আর্কাইভগল্প

বাল্মীকি প্রতিভা

ছন্দা বিশ্বাস

পাইন দেওদারের ছায়াঘেরা পথ দিয়ে ক্রমশ চড়াইয়ে উঠতে লাগল ঋতসোম। পথ একেবারে খাড়া না হলেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল ঋতসোমের। টাইট জিন্স আর ফুল স্লিভ গেঞ্জি পরেও রীতিমতো ঘেমে যাচ্ছে। এই পথে মানুষ কিংবা আর কোনও জীবজন্তু নজরে পড়ল না। অপূর্ব এক নৈঃশব্দ্য বিরাজ করছে। পাইন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরে বরফে ঢাকা জাসকার আর ধৌলাধার পর্বতমালা। কফিনের  ভেতরে সুরক্ষিত মমির মতো দেখাচ্ছে। কিছুটা এগিয়ে যেতেই একটা বাউলি চোখে পড়ল। মনে পড়ে গেল যশপ্রীতের কথাগুলো। ব্যাচমেট যশপ্রীত দিল্লির ছেলে। এর আগে বেশ কয়েকবার বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে এসেছিল। ওর মুখেই জেনেছে এই বাউলিটাকে এখানকার মানুষ নাম দিয়েছে সুভাষ বাউলি। এক সময় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নাকি এখানে থাকাকালীন এই বাউলির জল পান করতেন। তাই এমন নামকরণ।

 ধীর পায়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে বাকরোটা হিলটপের দিকে। উপরে উঠে আবার নিচের দিকে নেমে গেছে। আর সেখানেই এর শেষতম বিন্দু। বাকরোটা হিলের এই জায়গাটিকে অনেকে বলে সুইসাইড পয়েন্ট। গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে শুধু বসে থাকতে হবে। রাস্তাটা সোজা গিয়ে একটা জায়গায় শেষ হয়েছে। আর তার পরেই গভীর খাদ! জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। কলেজ ইউনিভার্সিটি থেকে অনেকেই এখানে ঘুরতে আসে। তবে প্রান্তসীমা পর্যন্ত যায় না। মানে যেতে পারে না। সে এক গা ছমছমে অনুভূতি।

এই পাহাড়ের উপরে একটা ভিউ পয়েন্ট আছে। সেই ভিউ পয়েন্টে উঠলে চোখে পড়বে দূরের শৈলশিরা। পাহাড়ের গায়ে আঁকাবাঁকা পথ, ধাপে ধাপে পাইন বার্চের ঘন সন্নিবেশ। সবুজে ঢাকা উপত্যকাভূমি। শোনা যায় বিচিত্র প্রজাতির পাখির কলকাকলি। সামনেই অতলস্পর্শী গভীর গিরিখাদ। নিচের দিকে তাকিয়ে সেবার মাথা ঘুরে গিয়েছিল ঋতসোমের। যশপ্রীতকে বলেছিল এখান থেকে একবার পড়ে গেলে মৃত্যু সুনিশ্চিত।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে পাশের বন থেকে পাখির ডাক কানে এল ঋতসোমের। অন্য সময় হলে আশপাশ তাকিয়ে দেখত পাখিটাকে দেখা যায় কি না। আজ সেই উৎসাহটুকু হারিয়ে ফেলেছে। ঋতসোম হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিল তার ফেলে আসা জীবনের কথা। কীভাবে জীবন শুরু করেছিল, আর কী হয়ে গেল। উচ্চ মাধ্যমিকে এবং জয়েন্ট এন্ট্রান্সে আশানুরূপ সাফল্যের পর এখানে পড়তে এসে শুরুটা বেশ ভালোই কেটেছিল। ফার্স্ট সেমিস্টারে একটু র‌্যাগিং হলেও পরে সিনিয়ার দাদাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে সেটাই কাল হয়ে দাঁড়াল। যে ছেলেটা র‌্যাগড হয়ে বাড়ি ফিরে যাবার জন্যে মনস্থির করে ফেলেছিল এক সময়ে সেই ছেলেটা যে কীভাবে আস্তে আস্তে নিজেই একজন র‌্যাগিং মাস্টার হয়ে যাবে বুঝতে পারেনি। নিজের ওপরে এমন ঘৃণা আর কখনও হয়নি।

সেদিন কয়েকজন সিনিয়র দাদার সঙ্গে ঋতসোমও ছিল। ওদেরই দুই বছরের জুনিয়র একটি ছেলেকে সেদিন ক্যাম্পাসের ভেতরে একটা উঁচু গাছে উঠতে বলেছিল। ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে জানিয়েছিল সে কোনও দিন গাছে ওঠেনি। গাছে কীভাবে চড়তে হয় সে জানে না।

ঋতসোমের দলের ছেলেরা হো হো করে হেসে বলেছিল, উঠিসনি তো কী হয়েছে ? আজ উঠে দেখা। ওঠ, নইলে এর পরের ধাপ পেরোবি কী করে ?

রাত তখন প্রায় দুটো বাজে। ছেলেটা হাতে পায়ে কত কাকুতি মিনতি করেছিল ওদের। কিন্তু ওরা তখন একেবারে ড্র্যাঙ্কড অবস্থায় ছিল। ওদের ভেতরে একটা ছেলে এসে সেই জুনিয়র ছেলেটির মুখে কিছুটা মদ ঢেলে দিয়ে বলল, ‘খা, খা, খেয়ে নিয়ে দেখ, এবারে পারবি।’

বাধ্য হয়ে ছেলেটা হ্যাঁচোড় প্যাঁচোড় করে বুকে ঘষে, ডালে পা বাঁধিয়ে হাত দিয়ে উপরের ডাল ধরে কোনও মতে উঠতে লাগল। রাগিংয়ের দলের একজন বলল,’ ওঠ্, দেখ্ আমরা ভিডিও করছি। পরে তোকে দেখাব। এই তো কী সুন্দর তুই গাছে উঠছিস, আবার বলছিস পারিস না ?’

