আর্কাইভগল্প

গল্প : আত্মহত্যার পূর্বাপর : মাহবুব আজীজ

ফাল্গুন মাসের এক দুপুরে নিয়ামুলের বউ ঘরের বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে দড়ি টাঙ্গিয়ে তাতে ঝুলে পড়ে। নিয়ামুল তখন ইশকুলে, সে পলাশীহাটা উচ্চবিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক―দুপুরে, একা ঘরে গলায় নাইলনের দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়ে নিয়ামুলের বউ রানু। প্রতিবেশী সিতারা বেওয়ার অনুসন্ধানের আওতায় আসবার আগে যে সময় পর্যন্ত ঝুলে থাকে রানু, ততক্ষণে তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে ওঠে।

২১/২২ বছরের তরুণী রানু যখন পলাশীহাটা উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ে, তখন সে নিয়ামুলের সরাসরি ছাত্রী; গণিতে প্রাইভেটও পড়ে সে নিয়ামুলেরই কাছে। আমরা, বাদিহাটির যুবকেরা তখনই জানি, পুতুলমতো মুখের রানুকে নিয়ামুলের বড্ড পছন্দ, বিদ্যালয় ছেড়ে ফুলবাড়িয়া কলেজে ভর্তি হয় রানু; নিয়ামুল আর রানুর প্রেমের কথা তখন আমরা জানতে পারি। রানুর উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হলে, চার বছর আগে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হয় তাদের, পলাশীহাটা ইশকুলের পাশে চার তলা ফ্ল্যাট বাড়ির তিন তলায় আড়াই কক্ষের ভাড়া বাসায় টোনাটুনির সংসার শুরু হয়। আমরা অনুমান করি, তারা বেশ সুখে আছে, শুক্রবার কি এটা-ওটা ছুটির দিনে রানুকে নিয়ে নিয়ামুল ফুলবাড়িয়ার একমাত্র সিনেমাহলে যায় সিনেমা দেখতে; এই জুটিকে আমরা বড় ঈর্ষার চোখে দেখি, ২০২৪ সালে যখন ফুলবাড়িয়া, বাদিহাটি কি কাওয়ানাড়ার রাস্তায় মেয়েদেরকে, মাথায় হিজাব ছাড়া আমরা প্রায় দেখিই না; তখন রানুকে আমরা বরাবরের মতো দেখি পিঠ ছাওয়া চুল লম্বা বেণীতে সুশোভন ও শ্যাম বর্ণের মসৃণ ত্বকে পুরু ঠোঁটের স্মিত হাসিতে তার চারপাশের ভুবন রঙিন করে তুলতে; চওড়া কপালে তার জ্বলজ্বল করে লাল টিপ, কাক কালো চোখের নিচে পুরু কাজল টেনে রানু যখন হেঁটে যায় আমাদের সামনে দিয়ে, বরাবরই আমরা নিজেরা নিজেদের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শব্দ শুনি। বানাড়ের তীরে বাদিহাটির একমাত্র রাইস মিল মেসার্স জাহাঙ্গির অ্যাণ্ড সন্সের মালিক মোহাম্মদ জাহাঙ্গির আলমের কনিষ্ঠা কন্যা বিলকিস আক্তার রানু গ্রামের আর দশজন সাধারণ তরুণী থেকে অবশ্যই আলাদা―তা সে রূপে তো বটেই, আচরণে ও কথায়ও; সেই রানু, স্বামীর সঙ্গে সুখীসুন্দর রানু কেন এক দুপুরে নিজের ঘরে বৈদ্যুতিক পাখার সঙ্গে নীলরঙা নাইলনের শক্ত দড়িতে নিজেকে ঝুলিয়ে দেয়, তা আমাদের বুদ্ধিতে কুলোয় না।

