
বসার মধ্যে তিনজন মানুষ মুখোমুখি বসে কিন্তু কোনও শব্দ নাই।
বসেছে সেই রাত একটার দিকে, এখন বাজতে চলছে রাত তিনটা। তিনজন মানুষ নীরব, নিথর, বাক্যহীন। একে অপরের দিকে আনমনে তাকায়, কখনও তাকায় জানালা দিয়ে বাইরের আলো অথবা নিরুপদ্রব অন্ধকারের দিকে, অথবা তাকিয়ে দেখছে বাসার হাজার বার দেখা নিরেট স্তব্ধ দেয়ালের দিকে, সময় কেটে যাচ্ছে স্থির করাতের উপর দিয়ে, একটু একটু করে।
আহির আলমের একমাত্র কন্যা বাসনা দেখছে, যদিও বসে বাসার সুসজ্জিত ড্রয়িংরুমে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছে একজন মানুষ রাস্তার উপর হাঁটছে, সেই মানুষটির একটা পা মানে বাম পা নাই। মানুষটি ক্র্যাচে ভর দিয়ে একটু একটু করে, ইঞ্চি ইঞ্চি করে হেঁটে যাচ্ছে। যেতে যেতে পথচারীরা তাকাচ্ছে মানুষটির দিকে, মানুষটি অসহায় আক্রোশে নিজের অথর্ব বাম পা আড়ালে আগলে রেখে দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে যাচ্ছে ক্র্যাচে ভর দিয়ে দিয়ে। চোখের কানির্শে জমছে ফোঁটা ফোঁটা জল, জলের অগ্নিপিণ্ড। কল্পিত দৃশ্যটি আর সহ্য করতে পারে না বাসনা, তীব্র চিৎকারে দুই হাতে মুখ ঢেকে দাঁড়ায়, আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার বাবার বাম পা কেন কেটে ফেলতে হবে ? কেন কেন ? লোকটা তো জ্ঞানত মানুষের কল্যাণ বই কখনও অকল্যাণ করেননি। জীবনটাই বিলিয়ে দিলেন মানুষের জন্য, আমার সেই বাবা কেন এক পায়ে হাঁটবে ?
বাসনার তীব্র অভিব্যক্তি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে করুণ রাত আরও করুণ ও বেদনামথিত রূপ ধারণ করে তাকিয়ে থাকে সিলভিয়া আখতার ও অবিরাম অভির দিকে। সিলভিয়া আখতার মোটামুটি নিম্নমধ্য পরিবারের নাগরিক হিসেবে একটা নিরুপদ্রব জীবন পার করে আসছিলেন, আসতে আসতে জীবনের মধ্যপ্রান্ত অতিক্রম করে তৃতীয় প্রান্তের সীমান্তে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল এ কি সংঘাত! এ কি অপরূপ অন্ধকার! সংসারের প্রিয় মানুষ মারা যায়, যাবে, তুলনাহীন শোকের সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে সংসারের অন্য মানুষ এক সময়ে স্থির হয়, বেদনা অতিক্রম করে। নিজের জীবনের মুখরতায় প্রবেশ করে স্মৃতির স্তূপ বুকে ধারণ করে কিন্তু প্রিয় মানুষ, সংসারের বৃক্ষমানুষ, সুঠাম দেহের মানুষ, রুচি আর সৌন্দর্যের রূপায়ণে অনন্য মানুষ যখন একটা পা হারিয়ে খোঁড়া বা ল্যাংড়া হয়ে চোখের সামনে হাঁটবে, বসবে, হাসবে―হাসবে! কী পরানে সহ্য করবে সিলভিয়া আখতার দৃষ্টির প্রসারিত বীক্ষণে ? চারপাশে দেখা অজস্র মানুষের মধ্যে আহির আলম রুচিতে, হাসিতে, প্রাণের স্পন্দনে এত মুখর একজন মানুষ, কীভাবে সহ্য করবে নিজের এই ক্ষতবিক্ষত শরীরের নিকৃষ্ট দড়িটানা দড়িটানা খেলা ?
সিলভিয়া আখতারের আত্মভাবনায় সাঁতার কাটার মধ্যেই বাসনা ড্রয়িংরুম ছেড়ে নিজের রুমে চলে যায় রোদন আর ক্ষয়িষ্ণু বেদনা সঙ্গী করে, কোন চোখে দেখবে প্রিয় পিতার বাম পা হারানো নৃশংস দৃশ্যাবলি ? মেয়ে বাসনা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সিলভিয়া আখতার জড়িয়ে ধরেন পুত্রকে, অভি ?
মা! পাথরের বুক চিরে বিষণ্ন কণ্ঠস্বর অভির।
কী হবে আমাদের ? মানুষটা নিজেকে সহ্য করতে পারবে না। একটা পা হারিয়ে, ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটবে সুন্দর শালপ্রাংশু মানুষটা, আমি দেখব কেমন করে ?
মা, অভি মায়ের মুখের উপর দৃষ্টি রাখে। জীবনে এই প্রথম মায়ের মুখের উপর গভীর আলোয় প্রখর দৃষ্টি রেখে তাকাল। ইস! মা আমার কী সুন্দর! এমন করে মাকে কখনও দেখিনি। নিজের মধ্যে কাটছে নিজেকে আতশি কাচে রেখে, এত কাছে আমার মা, এক সংসারের চার দেয়ালের মধ্যে কাছাকাছি থাকার কারণেই মাকে এমন করে দেখা হয়নি। কাছে থাকায় সৌন্দর্য হারিয়ে যায় বা দূরে সরে যায়। হাসপাতালে শুয়ে থাকা বাবাই দৃষ্টির অন্ধ দরজা খুলে দিয়েছেন।
কী ভাবছিস অভি ?
মা, এভাবে ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না। বাসনা তো এমনিতেই বাবার ন্যাওটা। ওকে বোঝাতে হবে জীবনের রূঢ় বাস্তবতা। তোমাকেও বুঝতে হবে―একজন মানুষ, আমাদের বাবা, তোমার স্বামী, সংসারের কর্তা বেঁচে থাকবেন আমাদের সঙ্গে, এটাই কি বড় আনন্দ নয় ? নেগিটিভ নয়, অনুগ্রহ করে পজিটিভ জায়গা থেকে বিষযটাকে দেখো। একটা পা থাকল না, তাতে কী! জীবন্ত মানুষটা আমাদের সঙ্গে থাকছেন, তোমার সঙ্গে ঝগড়া করছেন, আমাকে বাসনাকে বকছেন, এটা তো কম নয় মা!
সিলভিয়া আখতার পুত্রকে বুকের সঙ্গে ঝাপটে ধরেন, বাজান! তুই এমন করে ভাবতে পারিস ? তুই তো বড় হয়ে গেছিস।
মৃদু হাসে অভি, কী যে বলো না মা!
সত্যি অভি, তোকে নিয়ে খুব চিন্তা ছিল। কিন্তু তুই আমাকে চিন্তা থেকে মুক্তি দিয়েছিস। সত্যি আমার কোনও ভয় নেই। আহির আলম আমার স্বামী। তোদের বাবা। চাকরি থেকে অবসরে যাবে আগামী বছর, প্রয়োজন মনে করলে আগেই অবসরে যাবেন। তুই চাকরিতে আছিস, আমার বাপের বাড়ি থেকে সামান্য হলেও ভাড়া আসে। বাসনা মাস্টার্স করার পর যদি একটা চাকরিতে ঢুকতে পারে, আমাদের আর ভয় কী ? তোর বাপটাকে আমরা আদরে মমতায় পালন করতে পারব না ?
খুব পারব মা। আর তোমার স্বামী আহির আলম সাহেব কি বসে বসে তামাক খাওয়ার লোক ? শুয়ে বসে একটা না একটা ধান্ধা ঠিকই বরে করে ফেলবে।
সিলভিয়া আখতারের বিষণ্ন মুখের উপর সুখের বাতাসের প্রলেপ বয়ে যায়, তুই ঠিকই বলেছিস অভি। লোকটা বসে থাকার মানুষ না।
তাছাড়া বাবার কত পরিচিতজন আছে, একটা না একটা কাজের পরিধি ঠিকই বের করে ফেলবে বাবা। মাকে সমর্থন করে অভি।
সিলভিয়া আখতার আশ্বস্ত হয়ে সোজা হয়ে বসেন সোফার উপর, কখন কাটবে পা!
সকালেই আমাদের হাসপাতালে যেতে হবে।
সকালেই কাটবে ?
না, দুপুরের দিকে।
কীভাবে কাটবে ? ব্যথায় কুঁকড়ে যাবে না তোর বাপ ?
না, পা কাটার আগে বাবাকে অজ্ঞান করে নেবে।
দীর্ঘশ^াস ছাড়েন সিলভিয়া আখতার, তোর বাবাকে জানিয়ে এসেছিস ?
কী জানাব ?
বাম পা কেটে ফেলবে যে!
মাথা নিচু করে বসে থাকে অবিরাম অভি। সিলভিয়া আখতার ছেলের মুখের দিকে তাকান। বুঝতে পারেন না এই মুহূর্তে অভিকে। নিঃশব্দ কেন ?
কীরে চুপ কেন অভি ?
মা! মাথা তুলে তাকায় অভি, আমি যখন বাবাকে কেবিনে শেষবারের মতো দেখে আসি, তখন বাবা নিঃসাড়ে ঘুমুচ্ছেন। দরজায় দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত বাবার মুখ দেখে আমার মনটা বিষণ্ন হয়ে গেলো, খোঁচা খোঁচা দাড়ি মাখানো কী অসামান্য অসহায়ত্ব আর সৌন্দর্য নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। জাগাতে ইচ্ছে করেনি―
ঠিক করেছিস বাবা, ছেলেকে সমর্থন করেন সিলভিয়া আখতার।
এক ধরনের পালিয়ে আসাও বলতে পারো মা!
মানে ?
নিজের মুখে কীভাবে বলব, বাবা তোমার বাম পা আগামীকাল কেটে ফেলা হবে, তুমি ল্যাংড়া হয়ে যাবে। শুনে বাবার প্রতিক্রিয়া কী হবে, আমি ভাবতে ভাবতে চলে এলেছি বাসায়। জানো মা, আমি সেই আগারগাঁওয়ের পঙ্গু হাসাপাতাল থেকে হেঁটে হেঁটে বাসায় এসেছি।
বলিস কী তুই ?
হ্যাঁ মা।
কেন ? তুই তো হাঁটতে পারিস না। কাঁচাবাজারে গেলেও রিকশায় যাস!
কিন্তু মা দেখো, আমি যে হেঁটে হেঁটে এসেছি, আমার কোনও ক্লান্তি নেই। আমার কষ্ট হয়নি। কেবলই দেখছি বাবাকে। বাবার জোড়া পায়ের হাঁটা, দেখেছি বাবার বাম পাহীন একলা ডান পায়ে হাঁটা। আর দেখেছি রাস্তার লক্ষ লক্ষ মানুষের পা, যে জোড়া পায়ের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অত্যন্ত আনন্দে, হাসতে হাসতে। বন্ধুর সঙ্গে গল্প করতে করতে, বাদাম খুঁটতে খুঁটতে। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অজস্র মানুষ কল কল করছে, পা নাড়াচ্ছে আর সিগারেট টানছে। মা, জীবনে প্রথম দেখলাম মানুষের পা নাড়ানোর সৌন্দর্য। পা নাড়ালে কত চমৎকার লাগে! মনে হয় ঝরে পড়া তেজপাতার বনে সবুজ বাতাস লেগেছে।
দুঃখের মধ্যে মৃদু হাসেন সিলভিয়া আখতার, তুই কবিতা লিখিস নাকি ?
মাকে এখনও বলা হয়নি নির্মলা মণ্ডলের গল্পটা, কতোবার প্রস্তুতি নিয়েছে, আজ বলবেই কিন্তু মায়ের সমুখে দাঁড়ালেই ভেতরের সত্তা থেকে বলে―হারামজাদা বলিস না, বলিস না। বললে তোর মায়ের নিঃশ^াস বন্ধ হয়ে আসবে। তোর মা তোর জীবনে নির্মলা মণ্ডলের আগমন সহ্য করতে পারবে না। করুণ চিৎকারে বলবে, পেটে শত্রু ধারণ করেছিলাম। আর বলা হয় না। মাকে বলা হয় না, নির্মলা মণ্ডলকে মাঝে মাঝে ইনব´ে কবিতা লিখে পাঠায়। নির্মলা হাসে আর কবি সুড়সুড়ি ডাকে। কিন্তু এই মুহূর্তে কবিতা বলে কিছু নেই, সব ঝামা ঘষা তীব্র ইটের পাঁজর। আগামীকাল বাবার বাম পা কেটে ফেলা হবে। হা ঈশ^র!
মা!
কী ?
রাতে কিছু খেয়েছো ?
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে, চোখের মধ্যে দৃষ্টি ফেলে দেখতে থাকেন সিলভিয়া আখতার, আহির আলম বাম পা হারিয়ে একটা ক্র্যাচ নিয়ে হাঁটছেন, হাঁটছেন আর হাঁটছেন। নির্মল মুখে রাজ্যির বিরক্তি আর পথের পাথরের উপর তীব্র ঘৃণা রেখে হেঁটে যাচ্ছেন। অথচ মানুষটা পথে নামলেই হয়ে যেতেন বিরহী বাউল, চা খেতে খেতে ফুটপাথের চাঅলার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিতেন। রিকশায় যেতে যেতে রিকশাঅলার ঠিকুজি জেনে নিতেন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে। এক রিকশায় থাকলে ভীষণ বিরক্ত হতেন সিলভিয়া আখতার, তুমি থামবে ?
হাহাহা হাসিতে ফেটে পড়েন আহির আলম, সিলভিয়া তুমি যদি জগৎসংসারের খবর জানতে চাও, পথের এইসব নির্মল মানুষদের সঙ্গে আলাপ করবে, গল্প করবে, বের হয়ে আসবে সাজানো গোছানো সংসারের মধ্যে ওৎ পেতে থাকা থলের বাঘ।
মা উত্তর দিচ্ছো না কেন ?
কী বলছিস ? সিলভিয়া আখতার ফিরে আসেন কল্পবাস্তবতার দুয়ার থেকে।
রাতে খেয়েছো ?
মনেই ছিল না… উদাস আর নির্লিপ্ত স্বরে জবাব দেন তিনি।
হাত ধরে অবিরাম অভি, চলো খাব। আমারও খিদে পেয়েছে খুব। জানো, খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে অথচ খাবার খাওয়ার ব্যপারটা মনেই ছিল না। তুমি বলার পরা খিদেটা তীব্রভাবে ফিরে এসেছে।
মা ও ছেলে ভেতরের ডাইনিং টেবিলে বসে। টেবিলের উপর বসে ভাতের সঙ্গে ভাজা ইলিশ মাছ দিয়ে দু’জনে খায়। খেতে খেতে অভি আবার প্রশ্ন করে, মা কে বলবে ?
কী বলবে কাকে ? মুখের ভাত চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করেন সিলভিয়া আখতার।
বাবাকে ?
কোন বিষয়ে ?
তুমি ভুলে গেলে ? বাবার পা কাটার বিষয়ে―বাবাকে কে বলবে ?
আমি জানি না। তুই বল।
অসম্ভব, আমি পারব না। মুখের ভাত গিলে স্থবির বসে থাকে অবিরাম অভি, কীভাবে আমার মুখ দিয়ে বাবাকে এমন পরিস্থিতি বর্ণনা করব ? বলব, তোমার বাম পা কেটে ফেলা হবে, অসম্ভব, আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
কিন্তু মানুষটাকে তো জানাতে হবে, তীব্র চোখে তাকান ছেলের দিকে সিলভিয়া আখতার। না জানিয়ে পা কেটে ফেলা সম্ভব ? সারা জীবন একটা অপূরণীয় বেদনার মধ্যে থাকতে হবে―
বুঝতে পেরেছি মা, দ্বিধার পাথরে কাটতে থাকে অবিরাম অভি। খাওয়া শেষ করে তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলো। সকাল দশটার মধ্যে হাসপাতালে পৌঁছুতে হবে।
চল, হাত ধুয়ে উঠে পড়েন সিলভিয়া আখতার, একটা দীর্ঘশ^াস বেরোয় বুক চিরে, জানিস অভি―আমার মনে হচ্ছে একজন মানুষের বাম পা কেটে ফেলতে হবে জানানোর চেয়ে মৃত্যুর খবর দেওয়া অনেক সহজ।
পানি পান শেষে টেবিলের উপর গ্লাস রাখতে রাখতে অভি মায়ের কথার প্রতিধ্বনি তোলে, আর সেই মানুষটিই যদি হয় পিতা বা স্বামী। হাই তুলতে তুলতে বিছনার দিকে চলে যায় অভি। কিন্তু নিজেদের রুমে ঢুকে আর বিছানায় বসতে পারেন না সিলভিয়া আখতার, খাটের উপর সাদা ধবধবে বিছানার উপর তাকিয়ে থাকেন তিনি, এই বিছানায় এখন আমরা তিন পা নিয়ে ঘুমাব! অস্ফুট হাহাকারে বিছানার দিকে তাকিয়ে থাকেন সিলভিয়া আখতার। যেদিকে দৃষ্টি ফেরান, যা কিছু ভাবেন―দেখতে পান আহির আলম বাম পা বিসর্জন দিয়ে এক পায়ে হাঁটছেন… সকল বোধনের কেন্দ্রবিন্দু বাম পা, আহির আলমের বাম পা। চোখে ঘুমের তীব্র সাড়া, দাঁড়াতে পারছেন না কিন্তু বিছানায় তিন পায়ের দৃশ্যাবলি করোটির খোপে বাসা বাঁধায় সিলিভিয়া আখতার রুম থেকে বের হয়ে কন্যা বাসনার রুমে যান। নিজেদের রুমে থাকতে কেমন এক অশরীরী ভয়ার্ত বোধ সিলভিয়াকে তাড়া করে ফেরে। কন্যা বাসনা রুমের বিশাল খাটের মাঝখানে তীব্রবেগে ফ্যান ছেড়ে ঘুমিয়ে কাদা। মেয়ের মাথার কাছে একটা বালিশ শুয়ে ছিল বিড়ালের কায়দায়, টেনে নিজের মাথার নিচে দিয়ে শুয়ে পড়লেন সিলভিয়া আখতার। সঙ্গে সঙ্গে বাসনা মাকে জড়িয়ে ধরে দু হাতে ঘুমের মধ্যে। বাসনার জড়িয়ে ধরায় খুব অবাক হলেন সিলভিয়া। সাধারণত বাসনা নিজের বিছানায় কাউকে শেয়ার করে না, আমি কারও সঙ্গে ঘুমুতে পারি না বিছানায়। কখনও ঘুমাতে গেলে প্রায় ঝগড়া করে মাকে ঠেলে পাঠিয়েছে পিতার কাছে, আমি না ঘুমাতে পারলে কালকের ক্লাস করতে পারব না। তুমি বাবার কাছে যাও।
নিজের সংসারে নিজেকে আরশোলা মনে করে সিলভিয়া আখতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মেয়ের রুম থেকে বের হয়ে আসেন। অবশ্য সকালে পুরো বিষয়টা নিয়ে তুমুল ঝগড়া চলে, কেন আমাকে বাসনা বের করে দিয়েছে রুম থেকে। অত বড় খাট, আমি একটু শুইলে কী এমন সমস্যা ?
বাসনা যদিও কৈফিয়ত দেয়, আমার অভ্যাস। তুমি সারাদিন আমার রুমে গিয়ে ঘুমাও। কেউ নিষেধ করছে না।
ফাজলামো আমার সঙ্গে ? ঘুমানো দরকার রাতে আর তুই বলছিস দিনে ঘুমুতে ? বজ্জাত মেয়ে, সর চোখের সামনে থেকে।
বাসনা নিজের রুমে এসে বসে থাকে। প্রকৃত ঘটনা, রাতে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কতো ধরনের সংলাপ হবে, মা রুমে থাকলে কীভাবে সম্ভব ?
মেয়ের আজকের আচরণে অকারণে চোখের কোণে পানি জমে সিলভিয়া আখতারের। বুঝতে পারেন, পরিস্থিতির কারণে সংসারের ছিন্ন সূত্র এইভাবে জোড়া লেগে যায়।
সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনজনই দ্রুত হাসপাতালে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে খাবার টেবিলে বসে। অনেক অনেক দিন পর তিনজনে এক টেবিলে একই সময়ে বসে নাস্তা খাচ্ছে। অভি কখন ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খাবে, অভিও জানে না। দেখা যায় যখন ঘুম থেকে ওঠে অভি, তখন দুপুর। সুতরাং ঘুম থেকে উঠে বাথরুম সেরে দুপুরের এবং সকালের খাবার একই সঙ্গে খায়। সকালে উঠে ইউনিভার্সিটিতে চলে যায় বাসনা। আহির আলমের নাস্তা নির্ভর করে অফিসের গাড়ি আসা যাওয়ার সময়ের উপর। সিলভিয়া আখতারের নাস্তা খাওয়ার নির্দিষ্ট টাইম নেই―সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা…।
আহির আলমের বাম পা একটি সংসারের তিনজন মানুষকে জটিল সমীকরণে ফেলে দিয়েছে। প্রত্যেকে টাইম ফ্রেমের মধ্যে দু-এক দিনের জন্য হলেও আটকে গেছে, উড়ানচরের স্বাধীনতা হারিয়ে গেছে যখন তখন খাওয়ার ও ঘুমানোর ঘোরে।
সকালের নাস্তা খেতে খেতে বাসনা প্রশ্ন করে, বাবা কি নাস্তা খেয়েছে ?
খাওয়ার কথা তো। কারণ, হাসপাতাল থেকে খাবার দেবে, উত্তর অবিরাম অভির।
তোর বাবা যে রুচির মানুষ, হাসপাতালের খাবার কি খেতে পারবে ?
সিলভিয়া আখতারের কথা শেষ হতে পারে না, ঢুকে যায় অভি, মা তোমাকে বলি শোনো। মানুষের মতো অভ্যস্ত প্রাণি পৃথিবীতে খুব আছে। বাবাও পরিস্থিতির কাছে সমর্পিত একজন মানুষ―বুঝেই গেছে, আমি আছি হাসপাতালে, বাসায় নয়। সুতরাং এখানের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে।
ঠিক আছে, চল। খাওয়া শেষ করে তিনজনে দ্রুত বের হয়ে পড়ে। দরজায় তালা লাগিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পাশের বাসার সিমলার মা এসে প্রশ্ন করে, এত সকালে সবাই মিলে কোথায় যাচ্ছেন ?
হাসপাতালে যাচ্ছি আন্টি, উত্তর দেয় বাসনা।
অবাক সিমলার মা, হাসপাতালে কেন ?
বাবা হাসপাতালে ভর্তি, অভি জবাব দিয়ে হাত ধরে সিলভিয়া আখতারের, মা দেরি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি চলো।
কী হয়েছে তোমার বাবার ? মহিলা জোঁকের মতো ছেঁকে ধরেছে।
পায়ের সমস্যা―
বাম পায়ের সেই ব্যথাটা ? সিমলার মা কনফার্ম করতে চাইছে।
জি, অনেকটা জোর করেই অভি মায়ের হাত ধরে টেনে গেটের বাইরে নিয়ে যায়। পিছনে পিছনে বাসনা। কিন্তু সিমলার মা গেট পার হয়েও ওদের পিছনে পিছনে আসছে, আপা, ভাই যে হাসপাতালে জানালেন না তো!
মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে ওঠে অভির, জানালে কী হতো ? আপনি ফল মিষ্টি নিয়ে দেখতে যেতেন ? আবার বাবার পায়ের ব্যথা কমে যেত ? দেখতে পাচ্ছেন আমরা দ্রুত হাসপাতালে যাবার চেষ্টা করছি, কিছুক্ষণের মধ্যে বাবার বাম পায়ের অপারেশন―
সিমলার মা অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। অভিকে ধমক লাগান সিলভিয়া আখতার, চুপ কর। মুরব্বি মানুষ।
গলি থেকে মেইন রাস্তায় আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা অটো পেয়ে গেলে, প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে শেরে বাংলা নগরের পঙ্গু হাসপাতালে পৌঁছে যায় অভিরা। অটোর ভাড়া মিটিয়ে তিনজনে লিফটের সামনে দাঁড়ায়, সঙ্গে সঙ্গে লিফটও পেয়ে যায়। ডাক্তার অসীম কুমারের রুমের মধ্যে ঢুকতেই বলেন, আমি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি। একটা ছাপানো কাগজ এগিয়ে দিয়ে তাকান সিলভিয়া আখতারের দিকে, আপনি কি আহির আলমের স্ত্রী ?
জি।
আপনি এখানে সই করুন, কলম এগিয়ে দিলেন ডাক্তার অসীম।
কলম হাতে নিয়ে তাকান সিলভিয়া ছেলে ও মেয়ের মুখের দিকে। দ্বিধায় আক্রান্ত তিনি, কেন সিগনেচার ? মায়ের অভিব্যক্তি বুঝতে পেরে প্রশ্ন করে অভি, আমি তো গতকাল বাবার বাম পা কাটার সম্মতিপত্রে সিগনেচার করেছি। আজ আবার কেন ?
আপনার চেয়ে আপনার মা সংসারের বড়, তারও একটা সম্মতিপত্র থাকল আমাদের কাছে, হাসলেন ডাক্তার।
ঠিক আছে, মা সই করো।
সিলভিয়া আখতার সম্মতিপত্রে সিগনেচার করে বলেন, তোর বাবার সঙ্গে দেখা করি, চল।
হ্যাঁ, আপনারা কেবিনে যান, আমি আসতেছি।
তিনজন ডাক্তারের রুম থেকে বের হওয়ার সময়ে ঘুরে দাঁড়ায় অভি, আংকেল একটা বিষয় আলাপ করতে চাই।
করো।
বাবার যে পা কেটে ফেলা হবে, বাবা তো জানেন না। ওনাকে তো জানানো দরকার।
অবশ্যই জানানো দরকার।
আমরা কেউ জানাতে পারব না, করুণ চোখে তাকায় ডাক্তারের চোখের দিকে অভি। যদি আপনি…
ওকে, তোমাদের হয়ে আমিই বলব। কোনও সমস্যা নাই।
বুকের উপর থেকে একটা ভারী পাথর নেমে যায় তিনজনের। বের হয়ে আসে ডাক্তারের রুম থেকে। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে সাত তলায় উঠে আহির আলমের কেবিনের সামনে যায় তিনজন। দরজায় টোকা দিয়ে ঢোকে অভি, সিলভিয়া আখতার ও বাসনা। একটু আগে তিনি নাস্তা সেরেছেন। পাশে দাঁড়িয়ে নার্স একটা ইনজেকশন পুল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু রুমের মধ্যে একসঙ্গে তিনজনকে দেখে অবাক আহির আলম, তোমরা ?
মাথার কাছে দাঁড়ান সিলভিয়া আখতার, তোমাকে দেখতে এলাম।
ভালো করেছো। গতকালের চেয়ে সতেজ মনে হচ্ছে আহির আলমকে। বলেন, জানো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে নিজেকে কেউকেটা মনে হচ্ছে। এত যত্ন কেমন যেন বেশি বেশি লাগছে। আরও অবাক ঘটনা, পুরো সংসার চলে এসেছে, যা আমাদের সংসারে এক অসম্ভব কাব্য।
আংকেল, ইনজেকশনটা পুশ করি ?
ও হ্যাঁ, করুন, বাম হাতটা এগিয়ে দেন আহির আলম। নার্স অনেক সময় নিয়ে খুব ধীর লয়ে ইনজেকশনটা পুশ করে। পুশের জায়গায় ডলতে থাকে নার্স। আহির আলম বিছানায় সোজা শুয়ে আছেন। পুত্র, কন্যা, স্ত্রী দেখছেন আহির আলমের পা জোড়াও চুপচাপ পড়ে আছে সাদা চাদরের নিচে। হয়তো আধাঘণ্টা আর এক ঘণ্টা পর দুই পা থেকে বাম পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, একটা পা নিয়ে…
রুমের মধ্যে ঢোকেন ডাক্তার অসীম কুমার। দাঁড়ান আহির আলমের বেড ঘেষে, তাকান তীক্ষè চোখে, কেমন আছেন ?
ভালো! উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ আহির আলমের।
আপনার বাম পা কেটে ফেলা হবে কিছুক্ষণের মধ্যে। অনেক পরীক্ষা করে দেখলাম আপনার বাম পায়ে অনেক ব্যাকটেরিয়া জন্মেছে, না কাটলে এক সময়ে আপনার পুরো শরীর আক্রান্ত হতে পারে। তখন তো সমস্যা আরও কঠিন হবে। সেই কঠিন পরিস্থিতির আগে বাম পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলাই উত্তম।
কাটুন, বেশি রকমের যত্নআত্তি দেখেই বুঝতে পারছিলাম একটা কিছু ঘটবে। ঘটবে যখন, ঘটুক। অনেক বছর তো দুই দিয়ে দুনিয়াটা দেখলাম, এখন না হয় এক পা দিয়ে দেখব, কী বলেন ডাক্তার―নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাব… দুই পায়ের এক পা হারিয়ে ল্যাংড়া হওয়ার অভিজ্ঞতা চাইলেও কোটি কোটি মানুষ নিতে পারবে না কিন্তু আমি পারব, তাই না ডাক্তার ? হাহাহাহা হাসিতে ফেটে পড়লেন আহির আলম। হতভম্ব ডাক্তার নার্স আহির আলমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে আহির আলমের হাসির শব্দে হাসপাতালের দেয়ালের ইট খসে খসে পড়ছে, চারদিকে ধুমুন্ধুর শব্দের স্রোত…।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