লিটল ম্যাগ
উলুখাগড়া সাহিত্য-সংস্কৃতিরবিষয়ক একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা। দীর্ঘ ১ বছর বিরতি দিয়ে ৩৫ তম সংখ্যা হিসেবে এপ্রিল-জুন ২০২১ বেরিয়েছে। কৈফিয়ত হিসেবে সম্পাদক সিরাজ সালেকীন পত্রিকার শুরুতেই জানিয়েছেন―‘এক বছরের ব্যবধানে প্রকাশিত হল উলুখাগড়ার বর্তমান সংখ্যাটি। পাল্টে গেল আগের পরিকল্পনা। এই বিপত্তির মূল কারণ কোভিড-১৯। দুর্যোগের কিছুটা দাগ রয়ে গেল “স্মরণ” হিসেবে।’ নিশ্চয়ই আমরা কোভিড-১৯ এর মতো মরণঘাতী অতিমারির কথা শত বছর পরেও ভূগোলে বসবাসকারীরা কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ নিয়ে স্মরণ করব। বিশেষ মডেলিংয়ের মাধ্যমে ইকোনমিস্ট-এর করা হিসাব অনুযায়ী পৃথিবীতে এ পর্যন্ত এই কোভিড-১৯-এ অকালে ঝরে গেছে ৬৮ লাখের অধিক মানুষ (বিবিসি বাংলা : ৬ মার্চ ২০২৩)। এর পরেও অনেকে মারা গেছেন। এবং এখনও মারা যাচ্ছেন। সেই করোনা সময়ের আগে পরে আমরা যাঁদের হারিয়েছি সেই বিশিষ্টজনদের স্মরণ করার মানসে উলুখাগড়া এ সংখ্যাটির মূল উপজীব্য বিষয় হিসেবে ধরে নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে।
‘স্মরণ’ এ সংখ্যাটিতে মুর্তজা বশীরকে নিয়ে দুটি লেখা রয়েছে―একটি লিখেছেন জাহিদ রেজা নূর। শিরোনাম করেছেন―‘মৃত্যুর পর বেঁচে থাকা খুব কঠিন। সবাই বাঁচে না : মুর্তজা বশীর।’ এই শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় মুর্তজা বশীর মৃত্যুর পরও বেঁচে আছেন। জাহিদ রেজা নূর লিখেছেন―‘তিনি কথা বলেন খুবই দ্রুত। কণ্ঠস্বর দৃঢ় ও সাহসী। যে কোনও বিষয়ে আড্ডার গভীরতায় ঢুকে পড়তে পারেন অনায়াসে। অনর্গল বলে যাওয়া কথা কখনও প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে যায়, কিন্তু সবটা জুড়ে যা থাকে, তা হলো কম্পমান যৌবন। হ্যাঁ, এ কথাটা আমি খুব ভেবেচিন্তে বললাম। যে কজন বর্ষীয়ান মানুষের সঙ্গে এ পর্যন্ত আমার যোগাযোগ হয়েছে, আলাপ হয়েছে, তাঁদের মধ্যে মুর্তজা বশীরের [১৯৩২-২০২০] তেজোদীপ্ত যৌবনকে আমি আলাদা করতে পেরেছি। অন্যদের নানা বিষয় আমাকে আকৃষ্ট করেছে, কিন্তু এই যৌবন এত প্রবলভাবে আর কারও মধ্যে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
আমার সঙ্গে কথা হতো সামনাসামনি কিংবা টেলিফোনে। বিভিন্ন সময় তিনি এমন সব কথা বলেছেন, যা ধরে রাখতে পেরেছি বলে ভালো লাগছে। প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেও একটা সূত্র ধরেই চলেন তিনি। টক দই খাওয়ার উপকারিতার কথা বলতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়ার প্রসঙ্গ আসে যখন, তখন ভাতপোলাও, কুমড়া সøাইস না বেগুন সøাইস, বিদেশে স্প্যাগেটি খেয়ে থাকাসহ নানা কথা বলতে বলতেই চলে আসেন অমরত্ব প্রসঙ্গে। বাঁচতে চান প্রবলভাবে, কিন্তু সুস্থ শরীরে।’…কথা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেছেন―‘এ প্রজন্মের শিল্পীদের নিয়ে যা বলব, তা ওদের পছন্দ হবে না। টোটালি অবক্ষয়। পচে গেছে। তাদের মধ্যে কোনও মনুষ্যত্ব নেই। তাহলে দেশ এগোবে কীভাবে ? শুধু আমি বলব, আমি যেটা চেষ্টা করছি, আমার জীবনে একজন সৎ মানুষ এবং দেশপ্রেমিক।…যে কোনও ব্যক্তির ভেতরে কিন্তু আকাক্সক্ষা থাকতে হয়। আমি যখন চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে মাস্টারি করতাম, ছাত্রদের আমি দুটো কথা বলতাম। একটা কথা বলতাম, জীবন একবার, তুমি যে পৃথিবীতে এসেছিলে, ওটার চিহ্ন রেখে যাও।’ এভাবেই কথোপকথনের মধ্য দিয়ে আমরা শিল্পী মুর্তজা বশীরকে, একজন দেশপ্রেমিক মানুষের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে পারি। দীর্ঘ এ স্মৃতিচারণমূলক চমৎকার লেখাটিতে আমরা তাঁকে নানাভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতে পারব।
