আর্কাইভবিশেষ রচনা

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা বহুমাত্রিকতায় উচ্ছল তরঙ্গমালা

প্রচ্ছদ রচনা―সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

নাসির আহমেদ

মুহম্মদ নূরুল হুদা, ষাটের দশকের উজ্জ্বল নক্ষত্রপ্রতিম এক কবি। কবিতাকে যারা যাপিত জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করেন এবং নিরন্তর ধ্যানীর নিষ্ঠায় নিরবচ্ছিন্নভাবে কবিতার আরাধনায় নিমগ্ন থাকেন, এমন কবির সংখ্যা সব সময়ই হাতেগোনা যায়। বাংলা কবিতায় সেই স্বল্পসংখ্যক নিবিষ্ট কবির অন্যতম তিনি, মুহম্মদ নূরুল হুদা বহুলপ্রজ কিন্তু নিবিড়ভাবে শিল্পসচেতন। শব্দঘর-সম্পাদক যখন তার কবিতাসহ সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম নিয়ে একটি পর্যালোচনামূলক রচনা লিখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন, তখন সম্মত হতে সাহস করিনি, দ্বিধান্বিত থাকার একটাই কারণ, তা হলো মাত্র একমাসের নোটিশে তার মতো বহুলপ্রজ কবির বহুমাত্রিক কবিতার পর্যালোচনা সহজ নয়। তার ওপর তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন প্রচুর, অনুবাদ করেছেন বিদেশি কবিতা, লিখেছেন নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস, শিশুসাহিত্যসহ বিচিত্র রচনা। তবে তার অধিকাংশ কবিতা এক মলাটে থাকায় কবিতার একটা ধারাবাহিকতা অনুসরণের সুযোগ সহজেই মিলে গেল―সহস্রাধিক কবিতার এই সংকলনটির শিরোনাম, ‘মুহম্মদ নূরুল হুদা : ষাট বছরের কবিতা’ ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে কবির ষাটতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১১৪০ পৃষ্ঠার এই কবিতা সংগ্রহ প্রকাশিত হয়।

নিশ্চয়ই এই সংকলনের বাইরে রয়ে গেছে তার গত একযুগে গ্রন্থিত-অগ্রন্থিত অনেক কবিতা। তবে তাতে যে তার কবিতার গতি-প্রকৃতি বা ধারাবাহিকতা বিচ্ছিন্ন হবে, এমন শঙ্কা নেই। কারণ, মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রতিনিয়ত প্রকাশিত এবং সচেতন পাঠকের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত রয়েছেন। মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।

 তিনি বাংলা কবিতার সমস্ত ঐতিহ্য-পরম্পরা ধারণ করেই একটি নিজস্ব কাব্যভাষা এবং দার্শনিক উপলব্ধি যুক্ত করেছেন তার কবিতায় প্রায় শুরু থেকেই। বিশেষ করে বাংলা কবিতার যে গতিময়তা ধমনীর ধ্বনির মতো তিনি সত্তায় গেঁথে নিয়েছেন, যে কারণে তার কবিতা পেলব-কোমল আর লিরিক্যাল। বাংলা কবিতার সমস্ত ছন্দই ব্যবহার করেছেন, এমনকি সেই ছন্দ-আঙ্গিকের নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষাও দৃশ্যমান মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায়। প্রবহমান মুক্তক কিংবা গদ্যেও যখন তিনি কবিতা লেখেন তখনও একটা সুরের দোলা থেকেই যায় তার কবিতায়। আর সবচেয়ে বেশি করে তার কবিতায় যা ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময়, তা হলো মানুষের বহুমাত্রিক সত্তার চিত্রায়ন, সেই মানুষ সর্বব্যাপী। কখনও তা ব্যক্তির প্রতিবিম্ব, কখনও বা জাতিসত্তার শিকড় সম্পৃক্ত, কখনও দেশকাল ছাপিয়ে সর্ব-মানবীয় সত্তার প্রতীক হয়ে উদ্ভাসিত। ইতিহাস-ভূগোল আর নৃতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে তার কোনও কোনও কবিতা লোকবিজ্ঞানীর কাব্যিক পর্যবেক্ষণ হয়ে ওঠে।

তবে এই কবির আর একটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ না করলেই নয়, তা হলো তার প্রেমময় মন্ত্র, প্রেমের কবিতায় তা  অনির্বাণ লেলিহান। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় প্রায় চল্লিশটি কাব্যগ্রন্থে এক আশ্চর্য তারুণ্যে ভাস্বর রোমান্টিকতায় দেদীপ্যমান। প্রেমের কবিতায় তিনি সিদ্ধহস্ত। তবে সেই প্রেম নিছক নরনারীর রক্তমাংসময় সান্নিধ্যের তৃষ্ণায় কিংবা উষ্ণতায় নিঃশেষিত নয়। অনেক কবিতায় নরনারীর প্রেমকে ছাপিয়ে জগৎ আর জীবন, কাল-মহাকাল, নশ্বরতা আর অবিনশ্বরতার দ্বন্দ্বে উত্তাল বহুরৈখিক দার্শনিক ভাবনায় তা বাঙময় হয়ে ওঠে। এমন কি সাম্প্রতিক ফেসবুকে লেখা কবিতা পর্যন্ত এ কথা সত্য।

আমি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতা পড়ছি প্রায় ৪৫ বছর ধরে। যতদূর মনে পড়ে ১৯৭৬ সালে হাতে আসে তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ আমার সশস্ত্র শব্দবাহিনী। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ শোণিতে সমুদ্রপাত পড়েছি ১৯৭৯ সালে তার সঙ্গে পরিচয়ের পরে। তখন থেকেই লক্ষ্য করেছি মুহম্মদ নূরুল হুদা একদিকে যেমন প্রতীকী, অন্যদিকে তেমনই সহজাত প্রতিভায় সরল বর্ণনার মধ্যদিয়ে গভীর কথাটি উচ্চারণে এক আশ্চর্য কুশলতার অধিকারী। তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের ‘আমি মানুষ বলছি’ কবিতাটি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল। পঁচিশ বছর বয়সি একজন তরুণ কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থে এই কবিতা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। কবিতাটি উদ্ধৃত করছি :