ফুলবাড়িয়ায় তিন/চার তলা ফ্ল্যাটবাড়ির চল শুরু হলেও কেশোরগঞ্জ বাজারে এখনও ততোটা নয়; তারপরও যে দুই/চারটা বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি এই বাজার ঘিরে তৈরি ও চালু হয়, তারই একটির তিন তলার দক্ষিণমুখী আড়াই ঘরের ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে রানু আর নিয়ামুল। দোতলায় বাড়িওলা কুদ্দুছ আকন্দের বউ সিতারা বেওয়া দুপুরে খাবার টেবিল গোছানোর এক পর্যায়ে রানুর সন্ধানে যায়, উপর্যুপরি ডাকাডাকি করে দীর্ঘ সময়ে রানুর কোনও সাড়া না পাওয়ায় তার সন্দেহ হয়, স্বামী কুদ্দুছ আকন্দকে জানায় সিতারা বেওয়া, উপযাচক হয়ে কুদ্দুছ চারদিক খবর করে যে, বাসার দরজা ভেতর থেকে অনেকক্ষণ বন্ধ, রানুর সাড়া পাওয়া যায় না; তারা ইশকুলে খবর পাঠায়, নিয়ামুল দৌড়ে আসে; এরপর আর যা হবার তাই হয়; দরজা ভাঙ্গা হয়, নাইলনের দড়িতে ঝুলতে থাকা রানুর পা ধরে চিৎকার করে কাঁদে নিয়ামুল, ‘এইটা কি করলা!’

 ‘আহারে, রানুরে, আমি ওর ফিরিজে রাখা গোশতের বাটি আনতে গিয়া দেখি রাও নাই সারা বাড়িত’―বলে আর কাঁদে সিতারা বেওয়া, প্রতিবেশী রানুর ফ্রিজে মাংসের বাটি রাখে সিতারা, দুপুরে খাবার টেবিল গোছানোর সময় তাই আনতে গিয়ে বহু ডাকাডাকির পর আবিষ্কার করে যে, রানুর সাড়াশব্দ নাই! নিজেদের ফ্রিজ ক’দিন ধরে কাজ করে না, তাই প্রতিবেশীর এই সহযোগিতা কদিনই নিয়ে চলছিল সিতারা; ভিড় বাড়ে, সিতারা কেঁদেই চলে, ‘বড়ই লক্ষ্মী মেয়েগো, হাসিছাড়া কথা নাই। আমারে খালি কইতো, চাচিআম্মা আপনে খালি পুরান শাড়ি পিন্দুইন ক্যান!’ কুদ্দুছ আকন্দ কেশোরগঞ্জের ব্যবসায়ী, কাপড়ের দোকান থেকে শুরু করে রাইস মিল তার বেশ কয়েকটা; কাওয়ানাড়ার জাহাঙ্গির আলম তার নিকট বন্ধু, তারই কন্যা তাদের ভাড়াটিয়া রানু নাইলনের দড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা করে, এই শোকের কোনও তুলনা হয় না কুদ্দুছ-সিতারার। আর নাইমুল কিংকর্তব্যবিমূঢ় শব্দটির প্রতিরূপ হয়ে হতভম্ব দাঁড়িয়ে থাকে; কিছুক্ষণ কেঁদেকেটে সে আমাদের কয়েকজনকে ডাকে, আমরা যারা বাদিহাটি-কাওয়ানাড়ার যুবকের দল, নাইমুলের চেয়ে বছর তিন/চারের ছোট হলেও সমাজে চলাফেরায় নাইমুল আজকাল আমাদের অনেক উঁচুতে বটে, তারপরও বিপদের সময় আমাদেরই সবার আগে নাইমুল ডাকে, আমরা তার পাশে দাঁড়াই।