অপর লেখাটি লিখেছেন―দীপ্তি দত্ত, শিরোনাম করেছেন―‘ভাষা আন্দোলন ও শিল্পী মুর্তজা বশীর’। ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মুর্তজা বশীর প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। এই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার একটা অনুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যায় ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলন থেকে। নিজের অভিজ্ঞতা পরোক্ষভাবে গল্পের ছলে ‘একটি বেওয়ারিশ ডায়েরীর কয়েকটি পাতা’ শিরোনামে তিনি লিপিবদ্ধ করেন, যা এই সংকলনে স্থান পায়। গল্প না বাস্তব অভিজ্ঞতা এই নিয়ে কিছুটা দ্বিধা তারপরেও থেকে যায় দূরবর্তী সময়ের পাঠকের মধ্যে। দ্বিধার অবসান ঘটে অনেক পরে স্বাধীন দেশে এই ডায়েরির লেখা বিষয়ে অন্য একটি লেখায় তাঁর স্মৃতিচারণটি পাঠ করার পর : ‘তখন এই একুশে ফেব্রুয়ারী বইতে আমি কয়েকটি পাতা ভরে একটি লেখা লিখি, যাতে লেখা ২০ তারিখ, ২১ তারিখ এবং ২২ তারিখের আংশিক ঘটনা। তবে এখানে যা আমি লিখি তা একজন লেখকের সঙ্গে কল্পনা ছিল না। পুরোপুরি যা দেখেছি, যা শুনেছি―শব্দনিষ্ঠভাবেই সেগুলো লিখেছি।’… ‘একটি বেওয়ারিশ ডায়েরীর কয়েকটি পাতা’ লেখায় মুর্র্তজা বশীর কোনও লুকাছাপার আশ্রয় নেননি। ডায়েরিতে তিনটি দিনের উল্লেখ আছে। ১৯৫২ সালের ২০, ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি। তিনি ডায়েরিতে ২০ ফেব্রুয়ারি লেখেন : ‘কিছুক্ষণ আগে এ রাস্তাটার ওপর দিয়ে ছাত্ররা ঘোড়ার গাড়ী করে আগামীকালের হরতালের কথা জানিয়ে গেছে। ঘোষণার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতে সরকারী ভ্যানযোগে একশো চুয়াল্লিশ ধারা জারির ঘোষণা প্রতিটি লোককে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এ আচ্ছন্নতা আমারও এসেছে।’ ডায়েরির তথ্যমতে, ২১ তারিখ তিনি বিশ^বিদ্যালয়ের মাঠে আগে থেকেই উপস্থিত হন। সেখানে তিনি ১৪৪ ধারা ভেঙে অ্যাসেম্বলি যাওয়ার সিদ্ধান্তটি বয়ান করতে করতে নিজের দ্বিধার বিবরণ দেন। এই বিবরণ অকপট ও সাহসী এবং আত্মসমালোচনামূলক। এই বয়ান মুর্তজা বশীর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সমসাময়িক সময়ে বসেই দিচ্ছেন। তিনি লিখেছেন : ‘মিছিলের এক পাশে দাঁড়িয়ে ভেবেছি কি করব ? আমিও কি এ মিছিলে সরিক হবো ? যদি কিছু হয় ? সামনে ফালগুন…। তারপরেই পুলিশ, টিয়ার গ্যাস আর ছাত্রদের পারস্পরিক বন্ধুত্ব দেখতে দেখতে তিনি ভাবেন : সূর্য আজ কি আগুন ছড়াচ্ছে ? সবার শিরায়, স্নায়ুতে রক্তে ? ভাবছি কি করব। আমি কি করব। আজ আমাদের শিল্প প্রদর্শনী, আমার ছবি তাতে। বহু দিনের প্রত্যাশিত দিন আজ, শুধু আজ।’ আবুল মনসুর মুর্তজা বশীরের এক বছরের সিনিয়র শিল্পী আমিনুল ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন―‘তিনি মূলত ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি, তা তাঁর লেখা থেকেই জানা যায়। তবে তিনি ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতাদের একজন ছিলেন। এ বিষয়ে কোথাও দ্বিমত পাওয়া যায় না।’
দীপ্তি দত্তের লেখার ভেতর দিয়ে পাঠক অনেক সত্যের মুখোমুখি হতে পেরেছেন। এখানে রক্তাক্ত ২১শে শিরোনামে মুর্তজা বশীরের লিনোকাটে করা প্রথম কাজ ও দ্বিতীয় কাজ হিসেবে ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনে মুদ্রিত বেশ কিছু রেখাঙ্কন মুদ্রিত হয়। দীপ্তি দত্তর শিল্পী মুর্তজা বশীরকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক লেখায় অনেক তথ্যবহুল ঘটনা, ভাষা আন্দোলনের ঘটনায় ছাত্র মিছিল, ১৪৪ ধারা, শিল্পীদের সেদিন একটি চিত্র প্রদর্শনীর বিষয় সব দিক তুলে ধরেছেন। মুর্তজা বশীরকে নিয়ে দুজনের ভিন্নধর্মী দুটি লেখা পাঠককে অনেক তথ্য পেতে সহায়তা করবে।