যে-দিকে নীলিমা শেষ সে-দিকে পালাও

পালাতে পালাতে তুমি আগুন ছড়াও

ছড়াতে ছড়াতে তুমি দিগন্ত পোড়াও।

নীলিমা তো বাহ্য দৃষ্টি, দিগন্ত কুহেলী

সত্য শুধু সর্বজ্ঞ আগুন

সে পোড়াবে বাহ্যজ্ঞান, কুহেলিকা

মানুষের সখের ফাগুন।

যেখানে নীলিমা নেই সেখানে দাঁড়াও

দাঁড়াতে দাঁড়াতে তুমি আগুন ছড়াও

এবং নিস্তাপ হও, জ্বালানি বাড়াও।

এ রকম শিল্পসচেতন কবিতা তার প্রথম কাব্যগ্রন্থেও রয়েছে। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র এই কবি বিশ্বকবিতার ইতিহাস-ভূগোল আত্মস্থ করেই কবিতা লিখতে এসেছিলেন বিশ শতকের ষাটের দশকের মধ্যভাগে। তিনি যে কবিতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেই আত্মপ্রকাশ করেছিলেন, তার প্রমাণ পাই ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রস্থ শোণিতে সমুদ্রপাত এর কবিতাবলিতেও। এই কাব্যগ্রন্থে এমন অনেক কবিতা আছে যেগুলোতে কবিত্বশক্তির সহজাত প্রতিভার পাশাপাশি আছে তার অধীত জ্ঞানেরও বিচ্ছুরণ, আছে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য পুরাণেরও নানা অনুষঙ্গ। ডানকানের মুখের মতো, ফসটাস এখন নরকে, নার্সিসাস, পিগমেলিয়ন, মেটামরফোসিস ইত্যাদি  শিরোনামের কবিতাগুলোয় এর স্বাক্ষর মিলবে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো মুহম্মদ নূরুল হুদার ছন্দদক্ষতার পাশাপাশি নানারকম নিরীক্ষার ছাপও স্পষ্ট। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বাঙলা কবিতার প্রধান তিনটি ছন্দের কবিতাই তিনি উপস্থাপন করেছেন। প্রায় মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া ছন্দোবদ্ধ কবিতা লেখা সহজ কাজ নয়। সেই কঠিন কাজটি অনায়াস দক্ষতায় প্রথম কাব্যগ্রন্থেই উৎকীর্ণ করেছিলেন তিনি। ছন্দ চেনেন না যারা, অথবা কম চেনেন― এমন পাঠক (অনেক কবিও) গদ্য ভেবে বিভ্রান্ত হবেন। অথচ ছন্দের কোনো পর্ব/মাত্রার হিসেবের-ত্রুটি নেই। প্রায় গদ্যের মতো অথচ ছন্দবদ্ধ এমন একটি কবিতার শরণ নেওয়া যেতে পারে :

ফসটাস এখন নরকে।

পুণ্যলোভী জ্ঞানাত্মারা, আপনারা সকলেই শ্রবণ করুন

দশম গ্রহের আগে এ বার্তাই আবিষ্কৃত হলো

ফসটাস এখন নরকে।

জ্যোর্তিবিদ্যায় জ্ঞান বেড়ে যাচ্ছে হু হু মনীষার

সময় ফলকে দ্রুত লেখা হচ্ছে একাদশ গ্রহের গীতিকা

তাম্রলিপির মতো জ্বলছেই তবু এই নক্ষত্রলিপিকা

ফসটাস এখন নরকে।

জ্ঞানলোভী পাপাত্মারা,

তোমাদের থিওলজি প্রসারিত হবে বহুদূর

সঠিক জানবে প্রায় লোকাতীত পৃথিবীর সম্ভাব্য খবর

নিটোল সঠিক বার্তা সে জগতের, তবু জানি, জানবে এটিই

ফসটাস এখন নরকে। …

না, উদ্ধৃতি বাড়িয়ে লাভ নেই―যারা বোঝার এই কয়েকটি পঙ্ক্তি থেকেই উপলব্ধি করতে পারবেন একজন কবি তার প্রথম কবিতার বই নিয়ে আত্মপ্রকাশের মুহূর্তে যদি এতখানি সচেতন এবং অনায়াস ছন্দ কুশলতার স্বাক্ষর রাখতে পারেন, তার সম্ভাবনা কতদূর বিস্তারী! সেই দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস, সমগ্র মানবজাতির নানা সংগ্রাম সঙ্কট আর তার বিপুল সম্ভাবনায় উদ্দীপ্ত হয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন তার কবিতাকেও। মুহম্মদ নূরুল হুদা ‘জাতিসত্তার কবি’ এই বিশেষণে অনেকদিন ধরে ভূষিত। এই বিশেষণ আমার যদি স্মৃতি প্রতারণা না-করে, তাহলে বলব তার ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আমরা তামাটে জাতি প্রকাশের পরপরই তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। জাতি হিসেবে বাঙালিত্ব সেখানেই উৎকীর্ণ। দিনে দিনে তা ক্রমবিকশিত। বইয়ের প্রথম কবিতায়ই (আমার বয়স কত) তিনি সেই সুরটি বেঁধে দিয়েছেন। কবিতাটি উদ্ধৃত করা যাক :

‘বলুন বয়স কত, আমার বয়স?’

তাম্রবর্ণ একজন বিনীত বৃদ্ধকে

অবশেষে শুধাই এ কথা।

একজোড়া ভূ-মণ্ডল দুই চোখে তাঁর

মেতে ওঠে ঘূর্ণিনৃত্যে আলোকের বেশে

আমার কপাল ফুঁড়ে মস্তিষ্কের উষ্ণাধার জুড়ে

ঝরে ঘাম অবিরাম ফোঁটায় ফোঁটায়

অযুত-সহস্র-লক্ষ অণুরেখা

ফেটে যায় যেন মৃত্তিকায়;

‘ওরে এ ভীষণ রঙ্গালয়ে

সহসা পড়েছি এসে আমি জাদুবলে, যেখানে

আমারই স্কন্ধ হেনে খডুগ তাক করেছেন আমার জনক;

তবে কি শৈশবহীন তবে কি যৌবনহীন বার্ধক্যবিহীন

আমি এক নচিকেতা পুনর্জন্মহীন?

―আমার বয়স কত/(আমরা তামাটে জাতি)

বাঙালির আত্মপরিচয়ের উৎস সন্ধান করেছেন তিনি এই গ্রন্থে। সেই অনুসন্ধানের অবলম্বন হয়েছে তার অনেক কবিতা। আমার মা কিষাণী, হালাকু খানের নাতিপুতিরা, রাঙালির জন্মতিথি ইত্যাদি শিরোনামের কবিতায় বাংলা আর বাঙালির শিকড় সন্ধান করেছেন মুহম্মদ নূরুল হুদা। তার-ই আত্মানুসন্ধান আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে শিকড়গুলো শিরোনামের কবিতায়। নতুন করে পড়ে নিন পাঠক সত্তর দশকের শেষার্ধে লেখা এই কবিতাটি―