কোনওমতে একটা ডাল ধরে কিছুটা উঠে একটু দাঁড়াতেই অন্যেরা চীৎকার করে উঠল, ‘কীরে ওঠ, ওইটুকু উঠলে হবে ?’

‘আর পারব না গো, মনে হচ্ছে আমি এবারে পড়ে যাব। আমার হাত পা কাঁপছে। আমার সত্যি এবার ভয় করছে।’

এর উপরের ডালটা বেশ খানিকটা উঁচুতে।

ছেলেগুলো একসঙ্গে বলে উঠল ওই ডাল পর্যন্ত উঠলেই তোকে ছেড়ে দেওয়া হবে, ওঠ।

ছেলেটা চুপটি করে ডাল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। একজন বললে, নেমে আয়। এর চাইতে তোর চোখে চারশ পাওয়ারের ল্যাম্প  ধরলেই তোর উচিত শিক্ষা হবে।

ছেলেটা শিউরে উঠল। ও শুনেছে চোখে বাল্ব ধরে রাখলে ও সারাজীবনের মতো অন্ধ হয়ে যাবে। এর আগে একটি ছেলে ওই একইভাবে সারাজীবনের মতো অন্ধ হয়ে গেল। ভয়ে ওর বুকের  ভেতর থরথর করে কাঁপতে লাগল।

ছেলেটা এরপর পড়ি মরি করে উঁচু ডালে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে হাত পিছলে মাটিতে পড়ে যায়।

সর্বনাশ!

ছেলেটার মাথা ফেটে তখন গলগলিয়ে রক্ত ঝরছে। অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে মাটিতে।

ঋতসোমরাই ছেলেটাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ছেলেটার অবস্থা খুবই সংকটজনক।

যদি মারা যায় তাহলে খুনের দায়ে ওদের জেলহাজত বাস হয়ে যাবে।

পুরো লাইফটা বরবাদ হয়ে যাবে।

ঋতসোম ‘আঃ’ বলে চীৎকার করে ওঠে। অন্যমনস্কতা বশত এবড়ো খেবড়ো পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খেল। আর একটু হলে ও পড়েই যেত। ডানদিক ক্রমশ ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছে ভেবে হঠাৎ যেমন ভালো লাগল ঠিক তেমনি মনটা গভীর বিষণ্নতায় ভরে উঠল। খুব ছেলেবেলার একটা গল্পের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় এই অস্থির সময়ের ভেতরেও হাসি পেয়ে গেল। গল্পটা ওর এক মামা বলেছিলেন। খুবই রসিক মানুষ ছিলেন। গল্পটা ছিল এই রকম, একজন মানুষ সুইসাইড করতে যাচ্ছে ভোর চারটেয় যে ফার্স্ট ট্রেনটা যাবে সেই ট্রেনে গলা দিতে। তার হাতে একটা হ্যারিকেন। লোকটা আবার মিথ্যে কথা বলতে পারে না । তো রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ে ওদের পাড়ার একজন খবরের কাগজ বিক্রেতার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। সেও চলেছে প্রথম যে ট্রেনটা কলকাতা থেকে আসবে সেই ট্রেন থেকে পেপার সংগ্রহ করতে। সেই পেপারওয়ালা হ্যারিকেন-হাতে  লোকটিকে বললে,  ‘কী হে, তুমি এখন আবার কোথায় চললে ?’

লোকটা বিষণ্ন মুখে জানায়, তার মনে খুব দুঃখ। তাই সে মনের দুঃখে ট্রেনের তলায় গলা দিতে যাচ্ছে। একটু বাদেই যে লোকাল ট্রেনটা আসবে সেটাতেই―

‘তা তোমার হাতে হ্যারিকেন কেন ?’

‘এই বর্ষাকালে যদি পথে যেতে যেতে সাপে ছোবল দেয় ?’

‘তা দিলে কী হবে ? তুমি তো সুইসাইড করতেই যাচ্ছ ?’

‘না, মানে, আমি তো―’

সোম আবার সেদিনের কথায় ফিরে এল। এরপর র‌্যাগিং এ অভিযুক্ত অপরাধী সাব্যস্ত করে সিনিয়র ছেলেদের সাথে ওকেও কলেজ থেকে বহিষ্কারের নোটিশ ধরিয়ে দিলেন প্রিন্সিপাল। 

বাড়িতেও নাকি চিঠি পাঠানো হয়েছে। গার্জেনদের কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল ঋতসোম। চিন্তাপূর্ণী মাতার মন্দির থেকে ঘণ্টার ধ্বনি শুনতে পেল। বন্ধুদের মুখে শুনেছিল এখানে সতীর পা পড়েছিল। দেবী এখানে ছিন্নমস্তা রূপে পূজিতা হন। এখানে যে যা মানত করে তাই নাকি ফলে যায়। কথাটা মাকে বলায় মা এবারে আসার সময়ে ওর হাতে একশ টাকার নোট দিয়ে বলেছিল, মনে করে মন্দিরে গিয়ে একদিন পূজা দিস। আমি এখান থেকেই মাকে প্রণাম জানাচ্ছি। আর যদি কখনও মা সদয় হন তো আমি নিজে গিয়ে তাঁকে পূজা দিয়ে আসব।

