্জিতা হয়ে সুখিসুখি মুখ নিয়ে স্বামীর ঘর করতে গিয়েছিল। বীথর বাবা খুব ধুমধাম করেই বিয়ে দিয়েছিলেন বীথির। চেনাজানা লোকজনের মুখে সে সবকিছুর উৎসাহব্যঞ্জক বর্ণনা শুনতে আমার খুব খারাপও লাগেনি। আমি তো নিজের কাছে স্বীকার কারেই নিয়েছিলাম, আসলে বীথির মতো সুন্দরি শিক্ষিতা মেয়েকে বিয়ে করার মতো যোগ্যতা আমার নেই। ভাগ্যিস প্রেম করার আগে এই রকম পূর্বযোগ্যতা নির্ধারণের ব্যাপারটি এত কড়াকড়িভাবে কোথাও প্রতিপালিত হয় না। তাহলে হয়তো অই প্রেমের অভিজ্ঞতা থেকেই বঞ্চিত হয়ে থাকতে হতো আমাকে। এই একটি কারণে হলেও অন্তত আমি বীথির প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে পারি আজীবন। না, আমি নিমকহারাম নই। বীথির কথা আমার এখনও মনে আছে। সত্যি বলতে কি, চেষ্টা করেও বীথিকে আমি ভুলতে পারিনি এখনও।

শুধু নিয়োগপত্রটি পাওয়ার পর আমার একবার মনে হয়েছিল বীথির সঙ্গে আমার অই হারজিতের খেলায় আমি জিতে গেছি। একদিন বীথি বাধ্য হয়ে যে স্কুল মাস্টারটি তার সম্ভাব্য মালিকানার দাবি থেকে বাতিল করে দিয়েছিল, আমি এখন আর সেই মানুষটি নই। আহ! এখন যদি একবার বীথির সামনে গিয়ে বলতে পারতাম, দ্যাখো—আমি এখন আর একজন মানুষ, অন্য মানুষ। আমাকে তুমি এখন আর ইচ্ছে করলেও করুণা করতে পারো না।

কিন্তু এ ছিল আসলে শুধু আমার নিজের চিন্তাই। আমি তো ঠিকই জানতাম—আমি মানুষটা মূলত একই আছি। সেই নগণ্য স্কুল মাস্টারকে বিয়ে করলে বীথি হয়তো এখনকার চেয়ে কিছুই কম পেতো না কিংবা এখনকার এই মানুষটার মাঝে বীথি আর স্কুল মাস্টারটির চেয়ে বেশি কিইবা পেত।

আজকাল এসব ভাবনা মনে এলে আমার নিজের কেমন হাসি পায়। হয়তো বদলে যাচ্ছি আমি। হয়তো ঠিক টের পাইনি কিন্তু আমার নিজের মধ্যেও আসলে একরকম পরিবর্তনের পালা সূচিত হয়েছে।

তিন

থাকগে সে কথা। বরং পরে এক সময় সবিস্তারে বলা যাবে এই বীথি এপিসোড। আমার এখন কিন্তু সেই প্রথম দিনটির কথা ভাবতেই ভালো লাগছে। স্কুটার ছেড়ে দিয়ে চকচকে বাঁধানো রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি এসে পৌঁছে ছিলাম অফিস বিল্ডিংয়ের সামনের দিকের খোলা বারান্দায়। সামনের উঁচু প্ল্যাটফরম পেরিয়ে কাচের ভারি স্যুইং ডোরটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই আমি দেখেছিলাম ডানদিকের রিসেপসান লেখা কাচের ঘরে মিসেস সাবেথকে। তাঁকে দেখাচ্ছিল সেদিনের সেই ভোরের মতোই সতেজ। শ্যাম্পু করা ফাঁপানো চুলের সযত্ন খোঁপা। চমৎকার প্রিন্টের একটা শাড়ি পরেছিলেন তিনি। গায়ে ম্যাচ করা ব্লাউজ। ব্লাউজের বাইরে খুব মসৃণ কাঁধ, বুকের কিয়দংশ। মুখের প্রসাধন সামান্য। খুব ভালো করে না তাকালে ওটুকু সতিই চোখের পড়ার মতো নয়। আর কপালে—হ্যাঁ, ঠিক কপালের মধ্যিখানে শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ছোট একটি টিপ! আহ! গ্র্যান্ড! সব মিলিয়ে এই রকমই কিছু একটা মনে হয়েছিল আমার। টেলিফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন মিসেস রুকসানা সাবেথ। একটু যেন বুকে দোলা লাগানোর মতো ভঙ্গি, সংযত কিন্তু খুব চমৎকার কণ্ঠ। মহিলা সত্যিই সুন্দরী, মনে মনে আমি দ্বিতীয়বার তারিফ করেছিলাম তাঁর সৌন্দর্যের। সবকিছু এমন চমৎকার—এই রকমটি ঠিক কখনও সচরাচর এমন চোখে পড়ে না। তাঁর ডেস্কের সামনে ছোট্ট খোলা জায়গাটির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনি ‘জাস্ট এ মিনিট’ বলে টেবিলের একপাশে রাখা পিবিএক্স বক্সটায় বোতাম টিপে লাইন দিলেন। তারপর একটু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—গুড মর্নিং। হোয়াট ক্যান আই ডু ফর য়ু।