অনার্য এই শিকড়গুলো/অনাদ্যন্ত শিকড়গুলো/বুনতে বুনতে বুনতে বুনতে/শিকড়-কথা চারিয়ে দিলাম/তামাটে এক দ্রাবিড় গ্রিয়ট/গল্পগুলো চারিয়ে দিলাম।/বৃক্ষ তুমি যমজ ভ্রাতা/পাখি তুমি বোন/মা গঙ্গা ভগিরথী শিকড়-কথা চারিয়ে দিলাম/তামাটে এক দ্রাবিড় গ্রিয়ট/গল্পগুলো চারিয়ে দিলাম।/ জন্মজমি জন্মজাতি জলতরঙ্গ পললভূমি/ স্তরে স্তরে বর্শালাঙল/শিকড়-কথা চারিয়ে দিলাম/তামাটে এক দ্রাবিড় গ্রিয়ট/গল্পগুলো চারিয়ে দিলাম।

কবিতাটির আরও দুটি স্তবক রয়েছে―যার উদ্ধৃতি না দিয়েও বাঙালির নৃতাত্ত্বিক সামাজিক ইতিহাস অনুসন্ধানের প্রত্যয়টি বুঝে নেওয়া যায়। বাংলা, বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু তার কবিতায় নানাভাবে এসেছে এবং তা অনেকদিন আগে থেকে। আশির দশকেই তার কবিতাগ্রন্থের শিরোনাম যীসাস মুজিব ক’দিন আগে বাংলাদেশ তার মহান মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের স্মৃতির কাছে প্রত্যাবর্তন করেছে। শহিদ বুদ্ধিজীবীদের অনন্য আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেছে।

কিন্তু মুহম্মদ নূরুল হুদার ৪৫ বছর আগে লেখা কবিতা পড়লে মনে হবে যেন এ বছরই লেখা এ কবিতা। আমরা তামাটে জাতি কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতার সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করা অনিবার্য মনে হচ্ছে। চমৎকার চিত্রকল্পময় কবিতাটি :

তোমাদের হাড়গুলো

জোসনা রাতে উড়ে যাওয়া শাদা কবুতর,

সুদূর ঝর্ণার জলে স্বপ্নছাওয়া ঘাসের সবুজ,

তোমাদের হাড়গুলো অন্তহীন স্রোতস্বিনী সুরের নির্ঝর

একতারা হাতে এক বাউলের মনোজ গম্বুজ;

 তোমাদের হাড়গুলো বাঙলার সীমানা-ডিঙানো

ক্রমশ বর্ধিষ্ণু এক হরিৎ বাগান

করবাইন তাক-করা বেপরোয়া সৈনিকের গান;

তোমাদের হাড়গুলো বাঙলার হৃৎপিণ্ডে অবিনাশী ঝড়

বাঙালির জন্মতিথি, রক্তেলেখা ষোলো ডিসেম্বর।

মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় সেই যে বাঙলা ও বাঙালির শিকড়সন্ধানের শুরু তার অর্ধশতাব্দীর অধিককালের কাব্যচর্চার নানাস্তরে নানামাত্রিক কোণ থেকে বিকশিত ও পরিণত রূপ লাভ বরেছে। আমরা তামাটে জাতি, গ্রন্থনাম কবিতাটির কয়েক পঙ্্ক্তি উদ্ধৃত করে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক :

রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি

সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি

আমরা তামাটে জাতি আমরা এসেছি।

সমুদ্রের তলরূপী, গুহারূপী, মাতৃগর্ভরূপী

হৃদয়ের স্বপ্নশয্যা ছেড়ে,

সদিনÑসদৃশ্য সব লাঙ্গল উঁচিয়ে

মার্চপাস্ট করতে করতে আমরা এসেছি

আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।

রাজধর্ম পিছে ফেলে, পিছে ফেলে গোত্রের আরতী

লোকধর্মে লোকসঙ্গে, সুদীক্ষা নিয়েছি

আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা তার বহুল আলোচিত কাব্যগ্রন্থ আমরা তামাটে জাতি প্রকাশেরও অন্তত ছয় বছর আগে প্রকাশ করেছিলেন ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’। গ্রন্থ শিরোনাম ও দীর্ঘ কবিতাটিসহ একাধিক কবিতা তার আত্মঅন্বেষণের ইঙ্গিত― সচেতন পাঠক আগেই পেয়েছিলেন। বিশেষ করে বাঙালি কৃষিজীবী সমাজের লোক ঐতিহ্য-পুরাণ আর আবহমান বাংলার লোককথাকে নিবিড় উপমা, চিত্রকল্প আর সুরময় ছন্দের দোলায় তিনি দুলিয়েছেন একাধিক কবিতায়।

বৃষ্টি, মাঘ ১৩৭৮ কবিতায় তিনি বাঙালির লোকপুরাণ ব্যবহার করেছেন নিবিড় নৈপুণ্যে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে লেখা কবিতাটির দিকে দৃষ্টিপাত করে মুগ্ধ হই এখনও।

‘যদি বর্ষে মাঘের শেষ

ধন্যি রাজার পুণ্যি দেশ’―খনার বহুশ্রুত এই উদ্ধিতি ব্যবহার করে কবিতাটি বুনেছেন তিনি বাঙালিত্বের বহুবিধ ঐতিহ্য পুরাণের আশ্রয়ে।

মহাকাব্যের যুগ বহুকাল আগে অবসিত। কিন্তু একজন আধুনিক কবিও মহাকাব্যিক চেতনা ধারণ করতে পারেন। ‘পাবলো নেরুদাকে নিবেদিত’, ‘প্রতীক মানুষ’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতা (দশটি ভাগে বিভক্ত) পড়তে পড়তে বিস্ময়ে, লক্ষ্য করি মুহম্মদ নূরুল হুদা মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায়ই উপস্থাপন করেছেন মানব সভ্যতারই ইতিহাস আর অস্তিত্বের নানামাত্রিক বিবর্তনে আত্মজিজ্ঞাসার এক অসামান্য কাব্য আখ্যান, যেখানে আধুনিক কবিতার সমস্ত শর্ত অক্ষুণ্ন রেখেই তিনি নির্মাণ করেন গভীর দার্শনিকতাপূর্ণ কবিতা। ধর্মীয় কিংবদন্তি থেকে শুরু করে নানা লোকপুরাণও তার এই কবিতাটির অনুষঙ্গ হয়েছে। প্রতীক ব্যবহার করেছেন ব্যক্তি-অস্তিত্ব থেকে শুরু করে দেশকাল সমাজ আর সভ্যতার অস্তিত্বের  নানামাত্রিক বিবর্তন রূপায়ণে। কখনও  কখনও বুনে দিয়েছেন নানা কাহিনি গাথাও। কবিতার শেষ দু’টি পর্ব ৯ ও ১০ উদ্ধৃত করলে পাঠক ধারণা করতে পারবেন মানুষের ব্যক্তিসত্তা কীভাবে সমষ্টির সত্তায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়! সেই উদ্ধৃতির পূর্বরেশ (৮) থেকে কিছুটা উদ্ধৃত না করলে অস্পষ্ট মনে হতে পারে। ১০টি বিভাগ যেন একসূত্রে গাথাঁ। একটির সঙ্গে অন্যটি মালার মতো গ্রোথিত। সম্ভব হলে পুরো কবিতাটি উদ্ধৃত করতাম।