নাইমুল যখন পলাশিহাটায় অষ্টম-নবম শ্রেণিতে পড়ে আমরা অধিকাংশ তখন একই ইশকুলে পঞ্চম-ষষ্ঠ শ্রেণিতে; ইশকুলের অতি উজ্বল ছাত্র নাইমুল, ক্লাসে প্রথম স্থান তার অবধারিত, মাধ্যমিক পাস দিয়ে সে যায় আনন্দমোহনে; আর আমরা বেশির ভাগ ইশকুলের গণ্ডি একবারে পেরুতে পারি না। গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে আমরা যারা একত্রে চলি; তাদের চার/পাঁচজন মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হই, তাদের গন্তব্য বড়জোর ফুলবাড়িয়া কলেজ, বাকিরা মাধ্যমিকের আগে ঝরে যাই। দিনের অনেকটা সময় আমাদের কাটে বানাড় নদীর পাড়ে দোকান থেকে দোকানে; অবশ্য সুখের সময় আমাদেরও শেষ হয়, বাবা-চাচাদের নির্দেশ ও পীড়নে আমাদের বেশির ভাগ বাদিহাটা কি কাওয়ানাড়া বাজারে এর-ওর দোকানে দাখিল হই, একটু আধটু ব্যবসা করি বা বুঝবার চেষ্টা করি; এর মধ্যে রানুর এই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়া আমাদের যুবকদের আবার অনেক দিন পর নিজেদের একত্র করে, আমরা ঘন হয়ে দাঁড়াই নিয়ামুলের পাশে। তারই একদা ছাত্রী রানু, বয়সে ১০/১২ বছরের ছোট, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই বয়সের ব্যবধান ফুলবাড়িয়া বাদিহাটিতে কোনও বিষয়ই না বটে; বাইরে থেকে বরাবর তাদের দুইজনের হাসিমুখ দেখে ভেতরে আমরা ঈর্ষান্বিত হই; অবশ্য তাদের সন্তান নাই কেন ? এই প্রশ্ন আড়েঠারে উঠলেও তাদের আমাদের সুখী মনে হয়; আমরা বুঝতে পারি না, কোন কারণে রানু আত্মঘাতী হবার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নেয়।

রানুর আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ বুঝতে না পারলেও আমরা বুঝি নাইমুল ভয় পায়, তাকে পুলিশ প্রথমেই সন্দেহ করবে; আর তা করেও বটে। সন্ধ্যার আগে, রানু আর ততক্ষণে রানু নাই, তার পরিচয় হয়ে ওঠে―‘লাশ’; সেই লাশ ফুলবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে, পোস্টমর্টেম হতে থাকে; তার বাইরে অপেক্ষারত―ততক্ষণে খবর পেয়ে চলে আসা রানুর বাবা, মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন; আছি আমরাও―যুবকেরা আর নাইমুল আর পুলিশ। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসে―আত্মহত্যা, গলায় দড়ি দিয়েছে রানু নিজেই; আর তারপর জানাজার জন্য কাওয়ানাড়ার দিকে এগুতে থাকে উপস্থিত স্বজনেরা রানুর লাশসহ, আচমকা রানুর মা মাজেদা বেওয়া চিৎকার করে বলে, ‘এই কুত্তার বাচ্চার জন্য আমার মেয়ে মরছে। এই কুত্তার বাচ্চা আমার মেয়েকে মারছে…’

চারপাশে হুল্লোড়ে আমরা বুঝতে পারি, সারমেয় শাবক বলে যাকে শনাক্ত করছেন রানুর মা মাজেদা, সে নিয়ামুল হক, রানুর স্বামী। মাজেদা বেওয়া অশ্রুসজল ক্রুদ্ধ কণ্ঠে সজোর চিৎকার করে, ‘সারাদিন ছাত্রীদের লগে ফুসুর ফুসুর করে আর আমার মাইয়ার গায়ে হাত তোলে! আসল খুনি তো এইটা। আমি ক্যান মেয়েরে বাড়িত লয়া আইলাম না!’ হুল্লোড়-চেঁচামেচির মধ্যে শুনতে পাই মুরুব্বিরা রানুর মাকে থামাতে চেষ্টা করেন, আপাতত থামানও তারা; তবে এই প্রতিশ্রুতিতে যে, অবশ্যই রানুর আত্মহত্যার কারণ খুঁজে বের করে এর পেছনে কারু হাত থাকলে তার শাস্তির বিহিত তারা করবেন!

আর তারপর সেই রাতেই এশার নামাজের পর কাওয়ানাড়ায় পিতৃগৃহের উঠানের এক কোণে চার ভাইবোনের সবচেয়ে ছোট রানুকে কবরে শুইয়ে দেওয়া হয়। গোসল, দাফন―যাবতীয় কৃত্যাদি সম্পন্ন হয় নিয়ম মেনে, নিয়ামুল থাকে প্রতিটি কাজেই; আমরাও ছায়ার মতো তার পাশাপাশি থাকি, রানুকে কবর দেওয়া শেষ করে সমবেত দোয়ার পরই ফুলবাড়িয়ার পুলিশ নিয়ামুলকে তাদের সঙ্গে থানায় যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে তাকে পুলিশের গাড়িতে তোলে।

২.

আমরা শুনতে পাই, নিয়ামুলকে পুলিশ কঠিন জিজ্ঞাসাবাদ করে। থানা পুলিশ ঘটনা জানবার পরই সরকার পক্ষের হয়ে অপমৃত্যুর মামলা রুজু করে, তার কিছুক্ষণের মধ্যে রানুর পিতা বাদী হয়ে নিয়ামুলকে আসামি করে ফৌজদারি মামলা করেন। জানাজা শেষের আগেই মামলা দায়ের হয়, রানুর বড় দুই ভাই দ্রুত মামলার ব্যবস্থা করে। চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় পরবর্তী ২৪ ঘণ্টর মধ্যে ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ কোর্টে আসামি নিয়ামুলকে হাজির করে জামিনের আবেদন করা হয়। জাহাঙ্গির আলমের সুহৃদ বন্ধু, নিয়ামুলের বাড়িঅলা কুদ্দুছ আকন্দ আর তার স্ত্রী সিতারা বেওয়া আদালতে সাক্ষী দেয়, প্রায়ই রানুকে আজেবাজে কথা তো বলেছেই, তার গায়েও হাত তুলেছে নিয়ামুল, যা প্রতিবেশী হওয়ায়  সিতারা বেওয়ার কানে আসে। রানুও বিভিন্ন সময় তার এই চাচিআম্মার সঙ্গে সুখদুঃখ ভাগ করে বলেছে এসব কথা। আরও সাক্ষী হয় রানুর মা মাজেদা, তারও সিতারার মতোই অভিযোগ―বাইরে নানা সম্পর্ক রেখে চলা নিয়ামুল স্ত্রীর প্রতি পুরো মনোযোগী ছিল না। অবশ্য সাক্ষী-সাবুদ নিয়ামুলের পক্ষেও দাঁড়িয়ে যায়, আমাদেরই এক বন্ধু তরিকুল, ঠিকাদারির কাজ করে―ফুলবাড়িয়ায় সরকারি দলের সবচেয়ে উঁচু নেতার ডান হাত, বাঘা উকিল সে বন্দোবস্ত করে। উকিল প্রমাণপত্র পেশ করে, স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রানু সন্দেহপ্রবণতায় ভুগে প্রায়ই স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া বাধাতো। রানুর নিজের মাত্রাতিরিক্ত সন্দেহই তার আত্মহত্যার কারণ, অন্য কেউ নয়।

জেলা ও দায়রা জজ কোর্টে যখন এইসব সওয়াল-জবাব চলে আমাদের চোখের পাতা পড়ে না। হায়, বিচিত্র জগৎ ও জীবন। বেঁচে থাকতে যে রানুকে আগলে আগলে চলতে দেখেছি নিয়ামুলকে, আকস্মিক কোন ঘটনা নিয়ামুলকে বিপরীত মেরুতে দাঁড় করিয়ে দিয়ে হিসেব কষে দেখে নিচ্ছে―নিয়ামুল বা রানু, কার দোষে ঘটনা ঘটে ? রানুকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে গেছে নিয়ামুল ? সমাধান সহজে মেলে না, তবে নিয়ামুলের জামিন মেলে। সে জেল থেকে বেরিয়ে আসে আমাদের সঙ্গে, আবার  সে যেতে শুরু করে পলাশীহাটা ইশকুলে; ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসও নিতে থাকে, প্রায় প্রতি মাসে মামলার তারিখ পরে। নিয়ামুলের সঙ্গে আমরাও কোর্টে যাই, সওয়াল-জবাব দেখি। এর মধ্যে জামিন পেয়ে নিয়ামুল ভাড়া বাসা বদলে বাদিহাটিতে নিজের পৈতৃক ভিটায় চলে আসে। কেশোরগঞ্জ থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাদিহাটির পৈতৃক বাড়িতে অনেক দিন পর নিয়মিত বাস করতে শুরু করে নিয়ামুল, অনেক দিন পর আমাদের সঙ্গে অর্থাৎ, বাদিহাটির যুবকদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে থাকে সে।

রানুর বড় দুই ভাই―পাশের গ্রাম কাওয়ানাড়া বাজারের দুই দোকানের মালিক, রফিক আর শফিক―আমাদের দু’চার বছরের বড় হবে; সেই হিসেবে নিয়ামুলের কাছাকাছি বয়স; ঘটনার পর পক্ষ-বিপক্ষের অবস্থানে আমরা বুঝতে পারি, বাদিহাটির বানাড় নদী ঘিরে যে বৃত্তাকার এলাকা বাদিহাটি, তার টান সত্যিই আলাদা। যখন নিয়ামুল বউ নিয়ে ঘুরে বেড়াতো এ পাড়া ও পাড়া―আমাদেরই সমুখ দিয়ে, আমাদের তেমন পাত্তা সে দিতো না―একে সে উচ্চ বিদ্যালয়ের ডাকসাইটে গণিত শিক্ষক, উপরন্তু অতি সুন্দরী বউ, তাকে আর পায় কে―নিয়ামুলের এই দেহভঙ্গিমা আমাদের চোখে পড়ে, তাকে এড়িয়ে দূর থেকে ঈর্ষা করা ছাড়া আমাদের উপায় থাকে না। অবশ্য বিপদে পড়ামাত্র নিয়ামুল আমাদেরকেই ডাক দেয়, আমরাও সব ভুলে মুহূর্তে তার পাশে দাঁড়িয়ে যাই।

নিয়ামুলের সঙ্গে আমাদের কথা হতে থাকে। বত্রিশ বছরের সুঠাম যুবক, মুখে কিশোর বয়সে ওঠা ব্রনের রয়ে যাওয়া বেশ কটি ক্ষতচিহ্ন, বসন্তের দাগ কপালে, ছোট করে ছাঁটা চুলে মাঝারি উচ্চতার শরীরে তামাটে গায়ের রঙ আর কটারঙের চোখ; অন্তরঙ্গভাবে না মিশলে মিতবাক নিয়ামুলকে মনে হবে অন্তর্মুখী বা অহংকারী, আমাদেরও তাই ধারণা ছিল; তবে রানুর আত্মহত্যার পর তিন মাস জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে আসা যে নিয়ামুলকে আমরা নিজেদের মধ্যে পাই, সে মিতবাক বটে; তবে সে কথা শুনতে পছন্দ করে! ইশকুলে কয়েক ক্লাস উঁচুতে পড়ায় বরাবর নিয়ামুলকে আমরা ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করি, এখনও তাই―অগ্রজের প্রতি অনুজের যেমন কিছু সম্ভ্রমজনিত দূরত্ব থাকে, ইশকুলে পড়বার সময় অবশ্য আমাদের মধ্যে তা ছিল না। নিয়ামুল ভালো ছাত্র হওয়ায় খানিক ভাব নিয়ে চললেও আমাদের কাছে কখনওই এসব গ্রাহ্য করবার মতো বিষয় ছিল না, এখনও নাই। অর্থহীন অফুরন্ত আড্ডা ও দুনিয়ার সমস্ত কিছুকে তুচ্ছ করে দেখবার মতো চমৎকার মানসিকতা আমাদের যূথবদ্ধ করে; আমরা বাদিহাটির যুবকেরা, আমরা যারা কোনওকিছুই তেমন সুবিধামতো করতে পারি না, তারা বানাড় নদীর তীরে আশ্চর্য বাতাসে বটগাছের নিচে বসে জীবনের যাবতীয় বিষয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করি। আমাদের এই অভ্যস্ত জগতে নতুনভাবে যুক্ত হয় জামিনে ছাড়া পেয়ে পৈতৃক বাড়িতে ফিরে আসা নিয়ামুল। আমাদের বেশ কয়েকজনের মধ্য থেকে তিন/চারজনকে নিয়ামুল নিজের বিশেষভাবে কাছের বলে মনে করতে শুরু করে, আমরা আরও অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে থাকি; আমরা নিয়ামুলের প্রতিকূল মানসিক পরিস্থিতিতে আরও সহানুভূতিশীল হবার চেষ্টা করি।

বুঝলি, কিছু ভুল আমি করে ফেলছি রে। মোখলেস।― আমাদেরই একজন, মোখলেস, বাবার জুতার দোকানে যে খণ্ডকালীন বসতে শুরু করে; তাকে উদ্দেশ্য করে এক সন্ধ্যা হয় হয় সময় বলে নিয়ামুল।

ভুল আমরা সবাই কমবেশি করি। ভুল নিয়া বইসা থাকলে হবে ? সামনের দিকে চোখ দিতে হবে। আল্লায় এই কারণে মাথার পিছে চোখ না দিয়া মাথার সামনের দিকে আমাদের চোখ স্থাপন করি দিছেন!―আমাদের মধ্যে দার্শনিক ধরনের চিন্তা ও বচনে পারদর্শী আবদুর রব। সে ফুলবাড়িয়া কলেজে বিএ ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষায় দুইবার  অনুত্তীর্ণ হয়ে পড়াশোনায় বিরতি দিয়ে স্থানীয় এমপি সাহেবের বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতি লেখার কাজে যুক্ত হয়ে ভালোই আয় রোজগার করে।

না রে। এত সোজা না। কিছু ভুল রক্তের মইধ্যে থাকে। এগলাই বিপদ ডাইকা আনে।―বলতে বলতে নিয়ামুল আর যা বলতে শুরু করে; আমাদের শিরদাঁড়ায় শীতল স্রোত বয়ে যায়।

সত্য যে, আমি কথা কইতাম। ছাত্রীদের লগে। এর মধ্যে ক্লাস নাইনের একটা মেয়েরে মাঝখানে বেশিই ভাল্লাগে, এটা ঠিকই। ফুটফাট ম্যাসেঞ্জারে কথা কই, একটু আধুটু ছবি-টবি দিতে কই, এগুলা এমন কি! রানু ধইরা ফেলে কয়েকবার। লগ আউট করতে ভুইলা যাই, ঘুমাই যাই। সে দেইখা মন খারাপ করে। চিল্লাচিল্লি করে। মুখে মুখে চোপা করলে রাগ মাথায় উঠে আমার। মাইর লাগাই। এরপর দেখি, আস্তে আস্তে আর কিছু কয় না আমারে!

আমরা শুনতে থাকি। নিয়ামুল কতটা বলে আর কতটা বলে না―আমরা অনুমান করি, শুধু কথা আর ম্যাসেঞ্জার নয়, ছাত্রী বা ছাত্রীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও সম্ভবত গড়ে তোলে নিয়ামুল আর তাদের কারু সঙ্গে নিয়ামুলকে রানু হাতেনাতে ধরে। দার্শনিক আবদুর রব সরাসরি নিয়ামুলকে বলেই বসে, ‘ভাইসাব। ছেলেমানুষ পাইছেন আমরারে! এট্টু কথাটথায় এতখানি হয় না। আপনি বিভিন্নজনের সঙ্গে ফিজিক্যাল শটে গেছিলেন। ধরা খাইছেন আচমকা! নয় ?’