রাবেয়া খাতুনকে নিয়ে মো. আব্দুর রশীদ লিখেছেন―‘রাবেয়া খাতুনের গল্প সমগ্র : লেখক মনের বিচিত্র রং’ শিরোনামে। রাবেয়া খাতুন [১৯৩৫-২০২১] কর্মময় জীবনে শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁকে নিয়ে মো. আব্দুর রশীদ স্মৃতিচারণমূলক লেখায় লিখেছেন―‘ বৈচিত্র্যময় কর্মজীবন তাঁর লেখাকে করে তুলেছে বিচিত্রধর্মী। স্মরণীয় বাংলা সাহিত্যে তিনি নারী লেখক নন―একজন লেখক হিসেবে নিজের আসন তৈরি করেছেন। রাবেয়া খাতুনের রচনাকর্মের মধ্যে কোনো মেয়েলিপনা নেই এক আশ্চর্য ব্যতিক্রম।’ বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দৈশিক-ভাবনা সাহিত্য-রচনার ক্ষেত্রে আরও দৃঢ়রূপ পেয়েছে এবং বাঙালি-জীবনের সঙ্গে অনিবার্য সম্পর্কসূত্রে তিনি এ দেশের মনুষ্য জীবনের প্রতিরূপ হিসেবে চিহ্নিত। সাহিত্য-স্বীকৃতি হিসেবে অর্জন করেছেন একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।
রাবেয়া খাতুনের বিচিত্রমুখী রচনার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে বিস্মিত হতে হয়। তিনি অফিস করার মতো রুটিন করে লেখার কাজটি বহমান রেখেছিলেন; এমন নিষ্ঠা বাঙালি লেখকদের মধ্যে বেশ দুর্লভ। …সবক্ষেত্রে নিজস্ব জীবনোপলব্ধি ও কল্পনাশক্তি প্রবল থাকার সূত্রে তাঁর সাহিত্যসম্ভার বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত- মানসের প্রকৃত স্বরূপকে পাঠকের অনুভবের সীমারেখায় এনে দেয়। সবকিছু পিছনে সরিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে আজ বিচিত্রমুখী লেখক হিসেবে পরিচিত। শিশুতোষ সাহিত্য, ভ্রমণকাহিনি, গবেষণামূলক গ্রন্থ, স্মৃতিকথা, উপন্যাস রচনার পাশাপাশি তিনি ছোটগল্প রচনাতেও অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। দীর্ঘ ৫০ বছরের সাহিত্য-জীবনে রাবেয়া খাতুন লিখেছেন এক হাজারের অধিক ছোটগল্প।
বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে রাবেয়া খাতুনের সাহিত্যসম্ভার স্ববৈশিষ্ট্যে আলোকিত। এদেশের পরিবেশ- পরিপ্রেক্ষিত, প্রেম-বিরহ, ইতিহাস- ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ, পারিবারিক ভাঙন, সমাজ-চেতনা প্রভৃতি বহুমাত্রিকতায় উপস্থাপিত। গল্পের কাহিনি বর্ণনা, ঘটনার-ঘনঘটা-বিবৃতি উপস্থাপনে, চরিত্রায়ণ কৌশলে লেখক তাঁর স্বভাবসুলভ সংযম বজায় রেখেছেন। তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মের বিষয়ভাবনা, ভাষা-ব্যবহার, পরিচর্যার উপকরণ সর্বত্রই দেশীয় সমাজবীক্ষণের পরিচয় দিয়েছেন।… দীর্ঘকালব্যাপী সক্রিয় ও নিমগ্নতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ধারাটি বহন করে চলেছেন; এ কারণেই তাঁর সাহিত্যিক অবদান তাৎপর্যপূর্ণ এবং বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। অনিন্দ্যসুন্দর একটি আলোচনা পাঠককে মুগ্ধ করবে। এ আলোচনায় আলোচক রাবেয়া খাতুনের সাহিত্য নিয়ে কর্মের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন। ব্যাপক বিস্তৃতভাবে তাঁকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে নিয়ে দুটি লেখা রয়েছে। একটি লিখেছেন― পিয়াস মজিদ। শিরোনাম করেছেন― ‘বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের উপন্যাস-স্বাতন্ত্র্য’। অপর লেখাটি ‘বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ছোটগল্প’ শিরোনামে লিখেছেন―উষা গওহর।
পিয়াস মজিদ লিখেছেন―‘বহুমাত্রিক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের [১৯৩৬-২০২০] উপন্যাসও যে মাত্রারহিত হবে না, তা বলাই বাহুল্য। চারটি উপন্যাসের প্রণেতা তিনি, আমাদের আলোচ্য বাংলা ১৩৮১-তে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস সর্বনাশ চতুর্দিকে আর ফেব্রুয়ারি ২০০৩-এ প্রকাশিত দ্বিতীয় উপন্যাস মহাকাব্য। প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পূর্বে বেরিয়ে গেছে তাঁর খ্যাতনামা গল্পগ্রন্থ-চতুষ্টয় মুণ্ডহীন মহারাজ, বিশাল ক্রোধ, দূরদূরান্ত এবং অবিচ্ছিন্ন। সুতরাং তাঁর ঔপন্যাসিক অভিযাত্রাকে শৌখিন চর্চা ভাবার সুযোগ নেই বরং বলতে পারি এ তাঁর সচেতন শিল্পপ্রসূন।’
