অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

জাগুয়ার সূর্যের পদতলে : ইতালো ক্যালভিনো

অনুবাদ গল্প

ইংরেজি অনুবাদ : উইলিয়াম উইভার

বাংলা অনুবাদ : উৎপল দাশগুপ্ত

[ইতালো ক্যালভিনো ১৯২৩-১৯৮৫ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালির একজন বিশিষ্ট লেখক এবং সাংবাদিক। বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত ইতালিয়ান সাহিত্যিকদের অন্যতম। The Path to the Spider’s Nests, Invisible Cities, If on a Winter’s Night a Traveller―তাঁর লেখা কয়েকটি বিখ্যাত উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ।

 ইন্দ্রিয়ানুভূতি নিয়ে তিনি পাঁচটি গল্প লেখার পরিকল্পনা করেন। উপরিউক্ত গল্পটি তারই একটি। এই গল্পের উপপাদ্য বিষয় হলো রসনা। দুঃখের বিষয় তিনটি গল্প লেখার পরেই তাঁর মৃত্যু হয়।]

বানানটা খটোমটো হলেও স্থানীয় উচ্চারণে ‘ওয়ায়কা’। আমাদের এই হোটেল কোনও একসময় ছিল সান্তা ক্যাতালিনার কনভেন্ট। ছোট্ট ঘরটার ভেতর দিয়ে বারে যেতে গিয়েই পেন্টিংটা নজরে পড়ল। বেশ বড়সড় ক্যানভাস। পাশাপাশি দাঁড়ানো এক তরুণী নান আর এক বৃদ্ধ যাজকের প্রতিকৃতি। প্রায় স্পর্শ হয়ে যাবার মত স্বল্প ব্যবধানে পাশাপাশি রাখা দুজনের হাত। একটু আড়ষ্ট ভঙ্গি। অষ্টাদশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিক শিল্পকলার এক স্থূল নিদর্শন। তবু কি একটা মন কেমন করা অনুভূতি। একগুচ্ছ অবরুদ্ধ বাসনার বেদনাতুর ব্যঞ্জনা।

পেন্টিংটার তলার দিকজুড়ে লম্বা চওড়া এক ক্যাপশন। কালোর ওপর সাদা দিয়ে লেখা―বাঁকা বাঁকা হরফে। এক যাজক আর এক মঠবাসিনী যুগলের প্রেমকাহিনির মহিমান্বিত বিবরণ। কুলীন বংশের মেয়ে। মঠের জীবন বরণ করে নেবার সময় বয়স মাত্র আঠেরো। যাঁর কাছে স্বীকারোক্তি দান করল মেয়েটি, সেই যাজক বয়সে কুড়ি বছরের বড়। তারপর তিরিশ বছর জুড়ে তাঁদের নিবিড় প্রেমের ইতিহাস। (স্প্যানিশ ভাষায় অবশ্য প্রেম বলতে অতি-পার্থিব আসঙ্গলিপ্সাকেই বোঝায়।) দুজনের পারমার্থিক অনুরাগ (এবং একই সঙ্গে শারীরিক আকর্ষণ) এতই গভীর ছিল যে যাজকের মৃত্যুর মাত্র এক দিনের ব্যবধানে মেয়েটি অসুস্থ হয়ে তার দয়িতের সঙ্গে স্বর্গে মিলিত হবার জন্য পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যায়।

স্প্যানিশ ভাষায় অলিভিয়ার দখল আমার চাইতে বেশি। তাই গল্পটা ঠিকঠাক করে বুঝতে ও-ই আমায় সাহায্য করল। ব্যাখ্যা করে দিল অনেক দুর্বোধ্য শব্দের। গল্পটা পড়ার সময় আর তারপরেও বেশ কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে অন্য কোনও ভাবের আদানপ্রদান হলো না। এক অনির্বচনীয় সুখানুভূতি আবার অন্য দিকে এক অজানা আশঙ্কা―দুয়ে মিলেমিশে ভাব-বিনিময়কে অবান্তর করে তুলেছিল। কেমন যেন একটা অস্বস্তিকর অনুভব। অলিভিয়ার মনে কি চলছিল জানি না। নিজের অনুভূতিই কেবল বর্ণনা করতে পারি।

অলিভিয়াই মৌনভঙ্গ করল। বলল, ‘আমার চিলেস এন নগাদা১ খেতে ইচ্ছে করছে।’ তারপর দুজনে স্বপ্নচারির মতো যেন হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে ডাইনিং রুমের দিকে চললাম।

সহসা আমি যেন অলিভিয়ার মনের গহীনে প্রবেশাধিকার লাভ করলাম। তার মনের গতিপ্রকৃতি আমার কাছে ধরা দিতে লাগল। হয়তো একটু ধোঁয়াটে, একটু অস্পষ্ট তবু যেন ধরতে পারছিলাম। এরকম হয়েই থাকে। স্বামী-স্ত্রীর জীবনের শ্রেয় মুহূর্তে এরকম হওয়া অসম্ভব নয় মোটেই। তবে তার সান্নিধ্য না পেলে এটা উপলব্ধি করা বোধহয় সহজ হতো না।

তা প্রায় এক সপ্তাহের ওপর হতে চলল আমরা মেক্সিকো সফরে বেরিয়েছি। এই কদিন আগে―তেপোৎজোৎলানের২ এক রেস্তোরাঁয় গেছি। রেস্তোরাঁ সংলগ্ন একটা কনভেন্ট। সেই কনভেন্টেরই কমলালেবু বাগানের ছায়ায় আমাদের খাবার টেবিল পাতা। খুব সুস্বাদু আর বিশেষ শৈলিতে বানানো এক খাবার আমরা উপভোগ করছি। সেটা নাকি মঠের সন্ন্যাসিনীদের আবিষ্কৃত (অন্তত আমাদের যা বলো হলো) এক পরম্পরাগত রেসিপি। তামাল দে এলোতে৩―ভুট্টা, গ্রাউন্ড পোর্ক আর খুব ঝাল লংকা মিশিয়ে তুষের আগুনে ভাপানো। পরে এল চিলেস এন নগাদা―ওয়ালনাট স্যসে ভেসে থাকা শুকনো লাল লংকা―লংকার ঝাঁঝ আর স্যসের তিতকুটে স্বাদের ওপর মোলায়েম মিঠে ক্রিমের পুরু প্রলেপ।

এর পর থেকে নানেদের কথা মনে এলেই তাদের পরিশ্রমসিদ্ধ আর উদ্ভাবনী রন্ধনকৌশলের সৌরভ আমাদের স্মৃতিকে নাড়া দিতে থাকত। সেই সৌরভ কখনও ‘বজ্রাদপি কঠোরানি’, আবার কখনও ‘মৃদুনি কুসুমাদপি’। বিস্তারের যে পর্যায়েই থাক না কেন, সে এক অনুপম অনুভব। অন্য ইন্দ্রিয়দের দাবি তুচ্ছ করে রসনা ইন্দ্রিয় মধ্যমণি হয়ে উঠত।

সালুস্তিয়ানো ভেলাজকো―আমাদের মেক্সিকান বন্ধু আর সফরসঙ্গী―প্রচলিত ভোজনবিদ্যার রেসিপি নিয়ে অলিভিয়া যখন ওকে প্রশ্নের পরে প্রশ্ন করে যেত―তখন এমন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে কথা বলত মনে হতো কি না কি সব গূঢ় রহস্য ফাঁস করে ফেলছে। অবশ্য এটাই তার কথা বলবার ধরন―অন্তত একটা ধরন তো বটেই। স্বদেশের ঐতিহ্য, আদবকায়দা আর সংস্কৃতি নিয়ে বন্ধুর দখল ছিল তাক লাগানোর মত। সালুস্তিয়ানো যে অঢেল তথ্য দিয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করে চলেছিল, কখনও সেগুলো বলত একেবারে যুদ্ধ ঘোষণার মত জোরালো ভাষায়, আবার কখনও হাবভাব এমনই রহস্যময় হয়ে পড়ত মনে হতো কত কিছুই যেন লুকিয়ে যাচ্ছে।

অলিভিয়ার মনে হয়েছিল যে এসব খাবার বানাতে ঘন্টার পর ঘন্টা পরিশ্রম করতে হয়, আর তারও আগে নাকি হরেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর উপাদানের সমন্বয়সাধন ঘটাতে হয়। ‘এসব নানরা সারা দিন রান্নাঘরেই কাটাতেন নাকি ?’ সে জানতে চেয়েছিল। এত সব উপাদানের নতুন নতুন মিশ্রণ, মাপজোখ বদলে বদলে পরীক্ষা করা, ধৈর্য ধরে সেগুলো মেশানো, তারপর জটিল পদ্ধতিতে সেগুলো বানানো!

