আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

সুফিয়া কামাল : ভাষা ও প্রগতিশীল : আন্দোলনে নিরলস অভিযাত্রী : মালেকা বেগম

প্রচ্ছদ রচনা : বাংলা ভাষা

১৩১৮ সনের ১০ আষাঢ় (২০ জুন ১৯১১) বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদ পরগনার জমিদার পরিবারে জন্মেছিলেন সুফিয়া খাতুন।

একটি শিশুর জন্মের পর বাড়িতে সবার মধ্যেই সাধারণত আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। একই ঘটনা ঘটেছিল তাঁর জন্মের পরও। নানি নবজাতিকার নাম রাখলেন হাসনা বানু। হাতেমতাই পুথি পড়ে শোনাতেন সুফিয়ার মা। সেই কাহিনির ‘হাসনা বানু’ চরিত্রটি নানির খুবই পছন্দের ছিল। নাতনির মুখে মধু দিয়ে নাম রেখেছিলেন ‘সুফিয়া খাতুন’। তবে পরিবারের আত্মীয়-স্বজন তাঁকে ডাকতেন হাসনা বানু, হাসু বানু বা হাচু বানু বলে। সুফিয়া খাতুন ছিল তাঁর আনুষ্ঠানিক নাম।

একালে আমাদের কাল বইটিতে তিনি নিজের জীবনের বহু কথা লিখেছেন । বলেছেন, ‘এ আমার জীবনী নয়। সুদীর্ঘকাল পরিক্রমার সামান্য ইঙ্গিত।’ বলেছেন, ‘সেকালের জমিদার বাড়িতে পুণ্যাহ বলে একটি পর্ব অনুষ্ঠিত হতো। আনন্দ কলরবে আমার জন্মক্ষণটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল বলে শুনেছি।’

তাঁর লেখা এবং অন্যদের লেখা থেকে আমরা সুফিয়া কামালের ৮৮ বছরের কর্মবহুল জীবন সম্পর্কে জানতে পারি। দেশ-বিদেশের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার প্রিয় ছিলেন তিনি। মৃত্যু তাঁকে অমর করেছে।

২.

সুফিয়া কামালের শৈশব-কৈশোর কেটেছে পরিবারের অন্দরমহলে। শৈশবেই জেনেছিলেন, তাঁদের অন্দরমহলেই থাকতে হয়। অন্দরমহলের স্মৃতির বর্ণনায় শৈশব থেকে জানা মেয়েদের অবরোধবাসের কথা তিনি বলেছেন। সাত বছর বয়স থেকে তাঁকেও পরিবারের বেগম-বিবি তথা মা-মামিদের সঙ্গেই পর্দানশিন জীবনযাপন করতে হয়েছে। দেয়ালঘেরা বিরাট বাড়ি। ভেতরবাড়িতে সবুজ বাগানের শোভা। পুরুষ-বিচ্ছিন্ন অন্দরমহলের বিবি ও অবিবাহিত মেয়েদের গোসল করার জন্য ছিল একটি পুকুর। হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়চোপড় ইত্যাদি ধোয়ার জন্য ছিল আরেকটি পুকুর।

নদীর সঙ্গে যোগ ছিল অন্দরের পুকুরের। নদীর পানি-মাছ চলে আসত সেই পুকুরে। বাড়ির নারীরা অবসরের আনন্দে সেই মাছ ধরতেন। সাঁতার কাটতেন। নৌকা বেয়ে আনন্দ করতেন। শিশু সুফিয়াও এই আনন্দ-উৎসবে নিঃসংকোচে অংশ নিতেন। গরমের দিনে দুপুরে থাকার জন্য অন্দরমহলের ভেতরে ছিল আটচালা বাংলো ঘর। সেই ঘর থেকে সিঁড়ি বেয়ে পুকুরে যাওয়া যেত। রান্নাবান্না ও খাওয়াদাওয়া সেরে বউ-ঝি-মায়েদের সবাই পুকুরধারের বাংলোঘরে যেতেন, মেহেদি বেটে হাত রাঙাতেন, শিউলি বোঁটার রঙে কাপড় রাঙাতেন। তাঁর শৈশব কেটেছে অন্দরের এই রকম ঘেরাটোপের সীমানায়।

অন্দরমহলের সীমানায় বন্দি থাকা সত্ত্বেও শৈশবের দিনগুলোতে কালবৈশাখীর মধ্যে আম কুড়ানোর আনন্দে মেতেছেন তিনি। ছয় ঋতুর প্রতিটি ঋতু তিনি উপভোগ করেছেন বাড়ির অন্যসব বালিকা শিশুর সঙ্গে মিলেমিশে। শিউলি ফুলের রসে কাপড় রাঙানো এবং রং ছোড়াছুড়ির খেলায় অন্দরে যোগ দিতেন দুলাভাই এবং নানা-নাতি সম্পর্কের পুরুষ আত্মীয়স্বজনেরাও।

মায়ের কাছে রূপকথা শুনতেন। শুনতেন পুথির গল্পও। সেসব গল্পের শাহজাদিরা তাঁর মনে স্বপ্নপুরী গড়ে তুলেছিল। শিশু বয়স থেকেই তিনি ভাবুক হয়ে উঠতে থাকেন। গরমের দিনে পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে মা-মামিরা নামাজ পড়ে, চা খেয়ে, সেজেগুজে আনন্দ করতেন। সেই আনন্দের মধ্যেই অঙ্কুরিত হয়েছিল তাঁর কবিমন।

৩.