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, যিনি বাংলাদেশের গ্রাম বইয়েরও লেখক, তাঁর চেয়ে ভালো কে জানেন গ্রামীণ কাঠামো, খেতের গন্ধ, রাস্তার রূপ আর পথের আপদবিপদ। ‘ছত্রাকগঞ্জ থেকে জামতলায়, নিজেদের বাড়ি ফেরার পর, প্রায়ই একটা স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নটা এমন : শেয়ালের গর্ত থেকে সাদেক আলীরা বেরিয়ে আসছে। সাপের গর্ত থেকে সাদেক আলীরা বেরিয়ে আসছে। কুমিরের পা থেকে সাদেক আলীরা বেরিয়ে আসছে।’ স্বাধীনতার শত্রুদের সঙ্গে যোগ হয় মুক্তিকামী শিক্ষিত মানস আর নিম্নবর্গের মানুষের ব্যবধানের স্পর্শকাতর বিষয়। মালোপাড়ার মানুষেরা যারা একে তো হিন্দু, তার উপর গরিব। ধর্ম ও শ্রেণিগত দুই দিক দিয়েই তাদের ওপর খড়গ যা মুক্তিযুদ্ধ-মহাকাব্যেও বড় এক প্রপঞ্চ। আবার শত্রু অধিকৃত স্বদেশে জাতীয়তাবাদী ও সমাজতন্ত্রীদের অবস্থানও বর্ণনা করা হয়েছে, এসেছে গেরিলাযুদ্ধোত্তর ‘মুক্তাঞ্চল’ প্রসঙ্গও।
বিশ^াসের ভিতের উপর দাঁড়িয়েই দেশটা স্বাধীন হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধ মহাকাব্য লেখা হতে থাকে। মুক্তি আর স্বাধীনতার কোনও অলীক মহার্ঘ্যতা দান করান না বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, বরং মার চোখের পানি, কাছারি ঘর থেকে বাবার দেওয়া এশার নামাজের আজান, মাঠে ঘন হতে থাকা কুয়াশার ভেতর স্বাধীন দেশের পতাকা ঘিরে হাঁটতে থাকেন এবং অকূল, অশেষ হাঁটার মধ্য দিয়ে একসময় টের পেতে থাকেন স্বাধীনতার স্বাদ সে তো এই যখন তখন, যেমন ইচ্ছা তেমন হাঁটার অন্তহীন মহাকবিতার নাম।
বহুমাত্রিক লেখক বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে নিয়ে পিয়াস মজিদের মূল্যায়নধর্মী লেখাটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। কারণ, তাঁর লেখায় অন্তর্ভেদী বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেছেন পিয়াস মজিদ। চমৎকার বিশ্লেষণ। পাঠককে আপ্লুত করবে।
উষা গওহর ‘বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ছোটগল্প’ শিরোনামে লিখেছেন―‘আমাকে গল্প লেখা শিখিয়েছেন বাড়ির বউঝিরা, গ্রামের অভাবীরা, তল্লাটের নিরক্ষররা। পাটের আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে বাড়ির বউঝিরা নিজেদের মধ্যে সুখ-দুঃখের গল্প করতেন, আমি পাশে বসে পাটের আঁশ ছাড়াতে ছাড়াতে শুনতাম। কিংবা তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির কোনো বউঝি একটা তাল শাড়ির ভাঁজে অভাবী শাপলালতা তুলছেন, অভাবের সংসারে আজ এই খাদ্য, কিংবা কোনো নিরক্ষর মানুষ আকাশের দিকে চেয়ে গীত গাইছেন, আকাশে গোল হয়ে আছে সোলেমান বাদশার আংটি, নিরক্ষর মানুষটা সুলেমান বাদশাকে গীত শোনাতে শোনাতে ধান ওঠা মাঠের মধ্যে কুয়াশায় কোথায় উধাও হয়ে যেতেন, আমি বাড়ির সামনে রাস্তার ধারের মাচানে বসে তাঁকে খুঁজে বেড়াতাম। আমি বই পড়তাম পাগলের মতো, পারিবারিক লাইব্রেরির গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধের বইগুলোর মানুষজনের পাশাপাশি বাড়ির বউঝিদের, গ্রামের অভাবীদের, তল্লাটের নিরক্ষরদের দাঁড় করিয়ে দিতাম, দেখতাম কোথায় মিল কোথায় অমিল। এই অভিজ্ঞতার থেকে একটা তুলনার বোধ তৈরি হত মনে, আমার সামনের মাচানে বসে শূন্যের মধ্যে হাঁক দিতাম, যেন আজান হত আকার হাঁক।’ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে; সাধারণ মানুষ―দরিদ্র, গ্রামীণ জল-হাওয়ার স্রোতোধারায়। এরপর প্রেক্ষাপট পাল্টেছে, গ্রাম থেকে মানুষের ভাবনার কেন্দ্রে এবং এই সূত্র মেনে ‘মানুষ’ সর্বত্র, মানুষকেই খোঁজে। …বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের গল্পরচনার পেছনে আছে একটি শিক্ষিত মন, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ নিয়েই তাঁর আদি আকর্ষণ। এতে সম্পর্কচিহ্ন যেমন রূপ পায়, তেমনি মনোবিশ্লেষণ। …নাগরিক মধ্যবিত্তের দাম্পত্য, যৌনতা ও অবসাদ-বিষণ্নতার ছাপ রয়ে গেলেও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ১৯৭১-পরবর্তী গল্পে নতুনতর সামাজিক জিজ্ঞাসা যুক্ত হয়েছে। যদিও যুদ্ধ-পরবর্তী গল্পে সংগ্রামী চেতনার আভাস তেমন গভীরভাবে মেলে না বোরহানউদ্দিনের নাগরিক চরিত্রে, অথচ এরাই যুদ্ধ-পরবর্তীকালে হতাশায় আক্রান্ত হয়। হতাশা হয়তো মধ্যবিত্তের শ্রেণিচরিত্রের অংশ, লেখকও তা অতিক্রম করতে চাইনি।’ উষা গওহর তার আলোচনায় বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে এভাবেই মূল্যায়ন করেছেন। অত্যন্ত ঋদ্ধ একটি আলোচনা পাঠককে মুগ্ধ করবে। এভাবেই দুজন লেখক ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরকে স্মরণীয় করে পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।
আনিসুজ্জামানকে স্মরণ করেছেন তিনজন। মারুফুল ইসলাম শিরোনাম করেছেন―‘আনিসুজ্জামান’। তিনি কবিতায় তাঁকে স্মরণ করেছেন―‘আপনি আমার আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ/ এই অনুভবে আমি প্রতি রাতে প্রশান্তির চাদর টেনে নিই গায়ে/ বাইরে কখনও শুক্লপক্ষ কখনও কৃষ্ণপক্ষ…।’ আবার লিখেছেন―‘সূর্যমানব তিনি/ চন্দ্রকান্তিমান/ মরলোকে তাঁকে পাই/ অমৃতের সন্তান।’ এভাবেই কবিতায় তিনি তাঁকে স্মরণ করেছেন।
কুদরত-ই-হুদা ‘কোথায় পাবো তারে’ : প্রসঙ্গ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান’ শিরোনামে লিখেছেন―‘একজন মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন একটা মৌলিক প্রশ্ন তার আশপাশের জীবিতদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রশ্নটি এই যে, মৃত্যুর পরে তাকে কোথায় পাওয়া যাবে। এ কথার একটা ধর্মতাত্ত্বিক উত্তর হয়তো আছে। কিন্তু এর একটা ইহজাগতিক উত্তরও নিশ্চয়ই আছে। কোথায় পাবো তারে―এই জিজ্ঞাসার উত্তরের জন্য আমরা দৃষ্টি রাখতে পারি ওই ইহলোক ত্যাগ করা ব্যক্তির সারাজীবনের কর্মকাণ্ডের ওপর। সেটাই সংগত। কারণ, মানুষের অনুপস্থিতিতে কৃতকর্মই মানুষের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব করে; মৃত বিমূর্ত মানুষকেও মূর্ত করে রাখে। এই হিসেবে সম্প্রতি ইহলোক ত্যাগ করা অনিসুজ্জামানকেও [১৯৩৭-২০২০] খোঁজা যেতে পারে তাঁর সারাজীবনের কর্মকাণ্ডের মধ্যে।’ ‘ছাত্র তৈরির সফলতা কম থাকলেও শিক্ষক হিসেবে আনিসুজ্জামানের বোধ করি অন্যতম গুরুত্ব আছে। এই গুরুত্ব খুঁজতে হবে তাঁর নিজের কাজের মধ্যে; ছাত্র তৈরির মধ্যে নয় বা একাডেমিক চর্চার ঐতিহ্য তৈরির মধ্যেও নয়।’ গবেষক হিসেবে তিনি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য গ্রন্থের মধ্য দিয়ে। এই গ্রন্থে তিনি ১৭৫৭-১৯১৮ কালপরিসরের বাঙালি মুসলমানের সাহিত্যচর্চার একটা ইতিহাস নির্মাণ করেছেন। গ্রন্থটিতে তিনি বাঙালি মুসলমানের অস্পষ্ট-ধোঁয়াশা-চিহ্নিত সাহিত্যিক ইতিহাসকে স্পষ্ট করে তুলেছেন। শুধু সাহিত্যের ইতিহাসই বলি কেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস এখানে অভিব্যঞ্জিত হয়েছে মাইক্রোস্কপিক গবেষণায়। তাঁর এই গবেষণা পুরো বাংলা অঞ্চলে বাঙালি মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিশ শতকের বা তারও পরের ইতিহাসের রূপরেখার একটা বড় পাটাতন নির্মাণের আকরগ্রন্থ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে।’ কুদরত-ই-হুদার আলোচনা থেকে একজন আনিসুজ্জামান, গবেষণায় তাঁর যে ভূমিকা, সেটাই প্রাধান্য পেয়েছে। এছাড়া বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমানের অগ্রযাত্রার ইতিহাস উন্মোচনের মধ্যেই নিহিত। পরিশেষে লেখক এ কথা বলে ইতি টেনেছেন যে―‘ছাত্র-পরম্পরা তৈরি করতে না পারলেও তিনি নিশ্চয় বহুকাল বেঁচে থাকবেন তাঁর ব্যক্তিগত সৃজনকর্মের মধ্যে।’