‘নিজস্ব পরিচারিকা থাকত তাঁদর,’ সালুস্তিয়ানো জানিয়েছিল। কিছুটা ব্যাখ্যাও করল। সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে আসতেন বলে মেয়েরা নিজস্ব পরিচারিকাদের সঙ্গে নিয়েই আসতেন। মঠের কঠোর অনুশাসনের মধ্যেও ভোজনবিলাস তৃপ্ত করাকে দোষের মধ্যে ধরা হতো না। পরিচারিকাদের তৎপর সহায়তায় তাঁরা সাধ মিটিয়ে হরেক রকম খাবার বানাতেন। সবকিছু পরিচারিকারাই করে দিত, ওঁরা শুধু খোশখেয়ালে নিত্য নতুন রেসিপির উদ্ভাবন করতেন আর অনেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সেগুলো নিখুঁত বানাতেন। লাজুক স্বভাবের হলেও এসব অভিজাত মহিলাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা ছিল অসামান্য আর দুরূহ। চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে এঁদের খামখেয়ালিপনাও হতো একদম অভিনব। তাঁদের আচরণ, অভিব্যক্তি আর আবেগ ছিল অনন্য। শৈশবে আর কিশোর বয়সে পরিবেশের বৈসাদৃশ্য ব্যক্তিত্বের উদ্ভাসে তারতম্য রচনা করে। পারিবারিক বৃত্তে প্রচলিত অতীত শৌর্যের ইতিহাস বা ধমনীতে বয়ে চলা রাজরক্তের গরিমা, সুদূর শৈশব থেকে ভেসে আসা রৌদ্রোজ্জ্বল সমভূমির শ্যামল বনানী আর সরস ফলমূলের সুঘ্রাণ। খামখেয়ালিপনা দিয়ে তাঁরা সেসব উচ্ছ্বাস, অবস্থান্তর, বিষাদ আর স্বপ্নভঙ্গের হতাশা আড়াল করতে চাইতেন।

যেসব পবিত্র স্থাপত্যের চার দেওয়ালের কারাগারে বন্দি হয়ে ঈশ্বরের পূজারিণীদের নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হতো, এসব অসামান্য রেসিপির উদ্ভাবনে এগুলোর অবদানও কম নয়। লংকার তীক্ষè ঝাঁঝ মেশানো এসব রন্ধনপ্রণালি যেন তাঁদের একাকিত্বের বিরুদ্ধে নীরব জেহাদ। ঔপনিবেশিক শাসকেরা যেমন অপরিমিত ঐশ্বর্যের আড়ম্বরপূর্ণ প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের করুণা লাভে সচেষ্ট হতেন, ঠিক সেভাবেই সকল সন্ন্যাসিনী স্থানীয় ঝাঁঝালো লংকার বাছাই করা সন্নিবেশ ঘটিয়ে রান্নার স্বাদে এক স্বর্গীয় মোহাবেশ রচনা করতে চাইতেন।

তেপোৎজলানে জেসুইটদের বানানো অষ্টদশ শতাব্দীর এক গির্জায় গেছিলাম আমরা। শিক্ষার প্রসারের জন্য নাকি বানানো হয়েছিল। (তবে দুঃখের কথা হলো গির্জাটির প্রতিষ্ঠার পরেই সেটি ওদের হাতছাড়া হয়ে যায়; মেক্সিকো থেকে তারা বহিষ্কৃত হয়।) সোনার পাত দিয়ে মোড়া উজ্জ্বল বর্ণের দেওয়ালে খোদাই করা নৃত্যরতা অপ্সরী, ফুলের সুন্দর কারুকাজ। অ্যাজটেকদের ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির আর রাজপ্রাসাদের কথা মনে করিয়ে দেয়। কোয়েৎজাল্কোয়াৎল৪-এর রাজপ্রাসাদ! সমুদ্রের পিঠ থেকে দুহাজার মিটার উঁচুতে হৃদয়স্পর্শী এই সুবিশাল স্থাপত্যশৈলী মহান এক সাম্রাজ্যের প্রতিভূ হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে। (দক্ষিণ) আমেরিকান আর স্প্যানিশ সভ্যতার পারস্পরিক রেশারেশির জাজ্বল্যমান এই দৃষ্টান্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। স্থাপত্যই কেবল নয়, দুই সভ্যতার এই রেশারেশির ছোঁয়াচ রন্ধনশৈলীতেও লেগেছিল। দুই বিপরীত ঘরানার রসনার মেলবন্ধন হয়েছিল। বিজিত জাতির আবাদ করা মশলা বিজেতার রসনাকে বশীভূত করে ফেলেছিল। একদিকে যেমন বাদামি (ত্বকের) নারীর যত্ন আর বহিরাগত সাদা (ত্বকের) নারীর অপটু আগ্রহের মেলবন্ধনে গজিয়ে ওঠা ইন্দো-হিস্প্যানিক সভ্যতার অনুপম রন্ধনশৈলীর উদ্ভব ঘটল, অন্যদিকে তেমনি মেসা৫ মালভূমির প্রাচীন মূর্তিপূজকদের সঙ্গে বারোক৬ ধর্মোপাসকদের মারমুখী হিংস্রতা রক্তক্ষয়ী সংঘাতের আকার ধারণ করল।

 সাপারের মেনুতে চিলেস এন নগাদার নাম দেখতে পেলাম না। আসলে অঞ্চলভেদে পানভোজনসংক্রান্ত পরিভাষা, এমনকি আস্বাদও বদলে যায়। বদলে পেলাম নতুন একটা ডিশ―গুয়াকামোলে৭―মুচমুচে টরটিয়া৮ রুটির টুকরো গাঢ় সস্-এ ডুবিয়ে খেতে হবে। (এই সস্ মেক্সিকোর জাতীয় ফল আগুয়াকেট৯ অর্থাৎ আভাকাডো থেকে তৈরি।) টরটিয়া রুটিও হরেকরকম স্বাদের হতে পারে কিন্তু খুবই সংযত সেই স্বাদের প্রকাশ। তারপর ছিল গুয়াজোলোত কন মোল পবলানো১০―অর্থাৎ পুয়েব্লা শৈলীতে তৈরি মোল সস১১ দিয়ে টার্কির মাংস। এই শৈলীতে তৈরি সসের একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট আছে। এই সস্ তৈরি করাও বেশ পরিশ্রম আর সময় সাপেক্ষ―অন্তত দুদিন লেগে যায় বানাতে। রেসিপিটাও বেশ জটিল―বিভিন্ন ধরনের লংকা, রসুন, পেঁয়াজ, দারুচিনি, লবঙ্গ, গোলমরিচ, ধনে, জিরে, তিসি, আমন্ড, কিসমিস, চিনেবাদাম লাগে―আর ওপর থেকে চকোলেটের হালকা আস্তরণ। সব শেষে ছিল কেইসাডিয়া১২ (এটাও এক ধরনের টরটিয়া―ওপর থেকে মাংসের কিমা আর মুচমুচে করে ভাজা বীনস ছড়িয়ে দেওয়া। বেশ অনেকটা চিজ মিশিয়ে এর লেচি বানানো হয়)।

খেতে খেতে অলিভিয়ার ঠোঁট দুটো প্রায় জুড়ে গেল, অবশ্য চিবোনো বন্ধ হলো না, কিছুটা মন্থর হলো এই মাত্র―শূন্য দৃষ্টিতে একটা সতর্কভাব―রসনার তৃপ্তিকর কোনও বিশেষ অনুভূতিকে যেন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে! মেক্সিকো সফরে আসার পর থেকে লক্ষ্য করছি, খাবার সময় অলিভিয়ার মধ্যে এক অভূতপূর্ব একাগ্রতা কাজ করতে থাকে। রস্বাসাদনের আবেগ ঠোঁট থেকে নাকে সংক্রমিত হতে থাকে। একবার স্ফীত হয় তো পরমুহূর্তেই গুটিয়ে যায়। (এমনিতেই নাকের নমনীয়তা যথেষ্টই সীমাবদ্ধ―তার ওপর অলিভিয়ার কমনীয় নাকের বেলায় তো কথাই নেই। প্রায় অবোধগম্য অনুদৈর্ঘ্যকি সংকোচন আর প্রসারণের ফলে নাক ক্রমশ সরু হতে হতে মুখমণ্ডলের সঙ্গে সমান্তরাল হয়ে পড়ে।)

সোজাসুজি বলা যেতে পারে যে খাবার সময় অলিভিয়া একেবারে আত্মমগ্ন হয়ে পড়ে। নিভৃত সংবেদনায় খাবারের রসাস্বাদনে আবিষ্ট হয়ে পড়ে। অথচ বাস্তবে তার শরীরী ভাষা সম্পূর্ণ বিপরীত ইঙ্গিতবহ। রসাস্বাদনের অনুভূতি আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করার ইচ্ছে; স্বাদ আর গন্ধও; তার আর আমার দুজনের মিলিত রসনাগ্রন্থী দিয়ে অনুভব করার বাসনা। ‘এই―এটা খেলে ? খাবারটা কেমন লাগল ?’ বেশ একটু উদ্বেগ নিয়েই জানতে চাইল। যেন সেই মুহূর্তে দুজনেই হুবহু এক খণ্ড খাবার মুখে দিয়েছি আর দুজনের স্বাদগ্রহণের অনুভূতিও অভিন্ন। ‘এটা তো সিল্যান্ত্রো―ঠিক কি না ? একটু সিল্যান্ত্রো মুখে দিয়ে দেখ,’ একটু জেদ করেই বলল। যেসব পাতা দেখিয়ে কথাগুলো বলল সেগুলোর স্থানীয় নাম আমরা জোগাড় করতে পারিনি (ধনেপাতাও হতে পারে মনে হয় ?) তবে খাবারের সঙ্গে একটা ছোট টুকরো যেটা মুখে পড়েছে তার থেকে অতি সূক্ষ্ম মাদকতাময় এক মিষ্টি কিন্তু ঝাঁঝাল গন্ধ পাচ্ছি।

