অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

বিপন্ন প্রজাতি : কেস ৪৭৪০১ : ক্রিস্টাল উইলকিন্সন

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প

বাংলা অনুবাদ : অমিতাভ চক্রবর্ত্তী

[ক্রিস্টাল উইলকিন্সন একজন আমেরিকান সাহিত্য-গবেষক; দি বার্ডস অফ অপুলেন্স, ওয়াটার স্ট্রিট, ব্ল্যাকবেরিজ্, ব্ল্যাকবেরিজ্ প্রভৃতি উপন্যাসের জন্য পদকজয়ী লেখক। তাঁর দি বার্ডস অফ অপুলেন্স উপন্যাসটি সাহিত্যে উৎকর্ষতার জন্য ২০১৬ সালের আর্নেস্ট জে. গেইন্স পুরস্কার অর্জন করে। জন ডস প্যাসোস পুরস্কার, দি অরেঞ্জ পুরস্কার, হার্স্টন/রাইট লিগ্যাসি পুরস্কার প্রভৃতি বিভিন্ন পুরস্কারের জন্য মনোনীত এই লেখিকা অ্যাপালাসিয়ান সাহিত্যের জন্য চ্যাফিন পুরস্কার অর্জন করেন। একাধিক পুশকার্ট পুরস্কারের জন্য মনোনীত মিস উইলকিন্সনের ছোট গল্প, কবিতা এবং প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য পত্রপত্রিকায় এবং সাহিত্য সংকলনে, যেমন খুব সম্প্রতি দি এমার্জেন্স, অগ্নি, স্টোরি, অক্সফোর্ড অ্যামেরিকান ইত্যাদিতে। বর্তমানে তিনি কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়েটিভ রাইটিং প্রোগ্রামের এমএফএ-তে ইংরেজির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে অধ্যাপনা করছেন।

২০২১ সালে বর্তমান গল্পটির জন্য তিনি ‘ও হেনরি’ পুরস্কার পান। গল্পটি তিনি লেখিকা, তথ্যচিত্র নির্মাতা, সমাজ-সংস্কারক এবং অধ্যাপক টোনি কেড ব্যাম্বারাকে উৎসর্গ করেছেন।]

টোনি কেড ব্যাম্বারার জন্য

আমরা যারা কালো মেয়ে, তাদের ভিতরে ভিতরে এই গুনগুনানিটা সবসময় চলতে থাকে, কারও নজরে পড়ে না যদিও। পৃথিবীর ইতিহাস মনে রাখলে এটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা না। কিন্তু চলতে চলতে একটা দিন আসে যখন আমাদের পেটের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা গুঞ্জনটা আর আমরা চেপে রাখতে পারি না, শত চাইলেও পারি না। আর তখনই হয়তো তোমাদের স্ট্যাচু অফ লিবার্টির মাথায় চড়ে বসে কেউ। হয়তা বা তোমার অত্যাচারী স্বামীটি বুলেটে এ ফোঁড় ও ফোঁড় হয়ে যায়। কিংবা ধরো, সেই যে মেয়েটি যাকে তার ম্যানেজার বলেছিল যে জটা করে চুল বেঁধে আসা চলবে না, সে ঐ লোকের মুখের উপর তার গাড়োলপানা চাকরিটি ছুঁড়ে দিয়ে বেরিয়ে চলে যেতে পারে।

সেই দিন মেয়েটি এক কোনায় কুঁকড়ে বসে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলতে পারে কোন এক অচেনা কালো মেয়ের জন্য যাকে আবারও কোথাও মেরে ফেলা হয়েছে। কারণ মেয়েটি তার নিজের বোন বলে মনে হয়, কিংবা আন্টি কি কাজিন। হয়ত মেয়েটিকে দেখতে পাবে কোন এক প্রতিবাদ মিছিলের সামনের সারিতে হেঁটে চলেছে, যে হতচ্ছাড়া কাণ্ড সে এর আগে কোনও দিন কিছু করেনি, আজ করছে―উত্তাল, দৃপ্ত মহিমায় এবং রীতিমত দাপটের সঙ্গে। আর সেই সময় যখন তুমি দেখবে তাকে, যেন কোনও এক দেবীপ্রতিমা সে, প্রবল গর্জনে চিৎকার করে চলেছে যতক্ষণ না তার গলা ভেঙে গেছে তখন কেন করছ না জেনেই সেই মেয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া ছাড়া তোমার আর কোনও উপায় থাকবে না। কিন্তু যেটা তোমার কোনও ধারণাতে নেই সেটা হলো এই গুনগুনানি আমাদের মাথার ভিতর সবসময় হয়ে চলেছে। আমার নতুন রান্নাঘরে সকালের খাবার বানানোর সময় সেদিন ঠিক চিন্তাগুলোই আমার মাথায় ভেসে উঠল। আমি নিশ্চিত, এটা হতে পারে না যে সে দিনই প্রথম কোনও কালো মেয়ে তার নিজের সত্তার গহিন অন্তর আবিষ্কার করল কিন্তু আমার জন্য এই অনুভূতি সেই প্রথম।