‘আনিসুজ্জামানের সাংস্কৃতিক ভাবনা’ শিরোনামে মো. মেহেদী হাসান লিখেছেন―‘আনিসুজ্জামান তাঁর গবেষণায় সময়ের যে ব্যাপ্তিটা ধরেন তাতে সূচনাটা [১৭৫৭] বোঝা যায়, সেটা ঔপনিবেশিক কালের আরম্ভ কিন্তু শেষটা ১৯১৮। এর একটা অর্থ তো বুঝতে পারছি ইয়োরোপের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আরেকটা অর্থ দারুণ। কাজী নজরুল ইসলামের [১৮৯৯-১৯৭৬] আবির্ভাবের পূর্বকাল। এখন লেখা যায়, মুসলমানদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে তিনি নজরুলকে একটা যুগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি শেষই করেছেন গবেষণা এ ব্যাখ্যা দিয়ে : ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনার ইতিহাসে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে পূর্ববর্তীকালে মধ্যযুগের অনুবৃত্তি চলেছে। ১৮৭০ থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে তার আধুনিকতার প্রথম স্তর বলতে হয়।’ একটি প্রবন্ধে তিনি বলেছেন―‘স্বাধীনতা লাভের পরে নিজেদের সমরূপতার আনন্দে আমরা এমনই ছিলাম যে, ১৯৭২ সালে সংবিধান-প্রণয়নের সময়ে যখন গণপরিষদের কোনও সদস্য বললেন, “আমরা বাঙালি নই―আমরা চাকমা”, তখন আমরা চমকে উঠলাম। বাংলাদেশ যে এক জাতির দেশ নয়, আকারে ক্ষুদ্র হলেও অন্যান্য নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তা যে স্বতন্ত্র এবং অধিকারের প্রশ্নে বাঙালির সমান এ কথা বুঝতে আমাদের সময় নিয়েছে।’
আনিসুজ্জামানের ভাবনা-জগতের প্রধান সম্পদ তাঁর তথ্যনিষ্ঠা। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক তাঁকে যে বেশি পছন্দ করতেন তারও প্রধান কারণ ছিল এ তথ্যনিষ্ঠা। তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা তাঁকে অসাধারণ মান্যতা এনে দিয়েছিল। তাঁর গদ্যের আরেক গুণ হিউমার। খুব গুরুগম্ভীর বিষয় তিনি উপস্থাপন করেন চমৎকার সব হিউমার উইটের আশ্রয়ে। পরিমিতিবোধের জন্যও তিনি অননুকরণীয় হয়ে উঠেছিলেন।
‘কবি মনজুরে মওলার নিজস্ব কণ্ঠস্বর’ শিরোনামে সৌভিক রেজা লিখেছেন―‘একজন কবির জন্য আত্মনিমগ্নতা খুব জরুরি। তাঁর প্রয়োজন নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব। কেননা ভীড়ের গহ্বরে সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা রচনা, তার নির্মাণের প্রক্রিয়া নানাভাবে ব্যাহত হতে থাকে। কথাসাহিত্যিক মার্কেজ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “লেখার মতো নির্জন পেশা আর একটিও নেই। এই অর্থে কথাটা সত্য যে, আপনি যখন লিখছেন তখন কেউ আপনাকে সাহায্য করতে পারে না, তেমনি কেউ জানেও না আপনি কী করতে চান। সেখানে আপনি বাস্তবিকই একবারে একা, বিচ্ছিন্ন―কেবল একটা শূন্য পাতা আপনার সামনে।” কথাটার মধ্যে খানিকটা আবেগ, যুক্তি থাকলেও খুব একটা অতিশয়োক্তি নেই। এই নিমগ্নতার মানে আবার এটা নয় যে, তিনি শুধু নিজের চারিদিকেই পরিভ্রমণে ব্যস্ত থাকবেন। কবির একটি চোখ থাকবে তাঁর ভেতরের জগতে আরেকটি বাইরের দিকে।’ মনজুরে মওলাই বাংলা সাহিত্যে প্রথম, যিনি রবীন্দ্রনাথ আর এলিয়টের যুগ্মতাকে মান্যতা দিয়েছেন। তিরিশের দশকের উল্লেখযোগ্য প্রায় সব কবিই এটা করেছেন। বিশেষ করে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে-র নাম প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন। অনিন্দ্যসুন্দর একটি আলোচনা। মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে আছে।
