আর্কাইভগল্প

গল্প : রথসচাইল্ডের জিরাফ : ইন্দ্রাণী দত্ত

ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল। আলো মরে গিয়ে বেশ ঠান্ডা। এখানে ঈষৎ উঁচুতে দাঁড়িয়ে গাছের মাথা থেকে শিকড়ের দিকে সূর্য নামা দেখা যায়। হঠাৎ হঠাৎ সাদা বক উড়ে যায় পায়ের তলা দিয়ে―তখন সাঁৎ সাঁৎ করে সাইকেল চড়ে কেউ গেল মনে হয়―মাথায় সাদা হেলমেট।

আরও নিচে হ্রদ দেখা যাচ্ছিল―নীলচে রং এখন ঘন বেগুনি। জলের নাকি একটা হিলিং পাওয়ার আছে―রেণু কোথাও পড়েছে। শব্দটা যখন উপশম নয়, হিলিং পাওয়ার―মানে ইংরেজি বইতেই পড়েছিল। কিংবা কোনও কোটেশন―হয়তো হোয়াটস্যাপে। সে যেন পড়েছিল, যত দুঃখ তত জল লাগে হিলিংএর জন্য। কেউ হয়তো টুক করে স্নান করে নিল, কারও লাগল গোটা সমুদ্র। আপাতত তার মনের কোনও শুশ্রƒষার প্রয়োজন ছিল না―জলের দিকে তাকিয়ে একমনে স্মৃতিকে খেলিয়ে তোলার চেষ্টা করছিল রেণু। সুবর্ণ পাশে দাঁড়িয়ে। কব্জিতে বিয়ের লাল সুতো―হানিমুনে এসেছে ওরা।

বঁড়শিতে স্মৃতির টুকরা টাকরা গাঁথলেই রেণু তা টেনে আনছিল―নেড়ে চেড়ে পরখ করে জলে ফেরত পাঠাচ্ছিল, কিংবা আঁচলে বাঁধছিল, অথবা সুবর্ণর পকেটে ভরে দিচ্ছিল। স্কুলের গেটের সামনের ফুচকা, চুরমুর, হজমিগুলি, বন্ধুরা, ওর তানপুরা, হারমোনিয়াম, ওস্তাদজি, ডোভার লেনে ভোর হচ্ছে―আমজাদ খান সিন্ধু ভৈরবী ধরেছেন―একটা টুকরো শুধু, জলে ফেলছিল অথচ বঁড়শিতে উঠে আসছিল বারবার। একটা ছবি―নেটেই দেখেছিল; ক্যাপশান ছিল―রথস্চাইল্ডস জিরাফ, বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। রেণু পড়েছিল, এই জিরাফরা চুপচাপ―নাকি ইনফ্রাসোনিক সাউন্ড দিয়ে কমিউনিকেট করে। ছবিতে জলের সামনে জিরাফ আর অজস্র পেলিক্যান ছিল―যতটুকু জল, তাতে কেবলই পেলিক্যানের ছায়া। জিরাফের প্রতিবিম্ব স্বভাবতই ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে ।

আজ হনিমুনের তৃতীয় দিনে ছবিটা বারে বারে সুতো ধরে টেনে তুলছিল সে। সেই সঙ্গে আরও একটা ছবি―রিসেন্ট।

ওদের বৌভাতের রাতে, ভিড় টিড় যখন পাতলা, লোকজন পান মুখে দিয়ে ফিরে যাচ্ছে, ডেকরেটরের লোক বালতি গামলা গোছাচ্ছিল আর রেণুকে ফুল সাজানো ঘরে নিয়ে যাচ্ছে ওর ননদ জা; জেঠি শাশুড়ি বললেন, ‘পিন্টু কোথায় গেল ?’

সুবর্ণকে কিছু আগে খেয়াল করেছিল রেণু―স্পিকারে তখন মালকোষ―সানাই; রেণুর পাশে সুবর্ণ পোজ দিয়ে ছবি তুলছিল―সামনে সুবর্ণর পিসেমশাই, পিসিমা―গা মা ধা মা গা মা গা সা শুনতে শুনতে অন্যমনষ্ক হচ্ছিল রেণু। পিসেমশাইয়ের জামাই বলছিল―‘একটু কাছাকাছি দাঁড়ান বৌদি। ও বৌদি ? বৌদি বুঝি গান বাজনা খুব ভালোবাসেন ?’

সেই ফোটোসেশনের পরে সুবর্ণকে আর ওখানে দেখেনি রেণু।

জেঠিশাশুড়ি আবারও বললেন, ‘পিন্টুকে ডাক তো। ফুলশয্যার ধুতি পাঞ্জাবি বের করে রেখেছি, হাত মুখ ধুয়ে পরে নিক, রাত হয়েছে―’

ডাকাডাকি শুরু হলো এর পর। বড় ভাসুরের ছেলে মোবাইল নাচাতে নাচাতে দৌড়ে এল―‘ও ঠাকুমা, দেখবে এসো, কাকু কত খাচ্ছে। কাকিমা, ভিডিও করেছি মোবাইলে, দেখবে ?’

সাড়ে ছ ইঞ্চি স্ক্রিনে সবার সঙ্গে রেণুও দেখেছিল, খানিক আগের জমজমাট জায়গা এখন লম্বাটে আর নিঝুম। খাওয়ার টেবিলে উল্টোনো ফুলদানি, খালি জলের বোতল, হাত মোছার রঙিন কাগজ গড়াগড়ি যায়। সেইখানে সুবর্ণ বসে―সামনে পাঁজা করা রাধাবল্লভি; কোনওদিকে দৃকপাত নেই, বিয়েবাড়ির আলো সানাই ডেকরেটরের লোকজন, দোতলায় নতুন বৌ―সমস্ত যেন লুপ্ত তার চেতনা থেকে―ঘিয়ে পাঞ্জাবি, ধুতিতে দীর্ঘদেহী সুবর্ণ রাধাবল্লভি আর আলুর দম খাচ্ছে গোগ্রাসে, যেন কতকালের খিদে নিয়ে সে বসে―তার গায়ে, হাতে রাধাবল্লভির টুকরা, চিবুক গড়িয়ে, লম্বা গলার অ্যাডামস অ্যাপেল বেয়ে হলুদ একটা লাইন টপ টপ করে পাঞ্জাবি ভিজিয়ে দিচ্ছে।

জেঠিশাশুড়ি বলেছিলেন―‘আহা কখন থেকে উপোস টুপোস, বয়সের ছেলে খাবে না ? তোদের সবেতেই বাড়াবাড়ি―এই তুই আবার মোবাইল নিয়ে খেলছিস ?’ বাকিটা মুচকি হাসি আর গা ঠেলাঠেলিতে চাপা পড়ল। বাচ্চাটাও মোবাইল লুফতে লুফতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।

সে রাতে সুবর্ণ অসাড়ে ঘুমালে নতুন বালিশ চাদর ফুলের গন্ধে শুয়ে রেণু ঐ জিরাফ আর পেলিক্যানের ছবিটা স্বপ্নে দেখেছিল।

তারপর গত সাতদিনে কথা চুমু শরীর সবই হয়েছে―তবু, হনিমুনের তৃতীয় দিনে এই হ্রদের ধারে বেগুনি আকাশের তলায় পেলিক্যানের পাশে ল্যাগব্যাগে জিরাফের ছবি মন থেকে সরাতে পারছিল না রেণু।

শীত শীত করছিল। চাদর টানল সে।

সুবর্ণ বলল―‘এবার ওঠা যাক। সাড়ে আটটায় শুরু হবে বলেছিল না ? মিনিট দশেক লাগবে এখান থেকে অটো নিলে। তার আগে রাতের খাওয়া সেরেনি ?’

সারাদিন ঘোরাঘুরির পরে স্বাভাবিক ভরপেট খেলো দুজনে। রেণু আড়চোখে তার বরকে দেখছিল। ন্যাপকিন, টেবল ম্যানার্সে সুবর্ণ যথাযথ। ওরা অটোয় উঠল―পরদেশি পরদেশি যানা নেহি বাজছে। সুবর্ণ বলেছিল―‘এখনও এই সব গান লোকে শোনে ? এ তো আমাদের ছোটবেলার গান―’

‘আহা কত যেন বুড়ো মানুষ’―রেণু সুবর্ণর গা ঘেঁষে বসল।

হ্রদের পাশ দিয়ে চওড়া রাস্তা গিয়েছে, জল পেরোলেই সরু গলি, অনুজ্জ্বল দোকানপাট, ঘর বাড়ি মানুষজন―দেওয়ালে, দরজায় ছবি আঁকা। সেই সব ঘর দোরের গা ঘেঁষে অটো চলেছে। ছোট ছোট দোকানে দুধ উথলাচ্ছে কড়াইতে, ডাঁই করা জিলিপি, কচুরি, ইয়াব্বড়া লংকাভাজা―পাগড়ি পরা, চুমড়োনো গোঁফ দোকানদার―রেণু বলছিল―‘দেখ, যেন রাজপুত্র, না ?’ ওরা নাক টেনে গন্ধ নিচ্ছিল, হাসছিল অকারণ।

‘উফ যা খেয়েছি আজ।’ সুবর্ণ হাল্কা হেউ করল।

রেণু ব্যাগ হাতড়ে বলল―‘হজমের ওষুধ আছে, খেয়ে নেবে  ?’

‘আরে না। ওষুধ খাওয়ার মতো কিছু নয়।’

সুবর্ণ হাত ধরল রেণুর, আঙুল জড়িয়ে নিল।

অটো থেমেছিল। ওরা গেট পেরিয়ে ভিতরে এল। ছোট একটা ঘাসজমি পেরিয়ে পুরোনো হাভেলি। ভিতরের উঠানে খোলা মঞ্চ ঘিরে শতরঞ্জি, মশা, লোকজন, আলো জ্বলছিল―এই শহরে এসে পুতুল নাচ না দেখে কেউ ফেরে না। ওরা টিকেট কেটে মাটিতে বসল।

ম্লান অনুজ্জ্বল আলো, ঠান্ডা কনকনে মাটি―রেণুর সামান্য হতাশ লাগছিল―হ্রদের ধারে অনেক আলো লোকজন―ঐখানেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল রেণুর। ঠিক সেই সময় জোরালো স্পটলাইট পড়ল মঞ্চে। সারেঙ্গিতে ছড়―সঙ্গে রাবণহাত্তা আর ঢোল―রেণুর মনে হচ্ছিল কোথাও যেন একটা ঢাকনা খুলে যাচ্ছে―প্রথমটায় টাইট ঢাকনা খুলতে যেমন হয় একটু ধীরে ঘটছিল ব্যাপারটা তারপর বয়ামের প্যাঁচের সুতো আর ঢাকনার প্যাঁচ একসঙ্গে চলতে শুরু করল; জোরাল পুরুষালি গলায় গান উঠল পধারো মেরে দেশ―কেশরিয়া।

অমনি খুট করে খুলে গেল ঢাকনা আর বন্যার জলের মতো সুর ঢুকতে লাগল রেণুর শরীরে; তোলপাড় করছিল রক্ত―এই মশা ধুলো ঠান্ডা মেঝের ড্যাম্প লাগা গন্ধ ছাপিয়ে রাগ মান্ড ওকে ভাসিয়ে নিচ্ছিল―সুরে সুরে দুলছিল রেণু , ভাসছিল, স্নান করছিল।

একের পর এক গান, নাচ হচ্ছিল সামনে―রেণুর চোখ সরছিল না―এত সুর এত আলো এত গান এই শীতের রাতে কল্পনাও করেনি।

অনুষ্ঠান শেষ হতে, সে তখনও সুরে সুরে মজে―সুবর্ণর হাত ধরতে গেল রেণু ; সুবর্ণ ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেল একটু দ্রুতই। তারপর রাস্তায় নেমে গতি আরও বাড়িয়ে দিল―যেন দৌড়োবে। রেণু তাল রাখতে হিমসিম খাচ্ছিল।

সে চেঁচিয়ে বলল, ‘কী হলো ? শরীর খারাপ লাগছে ? বাথরুম যাবে ?’

গলিতে তখন লোকে লোকে ছয়লাপ―সুবর্ণকে আর দেখতে পাচ্ছিল না রেণু। অস্বস্তি, দুর্ভাবনা আর বিষাদ জেঁকে বসছিল ওর মনে―কান্না পাচ্ছিল, ঘাম―চাদর খুলে ফেলল সে। গা ঘেঁষে মানুষ, অটো, শিংওলা গরু―অনুজ্জ্বল আলোয় হোঁচট খেতে খেতে যে পথে এখানে এসেছিল সেই পথ খুঁজে ফিরছিল রেণু। সুবর্ণ কোথায় যেতে পারে স্পষ্ট কোনও ধারণা ছিল না তার। সে হাঁটছিল, দ্রুত হাঁটতে গিয়ে তার পায়ে টান ধরছিল, হাঁটু অবশ লাগছিল, মাথার মধ্যে হাতুড়ি পিটছিল কেউ। তবু হাঁটার জোর বাড়িয়ে দিল রেণু।

২.

সাত দিনে এই নিয়ে দ্বিতীয়বার রেণুকে কুহেলির সন্ধ্যা রায় মনে হলো সুবর্ণর। আজ প্রথমে যখন গান শুরু হলো―ঢোলক, সারেঙ্গি, রাবণহাত্তা আর রেণু দুলতে শুরু করল, অনেক দূরের মনে হলো রেণুকে। ঠিক সেদিনের মতো। রেণু দুলছিল; পিছনের দিক থেকে রেণুকে ব্যান্ড মাস্টারের মতো লাগছিল অথবা অপেরার কন্ডাক্টর। সারেঙ্গির সুরে সুরে মেরুন শাড়িতে রেণু সুরের তালে দুলছে, আর সুবর্ণর মনে হচ্ছে রেণু সম্পূর্ণ অন্য কিছু শুনছে; সম্ভবত রেণুর কান বেয়ে একটা পিয়ানোর গমগমে আওয়াজ পৌঁছে যাচ্ছে―রেণু ক্রমশ দূরের হয়ে যাচ্ছে―দূরের এবং রহস্যময়। এরপর একটা ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে রেণু নামবে; পিয়ানো যেখানে বাজছে সেদিকেই যাবে রেণু―নামতেই থাকবে―তাকে আর আটকাতে পারবে না সুবর্ণ―আস্তে আস্তে রেণু কুহেলির সন্ধ্যা রায় হয়ে যাবে।

সুবর্ণ তখন স্কুলে, ওদের টিভি দেখার বড় ঘর, ভনভন মশা, ঠাকুমা পিঁড়িতে বসে মালা জপতে জপতে ঢুলে পড়ছে, এদিকে টিভির চিত্রহারে গ্র্যান্ড পিয়ানোয় বিশ্বজিৎ আর গলা মেলানোর ঠিক আগে সন্ধ্যা রায় ঢাকাই শাড়ি পরে ঘোরানো সিঁড়িতে একলা দাঁড়িয়ে, কাজল পরা বিশাল চোখ―যেন ফিনফিনে চিনেমাটির ডল। পাশের ঘর থেকে মা আর বাবার গলা পাচ্ছিল রোজকার মতো। মা খুব জোরে চেঁচাচ্ছিল, পিয়ানোর আওয়াজ, তুমি রবে নীরবে ছাপিয়ে সেই সব কথা সুবর্ণর কানে আসছিল। মা বলছিল চলে যাবে। বলছিল, এ সংসারে মানুষ থাকে ? বলছিল, ‘আমার গান, আকাশবাণীর অডিশন―সব সব নষ্ট হলো শুধু তোমাদের জন্য।’

সুবর্ণর বুক পেট খালি হয়ে গিয়েছিল―তার মানে ও কেউ নয়। কেউ নয় মায়ের ? ও তবে কে ? মা চলে গেলে ওর কি হবে ? ভয় আর শূন্যতা বালক সুবর্ণ আর কখনও এইভাবে পায়নি―ওর ভয় সেই মুহূর্তে সন্ধ্যা রায়ে শিফট করে গেল―ওর মনে হয়েছিল, যেন একটা ফিনফিনে পুতুল সিঁড়ি দিয়ে নামছে আর নামলেই অবশ্যম্ভাবী পড়বে আর চুরচুর হয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে একদম। ভয়ে কাঁটা হয়ে সুবর্ণ সন্ধ্যা রায়কে সিঁড়ির ধাপেই ফ্রিজ করে দিতে চেয়ে, রিমোট টিপে টিভি অফ করে দিয়েছিল।

রাত ঘন হতে মা ভাত বসিয়েছিল―চোখ লাল, উস্কোখুস্কো এলোমেলো শাড়ি। রান্নাঘরে তেলকালি, কতদিনের ঝুল। ভাতের হাঁড়ির খুব কাছে কান নিলে শোঁ শোঁ শব্দ কানে আসে। সুবর্ণর বুক ফেটে যাচ্ছিল। সুবর্ণ বলতে চাইল―মা, বড় কষ্ট। বলতে চাইল, মা চলে যেও না। অথচ বলল―‘মা ভাত দাও।’

‘রান্না শেষ হয়নি তো। শুধু ভাত খাবি নাকি ?’

বালক সুবর্ণ বলেছিল―‘খুব যে খিদে পেয়েছে, মা।’ তারপর মণ্ড মণ্ড সাদা ভাত উদ্গলায় খেতে শুরু করেছিল। তার লালায় আর চোখের জলে নোনতা ভাত অস্বাভাবিক দ্রুততায় গলায় ঢুকছিল, কখনও আটকে যাচ্ছিল। সুবর্ণ চাইছিল, এই মুহূর্তটা ফ্রিজ করতে―যদি এইভাবে সে ভাত চেয়ে যায়, চেয়ে যেতেই থাকে, মা আর চলে যেতে পারবে না। কোথায় যাবে মা ওকে ভাত না দিয়ে ?

মা যায়নি সেদিন। পরেও নয়। গেল এই তো সেদিন―বাথরুমে গিয়ে সেরিব্রাল স্ট্রোক।

আজ এই পুরানো হাভেলিতে, হনিমুনের তৃতীয় রাতে সুবর্ণর চোখের ওপর রেণু কুহেলির সন্ধ্যা রায় হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ―বড় বড় চোখ মেলে দেখে নিচ্ছিল চারপাশ যেন সুবর্ণর পাশ থেকে উঠে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করবে যে কোনও সময়। সুবর্ণর খুব ইচ্ছে করল রেণুকে জাপটে ধরে বিছানায় নেয়―খুলে খুলে দেখে সব। কী গান ঢুকছে রেণুর কানে, কী বিক্রিয়া করে সেই গান রেণুর অভ্যন্তরে―সব জানতে চাইছিল সুবর্ণ। দেখতে চাইছিল রেণুর সবটুকু, সমস্ত জটিল কলকব্জা, বিক্রিয়া ও ফলাফল। ওদিকে পুতুলনাচ শুরু হয়ে গিয়েছিল। রাজা রানি রাজদরবার আলো করে বসে―আর একটা পেল্লায় সাপ বাঁশিশুদ্ধ সাপুড়েকে জাপটে ধরে গানের সুরে সুরে ওপরে উঠে যাচ্ছিল; এই ভিড় আলো লোকজন আর কাঠপুতলি―সমস্ত ফ্রিজ করে দিতে হবে ঠিক এইখানে―আলো আঁধারিতে পুরোনো টিভির রিমোট হাতড়াচ্ছিল সুবর্ণ, ক্ষ্যাপার মতো। বার কয়েক উঠে দাঁড়নোর চেষ্টা করেছিল, বসে পড়েছিল তারপর।

নাচ শেষ হতে লোকজন উঠে বেরোচ্ছে সবে, রেণুর হাত ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় নেমে স্প্রিন্ট নিল সুবর্ণ।

অন্ধকার রাস্তা ঘাটের খানাখন্দ পেরিয়ে সে দৌড়াচ্ছিল। কনকনে উত্তুরে হাওয়ার ঝাপট লাগছিল মুখে―চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিল। গলির দোকানপাট সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, শুধু ছোট চায়ের দোকানে একটি ছেলে―সুবর্ণর মতোই বয়স―পাকানো গোঁফ, কানে দুল, মাথায় পাগড়ি―যেন এক শাপগ্রস্ত রাজপুত্র―ঝাঁপ ফেলার আগে বারকোষ খালি করছিল, উনুন, মেঝে মুছে, পেডেস্ট্যাল ফ্যান চালিয়ে শুকোচ্ছিল। আগুন নিভে গিয়েছিল, শূন্য কড়াইতে দুধের শুকনো সর পড়েছিল। দোকানের সামনে হাঁফাচ্ছিল সুবর্ণ; ফ্যানের তীব্র হাওয়ায় দোকানঘর কেমন করে শুকায় কোমরে হাত দিয়ে দেখল কিছুক্ষণ। শুকিয়ে যাওয়ার একটা প্যাটার্ন ছিল―সেটা বুঝতে গেলে হাওয়ার গতি, মেঝের মাপ এসব মিলিয়ে একটা অংক কষতে হতো। সে শুধু হাঁফাচ্ছিল আর বাঁ দিক থেকে ডাইনে ভেজা অংশের ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাওয়া দেখছিল।

রাজপুত্র ঘর মোছা থামিয়ে দোকান বন্ধ হয়ে গেছে বলেছিল। তারপর কী ভেবে আঙুল দিয়ে নেভানো আগুনের ওপর ছোট পাত্র দেখিয়েছিল―অগভীর ধাতব, কাচের ঢাকনা বেয়ে জল নামছে ন্যাতানো পরোটায়। তিনটে ঠান্ডা পরোটার প্রথমটি তুলে নিল তারপর ছিঁড়ল―ঘর শুকানোর প্যাটার্নের মতো অনেকটা, বাঁ থেকে ডানে সামান্য ত্যারছা মতো আবার ডান থেকে বাঁয়ে। রাজপুত্র থালা এগিয়ে দিয়েছিল। বাঁ হাতে থালা ধরে টুকরা ভয়, বিপন্নতা আর দুঃখগুলি খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল সুবর্ণ।

রেণু এসে দাঁড়িয়েছিল কখন যেন। সুবর্ণ মুখ তুলে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় বলল―‘ভাত খাব। ভাত দাও।’

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button