আর্কাইভভাষা গবেষণা

শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু : মানবর্দ্ধন পাল

ভাষা-গবেষণা ধারাবাহিক

নবম পর্ব

[প্রাচীন ভারতীয় আলংকারিকেরা শব্দকে ‘ব্রহ্ম’ জ্ঞান করেছেন―শব্দ যেন ঈশ্বরতুল্য। পাশ্চাত্যের মালার্মেসহ নন্দনতাত্ত্বিক কাব্য-সমালোচকদেরও বিশ্বাস, শব্দই কবিতা। যা-ই হোক, শব্দের মাহাত্ম্য বহুবর্ণিল ও বহুমাত্রিক। বাংলা ভাষার বৃহদায়তন অভিধানগুলোর পাতায় দৃষ্টি দিলেই তা প্রতিভাত হয়। আগুনের যেমন আছে অসংখ্য গুণ তেমনই ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দেরও আছে অজস্র অর্থের সম্ভার। কালস্রোতে ও জীবনের প্রয়োজনে জীবন্ত ভাষায় আসে নতুন শব্দ, তা বিবর্তিতও হয়। পুরানো শব্দ অচল মুদ্রার মতো ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে মণি-কাঞ্চনরূপে ঠাঁই নেয় অভিধানের সিন্দুকে।

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সমুদ্রসম―মধুসূদনের ভাষায় : ‘ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। বৈঠকি মেজাজে, সরস আড্ডার ভঙ্গিতে লেখা, এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’। ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক―সবকিছু মিলিয়ে শব্দের ভেতর ও বাইরের সৌন্দর্য-সৌগন্ধ এবং অন্তর্গত আনন্দধারার ছিটেফোঁটা ভাষিকরূপ এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’ ধারাবাহিক।]

অন্নকূট

‘অন্ন’ মানে ভাত আর ‘কূট’ মানে স্তূপ বা পাহাড়। তাই ‘অন্নকূট’-এর আভিধানিক অর্থ  খাদ্যের স্তূপ বা ভাতের পাহাড়। যেদেশে দারিদ্র্য ও অভাব-অনটন প্রতিনিয়ত কড়া নাড়ে অধিকাংশ মানুষের দোরগোড়ায়, খাদ্যসংকট সাধারণের নিত্যসঙ্গী, সে-সমাজ ‘অন্নকূট’ শব্দটি বেমানান। সামন্তপ্রভু বা সামর্থ্যবানদের ঘরে অন্নের স্তূপ থাকলেও সাধারণের ঘরে ছিল অন্নাভাব ও দারিদ্র্য। তাই ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’―এই প্রার্থনা আমাদের আবহমান কালের। ‘টালত ঘর নাই নিতি আবেসী’―চর্যাপদে অনাহারক্লিষ্ট মানুষের এই হাহাকার তো মিথ্যা নয়! তাই পাহাড় সমান খাদ্যবস্তুর স্তূপের ধারণাটি আমাদের বিস্মিত ও লোলুপ করে তোলে।

তবে ‘অন্নকূট’ সংস্কৃত ভাষার ভারতীয় পুরাণ-সস্পর্কিত শব্দ। এর ভেতরে আছে মিথের মৌচাক। এটি মূলত সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের  গিরিগোবর্ধন পুজোর মাধ্যমে প্রচুর পানাহারের উৎসব। খাদ্যের জন্য শস্য ও পানের জন্য দুধ প্রয়োজন। এর প্রধান অবলম্বন গোধন। পুরুষ গোরুর শক্তিমন্ত চাষে জন্মে শস্য আর গাভীর স্তনে জন্মে দুগ্ধ। জীবনধারণের জন্য দুইই প্রয়োজনে বলে গোপ্রজাতির বৃদ্ধি চাই। তাই পৌরাণিককাল থেকে প্রচলিত হয়েছে গোবর্ধনপূজা উপলক্ষে অন্নকূট উৎসব। শ্রীকৃষ্ণের নাম যেহেতু গোপাল এবং তার বাহন গোরু তাই গোবর্ধন বা গোরু প্রজননের লক্ষ্যে পূজা মানে কৃষ্ণেরই আরাধনা।

কলকাতার দে’জ থেকে প্রকাশিত সাংবাদিক মিলন দত্তের একটি বিখ্যাত বই ‘বাঙালির খাদ্যকোষ’। প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি বাঙালির যতধরনের খাবার ছিল বা আছে তার বর্ণানুক্রমিক বিবরণ তিনি বইটিতে দিয়েছেন। বড়ো বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক সেই অভিধান। অন্নকূটের পৌরাণিক তত্ত্ব ও মাহাত্ম্য যা-ই থাকুক―মিলন দত্ত অন্নকূট সম্পর্কে লিখেছেন : ‘অন্নকূট : পাহাড়ের মতো উঁচু করে  অন্ন বা ভাত সাজিয়ে উৎসব। মূলত বৈষ্ণবদের উৎসব। বৈষ্ণবদের বিভিন্ন মন্দিরে বা আখড়ায় অন্নকূট উৎসব পালিত হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদে কাশীর অন্নপূর্ণা মন্দিরে ওই উৎসব পালিত হয়ে থাকে।… অন্নকূট মূলত গোবর্ধনপূজা। ওই উৎসবে অন্ন এবং গোবর দিয়ে গোবর্ধন পাহাড়ের প্রতীক তৈরি করে পুজো করা হয়। না, কেবল বাংলায় নয়, গোটা দেশেই হিন্দুরা এই উৎসব পালন করে থাকে।’ তাই চৈতন্য চরিতামৃতে আছে, 