রশীদ হায়দারকে নিয়ে লিখেছেন তাঁরই অনুজ জাহিদ হায়দার। শিরোনাম করেছেন―‘হোঁচটের পরও যে-জন হাঁটতেন’। তিনি লিখেছেন―‘প্রতিটি মানুষের কোনো না কোনো জীবন-দর্শন থাকে, দাদু ভাইয়ের চিন্তার মধ্যে যে-কয়টি ছিল’, তার একটি : ‘যে-লোক হাসি এডিট করে, সে বেশি জটিল।’…কখনও এরকম কথা হতো : ‘আপনার গল্প, উপন্যাস, শিশুসাহিত্য এবং নাটক ভবিষ্যতে কেউ না পড়লেও, এবং বাংলা সাহিত্যের কোনো গবেষক তথ্যমাফিক প্রয়োজনে উল্লেখ করলেও, আগামী প্রজন্ম বলবে : রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি একাত্তর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওরাল হিস্ট্রিকাল বাইবেল।’ শুনে বলতেন, ‘আমার লেখা সাহিত্য না পড়লেও কোনো ক্ষতি নেই, মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারিনি, আগামী প্রজন্ম যদি স্মৃতি একাত্তর পড়ে, আর কিছু না হোক, তারা দেশকে ভালোবাসতে পারে, স্বাধীনতার জন্যে জীবনের বিনিময়ে যে-ভালোবাসা দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা।’ এভাবেই জাহিদ হায়দার স্মরণ করেছেন প্রিয় অগ্রজকে।
শহীদুল ইসলাম ‘রশীদ হায়দারের ছোটগল্প’ শিরোনাম দিয়ে লিখেছেন―‘রশীদ হায়দার স্পষ্ট করেই বলেছেন, পরিচিত পরিবেশেই আছে তাঁর গল্পের মানুষজন। গল্পের যে পরিচিত আঙ্গিকটি এখনও বহাল আছে তাতে পরিচিতকে ব্যাখ্যা বা অপরিচয়ের চমক আনার মধ্যেই খোঁজা হয় সার্র্থকতা। ফলে গল্পের ধর্মেই পরিচিত ও অপরিচিতের খেলা চলে, এর মধ্য দিয়েই তৈরি হয় গল্পকারের নতুন পথ। এই পথে ছোটগল্প রহস্য, রোমাঞ্চ, আবেগ, মন-মনন- মনস্তত্ত্ব, প্রতীক-সংকেত মিলেমিশে কথাকল্প, বলা না-বলায় অতি বলার ইশারা। রশীদ হায়দার তার প্রথম গল্পগ্রন্থে জিজ্ঞাসু―মন, প্রেম, কাম, মৃত্যু―অস্তিত্বের সারকথার অনুসন্ধানী। এই সন্ধানে এক জীবনের দুই প্রান্ত; একদিকে শিশু, কিশোর বা যুবকের পরম্পরায় প্রেম ও কামরহস্য; অন্য প্রান্তে আছে মৃত্যু। দুটোই আবেগ, মনন ও সমাজের সংমিশ্রণ ঘটায়।’ তিনি এভাবেই রশীদ হায়দারকে নিয়ে তাঁর গল্পের ভেতরের গল্প হিসেবে তুলে ধরেছেন।
‘মায়া রহিয়া গেল’ শিরোনামে জোহা আজাদ লিখেছেন―‘সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে আবুল হাসনাতের প্রশ্নহীন আত্মপ্রতিষ্ঠা। বিগত শতকের সত্তরের দশকে সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হলেও তাঁর লেখকসত্তার উন্মেষ ঘটেছিল উত্তাল ষাটে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক ঘটনাপুঞ্জের বিচিত্র অভিঘাত ও অভিজ্ঞতার আলোড়নের কাল ছিল সেটি। আবুল হাসনাত [১৯৪৫-২০২০] নিজেও সময়ের সারথি। একদিকে শিল্পের প্রতি কৌতূহল, অভিনিবেশ; অন্যদিকে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা তাঁর মনোজগৎ ও মনস্তত্ত্ব গঠনে সহায়ক হয়েছিল। সমাজের নানা ক্ষেত্রের মানুষের সান্নিধ্যও পেয়েছিলেন তিনি। ফলে তাঁর অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়েছিল বিষয়ের ব্যাপকতায় ও বৈচিত্র্যে। …তাঁর সাহিত্যিক সম্ভাবনা ও সফলতা, হয়তো হয়ে উঠতে পারত ঈর্ষণীয়। পঠন-অভিজ্ঞতা, শিল্পকলাজ্ঞান এবং মানসপ্রস্তুতিও ছিল, অন্তর্রক্তপাত। হারানো সিঁড়ির চাবির খোঁজে এবং প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য গ্রন্থের ‘ভূমিকা’ বা ‘ভূমিকা নয়’ অংশে রয়েছে সেই বিষাদাত্মক আত্মস্বীকারোক্তি। ‘তবুও দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে আলস্য ঝেড়ে একদিন আকস্মিকই লেখা শুরু’ করেন আবুল হাসনাত। সেসব রচনার অন্তর্বর্তী বর্ণস্রোতে যেন ‘কোথাও এখনও মায়া রহিয়া গেল।’ এভাবেই তাঁকে জোহা আজাদ স্মরণ করেছেন।
