বইকথা
বাংলাদেশ বা বাংলা ভাষার শিল্পকলা-সমগ্রে কবিতাই সবচেয়ে প্রভাবশালী শাখা। প্রাচ্যের এ অঞ্চল এমন যে, উঠতি বয়সের আবহাওয়াই কবিতার মুখোমুখি করে দেয়। তারুণ্যে প্রেম যেমন, দ্রোহ যেমন, ফুলের কাঁটার আঘাতে ক্ষত যেমন, কবিতার উপস্থিতিও প্রায় অনিবার্য সেরকম। তো সেই তারুণ্যের অসুখে আক্রান্ত বাঙালি যুবক পরিণত হতে হতে অনেকেই আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন কবিতা তাকে ছেড়ে যায়। সে ভালো হয়ে যায়। জীবনের অন্যান্য ঘনঘটার সঙ্গে সন্ধি হতে থাকে তার। কিন্তু কতিপয় বাঙালি তরুণের, জীবনের অন্যান্য সিঁড়িতে হাঁটতে হাঁটতেও কবিতা থেকে আর মুক্তি মেলে না। কবিতার সঙ্গেই একটা সাংসারিক বোঝাপড়া হতেই থাকে এবং তাকে কবি হিসেবে শনাক্ত করেন পাঠক। পাঠক তাকে আবিষ্কার করেন। হতে পারে পাঠক আদতে কবি ও কবিতার ভেতর দিয়ে পৌঁছুতে চান সেই স্বর্গদ্বীপে, গোপনে যেখানে রয়েছে তার নিজেরই অধিবাস। কবি সেখানে শব্দ-বাক্য-অনুভূতির ভেতর দিয়ে পাঠকেরই প্রতিনিধি বা কবি ও পাঠক একাকার। মোস্তফা মোহাম্মদ তেমনি একজন কবি, বয়স বাড়বে তার কিন্তু কবিতা থেকে তিনি মুক্তি পাবেন না। গত শতকের একদম শেষ দশকে এসে যারা তারুণ্যে মুখর ছিলেন, মোস্তফা মোহাম্মদ তাদেরই একজন। এখন এই নতুন শতাব্দীর দুদশককাল অতিক্রমণের পর বর্তমানে যারা তরুণ, তরুণ কবি এবং বর্তমানের পাঠক, তাদের মুখোমুখি কবি মোস্তফা মোহাম্মদ। যেহেতু কবিতার সঙ্গে তারুণ্যের সমান্তরাল বোঝাপড়া চিরকালের, কাজেই শক্তিশালী কবি যেমন সবসময়ই তরুণ, প্রজ্ঞাবান পাঠকও সবসময় তরুণ থেকে যান। মোস্তফা মোহাম্মদ শক্তিশালী কবি হিসেবে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন বলেই তিনি সর্বদাই তরুণ আমাদের সামনে। এবং এই মুহূর্তে আমি দুইটি কবিতার বইয়ের মুখোমুখি, এক, ‘স্বর্গদ্বীপ ও ঝিনুকের গল্প’, অন্যটি ‘তোমার আগুনে পুড়ে।’ গ্রন্থদ্বয়ের প্রণেতা মোস্তফা মোহাম্মদ।
কবি বলছেন :
‘এতটা কাছের তুমি, দূরের আরও তত
প্রণমি তোমায় প্রিয়, প্রণতি আমার শত
সূর্যটা চুম্বনে খেলে যায়, যতটা কাছে পায়
অমরতা পাবার আগে, গুনগুন গান গায়
যতটা দূরের তুমি, কাছের চেয়ে প্রিয়
শিয়রে গজল-গালিব পানপাত্র ভরে দিও
জ্বলজ্বলে আগুণ মাথায়, নিশিদিন খেলে যাও
উন্মত্ত হরিণীর বুকে, কী সুখ তুমি পাও
আকাশে ওড়াও নীল, চোখের রঙ প্রিয়
আমার আত্মা কাঁপে, ভেতর-বাহির দিও
শিরায় কাঁপন জাগাও, অন্তরে অনন্তের হাসি
তোমাকে পাবার আসায়, হররোজ ছুটে আসি
তুমি বেঁধেছ আমার মন, বহুকোষী শরীর নয়
তোমার রঙের খেলায়, দেহমন পূর্ণতা পায়
কবিতাটি ‘স্বর্গদ্বীপ ও ঝিনুকের গল্প’ কাব্যগ্রন্থ থেকে এখানে উদ্ধৃত। প্রায় ৫৯টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত এই গ্রন্থে বিভিন্ন শিরোনামের কবিতা যেমন আছে, আছে সিরিজ শিরোনামের কবিতা। আছে ‘ঝিনুক’ সিরিজ। ‘ঝিনুক ১’ এ কবি বলছেন :
যতই গভীরে যাই নুড়ি
যতই উপড়ে উঠি বালি
জলে ডুবে খুঁজি আমি আলো