… নারীর দেবতা নই, যদিও নিনাদ আছে/আমারও আদিম; যদিও এ আমি/তর্জন গর্জন/যুবক-বিহীন এই নগরীতে হাঁটি, আর/যত্রতত্র পুঁতে রাখি আজানুলম্বিত এই নীলকান্তমণি।/চারপাশে কৃপাপ্রার্থী কুমারীরা আসে, কেউ কেউ হাসে,/ তবু কি পেয়েছি ভয় এমন সন্ত্রাসে?/কৃপায় কৃপণ আমি অতিবেশি; পরাক্রান্ত এ তর্জনী/অক্ষত শিশ্নের মতো শাসায় তাদের,/ পরোয়া করে না কোন দেশ-বেশ, কোন রীতিনীতি।/হে মনুষ্য যৌনবিদ,/তোমার প্রাচীন পুঁথি তাকেই তো যৌনাচার বলে।/ ঐন্দ্রজালিক নই,/ তবু যেই ইন্দ্রজালে বেঁচে আছি আমি/তার  নাম সঙ্গীত-প্রতীক; দিন ও রাত্রির সীমা অতিক্রম করে/যে অমর্ত্য সুর এসে আমাকে বাজায়, আমি তার/বাধ্য বশংবদ; একটি ইঙ্গিতে যার/ দ্যুলোক-ভূলোক এসে গোল হয়ে নাচে/স্পন্দমান নেই শিরা, সে আমারই অমর্ত্য শানাই;/হে মনুষ্য, যৌনযন্ত্র হয়ে, তুমি তাকে শিশ্নমন্ত্র বলো।

অধ্যাত্ম তর্জনী তুলে তুমি যে-রকম ধ্যানী দরবেশ/সমস্ত দরগাহ জুড়ে অলৌকিক জিকিরে জিকিরে/সোমও সঙ্গীতে খোঁজ অনাদি প্রতিমা,/ আমার শিল্পসীমা সে-রকম খোঁজে যাকে সে এক অসীমা।

৯.

কোনও এক দ্রাবিড় শহরে, মহেঞ্জোদারোতে কিংবা/হরপ্পায় তাকেই কি দেখেছি একদা?/হাজার বছর ধরে অনন্তর শোভাযাত্রা তাহারই উদ্দেশে।/ আজ এই নগরীতে অশ্রুতপূর্ব এই জনসমাবেশে/ তবে যদি নাহি পাই আমি, তাহলে মৃন্ময়ী/ দ্বিধা হয়ো; তোমার বিশাল গর্ভে/ তা হলে ধারণ করো আশিশ্ন আমার; যেমন অতিকায় বনস্পতি পেয়েছে জীবন,/তেমনি তোমার গর্ভে সহস্র বছর আমি যাপি-এ যৌবন।

১০

পরিশিষ্ট

প্রথমস্বর : যৌবন যাপনকালে মানুষেরা সেই মতো স্পপ্নদ্রষ্টা হয়/ সেইমতো আগমন চন্দ্রসূর্য সেটে রাখে উষর গগনে/ সেইমতো বেড়ে ওঠে ভূমণ্ডলে বায়ুচাপ হেন/তুমি কি তেমন কোনো স্বপ্ন দ্যাখো, আর্য সুমৃন্ময়?

দ্বিতীয় স্বর : যা-কিছু আমার স্বপ্ন সে-তো। এক শুচি-জন্ম/ ব্রহ্মাণ্ডে আমাতে এক বৈধ বিনিময়।

এই দীর্ঘ কবিতা দুটি অংশ থেকে পাঠক অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন কেন মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আরও লক্ষণীয় এই যে, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অক্ষরবৃত্ত বজায় রেখেই প্রায় মুখের ভাষার কাছাকাছি উচ্চারণে মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রায় গদ্যভঙ্গিতে নির্মাণ করেছেন ছন্দোবদ্ধ কবিতাটি।

মৃন্ময়-মৃন্ময়ী প্রসঙ্গটি এ কবিতায় দু-একবার এসেছে। ‘শোভাযাত্রা দ্রাবিড়ার প্রতি’ প্রকাশের পাঁচ বছর পর ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তার ‘অগ্নিময়ী হে মৃন্ময়ী’ শিরোনামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থে মুহম্মদ নূরুল হুদা তার কবিত্বশক্তির আর এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছেন। মৃন্ময়ী নামের নারীর প্রতীকে তিনি এমন অখণ্ড চেতনার বিস্তার ঘটিয়েছিলেন এই কাব্যগ্রন্থে যা ওই সময় বহুল আলোচিত হয়। সম্ভবত এই বইটি কবি আহসান হাবীবের বিচারে একটি প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার অর্জন করে। মলাট এবং শিরোনামপৃষ্ঠাহীন হওয়ায় খণ্ডিত বই দেখে বোঝার উপায় ছিল না এটি কার লেখা কাব্যগ্রন্থ। চল্লিশ বছর আগের কথা, তবু মনে আছে। একাধিক কবিতার বই ছিল পুরস্কার মনোনয়নের জন্য। দৈনিক বাংলার (অধুনালুপ্ত) কিংবদন্তিতুল্য সাহিত্য সম্পাদক কবি আহসান হাবীবের সহকারী হিসেবে তার অনেক কাজেরই সহযোগী থাকতে হয়েছে। কোথাও প্রকাশ না করার কঠোর শর্তে সব কয়টি মুদ্রিত অথচ খণ্ডিত কাব্যগ্রন্থ ধীরলয়ে টেনে টেনে তাকে পড়ে শোনাতে হয়েছিল। তিনি তার সামনে একটি গোপনীয় শাদা কাগজে মার্কিং করছিলেন কবিতা শুনে শুনে। পুরস্কার ঘোষণার আগে আমিও জানতাম না, যে পাণ্ডুলিপি কবি আহসান হাবীবের মতো জহুরি সম্পাদকের দৃষ্টি কেড়েছিল, সেই কাব্যগ্রন্থের কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। পুরস্কার ঘোষণার খবর কাগজে প্রকাশের পর হাবীব ভাই বিষয়টি শেয়ার করেছিলেন। এই গল্প আমি কখনও কোথাও করিনি। আজ প্রাসঙ্গিক বলেই উল্লেখ করা।