‘কবিতা, জীবন দেখার দর্পণ যাঁর : কাশীনাথ রায়’ শিরোনামে নিপা জাহান স্মরণ করেছেন―‘কবিতা তাঁর কাছে জীবনকে নানামাত্রিকভাবে দেখার দর্পণই ছিল―এতে তিনি আত্ম-অবয়বের প্রতিফলন যেমন ঘটিয়েছেন, ততোধিক তুলে ধরেছেন পাশর্^-অবয়ব-অবকাঠামো। কবিতায় পাওয়া অমলকান্তির রোদ্দুর হবার প্রগাঢ় ইচ্ছের মতো কবিতাগ্রস্ত হয় কিছু মানুষ; “এক জন্মে সবকিছু পায় না সবাই” বুঝতে পেরে “এই জন্মে” ও “জনমে জনমে” তবু সেই ইচ্ছেকে লালন করার ধৈর্য ও অনুরাগ নিয়ে অর্ধশতাব্দী অতিবাহিতকরণ সহজ নয়। ষাটের দশকে আবির্ভূত কবি কাশীনাথ রায় [১৯৪৭-২০২১] এই কষ্টসাধ্য কবিতাযাপনকারী।’ তাঁকে নিয়ে নিপা জাহানের হৃদয়গ্রাহী লেখাটি পাঠককে কাশীনাথ রায়কে জানবার সুযোগ করে দিয়েছে।
এ সংখ্যায় কবিতা লিখেছেন― মাহমুদ কামাল, দিপংকর মারডুক, মিথিলা তাবাসুম, শঙ্খচূড় ইমাম, হানিফ রাশেদীন ও হোসাইন মাইকেল।
এ সংখ্যায় গল্প লিখেছেন―নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর, রাশেদ রহমান, মঈনুল হাসান ও শিল্পী নাজনীন।
খাবার বিষয়ে একটি চমৎকার গদ্য লিখেছেন―পবিত্র সরকার। খাওয়া নিয়ে তাঁর একটা চমৎকার লেখা আমরা পাঠ করবার সুযোগ পেলাম। খাদ্য নিয়ে যে এতভাবে এত রকমের সুখপাঠ্য একটি লেখা যেতে পারে তা পবিত্র সরকারের লেখাটি পাঠ না করলে জানতামই না। তিনি লিখেছেন―‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার দীনেশচন্দ্র সেনের কনিষ্ঠ পুত্র অরুণ সেন [কবি সমর সেনের পিতা] নাকি বেহালার বাড়ির রোয়াকে বসে পাড়ার ছেলেদের কাছে সরলভাবে ইয়োরোপীয় দর্শনের ইতিহাস বোঝাতেন। তিনি বলতেন, “হেগেল কেইম্, অ্যন্ড হি সেইড (মাথায় থাপ্পড় মেরে) দিস্ ওয়াজ অল্!” মানে মাথাই, অর্থাৎ মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাই সার কথা। তার পর বলতেন, “দেন রুকো কেইম্, অ্যান্ড হি সেইড্ [বুকে থাপ্পড় মেরে] দিস্ ওয়াজ অল্।” অর্থাৎ মানুষের হৃদয়ই সব। তার পরেও বলতেন, “দেন মার্কস কেইম্, অ্যান্ড হি সেইড্ [পেটে থাপ্পড় মেরে] দিস ওয়াজ অল্।” অর্থাৎ খিদে আর খাবারই জীবনের সারবস্তু। খানিকটা উপনিষদের অন্নই ব্রহ্মের মতো। কিন্তু এখানেই তাঁর কথনের শেষ ছিল না। তাই শেষ করতেন এই বলে যে, “দেন ফ্রয়েড কেইম্ [এবারে কোথাও থাপ্পড় না মেরে], হি ওয়েন্ট ইভ্ন ডাউনওয়ার্ডজ্!” আশা করি শেষ কথাটার ব্যাখ্যা করার দরকার নেই।
এই লৌকিক উপাখ্যান থেকে আমার মার্কসবাদে বিশ^াস আরও পোক্ত হয়েছিল। আমি বুঝেছিলাম যে, জন্ম থেকে মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের খেতেই হয়।’ তিনি খাদ্য নিয়ে লিখতে যেয়ে মোদ্দা কথাটা মার্কসের উদ্ধৃতিতেই তুলে ধরেছেন যে জন্ম থেকে মৃত্যুর আগের মুহূর্ত পর্যন্ত খাবার। যা আমাদের খেতেই হয়। আর এই খাবারের জন্যই তো এত এত সংগ্রাম, যুদ্ধ-বিগ্রহ। সেই খাবার নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছেন―দুগ্ধপোষ্যতা থেকে দুগ্ধজাত খাদ্য, নুন খাই গুণ গাই, চা ও আনুষঙ্গিক, সকালের জলখাবার, মধ্যহ্নকালীন, নৈশভোজন, পানীয়। তাঁর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে বিভিন্ন পদের খাবারের সঙ্গে পরিচয়, তার স্বাদ আস্বাদন এসব নিয়ে বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। যা আমাদের পাঠে আনন্দ দেবে।
উলুখাগড়া এই সংখ্যাটি একটি অনিন্দ্যসুন্দর আয়োজনে সমৃদ্ধ সংখ্যা। প্রয়াত বিশিষ্টজনদের নিয়ে স্মরণীয় সংখ্যা হিসেবে এটি সংগ্রহে রাখার মতো। আসলে সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক এ কাগজটি দীর্ঘদিন আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে সুবাতাস বইয়ে চলেছে। সম্পাদক সিরাজ সালেকীনকে এ কারণে সাধুবাদ দিতেই হবে, অন্যথায় অবিচার করা হবে।
লেখক : কবি, গল্পকার,
প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক