পাখিটির ভয়
শংকর চক্রবর্তী
হয়তো ছিলে না তবু কোনও দুঃখ থেকে জেগে উঠে
সন্ধেবেলা বাসস্টপে দু দণ্ড দাঁড়িয়ে আলো দেখতে চাইলে
আলোর ভিতরে
তিনশো দৈত্যের মুণ্ডু তোমাকে মধুরতম স্বপ্ন দেখাবে কি―
জেগে উঠে কান্না চেপে চেয়ার পাল্টালে ঘন ঘন
যেসব উঠানে মেঘ আগে নামেনি কখনও
তোমাদের হাড়গোড় ভেসে গেল জলে
নিজের অদ্ভুত মুখ দেখে ভয়ও পেয়েছিলে খুব
তারপর সারারাত দমবন্ধ করে ছুটে গেলে
ছুটতে ছুটতে বৃষ্টি আর ভেজা-পাহাড়ের গা-থেকে অসংখ্য রক্ত-জোঁক
কখনও হাঁ-করা অন্য আহ্লাদের দিনও তোমাকেই
মাংসপিণ্ড ভেবে সত্যিই ছুড়ে দিল নতুন রাস্তায়―
একটা রঙিন পাখি চোখের সামনে ভেসে উড়ছে তখন
ভাঙাচোরা ঘুম থেকে লাফ দিয়ে উঠেছিলে তুমি
পাখিটি কখন যেন রঙের পালক ছেড়ে উড়ে গেল ভয়ে।
রবীন্দ্র গোপ
নিজের সাথে নিজের দেখা
মানুষ হেই মানুষ, কখন যে একা হয়ে যায়
হাত বাড়ালেই হাতের আড়ালে মানুষের ছায়া
একা একা মানুষ হাঁটে, হেঁটেই যায় দূরে
পায়ের শব্দ শুনে মানুষ আপন করেই শোনে।
টিকটিকি শব্দ করলে তার শব্দে অস্তিত্ব খুঁজে
কে আসে কে যায় না কি যে যায় সে যায় আর
একা একা নিজের সাথেই নিজেরই কথা বলা
শুধু দিন যায় উত্তাল দিনের পালের উড়াল গান।
একা হলে দেখি শুধু আপন পৃথিবী শুধুই আপন
কত কি যে মনে পড়ে টাপুর বৃষ্টির নূপুর মাতাল
শব্দের শূন্যতা পাখি যায় কোথায় হারিয়ে যায়
যেতে যেতে আপন ঠিকানা পায় না সে আর।
————————————————–
হাসান হাফিজ
সায়াহ্নের স্বগতোক্তি
ইশ্কে মজলে এরকমই হয়
কে আপন কে বা পর করা যায় না সহজে নির্ণয়।
ইশ্কে ডুবলে দিবানিশি টানাহ্যাঁচড়া ভাঙাচোরা নাও
উজানে প্রবল সোঁতে একলাএকলি দাঁড় বৈঠা বাও
আপনার মাঝে তুমি অকস্মাৎ জ্বলে উঠে নিভৃতে হারাও
নারী ও জীবন দুয়ে কেড়েছে সংবেদ কিছু দিয়েথুয়ে
নিজেরা দিওয়ানা হতে জানে সর্বক্ষণ, হয়েছেও তাই
আমি ভ্যাবলা সে কারণে তরক্কিও কিছুমিছু হয় নাই
ইশ্কে আমি ভালোই হয়েছি দ্রব,পরাস্তের কাহিনি শোনাই
একজন্ম এভাবে ফুরিয়ে যাবে ছড়িয়ে আনন্দরেণু আলো রোশনাই
বেজে উঠছে অনিবার্য বিদায়ের অনাত্মীয় করুণ সানাই…
—————————————————
আদিত্য নজরুল
কৃষ্ণপক্ষ
কারও কারও মুচকি হাসির দ্যুতি
মৃত মাছের চোখের মতো চিরকাল জেগে থাকে মনে।
শুধু পাশাপাশি
বসে থাকলেই
চিরকাল পাশে থাকা হয়ে ওঠে না
ঘনিষ্ঠতার ভেতরেও
খুব গোপনে গোপনে
যূথবদ্ধ হয়ে থাকে
বিচ্ছিন্নতা;
যেমন―জীবনের মাঝে
ভীষণ গোপনে গেঁথে থাকে মৃত্যু।
পাশাপাশি বসে থাকলেও
প্রস্ফুটিত হয় না সংসার…
পাশাপাশি বসে থাকা
লোকটির রোমান্টিক হাসি
কখনও কখনও
খুব গোপনেই―
তুলে রাখতে হয় স্মৃতির অ্যালবামে।
————————————————–
মঈনউদ্দিন মুনশী
বৃত্ত
আমি চক দিয়ে আমার শরীরের চারিদিকে একটা বৃত্ত বানিয়েছি।
সেই বৃত্তের ভেতরে খোদাই করেছি আমার সব প্রিয়জনদের নাম
যারা বেঁচে আছে―যে পর্যন্ত শুধু একটাই খালি জায়গা অবশিষ্ট থাকে আমার পায়ের নিচে। বৃত্তের বাইরে রেখেছি সেই সব নাম যাঁদেরকে আমি হারিয়ে ফেলেছি।