‘হেন মতে অন্নকূট করিল সাজন।’

শৈশবে দেখেছি, সম্ভ্রান্ত ও সম্পন্ন সনাতন পরিবারে মহাসমারোহে পালিত হতো অন্নকূটের ভোজনোৎসব। আমার ঠাকুরমা নির্মলাসুন্দরী ও দিদিমা সাবিত্রীরাণীকে দেখেছি কার্তিক মাসের সেই বিশেষ তিথিতে অন্নকূট উৎসব পালন করতে। বৈষ্ণবপন্থি সঙ্গীসাথি নিয়ে ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই স্নান সেরে তাঁরা শুরু করতেন বিপুল রান্নার আয়োজন। শ্রীকৃষ্ণের একশো আটটি নাম বলেই বোধকরি অন্নকূটে রান্না করা হয় একশো আট প্রকারের বিচিত্র ব্যঞ্জন! টক-ঝাল-তেতো থেকে মুড়িমুড়কি, মিষ্টিমণ্ডা, দুধ-দই, ক্ষীর-পায়েশ-পিঠা পর্যন্ত! ঘৃত সহযোগে নাম না জানা বিচিত্র স্বাদের বহু শাক ও ভাজা-বড়া দিয়ে শুরু―শেষ হয় অম্বলে, মিষ্টান্নে ও ফলমূলে। সবই প্রাণিজ আমিষমুক্ত সুস্বাদু নিরামিষ। এমন অচেনা এবং অনাস্বাদিতপূর্ব কতকিছুই যে থাকত তার ইয়ত্তা নেই―প্রতিটি ব্যঞ্জন দিয়ে এক গ্রাস করে খাওয়াও ছিল ভোজনবিলাসীর জন্য দুঃসাধ্য!

এই অন্নকূট উৎসবের কথা মনে পড়ল পুরনো দিনের এক জমিদারপুত্রের বিবাহপূর্ব আশীর্বাদ অনুষ্ঠানের খাদ্যতালিকা দেখে। অবাক করা কাণ্ড যে, সেই মেন্যুতে আমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য একশো আটত্রিশ প্রকার খাবারের মুদ্রিত বিবরণ ছিল। তা আষাঢ়ে গালগল্প নয়―ধনাঢ্য বাঙালির সামাজিক ইতিহাস এবং আভিজাত্য প্রকাশের দলিল। এই দ্যরিদ্র্যক্লিষ্ট দেশে অপচয়ের পরাকাষ্ঠাও বটে। পাঠকদের জন্য সেই বিবরণ ও পূর্ণাঙ্গ তালিকাটি প্রকাশ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না।

১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ১৪ অগ্রহায়ণ। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে যুবরাজ সৌরীশচন্দ্র রায়ের বিবাহপূর্ব আশীর্বাদ উপলক্ষে সেই প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়েছিল। রাজকীয় বিপুল মুখরোচক খাদ্যের সঙ্গে ছিল নাচগান, নাটক-সিনেমা ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের বিশাল আয়োজন। এই সঙ্গীতসন্ধ্যায় আমন্ত্রিত হয়ে যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনের জন্য এসেছিলেন সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এবার পড়ুন সেই রাজকীয় ভোজানুষ্ঠানের খাদ্যতালিকাটি।

★পোলাও―নিরামিষ★

১. সাদা ভাত ২. বিষ্ণুভোগ ৩. ছানার পোলাও।

★পোলাও―আমিষ★ (মাছের)

৪. রুইমাছের টিকলি পোলাও

৫. চিংড়িমাছের কাশ্মীরি পোলাও।

★পোলাও―মাংসের★

৬. ডিমের টিকলি পোলাও

৭. মটন ক্রুকেট পোলাও।

★আমিষ ভাজা―মাছের★

৮. রুইমাছের পেটি ভাজা

৯. চিংড়িমাছের কাটলেট

১০. ক) পামফ্রেট ফ্রাই খ) ভেটকি মাছের ফ্রাই। ১১. কই মাছের পাতরি ১২. রুইমাছের দম পোক্তা। ১৩. ভেটকি ক্রুকেট। ১৪. মাছের সিঙ্গারা।

১৫. মাছের কচুরি ১৬. দইমাছ ১৭. মালাইকারি।

★মাংস★

১৮. মাটন কাটলেট ১৯. রোস্ট ২০. হাড়ি কাবাব ২১.ক) মাটন কোর্মাকারি খ) রুইমাছের চপ গ) মাংসের চপ।

★ডিমের★

২২. ডেভিল ২৩. মামলেট।

★নিরামিষ ডাল★

২৪. মুগ মনোহর

★আমিষ ডাল★

২৫. রুইমাছের ছোলার ডাল।

★নিরামিষ ভাজা★

২৬. কঙ্কাশাক ভাজা ২৭. আলুভাজা

২৮. পটলভাজা ২৯. বেগুনভাজা ৩০. কপিভাজা ৩১. নারকেলের ফ্রাই।

★নিরামিষ তরকারি★

৩২. কুমড়ার হুসেন শা ৩৩. লাউ রায়তা ৩৪. ফুলকপির মিটি মুখ ৩৫. ফুলকপির মোগলাইকারি ৩৬. বিট শানাদ ৩৭. বাঁধাকপির বুকধরফরি ৩৮. ফুলকপির রোস্ট ৩৯. পাপড়কারি ৪০. ছানার ডিমের কারি ৪১.ক) মোচার চপ খ) ভেজিটেবল চপ ৪২. এঁচোরের কাটলেট ৪৩. বাঁধাকপির মির্জাপুরী। ৪৪. আলুর জয়হিন্দ ৪৫. ছানার কারি।

★আমিষ তরকারি★

৪৬. পটল দোম্মা কারি ৪৭. লাদা দোম্মা।

★চাটনি★

৪৮. আনারসের চাটনি ৪৯. রসমুণ্ডির চাটনি ৫০. আদার চাটনি ৫১. কমলালেবুর চাটনি ৫২. আলুবোখারা ও খেজুরের চাটনি।

★আচার★

৫৩. ম্যাংগো সুইট ৫৪. করমচার আচার

৫৫. আমের চাটনি ৫৬. বাঁশের কোড়ের আচার ৫৭. লংকার আচার ৫৮. ফুলকপির আচার ৫৯. কড়াই শুটির আচার ৬০. আদার আচার।

★পায়স★

৬১. বোঁদের পায়স ৬২. সিমুইয়ের পায়স ৬৩. পেস্তার পায়স ৬৪. কমলালেবুর পায়স ৬৫. আনারসের পায়স।

★ভাজা★

৬৬. পাপড় ভাজা ৬৭. লুচি ৬৮. রাধাবল্লভী ৬৯. সিঙ্গারা ৭০. কচুরি ৭১. আটভাজা (বেঙ্গল স্টোর) ৭২. ক্ষীরের মামলেট।

★ফল★

৭৩. বেদানা ৭৪. আঙুর ৭৫. আমেরিকান পেস্তা ৭৬. মনাক্কা ৭৭. বাদাম ৭৮. এফ্রিকট ৭৯. কিসমিস ৮০. মনকি নাট ৮১. কমলালেবু ৮২. খেজুর ৮৩. পিচ ৮৪. আখরোট ৮৫. আপেল ৮৬. সফেদা ৮৭. পেয়ারা ৮৮. তরমুজ ৮৯. আনারস ৯০. পেঁপে ৯১. শসা ৯২. মর্তমান কলা ৯৩. আখ ৯৪. টিনের লিচু ৯৫. পাকা আম।

★সন্দেশ★

৯৬. শুভাশীর্বাদ ৯৭. দেদো মোণ্ডা (দিগনগর) ৯৮. পানতোয়া (স্বরূপগঞ্জ) ৯৯. ছানার জিলাপি (মুক্তাগাছা) ১০০. সীতাভোগ (বর্ধমান)। ১০১. মিহিদানা (ঐ) ১০২. খাজা (কালনা) ১০৩. ছানাবড়া (বহরমপুর) ১০৪. মনোহরা (বেলডাঙা) ১০৫. বাদামি বরফি (কৃষ্ণনগর) ১০৬. সরভাজা (ঐ) ১০৭. সরপুরিয়া (ঐ) ১০৮. রাজভোগ (ঐ) ১০৯. ছানার গজা (ঐ) ১১০. আবার খাব (দ্বারিক) ১১১. গোলাপফুল সন্দেশ (ঐ) ১১২. শোনপাপড়ি (ঐ) ১১৩. কালাকঁন্দ (ঐ) ১১৪. গালচাপড়া (ঐ) ১১৫. প্রাণধরফড়ি (ঐ) ১১৬. লেডিকেনী (নবদ্বীপ) ১১৭.

বেদানা বোঁদে (ঐ) ১১৮. অমৃত জিলাপি (ঐ) ১১৯. হিমসাগর (বহরমপুর) ১২০. পোলাও সন্দেশ (ঐ) ১২১. মুগের ডালের জিলাপি (বালিচক) ১২২. নিকুতি (শান্তিপুর) ১২৩. রসকদম্ব (কালীগঞ্জ) ১২৪. ক্ষীরের দই ১২৫. ভাপা দই ১২৬. রাবড়ি ১২৭. ক্ষীরের পেস্তা।

★মোরব্বা★(বীরভূম)

১২৮. আমের ১২৯. পটলের ১৩০. বেলের ১৩১. শতমূলির ১৩২. পেঁপের ১৩৩. আমলকির।

★সরবত ও পানীয়★

১৩৪. চা, সোডা, লিমনেড, জিঞ্জারেট, লিমনক্রাস, আইসক্রিম সোডা, আইসক্রিম পুডিং।

১৩৫. খরিকা ১৩৬. তবক পান, মশলা, কিমান জর্দা, দোক্তা।

★হজমি★

১৩৭. সিগারেট, সিগার ১৩৮. যোয়ানের আরক, যোয়ানের বড়ি, সোডি-বাইকার্ব, বাই-কোলেট, সেরিডন, কড়কাড়, ব্রমাইড।