বড় ভি মানে আমার বর, তার কাজের জায়গায় ক্রমাগত উপরে উঠছিল। কিন্তু আমার কখনওই নিজের লোকজনদের থেকে খুব দূরে থাকার ইচ্ছ ছিল না। ওর এই হালের পদোন্নতির আগে অবধি আমাদের দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারটায় আমরা ঠিকঠাকই মানিয়ে নিয়েছিলাম, যেন আমাদের দুজনের কারওই প্রথম বিয়ে বলে কিছু ছিল না। কিন্তু যবে থেকে আমরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে নুতন জায়গায় উঠে এসেছি, আর বিগ ভি ক্যালানের মতো আচরণ করতে শুরু করেছে, কিছু একটা আমার পেটের মধ্যে লতিয়ে এসে উঠেছে আর সেখানে ঘাঁটি গেঁড়ে বসে গুনগুন করে চলেছে।

সেই সকালে বড় ভির মেজাজ ভালোই ছিল। মানে ওর পক্ষে যতটা ভালো হওয়া সম্ভব আরকি। নতুন সোফাটায় ছেৎরে পড়ে খবরের কাগজে ডুবে ছিল, পায়ের বুটজোড়ার একটা সোফার কুশনে গেঁথে আছে আর অন্যটা মেঝেয় গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমার বলতে ইচ্ছা করছিল, ‘ভিনসেন্ট পিকেন্স, পোড়াকপাল সোফাটা থেকে তোমার ঠ্যাংটা সরাও দিকি!’ কিন্তু আমি টের পাচ্ছিলাম আমার পেটের কাছে চামড়ার তলায় তলায় কিছু একটা কাঁপছে, তিরতির করছে, আমি তাই ভির বদলে সেইদিকে মন দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দুমাস হয়ে গেল নতুন বাড়িটায় এসেছি আমরা আর এখন ঐ বসে আছে আমার লোকটি, ইস্ত্রি-করা ইউনিফর্ম, তাতে সাদা রঙের পকেটের উপর নীল হরফে সদ্য সদ্য তার নিজের নামটি লেখা হয়েছে, পরিষ্কার কামানো মুখ, মাথার চুল নিজের হাতে থাক থাক করে সাজানো, বকবক বকবক―সমানে মুখ চলছে, বুটজুতোগুলো ফার্নিচারের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, সবকিছুতে ঔদ্ধত্যের ছাপ একেবারে ফুটে বের হচ্ছে।

ইউনিফর্মে ওর নামের নিচে গোল বাঁকানো হরফে হাতের লেখার ঢঙে ছোট ছোট করে যে সুপারভাইজার কথাটা লেখা আছে, খুব ভালো করে নজর না করলে সেটা আপনার চোখে নাও পড়তে পারে কিন্তু ওর প্রতিটি নড়াচড়ায় আপনি বুঝে যাবেন যে সে একজন সুপারভাইজার। এমনকি ওর গায়ের ঐ ভুরভুর করা কোলন থেকেও সুপারভাইজার মার্কা গন্ধ বেরোচ্ছে। ভাজি বানানোর জন্য আলুগুলো কেটে তাওয়ায় ছাড়ছিলাম আমি, নিজের হাতের দিকে নজর করলাম, কাঁপছিল সে দুটো। সেই সময় আমার সবচেয়ে বেশি মন চাইছিল আমার মার সঙ্গে দুটো কথা বলতে কিন্তু আমি রান্নাটা চালিয়ে গেলাম। জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, পিছনের উঠানে ছ’টা রাস্তার বেড়াল নিজেদের গা পরিষ্কার করছিল আর মাঝে মাঝে শরীরগুলো টানটান করে আড়মোড়া ভাঙছিল। ছাই রঙা একটা আবার ভিতর-বারান্দার চেয়ারটায় আরাম করে চড়ে বসেছিল, মোটাসোটা গোলগাল, অহংকারে মটমট করছে। বেড়ালগুলো প্রায় রোজই পিছনের উঠানটায় চক্কর মেরে যায়, যাতে ওদের সঙ্গে একটা চেনা-পরিচিতি গড়ে ওঠে। যবে থেকে আমরা এখানে এসে উঠেছি, ওরাও ঐখানেই অবস্থান নিয়েছে। বড় ভি ওদের কখনও নজর করে দেখেনি কিন্তু আমি দেখেছি।

‘উন্মাদ’, সেই সকালে বলে উঠল বড় ভি, ‘মাতৃজঠরহীনগুলো!’ আমায় শুনিয়ে শুনিয়ে কোনও রাজনৈতিক নেতাটেতা কারও সম্পর্কে রাগ উগরে দিচ্ছিল। দেখলে মনে হবে ওদের কারখানায় মজুরদের দল চালাতে নয়, দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য নির্বাচনে নামতে যাচ্ছে সে। ফালতু খিস্তি করে যাচ্ছে, বুকনি ঝেড়ে যাচ্ছে, ‘আমাদের চেনা দিনকাল খতম এবার। বলে দিলাম আমি। মাতৃজঠরহীনগুলোর মাথা খারাপ। লোকটাকেই ধরো না, আমাদের কাজের ওখানে, না-থান-ইয়েল, মনে আছে তোমার, বলেছিলাম, এই না-থান-ইয়েলের কথা ?’ দি হেরাল্ডের পাতা থেকে আমার দিকে ত্যারচা করে তাকিয়ে মুখটা তুলল সে, যেন আমার কাছ থেকে উত্তরের অপেক্ষা করছে। ‘বে-ই ?’ বলে উঠল সে। আমি আমার টি শার্টের সামনেটায় হাত দুটো মুছে নিলাম, আলুগুলো খন্তা দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে দিলাম, পেঁয়াজকুচি ছেড়ে দিলাম কিছু। ও বকবক করে চলল, আর আমি মাঝে মাঝে হুঁ হুঁ, জানি তো, ঠিকই বলেছ সোনা, এই করে চালিয়ে গেলাম কিন্তু আসলেই আমি যা শুনছিলাম তা হলো আমার নিজের ঘাড়ের দপদপানি।

আমি জানলা দিয়ে আবার বাইরে তাকালাম এবং দেখলাম বেড়ালগুলো হাওয়া হয়ে গেছে।

আমাদের খুকিটা যতক্ষণে লটরপটর করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল, আমি বিস্কিটগুলো পুড়িয়ে খাক করে ফেলেছি। এতদিন যেভাবে রেঁধে এসেছি, আজও সেভাবেই রেঁধেছি তবু পুড়ে গেল। নতুন উনুনটার জন্যই হলো মনে হয়। খাবার টেবিলে এসে খুকি ওর পিঠের ব্যাগটা একটা চেয়ারের উপর ছুঁড়ে ফেলে, থপ করে আরেকটা চেয়ারে বসে পড়ল।

‘কবে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি আমরা ?’ বলল সে আর তার অপূর্ব সুন্দর চোখ দুটো বড় ভির দিকে তুলে ধরল। তিনি এতক্ষণে প্রাণভরে প্রচারকার্য চালানো শেষ করে এই মাত্র টিভিতে মন দিয়েছেন। বড় ভি খুকির নিজের বাবা নয়, কিন্তু চার বছর আগে আমাদের বিয়ের দিন থেকে এই লোকটি ওর জীবনের সঙ্গেও জুড়ে গেছে। একে অপরকে ওরা মেনে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু সেটা অনেকটা গির্জার সদস্যরা যেমন পরস্পরকে সহ্য করে নেয় সেই রকম, সত্যিকারের নিজের পরিবারের লোকজনদের মতো করে নয়। বা তখন অন্তত সেই রকমই মনে হতো।

খুকির দিকে তাকাল সে। আমি বিস্কিটগুলো জঞ্জালের পাত্রটায় বিসর্জন দিলাম। আমার পূর্বসুরী মহিলাদের যে দীর্ঘ সারি বেয়ে পৃথিবীতে এসেছি তাদের কথা ভাবলাম আমি। আদিযুগের বড়সড় তাগড়াই গ্রাম্য মেয়ে―চওড়া হাড়ের কাঠামো, সরু সরু ঠ্যাঙের দুরন্ত রাঁধুনি আমরা। আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছিলাম আমার নানিকে, পাহাড়ের বুকে তাঁর রান্নাঘরে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে দেরাজের আংটাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন, পাউরুটি তৈরি হওয়ার গন্ধ সারা বাড়ি জুড়ে ঢেউয়ের মতো ভেসে যাচ্ছে আর আমরা সবাই খাবারের জন্য অপেক্ষা করে আছি। বুকের ভিতর আমার হৃৎপিণ্ডটা টিকটিক করছিল, কখনও আস্তে, কখনও জোরে আর আমার মনে হচ্ছিল, পেটের ভিতরের গুনগুনানিটা নাগাড়ে পাক খেয়ে চলেছে, কাঁচের জলপাত্রের ভিতর ঘুরে চলা গোল্ডফিশের মতো।

দোতলায় ছোট ভি এই সময় ওর ঘর থেকে কান্না জুড়ে দিল আর ভাজির তাওয়াটা আমার হাত ফস্কে মেঝেতে পড়ে গিয়ে একটা টাইলসের কোনাটা ভেঙে দিল, নতুন বসানো টাইল, সাদা, এক মিনিট আগেও ঝকঝক করছিল যেন টিভি থেকে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, গেল।

‘নিকুচি করেছে’, বলে উঠল বড় ভি আর আমার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকল কিন্তু আর কিছু বলল না। সকালের খাওয়া ঠাণ্ডাই সারতে হলো আমাদের যার জন্য এখন আমার আফসোস্ হচ্ছে। আরও আফসোস্ হচ্ছে যে ও বেরিয়ে যাওয়ার সময় আজকে আমরা চুমুটাও খাইনি।

সেই সকালে আরও পরের দিকে ছোট ভি যখন বসার ঘরের কার্পেটে নিজের মনে খেলছিল আমি কার্ডবোর্ডের বাক্সগুলো গ্যারাজের এক কোনে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছিলাম আর আমার নিজের দামি বা পছন্দের জিনিসগুলো রান্নাঘরের মেঝেয় আমার চারদিকে গোল করে সাজিয়ে রাখছিলাম। আমার মামনি সারার একটা ফটো আর মায়ের নিজের একগুচ্ছ হলদে হয়ে যাওয়া রেসিপি কার্ড, টেবিল সাজানোর সাদা লিনেন ভরা একটা না খোলা বাক্স যেটা সম্ভবত কেউ আমাদের বিয়েতে উপহার দিয়েছিল, আরও নানা রকম জিনিস যেগুলো কোনও না কোনওভাবে আমার কাছে বিশেষ কিছু। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া নানারকম জিনিস যখন দেখছিলাম আমি, বসার ঘরের জানালা দিয়ে নজরে এল―আমাদের বাড়ির সামনের হাঁটা-পথ ধরে এক সাদা মহিলা আলুথালু হেঁটে আসছে। চিবুক ঘিরে থাকা কোঁকাড়ান সাদা চুলে স্কুল ছুটির পর বাড়ি বাড়ি যাওয়া মহিলদের মতো দেখাচ্ছে তাকে। সবুজ সোয়েটার, তাতে উজ্জ্বল লাল আপেলের ছবি, হলুদ আর সবুজে মেশানো মোটা পশমের কাপড়ের হাঁটু পর্যন্ত নামা আঁটোসাঁটো প্যান্ট আর সাদা মোজা। সবে ভাবছিলাম যে এ ঠিক বাড়িতে আসছে কি না, আর তখনই দরজায় ঘণ্টি বেজে উঠল।

‘আপনিই কি এ বাড়ির মালকিন ?’ প্রশ্ন করলেন ভদ্র মহিলা।

‘আমিই’―বললাম আমি। আর দরজার সামনের ঝড়-আটকানো―পাল্লাটা একটুখানি খুলে ধরলাম।

‘আপনি আছেন তো আমাদের সঙ্গে ?’ সাদা মহিলাটি কথাটা বলেই দরজার চিলতে ফাঁক দিয়ে একটা ক্লিপবোর্ড ঢুকিয়ে দিল। রাস্তার ওপারে একটি লোক তার বাড়ির সামনের হাঁটা-পথটা ঝাড় দিচ্ছে। একজন মহিলা একটি বাচ্চাকে দাঁড়িয়ে-থাকা একটি গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। কুকুর কোলে নিয়ে এক বুড়ি বারান্দায় দোলনা-চেয়ারে বসে আছে। ওরা সবাই দেখছিল আমাদের। ওরা সবাই সাদা। আমি লিনেনের বাক্সটা এমনভাবে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে রাখলাম যেন ওটা একটা ঢাল।

সাদা মহিলাটি আমায় ছাড়িয়ে মেঝেয় ছড়ানো এখনও না খোলা অন্য বাক্সগুলোর দিকে তাকাল। নাক ঘষল, গলা খাঁকারি দিল, তারপর জিজ্ঞাসা করল সবকিছু ঠিকমত সাজানো-গোছানো হয়ে গেলে সে পরে একবার আসবে কি না। আমি একটা কথাও বলিনি কিন্তু গুনগুনানিটা নড়তে শুরু করেছে, নাভির চারপাশে চক্কর কাটতে লেগেছে, নাগরদোলার চাকার মত।

‘ওগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার কিছু একটা উপায় আমাদের বের করতেই হবে, কথাগুলো বলে সে তার কলমটা ক্লিপবোর্ডের গায়ে ঠুকতে শুরু করল।’ ‘এই আবেদনপত্র…’ আমি হাতের মুঠিটা একদিকের কোমরে রাখলাম, বোধহয় সেটা ওর কাছে কিছু একটা বিপদসংতেত হিসেবে কাজ করল কারণ আমি ঠিক সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। ছোট ভি কার্পেট জুড়ে হামা দিচ্ছিল, আমি শুনতে পাচ্ছিলাম একটু একটু করে সেইদিকে এগিয়ে আসছে সে, যেখানটায় আমি ‘আমার বক্তব্য’ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তাকে দেখতে পেয়ে মহিলাটি আর্তনাদ করে উঠল যেন সে বাড়ির পিছন থেকে বেড়ালছানাগুলোর কোনও একটা বেরিয়ে আসতে দেখেছে। সে এখনও তার গলাটা লম্বা করে রেখেছিল বাড়ির ভিতরটা দেখার জন্য। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম আমার নতুন প্রতিবেশিরা যে যা করছিল সব মাঝপথে থামিয়ে, কথার মাঝখান থেকে, পথের মাঝখান থেকে, আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আবেদনপত্রটা নিয়ে নিলাম, মহিলাকে ধন্যবাদ দিলাম আর তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিলাম।

‘একেবারে নচ্ছার ব্যাপার সব, বল ?’ ছোট ভিকে বললাম আমি। আমি ওকে একটা চিবোনোর বিস্কুট দিয়ে ওর মাথায়, দুই গালে হাত বুলিয়ে আদর করে দিলাম। আমার মানিক, আমার সোনা ছেলেটা। আমি লিনেনের বাক্সটা সোফার উপর রেখে দিয়ে মহিলার দেওয়া কাগজটা পড়ে ফেললাম।

‘বেড়াল মেরে ফেলার জন্য আবেদনপত্র লেখে, কেমন মানুষ এরা ?’ বেশ জোরে জোরেই বললাম আমি কিন্তু আমার মনে হলো যেন আমি নিজের মনে কথা বলছি। ‘মাথামারানি বেড়াল নিয়ে পড়েছে!’ না বলে পারলামনা আমি কারণ ঘটনাটা আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলামনা। ছোট ভি খেলা থামিয়ে আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল যেন ও জানে কি বলতে চাইছি আমি। ‘ছোট ভি-রে, ঐ লোকগুলোর বুদ্ধিশুদ্ধি নরকেরও অধম,’ বললাম আমি।

অ্যাসপিরিন নিতে হলো আমায়।

পিছনের জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম রাস্তার বেড়ালগুলো জঙ্গল থেকে বের হয়ে এল আর সূর্যের আলোয় নিজেদের টানটান করে ছড়িয়ে দিল। এদিকে যতক্ষণ আমায় দেখতে পেয়েছে ছোট ভি নিজের মনে ঠিকই ছিল। টসটস করে লালা ফেলতে ফেলতে একটা খেলনাগাড়ি নিয়ে খেলছিল সে।

এটাই যদি ঘরে পালা বেড়ালের ব্যাপার হতো, গল্প অন্যরকম হতো। যাকে বলে আহ্লাদের হদ্দমুদ্দ! কালো বেড়ালটা সোফার হাতলে জমিয়ে বসে আছে আর কোনও এক লোক তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কিংবা টিভিতে কার্টুন দেখতে দেখতে কোনও মেয়ে দোল-দোল-দুলুনি করে পুতুল খেলার মতো আহ্লাদ দিচ্ছে হলুদ বেড়ালটা। কিন্তু এখানে বেড়ালগুলো সব জংলি, অন্তত সেই সাদা মহিলা তাই বলেছিল। যদিও আমি ওদের মধ্যে তেমন কিছু জংলিপনা দেখতে পাইনি। ওদের দিকে খাবার টুকরো ছুঁড়ে দেওয়ার সময় একটা-দুটো তো গায়ে হাত বুলিয়ে আদরও করেছি। যে যাই বলুক, আমি তাদের দেখতে থাকলাম। ছোটগুলো কেউ কেউ বড়দের পিছন পিছন চলছিল আর একেবারে বাচ্চাগুলো এখন হাত-পা ছড়িয়ে শরীর টানটান করে হাই তুলতে শুরু করল।

জমির শেষে গাছগাছালি দিয়ে একটা বাগানের মতো করা ছিল। আমার বেশ অবাক লেগেছিল যেসব গাছ দেখলে মনে হয় ওরা যেন বরাবর নিজে থেকেই এখানে ছিল, কোন পাড়াকে দেখতে ভালো লাগবে বলে বাইরে থেকে এনে পুঁতে দেওয়া গাছদের মতো নয়। জানালা থেকেই আমি ওক আর সিকামোর গাছগুলো খুঁজে নিতে পারতাম। দিনের যে সময়টা শুধু ছোট ভি আর আমি থাকতাম, এই গাছ খোঁজাটা ছিল আমার প্রিয় কাজ। গাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসতাম আমি।

ছোট ভি মাথাটা তুলল ওর। কে জানে কোথা থেকে বিলি হলিডের গানের একটা লাইন আমার মাথার মধ্যে পাক খেয়ে ঢুকে এল। অন্য যে কারও মতো গাছের সঙ্গে আমার ইতিহাসটা জটিল কিন্তু এটা মানতেই হবে যে আমি একজন কালো মহিলা, যে, সোজা কথা, গাছ ভালোবাসে। তুমি আমার থেকে সবকিছু নিয়ে নিতে পারো না। আর সেটা আমি যে কাউকে বলব। গাছের প্রতি আমার ভালোবাসাটাও তুমি কিছুতেই কেড়ে নিতে পারবে না। অমন ইচ্ছের ইয়ে মারি আমি।

আকাশটা ছিল ঝকঝকে, আমার মায়ের প্রিয় লব্জ এই শব্দটা। জঙ্গলটা সোজাসুজি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। এলাকাটার বারো বাজিয়েছে ডাইনে এবং বাঁয়ে সারি বেঁধে ছড়িয়ে থাকা বড় বড় সাদা রঙের একগুচ্ছ বাড়ি যেগুলোর প্রত্যেকটা দেখতে যে বাড়িটায় আমি দাঁড়িয়ে আছি হুবহু এটারই মতন। যে জায়গাটায় আমাদের বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, আমি নিশ্চিত যে এখানে কোনও একসময় কোনও এক কৃষক তার জমি চাষ করত। অথবা এমন হতে পারে, এটা ছিল কখনও চাষ না হওয়া কোন জমির একটি খণ্ড, যে জমি পড়ে থেকে জঙ্গল হয়ে গেছে, অন্তত আমার সে রকমই মনে হয়েছিল। হয়তো-বা আরও কিছু বছর আগে ভুট্টা কি তামাকের খেতের সারিতে আমার কালো ভাইবোনেরা সারি বেঁধে কাজ করেছে কিংবা জাম কুড়িয়েছে কোনও ওয়াইয়নডোটে তরুণী। আমি জানি, এমনও লোক আছে যারা এরকম কিছু ভাবে না কিন্তু আমি আসলে এসবই ভাবি। বেশির ভাগ কালো মেয়েরা কেমন সেটা নিয়ে তোমার মতো যাই হোক না কেন, আমি এখন তোমায় আমার কথাটা বলতে চাইছি।

আমি এরপর গ্যারাজে গেলাম আরও বাক্সের খোঁজে আর সেই সঙ্গে চট করে একটু ধোঁয়া টেনে নিতে। তখনই একটা ইঁদুর নজরে এল আমার। অন্য ধরনের মেয়ে হলে সে এমন চ্যাঁচামেচি জুড়ে দিত যেন খুনোখুনি লেগে গেছে কিন্তু আমি তা করিনি। লম্বা লেজটা পাতলা ফিতের মতো উপরের দিকে পাকিয়ে আছে। হতে পারে, এখানকার ইঁদুরগুলো এভাবেই বেড়ে ওঠে ? আমি তেমন কিছু না ভেবেই ওটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তখনই এই ‘মিডওয়েস্ট’-এ আমার প্রথম বন্ধুটির খুদি খুদি চোখ দুটিতে একটা ঝিলিক লক্ষ্য করলাম। ‘কী চলছে ?’ বললাম আমি। ‘আছিস কেমন! দোস্ত ?’ আমি জানি আর একটু হলেই ওর গায়ের উপর গিয়ে পড়তাম আমি, আমার জুতার নিচে ওকে চেপ্টে মেরেও ফেলতে পারতাম। গ্রামের খামার বাড়িতে বাবাকে এভাবে একটা কপারহেড সাপ জুতোর নিচে থেঁতলে মেরে ফেলতে দেখেছি। লক্ষ্যে-স্থির এক কালো মানুষের অবাক-করা ক্ষমতা। হম্প! কুটিল পৃথিবী তারপর হঠাৎ নেমে আসা এক কাজের জুতোর গোড়ালির আঘাতে আবার নিরাপদ। কিন্তু ইঁদুরটা, ঠিক যেমন বেড়ালগুলো বা এই আমি, কোনও কাউকে কিছু বিরক্ত করছিলাম না তাই আমিও ওটাকে কোনও জ্বালাতন করিনি।

আমি যখন মাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম বাবার পায়ের নিচে কপারহেড সাপ পিষে ফেলবার ঘটনাটা তার মনে আছে কি না, মা বলল ‘বটেই তো, পরিষ্কার মনে আছে আমার। আঁ হাঁ, ঠিক সেটাই করেছিল সে।’

আমরা দুজনেই চুপ করে ফোন ধরে রেখে একে অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে যাচ্ছিলাম।

‘কেমন বুঝছিস, এখানকার থেকে ভালো ?’ মা জিজ্ঞাসা করল আমায়।

‘জানি না। কালো লোক বিশেষ চোখে পড়েনি এখানে।’

‘ইন্ডিয়ানা,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মা, তারপর রাগে গরগর করল, ‘দেশের এলাকাটায় আমাদের সবাইকে মেরে ফেলেছে ওরা।’

‘ও মামণি’, বললাম আমি। ‘এটা একুশ শতাব্দী।’

এই দক্ষিণের ইতিহাসটা চিন্তা করছিলাম আমি এবং উত্তরের কথাটাও এবং প্রতিদিন খবরে যেটা দেখতে পাচ্ছিলাম, সর্বত্র কালো মেয়েদের পেটের ভিতর ঐ গুড়গুড়ানি হয়ে চলেছে। আমি মাকে বোঝাতে চাইছিলাম যে কীভাবে হতে পারে, তারা একটা পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে। কিন্তু কালো মানুষেরা এখনও প্রতিদিন খুন হয়ে যাচ্ছে, তাই আমি ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলাম না তাই এই নিয়ে কোনও কথাই বলিনি আমি। মার সঙ্গে আমার এই ধরনের কোনও কথা হয় না। কিন্তু সেই মুহূর্তে আমি জানতাম উত্তরটা একেবারে আমার পেটের মধ্যিখানেই বসে ছিল। আমি ভাবছিলাম আমার মা কি ফোনের ভিতর দিয়ে শুনতে পাচ্ছে আমার ভিতরের এই আসন্ন মহা-আবির্ভাব বা কিছু একটা যে ঘটছে তার আওয়াজ ? কিংবা মা কি কখনও তার নিজের অন্তরের কথা কান পেতে শুনেছে ? কিন্তু আমার নিজে থেকে লাফালাফি করে এ কথা জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়নি। আমার ইচ্ছে করছিল মাকে বলি ঐ সাদা মহিলা আর ইঁদুর আর বেড়ালগুলোর কথা এমনকি বিগ ভির বারফট্টাইয়ের কথাও কিন্তু বলিনি আমি।

‘আমি যা জানি তা জানি’―বলল মা।

আমার নজরে এল ছাদে একটা মাকড়সা গুটি গুটি এগোচ্ছে। ব্যবস্থা নিতে হবে ওটার। কিন্তু এখন কিছু করতে ইচ্ছে হলো না। ওরও হয়তো স্বাধীনতা থাকা উচিত। সে তো একমনে স্রেফ ওর নিজের কাজটুকুই করে যাচ্ছে। আমরা সবাই কি সেটাই করতে চাই না ? নিজের মনে আমাদের নিজের নিজের কাজটা করে যেতে ?

তখন মা বলল, ‘তা এবার বল তো সোনা, ঠিক কি রকম চলছে সব ? যা সত্যি তাই বল।’

আমি যা বললাম তা হলো, ‘সব ঠিক আছে।’ কিন্তু আমার ইচ্ছে করছিল অঝোরে কাঁদতে শুরু করি এবং তখনও বড় কিছু ঘটে যায়নি।

‘আমার নাতি-নাতনিরা কেমন আছে ?’ জিজ্ঞাসা করল সে।

ভালো আছে।

তোর নিজের লোকটি ?

চমৎকার।

মা এত জোরে হেসে উঠল যে বিষম খেয়ে গেল। ‘চমৎকার ?’ প্রশ্ন করল সে। ‘তুই ভালো করে জানিস যে ওর কোনও কিছুই চমৎকার নয়।’

‘আমরা সবাই ঠিক আছি, মা।’ বলেছিলাম আমি। আর আমি মিথ্যা কথা বলছিলাম না। আমি তো আর টিভি-জ্যোতিষী মিস ক্লিও নই। কী করে জানব আমি কি আসতে চলেছে ? মন পড়া যায় নাকি ? ভবিষ্যৎ জানা আছে তোমার ?

ফোনে কথাবার্তা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আমি কিছুক্ষণ ফোনটা কানের কাছে ধরে রেখে ওটার গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে গেলাম, পাগলের মতো মাকে কাছে পেতে ইচ্ছা করছিল।

তখনও কয়েক সেকেণ্ড বাকি ছিল যখন আমি দরজার ঘণ্টি বেজে উঠতে শুনলাম।

এই দ্বিতীয়বার তার বেড়াল মারার প্রস্তাব নিয়ে সেই সাদা মহিলা আমার দরজায় এসে হাজির হয়েছে। কখনও কখনও আমি চুপচাপ বসে কল্পনা করতে চেষ্টা করি যে একটা পুরো ঘর ভর্তি করে একদল সাদা মেয়েছেলে বেড়াল মারার পরিকল্পনা নিয়ে গজল্লা করছে। গোটা দেশ জুড়ে এত এত কালো মানুষ যখন ঠাণ্ডা পাটাতনের উপর লাশ হয়ে শুয়ে আছে তখন এটাই তোমরা করবার মতো কাজ খুঁজে পেয়েছ ? দরজাটা এক চিলতে ফাঁক করা ছিল, আমি শুনতে পেলাম মহিলাটি হাট করে খুলে ফেলেছে সেটা।