নিজের আবেগের সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে নেওয়ার অলিভিয়ার এই প্রচেষ্টা আমার ভালো লাগছিল। পরস্পরের বিদ্যমানতার এই আনন্দকে ভাগ করে নেওয়ার মধ্যেই যেন তার পরিতৃপ্তি। আমাদের আত্মবাদী প্রাতিস্বিক অবস্থানে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পরিপূর্ণতা পায় একমাত্র দৈহিক মিলনে। এই ধারণার যাথার্থ যাচাই করে দেখার অবরুদ্ধ একটা ইচ্ছে ক্রমেই আমাকে পেয়ে বসছিল। মেক্সিকো সফরে বেরোনোর পর থেকে আমাদের মিলনেচ্ছাটা একেবারে স্তব্ধ না হয়ে গেলেও রীতিমত বিরল হয়ে পড়েছিল। সাময়িক ব্যপার সন্দেহ নেই―উদ্বিগ্ন হবারও কারণ তেমন নেই। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে এই ধরনের ওঠাপড়া চলতেই থাকে। অলিভিয়ার অফুরান প্রাণশক্তির উদ্ভাস, তাৎক্ষণিক অথবা বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া, উচ্ছ্বাস, লিপ্সা, স্পন্দন সবই নিজস্ব ছন্দে চলছে। তবে আমাদের মিলনশয্যায় নয়, ইদানীং তার এসব অভিব্যাক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটছে খাবার টেবিলে।

প্রথম দিকে মনে হয়েছিল যে রসনাতৃপ্তি আমাদের অন্যান্য ইন্দ্রিয়দের জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করবে। ভাবাটা ভুলই হয়েছিল। অসামান্য সেসব খাবার নিঃসন্দেহে রসনাউদ্দীপক কিন্তু উদ্দীপনের ক্ষমতা রসনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। (অন্তত আমার সেটাই মনে হয়েছিল। অন্যদের কথা বলতে পারব না, আমাদের জন্য কথাটা খুবই যথাযথ। এমনও হতে পারে অন্য কোনও পরিবেশে আমাদের ক্ষেত্রেও কথাটা খাটবে না।) এরা ইন্দ্রিয়াসক্তিকে উদ্দীপ্ত করল। আর সেই উদ্দীপ্ত ইন্দ্রিয়াসক্তি পরিতৃপ্ত করার জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ল আরও নতুন ধরনের খাবার―যেগুলো আমাদের আসক্তিকে তীব্রতর করতে সক্ষম। অন্য ধরনের ইন্দ্রিয়াসক্তির সেখানে প্রবেশ নিষেধ। এমত অবস্থায় আমরা সেই মঠবাসিনী আর যাজকের প্রেমের স্বরূপ বাস্তবিক কেমন ছিল তা নিয়ে নানারকম জল্পনা করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলাম। সমাজের চোখে―এমনকি নিজেদের চোখেও―হয়তো নিষ্পাপ, ইন্দ্রিয়াতীত ছিল সেই প্রেম। আবার রসনাউদ্দীপক নিগূঢ় আস্বাদের পারস্পরিক অংশগ্রহণের অমোঘ আকর্ষণে প্রবলভাবে ইন্দ্রিয়াসক্ত।

‘অংশগ্রহণ’ কথাটাই হঠাৎ আমার মনে ভেসে উঠল। শুধু মঠবাসিনী আর যাজকের কথা ভেবেই নয়―অলিভিয়া আর আমার সম্পর্কের কথা ভেবেও। সান্ত্বনা পেলাম ভেবে। তার মানে দুজনের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে চলেছে বলে যে আশঙ্কা আমি করেছিলাম সেটা একেবারেই অমূলক। তাই যদি না হবে তবে হৃদয়াবেগে আচ্ছন্ন হয়ে অলিভিয়া আমার অংশগ্রহণ কামনা কেনই বা করবে ? কিছু দিন ধরেই আমার মনে হচ্ছিল যে নিত্য নতুন রসনাতৃপ্তির অন্বেষণে অলিভিয়া আমাকে একজন আজ্ঞাধীন ব্যক্তি হিসেবেই চাইছিল, সহচর হিসেবে আমার উপস্থিতি কাম্য কিন্তু কর্তৃত্ব ফলানো―নৈব নৈব চ! খাবারের সঙ্গে তার যে একটা নিবিড় সখ্য গড়ে উঠেছে সেটা পর্যবেক্ষণ করা! বিরক্তিকর ধারণাটা আমাকে ক্রমশ পেয়ে বসছিল আর সেটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। এক দিক দিয়ে আমাদের অংশগ্রহণ ছিল সর্বাত্মক। একই অভিন্ন আবেগে আমরা ভেসে যাচ্ছিলাম তবু প্রকৃতিগত ভিন্নতার জন্য দুজনের অনুভূতি ভিন্ন দুই খাতে বয়ে যাচ্ছিল। অনুভূতির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ এবং নির্ভুলভাবে সংরক্ষণের ব্যাপারে অলিভিয়ার পটুত্ব ছিল অসাধারণ। আমার চেষ্টা থাকে যেকোনও অভিজ্ঞতার মর্মে প্রবেশ করে সেটি বাচনিকভাবে প্রকাশ করার আর আত্মিক ভ্রমণের সঙ্গে ভৌগোলিক পর্যটনের আদর্শ মেলবন্ধন খুঁজে বের করা। অবশ্য এটা পুরোপুরি আমারই অনুমান যেটা অলিভিয়া সাগ্রহে মেনে নিয়েছে (নাকি ধারণাটা অলিভিয়াই আমার মনে গেঁথে দিয়েছে―আমি শুধু ধারণাটাই নিজের মতো করে ওকে বলেছি!) স্বাভাবিক চিন্তাধারার সঙ্গে যেমন অন্যের দ্বারা আরোপিত চিন্তাধারার মিল পাওয়া মুশকিল, তেমনি বিদেশ সফরের সময় স্থানীয় খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে আমাদের অভ্যস্ত খাদ্যরুচির মিল পাওয়া দুষ্কর। তাই সফর সার্থক করার জন্য আমাদের শুধু সেখানকার খাদ্যরুচির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিলেই হবে না, সেখানকার সংস্কৃতি, বনজ আর প্রাণীজ সম্পদের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। ভিন্ন রুচিতে তৈরি খাদ্য শুধু মুখের ভেতর দিয়ে পেটে চালান করাটাই যথেষ্ট নয়, ভিন্ন কোন যন্ত্রপাতি দিয়ে গম পেষা হচ্ছে কিংবা কোন ধরনের পাত্রে রান্না করা হচ্ছে, সেগুলো নিয়েও কৌতূহল থাকতে হবে। আজকের যুগে পর্যটন এরকমই হওয়া উচিত। টিভির দৌলতে সবকিছুই তো আরাম কেদারায় বসে বসেই দেখে নেওয়া যায়। (তা বলে ভেবে নেবেন না যে আমাদের দেশে শহরের নামিদামি রেস্তোরাঁয় গিয়ে আপনি এসব স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, এসব খাবার ঠিক স্থানীয় খাবারের সঠিক প্রতিকল্প নয় বরং বলা যেতে পারে স্টুডিয়োয় তৈরি দুর্বল প্রতিলিপি।)

সে যাই হোক, ঘুরতে ঘুরতে অলিভিয়া আর আমি যাবতীয় দ্রষ্টব্য দেখে নিলাম। (ব্যাপারটা মোটেও হেলাফেলা করার মতো নয়!) পরের দিন সকালেই আমরা মন্ট অ্যালবানের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দেখতে যাব বলে ঠিক করলাম। গাইডও একেবারে ঠিক ঠিক সময়ে একটা ছোট্ট বাস নিয়ে হোটেলে হাজির। রোদ ঝলমলে ঊষর প্রান্তর অ্যাগাভি ক্যাক্টাসের ঝোপে ছেয়ে আছে। এই ক্যাক্টাস থেকে মেসক্যাল১৩ আর টেকিলা১৪ তৈরি করা হয়। রয়েছে নোপেলি (যাকে আমরা প্রিকলি পিয়ার বলে থাকি) আর সিরিয়াসের ঝোপ―আর নীল নীল ফুলে ভরা জ্যাকারান্ডা। রাস্তাটা আস্তে আস্তে পাহাড়ের ওপর উঠে গেছে। ওপরে উপত্যকা দিয়ে ঘেরা মন্ট অ্যালবান। ধ্বংসাবশেষ, মন্দির, কারুশিল্প, প্রশস্ত তোরণ, নরবলি দেবার জায়গা এবং আরও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের জটিল প্রদর্শশালা। সব মিলিয়ে পর্যটকদের জন্য আতঙ্ক, পবিত্রতা আর রহস্যের অনুভূতির সৃষ্টি করার আয়োজন। পুরোহিতের হাতে ধরা পাথরের কুড়ালের আঘাতে কারও বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে টাটকা রক্তে তোরণের সোপান ভিজে গেছে―কল্পনার চোখ মেলে আমরা যেন দেখতে পেলাম।

মন্ট অ্যালবান তিন তিনটে সভ্যতার উৎপত্তিস্থল। একই সভ্যতার ধ্বংসস্তূপের ওপর গড়ে উঠেছিল পরবর্তী সভ্যতা। ওলমেকদের নির্মাণ কাজে লাগিয়ে জাপোটেকরা নিজেদের নির্মাণকার্য চালিয়ে গেছে। আবার মিক্সটেকরা ঠিক একইভাবে জাপোটেকদের সৃষ্টিতে অদলবদল এনেছে। পাথরের ওপর খোদাই করা ঘটনা থেকে অনুমান করা যায় মেক্সিকোর প্রাচীন সভ্যতার মানুষ কালের আবর্ত ঘিরে বিষাদময় এক ধারণা পোষণ করত। বাহান্ন বছরে সৃষ্টি একবার করে ধ্বংস হয়ে যায়, ঈশ্বরের মৃত্যু ঘটে, মন্দির ধ্বংস হয়ে যায়, মহাজাগতিক এবং পার্থিব বস্তুর নতুন নামকরণ হয়। এই অঞ্চলে বসবাসকারী যেসব মানুষের কথা ইতিহাসে উঠে এসেছে পরম্পরাগতভাবে তারা হয়তো একই গোষ্ঠীর মানুষ ছিল, হয়তো তাদের ধারাবাহিকতা পাথরে উৎকীর্ণ ঘটনাবলির নৃশংসতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত কিন্তু ছেদ পড়েনি। হিয়েরোগি-ফিক লিপিতে এখানে বিজিত গ্রামের নাম খোদাই করা, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পরাজিত ঈশ্বরের মাথা মাটির দিকে রেখে পা থেকে লটকে দেওয়ার দৃশ্য, আর শৃঙ্খলিত যুদ্ধবন্দি আর তাদের ভূলুণ্ঠিত ছিন্ন শির।

ট্র্যাভেল এজেন্সি আমাদের যে গাইডের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিয়েছিল, তার নাম অ্যালোনসো। বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা আর মুখটা ওলমেকদের মতো থ্যাবড়া (নাকি মিক্সটেকদের মতো ? না জাপোটেকদের মতো ?)। লজ দানজানতেস১৫ নামে বিখ্যাত বাস রিলিফ বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে হাত-পা নেড়ে আমাদের দেখাল। বলল ছবিতে আঁকা মূর্তিগুলোর মধ্যে মাত্র কয়েকজনের শরীরই নৃত্যছন্দে রয়েছে (অ্যালোনসো কয়েক স্টেপ নেচে দেখাল); যারা এক হাত তুলে চোখে লাগিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তারা খুব সম্ভব জ্যোতির্বিদ (অ্যালোনসো জ্যোতির্বিদদের মত পোজ নিয়ে দেখাল)। তবে অ্যালোনসোর মতে বেশির ভাগ মূর্তিই প্রসবরতা মেয়েদের দেখানো হয়েছে (অ্যালোনসো সেটাও অভিনয় করে দেখাল)। জানা গেল যে এই মন্দিরে এসে সহজে প্রসব হওয়ানোর জন্য মেয়েরা মানত করত, রিলিফের ছবিগুলোও সেই ঘটনারই সাক্ষ্য বহন করছে। এমনকি দেয়ালচিত্রের নাচের মুদ্রাগুলোও ক্লেশ নিবারণের তীব্র আকাঙ্খার শৈল্পিক অনুসরণ―বিশেষ করে প্রসবে যখন শিশুর পায়ের দিকটা প্রথমে বেরিয়ে আসত। (অ্যালোনসো সেসব মুদ্রাও নকল করে দেখাল।) একটা রিলিফে সিজারিয়ান অপারেশনের ছবি―এমনকি গর্ভনালি আর জরায়ুর চিত্রসমেত। (আগের তুলনায় অনেক বেশি নির্মমভাবে নারীর দেহতত্ব অঙ্গভঙ্গী দিয়ে ফুটিয়ে তুলে অ্যালোনসো হয়তো প্রসবকালীন ব্যবচ্ছেদের তীব্র দৈহিক যন্ত্রণার সঙ্গে জন্ম আর মৃত্যুর পারস্পরিক সংযোগটা তুলে ধরতে চাইল।)

আমাদের গাইডের বিচিত্র অঙ্গভঙ্গী আর কথাবার্তা থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে গেল। এসব মন্দিরকেন্দ্রিক বলিদান প্রথা মানুষের রক্তে মজ্জায় মিশে গেছে। গ্রহ নক্ষত্রের হিসেব মিলিয়ে শুভদিন ঠিক করে বলিদানকে ঘিরে চলত নৃত্যের উৎসব। জন্ম নামক ঘটনার বিশেষ কোনও তাৎপর্য ছিল না। জন্ম মানে শত্রুর সঙ্গে লড়াই করে পণবন্দি করার জন্য নতুন নতুন সৈন্য। রিলিফে কোথাও কোথাও ছোটাছুটির করার দৃশ্য, কুস্তি লড়ার দৃশ্য, আবার ফুটবল খেলার দৃশ্যও ধরা পড়েছে। অ্যালোনসোর মতে এগুলো কোনওটাই বন্ধুত্বপূর্ণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দৃশ্য নয়। পণবন্দিদের বাধ্য করা হতো এসব খেলায়। হারা জেতার ওপর ঠিক করা হতো হাড়িকাঠে মাথা দেবার অধিকার কার আগে আর কার পরে।

‘মানে পরাজিতদের আগে বলি দেওয়া হতো ?’ আমি জানতে চাইলাম।

‘ঠিক তার উলটোটা। যারা জিতত তাদের!’ অ্যালোনসোর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘আগ্নেয়শিলা দিয়ে তৈরি ছোরা দিয়ে নিজের বক্ষবিদীর্ণ হতে দেওয়া খুব সম্মানের ব্যাপার ছিল!’ সদ্যচ্ছিন্ন কম্পমান হৃদয়কে সূর্যদেবের কাছে উৎসর্গ করে প্রার্থনা করা হতো যেন প্রতিদিন প্রত্যুষে ফিরে এসে সূর্যদেব যেন আবার ধরাকে আলোকিত করেন। কিছুক্ষণ আগেই অ্যালোনসো খুব গর্বের সঙ্গে তার পূর্বপুরুষদের বৈজ্ঞানিক ঔৎকর্ষের ব্যাখ্যান করছিল। ঠিক তেমনিভাবেই ওলমেকদের এই উত্তরসূরী সমান উচ্ছ্বাস নিয়ে বলিদান প্রথার তাৎপর্য বোঝাতে লাগল।

অলিভিয়া এবার মৌনভঙ্গ করল। জানতে চাইল, ‘বলিপ্রদত্ত মানুষটার দেহটা নিয়ে কি করা হতো ?’

অ্যালোনসো চুপ।

‘ওই যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, নাড়িভুঁড়ি―সেগুলো নিশ্চয়ই ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা হতো। এটাতো বোঝা গেল। কিন্তু তারপর কী করা হতো ? পুড়িয়ে ফেলা হতো ?’ অলিভিয়া ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়।

‘না, ওগুলো পুড়িয়ে ফেলা হতো না।’

‘তাহলে ? ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা জিনিস মাটিতে পুঁতে ফেলে পচে যেতে দেওয়া হতো না নিশ্চয়ই!’

‘লজ জোপাইলটিস,’ অ্যালনসো বলল। ‘শকুন―তারাই বেদি সাফ করে ওগুলো স্বর্গে বহন করে নিয়ে যেত।’

‘শুধুই শকুনরা, বরাবর ?’ অলিভিয়ার ভেতরে কেমন একটা জেদ, আমার ঠিক বোধগম্য হলো না।

মনে হলো অ্যালোনসো জবাবটা এড়িয়ে যেতে চাইছে, প্রসঙ্গান্তরে চলে যাবার চেষ্টা করছে। আমাদের নিয়ে তাড়াতাড়ি পুরোহিতরা যে রাস্তা দিয়ে মন্দিরে যেতেন, যেখান থেকে ওঁরা ভয়াবহ মুখোশে মুখ ঢেকে জনসাধারণকে দর্শন দিতেন সেসব জায়গা দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমাদের গাইডের অহেতুক পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের প্রবণতা বেশ বিরক্তিকর লাগছিল। আমাদের মোটা মাথায় ঢোকানোর জন্য সবকিছুই যেন ওকে খুব সরল করে বলতে হচ্ছিল। যেন আরও অনেক কিছুই বলা যায় কিন্তু আমরা বুঝে উঠতে পারব না, তাই যেন সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছিল। অলিভিয়াও ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। মৌন গাম্ভীর্যের একটা মুখোশ এঁটে নিল একটু পরেই। বাসে ঝাঁকুনি খেতে খেতে ওয়ায়কা ফেরার পথেও একদম চুপচাপ।

অনেকবার তার সঙ্গে চোখাচোখি করার চেষ্টা করলাম। মুখোমুখিই বসেছিলাম আমরা। সিট দুটো ওপর নিচু হবার কারণেই হোক বা আর কোনও কারণে ঠাহর হলো যে আমার চোখ তার চোখে নয় তার দাঁতের ওপর পড়ছে। ঠোঁট দুটো ফাঁক থাকায় তার সামনের দাঁতের সারি দেখা যাচ্ছিল। বিষণ্ন দৃষ্টি―দাঁতের সারির সঙ্গে একদম মানানসই নয়। দাঁতের সারিকে কাজে লাগানোর মতো আমিষ আহার্য সামনে নেই বলেই হয়তো। সাধারণত কারও চোখে চোখ রেখে আমরা তার ভাবনার নাগাল পেতে চাই। এখন তার তীক্ষè দাঁতের সারির দিকে তাকিয়ে মনে হলো কোনও একটা ইচ্ছে অবদমিত করবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। মনে মনে কী একটা প্রত্যাশা।