খাবারের এত উপচার দেবলোকেও আছে কিনা সন্দেহ! স্থান-বিশেষের নামকরা খাবারটিও সংগ্রহ করা হয়েছে। নম্বরফর্দ ঠিকমত করলে এই তালিকা ১৩৮ থেকে ১৬০-এর ওপরে উঠবে। এই মেন্যুর অধিকাংশের স্বাদ গ্রহণ তো দূরের কথা নামই আমরা অনেকে শুনিনি! প্রিয় পাঠক, আপনারা কয়টি ব্যঞ্জন খেয়েছেন বা নাম শুনেছেন ?

★ তথ্যসূত্র : সিনহা প্রতিম, কলকাতা।

কর

‘তুমি নির্মল কর, মঙ্গল করে

মলিন মর্ম মুছায়ে

তব পূন্য কিরণ দিয়ে যাক মোর

মোহ-কালিমা ঘুচায়ে।’

                ―রবীন্দ্রনাথ

‘কর’ শব্দটা খাঁটি সংস্কৃত―যখন এর শাব্দিক অর্থ : হাত, হস্ত, পাণি ইত্যাদি।  এটি যেমন তৎসম শব্দ তেমনই বাংলা  ক্রিয়ার মূলও (√ক)। মধ্যম পুরুষে তুচ্ছার্থক ক্রিয়াপদ হিসেবেও আমরা এটি প্রয়োগ করি : ‘তুই কর’। তখন  শেষের ‘অ’ বাদ দিয়ে ব্যঞ্জনান্ত উচ্চারণ করি। আবার সাধারণ মধ্যম পুরুষে উচ্চারণ করি ‘অ’ যুক্ত করে―তুমি ‘করো’। তাই ‘কর’ এক অর্থে শব্দমূল অন্য অর্থে ক্রিয়ার মূল বা ধাতু।―এতক্ষণে নিশ্চয়ই মেজাজ বিগড়ে যাবার কথা―ব্যাকরণের এই অনাকাক্সিক্ষত কচকচি কারই বা ভালো লাগে! মাধ্যমিকে মাথা গরম-করা এসব বিষয়ের কথা মনে পড়লে আজও গা শিউরে ওঠে! তবু শব্দের সদর-অন্দর দেখতে গেলে ভাষার কলকব্জা একটু নাড়তেই হয়। এক্সরে ছাড়া তো অন্দরমহলের অনেক কিছুই দেখা যায় না।

 ব্যাকরণের নিয়মে―হস্ত আছে যার তার নাম যদি ‘হস্তী’ হয় তবে মানুষের নামই ‘হস্তী’ হওয়া উচিত ছিল। কারণ হাতের ব্যবহার মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী বেশি করে ? মগজের পর এই হাতজোড়াই আমাদের মানুষ করেছে―মর্যাদা দিয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের। ডারউইনের বিবর্তনবাদ বিশ্বাস করলে মানতে হবে যে, আমাদের আদিম পূর্বপুরুষ যখন থেকে সামনের দুপাকে হাঁটার কাজ থেকে মুক্তি দিয়ে ধরার কাজ শিখেছে সেদিন থেকেই সভ্যতার শুরু। হাতকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে মানুষের অগ্রগতির সূচনা। হাতের যে প্রতিশব্দ ‘কর’ তা সংস্কৃত √কৃ ধাতু থেকে উৎপন্ন। কিন্তু ‘কর’ শব্দটি একার্থবোধক নয়; দ্ব্যর্থবোধকও নয়―বহুবিচিত্র অর্থ আছে এর।

রবীন্দ্রনাথের কাব্যবাণীতে পাওয়া যায় : ‘আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর…।’ কিংবা ‘আজি নির্মল কর উজ্জ্বল করে মলিন মর্ম মোছায়ে।’ এসব ‘কর’ কিন্তু  এক অর্থের নয়। ‘কর বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার করবাবু দিশেহারা!’ এ-করও সে-কর নয়! তাই করের অর্থের কারিশমা ও ভাবের কেরামতি একটু পরখ করে দেখা দরকার।

★ কর =  কর্মসম্পাদনের আদেশ, নির্দেশ, অনুরোধ। মধ্যম পুরুষের অনুজ্ঞা। ক্রিয়াপদ হিসেবে এর প্রয়োগ সহজলভ্য এবং সাধারণের কাছে পরিচিত। তাই রবীন্দ্রনাথের গানে পাই : ‘আমারে কর তোমার বীণা লহ গো লহ তুলে।’ প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এর বিচিত্র ও একটু ভিন্ন রূপের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। যেমন : করিউ, করতহি, করন্তি, করএ, করিলোঁ, করিলান্ত, কৈল, করিবেক, করিহলি ইত্যাদি। এবার কয়েকটি প্রাচীন প্রয়োগ :

★ ‘দিঢ় করিঅ মহাসুহ পরিমাণ।’

(চর্যা- ১)।

★ ‘বসি তোহ্মে তার পাশে করিহলি উপহাসে।’ (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন)।