আমি বললাম, গুড মর্নিং। তারপর সামান্য নড করে আমার হাতের খামটি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর দিকে। একবার তাকিয়ে খামটি খুলে তিনি চিঠিটা বের করলেন। আমি এই ফাঁকে তাঁর চম্পক অঙ্গুলি-সঞ্চালন লক্ষ্য করলাম পরম আনন্দের সঙ্গে, বলতে দ্বিধা নেই। চিঠিটার দিকে একবার তাকিয়েই মিসেস সাবেথ বুঝতে পেরেছিলেন। পরমুহূর্তেই উঠে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘কনগ্র্যাচুলেশানস। লেট মি ওয়েলকাম ইউ অন ইউর ব্রাইট বিগিনিং।’

আমি মিসেস সাবেথের চোখে চোখ রেখে বলেছিলাম—থ্যাংক ইউ।

এরপর বোতাম টিপে পার্সোন্যাল ম্যানেজারের ঘরে কানেকশান দিয়েছিলাম তিনি।

ছোট কয়েকটি কথায় জানিয়েছিলেন আমার আগমন-সংবাদ। আমি ততক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রায় লোভীর মতোই দেখছিলাম মিসেস সাবেথকে। হালকা সেন্টের চমৎকার একট সুবাস পাচ্ছিলাম আমি। হ্যাঁ, আমার জীবনের ব্রাইট বিগিনিংই বটে। পেছনে আমার জীবনের অন্ধকার, বিষণ্ন অতীত। আমি সেদিকে আর কখনও ফিরে তাকাব না। আমি শুধু এগিয়ে যাব আমার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে। ঠিক এইরকম উজ্জ্বল বেঁচে থাকব… এমনই ছিমছাম, স্মার্ট!

মিসেস সাবেথ ততক্ষণে টেলিফোন নামিয়ে রেখেছেন। বললেন, ওয়েল মিস্টার …। ইউ আর নাউ টু মিট মিস্টার ব্রাউন। বলেই আবার সেই চমৎকার মিষ্টি একটি হাসি উপহার দিয়েছিলেন। তার পরের ঘটনা দীর্ঘ নয়, সংক্ষিপ্ত। মিস্টার ব্রাউনও তাঁর হাত বাড়িয়ে উষ্ণ করমর্দনের পর বলেছিলেন, কনগ্রাচুলেশানস্। আমার মনে পড়ল, মিস্টার ব্রাউনকেও আমি আমাদের ইন্টারভ্যুয়ের সময় দেখেছিলাম।

ব্রাউনের ওখানে বেশিক্ষণ বসতে হয়নি। তিনি নিজেই আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন বিভাগের চিফ মিস্টার চৌধুরীর রুমে। আমি মিস্টার চৌধুরীকে দেখেই চিনেছিলাম।

ইন্টারভ্যুয়ের সময় মিস্টার চৌধুরী ছিলেন জেনারেল ম্যানেজারের পাশেই। ভদ্রলোক মাঝবয়েসি ফর্সা। বলা যায় একটু মোটাও। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। মিস্টার ব্রাউন চলে গেলে তিনি আমাকে বসতে বলেছিলেন। আমি জয়েনিং রিপোর্টটা রেখেছিলাম তাঁর টেবিলে। দু-একটা কথার পর বেল টিপে বেয়ারাকে ডেকে চা আনতে বলেছিলেন তিনি।

সেই আমার প্রথম দিনের চাকরি। মিস্টার চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বি ফেমিলিয়ার এন্ড স্টার্ট টুমরো। আজকে সব দেখে শুনে নিন আপনি।’ তারপর কয়েকটি ফাইল আর কাগজপত্র দিয়েছিলেন আমাকে। সেসব বগলদাবা করে নিজের রুমে ফিরে এসে দরজাটা ঠেলে দিয়ে প্রথমেই একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম আমি।

আমার রুম ঠিক করা হয়েছিল মিস্টার চৌধুরীর রুমের ঠিক পাশেই। সাজানোর স্টাইলটা প্রায় একই রকম হলেও আমার রুমটা ছিল ছোট। আমি সিগারেট ধরিয়ে জানালার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। ফ্যাক্টরি বিল্ডিং আর বাগানের একাংশ আমার চোখে পড়ল।

রুমের প্রায় পেছনের দিকে রাখা ছিল আমার ছোট সেক্রেটারিয়েট টেবিল। ওপরে পুরু কাচ, সুন্দর ডিজাইনের অ্যাশট্রে, ডেস্ক ক্যালেন্ডার আর কলমদান সাজানো ছিল টেবিলে। আর একটা টেলিফোন। বুঝতে অসুবিধে হলো না—পিবিএক্স লাইনেরই এক্সটেংশান ওটি। নিজের চেয়ারে বসতে বসতে হাসি পাচ্ছিল আমার। এই হলো আমার জগৎ। মাসান্তে চার অঙ্কের মাইনের নিরাপদ জগৎ। আহ! চাকরি! ইচ্ছে হলো বীথিকে একবার ফোন করে চমকে দিই এখান থেকে। কী করবে বীথি ? নিজেই নিজের হাত কামড়াবে ? সিগারেটটা দ্রুত পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল আমার হাতে। কিং সাইজ ফিল্টার টিপ্ড বিদেশি সিগারেট। প্যাকেটটি কিনেছিলাম সেদিন সকালেই।

মে আই কাম ইন স্যার ?

চমকে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম—একজন আধবয়েসি বুড়োটো লোক দাঁড়িয়ে অর্ধমুক্ত দরজার কাছে। সিগারেট অ্যাশট্রেয় গুজে দিয়ে বললাম—ইয়েস প্লিজ।

ভদ্রলোক দরজাটা খুব সন্তর্পণে বন্ধ করে এগিয়ে এসে বললেন, ‘গুড মর্নিং স্যার। আই অ্যাম ডেভিড গোমেজ।’

তারপর আমার প্রায় হতভম্ব মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলেছিলেন গোমেজ সাহেব। আর পরক্ষণেই বলেছিলেন, আমি স্যার এই বিভাগেই কাজ করি। অ্যাসিস্টেন্ট। আপনার কোনও দরকার হলে ডাকবেন স্যার। আমি জেনারেল সেকশানে বসি।

গোমেজ সাহেব কথা বলছিলেন দাঁড়িয়ে। আমি তাঁকে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলেছিলাম, ‘বসুন।’

মিস্টার গোমেজ তখন আবার যথাসম্ভব কেতারদুরস্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘থ্যাংক ইউ স্যার।’

তরপর টুকিটাকি আর কিছু খুচরো কথা বলে গোমেজ বিদেয় নিয়েছিলেন। আমি আর দেরি না করে ফাইল-পত্র খুলে বসেছিলাম। না, আর দেরি নয়। এবার এখানকার কাজটাজগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে হবে আমাকে।

সেই তো শুরু। আমি ধীরে ধীরে গুছিয়ে নিয়েছিলাম সব।

আমি জানতাম—এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কাজের রীতি-টিতি সম্পূর্ণ আলাদা। আর বেতনের বিনিময়ে প্রায় সবটুকু সময়েই ব্যস্ত থাকতে হবে আমাকে। সেজন্য প্রথম থেকেই সিরিয়াস ছিলাম আমি। আমার বস মিস্টার চৌধুরী, বলতে গেলে, বেশ সদয়ই ছিলেন আমার প্রতি। কিন্তু কাজের বেলায় একটুও ঢিলেমি পছন্দ করতেন না তিনি। প্রায় সারাক্ষণই নানা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো আমাকে। তবে কাজ আমার ভালো লাগছিল। আমার নিজের সেকশান ছাড়াও অন্য সেকশানের অফিসারদের সঙ্গেও পরিচয় হয়ে গেল আমার অল্প কদিনের মধ্যেই। আর সবার আগে জমে গেল মার্কেটিংয়ের জুনিয়র এক্সিকিউটিভ রহমানের সঙ্গে। তুখোড় ছোকড়া। যেমন স্মার্ট, তেমনই কাজের। আর প্রায় আমারই মতো গুড স্মোকার। রহমান এই অফিসে ঢুকেছিল আমার প্রায় বছর খানেক আগে। মোটামুটি অফিসিয়েল অন্ধিসন্ধিগুলোর ব্যাপারে নানারকম প্রাথমিক তালিম পেলাম আমি রহমানের কাছেই।

এই ছিল আমার জীবন। দিন গেলে, ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম এক ধরনের নেশার মধ্যে আটকে যাচ্ছি আমি। সেই ঠিক কাঁটায় কাটায় সাড়ে আটটায় অফিসে আসা। নটায় টি। একটায় লাঞ্চ ব্রেক। আধঘণ্টা। ঠিক তিনটেয় আবার টি। এই দুবারের চা অফিসের। এর বাইরে চা খেতে হলে নিজের পকেট। আর তাতে কার্পণ্য ছিল না আমার একটুও। লাঞ্চ খেতাম আমরা অফিস ক্যান্টিনেই। সাড়ে চারটায় অফিস থেকে বেরিয়ে আমি আর রহমান ফিরতাম একসঙ্গে। সিনিয়র অফিসাররা প্রায় সবাই নিজের গাড়িতে আসতেন। যাঁদের নিজের গাড়ি নেই, তাঁরা অফিসের গাড়িতে চড়তেন। আমি আর রহমান ছিলাম অই দলে। একটা মাইক্রোবাস তুলে নিয়ে আসত আমাদের আর ফেরার সময় নামিয়ে দিয়ে আসত বাসার গেটে। বুঝতে পারছিলাম, পাড়ায় রীতিমতো খাতির বেড়ে যাচ্ছিল আমার। যে সব প্রৌঢ় আত্মীয় আমার মতো প্রমিসিং ছেলের স্কুল মাস্টারির জন্য নিত্য দুবেলা আমার বাবার কাছে ক্ষোভ ও সহানুভূতি প্রকাশ করতেন, তাঁদের কয়েকজনের বিবাহযোগ্যা কন্যারত্নের আনাগোনা বেশ বেড়ে গিয়েছিল আমাদের বাসায়। সুযোগ পেলে আমার বৌদিও ওদের নিয়ে নানারকম ঠাট্টা করতে আর টিপ্পনি কাটতে ছাড়তেন না আমাকে। আমি জানতাম—ওদের মধ্যে অন্তত দুজন ইতঃপূর্বে নানা অজুহাতে আমার বাবার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য সেসব ছিল আমার বাবারই ব্যাপার। আমার তাতে কোনও ভূমিকাই ছিল না। আর সেই দুই ভদ্রলোককে এখন প্রায়ই আমাদের বাসায় দেখতে পেতাম আমার বাবার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে ভয়ানক উদ্বিগ্নতা নিয়ে বসে থাকতে।

একদিন রহমানকে বলেছিলাম অই কথা। রহমান হো হো করে হেসে উঠেছিল সব শুনে। তারপর বলেছিল, মহা হারামি তুই। তোকে যতখানি সিধে আর সরল ভাবি—আসলে তো তুই তা নস দেখছি।

কথায় কথায় একদিন রহমানকে বলেছিলাম বীথির কথা। সব শুনে রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বলেছিল—তোর যে এরকম দুঃখটুঃখ আছে এটা তোকে দেখলে কিন্তু মনে হয় না। শালা যা নিখুঁত আর ফরম্যাল তুই।

রহমান ওর প্রেমিকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। বড়লোকের মেয়ে দীনা। সুন্দরী তো বটেই। আমার মনে হয়েছিল দীনা রহমানের চেয়েও বেশি স্মার্ট। কয়েকবার রহমানের বাসায়ও গিয়েছিলাম। রহমানের আব্বা উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার ছিলেন। মোটা পেনশন আর দুখানা বাড়ি করে রিটায়ার করেছেন। একটা বাড়িতে রহমানরা নিজেরা থাকে। অন্যটা ভাড়ায়। রহমানদের বাসা বেশ সাজানো-গোছানো, ফিটফাট। দামি ফার্নিচার আর ফ্রিজ, টেলিভিশন—এসব তো ছিলই। কিন্তু রহমানের দুঃখ ছিল অন্য কারণে। ও বলত, ওর আব্বার অন্তত এককানা গাড়ি থাকা উচিত ছিল। তারপর খুব কায়দা করে হেসে বলত, আমার গাড়ি থাকলে রোজ মিসেস সাবথকে লিফট দিতাম, মাইরি। আমি বলেছিলাম—আস্তে বলো। দীনা শুনতে পেলে এখনই ‘গেট আউট’ করে দেবে।

অফিসে প্রায়ই দীনা ফোন করত রহমানকে। আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম—দীনা, জেনারেল ম্যানেজার জানতে পারলে রহমানের চাকরি কিন্তু একদিনেই নট হয়ে যাবে। ঝাড়া একঘণ্টা টেলিফোনে গুজুরগুজুর ফুসুর ফুসুর করার মজা টের পাবে তখন।

এরই মাঝে একদিন বীথির টেলিফোন পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। আহ! বীথি! বীথি বলেছিল—তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। একটু দেরি হয়ে গেল অবশ্য। কিন্তু কি করব! মাত্র কালই শুনলাম তো।

আমি বীথির কথায় মজা পাচ্ছিলাম। তদ্দিনে অফিসে আমি দেড় মাসের পুরোনো হয়ে গেছি। এক ধরনের নতুন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে রোজকার মতো সেই নিয়মিত আড্ডায় যাওয়া হয় না আর। কিংবা গেলেও অল্পেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মনে হয়—কী আশ্চর্য! এদের সঙ্গে এই রকম অর্থহীন অলস জীবনযাপনে একসময় আমি কী করে যে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম! আমার মনে পড়ে, প্রথমবার মাইনে পেয়ে বাবার হাতে কড়কড়ে একশো টাকার পাঁচটা নোট তুলে দিলে তিনি প্রায় কেঁদে ফেলেছিলেন। মা আর বৌদির জন্যে নতুন শাড়ি কিনেছিলাম। বাবার জন্যে একজোড়া পাম্প স্যু। মা বলেছিলেন—এত সব খরচপত্র করার কী দরকার!

সেই প্রথম মনে হয়েছিল—সংসারে আমার নিজেরও একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা আছে। আমি বুঝতে পারছিলাম—বাড়িতে আমার জন্যে একটি পরিবর্তন ঘটছে।

দাদা বলছিলেন—পর্দার কাপড়-টাপড়গুলো অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। নতুন কাপড় কেনা দরকার। আর একটা সোফা সেট, অন্তত বেতের। তোর বন্ধু-বান্ধবরা এলে কোথায় বসতে দিবি।

আমার বন্ধু-বান্ধবদের আপ্যায়নের ব্যাপারে দাদা যে অতোখানি উদ্বিগ্ন সেই প্রথম জানতে পারলাম। বলা বাহুল্য, আমার হাতে তখন অত সব খরচপাতি করার মতো টাকা ছিল না। অতএব চেপে গেলাম।

মাস তিনেক পর অফিসে একটি ব্যাপার ঘটল। আমি আমার বস মিস্টার চৌধুরীকে বলেছিলাম—কিছু প্রোডাক্টসের প্যাকেজিং ডিজাইন অনেক পুরোনো হয়ে গেছে। মনে হয়, ডিজাইন আরও মডর্নি করা উচিত।

মিস্টার চৌধুরী বললেন—জেনারেল ম্যানেজার রাজি হবেন না। এটা আমাদের একটা ট্র্যাডিশনের ব্যাপার।

আমি বললাম—একটু চেষ্টা করে দেখবো স্যার ?

মিস্টার চৌধুরী বললেন—চেষ্টা করে দেখতে পারো কিন্তু তাতে কোনও লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না।

আমি এ নিয়ে রহমানের সঙ্গে আলাপ করলাম। রহমান তো প্রস্তাব শুনে লাফিয়ে উঠল। বললো—করতে পারলে খুব ভালো হয়।

এবার আমি নিজের উদ্যোগে এগিয়ে গেলাম। আমাদের পরিচিত এক কমার্শিয়াল ডিজাইনারকে দিয়ে কিছু নতুন ডিজাইন করালাম। তাতে একটু-আধটু আমার নিজের আইডিয়া আর মতও জুড়ে দিলাম সুযোগ মতো।

ডিজাইন আর প্রোপোজ্যাল দেখে জেনারেল ম্যানেজার বললেন, হেড অফিসের অ্যাপ্রুভ্যাল লাগবে।

হেড অফিস লিখল—ট্রায়াল হিসেবে করা যায়।

সবকিছু ঠিকঠাক করতে আরও প্রায় তিনমাস লেগে গেল। তারপর প্রথম একটি প্রোডাক্ট নতুন ডিজাইনের মোড়কে ছাড়া হলো বাজারে।

আর আশ্চর্য! দেখা গেল আমি যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি ভালো সাড়া পেলাম আমরা।

কিন্তু সে সব থাক। বরং এইবেলা একটু নিজের কথা বলি। বাড়িতে দু-একবার বিয়ের ব্যাপার নিয়ে কথা উঠল। আমি বললাম—এখন নয়।

রহমান বলল—ঠিকই করেছিস। খবরদার এখন একদম বিয়ে করবিনে। বিয়ে করলেই কিন্তু তোর গ্ল্যামার শেষ হয়ে গেল।

আমি বললাম—সেজন্যেই বুঝি দীনাকে খালি ঝুলিয়ে রেখেছিস।

রহমান হো হো করে হসে উঠল। বলল, কিসসু চিন্তা নেই। বড়লোকের মেয়ে। আমি না করলেও বিয়ের ওর অসুবিধে হবে না।

এর মাঝে দু-একবার টেলিফোন করেছিল বীথি। একথা সেকথার পর বলত, এবার একটা বিয়ে করে ফেল। বল তো আমি একটা মেয়ে দেখি তোমার জন্য।

আমি বলেছিলাম, ঠিক তোমার মতো একটি দেখতে পারো আমার জন্যে! (ডায়ালগ আর কী!)

আমার কথায় একটু চেপে গিয়েছিল বীথি। বলেছিল, আমার মতো নয়, আমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দরী মেয়ে দেখবো তোমার জন্যে।

আমি বলেছিলাম, সুন্দরী মেয়েদের আমার খুব ভয়। ওদের কথার কোনও ঠিক থাকে না।

বীথি একটু স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার কথায়।

আমি বলেছিলাম, ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ।

তখন খুব ধীরে সন্তর্পণে ওর টেলিফোন নামিয়ে রাখার স্পষ্ট ছবিটা আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম অনেক দূরে বসেও।

আমার খুব খারাপ লেখেছিল তখন। বীথিকে অই রকম একটা কথা বলা নিশ্চয়ই আমার উচিত হয় নি। কিন্তু আমি কী করব! আমিও তো মানুষ!

আমি একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম। পরমুহূর্তেই মিসেস সাবেথের কণ্ঠ ভেসে এসেছিল। দুবার ‘হ্যালো হ্যালো’ শোনার পর সম্বিত ফিরেছিল আমার। তারপর আমার সাড়া পেয়েই বলেছিলেন—প্লিজ হোল্ড অন। মিস্টার ব্রাউন ওয়ান্টস ইউ।

সেই আমার জীবন। এই রকম আমি বেঁচে আমি। এই এক বছরে অনেক পরিবর্তন হয়েছে আমার। মাঝে মাঝে তাই দর্পণে নিজেকে দেখে অবাক হই। সেই গোবেচারা শান্ত লোকটির পরিবর্তে যেন খুব স্মার্ট ধূর্ত একটি মানুষকে দেখি আমি এখন। অফিস-চাকরি-বাসা এই রকম একটি বৃত্তের মাঝে ধীরে ধীরে আমি সঙ্কুচিত হয়ে এসেছিলাম। অফিসে মিসেস সাবেথের সঙ্গে টেলিফোন হালকা রসিকতা করি।

এর মাঝে আমার বাবা আমাকে অনেক কবার বিয়ের কথা বলে হতাশ হয়েছেন। তাঁর মনোনীত পাত্রীদের কাউকে আমি পছন্দ করতে পারিনি। কেমন গ্রাম্য আর নির্বোধ বলে মনে হয় ওদের আমার। আমি খুব অবাক হয় ভাবি—ঠিক এই রকম সাধারণ, গ্রাম্য আর নির্বোধ বীথিকে কী করে আমি সহ্য করতাম একদিন!

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button