শ্রুতিসিদ্ধ, দৃঢ় ও কোমল : ফারুক মাহমুদ
প্রচ্ছদ রচনা : শব্দঘর নির্বাচিত সেরা বই ২০২৩―কাব্যগ্রন্থ
একটি রচনা কেন ‘কবিতা’, এর তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিস্তৃতভাবে দেওয়া যেতে পারে। এতেও যে সব পাঠকের গ্রাহ্যতা পাবে, এর কোনও নিশ্চিতা নেই। কেউ সন্তুষ্ট হবেন, আবার কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করে জানাবেন নিজের অসন্তুষ্টি। যখন থেকে কবিতা এল, সঙ্গে এল ‘কবিতা কী’ এই তৃষ্ণামুখর প্রশ্নটিও। সমাধান মেলেনি, স্থাপিত হয়নি কোনও ঐকমত্য। একসময় তুলাধুনা হয়েছে এমন ‘অকবিতা’, সংলগ্ন সময়েই পেয়েছে প্রশংসার পঞ্চমুখ। একটা বিষয়, যার কাছে আকাক্সক্ষা বেশি, তার নিখুঁতত্ব খোঁজার প্রবণতাও বহুমুখী। এমনটা ঘটে কবিতা নিয়েও।
বাংলা কবিতা, আদিপর্বে, মধ্যপর্বে ছিল এক-দুটি বিষয়-নির্ভর। বলা হয়ে থাকে, কবিতার আধুনিক কাল শুরু হয়ছে মাইকেল মধুসূদনের হাতে। পয়ারই ছিল কবিতার বাহ্যিক রূপ। মানতেই হয়, মাইকেল মধুসূদন আট + ছয় মাত্রার অন্ত্যমিলবিশিষ্ট কবিতাকে ছন্দের আঁটোসাটো প্রকরণ থেকে মুক্তি দিলেন। চৌদ্দ মাত্রা রাখলেন ঠিকই, অন্ত্যমিলের বাধ্যবাধকতা ডিঙ্গিয়ে প্রবহমানতার মান্যতা এল। আমরা বলি ‘অমিত্রাক্ষর’ ছন্দ। বিষয়ে দেখা দিল বৈচিত্র্য। বিশ্বসাহিত্যের আবহ রচিত হলো মাইকেলের কাব্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা কবিতায় আপাত সহজ উচ্চারণের মধ্যে জুড়ে দিলেন ভাব, মনোচেতনার নানা তরঙ্গ, দার্শনিকতার প্রশ্ন, প্রতিপ্রশ্ন। কিছুটা বোঝা যাচ্ছে, আবার যাচ্ছেও না। ত্রিশের কবিরা ছায়াস্বচ্ছতা থেকে সরিয়ে এনে বাংলা কবিতাকে দাঁড় করালেন হিমাগ্নি, কাদা-কাঁকরের বহুবাঁক-পথে। যেতে যেতে নদী, মোহনা, বিষয়ের বহুবিধ বন-উপবন। রহস্য আছে, আছে রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা।
‘শব্দের অনেক শৌর্য’। কবিতায় এল এমনই এক রোদের প্লাবন, ছায়ার সমষ্টি থেকে মুখ তুলল কবিতার ভ্রƒণ। আসন্ন অন্ধকারে জ্বলে আলোর আশ্বাস। চতুর্দশ মাত্রার পয়ার থাকলেও অন্ত্যমিলের জবরদস্তি নেই। এসে-এসে এল মহাপয়ার। খুব অতীতে না গেলেও ক্ষতি নেই। গত একশ বছরের কবিতাকে যদি দেখি, এর বহিরঙ্গ বদলেছে, ভেতর-স্পন্দনেও এসেছে বহুমাত্রিকতা। বলা যায়, সব মিলিয়ে এই সময়-পরিধিতে কবিতা দাঁড়াতে পেরেছে সমর্থ পায়ে। এর অর্থ এই নয়, আগের কবিতা দাঁড়াতে শেখেনি। উচ্চ, তুচ্ছ―সবই হতে পারে কবিতার বিষয়। ছন্দ-প্রকরণের বৈচিত্র্য―তা-ও রয়েছে প্রবাহিত।