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনে, ১৯৬০-এর দশকের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেও ছিল তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ। আবার ১৯৭২ থেকে শুরু হওয়া প্রগতিশীল বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনে, ১৯৭৫ থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত অব্যাহতভাবে গণতন্ত্রের বিজয় অর্জনের আন্দোলনেও ছিল তাঁর অপরিসীম ভূমিকা। রাজনীতির দলীয় কর্মকাণ্ডের বাইরে সংস্কৃতিসেবী, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী, নারী ও শিশুদের অধিকার অর্জনের ধারাবাহিক সংগ্রামে-মিছিলে সুফিয়া কামাল বরাবর পালন করেছেন সাহসী জননীর ভূমিকা।

সুফিয়া কামালের প্রতিটি দিন ও মুহূর্তের কর্মকাণ্ড লিপিবদ্ধ করলে বাংলাদেশের ইতিহাস নতুন আলোকে উদ্ভাসিত হবে। তাঁকে ছাড়া এ দেশের রাজনীতির প্রগতি থমকে যেত, শিশুদের জন্য আনন্দময় শৈশব রচনার কাজ বন্ধ হয়ে যেত, নারীদের অবরোধমুক্তির সক্রিয় আন্দোলন-সংগ্রাম হতো না।

উল্লিখিত সবক্ষেত্রে সুফিয়া কামালের অবদান তাঁর নিজের জীবনকেও করে তুলেছে মহাগৌরবে গৌরবান্বিত। দেশ ও জাতির অগ্রগতিতে অসংখ্য মানুষের যে অবদান, তারও মূলে রয়েছে তাঁর অপরিসীম নেতৃত্ব-শক্তি।

শিশু-কিশোর ও তরুণ ছেলেমেয়েদের কাছে তিনি ছিলেন তাদের দুচোখের মণিস্বরূপ। ছিলেন তাদের কাছে নবজীবনের দূতস্বরূপ মহীয়সী। তাঁকে ঘিরে শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের জীবন যেন নতুন করে স্ফূর্তি পেত।

ভাষা আন্দোলন

সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন শুরু করে দিয়েছেন। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার ছিল উর্দু ভাষা প্রচলনের পক্ষে। বাংলা ভাষা আর বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের ষড়যন্ত্রের শেষ ছিল না। ছাত্রসমাজের আন্দোলন দমাতে তারা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাজপথে পুলিশ ও সেনাবাহিনী নামাল। গুলিতে শহিদ হলেন ছাত্র-পথচারীসহ অনেকে। খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা প্রদেশে। মিছিলে মিছিলে ছেলেমেয়েরা বলতে থাকে, আরও রক্ত নাও, আমরাও শহিদ হব তবু মায়ের ভাষা-মুখের ভাষা কেড়ে নিতে দেব না। সুফিয়া কামাল বেরিয়ে পড়লেন রাজপথে। দুই শিশুকন্যা সুলতানা ও সাইদাকে বুকে আগলে হাঁটা শুরু করলেন টিকাটুলীর বাসা থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে (আজকের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) তখন অগুনতি মানুষের ভিড়। সবাই কাঁদছে। শপথ নিচ্ছে তারা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ বলে। ‘শহিদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ বলে সুফিয়া কামাল মিছিলের সঙ্গে হেঁটে ঘটনাস্থলে এলেন। সবার সঙ্গে মিলে শপথ নিলেন। নারীদের নিয়ে সভা করলেন, প্রতিবাদ জানালেন।

দ্রুতই জানা গেল শহিদদের নাম। তাঁরা হলেন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, সালাম, রফিকসহ নাম না জানা আরও কয়েকজন। আহতও হলেন অসংখ্য ছাত্র-জনতা। বাঙালির এই আত্মত্যাগ ও আন্দোলনের ফলে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেল ১৯৫৬ সালে। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবস হিসেবে পালিত হতে শুরু করল। বাংলা ভাষার আন্দোলনে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যেমন যোগ দেন, জীবন দেন তেমনি যোগ দেন জায়া-জননীরাও। এই রকম বহু আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরে আজ একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেয়েছে। সুফিয়া কামাল এই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৯১ সাল পর্যন্ত একুশে ফেব্রুয়ারি, রাষ্ট্রভাষা ও শহিদ মিনার নিয়ে তিনি লিখেছেন ৬৫টি কবিতা। এসব কবিতার কিছু কিছু তাঁর বইয়ে স্থান পেয়েছে, কিছু অগ্রন্থিতও থেকে গেছে। নিচে তুলে ধরা হলো এরকমই অগ্রন্থিত দুটি কবিতা :

বাংলা মায়ের বুকের দুলাল

বাংলা মায়ের আশা

তাদের মুখে গানের মতো

ছন্দ মধুর ভাষা।

এই ভাষাকে রাখতে গিয়ে

শহিদ হলো যারা

বাংলাদেশের গানে গানে

রইল বেঁচে তারা।

তাদের তরে কান্নাত নয়

কণ্ঠে জাগাও সুর

শহিদ বীরের বন্দনাতে

পরান ভরপুর।

[আপন ভাষা]

অথবা

সেদিন প্রভাতে

মরণেরে তুচ্ছ করি প্রাণ লয়ে প্রাণের সভাতে

যারা এসেছিল বাহিরিয়া,

দিন শেষে যারা আর যায়নি ফিরিয়া

সন্ধ্যা-দীপ-জ্বালা-গৃহে মায়ের জীবন ভরি তার

নামিয়াছে অনন্ত আঁধার।

রচিয়াছে ভাষা যারা রক্তের অক্ষরে

বিশ্বের সভায় যারা শোণিত-স্বাক্ষরে

লিখিয়া রাখিয়া গেল নাম

একুশের এই দিনে তাহাদের জানাই সালাম।

[শহিদ-স্মৃতি]

 ঢাকা থেকে

লেখক : শিক্ষাবিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button