নিয়ামুল আর আড়াল রাখে না। বলে―‘হ্যা। রানুর হাতে ধরা খাই। শুইছি তো ম্যালা। তবে হাতেনাতে ধরা খাইছি একজনের লগে। সেই ক্লাস নাইনের মেয়েটা। আমার ছাত্রী। সেদিন ওই সময়ে কাওয়ানাড়ায় বাপের বাড়িতে থাকবার কথা রানুর, সে ডুপ্লিকেট চাবি নিয়া সোজা বেডরুমে আইসা আমারে মাইয়ার বুকের উপরে ঠাইসা ধরে!’

আমরা নীরব হয়ে শুনতে থাকি।

নিয়ামুল বলে চলে, ‘এরপরে প্রায়ই ঝগড়া, মারপিট চলে। রাইতের পর রাইত যায়, রানু আমারে ছোঁয় না। আমি জোর কইরা করি মাঝেমধ্যে। সে সাপের মতো পইড়া থাকে। এর মধ্যে দেখি―ইউএনও ওয়াহাব সাহেবের বউ রিয়ার লগে বেজায় খাতির রানুর। রানুরই বয়সী রিয়া; গান গায়, ছবি আঁকে। ভড়ংয়ে বাঁচে না। ও আল্লা দেখি―রিয়ার কাছে রানু ছবি আঁকা শিখতেছে, ওয়াটার কালার! ওয়েল পেইন্টিং! বাপের জন্মে এইগুলা দেখছি আমি!…

কথায় বিভোর হয়ে থাকে নিয়ামুল; নিজেকেই যেন বলতে থাকে সে―‘রানু গানের রেওয়াজ করে ভোরে উইঠা। চাইর বছর বিয়া হইছে আমাদের, পোলা-মাইয়ার খবর নাই। সারাদিন গান-বাজনা, ছবি আঁকাআকি! রিয়া, রিয়া করে পাগল হয়ে থাকে রানু। একটা কিছু রান্না করলে, রিয়ার জন্য সেটা নিয়া ছুট! দেখি একদিন শাড়ি কিনে রিয়ার লাইগা, একদিন সেই শাড়ির পাড় লাগাইতে যায় সেই কতদূরে। রিয়ার লাইগা ব্লাউজ, শখের পুতুল কিনতে যায় কই কই…। আর ঘুরে। এরা দুইটা সুযোগ পাইলেই এইখানে ওইখানে টো টো করে!… আমার সহ্য হয় না। একদিন কয়াই ফালাইলামÑতুমি তো ইউএনওর বউ রিয়ার লগে শোও। নইলে সকালে উইঠা আ-আ গান! আর, দুপুর রইদে ব্লাউজ বানাইতে যায় কেউ ? হুদাহুদি! আমি কইতেই থাকি―তুমি যেমনে রিয়ারে দেইখা খুশি হও। এইটা কোন মেয়েছেলে আরেক মেয়েছেলের জন্য হয় না। এইটা অন্য কিছু! আমার লগে সাপের মতো পইড়া থাকো-ঠান্ডা, আর রিয়ারে দেইখা চিতার মতো দৌড়াও। সব বুঝি।’

তখন সন্ধ্যার রঙ ফিকে হয়ে রাতের অন্ধকারের দিকে এগোয়, বানাড়ের তীরে মৃদু বাতাস আমাদের ঘিরে রাখে। হুহু করে কাঁদে আর বলে নিয়ামুল―‘আমিই শালার শুইতে শুইতে মানুষের মধ্যে শোয়া ছাড়া কিছু দেখি নাইরে! রানুরে কি দোষ দিমু আর!

সম্ভবত মানুষ পশুই; বিবেকবর্জিত মানুষের অর্থহীন আর্তনাদে বিরক্ত হয়ে বাস্তবিক পশুরা তাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে মানুষের সঙ্গে কখনই কথা বলে না।

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button