হোটেলে পৌঁছে বিশাল লবি (যেটা কখনও কনভেন্টের প্রার্থনাগৃহ হিসেবে ব্যবহৃত হতো) পেরিয়ে আমাদের রুমের দিকে এগোলাম। দূর থেকে ভেসে আসছে কলরোল―যেন কোনও পাহাড়ি ঝরনার জল প্রবল বেগে মাটিতে আছড়ে পড়ে শতধাবিভক্ত হয়ে ছোট ছোট তটিনীর মতো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আরও কাছে আসতেই শব্দের সমস্তত্ত্বতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল। জলোচ্ছ্বাসে শব্দের জায়গায় এখন হাজার হাজার পাখির বিচিত্র কলধ্বনি―কাক, দোয়েল, কোকিল, ফিঙে―পাখিরালয়ে এসেছি যেন। দরজার কাছ থেকে (করিডর থেকে রুমে যেতে আমাদের কয়েক ধাপ সিঁড়ি নামতে হয়) দেখতে পেলাম প্রত্যেক চায়ের টেবিল জুড়ে স্প্রিং হ্যাট পরিহিত অগণিত মহিলার সমাবেশ। প্রজাতন্ত্রের নতুন রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন উপলক্ষে দেশ জুড়ে প্রচার চলছে। সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতির স্ত্রী ওয়ায়কার সম্ভ্রান্ত নাগরিকদের স্ত্রীদের জন্য তাই এক সমারোহপূর্ণ চা চক্রের আয়োজন করেছেন। খিলানযুক্ত প্রশস্ত ছাদের তলায় তিনশো জন মেক্সিকান মহিলা পারস্পরিক বাক্যালাপে মগ্ন। অল্প আগে যে ধ্বনিতাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম সেটা সবার একসঙ্গে কথোপকথনের এবং কাঁটা চামচ ছুরি আর চায়ের পেয়ালার টুংটাং ঝংকারের মিশ্র ফল। সভাকক্ষে টাঙিয়ে রাখা গোলগাল চেহারার একজন মহিলার সম্পূর্ণ রঙিন ছবি দৃষ্টি আকর্ষণ করল। লম্বা কালো চুল সোজাসুজি পিঠের দিকে নেমে গেছে; পরনে নীল রঙের পোশাক, যার বোতাম দেওয়া কলারটুকুই শুধু দৃশ্যমান। হঠাৎ দেখে চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের সরকারি প্রতিকৃতির একটা বলেও ভ্রম হতো পারে।

করিডর থেকে সিঁড়িতে যাবার জন্য আমাদের রিসেপশনের ছোট ছোট টেবিল পেরিয়ে যেতে হলো। যখন আমরা প্রায় বেরিয়ে আসছি তখন হলের পেছনদিকে বসে থাকা অল্প কয়েকজন পুরুষ অতিথির মধ্যে থেকে একজন উঠে দাঁড়িয়ে দুই বাহু প্রসারিত করে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। সে আর কেউ নয়, আমাদের বন্ধু সালুস্তিয়ানো ভেলাজকো। হবু রাষ্ট্রপতির কর্মীদলের একজন সদস্য আর সেই পদাধিকারবলে নির্বাচনী প্রচারের একজন গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রাহী। রাজধানী ছেড়ে চলে আসার পর তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। আমাদের সঙ্গে আবার দেখা হওয়ায় কত যে আনন্দ পেয়েছে স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছ্বাস দিয়ে প্রকাশ করল। সফর কেমন চলছে খুব আগ্রহের সঙ্গে জানতে চাইল। (মহিলা প্রধান পরিবেশ থেকে হয়তোবা কিছুক্ষণের জন্য নিষ্কৃতিও খুঁজছিল।) আমাদের সঙ্গে হাল ছেড়ে করিডরে বেরিয়ে এল।

আমরা কী কী দেখলাম সেগুলো জানতে না চেয়ে সে সরাসরি বলতে লাগল কোন কোন জায়গা সে আমাদের সঙ্গ দিতে না পারার জন্য নিশ্চয়ই দেখে উঠতে পারিনি। আবেগপ্রবণ অথচ সমঝদার ব্যক্তিরা এভাবেই কথা চালু করেন, বিশেষ করে বন্ধুমহলে। উদ্দেশ্য অবশ্যই মহৎ হয়ে থাকে কিন্তু সদ্যসমাপ্ত ভ্রমণ থেকে আসা ব্যক্তির আত্মপ্রসাদ একেবারে ধুলোয় মিশে যায়। হল থেকে ভেসে আসা কোলাহলে তার আর আমাদের কথাবার্তার অর্ধেকই বোধগম্য হচ্ছিল না। তাই বুঝতে পারছিলাম না আমরা যেসব জিনিস দেখে এসেছি বলে তাকে বললাম সেগুলো না দেখে আসার জন্যই সে আমাদের তিরস্কার করল কিনা।

‘আমরা আজ মন্ট অ্যালবান দেখে ফিরলাম’ গলা একটু চড়িয়ে ওকে তাড়াতাড়ি জানালাম। ‘তোরণ, রিলিফ, বলিদানের বেদি…’

সালুস্তিয়ানো হাতটা মুখের কাছে এনে হাওয়ায় নাড়ল। এই অঙ্গভঙ্গির মানে হলো অনুভূতিকে ভাষায় প্রকাশ করতে সে অক্ষম। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং নৃতাত্ত্বিক যেসব বিবরণ দিতে শুরু করল, আমার ইচ্ছে করছিল তার প্রত্যেকটা কথাই মন দিয়ে শোনার কিন্তু ভোজসভা থেকে এতই কথাবার্তা ভেসে আসছিল যে প্রায় কিছুই শুনতে পেলাম না। তার অঙ্গভঙ্গি আর ছাড়া ছাড়া কথা থেকে যেটুকু বুঝতে পারলাম (‘স্যাংগ্রে [রক্ত]… অবসিডিয়ানা [অগ্নিশিলা]… ডিভিনিডাড সোলার [সূর্যদেব]’) মনে হলো সে নরবলির কথা বলছে। কথার মধ্যে একটা ভয়মিশ্রিত ভক্তি ফুটে উঠছে, যদিও এসব প্রথার সাংস্কৃতিক তাৎপর্য অনুধাবনের ব্যাপারে আমাদের চাতুর্যহীন গাইডের তুলনায় সালুস্তিয়ানোর উপলব্ধি অনেক পরিণত মানের।

অলিভিয়া দেখলাম সালুস্তিয়ানোর কথাবার্তা আমার থেকে ভালো বুঝতে পেরেছে। কিছু একটা জানতে চাইল। বুঝতে পারলাম দুপুরে অ্যালোনসোকে করা প্রশ্নটাই হয়তো আবার জিগ্যেস করল। ‘শকুনরা যা নিয়ে যেতে পারত না―সেগুলো পরে কী করা হতো ?’

অলিভিয়ার চোখের ঝলকানির সঙ্গে সালুস্তিয়ানো পরিচিত। তার চোখও ঝলসে উঠল। হঠাৎ গলা নামিয়ে ফিসফিস করে কথা বলার ভঙ্গি দেখে অলিভিয়ার প্রশ্নের লক্ষ্য আমি বুঝে ফেললাম। কথা খুবই নিম্নস্বরে হলেও কোলাহল ছাপিয়ে সেগুলো এখন বেশ ভালোই বুঝতে পারছিলাম।

‘কে জানে ?… পুরোহিতরা… এসব এক ধরনের ধর্মীয় আচার… মানে অ্যাজটেকদের আর কি―যাদের সম্বন্ধে আমরা অন্তত কিছুটা জানতে পেরেছি। তা ওদের ব্যাপারেও অনেক কিছুই তো অজানা। এগুলো সবই গোপন আচার। হ্যাঁ, ভোজনও আচারের অঙ্গ ছিল… পুরোহিতরা ঈশ্বরের হয়ে ক্রিয়া সম্পাদন করতেন, আর তাই বলির উৎসর্গ… পবিত্র ভোজন …’

এটাই কি তবে অলিভিয়ার উদ্দেশ্য ? কথাটা ওকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেওয়া ? অলিভিয়ার কৌতূহল এখনও মেটেনি ‘কিন্তু কীভাবে ঘটত ব্যাপারটা ? এই খাবার…’

‘ওই যা বললাম―কেবলই কতগুলো অনুমান। হয়তো রাজপরিবারের লোকেরা আর যোদ্ধারাও যোগ দিতেন। বলিপ্রদত্ত ব্যক্তি তখন ঈশ্বরের অংশ হয়ে গেছেন, ঐশ্বরিক শক্তি প্রেরণ করছেন।’ এটা বলার সময় সালুস্তিয়ানো গর্ব, নাটকীয়তা আর আবেগে ভেসে গেল। ‘শুধু যেসব যোদ্ধা বলিপ্রদত্ত ব্যক্তিকে বন্দি এবং বলিপ্রদান করতেন তাঁরা সেই মাংস স্পর্শ করতে পারতেন না। তাঁরা নীরবে অশ্রুপাত করতেন।’

অলিভিয়া পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারল না। ‘এই যে মাংস… খাবার জন্য… যেভাবে সেই পবিত্র আহার রান্না করা হতো… সে ব্যাপারে কিছু জানা নেই ?’

সালুস্তিয়ানোকে একটু চিন্তান্বিত লাগল। ভোজসভা থেকে চ্যাঁচামেচি দ্বিগুণ জোরে আসতে শুরু করেছ। সালুস্তিয়ানো এই আওয়াজে বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে পড়ল। একটা আঙুল দিয়ে কান চেপে ধরে জানাল এত আওয়াজে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া খুবই মুশকিল। ‘নিয়ম নিশ্চয়ই কিছু ছিল। বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান না করে সেই খাবার নিশ্চয়ই গ্রহণ করা হতো না… বলিপ্রদত্ত ব্যক্তিকে যথাযোগ্য সম্মান জনানো হতো―তাঁদের বীরত্বকে―ঈশ্বরকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতো… সাধারণ খাবারের মতো খাওয়া যেত না। আর একটা গন্ধ …’

‘কী বলে সবাই―ওগুলো খেতে ভালো নয় ?’

‘না একটা অদ্ভুত গন্ধের কথা বলে।’

‘অর্থাৎ মশলা দিয়ে রান্না করতে হতো―খুব কড়া কোনও মশলা ?’

‘কে জানে সেই গন্ধ ঢাকার দরকার পড়ত! অনেক রকম মশলার দরকার নিশ্চয়ই পড়ত সেই গন্ধ ঢাকবার জন্য!’