আমরা বৃত্তের শক্তির কাছে নিত্য শিকার হই,
প্রত্যাশা করি এর শরীর থেকে আমাদের ঘনিষ্ঠতা দূর করতে।
আমার আছে শুধু প্রতীক্ষার শুরু, যেটা আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। মাটিতে আমার তালু ঘসলে
বৃত্তের সাদা রেখা হয়ে ওঠে চক এবং চামড়ার ধুলোর
একটা মিশ্রণ―এখনও দুটো পৃথিবী
আলাদা রয়েছে, আমার ধর্মীয় গণ্ডির সীমানা ভেঙে ফেলার পরেও। আমি জায়নামাজ গুটিয়ে ফেলি গলিত বরফের ওপর,
জমাট দিঘির পানে চেয়ে বসি, কল্পনা করি সূর্য ভেদ করে যাচ্ছে পুরু বরফ। একজন মানুষ অক্লান্ত বসে আছে মাঝখানে,
তাঁর যন্ত্র খোদাই করছে একটা ক্ষত ঘনীভূত পানির মধ্যে,
বরফের মধ্যে মাছ শিকার। আমি তাকিয়ে থাকি, অপেক্ষা করি
যে পর্যন্ত তাঁর বঁড়শি একটা মাছ খুঁজে পায়। মনে হয়, হয়ত এভাবেই মৃত্যু আমাদেরকে খুঁজে পায়―যা আমরা চাই তার প্রলোভন দেখিয়ে!
————————————————
গৌতম হাজরা
সুতো
সুতোর নিজস্ব একটা গন্ধ থাকে
যে গন্ধ সারা সংসার জুড়ে ছড়িয়ে যায়।
সুতো সুতোর মতো পরতে পরতে
পাকে পাকে আলো অন্ধকারে
মাকুর ঢেউ ভেঙে তৈরি করে আস্ত সংসার।
সুতোর রঙ সাদা, ভাতেরও রঙ সাদা
তাই ভাত আর সুতো দুটোই
জীবনের দেশ মহাদেশ
ভাঙে গড়ে, পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে বেশ!
————————————————-
হাশিম কিয়াম
অপেক্ষা
চোখ খুলে দেখি, একাকীত্বের মহাসাগরে ডুবে আছি
আমি টাইটানিক জাহাজ; অনাদিকালের
নির্জনতার শীতল পাটি বিছিয়ে রেখেছি
বুকের মাঝে; মনের আঁকাবাঁকা পথে কোনও
সাপ নেই ফণা তুলে, গেঁদা ফুলের পাপড়ি অপেক্ষায় আছে
তোমার আলতারাঙা পায়ের সোহাগ
মাখার জন্য; ইতিহাসের রংচটা ডানা সাজিয়ে দেবো
গল্পের পালকে; সব গল্প শেষ হলেও কিছু
গল্প রয়ে যায়, সেসব গল্পও অনুবাদ করে তিলা ঘুঘুর
ঝাঁকে উড়িয়ে দেবো…পাহাড়ি কিশোরীর চুলের
গন্ধ-মাতাল গল্পের প্রজাপতিরা চোখ জুড়াবে পেশিবহুল
পাহাড়ি যুবকের; আমরাও গল্পের গোলকধাঁধায় হারিয়ে
যাব অনন্ত গল্প হয়ে যেমন পাইথনের পেটে ধীরে ধীরে হজম হয়ে
যায় যুবতী চিত্রা হরিণী…
—————————————————————
মেহনাজ মুস্তারিন
বন্ধনে
জানি নক্ষত্র নই তবু গভীর এক দুঃখ
গ্রহের মতো
রাত-দিন জেগে আছে! অতি ক্ষুদ্র প্রাণ আমি, বেহুলার ভেলায়
লখিন্দরের মতো ভেসে চলেছি! শুনেছি, ভালোবাসায়
মৃতজনে জাগে প্রাণ! তবু ইন্দ্রের সভায় নৃত্য নয়,
জেগে আছি আলো হাতে—
অপেক্ষা কোনও এক শব্দের! যাকে ঠিক অনুভব করা যায়! স্পর্শে!
ফিরে এসো যদি ইচ্ছে হয়! যদি ইচ্ছে হয় আঙুল
ছুঁয়ে দিতে! মধ্যগগনে যে হাত ছুঁয়েছিল মুখখানি একবার!
জ্যোৎস্নাও করেনি বারণ! সেই ক্ষণে
ঝরে পড়েছিল আলো, ভিজেছিলাম
ধুয়ে নিয়ে যত দুঃখ ছায়া, প্রেমের স্রোতে!
যদি আসো আলোর বন্যায়
ঢেকে যাবে চারপাশ! শুধু একবার
ফিরে দেখো! শুধু একবার আগলে নাও তোমার
স্বপ্ন আকাশ! দেখো, মাটি বৃক্ষ কীট পতঙ্গ সবুজবীথি,
চেয়ে আছে তুমি আসবে বলে! চেয়ে আছে চন্দ্রতিথি!
ঝড়ো বৃষ্টি? তারাও চেয়ে আছে,
তুমি আসবে বলে! ওরা ঝরবে! ওরা গাইবে! সেই গানে
দোদোল দোলায় দুলবে ওরা! ঝড়ো হাওয়ায় কম্পন! যেন সুরের ধারায়
নামবে বৃষ্টি! জেগে ওঠব চোখের তারায়!
তোমার স্পর্শে; দেখো আবারও ভিজে যাব তোমার উষ্ণতায়!
————————————————————-
মুশাররাত
দূরত্ব
এখানে অনেক বেশি অন্ধকার
আলো হয়ে আসা
তোমাকে একটু দরকার।
এখানে বজ্রপাতেও ভাঙে না
কঠিন নীরবতার ঘুম
অনুভূতি শত
দিয়ে যায় ক্ষত
আসে না তো মৌসুম।
এখানে ভিড়ের মাঝে
একা জেগে থাকে একটি মানুষ
ওপারে তীরের খোঁজে তুমিও
তবু পার হওয়া যায় না এই
অথৈ সমুদ্দুর।
————————————–
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
আলো
গাছেদের ছায়ার সাথে যোগাযোগ করা হলো না
কুঠুরির কালো ঘরে ঢুকে দেখা হলো না
কতটা বৃষ্টির জল জমিয়ে রেখেছে তারা
মেঘের ভেতর সরোবর হয়ে দু-পাশে বনানী সেজেছে
সেখানে উড়ে বেড়ানো পাখিদের বয়স জানা হলো না
জানা হলো না নিরাশ্রয়ী পাখিদের ঠিকানা―
দুপুরে কিচিরমিচির শব্দে বারবার ঘুম ভাঙছিল
লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু কাক কর্কশ আওয়াজে
পরবর্তী আস্তানার ঠিকানা খুঁজছিল আলোয়
আলোরা জানে না কোথায় লুকিয়ে অন্ধকার
আলো শুধু নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়
সেও কি আলো! নাকি ভ্রম
চোখের আলো যেভাবে কমে আসে
দেখি ফ্লাইওভার কত দ্রুত বয়ে যায় নীরব
দেখি উঁচু অ্যাপার্টমেন্ট, ডালগোনা কফি
আমি জানি সেও এক আলো
অন্ধকার ভেবেছে, নিজেকে মুখ লুকাবার।
——————————————-
স্নিগ্ধা বাউল
মুঠোভর্তি শহর নিয়ে বসে আছি
পাশ কাটিয়ে শুয়ে পড়লেই হাতদুটো এক হয়
তরল রোদে ভেসে যায় বিছানা তক্তপোশ
উঠে আসে পাতার কাফেলার ঘ্রাণ। অনর্গল
বিড়াল ডাকছে বিষণ্ন অন্ধকারে, গলগলিয়ে
ভোরের জল, ব্যস্ততাহীন ডানায় ঝিমায় পাখি
আমি বসে আছি মুঠোয় আগলে শহরের গলি।
অন্তত বছর হলো। স্হির পাগুলি এবং নখ
বাড়ছে পৃথিবীর বয়স হয়ে। আয়োডিন যেন।
আকাশে জমাট দুঃখ উড়ে বিমান পাখনায়
অথচ পাখিগুলোর মনে হলেই আকাশ হাসতো
ধূপের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম সন্ধ্যায়
চন্দনাবৃত পর্দার আড়ালে পতঙ্গভুক হাতগুলো
নিঙড়ানো জল হয়ে যায় আমার মরামুখ হয়ে
ভনভনায়, মাছির ডানা গতিতে উড়ে ফলিত বিদ্যায়
মরুভূমির প্রখর বিদ্রুপাত্মক ডেড সোলস
পুরো নাম হয়ে যায় নাকের ডগায়, আমি ঘুমাই
শর্তহীন শূন্য বিরাট মেজাজ হয়ে অঙ্ক বানায়
আমি তো জানি রাত্রির কষ্ট হচ্ছে আমায় ছাড়তে।
যেখান থেকে ফিরতে হয় ফিরে আসাটাই যৌক্তিক,
তার উপসংহারের দিকে তাকিয়ে আছে চোখ অথবা হাতের আঙটিগুলো। যে যূথবদ্ধ আর্তনাদ জ্বলন্ত উনুনে ন্যাপ্থার মজুত করল, তারও উদ্বায়ী ধর্মের সাথে দেখা হয়। ভাসতে ভাসতে অথবা উড়ুক্কু হয়ে কিঞ্চিৎ যে আনন্দ নিয়ে কথারা উপভোগ করে, সেখানে একা দাঁড়িয়ে থাকাটা জরুরি। আপাতত তীর্থেই যাচ্ছে মন কিংবা মনন, পরিশুদ্ধি পরিত্রাণের হয়ে কথা বলতে চায় বহুদিন। রাতের পথ নেই বলেই জানতাম কেননা সেখানে বায়বীয় পদ্ধতির অন্ধকারে ঝরে যায় অজস্র মানুষের মতো সাদা থকথকে পারদ―।