মায়ের কথা রাখতে পারছে না ভেবে মনটা হঠাৎ কেমন দুর্বল হয়ে পড়ল।

না, এমন হলে তো চলবে না। ও কিছুতেই দুর্বল হবে না। মনটাকে শক্ত করল ঋতসোম। ডান দিকে পাহাড়ের ঢালে কয়েকজন মেষ পালক বালক দেখতে পেল। এত উঁচুতে সাধারণত কেউই আসে না। ঋতসোম তাকিয়ে দেখল ও অনেকটা ওপরে চলে এসেছে।

আর খুব বেশি দূরে নয় ওর গন্তব্যস্থল। ডানদিকে বাঁক নিয়ে খাড়া উপরের দিকে কিছুটা উঠে আবার নিচেয় নেমে কিছুটা গেলেই সেই মৃত্যুরেখা।

আনমনে খাদের ধার বরাবর এখন হাঁটছে ঋতসোম। রাতের পর রাত বিনিদ্র রজনী কাটিয়ে এখন সে বিধ্বস্ত। এমন টলমলো পায়ে হাঁটছে যে, যে-কোনও মুহূর্তে গভীর খাদে পড়ে যেতে পারে।

ঠিক এমন এক বিপদ মুহূর্তে হঠাৎ কে যেন  পেছন দিক থেকে ওর হাতটা চেপে ধরল।

ঋতসোম চমকে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল লাল চেলি কপালে সিঁদুরের টিপ পরা একজন সাধু পুরুষ তার পাশে।

সাধুবাবার হাতে ত্রিশূল, একমাথা শাদা চুল মাথার ওপরে চূড়ো করে বাঁধা। তাঁর বুক পর্যন্ত লম্বা দাড়ি।

ঋতসোমের মনে হলো সাধুবাবাকে এর আগে কোথায় যেন দেখেছে।

মনে মনে ভাবে, ইনি ভুলওয়ানী মাতার মন্দিরের সেই সাধুবাবা নন তো ? ভুল করে যে এ পথে আসে তাকে তিনি তাঁর মন্দিরে নিয়ে যান। একটু আগেই এখানে আসার পথে বাম দিকে মন্দিরটা রেখে এল সে।

‘কী রে, কী ভাবছিস ?’

সাধুবাবা চোখের ইশারায় জানতে চান।

সাধুবাবার চোখের দিকে তাকাতেই ওর দুই চোখে কেমন যেন ঘোর লেগে গেল। কী দীপ্তি সেই চোখে।

বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না ঋতসোম।

দুই

দুইদিন বাদেই কলেজে অনুষ্ঠান আছে। বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠান। এবারে ওদের ইনস্টিটিউশন থেকে সেদিন দুইজন বিশিষ্ট মানুষকে সাম্মানিক ডি লিট প্রদান করা হবে। একজন হলেন প্রখ্যাত ক্রীড়াবিদ এবং অন্যজন হলেন একজন বিখ্যাত লেখক। তাঁর লেখা বেশ কিছু উপন্যাস এবং গল্প অবলম্বনে নাটক এবং চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে মিডিয়ার লোকেরা কলেজে আনাগোনা করছে। লেখককে নিয়েই তাদের বেশি উত্তেজনা।

গত মাসে মাকে কথাটা বলাতে মা বলল, ‘টিকিট কেটে দে, আমি থাকব তোদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে।’

সেই মতো ঋতসোম ফ্লাইটের টিকিট কেটে দিয়েছে মাস খানেক আগেই ।

আর এর ভেতরেই ঋতসোমের জীবনে ঘটে গেল চরম সর্বনাশ! এখন মায়ের কাছে মুখ দেখাবে কী করে! সারাজীবন যে র‌্যাগিং ব্যাপারটাকে ঘৃণা করে এসেছে সেই কিনা একটি ছেলেকে মৃত্যুপথযাত্রী করে তুলল ?

কথাটা যতবার ভাবছে ততই ওর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা হারিয়ে যাচ্ছে। ও র‌্যাগিং না করলেও সেই দলে ছিল। দলের সকলকে কলেজ থেকে বহিষ্কারের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ওর জীবনটাই একেবারে বরবাদ হয়ে গেল। কত আশা নিয়ে বাড়ি থেকে তাকে এখানে পড়তে পাঠানো হয়েছিল। কত গর্ব মা বাবার মনে। এমতাবস্থায় ও কিছুতেই মায়ের সামনে দাঁড়াতে পারবে না।

একটা এলোপাতাড়ি ঝড় তোলপাড় করে দিচ্ছে সব কিছু।

ঋতসোম ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। ওদের হোস্টেল-ক্যান্টিন থেকে রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে।

ঋতসোমের আজ কেন জানি খুব ছোটোবেলার কথা মনে পড়ছে। তখনও বেশ ছোট। রাঘব মামা বাংলাদেশ থেকে আসার সময়ে কচ্ছপের মাংস আর কাঁকড়ার ঘিলুর বড়া নিয়ে আসত। খুব ভালোবাসত ওকে রাঘব মামা। রাঘব মামা ওদের বাড়িতে ঢোকার আগেই ‘সো―ম’ বলে চীৎকার করত রাস্তা থেকে।

এই ডাকটা এখন কানে বাজছে।

ছোট্ট কুকুর ছানার মতো সোম সারাটাদিন রাঘব মামার  পেছন পেছন ঘুরে বেড়াত। মনে আছে রাঘব মামা ওদের বাড়িতে ঢুকে একেবারে মায়ের কাছে চলে যেত। তারপর ব্যাগ খুলে তার ভেতর থেকে কতকগুলো কাপড়ের পুটুলি বের করে বলত, ‘দেখ তো দিদি, মা কী পাঠিয়ে দিল ?’