★ ‘আর তোমা করিবাম মোহন্ত উজীর।’ (আলাওল)।

★ ‘ধার্মিক হও তুমি করিলাঙ বিস্বাস।’ (মালাধর বসু)

এমন শতাধিক উদাহরণ সংগ্রহ করা যায় প্রাচীন কবি ও কবিতা থেকে। তবে প্রয়োজন নেই। কেবল মনে রাখতে হবে এধরণের ক্রিয়াপদগুলো থেকেই রূপান্তরিত হয়ে আধুনিক বাংলা ভাষার ক্রিয়াপদ গঠিত হয়েছে।

★ কর =  শুল্ক, খাজনা। আয়কর, ভূমি উন্নয়ন কর, পৌরকর, মূল্যসংযোজন কর ইত্যাদি। * ‘জত বৈসে দ্বিজবর তার নাহি নিব কর চাষভূমি বাড়ি দিব দান।’ (মুকুন্দরাম চক্রবর্তী)।

★ কর =  যা সূর্যাদি বা অন্য তেজস্কর পদার্থ থেকে বিক্ষিপ্ত হয়। কিরণ, রশ্মি, আলো, তাপ। * ‘ফিরএ আকাশ পরে মহাদীপ্ত কর।’ (সৈয়দ সুলতান)।

আবার ‘কর’ শব্দের সামনে যখন অন্য শব্দ সমাসবদ্ধ হয়ে যুক্ত থাকে তখনও করের অর্থ একরকম হয় না। তাই রবিকর, আয়কর, শব্দকর ও গুণাকর একজাতীয় অর্থ নয়। অনেকের জানা থাকলেও একটু ভেঙে বলি:

* রবিকর =  রবির কর, সূর্যের আলো। ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস।

* আয়কর =  আয়ের জন্য কর। নিমিত্তার্থে চতুর্থী তৎপুরুষ।

* শব্দকর =  শব্দ করে যে (বাদ্যকর)। উপপদ তৎপুরুষ।

* গুণাকর =  গুণের আকর। ‘আকর’ অর্থ খনি। ষষ্ঠী তৎপুরুষ।

‘কর’ অন্য শব্দের পরে থাকলে যেমন বিপদ―বোধের বিভ্রম ও অর্থবিভ্রাট ঘটে―সামনে থাকলেও আপদের অন্ত নেই! যেমন, ‘করদ’ মানে অধীনতা স্বীকার করে কর দেয় যে। আর ‘করধা’ মানে উৎকোচ, ঘুস। এমন অজানা বা অল্পজানা কয়েকটি বিদখুটে শব্দের উল্লেখ করি:

* করকোষ্ঠি =  হাতের রেখা নির্ণয় করা কাগজ।

* করনলিনী =  পদ্মের মত সুন্দর হাত।

* করপল্লব =  নতুন পাতার মতো নরম হাত।

* করকা =  মেঘজাত শিলা।

* করকাম্ভ =  নারকেলের জল।

* করকণ্টক =  হাতের নখ।

* করঙ্ক =  পানের বাটা।

* করঙ্গ =  ভিক্ষাপাত্রবিশেষ।

এমন সহচর শব্দের অন্ত নেই। তাই ক্ষান্ত দিই।

★ কর =  বাঙালি হিন্দুদের নামের শেষে যুক্তথাকা পদবিবিশেষ। বাংলা ভাষার কৃতী ঔপন্যাসিক বিমল কর।

★ কর =  প্রত্যয়বিশেষ, করে যে কিংবা কারী, কারক, দায়ক জনক অর্থে। উপপদ তৎপুরুষ সমাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। হিতকর―হিত বা কল্যাণ করে যে। সুখকর―সুখ করে যে (দায়ক)। প্রভাকর―প্রভা (আলো) করে যে।

★ কর =  যা দিয়ে কাজ সম্পাদন করা হয়, হাত। ‘কর কমল বাহু মৃণাল।’

(বড়ু চণ্ডীদাস)। ‘প্রভু করে ইহাঁ রূপ ছিল দশ মাস।’ (কৃষ্ণদাস)।

‘কোমলতর কমলকরে পরশ কর প্রাণের পরে।’ (রবীন্দ্রনাথ)।

কোনও শব্দের অর্থই তুচ্ছ নয়, হীন নয়, অবজ্ঞার নয়। সকল অর্থই গুরুত্বপূর্ণ। তবু কেন জানি মনে হয়, কর-এর হাত এবং আলো অর্থ দুটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই হাতে প্রেমিক কাঁকন পরায়, শোষক শৃঙ্খলও পরায়। এই হাত আলিঙ্গনের স্পর্শসুখ দেয়, আন্দোলনে মুক্তির নিশানাও দেখায়। তাই আমরা ভালোবাসার  চালধোয়া স্নিগ্ধ-কোমল হাত চাই―বিদ্রোহের বজ্রমুষ্ঠিযুক্ত হাতও চাই। আর সর্বময় নিকষকালো অন্ধকার দূর করার জন্য আলোও চাই। শিক্ষার  আলো, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো, প্রগতির আলো, সংস্কারমুক্তির আলো সর্বোপরি আলোকিত মানুষ। কবীন্দ্র রবীন্দ্রের ভাষায় : ‘আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও।’ ‘অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই,  চাই মুক্ত বায়ু… / আনন্দ-উচ্ছল পরমায়ু।’ তাই তো আমরা ‘আলো হাতে চলিয়াছি আঁধারের যাত্রী।’

কুল

কাদের কুলের বউ গো তুমি

কাদের কুলের বউ ?

যমুনায় জল আনতে যাচ্ছ

সঙ্গে নাই তো কেউ।

            ―রামনিধি গুপ্ত

কুল এবং কূল বাংলায় সমোচ্চারিত ভিন্নতার্থক শব্দ। এদুটো শব্দের উচ্চারণ একেবারে একরকম। হ্রস্ব-উ- কার এবং দীর্ঘ-ঊ-কারে বানান ছাড়া কোনও পার্থক্য নেই কিন্তু অর্থ সম্পূর্ণ  আলাদা। আবার ‘কোল’ বলেও একটি শব্দ আছে―প্রায় সমোচ্চারিত কিন্তু আলাদা অর্থ। সাধারণের অসচেতন উচ্চারণে হ্রস্ব-উ এবং ও প্রায়শই একাকার হয়। এজন্যই লৌকিক উচ্চারণে চোর > চুর, ভোর > ভুর, আলো > আলু হয়ে যায়। রামনিধি গুপ্তের লেখা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কণ্ঠে পুরনো দিনের গানে শুনি : ‘কাদের কুলের বউ গো তুমি, কাদের কুলের বউ/ যমুনার জল আনতে যাচ্ছ সঙ্গে নেই কো কেউ।’ জসিম উদদীনের বহুল পঠিত বিষাদাত্মক ‘কবর’ কবিতায় একমাত্র নাতি ছাড়া দাদুর তিন কুলে আর কেউ রইল না! আর পল্লিগীতির আইকন আবদুল আলিমের কণ্ঠে শুনি : ‘নদীর কূল নাই, কিনার নাইরে…।’ কবিগুরুর ‘সোনার তরী’ শীর্ষক কবিতায় পড়ি : কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা। আপ্তবাক্য আছে : ‘মায়ের কোল সন্তানের পরম আশ্রয়।’ শৈশবে মায়ের মুখে শুনেছি, সরস্বতীপুজোর আগে কুল খেতে নেই। এই-যে তিন বানানের কুল, কূল এবং কোল―এসবের অর্থ-পার্থক্য আমরা সবাই জানি : কুল  =  বংশ, কূল  =  তীর বা তট, কোল  =  অঙ্ক, কাঁখ। কিন্তু অন্যসব বাদ দিয়ে আমরা যদি কেবল হ্রস্ব-উ-কারযুক্ত ‘কুল’ শব্দটির কথাই ভাবি তবে দেখব তা একার্থবোধক নয়―এরও আছে বহুতর অর্থের ব্যঞ্জনা। তারই একটু খোঁজ-খবর নেওয়া যাক।

নদীতীরের কূল-কিনারা তবু পাওয়া যায়, তা পদ্মা-মেঘনা বা মিসিসিপি, আমাজন যা-ই হোক। কিন্তু সহজে মেলে না মহাসাগরের কূলকিনারা। তেমনই ‘কুল’ শব্দও যেন অকূল পাথার! অভিধানে প্রদত্ত এর অর্থগুলোর দিকে প্রথমে চোখ ফেরাই। তাতে কুলের অর্থ পাওয়া যায় : সন্তান, গোত্র, বংশ, গোষ্ঠী, সদ্বংশ, রূপবান, নবগুণান্বিত বংশ, অভিজাত্য, জাতি, বংশ-মর্যাদা, রাশিকরণ, আশ্রয়, পাল, যূথ, সজাতীয় দল, গৃহ, সতীত্ব, বল্লাল সেন-প্রবর্তিত কৌলীন্য প্রথা, বর্ণ, সব, সমুদয় (বহুবচন নির্দেশক প্রত্যয়), কুলগাছ, কুলফল (বরই)। এছাড়াও কুলের আরও সমার্থক বা প্রতিশব্দ আছে, যেগুলো উল্লেখ না-করলেও চলে। তবে সংস্কৃত ভাষায় এর ভিন্ন অর্থও আছে―দেহ, দেশ, জনপদ, ক্ষেত্র, বন্ধুভাব, মৈত্রীকরণ ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় কুলের এসব অর্থের প্রয়োগ নেই। অর্থভিন্নতার কারণে অভিধানে ‘কুল’ শব্দের চারটি ভুক্তি পাওয়া যায়। তবে সাধারণ্যে এর প্রধান অর্থ বংশ হলেও অন্যগুলোও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় কিংবা আমাদের তেমন অজানাও নয়।

★ কুল  =  কাঁটাযুক্ত মাঝারি আকৃতির একপ্রকার গাছের অম্লরসযুক্ত ফল। কুলনামক কাঁটাগাছ বা কুলগাছ কিংবা কুলফল। বৈদিক ভাষায় এই ফলের নাম―কুডী বা কুলী। সংস্কৃতে―কোলি, কোলং, কুবলং।

প্রাকৃত বাংলায়―কুলি, বদরীফল। হিন্দিতে কুলফলকে বলে―বৈর। প্রচলিত বাংলায় বরই (বদরী > বৈর > বরই)। দেশি জাতের ছাড়াও বাজারে এখন বিভিন্ন জাতের উচ্চ ফলনশীল বরই এখন পাওয়া যায়। ডিম্বাকৃতি, অণ্ডাকৃতি, নারকোলি, আপেলকুল ইত্যাদি। স্বাদ, আকৃতি, রঙ ও নমুনায় এগুলো আলাদা।

★ কুল =  বহুবচন নির্দেশক সংস্কৃত প্রত্যয় বা বিশেষণ পদ। অর্থ―সকল, সব, সমস্ত, সমুদয় ইত্যাদি। সব ধরনের বহুবচন নির্দেশক বিশেষণ সকল শব্দের সঙ্গে প্রযোজ্য নয়। কিন্তু ‘কুল’ উন্নত প্রাণী, ইতর প্রাণী ও অপ্রাণিবাচক সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে বহুবচন প্রকাশে ব্যবহার করা যায়। যেমন―মানবকুল, নারীকুল, রক্ষঃকুল, পক্ষীকুল, ফুলকুল, মৃগকুল ইত্যাদি। ‘সুখে মৃগকুল বসে।’

(সকল অর্থে, বড়ুচণ্ডীদাস)।

★ কুল  =  আরবি শব্দ। অর্থ―সব, বেবাক, বিলকুল। যেমন―কুলকপাল (আরবি শব্দ কুল + সংস্কৃত কপাল)। ‘যা থাকে কুলকপালে, দেশে ফিরে গিয়েই ঐ মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব করব।’ (বিশেষ্য পদ, সম্পূর্ণ ভাগ্য অর্থে, প্রমথ চৌধুরী)।

★ কুল  =  সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ এবং বিশেষ্য পদ। সংস্কৃত ব্যাকরণে ‘কুল’ ক্লীবলিঙ্গ (√কুল্ + অ)। লক্ষ করা যায়, প্রাচীন বাংলায়, বিশেষত চর্যাপদে কুল এবং কূল সমার্থক ছিল। তাই ‘তীর’ অর্থে ১৪ নং চর্যায় লেখা হয়েছে : ‘জোর রথে চড়িলা বাহবা ণ জাই কুলেঁ কুল বুড়ই।’ একালে অক্ষয়কুমার দত্তও ‘দিশা’ অর্থে লিখেছেন : ‘ভেবে কুল পাইনে।’ তবে বংশ অর্থে ‘কুল’ শব্দের প্রয়োগ বাংলা ভাষায় বেশি লক্ষ করা যায়। মহান কবি-লেখকদের রচনা থেকে প্রাসঙ্গিক কিছু চুম্বক পঙ্ক্তি চয়ন করা যায় :

* এক লক্ষ পুত্র আর সোয়া লক্ষ নাতি/ কেউ না রইল কুলে জ্বালাইতে বাতি। (রামায়ণ)।

* এতেকেঁ বুঝিল তার বড় কুল জাতী। (বড়ুচণ্ডীদাস)।

* একুলে ওকুলে দুকুলে গোকুলে আপনা বলিব কায়। (চণ্ডীদাস)।

* একুল ওকুল দুকুল চাহিতে সংশয় পড়িল রাধা। (জ্ঞানদাস)।

* যদি কালী কূল দেন কুলে আগমন। (ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর)।

* সে যে অকুলতারণ, কুলের কারণ, কুল ছেড় না পরের বোলে।

(রামপ্রসাদ)।

* কুলশীল নাশে কালিয়া প্রেমের মধু। (চণ্ডীদাস)।

* কুলে দিয়া ছাই ভজি উহারে।

(ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর)।

* আমি কুলহারা কলঙ্কিনী/ আমারে কেউ ছুঁইয়ো না গো সজনী। (শাহ্ আবদুল করিম)।

মধুকবির ‘মেঘনাদবধ’ মহাকাব্যে ‘কুল’ শব্দের প্রয়োগ-প্রাচুর্য লক্ষ করা যায় :

* ক্ষত্রকুলে জন্ম মম, রক্ষঃকূলপতি…।

* বলজ্যেষ্ঠ, রক্ষঃকূলশ্রেষ্ঠ শূরমণি।

* ‘মানবকুলে দেবী সীতা ও দানবকুলে দেবী প্রমিলা।’ কবি তাঁর সমাধিলিপিতেও কুল শব্দটির সন্ধিযুক্ত করে লিখেছেন : ‘দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রী মধুসূদন।’

কুল শব্দটি আভিজাত্য-প্রকাশক, তথাকথিত উচ্চ শ্রেণির গৌরবধারী ও সামন্ততন্ত্রের বিত্তবিলাসিতার অহংকার-ঋদ্ধ। কারণ কুল শব্দ থেকেই প্রত্যয়যুক্ত হয়ে কুলীন (কুল + ঈন) ও কৌলীন্য (কুলীন + ষ্ণ্য) শব্দের সৃষ্টি। সমাসবদ্ধ হয়ে তৈরি হয়েছে―কুলদা, কুলপুরোহিত,  কুলগুরু, কুলকমলিনী, কুলকামিনী, কুলবালা ইত্যাদি সদর্থক শব্দ। আবার নেতিবাচক শব্দও আছে অনেক : কুলটা, কুলত্যাগী, কুলনাশী, কুলকলঙ্কী…। বংশগৌরব, কুলের বড়াই, পদবির অহংকার, সামন্ত মানসিকতা, শ্রেণিবৈষম্যের ও ধনগর্বের পরিচায়ক। তাতে সমাজ অমানবিকতার অহিফেনে লিপ্ত হয়―মানুষে-মানুষে বাড়ে বিভেদ এবং  বিচ্ছিন্নতা। কুলের ফানুস-গৌরব নিয়ে রচিত রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটক এই অসঙ্গতিপূর্ণ সামাজিক দুর্বলতারই দলিল। কূলের পৌরাণিক তাৎপর্যও আছে―আশ্রমের প্রধান মুনি। যিনি দশ হাজার শিষ্যকে অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় দান করে নিজগৃহে পাঠদান করেন তিনি ‘কুলপতি’। আবার জন্মমৃত্যুর সনতারিখসহ বংশপরম্পরার বিবরণ লেখা থাকে যাতে তাকে বংশপঞ্জি বা কুলজি বলে। অনেক অভিজাত হিন্দুসমাজের কুলজিতে বৈবাহিক সম্পর্কের বিবরণও থাকে।

কুল নিয়ে বাংলায় প্রবাদবাক্যও আছে। উভয় সংকটকে বলা হয়, ‘শ্যাম রাখি, না কুল রাখি।’ অর্থাৎ শ্যাম রাখতে গেলে কুলমান যায় আর বংশমর্যাদা রাখতে গেলে কৃষ্ণপ্রেম ত্যাগ করতে হয়। কুকর্মের মাধ্যমে বংশের মানহানি করাকে বলা হয়, ‘কুলের মুখে কালি দেওয়া।’ তীব্র জ্বালাকর ও তেজস্কর দীপ্তিকে বলে, ‘কুলকাঠের আগুন।’ রবইগাছের আগুনের উত্তাপ নাকি তীব্র হয়। বিয়ের পাত্রী-পছন্দের ব্যাপারে একটি প্রবাদ আছে : ‘কুলের কন্যা কালোও ভালো/ নদীর জল ঘোলাও ভালো।’ এখানে পাত্রীর রং ও দৈহিক সৌন্দর্যের চেয়ে বংশমর্যাদাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিধবা বাঙালি নারী যখন বহুমুখী বিপন্নতায় আর্ত কণ্ঠে বলে, ‘আমি তিন কুল শূন্য’ তখন এই শূন্যতা মহাশূন্যের শূন্যতার চেয়ে কম নয়! এই ‘তিন কুল’ মানে তিন দিকের তটহীনতা নয়―পিতৃকুল, মাতৃকুল ও শ্বশুরকুলের শূন্যতা।

কুল শব্দটি যখন দ্বিত্বরূপে ‘কুলকুল’ হয় তখন তা ধ্বন্যাত্মক শব্দ হিসেবে ভিন্ন অর্থ ধারণ করে। বাংলা ভাষায় ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলো প্রধানত শ্রুতিনির্ভর। যেমন―ঝরঝর, শনশন, টিপটপ, ঝমঝম তেমনই কুলকুল। প্রকৃতি-সঞ্জাত মৃদুমন্দ ও কোমল ধ্বনিতরঙ্গের আভাস পাওয়া কুলকুলের মধ্যে। জলের ধীরগতির প্রবহমানতায় যে সুখশ্রাব্য শব্দতরঙ্গ ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে’ প্রবেশ করে তা-ই কুলকুল ধ্বনি।’ তাতে কোনও উচ্চ নাদ নেই―আছে ধ্বনির  কুসুমকোমল পেলবতা।

কুলগৌরব ও বংশমর্যাদার ঠুনকো আভিজাত্য অনেক ক্ষেত্রে জীবন অতিষ্ঠ করে―বিশেষত বর্ণ-হিন্দু সমাজে। তাই অসবর্ণ বিয়ে এখন ব্যাপকভাবে প্রচলিত এবং নিন্দনীয়ও নয়। তাই প্রবাদ আছে―কুল ধুয়ে কি জল খাব ? একথায় মনে পড়ল করুণ এক সমাজসত্য :

এক বর্ণাশ্রমবাদী পিতা তথাকথিত উঁচু বংশ-বর্ণ-গোত্র-গোষ্ঠী-পদবি দেখে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। একদিন পিতা কন্যাকে দেখতে এসে লক্ষ করলেন, সে বড় হাঁড়িতে রান্না করছে। জিজ্ঞেস করলেন,

‘কী রান্না করছিস্ মা’ ? মেয়ের উত্তর :

‘কুল সেদ্ধ করছি।’ তাই বংশগৌরব এবং কৌলিন্য একালে ভাঙা হাটের মত বিত্তহীন, জনহীন এবং  পণ্যশূন্য ধূসর প্রান্তর।

[চলবে]

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button