উল্লেখ এই কারণে যে, মুহম্মদ নূরুল হুদা অগ্নিময়ী হে মৃন্ময়ী শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে তার প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষরই উৎকর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১ থেকে ৫০ ক্রমিকে শিরোনাম প্রকাশিত হয়েছিল কবিতাগুলো। ওই সময় বইটি যথেষ্ট আলোচিত হয়েছিল। অনেকটা আল মাহমুদের সোনালী কাবিন এর মতো গভীরতা স্পর্শী অথচ লিরিক্যাল এই কবিতাগুলো আল মাহমুদের সোনালী কাবিন এর সঙ্গে তারপরও এই কবিতার সামান্যতম সম্পর্ক নেই। মাহমুদ লিখেছিলেন সনেট-আঙ্গিকে, নূরুল হুদা লিখেছেন অক্ষরবৃত্তের মুক্তক রীতিতে এবং কখনও অন্ত্যমিল, কখনও মধ্যমিলে এক আশ্চর্য সুরের অনুরণন সৃষ্টি করে। দৃষ্টান্ত হিসেবে অগ্নিময়ী হে মৃন্ময়ী ১. নম্বর কবিতাটির উদ্ধৃতি উপস্থাপন করা যেতে পারে; এরা কেউ দুঃখ নয়, এরাই তো সুখ/যতবার বিজিত হয় সাম্রাজ্য তোমার/এরা ততবার/ বিজেতার রক্তপায়ী ঝিকানো অসিতে/ দেখে নিজ মুখ;/এরা কেউ দুঃখ নয় এরাই তো সুখ। একদা পুড়েছি আমি। আমিই কি পুড়েছি একাকী?/সেদিন তো পুড়ছিলো রোম,/তারো আগে ট্রয়;/ প্রতি বার পুড়েছিলো কার ক্ষুদ্র বুক?/ওরা কেউ দুঃখ নয়, ওরাই তো সুখ।

এবারো কি অগ্নিকাণ্ড হবে? রশ্মিময় বিস্ফোরণে পুড়বে কি/ঢাকা ও শিকাগো?/ গলিত চোখের মতো খসে যাবে আকাশের/প্রতিটি তারকা? খসুক;/ অগ্নিই দর্পণ আজ, অগ্নিই বিজয়ের মুখ।

দূরে আছি ভয় নেই, কেঁপো না মৃন্ময়ী।/ থাকো বুকে, খুলবো না বুকের সিন্দুক।/ পাখির ছানার মতো তোমার শরীর ঘিরে যারা/ ওইখানে কলরব করে,/ ওরা কিন্তু দুঃখ নয়, ওরাই তো সুখ।/ আসন্ন বিজয়লিপি তোমাকে পাঠাবো আমি তাদের মুখেই।’

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা মৃন্ময়ীকে চিত্রিত করেছেন বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে। প্রেমের গভীর অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত করেছেন নানা অনুষঙ্গ আর আঙ্গিক বৈচিত্র্যও। যেমন ৪৭ নম্বর কবিতাটি (মাত্র ৮ লাইন)

স্বরমাত্রিক ছন্দে ৬+৫ মাত্রার চালে সজিয়েছেন :

আধখানা    দ্বার    বন্ধছিল

   ৬                    ৫

আধখানা   দ্বার     খোলা

    ৬                অপূর্ণপর্ব ২ মাত্রার

 তোমার জন্য       তোলা

       ৬             ২ অপূর্ণপর্ব

৫০তম তথা শেষ কবিতাটির উদ্ধৃতি টেনে অগ্নিময়ী হে মৃন্ময়ীর প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই।

৫০.

চিতার চন্দন আমি যাই জ্বলে যাই।/ দৃষ্টি নয়, সর্বগ্রাসী যমজ আগুন/দুরন্ত দুচোখ জুড়ে জোড় হুতাশন/প্রলয় সূর্যের মতো বিশ্বময় জ্বেলে রাখো/ সর্বনাশটিপ/ দৃষ্টিপাতে জ্বলে তবু, সীমা ও সিনাই।

পারি না, পরি না/ মুসার মোজেজা নিয়ে/ এ আগুন নেভাতে পারি না;/ শর্মিন্দা শরীর সখি কোথায় লুকাই!

অগ্নিময় তুমিতো মৃন্ময়ী/ জেগে আছো বহুভঙ্গ ভ্রƒ-থেকে ভ্রƒণে/

আগুন নির্মত তবু, ওই তনু পোড়ে না আগুনে।

মুহম্মদ নূরুল হুদা বারবার বদল করেছেন তার বিষয় এবং বাকভঙ্গি। বিশেষ করে ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তার যিসাস মুজিব কাব্যগ্রন্থে তিনি সামরিক শাসনবিরোধী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন তার কবিতায় এবং একই সঙ্গে ব্যঙ্গবিদ্রƒপে সময়ের পিঠে চাবুক হেনেছেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ কাল পরিসরে লেখা কবিতাগুলো পড়লে একটা দুঃসময়ের ছবি পাওয়া যায়। এবং একই সঙ্গে বাঙালির দুঃসময় অতিক্রমের আশাবাদ কখনও প্রত্যক্ষ ভাষ্যে কখনও বা প্রতীকে পরোক্ষে উচ্চারণ করছেন তিনি। কিছু কবিতা আবার পদ্যের সারল্যকেও গ্রহণ করেছে। যেমন ‘না-জিব বাঙালির কথা’ শীর্ষক তিন লাইনের কবিতাটি :

নেই তো তাহার জিব

যে বলেনি জাতির পিতা

মুজিব, শেখ মুজিব। (১৯৮০)

তবে বইটির প্রথম কবিতাটি ১৯৭৬ সালে লেখা। পুলিশ ও প্রজাপতি :

হাই ব্যাটা প্রজাপতি, কি করো আকাশে?/

শুনে সব প্রজাপতি মুখ টিপে হাসে,/

হাসছি আমিও/ প্রজাপতি প্রজা নয়, নেই তার স্বামীও।

বলা যেন অনেকটা ছড়ার ঢঙে, কিন্তু বিষয় সিরিয়াস। ভঙ্গি বিদ্রƒপের। ‘চন্দ্ররাজের শাসন’ নামের কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক :

মেঘের ভেতর শব্দ শোনা গেলো

শব্দতো নয় জোছনা ঝলোমলো

জোছনা তো নয় ভাষণ

শুরু হলো চন্দ্ররাজের শাসন (১৯৮৩)

‘কবিকাহিনী’ শিরোনমের কবিতাটি পড়লে বোঝা যাবে সহজ চালে মুহম্মদ নূরুল হুদা কী গভীর রাজনৈতিক বাস্তবতার ছবিটি আঁকতে চান সদ্য স্বাধীন দেশে!