মা পরম যত্নে সেই পুটুলি খুলে তার ভেতর থেকে এক একটা জিনিস বের করে আনত আর নাকে ঘ্রাণ নিতে নিতে বলত, ‘কতদিন বাদে যে জেঠিমার হাতের রান্না খাবো।’

নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, পিঠে পুলির পুটুলিগুলো খুলে দেখতে দেখতে মা একের পর এক প্রশ্ন করে যেত।

মামার মুখে সে কত গল্প। মা একটা প্রশ্ন করছে আর মামা উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। কথা যেন শেষই হতে চায় না।

মা বাপের বাড়ির কথা শুনতে শুনতে কখনও আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নিত। মা দেখতাম সেই পুটুলিগুলো থেকে খুব অল্প পরিমাণে কিছু কিছু জিনিস বের করে আবার সেগুলো গুছিয়ে বেঁধে রাঘবের হাতে দিয়ে বলত, ‘আর দেরী করিস না ভাই, নীলুর হাতে দে। কখন বেরিয়েছিস খাবারগুলো নইলে নষ্ট হয়ে যাবে।’

রাঘব মামা মুখ গম্ভীর করে বলত, ‘কী করছ কি দিদি, এগুলো রাখো তো, আমি সামনের বার যখন আসব তখন আবার নিয়ে আসব। এগুলো মা তোমাদের জন্যেই পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি তো মাঝে মধ্যেই আসছি। তখন নীলুদিদের জন্যে নিয়ে আসব।’

মা তাও জোর করে রাঘব মামার হাতে তুলে দিতে দিতে বলত, ‘ওর বাচ্চারা খেলেও সে আমারই সুখ। ওরা কি আমার পর ? এই তো আমি রাখলাম। এতেই হয়ে যাবে।’

রাঘব মামা বলল, ‘সন্ধ্যের সময়ে আসব। দাদাবাবুকে বলে রেখো আমি আজ  রাতে এখানে খাব।’

সোম অনেক বড় হয়ে জেনেছিল রাঘবমামা ওর  নিজের মামা নন। নীলু মাসির আপন ভাই হলো রাঘব মামা। ওদের পাশের পাড়াতে থাকে নীলু মাসিরা। বাংলাদেশে মা আর নীলু মাসিরা পাশাপাশি থাকত, ঋতসোমের মায়ের প্রতিবেশি কিন্তু খুব ভালো সম্পর্ক। ঋতসোমের দিদা আর নীলু মাসির মা সই পাতিয়েছিল। নীলু মাসি আর রাঘব মামার মাকে ঋতসোমের মা জেঠিমা বলেই ডাকত। বিয়ের পরে ঋতসোমের বাবা মা এদেশে চলে এলে কয়েক বছর বাদে নীলু মাসিরাও এদেশে চলে আসে। ঋতসোমের নিজের কোনও মামা না থাকায় রাঘব মামাকেই মা ভাইফোঁটা দিত। ঋতসোমের ভাবতে বেশ ভালো লাগত, রাঘবমামা সকালে বাংলাদেশ থেকে প্রাতঃরাশ খেয়ে বের হতো আর এদেশে এসে দুপুরের ভাত খেত। মনে আছে খুব ছোটবেলায় শীতকালে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে যখন ভোকাট্টা হয়ে যেত এবং অনেক উঁচুতে উঠে পুব আকাশের দিকে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে দূরে বহুদূরে উড়ে চলে যেত। ঋতসোমের তখন কেন জানি মনে হতো ঘুড়িটা বুঝি রাঘবমামার কাছে চলে যাচ্ছে। একটা চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলে ভালো হতো।

ঋতসোমের খুব বাংলাদেশ কেমন দেখতে যেতে ইচ্ছা করে।

মা বলেছে আগে একটা চাকরি হোক, তারপর ওদেশে ঘুরে আসব।

কানাঘুষোয় শুনতে পেত রাঘব মামার কোনও পাসপোর্ট লাগে না। ‘পলানো পথে’ যখন খুশি চলে আসত মামা। এদেশে মামা অনেক সেবামূলক কাজের সঙ্গে জড়িত ছিল। একট অনাথ আশ্রম চালাত। গরিব দুখীর প্রতি মামার বরাবর খুব টান ছিল। কেউ কিছু চাইলে তিনি কখনও না করতেন না। মার মুখে শুনত ও দেশেও মামা গরিব মানুষদের নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। কিন্তু কিছুদিন হলো রাঘবমামার কাজকে সরকার কুনজরে দেখছে। রাঘবমামার ওপরে পুলিশের নজর পড়েছে। কোত্থেকে এই টাকা-পয়সা জোগাড় করছে সেই ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে শুরু করে দিয়েছে। রাঘবমামার বাবাকে রাজাকারেরা মেরে ফেলেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে। অনেকেরই চাপা রাগ আছে রাঘবমামাদের পরিবারের ওপরে।

মনে পড়ছে অনেক বছর আগের একটা দিনের কথা। তখন গ্রীষ্মকাল। টানা লোডশেডিং চলছে সন্ধ্যে থেকে। গরমে ঘরের ভেতরে থাকা যাচ্ছে না দেখে মা উঠোনে মাদুর পেতে দিলে ওর দাদা আর দিদি পড়তে শুরু করে দিল হ্যারিকেনের আলোয়।

দিদির ক্লাস টেন আর দাদা নাইনে পড়ত তখন। সোম তখন খুবই ছোট। তবে বেশ মনে আছে দাদা জোরে জোরে পড়ত, … অচেনার আনন্দকে পেতে হলে পৃথিবী ঘোরার প্রয়োজন নেই, …

‘দৌড় দৌড় দৌড় জীবনে এই প্রথম বাঁধাহীন গণ্ডিহীন, মুক্তির উল্লাসে তাহাদের তাজা তরুণ হৃদয় তখন মাতিয়া উঠিয়াছিল। পরে কী হইবে তাহা ভাবিবার অবসর কথায় ? ’

আর দিদি দুলে দুলে পড়ত, ‘…তুষের আগুন প্রথমে যেমন যেমন ধিকিধিকি তারপর ধু-ধু করে জ্বলে ওঠে, তেমনি গোহের পর থেকে রাজপুতদের ওপরে ভিলদের রাগ ক্রমে ক্রমে অল্পে অল্পে বাড়তে বাড়তে একদিন দাউ দাউ করে পাহাড়ে পাহাড়ে বনে বনে দাবানলের মতো জ্বলে উঠল …’

হঠাৎ সবার পড়া থেমে গিয়ে রেডিওর সংবাদে কান খাড়া হয়ে গেছে। দিল্লির সংবাদ পড়ছেন বিভা নাগ। বাংলাদেশের একজন কুখ্যাত খুনির মাথার দাম ধার্য করা হয়েছে এক লক্ষ টাকা। জীবিত ধরে দিতে পারলে তাকে এই পুরস্কার দেওয়া হবে। বেশ কিছু ব্যাংক ডাকাতি, তোলাবাজি এবং কয়েকজন ব্যবসায়ী খুনের সঙ্গে সে জড়িত। গোয়েন্দা পুলিশ অনুমান করছে সেই খুনি নাকি বর্তমানে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।

ঋতসোম সেই সময়ে কুমড়ো ডগার ভেতরে জোনাকি পোকা ধরে ধরে ভরে রাখছিল। খবরটা শুনে ওর বুকের ভিতর কেঁপে ওঠে। ও এক ছুটে মায়ের কাছে চলে আসে। মা তখন রাতের রান্নায় ব্যস্ত। ঋতসোম মার গা ঘেঁষে বসে পড়ল ।

‘কিরে, কী হয়েছে ?’

‘না কিছু না।’

ঋতসোম চপ করে থাকে।

হঠাৎ কোত্থেকে রাঘব মামা প্রায় হুংকার দিয়ে ‘সোম’ বলে উঠানে এসে দাঁড়াল।

রাঘবমামার এমন হঠাৎ আবির্ভাবে দাদা দিদি দুজনেই ‘বাবা গো’ বলে চীৎকার করে ওঠে।

হয়তো সংবাদটা শুনে তারাও আমার মতোই ভীত হয়ে পড়েছিল।

রাঘবমামা দাদার পিঠে জোরসে চড় দিয়ে বলল, ‘কী রে ব্যাটা, হঠাৎ ভয় পেলি কেন ?’

মা রাঘব মামার গলা শুনে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এল। অস্পষ্ট আলোয় দেখল রাঘবমামার  পেছনে সতেরো আঠারো বছরের একটি মেয়ে। হ্যারিকেনের আলোতে খুব ভালো করে মেয়েটার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মাটির দিকে মুখ করে সে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল।

রাঘব মামা একটু এগিয়ে এসে মাকে একপাশে নিয়ে খুব নিচু গলায় কিছু বলছে।

কী বলল সেটা ঋতসোম বুঝতে পারল না। শুধু এইটুকুই বুঝল বেশ তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা।

মা মেয়েটির হাত ধরে তাকে  ঘরে নিয়ে গেল। এরপর মা বাবার সঙ্গে কথা বলল। বাড়িতে একটা থমথমে ভাব।

খানিকটা সময় পরে দেখি নীলু মাসি আমাদের বাড়িতে এল। রাঘব মামা ঘরের ভেতরে অস্থিরভাবে পায়চারী করতে লাগল। মা আর নীলু মাসি দুজনে কী যেন শলাপরামর্শ করে বাবার সঙ্গে কথা বলল। আধো আলোছায়ায় ঘরের  ভেতরে মা, বাবা নীলু মাসি আর রাঘব মামাকে ভূতের মতোই দেখাচ্ছিল। খুব গুরুগম্ভীর আলোচনা চলছে সেটা সোম বুঝতে পারছে।

সোমের মনে আছে সেই রাতে মা আলমারি থেকে একটি নতুন শাড়ি বের করে মেয়েটিকে পরতে বলল। ঘরে মার একজোড়া নতুন শাঁখা রাখা ছিল। সরু শাঁখাজোড়া মা কিছুদিন আগেই শাঁখারীর কাছ থেকে কিনেছিল। পরা হয়নি। সেই শাঁখা জোড়া নীলু মাসির হাতে দিয়ে বলল, ওকে পরিয়ে দে।

তারপর নিজের হাত থেকে দুটি সোনার চুড়ি খুলে মেয়েটির হাতে পরিয়ে দিয়ে বলল, ‘স্বয়ংসিদ্ধা হতে হবে তোমায়।’

মেয়েটির চোখ তখন জোয়ারের নদী।

সেই রাতে মা আর নীলু মাসি রাঘবমামার সঙ্গে সেই মেয়েটার বিয়ে দিল। মা নিজের রূপোর সিঁদুরের কৌটো রাঘব মামার হাতে তলে দিয়ে বলল, ‘নে, ওকে সিঁদুর পরিয়ে দে।’

কোনও রকম শঙ্খধ্বনি ছাড়াই সামান্য নিচু গলায় উলুধ্বনিতে রাঘব মামার বিয়ে হয়ে গেল।

রাঘব মামা নিজের হাতে মেয়েটার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে দিলে ।

ঘরের ভিতরে এই ঘটনা চলছে আর উঠোন থেকে সোম দিদির পড়া শুনতে পাচ্ছে, ‘… সে রাত্রি কী ভয়ানক রাত্রি! সেই মালিয়া পাহাড়ের ওপরে অসংখ্য ভিল আর নিচেয় গুটিকতক রাজপুত প্রাণপণে যুদ্ধ করতে লাগল … ’

ঋতসোমের মা আঁচলের তলা থেকে নীলু মাসির হাতে একটা কাগজে মোড়া ক্যাপ ফাটানো বন্দুকের মতো কী যেন ধরিয়ে দিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলল, ‘ওটাকে আজ রাতেই মাটিতে পুঁতে রাখিস। খবরদার কেউ যেন টের না পায়।’

ভোর রাতে ঋতসোমের বাবা টর্চ হাতে রাঘব মামা আর সেই মেয়েটিকে চুপিচুপি স্টেশনে নিয়ে চললেন। মা ঠায় সেই ভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল।

ফার্স্ট লোকাল ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে গেলে বাবা ফিরে এলেন।

মা ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে, ‘রাস্তায় কারও সঙ্গে দেখা হয়নি তো ?’

বাবা জোর গলায় বলেছিল, ‘দেখা হলেই বা কী ? মানুষের বাড়িতে কী আত্মীয়-স্বজন কেউ বেড়াতে আসে না ?’

সোম অনেক বড় হয়ে জেনেছিল, রাঘব মামাকে ওদেশে ‘রবিন হুড’ বলে ডাকত। যে কি না বড়লোকদের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে গরিব দুঃখীদের দান করত।

তিন

সাধুবাবা ঋতসোমকে তাঁর মন্দিরে নিয়ে এলেন। পাহাড়ের ওপরে পাইন দেবদারুর ছায়ায় ছোটখাটো একটি মন্দির। মন্দিরের  পেছনে কাঠের একটি বাড়ি। সম্ভবত সাধুবাবার। সাধুবাবা ওকে মন্দিরের চাতালে বসিয়ে রেখে ঘরে গেলেন। ঋতসোম তাকিয়ে আছে সাধুবাবার দিকে।

সাধুবাবা ফিরে এলেন একটি তামার পাত্রে বেশ কিছু শুকনো ফল, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে। ঋতসোমের সামনে এনে বললেন, ‘খেয়ে নে। দেখে মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ অভুক্ত আছিস।’

ঋতসোম এক বুক শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলে, ‘আমি কিছু খাব না। আমার কিছুই ভালো লাগছে না সাধুবাবা। আমি তো মরে যেতে চেয়েছিলাম। আপনি কেন আমায় ফিরিয়ে আনলেন ?’

কথাটা বলতে বলতে ঋতসোমের দুই চোখ জলে ভরে উঠল।

সাধুবাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘খা, ভুলওয়ানী মায়ের প্রসাদ খা, খেয়ে দেখ, সব দুঃখ সেরে যাবে। উদর পূর্ণ তো মস্তিষ্ক শূন্য।’

ঋতসোম আস্তে আস্তে প্রসাদটুকু খেয়ে পাশে রাখা পিতলের ঘটি থেকে জল খেয়ে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল।

সেই অবসরে সাধুবাবা একটু নিচের দিকে গিয়েছিলেন। ফিরে এলেন একদল শিশুর সঙ্গে করে। তারপর ঋতসোমের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোথায় তোর বাড়ি ?’

‘ওয়েস্ট বেঙ্গল।’

‘ওয়েস্ট বেঙ্গলের কোথায় ?’

এবারে সাধুবাবা ভাঙা ভাঙা হিন্দি বাংলা মিশিয়ে কথা বলতে লাগলেন। ঋতসোম বললেন, ‘আপনি কখনও ওয়েস্ট বেঙ্গল গিয়েছেন ?’

‘হ্যাঁ, ওয়েস্ট বেঙ্গল গিয়েছি, তারাপীঠ থেকেছি, আসামের কামরূপ কামাখ্যা গিয়েছি, কামাখ্যা তো আমার সাধন ক্ষেত্র ছিল একটা সময়ে। আরও কত জায়গায় যে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছি তার কোনও ঠিক ঠিকানা নেই।’

এরপর সাধুবাবা ঋতসোমের কাছ থেকে সমস্ত কথা শুনলেন। কীভাবে সে জড়িয়ে পড়ল রাগিংয়ের সঙ্গে।

সাধুবাবাকে কথাগুলো বলে এখন ওর অনেকটা নির্ভার লাগছে। অনেকটা হাল্কা মনে হচ্ছে। ও পায়ে পায়ে মন্দিরের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছে। কী শান্ত পরিবেশ। কত পাখি গাছে উড়ে বেড়াচ্ছে। কাছেই একটা ঝরনা থেকে জল পড়ছে। সাধুবাবা বললেন, আজ তুই আমার এখানে থাক। কাল সকালে আমি নিজেই তোকে হোস্টেলে নিয়ে যাব।’

এরপর সাধুবাবা ঋতসোমকে ওনার ঘরে নিয়ে গেলেন। ঋতসোম দেখল সাধুবাবার ঘরভর্তি বই।

‘এ সব বই আপনি পড়েন ?’

সাধুবাবা মৃদু হাসলেন।

বেলা পড়ে এসেছে। সাধুবাবা বাচ্চাদের নিয়ে চললেন একটা আশ্রমে। ঋতসোমও আছে তাদের দলে।

আমের সামনে দুটি কাঠের সঙ্গে লাগানো একটি সাইন বোর্ডে লেখা আছে  ‘লিটল হেভেন’।

ঋতসোম বুঝতে পারল এটি একটি অনাথ আশ্রম। সাধুবাবাই এদের দায়িত্বে আছেন। অবশ্য আরও দুজন লোক রাখা আছে এদের দেখভাল করার জন্যে। 

সাধুবাবা জানালেন, ‘এই সব অনাথ শিশুদের নিয়েই তাঁর জীবন। আর ওই বইপত্তর এবং মন্দির।’

রাতে অনেক ক্ষণ গল্প হলো সাধুবাবার সঙ্গে। ঋতসোম ওর যেটুকু বুদ্ধি তা থেকে বুঝতে পারল মানুষটা অগাধ জ্ঞানের অধিকারী। রাতে খিচুড়ি ভোগ খেয়ে শুয়ে পড়ল ঋতসোম।

বেশ ফ্রেশ একটা ঘুম হলো।

সাধুবাবা বললেন, ‘এখন কোথায় যাবে, হোস্টেলে ?’

‘ভাবছি।’

‘হোস্টেলে ফিরে যাও। আর ভুলেও মৃত্যুচিন্তা করবে না। নতুন উদ্যমে পড়তে শুরু করো। পেছনের দিকে তাকাবে না। আমি তোমাদের কলেজ-অধ্যক্ষের সঙ্গে কাল রাতে কথা বলেছি। হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট আমার বিশেষ বন্ধু। ওনাকেও তোমার কথা বললাম। কোনও রকম অসুবিধা হবে না।’

‘কিন্তু আমার একটা বছর যে নষ্ট হয়ে গেল।’

‘নষ্ট কাকে বলছ ? মনে করো এক বছর বাদে তুমি জন্মেছ। তোমার জন্মান্তর ঘটেছে। অতীত চিন্তা করে বোকারা। তুমি সামনে দিকে এগিয়ে যাও। মানুষ একদিন তোমার সমস্ত পাপ সব অপরাধের কথা ভুলে যাবে। শুধু মনে রাখবে তোমার বর্তমান এবং তোমার ভবিষ্যৎকে। আমি জেনেছি, তোমাদের কেরিয়ারের কথা ভেবেই কলেজ কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাস্টিকেট না করে এই বছর পরীক্ষা দিতে দেবেন না। হ্যাঁ তোমাদের কঠোর সাজা হতো যদি ছেলেটা মারা যেতো।

ভুল করেছ, বড় ভুল। এই ভুল থেকে তোমায় শিক্ষা নিতে হবে।

গভীর একাগ্রতা নিয়ে কঠোর তপস্যা শুরু করে দিতে হবে। আর সেই তপস্যা হলো পড়াশুনা। জানোই তো, ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ।’

চার

এয়ারপোর্ট থেকে মাকে নিয়ে এসেছে ঋতসোম। মাকে ও নিজে থেকে কিছুই বলবে না ভাবছে। পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে তখন বুঝিয়ে বলা যাবে।

ওদের ইউনিভার্সিটি চত্বর আজ সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। লাইন দিয়ে একের পর এক কত গাড়ি আসছে। কত বিশিষ্ট জনের আজ আসার কথা আছে।

সকাল থেকেই নানান অনুষ্ঠান চলছে।

মাকে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ওদের গেস্ট রুমে নিয়ে এল। আগে থেকে বুক করতে হয় এটা। সাধারণত অবিভাবকেরা এলে এখানেই থাকেন। সামনেই সবুজ লন, গার্ডেন। সেখানে নানান মরসুমি ফুলের শোভা। মা খুব খুশি হলো এই পরিবেশ দেখে।

ঋতসোম মাকে বলল তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিতে। কিছু খেয়ে তারপরে ওদের অডিটরিয়াম হলে ঢুকে যাবে। চার হাজার আসন আছে অডিটরিয়ামে। সামনের দিকে না বসলে ভালো করে প্রোগ্রাম দেখা যাবে না।

মা আজ জারুল রঙ্গের ঢাকাই জামদানি পরেছে। অনেকেরই বাবা মা এসেছেন।

এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে কলেজের ছেলেমেয়েরা অতিথিদের গেট থেকে বরণ করে নিয়ে এল। ফুল চন্দন পুষ্প স্তবক দিয়ে তাদেরকে অভ্যর্থনা জানানো হলো।

মঞ্চে পরপর সব বিশিষ্টজনেরা বসে আছেন। আছেন রাজ্যের গভর্নর, শিক্ষামন্ত্রী, মেয়র ছাড়াও অন্যান্য ইউনিভার্সিটির বিখ্যাত সব পণ্ডিতপ্রবর।

ঋতসোম মাকে সঙ্গে করে অডিটরিয়াম হলে ঢুকল। একটু পেছনের দিকে জায়গা পেল ওরা।

যাই হোক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। এক এক করে সকলে বক্তব্য রাখছেন।

ঋতসোম কিছুক্ষণের জন্যে বেশ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল।

হঠাৎ ওর সম্বিৎ ফেরে এক চেনা কণ্ঠস্বরে। মাইক্রোফোনের সামনে গম গম করছে তাঁর কথাগুলো।

কী অপূর্ব বাচন-ভঙ্গি। চোখ বন্ধ করলে মনে হয় গভীর সমুদ্র থেকে উঠে আসা এক মন্ত্রধ্বনি!

ঋতসোম মঞ্চের দিকে তাকিয়ে দেখে রীতিমতো বিস্মিত হল। দেখল ডায়াসে বক্তব্য রাখছেন সেই ভুলওয়ানী মাতার মন্দিরের সাধুবাবা।

ঋতসোমের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘সাধুবাবা!’

মা পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কে, সাধুবাবা ? ইনি ?’

ঋতসোম মাথা নাড়ে।

‘ইনি হলেন এই মুহূর্তে আমাদের দেশের নামকরা একজন সাহিত্যিক। এনাকেই আজ সাম্মানিক ডি লিট প্রদান করা হবে।’

এই যে এই মাত্র সঞ্চালক বললেন।

মায়ের কথায় ঋতসোমের আর এক প্রস্থ চমক লাগে।

ও কী চোখে ঠিক দেখছে ? নাকি অন্য কেউ ?

উপস্থিত সকলে মুগ্ধ হলেন তাঁর বক্তব্য শুনে।

অনুষ্ঠান শেষ হবার আগেই ঋতসোম মাকে নিয়ে বেরিয়ে এল।

বাইরে এসে দেখল সেই সাধুবাবা দাঁড়িয়ে অন্য একজনের সঙ্গে কথা বলছেন।

ঋতসোম অদূরে অপেক্ষা করতে লাগল।

কথা বলা শেষ হলে ঋতসোম এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আপনি যে এত বড় একজন সাহিত্যিক, সত্যিই জানতাম না।’

কথাটা বলে ও সাধুবাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

সাধুবাবা বললেন, ‘তোমার সঙ্গে একজন মহিলাকে দেখছি উনি কি তোমার মা ?’

‘হ্যাঁ, আজই এসেছেন।’

‘থাকবেন তো ?’

‘হ্যাঁ, এই সপ্তাহটা। রবিবার চলে যাবেন।’

‘ঠিক আছে। তুমি মাকে নিয়ে আমার আশ্রমে এসো, কেমন ?’

সাধুবাবা কয়েক পা এগিয়ে যেতেই একটি দামি গাড়ি তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল।

সাধুবাবা সেই গাড়িতে উঠে বসলেন।

ঋতসোম শিশুর মতো অবাক চোখে সাধুবাবার গমন-দৃশ্য দেখতে লাগল।

পাঁচ

আজ মঙ্গলবার। মাকে সঙ্গে করে ঋতসোম বেরিয়ে পড়ল। আশপাশের বেশ কয়েকটা দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে দেখাবে। তারপর বিকেলের দিকে সাধুবাবার মন্দিরে যাবে।

ঋতসোমের এখনও চোখে ঘর লেগে আছে যেন। ও কিছুতেই মেলাতে পারছে না সাধুবাবা এত বড় একজন সাহিত্যিক ?

তবে ওনার বিপুল বইয়ের ভাণ্ডার যদি নিজে চোখে না দেখত তাহলে আরও বেশি আশ্চর্য হতো।

মানুষের ভিতরে যে কত রকম প্রতিভা লুকিয়ে থাকে, ভাবছে ঋতসোম।

মা বলল, ‘একবার এখানে যখন এসেছি তখন চিন্তাপূর্ণী মাতার মন্দিরে একবার যাব। তোর একটা মানত ছিল, ভাবছি পূজো দেবো। আবার কবে আসা হবে ঠিক আছে।’

সব কিছু সেরে উঠতে উঠতে বেলা গড়িয়ে গেল।

মাকে নিয়ে যখন সাধুবাবার আশ্রমে এল তখন বিকেল গড়িয়ে গেছে। পাইন দেওদারের জঙ্গলঘেরা পথটা আরও ছায়াচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।

তবে অনেকটা উঁচুতে বলে আকাশে এখনও আলোর পরশ মাখা আছে। সেই আলোর স্পর্শের কিয়দংশ সাধুবাবার মন্দিরে এসে পড়েছে।

মা অবাক হয়ে প্রাক সন্ধ্যার সেই নৈসর্গিক শোভা উপভোগ করছেন। চারদিক ঢেউ খেলানো পাহাড়ের সারি, পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে পাইন বৃক্ষরাজি। দূর পাহাড়ের  পেছনে অস্তমিত সূর্যের রক্তিম আভা, পাখিদের বিচিত্র কলতানে মুখর এই অরণ্যবেষ্টিত প্রাঙ্গণ। সত্যিই অপূর্ব।

সাধুবাবা কীভাবে যেন বুঝতে পেরেছেন ঋতসোম এসেছে। উনি ধীর পায়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এলেন।

ঋতসোম মাকে আস্তে আস্তে বলল, ‘মা, ওই যে সাধুবাবা আসছেন।’

গেরুয়া বসনধারী সাধুবাবা ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। তারপর মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে  মৃদু হাসলেন। তারপর নিচু হয়ে ঋতসোমের মায়ের পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করলেন।

‘একী! এ কী করছেন! আমার পাপ হবে যে,’ বলে পরম লজ্জায় কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন।

সাধুবাবা তখনও পর্যন্ত মায়ের মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

ঋতসোম বিস্মিত হয়ে সেই নাটকীয় দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছে। কী শুনছে ? কী দেখছে ও ? নিজের কান এবং চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এও কী সম্ভব ?

সাধুবাবা ওদের ডেকে নিয়ে একটা ঘরে বসিয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

মা ঘুরে ঘুরে ঘরের পরিবেশ লক্ষ্য করছে। কারও মুখে কোনও কথা নেই।

সাধুবাবা হঠাৎ পাশের ঘর থেকে একটা জিনিস এনে মায়ের হাতে রাখলেন। তারপর মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি কী সত্যি আমায় চিনতে পারেননি ?’

মা এই প্রথম ভালো করে সাধুবাবার মুখের দিকে তাকাল। চোখের পলক পড়ছে না মায়ের। মায়ের চোখ ক্রমশ বিস্ফারিত হয়ে যাচ্ছে।

থর থর করে কাঁপছে মা। দুটি চোখে জলের ধারা চিবুক ভিজিয়ে দিচ্ছে।

মা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘র-র-রা-রা-ঘব না ?’

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button