সব শিল্প উত্তরাধিকারজাত। কবিতাও। উৎস, মোহনা―এসবও তো নদীজীবনের অংশ। শিল্পেও এমনটি থাকে। চিরকালীনতার সঙ্গে সমকালীনতার মেশামেশিতেই উন্মুক্ত হয় নতুন শিল্পসরণি। বর্তমান বাংলা কবিতায় যারা উত্তরাধিকারজাত হয়েও সমকালীন, এঁদের তালিকায় মিনার মনসুরের নামটি যুক্ত করা যায়। সাহিত্যের সব শাখার মধ্যে কবিতাচর্চার স্রোতটিই বিপুল তরঙ্গমুখর। সব কোলাহলই অর্থবোধক হয় না। এর মধ্যে যে স্বর এবং সুরটি নিরেট, সংহত, সেটিই কানে-মনে গৃহীত হয়। আমাদের অনেক কবি। অগণিত কবিতা লেখা হয়, ছাপা হয়। বইয়ের আকৃতিও পায় বিপুল কবিতারাশি। এর মধ্যে বিশিষ্ট হয় কোনও কোনও কবি, কোনও কোনও কবিতা। বাঙালির একটা গুণ, (অনেকে এটাকে দোষ বা দুর্বলতা বলতে চান) জন্মগতভাবেই এরা আবেগপ্রবণ। এই প্রবণতা অনেক মহৎ অর্জনের পাথেয় বটে। এই আবেগ-প্রাবল্য থেকেই কবিতা লেখা। বিষয়টি বাঁকা চোখে না দেখাই ভালো। অনেকের মধ্য ‘একজন’ হয়ে ওঠায় কৃতিত্ব বেশি। আমাদের কবিরা নিশ্চয়ই বিশিষ্টতার দাবিদার। পাঠক, ভুল বুঝবেন না। আমরা কিন্তু সাহিত্যের অন্য শাখায় নিবিষ্টদের খাটো করে দেখছি না। শুধু বলতে চাচ্ছি, কবিতা চর্চাসংশ্লিষ্টদের সংখ্যা-বিপুলতার কথা। অনেকের মধ্যে ‘একজন’ হয়ে ওঠার জন্য নিশ্চয়ই কিছু আলাদা অর্জনের দরকার। কবি হিসেবে সকলের মধ্যে থেকে আলাদা হবেন বিষয়-বৈচিত্র্যে, উপস্থাপনায়, ভাষায়, ভাষা প্রয়োগ-সিদ্ধতা, ভাবুকতা, চিন্তায়, দর্শনে; সর্বোপরি এসব ক্ষেত্রে নতুনত্ব প্রচলনে। লেখালেখির প্রারম্ভিক পর্যায় থেকে মিনার মনসুরের কবিতায় এসব লক্ষণ লক্ষ করা যায়। কী প্রেমের কবিতায়, কী রাগী কবিতায় কী বিষয়বেষ্টিত কবিতায়, কী প্রতিজ্ঞার কবিতায়―এই কবির আলাদা কণ্ঠস্বরটি শনাক্ত হয়ে যায়। শুরুর দিকে এই ‘আলাদা’ কণ্ঠস্বরের বিষয়টি দূরবর্তী, অনুচ্চ, ফোঁট-ফোঁটা মনে হলেও, দিন গড়িয়েছে, লক্ষণগুলো স্পষ্ট হয়েছে। রঙের বিচিত্র রেখাগুলো মিলে-মিলে ছবি হয়ে উঠেছে। সব ছবি মূর্ত নয়, আছে বিমূর্ত ছবিধারাও।
চল্লিশ বছর আগে ১৯৮৩ সালে বেরিয়েছিল মিনার মনসুরের প্রথম কাব্য অবরুদ্ধ মানচিত্র। সকালের প্রথম সূর্য বলে দেয় দিনটি কেমন যাবে―এরকম একটি কথা প্রচলিত আছে। সেই সময়ের বাংলা কবিতার পাঠক শুনতে পেয়েছিলেন দূরাগত এক ছন্দপদধ্বনি। আগুনপুষ্পে গাঁথা একটি মালা। ক্ষমতার দম্ভ সেদিন তা সহ্য করেনি। স্বৈরাচারী শাসকরোষে মিনার মনসুরের অবরুদ্ধ মানচিত্র নিষিদ্ধ হয়। এরপর বেরিয়েছে এই কবির দেড় ডজনের বেশি কাব্য। সম্প্রতি বেরিয়েছে