দখিন দুয়ার খুলে বসে আছি, ঢেউরোদে কাঁপে বঙ্গদেশ।/ উন্মাতলে এ বৈশাখে রূপ দেখি কার?/ ঝড়োজলে বিনিদ্র ভূগোলে/কাঁপছে ডাঙ্গায় তোলা কাতলের মতো/আমার স্বদেশ―/নাকি বঙ্গদেশ?

‘যাহা চাই ভুল করে চাই’―যেন এক অমোঘ ফর্মুলা …

না, দীর্ঘ কবিতা, উদ্ধৃতি নয়―বরং পাঠকের ধারণায় থাক সচেতন কবির স্বদেশ ভাবনা। ১৯৭৬ সালে ‘বাকস্বাধীনতা’ কবিতায় তিনি যে বিদ্রƒপাত্মক ভাষায় সময়ের ছবি আঁকতে চেয়েছেন, সেই ইচ্ছেটাই বড়ো। ‘কথায় কথায় ধুয়া/ হুয়া হুক্কা হুয়া/

এই বিদ্রƒপাত্মক চরণগুচ্ছ প্রতিটি স্তবক শেষে উচ্চারণের মধ্য দিয়ে সময়ের ছবিই আঁকার প্রয়াস পেয়েছেন কবি। ‘মাতৃভাষা’, ‘ভালোবাসা ১৯৭৫’, ‘নির্বাসিত ঘাতকের স্বগতোক্তি’, ‘বিজিত ও বিজয়ীর কাহিনী’ ইত্যাদি কবিতায় মূলত সচেতন রাজনৈতিক বোধেরই পরিচয় দিয়েছেন তিনি। ১৯৮২ সালে এক সামরিক শাসকের ক্ষমতা অবসানের মধ্যদিয়ে আর এক সামরিক শাসকের আগমনকালে তিনি যখন লেখেন :

যারা নিরস্ত্র হয়েছিলো তারা আবার সশস্ত্র হচ্ছে

যারা ধ্বংস হয়েছিল তারা আবার উত্থিত হচ্ছে

যারা নিশ্চিহ্ন হয়েছিল তারা আবার চিহ্নমান হচ্ছে

প্রভু, সৃষ্টি কি পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছে?

জীবনের উল্লাস যদি রোদনে পর্যবসিত

জীবনের অস্তিত্ব যদি মৃক্তিকাচ্যুত

জীবনের শোণিত যদি ধমনী-চ্যুত

প্রভু, জীবেদের আত্মাকে তোমার উদ্দেশে প্রধাবিত?

আমরা কি আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়েছিলাম?

আমরা কি আমাদের রুহ থেকে বিযুক্ত ছিলাম?

আমরা কি পবিত্র নহরের স্রোতে ব্যভিচারী হয়েছিলাম?

প্রভু, আমাদের হাত এখন তোমার উদ্দেশ্যে উত্তোলিত।’(১৯৮২)

অপেক্ষাকৃত সরল ও বিবৃতিধর্মী অনেক কবিতাও এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। যা কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার মতো শক্তিমান কবির এক ধরনের হেয়ালিও কেউ কেউ মনে করতে পারেন। ‘পায়ের সাথে পা কাঁপে না’, কবিতাটি শুধু নয়, এমন আরও অনেক কবিতায় মনে হয় নূরুল হুদা তার গভীর ঘন কবিতার বলয় ভেঙে ছড়ার ছন্দেও কিছু কিছু কবিতা নিয়ে এই কাব্যগ্রন্থে অবির্ভূত হয়েছিলেন। তবে এই গ্রন্থেই বেশ কিছু কবিতায় বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ের অন্তত ৭/৮ বছরের চিত্র ধরা রয়েছে, যার গুরুত্ব উপেক্ষণীয় নয় মোটেও।

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার যিসাস মুজিব এর কবিতাগুলো যখন লেখা হচ্ছে তখনও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে হাতেগোনা কয়েকজন কবি ছাড়া সামরিক শাসনকবলিত বাংলাদেশে কবিতা বলতে গেলে খুব কমই লেখা হয়েছে। ১৯৮০ সালে তিনি যখন যিসাস মুজিব শিরোনামের কবিতার বইয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে একাধিক কবিতা উপস্থাপন করেন, তা ছিল নিংসন্দেহে সাহসী ঘটনা। বাংলা একাডেমির মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের উদ্দেশ্যে সামরিক শাসকদের কীর্তিকলাপ নিয়ে বিদ্রƒপ করেন, বঙ্গবন্ধুকে পিতা সম্বোধন করে একের পর এক কবিতা লেখেন, তা কম ঝুঁকিপূর্ণও ছিল না এই  বাংলাদেশে। গ্রন্থের নাম-কবিতাটির উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে :

হতে পারতে আইখম্যান খুনির কাহিনী

হতে পারতে মৃত্যুদণ্ডে খাস সহিদাতা

অথচ তোমার বুকে জেগেছিলো

এ কেমন আশ্চর্য ধমণী।

নিষ্পাপ বাঙালি রক্তে যে গাদ্দার খেলেছিল হোলি

শক্তিমদমত্ত সেই সহিংস অশনি

তোমার বিশাল বুকে তারও জন্য ছিল কিছু ক্ষমা

গুঁড়িয়ে দাওনি, পিতা সেই খলনায়কের খুলি।

 সে-সুবাদে সেই ভণ্ড পুরোহিত প্রাণী

আঁধারের সঙ্গী হয়ে পাঠ করে প্রতিহিংসা রায়

হাত দুটো প্রসারিত, পিতা, তুমি চূড়ান্ত কোরবানি

  তোমার বঙ্গজ রক্তে সন্তানের পাপ ঘুচে যায়।

ফুরোবে না গঙ্গাধারা, ফুরোবে না বঙ্গভাষী কবিদের নিব

ফুরোবে না এই রক্ত, পিতা তুমি যিসাস মুজিব।

কবির পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ হনলুলু ও অন্যান্য কবিতা ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। কবির যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালীন দিনগুলোর নানামাত্রিক অভিজ্ঞতা এই গ্রন্থের কবিতামালায় বাঙময়। এর বাইরেও প্রেমের কবিতাসহ নানা বিষয় বৈচিত্রে বইটি উজ্জ্বল। মুহম্মদ নূরুল হুদার নিজেকে অতিক্রমণের প্রয়াসই লক্ষণীয় (যিসাস মুজিব ও হনলুলু ও অন্যান্য কবিতা) কাছাকাছি সময়ে প্রকাশিত দুটি কাব্যগ্রন্থে। কবিতাগুলোর শিরোনামেও সেই বিদেশি আবহ আর বিষয়ের আভাস স্পষ্ট। যেমন, প্রথম কবিতার শিরোনাম ‘প্যাসিফিক ১৯৮৫’। এ ছাড়া ম্যাজিক আইল্যান্ড ১৯৮৫, মনোয়া উপত্যকায় বৃষ্টি, ডায়মন্ড হেড, ওয়াইকিক ১৯৮৬, ব্যাকস্যান্ড বিচ, লিলিলিউ ইত্যাদি কবিতায় যুক্তরাষ্ট্রের রোদবৃষ্টি, কুয়াশা-শিশিরসহ বিচিত্র মানুষ ধরা দিয়েছে কবির কুশলী হাতে। এই গ্রন্থের কবিতামালা বরং আরও প্রগাঢ় এবং প্রতীক-চিত্রকল্পে সংহত।