তোমার ভেতরে কোন শাঁই দিল
বুকের ভেতরে খুঁজি মুক্তার দানা
চোখের ইশারাতে অসীমের ঠিকানা
পেটের বেদনা সে তো ঝিনুকের প্রেম
সেই খেলা পূর্ণতায় পান করে হেম
বনবাসে যায় সীতা স্বর্গত্যাগী হাওয়া
কামনার বিষে পুড়ে নীল হয়ে যাওয়া
ফলবতী বৃক্ষের নাইকো ভাবনা
আমাদের ভালোবাসার দুষ্মন্ত-জনা
তোমার জলেতে কুমির কীভাবে নামিল
বুকের সাগরে কে বা এত প্রেম দিল
ঝিনুক―
কী এক অপূর্ব অভিলাষ
প্রেমের আখরে পূর্ণতায় বসবাস
তোমার বেদনা আমাকে ভাবায়
প্রেমের চোখে ডুব দিয়ে মুক্তা ফলাই
দেশ-কাল-ইতিহাস চেতনা, প্রেম- বিরহের সম্মিলন ঘটেছে কবি মোস্তফা মোহাম্মদের কবিতায়। এবং সমকালীন কবি সমাজের হট্টমালার বাইরে তিনি নিজের মতো হাঁটেন, এটি তার ক্ষমতা। ‘তোমার আগুনে পুড়ে’তে রয়েছে প্রায় একশত পঁচিশটি কবিতা। এই গ্রন্থের একটি কবিতা ‘জলের অতলে’ :
‘আমাদের প্রেম রক্তাক্ত জীবনের দীর্ঘ ইতিহাস
তোমার আর্কাইভে রাখা জমানো বরফ ধুলোবালি যতসব―
আবর্জনার স্তূপ ঘেঁষে বের করা আমার স্বদেশ
স্তনের উত্তুঙ্গ চূড়ায় কেওকারাডং, কটিদেশে নিকনো নদী
নাভিমূলে অথৈ সাগরথরূপে ভরা তুমি, তোমার
শস্যদানা রুপালি ইলিশ লুটে নেয় পর্তুগিজ-হার্মাদ-ওলন্দাজ
ইংরেজ জলদাস।
জলের অতলে নুড়ি ঝিনুকের মুক্তাফলানো বেদনা
মায়ের পেটে ভ্রূণ আমাদের ভালোবাসা― আমাদের সংগ্রাম
১৭৫৭ থেকে ১৯৭১―এই দীর্ঘ পথ চলা।
চলতে চলতে আমরা খাদের কিনারে গেছি বহুবার―রিক্তচিত্তে
ফিরে গেছি―করেছি যুদ্ধ সঞ্চালন, হয়েছি উদাস।
তোমার আর্কাইভে আমি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি
হৃদয়ের সমস্ত আকাশবাম স্তনের নিচে
কোথাও ২৫ শে বৈশাখ, ১১ জ্যৈষ্ঠ, ২২শে শ্রাবণ
১৬ই ডিসেম্বর আর ২৫শে মার্চ― আর ডান স্তনের
সমস্তটাই জুড়ে হায়েনার শ্বাপদ নখর…
আগেই বলেছি, কবিতায়ই শুধু রোমান্টিসিজম দ্বারাই আটকে থাকেন না কবি মোস্তফা মোহাম্মদ, তিনি তার দেশকাল ও সময়ের প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন। এভাবেই সমৃদ্ধ হতে থাকে বাংলা কবিতা। দুইটি কাব্যগ্রন্থ থেকে মাত্র দুইটি কবিতা উদ্ধৃত করেই কবিকে পুরোপুরি পাঠকের সামনে উন্মোচিত করা অসম্ভব। বরং যেকোনও পাঠকের জন্যেই যা করণীয়, নিজের মতো করে কবিতা পাঠ করা। আশা করি, পাঠক আদর করে হাতে তুলে নেবেন মোস্তফা মোহাম্মদ প্রণীত কাব্যগ্রন্থ স্বর্গদ্বীপ ও ঝিনুকের গল্প ও তোমার আগুনে পুড়ে। লেখালেখিতে পাঠকই শেষ কথা। কবিতার পাঠক আর কবির মধ্যে যে দূরত্ব, তা যেমন সামান্য, কখনও কখনও সামান্য নয়, অধিক। হয়তো অভিজ্ঞতার পার্থক্য থেকে যায়। তারপরও কোনও সংবেদনশীল পাঠক পোড়েন না? কোনও পাঠক স্বর্গদ্বীপে পৌঁছুতে চান না?
আশা করি, বই দুইটি সংগ্রহ করবেন আপনারা। পাঠ করবেন। কবি ও কবিতাকে আবিষ্কার করবেন। দেখবেন, কবিতা পড়তে পড়তেই আপনার মন আনন্দ-ভালোবাসায় আকীর্ণ হয়ে উঠেছে। কবির দহনও আপনার ভেতরে পৌঁছে আপনাকে পোড়াচ্ছে, জ্বালাচ্ছে। সেই জ্বালায় কি পুড়তে চান না?
লেখক : কবি