মিনার মনসুরের কাব্য ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম। পাঠকমনে প্রশ্ন আসতে পারে, ব্রাসেলসের কোন সন্ধ্যাটি মনোরম ছিল ? ইতিহাস-সচেতন পাঠক জানেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে উচ্চাভিলাষী, বিপথগামী কিছু সেনাসদস্য জাতির পিতা, স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করে। বিদেশে থাকায় তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন ব্রাসেলসে বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের সঙ্গে শিষ্টাচারবহির্ভূত অমানবিক আচরণ করে। সেই দূতাবাসের যিনি ‘মাথা’, তিনি কবিতা লেখেন। ভাবা যায় না একজন কবিতা লেখক দুই অসহায় মহিলার সঙ্গে এমন অমানবিক আচরণ কী করে করতে পারল! মিনার মনসুর তাঁর সাম্প্রতিক কাব্যের নাম রেখেছেন, ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম। অমানবিকতার চরম সময়টিকে কবি কেন বলছেন ‘মনোরম’! এর উত্তর পেতে গ্রন্থের নাম কবিতাটি পাঠ করা যেতে পারে―ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম। নিখুঁত। মান্যবর রাষ্ট্রদূত কবিতার মতোই সযত্নে নির্মাণ করেছিলেন সেই সন্ধ্যাটিকে। কেননা কিঞ্চিৎ কবিখ্যাতি ছিল তার। দুর্লভ এক ফুলদানির মতোই সবার নজর কাড়ছিল তার ডিম্বাকৃতি সুকুমল অবয়ব। সেখানে খেলা করছিল ভক্তি, আনুগত্য, পেশাদারিত্ব আর পলাশি প্রান্তরের বিচিত্র সব আলো-অন্ধকার।
‘মনোরম’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ১. মনোহর, মনোরঞ্জক ২. সুন্দর, রমণীয়। শব্দটি বিশেষণ এবং ইতিবাচক। যে সন্ধ্যাটি ছিল বেদনাবিধুর, অমানবিকতায় আচ্ছন্ন, অথচ কবি বলছেন ‘মনোরম’! শব্দের স্থিরীকৃত যে অর্থ, প্রয়োজনে এর প্রয়োগে ভিন্ন, এমন কি বিপরীত অর্থেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। কবির পক্ষে এ-কাজটি করা সম্ভব। বলা যায়, মিনার মনসুর কবিতায় ‘মনোরম’ শব্দটি উল্টো অর্থব্যঞ্জনায় ব্যবহার করেছেন। দ্বিতীয় বিষয়টি, এমন হতে পারে, যারা একটি স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপতিকে হত্যার পর, তাঁর দুই কন্যার বিষাদ-রোদন অগ্রাহ্য করে, দখলিকৃত ক্ষমতার কাছে ক্রীতদাসীয় আনুগত্য প্রকাশের সময়টা তো তাদের কাছে ‘মনোরম’ই। ওখানে তখন ‘পলাশি প্রান্তরের বিচিত্র সব আলো-অন্ধকার’ খেলা করছিল। তৃতীয় বিষয়টি, হতে পারে, চরম ‘স্যাটায়ার’ করতে গিয়ে কবি অমানবিক সময়টাকে ‘মনোরম’ বলেছেন। অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য দেখাতে অনেক সময় ভীষণ মন্দটাকেও ‘ভালো! ভালো!’ বলে উড়িয়ে দেওয়া হয়।