একটি উদ্ধৃতি :

চিরল পাতার বৃষ্টি কি নাম তোমার!/মেঘ এসে কুটিকুটি তোমার ও-চুলে।/রোদ এসে চুমু দিলে রাজহংসী তুমি।/ শরীর বাঁজিয়ে কেন নাচো তো দেকিনি।

কিংবাÑ

মেঘের মতন মেয়ে অথচ সে শাদা/ রূপের শিখার মতো সারাক্ষণ জ্বলে/দুটি চোখ দুটি দ্বীপ সফেন সাগরে/ আমিই তো বাতিঘর দৃষ্টি তার বলে।

এই গ্রন্থে কিছু ভালো কবিতা আছে স্বনামখ্যাত কবি-সহিত্যিকদের নিয়ে। যেমন কবিতার শিরোনাম ‘আহসান হাবীবের বাড়িফেরা’, শামসুর রাহমান অগ্রজপ্রতিমেষু ইত্যাদি। আবার উৎসর্গ করা কবিতা আছে আবুল ফজল, আল মাহমুদকে। চিত্তরঞ্জন সাহাকে সম্বোধন করে লেখা―দএকটি ফরমায়েশি কবিতা’। বৃক্ষবাবুর গল্প শিরোনামে একটি চমৎকার দীর্ঘ কবিতা রয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে।

আসলে একজন কবি ক্রমাগত অনুসন্ধান করে যান। যার অনুসন্ধান যত গভীর, অনুসন্ধান না বলে এখানে খনন শব্দটি ব্যবহার করা যায়। কবির চেতনালোকে দিনরাত খনন কাজ চলতে হয়। খনন ছাড়া মূল্যবান সম্পদ আহরণ করা যায় না। সেই খনন পিপাসাই কবিকে দিয়ে অবিরল লিখিয়ে নেয় বিচিত্র সব ভাবনার কাব্যরূপ। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার কবিতায় সেই অন্বেষণ তথা খননের রক্তপাত দৃশ্যমান। কবিতাকে তিনি কখনও আলো আঁধারী কখনও উজ্জ্বল খোলা প্রান্তরে দেখেন এবং পাঠকদের দেখান।

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার স্মৃতিপুত্র কাব্যগ্রন্থে তার কবিতার আরেক নতুন বাঁক লক্ষণীয়। বইয়ের প্রথম কবিতার শিরোনাম ‘লাঙ্গলমানুষ’। নদীমাতৃক বাংলার আবহমান কৃষি সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভ্রমণ করেছেন তিনি এই কবিতায়। এই দীর্ঘ কবিতায় লোকায়ত জীবনের এক আশ্চর্য ছবি এঁকেছেন জলদগম্ভীর উচ্চারণে। সচেতন পাঠকের মুগ্ধতা জাগায়। বাংলার ধর্ম-দর্শন লোকাচারে সজ্জিত এই কবিতার পুরোটাই উদ্ধৃতিযোগ্য। কিন্তু সীমিত পরিসরে তা সম্ভব নয় পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে শুধু কবিতাটির শেষ দুটি স্তবক উদ্ধৃত করতে চাই :

পুণ্যার্থীরা দড়ি দিয়ে ঘিরেছে আপন আপন ঘরবাড়ি,/প্রণামী দিচ্ছে শ্রীশ্রী দিগি¦জয়ী ব্রহ্মচারীর চরণে, /পাশে নগরদোলার পাশে বীজতলা, /আর প্রেমতলা সবচেয়ে উঁচু বৃক্ষের শাখায় উড়ছে /রঙবেরঙের চক্রপতাকা;/

এখন ব্রহ্মপুত্রের জলে অস্তযাত্রী সূর্যের অগ্নিচিতা/ আর রাজঘাটের মন্দিরে বসন্ত পূজার শেষে / কীর্তনের সুর তুলেছে নবীনা বোষ্টমী /‘গুরু আমার খেলা ভেঙ্গে যায়/ গুরু তোমার সেবা করতে পারলাম না’/ ঐতিহাসিক জানতে চায় ‘কে গুরু, কোথায় গুরু? / কবির চোখের সায়, ওইতো ভেসে ভেসে যায়’। / কবির তর্জনী লাঙ্গলের ফলা হয়ে / আমূল বিদ্ধ করে মানুষের হৃৎপিণ্ড, / তখন জগৎ সংসার ছিন্নভিন্ন,/ মানুষেরা লাঙ্গলমানুষ / তখন ধরিত্রী বোষ্টমীর জন্যে দিগি¦দিক হৃদয়ক্ষরণ, /জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে ধাবমান মানুষের উজানচরণ।

একই কাব্যগ্রন্থে ‘জাতিপিতা’ শিরোনামের কবিতাটি আঙ্গিকের দিক থেকে লিরিক্যাল। স্বরমাত্রিক ছন্দের দোলায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে চিত্র এঁকেছেন কবি, তা যেমন অভিনব তেমনি কৃষিজীবী সমাজ-সভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসের সঙ্গেও অসাধারণ নৈপুণ্য অন্বিত। আর তাতেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে জাতির পিতার জীবন সংগ্রাম এবং তাঁর লোকায়ত ঐতিহ্য। এই কবিতাটিও মোটামুটি দীর্ঘই। একাধিক কবিতা আছে এই গ্রন্থে যেখানে বিষয়বস্তু হয়েছেন বঙ্গবন্ধু। জন্মান্তর,  মুজিবমিনার, মুজিবÑবরণ, জাতিপুত্র ইত্যাদি কবিতার পাশাপাশি মনে দাগ কাটে মানবপদ্ম, দুধখোকা, বাবা ফিরে এসোসহ বেশ কয়েকটি কবিতা। এই গ্রন্থে  নূরুল হুদা লিরিকের বন্ধন ছিন্ন করে গদ্য কবিতার সঘন উচ্চারণে এক ধরনের ঘোর সৃষ্টির প্রয়াস পেয়েছেন। গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা দীর্ঘ কিন্তু গাঁথুনি টানটান। তার বেশ কয়েকটি লিরিক্যাল কবিতাও প্রবহমান একই গ্রন্থে। ‘স্মৃতিপুত্র’ কবিতায় যেন কবি নন, একজন দার্শনিকই কথা বলছেন কবিতায়।