অলিভিয়া জিগ্যেস করল, ‘পুরোহিতরা… কীভবে রান্না করা হতো… রন্ধনপ্রণালি নিয়ে কোনও নির্দেশ ? কিছু বলে যাননি ?’

সালুস্তিয়ানো মাথা ঝাঁকাল। ‘খুবই রহস্যজনক ব্যাপার, ওদের জীবনটাই ছিল রহস্যে মোড়া।’

এবার অলিভিয়াই সালুস্তিয়ানোর মুখে কথা বসানোর চেষ্টা করল। ‘হয়তো গন্ধটা টিকে থাকত, অন্য গন্ধ মেশানোর পরেও ?’

সালুস্তিয়ানো ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে খানিক ভেবে নিল কী বলবে। ‘ওটা ছিল পবিত্র ভোজন। পঞ্চভূতের সমন্বয় ঘটানোর জন্যই বলিপ্রদান করা হতো―হ্যাঁ, খুবই ভীতিজনক সমন্বয়… দহনশীল, দ্যুতিমান…’ বলতে বলতে সালুস্তিয়ানো চুপ করে গেল। হয়তো তার মনে হলো একটু বেশিই বলে ফেলেছে। হয়তো আহারসংক্রান্ত আলোচনা করতে করতে নিজের কর্তব্যের কথাও মনে পড়ে গেল। আরও বেশি সময় আমাদের সঙ্গে কাটাতে না পারার জন্য ক্ষমা চেয়ে তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিল। নিজস্ব টেবিলে ফিরে যেতে হবে।

সন্ধে নামার পরে আমরা জোক্যালো আর্কেডের একটা কাফেতে গিয়ে বসলাম। ঔপনিবেশিক আমলে মেক্সিকোর পুরোনো শহরগুলোর প্রাণকেন্দ্র ছিল জোক্যালো নামের চত্বরগুলো। বসে আছি সবুজের মধ্যে, সযত্নে ছাঁটা অ্যালমেন্দ্রোস১৬ গাছের সারি―নামের মিল থাকলেও আমন্ড গাছের সঙ্গে কোনও মিল নেই। সরকারি প্রার্থীকে স্বাগত জানানোর জন্য ছোট ছোট পতাকা আর ব্যানারে ভরে থাকা জোক্যালোতে আজ উৎসবের মেজাজ। ওয়ায়কার স্থানীয় মানুষজন সপরিবারে আর্কেডের তলায় ঘোরাফেরা করছে। মেস্ক্যালিনা১৭ সংগ্রহ করবার জন্য কিছু আমেরিকান হিপি কোনও এক বৃদ্ধার অপেক্ষা করছে। গরিব ফেরিওয়ালারা মাটির ওপর রঙিন কাপড় বিছিয়ে নিয়েছে। দূর থেকে লাউডস্পিকারের গুঞ্জন ভেসে আসছ। বিরোধী প্রার্থীর সমাবেশে জনসমাগম তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি।

চত্বরের মধ্যিখানে একটা কিয়স্কে অর্কেস্ট্রা চলছে। ইউরোপের চেনা পরিবেশে কাটানো অনেক দিন আগের কিছু সন্ধ্যের কথা মনে পড়ে গেল। বয়সটা ছিল এমনই যখন স্মৃতিমাত্রই জমিয়ে রাখার দায় বা তাগিদ থাকে না। মন বড় বিচিত্রগতি। কখনও কখনও এমন বিভ্রম ঘটায় যে কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক করা যায় না। পলকের মধ্যে আমার চেতনায় স্থানের সঙ্গে কালের এক অনন্ত ব্যবধান রচিত হয়ে গেল। কালো স্যুট আর টাই পরা কৃষ্ণ বর্ণের গাইয়ে বাজিয়েরা নিরাসক্ত মুখে সঙ্গীত পরিবেশন করে চলেছে। অনন্ত গ্রীষ্মের দেশ থেকে আসা বিচিত্র বর্ণের জামাকাপড় পরা কিছু পর্যটক শুনছে। আর আছে গোল হয়ে বসা কিছু প্রবীণ নরনারী―চটকদার পোশাকের আড়ালে বয়স লুকিয়ে রাখবার ব্যর্থ চেষ্টা। আছে কিছু অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে―ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকে, অযত্নবর্ধিত স্বর্ণালি শ্মশ্রু আর বিন্যস্ত কেশরাশি নিয়ে―কাঁধের ঝোলা ব্যাগ নামিয়ে রেখে ধ্যানমগ্ন―পলিতকেশ হবার অনন্ত প্রতীক্ষায় যেন। প্রাচীন পঞ্জিকার পাতা থেকে উঠে আসা শীতের রূপকময় প্রতিমূর্তি।

‘পৃথিবী ধ্বংসের আর দেরি নেই বুঝলে। সূর্যদেবের আর প্রতিদিন উদয় হতে ইচ্ছেই করে না। বলি দেওয়া নরমাংসের যোগান না থাকায় সময় বেচারা অনাহারে রয়েছেন। ঋতু আর কালচক্রেও ওলটপালট হয়ে গেছে,’ আমি বলে ফেললাম।

‘মনে হচ্ছে সময়ের অন্তিমকালের কথা ভেবে একমাত্র আমরাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি,’ অলিভিয়া জবাব দিল। ‘এই আমরা―যারা না বোঝার ভান করে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। ভান করি যেন নতুন স্বাদ পরখ করার কোনও আগ্রহই নেই।’

‘তুমি বুঝি এই জায়গার কথা বলতে চাইছ ? ওদের উগ্র মশলার দরকার পড়ত―কারণ তারা জানত―মানে এখানে ওদের খাবার…’

‘আমরাই বা আলাদা কোথায়! আমরা ভুলে যেতে চেয়েছি―এটাই তফাৎ। জেনে নেবার সৎসাহসটুকুও জোগাড় করে উঠতে পারিনি―যেমন এরা করেছে। এঁদের কাছে অতীন্দ্রিয়করণের আবডালটুকুও নেই। ভয়ের ব্যাপার কিছু থাকলেও সেটা ছিল এদের চোখের সামনে। তবু চেটেপুটে খেতে ওদের কোনও বাধা ছিল না―আর সেই জন্যই উগ্র মশলার…’

‘মানে গন্ধটা ঢাকবার জন্য বলছ ?’ সালুস্তিয়ানোর অনুমানের কথা মাথায় রেখে বললাম।

‘মনে হয় ঢাকা দেওয়া যেত না। ঢাকা দেওয়ার যুক্তিও কিছু নেই। খাচ্ছি কিছু আর স্বাদ পাচ্ছি অন্য কিছুর! হয়তো উগ্র মশলা মিশিয়ে স্বাদটাকে আরও সমৃদ্ধ করা হতো―রসনার প্রতি সুবিচার হতো।’

কথাগুলো শোনার পর আবার আমার অলিভিয়ার দাঁতের দিকে তাকানোর ইচ্ছেটা হলো, বাসে ফেরবার সময় যেমন হয়েছিল। ঠিক সেই সময় দাঁতের ফাঁক দিয়ে তার জিভটা বেরিয়ে এসেই সুড়ুৎ করে আবার মুখের ভেতর ঢুকে গেল। কল্পনায় বিশেষ কোনও আহার্যের আস্বাদ মনে পড়ে গিয়েছিল কি ? অলিভিয়া নিশ্চয়ই সাপারের মেনু নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে।

নিচু কয়েক সার বাড়ির মধ্যে আমরা রেস্তোরাঁটা খুঁজে বের করলাম। শুরু হলো হাতে বানানো কাচের পাত্রে রাখা গোলাপি রঙের একটা তরল পদার্থ দিয়ে―সোপ দে ক্যামেরোনিস―চিংড়ির স্যুপ―অপরিমেয় ঝাল―সেসব লংকার সংমিশ্রণে আমরা আগে পরখ করে দেখিনি―বিশেষ করে বিখ্যাত চিলেস জ্যালাপিয়োনিস। তারপর এল ক্যাব্রিতো―কঁচি পাঁঠার রোস্ট। এই রেসিপির প্রত্যেক কামড়ে চমক। দাঁত দিয়ে কাটার সময় একটা মুচমুচে ভাব, পরক্ষণেই মুখে গলে যায়।

‘ও কি! খাচ্ছ না যে ?’ অলিভিয়া জিজ্ঞেস করল। খুবই অভিনিবেশ সহকারে প্লেটে রাখা খাদ্যপদার্থের রসাস্বাদন করছিল। তা বলে স্বভাবসিদ্ধ হুঁশিয়ারিতে ঘাটতি ছিল না। আমি শুধু তার দিকে চেয়েছিলাম, আর মনের মধ্যে উদ্ভট সব ভাবনা জট পাকিয়ে উঠছিল। অলিভিয়া যেন আমার মাংস দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে নিল, তারপর জিভ দিয়ে টেনে সেটা মুখে চালানো করে দিল। পাচক রসে জারিয়ে ছেদন দন্তে টুকরো করার জন্য ধরেছে। সামনেই বসে আছি অথচ আমার খানিকটা অংশ, হয়তো বা পুরোটাই তার মুখগহ্বরে ঢুকে পড়েছে। চিবিয়ে চিবিয়ে সেগুলো টুকরো টুকরো করে ফেলছে। আমার অবস্থান কিন্তু একেবারেই নিষ্ক্রিয় নয়, মানে বলতে চাইছি, অলিভিয়া যখন আমার মাংস, হাড়গোড় চিবিয়ে চলেছে, তার ভূমিকার অভিনয়টাও আমিই করে চলেছি, আমার স্বাদগ্রন্থী থেকে পাওয়া স্বাদ তৎক্ষণাৎ তার শরীরে চালান করে দিচ্ছি। তার শরীরে স্পন্দন তৈরি করছি―অনুভবটা যেন তার একার নয়, আমারও। এক পরিপূর্ণ অন্তরঙ্গতা―আমাদের উভয়কেই অভিভূত করে ফেলেছে।

বাস্তবে ফিরে এলাম; অলিভিয়াও। দুজনেই নিবিড়ভাবে সামনে রাখা প্রিকলি পিয়ার পাতার স্যালাডের দিকে তাকালাম (এনস্যালাদা দে নোপ্যালিটোস)―সেদ্ধ করে রসুন, ধনে, লাল লংকা, তেল আর ভিনিগার মিশিয়ে তৈরি। তারপর গোলাপি রঙের ক্রিম দিয়ে বানানো ম্যাগের পুডিং (এক ধরনের অ্যাগাভি ক্যাক্টাস)। সঙ্গে ছিল এক ক্যারাফে স্যাংগ্রিটা১৮ আর সব শেষে দারচিনি দেওয়া কফি।

পরিস্থিতে এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে অলিভিয়ার আর আমার অন্তরঙ্গতার কথা মনে এলেই নানা রকম খাদ্যের ছবি কল্পনায় ভেসে ওঠে। কেবল খাদ্যবস্তুর সান্নিধ্যেই যেন এই অন্তরঙ্গতা সংস্থাপন করা সম্ভব। ভাবনাটা অলিভিয়ার মোটেই পছন্দ হলো না। রীতিমত বিরক্ত হলো। আর সেই বিরক্তির প্রকাশ ঘটল এই সাপারের মধ্যেই।

‘কী বিরক্তিকর তুমি! যত্তসব মান্ধাতার আমলের চিন্তাভাবনা!’ অলিভিয়া শুরু করল। কথাবার্তা জিইয়ে রাখার দায়িত্ব তার ঘাড়ে ছেড়ে দিয়ে আমি যেসব সময় মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকি, এই বহু পুরোনো অভিযোগটাও আবার শুনিয়ে খোঁটা দিল। (রেস্তোরাঁর টেবিলে আমরা দুজনে একা থাকলেই এই নিয়ে আমাদের মধ্যে তুমুল ঝগড়া লেগে যেত।) অভিযোগের ফিরিস্তি যথেষ্ট দীর্ঘায়ত আর সেসব অভিযোগের সত্যতা নিয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। তবু কেন যেন মনে হয় এই দ্বন্দ্বই স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমাদের একাত্ম করে রেখেছে। সাংসারিক জটিলতাগুলো চট করে বুঝে নিয়ে তার থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা আমার থেকে অলিভিয়ার অনেক গুণ বেশি। বহির্জগতের সঙ্গে আমার যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমও এই অলিভিয়া। ‘চিরটা কাল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থেকে গেলে। চারপাশে যা কিছু ঘটছে তাতে তুমি কতটুকু অংশগ্রহণ কর ? তোমার নিজের কোনও উদ্যম নেই। অন্যের কাঁধে বোঝা ফেলে দিয়ে তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকতে চাও! কী উদাসীন তুমি আর কেমনতর…’ আমার দোষের তালিকায় আরও একটা বিশেষণ যুক্ত হলো এবার; কথাটার মানে আমার কাছে নতুন করে ধরা পড়ল: ‘পানসে’!

আমি হলাম কি না পানসে! মনে মনে কথাটার মানে তলিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। স্বাদ-গন্ধহীন! তার মানে অলিভিয়া যদি আমাকে দিয়ে খিদে মেটাতে চায়, মেক্সিকানদের রান্নায় ব্যবহার্য মশলাপাতির দরকার পড়বে। লাউডস্পিকার যেমন শব্দের শক্তি বাড়িয়ে তোলে, ঠিক তেমনি উগ্র সুবাসযুক্ত মশলাপাতি স্বাদহীনতার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে―কিংবা বলা যেতে পারে অলিভিয়ার আমাকে দিয়ে খিদে মেটানোর বাসনার সঙ্গে রসনার আদান-প্রদানের রাস্তা খুলে দেবে।

‘আমাকে তোমার পানসে মনে হলো ?’ প্রতিবাদ করার একটা চেষ্টা করলাম। ‘তোমার কি ধারণা আছে যে এমন অনেক মশলা আছে যেটা লংকার মতো নিজেকে প্রকট না করেও রান্নার স্বাদ বদলে দিতে পারে ? এসব সূক্ষ্ম স্বাদ গ্রহণ করার জন্য রসনাকে তৈরি করতে হয়।’

পরের দিন সকাল সকাল সালুস্তিয়ানোর গাড়িতে আমরা ওয়ায়কা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। নির্বাচনপ্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারের জন্য বন্ধুকে কয়েকটা জায়গায় যেতে হবে। সফরের কিছুটা অংশ আমাদের সঙ্গে থাকবে বলে কথা দিল। যাবার পথে একটা প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটে নিয়ে গেল যেখানে এখনও ট্যুরিস্ট সমাগম তেমন ভাবে হয়নি। একটা পাথরের ভাস্কর্য―মাটি থেকে অল্প একটু ওপরে উঠে এসেছে―খুবই পরিচিত ভঙ্গি―মেক্সিকোর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো ঘোরার সময় অনেকবার এই ভঙ্গির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে―চ্যাক মূল―অর্ধশায়িত মনুষ্যমূর্তি―এট্রুস্ক্যান১৯ শৈলিতে নির্মিত―পেটের ওপর একটা থালা রাখা। অমসৃণ পাথর দিয়ে তৈরি একটা পুতুল―মুখে ভালোমানুষী ফুটে উঠেছে। অথচ পেটের ওপর ধরে থাকা ওই থালাতে করেই নাকি বলির মানুষের হৃদয় দেবতাকে উৎসর্গ করা হতো।

‘ঈশ্বরের বার্তাবহ―কথাটায় কি বোঝাতে চাওয়া হয়েছে ?’ আমি জানতে চাইলাম। সংজ্ঞাটা আমি গাইডবুকে পেয়েছিলাম। ‘ও কি ঈশ্বর প্রেরিত এক দানব যে ওই থালাতে করে উৎসর্গীকৃত বস্তুটা তাঁর কাছে পৌঁছে দিত ? নাকি সে মানুষের প্রতিনিধি, ঈশ্বরের কাছে তাঁর আহার্য নিয়ে যেতে হতো ?’

‘কে বলতে পারে ?’ সালুস্তিয়ানো বলল। এসব প্রশ্নের কোনও জবার হয় না―এমন একটা ভাব। তারপর ভেতর থেকে কিসের যেন সাড়া পেয়ে বলল, ‘এও তো হতে পারে, যাকে বলি দেওয়া হলো সে নিজেই নিজের নাড়িভুঁঁড়ি ওই থালায় নিয়ে দেবতাকে অর্পণ করছে। অথবা যে বলির কাজ সম্পন্ন করেছে সেই হয়তো বলিপ্রদত্তের ভঙ্গিমায় রয়েছে―কারণ সে জানে হয়তো আগামীকাল তার পালা আসবে। এই পারস্পরিকতা না থাকলে নরবলি ব্যাপারটাই যে অচিন্তনীয়। আজ যে উৎসর্গকারী কাল হয়তো সেই বলির পাত্র। বলির পাত্র নিজেও কোনও সময় অন্য লড়াইয়ে জয় লাভ করে কারও বলির কারণ হয়েছে, তাই নিজেকেও বলির পাত্র হিসেবে দেখতে তার বাধে না।’

‘ওদেরও খাদ্য হতে হতো কারণ তারাও কোনও না কোনও সময় খাদক হয়েছিল ?’ বললাম আমি। কিন্তু ততক্ষণে সালুস্তিয়ানো সর্পদেবের প্রতীক কেন জীবন এবং সৃষ্টির ধারাবাহিকতা বোঝানোর জন্য ব্যবহার করা হয় সেই নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে।

ইতোমধ্যে অলিভিয়ার আমাকে খেয়ে ফেলাবার ধারণার মধ্যে একটা ভ্রান্তি আমি ধরে ফেললাম। অলিভিয়া আমাকে নয়, আমিই অলিভিয়াকে খেয়ে ফেলি (সবসময় তাইই হয়ে থাকে)। রসনা উদ্রেককারী সুগন্ধিত নরমাংস তারই অধিকারভুক্ত হয়, যে নরমাংস খায়। অলিভিয়াকে বুভুক্ষুর মতো খেয়ে ফেলতে পারলেই আমি তার কাছে আর পানসে থাকব না।

সেদিন সন্ধেবেলা যখন তার সঙ্গে সাপারে বসলাম, তখনও কথাটা আমার মনে ছিল। ‘তোমার হয়েছেটা কী বলত ? খুব অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে!’ অলিভিয়া বলে উঠল। কিছুই তার চোখ এড়িয়ে যাবার নয়। যে ডিশ আমাদের পরিবেশন করা হলো তার নাম গরদিতাস পেলিজক্যাদোস কন ম্যান্তেকা যার আক্ষরিক মানে করলে দাঁড়ায় মাখনে ডোবানো নাদুস-নুদুস মেয়ে। অত্যন্ত মনযোগ সহকারে মিটবলগুলো মুখে ফেলতে লাগলাম। দাঁত দিয়ে পিষে ফেলার সময় এক ধরনের কামোত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম। মনে হতে লাগল অলিভিয়ার সুস্বাদু প্রাণশক্তি প্রতিটা মিটবল চিবিয়ে খাবার সময় আমার সমস্ত অন্তরাত্মা দিয়ে শুষে নিচ্ছি। আমার, মিটবলের আর অলিভিয়ার মধ্যে এক ত্রিধা আত্মীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। তারপর হঠাৎ খেয়াল হলো চতুর্থ একটা পক্ষ এই আত্মীয়তার মধ্যে অনাহুত প্রবেশ করেছে। আর এই চতুর্থ পক্ষ বাকি তিন পক্ষকে দূরে ঠেলে দিয়ে নিজেই আসর জমিয়ে নিয়েছে। চতুর্থ পক্ষটা হলো মিটবলগুলোর নাম―গরদিতাস পেলিজক্যাদোস কন ম্যান্তেকা―আসলে আমি নামটারই রসাস্বাদন আর হজম করে চলেছি! খাওয়া শেষ হয়ে যাবার পরেও আমি ওই নামেই মোহাচ্ছন্ন হয়ে রইলাম। রুমে গিয়ে শোবার পরেও সেই মোহ আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখল। আর মেক্সিকো সফরে এই প্রথম―যা এতদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছিল―যে সম্পর্ক আমাদের বিবাহিত জীবনের মূল অনুপ্রেরণা―আবার ফিরে এল।

পরের দিন সকালে আমরা পরস্পরকে চ্যাক মূল পোজে বিছানায় বসে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম। চোখমুখ পাথরের মূর্তির মতো নিষ্প্রভ, কোলের ওপর ধরা থালায় হোটেলের নাম না জানা কোনও ব্রেকফাস্ট। স্থানীয় আস্বাদের মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য আমরা আম, পেঁপে, চেরিমোয়া২০ আর পেয়ারার অর্ডার দিলাম। এসব ফলের মাধুর্যের সঙ্গে সঙ্গে সুক্ষ্মভাবে অম্লরসের আভাসও থাকে।

আমাদের সফর এবার মায়া সভ্যতাকে কেন্দ্র করে এগিয়ে চলল। পালেনকের মন্দিরশ্রেণি দর্শনের জন্য আমার গভীর ট্রপিক্যাল অরণ্যে প্রবেশ করলাম। ঘন বৃক্ষাচ্ছাদিত পাহাড় দিয়ে ঘেরা জঙ্গল। সারি সারি রবার গাছের ঝুরি মাটিতে নেমে এসেছে। হালকা বেগুনি রঙের ম্যাকুইলিস ফুলে ছেয়ে আছে। আগুয়াকেটের ঝোঁপ। বড় বড় গাছ বেষ্টন করে লতানে ফুল আর পাতা। ঝুলন্ত উদ্ভিদ। ইনসক্রিপশন মন্দিরের চড়া সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে একবার মাথাটা টলে উঠল। অলিভিয়া সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামা পছন্দ করে না। মন্দিরের সারির সামনের খোলা মাঠে, যেখানে বাসগুলো এসে দাঁড়াচ্ছে, যাত্রীদের নামিয়ে দিচ্ছে আবার ফেরত নিয়ে যাচ্ছে, সে সেই ভিড়ের মধ্যেই রয়ে গেল। বহুবর্ণ মানুষ আর বিচিত্র পোশাকের ভিড় সেখানে, আর কলরোল। আমি একাই সূর্যদেবের মন্দিরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম। জাগুয়ার সূর্যের একটা কারুশিল্প দেখার জন্য। কেতজাল পার্শ্বচিত্র দেখার জন্য ফোলিয়াটেড ক্রস মন্দিরে গেলাম। তারপর এলাম ইনসক্রিপশন মন্দিরে। এই মন্দিরের বিশেষত্ব হলো এখানকার সিঁড়ি খুবই চড়া আর চওড়া। সিঁড়ি বেয়ে শুধু ওপরে উঠলেই হবে না, নামতেও হবে। মন্দিরের ভেতরে গিয়েও আবার অনেক ধাপ সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠতে আর নামতে হয়। এত সব করে ভূগর্ভস্থ এক সমাধিগৃহে পৌঁছলাম। এক পুরোহিত রাজার সমাধি আছে সেখানে। (মেক্সিকোর অ্যানথ্রপলজিক্যাল মিউজিয়ামে এই সমাধির এক অবিকল প্রতিরূপ অনেক কম আয়াসে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল মাত্র কয়েকদিন আগে।) বেশ জটিল নকশা খোদাই করা একটা পাথরের ওপর রাজাকে একটা যন্ত্রের ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে যেটা অনেকটা কল্পবিজ্ঞানে পড়া মহাকাশযানকে মহাকাশে পাঠানো যন্ত্রের মতোই দেখতে। প্রকৃতপক্ষে এই দৃশ্য মনুষ্য শরীরের পাতালদেবতার সকাশে অবতরণের এবং উদ্ভিদ বা গাছপালা হিসেবে পুনর্জন্মের প্রতীক।

নিচে গেলাম, আবার ওপরে উঠে জাগুয়ার সূর্যের আলোয় ফিরে এলাম। হরিৎপত্রের প্রাণরসের অসীম সমুদ্রে। পৃথিবী পাক খেয়ে গেল। পুরোহিত রাজা আমার গলায় ছুরি চালিয়ে দিলেন। আমি লুটিয়ে পড়লাম। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আমি আবার চওড়া টুপি পরা ট্যুরিস্টদের ভিড়ে মিশে গেলাম। সূর্যের কিরণ আর পত্রহরিতের তেজ আমার শিরায় উপশিরায় ধমনিতে বেগে ধাবমান। সমস্ত তন্তু যা আমি চর্বণ এবং পরিপাক করেছি, সমস্ত তন্তু যা দিয়ে আমি সূর্যের রশ্মিকে আত্মভূত এবং বিলীন করে চলেছি, এদের আনুকূল্যেই একই সঙ্গে আমি জীবনকে গ্রহণ করছি আবার মৃত্যুকে স্পর্শ করতেও পারছি।

নদীর ধারে এক রেস্তোরাঁর খড় দিয়ে ছাওয়া নিকুঞ্জে―যেখানে অলিভিয়া আমার জন্য অপেক্ষা করছিল―আমাদের দুজনের চর্বণকার্যই ছন্দবদ্ধ লয়ে শুরু হয়ে গেল। ঠিক সাপের মত ফনা উঁচিয়ে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি―পালা করে পরস্পর পরস্পরকে ভক্ষণ করে পরমানন্দ লাভ করছি এবং অচিরাৎ পরিপাক করে ফেলছি―স্বজাতিভক্ষণের সর্বব্যাপী স্তরে যেখানে প্রণয়শীল অন্তরঙ্গতা আমাদের শরীরের সঙ্গে সোপা দে ফ্রিহলেস (মটরশুটির স্যুপ), হুয়াচিন্যাংগো আ লা ভেরাক্রুজানা (ভেরাক্রুজ ঘরানার মাছের কারি), এনচিলাদা (মাংসের পুর দেওয়া টরটিয়া আর লংকার সস্) এসবের সীমারেখা নিশ্চিহ্ন করে দেয়।

টীকা :

১. চিলেস এন নগাদা―মেক্সিকোর পরম্পরাগত খাবার।

২. তেপোৎজোৎলান―মেক্সিকোর একটা শহর।

৩. তামাল দে এলোতে―মেক্সিকোর আরেক পরম্পরাগত খাবার।

৪. কোয়াৎজাল্কোয়াৎল―পালকের মুকুট পরা সর্পদেব―অ্যাজটেকরা উপাসনা করতেন।

৫. মেসা―দক্ষিণ আমেরকার মালভূমি অঞ্চল।

৬. বারোক ধর্ম―ঐতিহাসিক বারোক যুগে প্রচারিত ধর্মমত―ঈশ্বর নির্দেশিত মহাজাগতিক সমন্বয়ের ধারণা।

৭. গুয়াকামোলে―অ্যাজটেক (বর্তমানে মেক্সিকোর) রন্ধনশৈলীতে প্রস্তুত মেক্সিকোর খাবার।

৮. টরটিয়া―মেক্সিকান রুটি অনেকটা আমাদের হাতে গড়া রুটির মতো কিন্তু মুচমুচে।

৯. আগুয়াকেট―(মেক্সিকান ভাষায়) আভাকাডো ফল।

১০. গুয়াজোলোত কন মোল পবলানো―মেক্সিকোর টার্কির মাংস দিয়ে তৈরি খাবার।

১১. পুয়েব্লা শৈলীতে তৈরি মোল সস―এই সস মেক্সিকোর পুয়েব্লা আর ওয়ায়কা শহরের বিশেষত্ব।

১২. কেইসাডিয়া―চিজ দিয়ে বানানো টরটিয়া।

১৩. মেসক্যাল―এক ধরনের মেক্সিকান সুরা।

১৪. টেকিলা―এক ধরনের ইতালিয়ান সুরা।

১৫. লজ দানজানতেস―নর্তক/নর্তকীর দল। মন্ট অ্যালবানে খোদাই করা বাস রিলিফ।

১৬. অ্যালমেন্দ্রোস গাছ―বাদাম গাছ (আমন্ড)

১৭. মেস্ক্যালিনা―মেসক্যালিন (এক ধরনের ড্রাগ―নেশা করার জন্য)।

১৮. স্যাংগ্রিটা―অনেকরকম ফলের রসের ককটেল।

১৯. এট্রুস্ক্যান শৈলি―প্রাচীন রোমের এট্রুস্ক্যান সভ্যতার অবদান। (লৌহ যুগ)।

২০. চেরিমোয়া―আনারস জাতীয় এক ধরনের ফল (দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যায়)।

প্যারিস থেকে

সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button