দুই
মানুষ কত রকম জীবনই-না পেয়ে থাকে। বিশেষ করে কবি-জীবন নানা রকম হয়ে থাকে, কেউ পায় শান্ত আর সমতল জীবন। সে-জীবনে চলায় বাঁক থাকলেও থাকে না অস্থির উন্মাদনা। কারও জীবন হয় নাটকীয়তাপূর্ণ। কারও কারও হয় বাণবিদ্ধ তীক্ষèকরুণ। কারও জীবন মরুময়তার রুক্ষতায় ভরা। হেঁয়ালি, দ্বন্দ্বপীড়িত, আত্মপীড়নের জীবনও কারও ভাগ্যলিপি হয়ে দাঁড়ায়। এমনও তো দেখা যায়, কেউ হয়ে পড়েছেন সময়নিয়ন্ত্রিত। উপায় থাকে না।
আমরা কী দেখলাম মিনার মনসুরের কবি হয়ে ওঠার সময়-স্বরূপ! তার একটি কাব্য সংকলনের ফ্ল্যাপ থেকে আমরা জানতে পারি, তার কাব্যভুবনের আবির্ভাব ঘটেছিল এক অস্থির টালমাটাল সময়ে। (উদ্ধৃতি) ‘সেই সময় ধারণ করছে একটি নতুন ভূখণ্ডের অভ্যুদয়ের অভূতপূর্ব ইতিহাস ও আবেগকে; আকাশচুম্বী আশা ও আশাভঙ্গের বিপুল বেদনাকে। বিশেষ করে পঁচাত্তরের কালরাত্রির কাপুরুষোচিত বীভৎসতা তাড়িয়ে বেড়ায় নিরন্তর। দুর্বিনীত বুটের গর্জনতাড়িত শ্বাপদসংকুল, জটিল ও শ্বাসরুদ্ধ সেই সময়ে কবি মিনার মনসুর তাঁর সৃষ্টিশীলতার ভেলা ভাসালেন কাব্যের আগুননদীতে।’ যা স্বাভাবিক, তা-ই হয়েছে। মিনার মনসুরের সেই সময়ের কবিতা হয়েছে কিছুটা উচ্চকণ্ঠ, ঝাঁঝালো, উত্তপ্ত। ‘ব্যর্থতা, অপেক্ষা আর যন্ত্রণার ভারে/ আমার পূর্ণতা―’। এ হলো সময়ের বিশ্বস্ত নিরেট চিত্র। ব্যর্থতা আর যন্ত্রণার মধ্যেও ‘অপেক্ষা’টি তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন।
কবিতাই কবিতার শত্রু। সেটি কেমন ? একজন প্রকৃত কবি নিজেই তার একটি কবিতাকে পরবর্তী কবিতার সামনে দাঁড় করিয় দেন। এখানে অতিক্রমটাই জরুরি। সত্যটি হলো, অনেক প্রতিভাবান কবিকে দেখা গেছে সারা জীবন একই ধরনের কবিতা লিখে গেছেন, বাঁকবদল নেই, নিজেকে অতিক্রম নেই। কোনও জল-স্থানের জল যতই স্বচ্ছ হোক, কিন্তু তরঙ্গ নেই। সেই জলে প্রবাহের সৌন্দর্য থকে না।
মিনার মনসুরের প্রথম কাব্য এই অবরুদ্ধ মানচিত্র এবং সাম্প্রতিক কাব্য ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম-এর মধ্যে যদি সংযোগরেখা টানা যায়, কবিতার অন্তর্গত আর বহিরঙ্গের চলিষ্ণুতাটা মনস্ক পাঠক নিশ্চয়ই আঁচ করতে পারবেন। বিষয়বৈচিত্র্য এবং বাকভঙ্গির রকমফেরটাও সহজে শনাক্ত করা যাবে।