২০০১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত দরিয়ানগর কাব্যগ্রন্থে জীবন্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়-সমুদ্র আর অরণ্যবেষ্টিত চট্টগ্রামÑকক্সবাজারের চিত্রকল্পময় দৃশ্যাবলী। একই সঙ্গে লোকায়ত বাংলার গ্রামীণ জীবনের মানবিক সম্পর্কের নানা দিক―এর পাশাপাশি বাঙময় হয়ে উঠেছে প্রকৃতি স্বয়ং। নানা আঙ্গিকের কবিতামালা সজ্জিত এই কাব্যগ্রন্থটি।

 ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ পদ্মাপারের ঢেউ সওয়ার। এই কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমানসহ  অনেক বরেণ্য কবিব্যক্তিত্ব বিষয় হয়ে এসেছেন একাধিক কবিতায়। ‘গুহবয়ান’ সিরিজ কবিতাগুচ্ছ এই গ্রন্থের লাবণ্য অনেকখানি বিস্তৃত করেছে।

 পুণ্যবাংলা কাব্যগ্রন্থে বিষয় আর আঙ্গিকের নানারকম নিরীক্ষা চোখে পড়বে সচেতন পাঠকের। পদ্মাপাড়ের ঢেউ সওয়ার, পুণ্যবাংলা আর সুরসমুদ্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ কাছাকাছি সময়েই রচিত। কিন্তু একটি থেকে অন্যটিতে প্রবেশ করলে মনে হয় সচেতন প্রয়াসে মুহম্মদ নূরুল হুদা নিজেকে অতিক্রম করে যাবার চেষ্টা করেছেন সহজাত প্রতিভায়।

 কবিজীবনে এমন সময় কারও কারও আসে, যখন যে কোনও বিষয় নিয়ে যখন-তখন কবিতা লিখবার ক্ষমতা আত্মস্থ হয়ে যায়। এর ভালো দিক আছে, মন্দ দিকও আছে। কবিতার যে ক্রাফটসমানশিপ তা এই পর্যায়ে সব সময় ধরে রাখা যায় না। অনেক সময় শক্তিমান কোনও কবির কবিতাও সরল পদ্যের কাছাকাছি চলে যায়, অথবা বিবৃতিধর্মিতা দ্বারা আক্রান্ত হয়। কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা উজ্জ্বল কবিতার পাশাপাশি কিছু জনপ্রিয় পদ্যও লিখেছেন। যা তার নিজের প্রতি সুবিচার সব সময় মনে হয়নি। আবার এমন কিছু লিরিক তিনি লিখেছেন যা আপাতশ্রুতিতে সরল মনে হলেও তা গভীর ব্যঞ্জনাময়। বাচ্যার্থ সরল কিন্তু ভাবার্থ গভীর তাৎপর্যময়। এই ধরনের কবিতাই কালোত্তীর্ণ হয়ে যায়। তার কবিতায় রহস্য যেমন আছে তেমনি মিস্টিসিজম এবং সুফিজমের আশ্চর্য প্রভাব লক্ষ্য করি। কবিতার চিত্রকল্প রচনায় তার মুন্সিয়ানা উচ্চমানের। একইসঙ্গে ছন্দ দক্ষতায় তার অর্জন অসামান্য।

 ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আমার সাহস নেই টোকা মেরে সুন্দরকে উড়িয়ে দেবার কাব্যগ্রন্থটি আঙ্গিক বৈচিত্র্য এবং বিষয়ের গভীরতায় মনোহর। না সঙ্কেত না লিপি, কবিনামা, এ-বর্ষায় চাষমাঝি, কবিতাগুলো মন ছুঁয়ে যায়! ‘হে দরিয়া রাণী হে সুন্দরের জন্মকথা’ সিরিজ কবিতাগুচ্ছ আমার বিবেচনায় এ কাব্যগ্রন্থের অন্যতম আকর্ষণ। বিশেষ করে ঐতিহ্য আর প্রকৃতির আশ্রয় নিয়ে কবি তার তীব্র তীক্ষè রোমান্টিকতা স্বাক্ষরিত করেছেন এই কাব্যগ্রন্থে। এ প্রসঙ্গে বলতেই হয় কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা আধুনিকতা সমুন্নত রেখে আপাদমস্তক রোমান্টিক। তার ব্যক্তিসত্তার  মতোই তার কবিতার প্রাণশক্তিও সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না।

প্রায় এক যুগ আগে মুহম্মদ নূরুল হুদা কুরআন কাব্য-আমপারা (কলেমাসহ) শিরোনামে একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। কোরআনের বিভিন্ন সূরার বিষয়বস্তু বা বক্তব্য অবলম্বনে এই কবিতাগুলো রচনা সত্ত্বেও তার মৌলিক কবিসত্তার ছাপ তাতে স্পষ্ট।

এই আলোচনার সঙ্গে  প্রাসঙ্গিক কিনা জানি না, তবু উল্লেখ করতে ইচ্ছা হয়, তার প্রবন্ধের কথা তাঁর উপন্যাসের কথা। আমাদের খুব কম সংখ্যক কবির মধ্যেই গদ্য লেখার উৎসাহ লক্ষণীয়। ব্যতিক্রম যারা তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে মুহম্মদ নূরুল হুদার কথা উল্লেখ করা যায়। কাজী নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের অনেক বরেণ্য কবি সাহিত্যিকের রচনার উপর আলোকপাত করেছেন, বিভিন্ন সময়ে এই কবি নজরুলের শ্রেষ্ঠত্ব শিরোনামের প্রবন্ধের বইটি পড়ে যে কোনও সচেতন পাঠক তাকে নজরুল গবেষক স্বীকৃতি দিতে পারেন, নানাভাবে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন নজরুলকে গ্রন্থিত চব্বিশটি প্রবন্ধে। এছাড়া তার জোড়া উপন্যাস জন্মজাতি / মৈনপাহাড় বিশদ আলোচনার দাবি রাখে। বিশেষ করে অরণ্য জনপদের মানুষের জীবন এবং সংগ্রামকে, সমুদ্র পাহাড় আর নিসর্গ প্রকৃতিকে মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার যে নৈপুণ্য তিনি দেখিয়েছেন জোড়া-উপন্যাসে তা মনোমুগ্ধকর। এই জোড়া উপন্যাসে তার শৈশব কৈশোর এবং যৌবনের আত্মছায়াও দুরলক্ষ্য নয়। এমন বিশ্বস্ত বয়ানে তিনি এই কাহিনি বলেছেন, অভিজ্ঞতার বাইরে থেকে দেখা অসম্ভব।

লেখক: কবি

——————–

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button