অভ্যাসের আনন্দে আমরা একটা কথা প্রায়ই বলি, ‘অমুক হচ্ছেন প্রেম ও দ্রোহের কবি’। মিনার মনসুরের বেলায়ও এ কথাটি বলা হয়ে থাকে। নিরেট প্রেম বা দ্রোহের কবিতা বলে কি কিছু আছে! আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বলা হয় ‘বিদ্রোহী কবি’। বিদ্রোহ-উচ্চারিত অনেক কবিতা তিনি লিখেছেন। বিশেষ করে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বিদ্রোহী’র সুবাদে কাজী নজরুল ইসলামের নামের আগে স্থায়ী হয়ে বসে গেছে ‘বিদ্রোহী’ অভিধাটি। অথচ এই কবিতারই বহু চরণে রয়েছে প্রেমের অমিয় উচ্চারণ। ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরি, আর হাতে রণ-তূর্য!’ এখানে শতভাগ বিদ্রোহ কোথায়, কোথায় শতভাগ প্রেম! অর্ধেক প্রেম, অর্ধেক বিদ্রোহ। মিনার মনসুরের কবিতা থেকে দুটি উদাহরণ দিই। ১. ‘ব্যর্থতার আধখানা জুড়ে আছে রমণীর প্রেম’ এবং ‘রমণীর বিষণ্নতা এখানে যুদ্ধের নৃশংস প্রস্তুতি আনে…’। (এ কেমন ঝুলে আছে)। এটিকে কবি কিন্তু ‘দ্রোহের কবিতা’র দলভুক্ত করেছেন। ২. ‘আমাকে যে নত হতে বলো―/ আমি আর কত নত হবো!/ জন্ম থেকে আভূমি নত হয়ে আছি;/ নত/ হতে/ হতে/ হতে/ মৃত্তিকার সঙ্গে মিশে গেছি।/ এতোখানি নত হলে ফের কী করে দাঁড়াবো বলো! / আমাকে যে দাঁড়াতেই হবে।’ এই উদ্ধৃতাংশের কবিতাটিকে (দাঁড়াতেই হবে) মিনার মনসুর কিন্তু প্রেমের কবিতা বলছেন। প্রেমের কবিতায় দ্রোহচেতনা এবং দোহের কবিতায় প্রেমচেতনা মিনার মনসুরের কবিতার একটি বৈশিষ্ট্যও বটে।
তিন
ছন্দ হচ্ছে কবিতার আত্মা। অনেকে পয়ারের অন্ত্যমিলকেই ছন্দ ভেবে থাকেন। বিষয়টি তা নয়। আলংকারিকরা বাংলা কবিতার যে ছন্দের কথা বলেছেন এগুলো মান্য করেই বাংলা ভাষায় মহৎ ও কালজয়ী কবিতা লেখা হয়েছে, হচ্ছেও। এরপরও, সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা কবিতার অন্যান্য উপাচার-অনুষঙ্গের মতো ছন্দেও বিবর্তন এসেছে, এটি চলমান থাকবে। মিনার মনসুর ছন্দসচেতন কবি। প্রচলিত ছন্দে কবিতা লিখেছেন, ছন্দের আঁটোসাঁটো রেখা অতিক্রমের চেষ্টাও তার কবিতাকাজে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। তার ছন্দমান্যতার উদাহরণ দিই―‘আমি এখন ব্যর্থ মানুষ/ একলা মানুষ/ এই শহরে একা একা ঘুরছি কেবল/ ঘুরছি কেবল ব্যর্থতারই গোলক-ধাঁধায়।’ (আমি কি আর মানুষ আছি)। এটি স্বরবৃত্ত ছন্দ।
অন্ত্যমিলে ১৪ মাত্রা পয়ারের উদাহরণ―‘শুয়ে আছে দীর্ঘশ্বাস। মাটিও বিব্রত/ হাড়-মাংস গিয়েছিল খসে ঢের আগে/ তাচ্ছিল্যে-বিদ্রƒপে; তবু সতত জাগ্রত।/ ব্যাকুল হৃদয় ছিল পূর্ণ অনুরাগে।’ (শুয়ে আছে দীর্ঘশ্বাস)। এবার মাত্রাবৃত্ত ছন্দের ৪+৪ মাত্রার চাল―‘তুমি নেই আমি আছি/ কানামাছি কানামাছি/ ছিলে বড় কাছাকাছি―/ কানামাছি কানামাছি।/ ছিলে নাকি কাছাকাছি?/ কানামাছি কানামাছি।/ হৃদয়ের নাচানাচি/ কানামাছি কানামাছি।/ ভালোবাসি ভালোবাসি/ কানামাছি কানামাছি।’… (কানামাছি কানামাছি)।
প্রচলিত বাংলা তিন ছন্দে মিনার মনসুর অনেক কবিতা লিখেছেন। তবে অক্ষরবৃত্তে তিনি সহজ দক্ষতায় লিখেছেন বিপুল কবিতারাশি। সমপর্ব, অসমপর্ব―অক্ষরবৃত্তের নানা কাজ আছে তার কবিতায়। লেখা শুরুর প্রাথমিক পর্যায়েই ‘গদ্যকবিতা’ বা ‘টানা গদ্যের কবিতা’ লেখার প্রতি মিনার মনসুরের বিশেষ ঝোঁক লক্ষ করা যায়। পরবর্তী ক্রমে এই প্রবণতা বেগবান হয়েছে, বিপুলসংখ্যক হয়েছে।
গদ্য কবিতা লেখার একটা ধারা প্রচলিত আছে। কোনও কোনও ছন্দ-গবেষক বাইবেলের ‘সলোমনের গান’কেই গদ্যছন্দের আদি নিদর্শন বলেছেন। সংস্কৃত সাহিত্যেও এমন ধারার সন্ধান পাওয়া যায়। বলা হতো ‘বৃত্তগন্ধি’ রচনা। কবি অরুণ মিত্রের মতে, ফরাসী কবি আলোয়াজিয়ুযস বেরেত্রাঁ (১৮০৭-১৮৪১) হচ্ছেন আধুনিক গদ্যকবিতার জনক। অনেকে মনে করেন, আধুনিক যুগে ওয়াল্ট হুইটম্যান (১৮১৯-১৮৯২) প্রথম গদ্যকবিতা লেখেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ওয়াল্ট হুইটম্যানের আদর্শই অনুসরণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে গীতাঞ্জলি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, গদ্যভাষ্যে। সেটি বিদগ্ধ মহলে ‘অনুবাদ কাব্য’ হিসেবেই সমাদৃত হয়েছিল। সেই সময়ই কবির মনে একটা চিন্তা উঁকি দেয়, পদ্য ছন্দের ঝংকার না-রেখে ইংরেজির মতো বাংলা গদ্যে কবিতার রস দেওয়া যায় কিনা। শুরু করলেন এমন ধারার লেখা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসব কবিতার নাম দিলেন ‘রিদমিক প্রোজ’।
তাঁর ভাষায়―‘কাব্যভাষার একটা ওজন আছে, সংযম আছে; তাকেই বলে ছন্দ। গদ্যের বাছবিচার নেই। সে চলে বুক ফুলিয়ে। সেই জন্যেই রাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি প্রাত্যহিক ব্যাপারে প্রাঞ্জল গদ্য লেখা চলতে পারে। কিছু গদ্যকে কাব্যের প্রবর্তনায় শিল্পিত করা যায়। তখন সেই কাব্যের গতিতে এমন কিছু প্রকাশ পায় যা গদ্যের প্রাত্যহিক ব্যবহারের অতীত। গদ্য বলেই এর ভিতরে অতিমাধুর্য-অতিলালিত্যের মাদকতা থাকতে পারে না। কেবল কঠিন মিলে একটা সংযত রীতির আপনাআপনি উদ্ভব হয়। নটীর নাচে শিক্ষিতপটু অলংকৃত পদক্ষেপ। অপর পক্ষে, ভালো চলে এমন কোনও তরুণীর চলনে ওজন-রক্ষার একটি স্বাভাবিক নিয়ম আছে। এই সহজ সুন্দর চলার ভঙ্গিতে একটা অশিক্ষিত ছন্দ আছে, যে ছন্দ তার রক্তের মধ্যে, যে ছন্দ দেহে। গদ্যকাব্যের চলন হল সেইরকম―অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল গতি নয়, সংযত পদক্ষেপ।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গদ্যছন্দে বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। মূলত তাঁর হাত ধরেই বাংলা কবিতায় ‘গদ্যছন্দ’ পথচলা শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যছন্দে লেখা একটি কবিতার অংশবিশেষ উদ্ধৃত করছি―‘নাম তার কমলা।/ দেখেছি তার খাতার উপর লেখা―/ সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।/ আমি ছিলাম পিছনের বেঞ্চিতে।/ মুখের এক পাশে নিটোল রেখাটি দেখা যায়,/ আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নিচে। কোলে তার ছিল বই আর খাতা।/ যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।’ (ক্যামেলিয়া)
রবীন্দ্রপরবর্তী সময়ে, তিন, চার, পাঁচ এবং ছয়ের দশকে প্রধান কবিদের অনেকে গদ্যকবিতা লিখেছেন। সেই ধারা যথেষ্ট বেগবান হয়ে অব্যাহত রয়েছে। মহাপয়ারের জাদুকর, জীবনানন্দ দাশের রয়েছে কিছু গদ্যকবিতা। যেমন― ‘হাওয়ার রাত’, ‘আমি যদি হতাম’, ‘নগ্ন নির্জন হাত’ ইত্যাদি। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়―এঁরাও গদ্যকবিতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। ছয় দশকের কবি সিকদার আমিনুল হকের গদ্যকবিতার সংখ্যা অনেক। তাঁর একাধিক গদ্যকবিতা বই রয়েছে। কবি বলতেন ‘টানা গদ্যের কবিতা’। সিকদার আমিনুল হকের প্রথম কাব্য দূরের কার্ণিশ-এ কয়েকটি গদ্যকবিতা আছে। পরবর্তী সময়ে তিনি হাত খুলে গদ্যকবিতা লিখছেন। সাতের দশকে মিনার মনসুর প্রথাগত ছন্দের পাশাপাশি গদ্যকবিতা লিখে যাচ্ছেন।
চার
মিনার মনসুরের সাম্প্রতিক কাব্য ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম গদ্যকবিতাবহুল। এই গ্রন্থে কবিতা আছে ৪৫টি। ব্যতিক্রম করে গোনা, বাকিগুলো টানা গদ্যে লেখা। সময়ের বিভিন্ন তরঙ্গ, অভিঘাত, প্রত্যাশা এবং পরিণতি ভাষা পেয়েছে এ গ্রন্থের কবিতারাশিতে। জলস্থানের সব ঢেউ, সব সময় একই স্পন্দনে চলে না। উঁচু নিচু হয়, শব্দ হয়―কখনও সুরাশ্রিত কখনও সুরবিমুখ। মিনার মনসুর তাঁর কবিতায়, সবই বাক্যবেষ্টিত করেন, ছন্দের সুডৌল আবহে হয়ে ওঠে গূঢ়-অর্থক, মুগ্ধতা-স্পর্শক। ‘ঘোড়াটি ঘামছিল। ভাদ্রের চাবুক―যদিও দৃশ্যমান নয় তার তীব্র দংশন, তবু তার অজস্র ক্ষত থেকে ঝরে পড়া রক্তস্রোত তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল কুরুক্ষেত্র ভয়াল স্মৃতি। এখানেই যতিচিহ্ন টানা গেলে একটি গতি হলেও হতে পারতো ত্রিশঙ্কু বাবুর। হয়তো এ যাত্রায় বেঁচে যেতেন জীবনানন্দ দাশ।’ উদ্ধৃত কবিতাংশে কবি দাঁড়িয়েছেন একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে। পাঠককে উৎসাহিত করছেন তার চেতনার স্তরটিকে আরও প্রসারিত করতে, ঘটনার পেছনের যুগপৎ সামনের আসন্ন ঘটনার দিকে সহজ করে তাকাতে। কেন ঘোড়াটি ঘামছিল ? শব্দদৃশ্যে ত্রিশঙ্কু বাবু, জীবনানন্দ দাশ কেন এলেন ? প্রেক্ষাপট হল কুরুক্ষেত্র। মাঝপথে যতিচিহ্ন টানা যায়নি। বলা যায়, কবি তা টানেননি, ইচ্ছাকৃত। যদি যতিচিহ্ন এসে যায়, তাহলে তো পাঠকের ভাবনাকাজ ফুরিয়ে যাবে।
পাঠককে দাঁড়িয়ে রাখার এমন কারুকাজ কবি তাঁর প্রায় সব কবিতায়, স্তবকে স্তবকে করেছেন। কুশলি কবির কাজ তো তা-ই―পাঠককে প্রশ্ন, অপেক্ষা ও অন্বেষণে ব্যাপ্ত আর ব্যস্ত রাখা। কবিতার শব্দের ভিতর যে শক্তি, থাকে যে সৌন্দর্য, এটি কবি চিহ্নত করবেন, পাঠক সেগুলো আবিষ্কার করেন। শব্দ শুধু অক্ষর বা অক্ষরের সমষ্টি নয়। শব্দ দেখে, পাঠ করে এবং উপলব্ধির সৌন্দর্যের মধ্যে কবিতাকে কাছে পেতে হয়। মিনার মনসুরের কবিতায় শব্দ হয়ে ওঠে বহুঅর্থক। এটা সম্ভব হয় কবির বহুমাত্রিক পর্যবেক্ষণদক্ষতা, প্রয়োগের ঔচিত্য এবং দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। এই কবির কবিতায় প্রচলন, আভিধানিক বেষ্টনী থেকে মুক্তি পেয়ে শব্দ সাজে নতুন আবরণে, আভরণে। প্রায় সব কবিতা থেকে এমন উদাহরণ দাঁড় করানো যাবে।
দেশ, বঙ্গবন্ধু, দেশজনতার আকাক্সক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উদার মানবিক মূল্যবোধ―এ সব মিনার মনসুরের প্রতিটি কাব্যে শনাক্ত করা যায়। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপস্থিতি লক্ষ করা যায় অনেক কবিতায়। শোক, রোদন ইত্যাদি উজিয়ে মিনার মনসুর বঙ্গবন্ধু-বিষয়টিকে তার সাম্প্রতিক কবিতায় মহান নেতার আদর্শিক অবস্থানটাই মুখ্য করে তুলেছেন এবং এটাই প্রত্যাশিত। মিনার মনসুর যখন উচ্চারণ করেন, ‘একটি তর্জনী―কেবল একটি তর্জনী―তখন গর্জন করে উঠেছিল। আর তাতেই বদলে গিয়েছিল আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস।’ এখানে শোক নেই, আছে শৌর্যের বয়ান।
মিনার মনসুরের কবিতায় প্রতীকের প্রবাহ, সংকেত, দর্শন-ভাবুকতা, যুক্তির স্বচ্ছতার সঙ্গে যুক্ত থাকে শ্রুতিসিদ্ধ দৃঢ় ও কোমল উচ্চারণ, ছন্দপ্রবাহ। যোগ্য কবিতার জন্য এগুলো খুব আবশ্যক।
লেখক : কবি