‘কই, বাড়ির মালকিন কোথায় ?’ চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল সে, আর আমি ছোট ভিকে কোলে করে একেবারে ঠিক সময়মত ঘরে ঢুকে এসে দেখতে পাচ্ছি কীভাবে ওর পা এগিয়ে আসছে যাতে আমার বিরক্তির মাত্রাটা একেবারে উপচে যায়। ‘আমার’ বলেছি, খেয়াল করেছ তো ? কী আসল গেল তাতে, ঠিক ? রান্নাঘরের দেয়ালটা ঘুরে ওপাশ দিয়ে আসতে গিয়ে মাথাটা আমার চক্কর খেয়ে উঠল। পেটটা খামচে ধরল যেন, সেটা আমায় আরও অস্থির করে দিল। ভগবানের দিব্যি, মনে হলো যেন বাচ্চা বিয়োতে যাচ্ছি আমি।

‘শুনুন, কী করে সটান কারও ঘরের ভিতরে ঢুকে আসেন আপনি ?’ বললাম আমি। আমার গলার আওয়াজ খুবই শান্ত আর নিচু ছিল কারণ আমি জানতাম যা ঘটতে চলেছে তা ভালো কিছু হবে না। আমি একেবারে সেই মুহূর্ত থেকেই ব্যাপারটা জানতাম।

আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার মুখ লাল হয়ে গিয়েছে, কান গরম লাগছে যেন আগুনে পুড়ে যাচ্ছে। ছোট ভিকে আমি কোলে ধরে রাখার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু ও সমানে চেষ্টা করে যাচ্ছিল কোল থেকে নেমে পড়ে খেলতে যেতে।

‘আমাদের আরও পঞ্চাশটা সই লাগবে’ ঘরের সামনের বারান্দাটায় এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল সে।

‘এই বোকা বোকা ফালতু জিনিসে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই,’ বললাম আমি, ‘একেবারে প্রথমেই বলে দিয়েছি তো আপনাকে।’ এবং আমি যখন দরজাটা বন্ধ করার চেষ্টা করছি সে তার পা আমার দরজার পাল্লার মাঝখানে গলিয়ে দিল। হ্যাঁ, ঠিক তাই। ভাবতে পারো ?

‘আমাদের কথাগুলো ভেবে দেখার সময় পেয়েছেন কি আপনি ?’ হাঁদার মতো প্রশ্ন করল সে।

আমি তাকে বললাম, ‘শুনুন, এই শেষ বার, গোল্লায় যাক আর একটা বারও আর আপনাকে বলতে যাচ্ছি না আমি।’ মহিলার থেকে দূরে থাকার চেষ্টায় ছোট ভি আমার কোলের ভিতর সেঁধিয়ে এল। আমি চেষ্টা করছিলাম আমার পা দিয়ে ঐ মহিলার পা ঠেলে বার করে দিতে। কিন্তু ঐ পেছনপাকা মহিলা গোড়ালিটা শক্ত করে দাবিয়ে রেখেছিল।

‘কতদিন ধরে আছেন এখানে ?’ প্রশ্ন করল সে, আর কি দুঃসাহস, ক্লিপবোর্ডের উপর এমনভাবে কলমটা উঁচিয়ে ধরল যেন আমি যা বলব সব পটাপট লিখে নেবে।

‘কী ?’ এইটুকুই বলে উঠতে পারলাম আমি। ‘কী ?’ ঠিক এইটুকুই।

ছোট ভি কাঁদতে শুরু করেছিল কারণ ও চাইছিল আমি ওকে কোল থেকে নামিয়ে দিই। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল এই পুরো সময়টা ওকে আমার নিজের কাছে আঁকড়ে ধরে রাখা দরকার। মায়ের মন, কিছু একটা কু ডাকছিল মনে হয়।

‘আপনার কাছে মর্টগেজের কপি আছে কোনও যেটা দেখাতে পারেন আমায় কিংবা ভাড়া নেওয়ার কাগজপত্র ?’ মহিলা জিজ্ঞাসা করল।

আমি দরজাটা আরও খানিকটা খুলে ধরলাম কারণ আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম যে যা শুনেছি, ঠিক শুনেছি আমি। আমি ওর দিকে মুখটা ঘোরালাম আমার আর মিথ্যে বলব না, আমার ইচ্ছা করছিল আমার নাকের ডগাটা ওর নাকের ডগায় একেবারে ঠেকিয়ে দেই যাতে যা শুনছি সেটা নিয়ে পুরোপুরি নিঃসন্দেহ থাকতে পারি। ‘কী বললেন আপনি ?’ বললাম আমি। ‘কী আছে আমার ?’

সে আবার একই কথা বলল, তারপর পিছিয়ে গিয়ে তার পাটা বের করে নেওয়ার আগে তার মুখে খানিকটা ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল।

আমি ঠাস করে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম কিন্তু সেটা তালাবন্ধ করতে পারার আগেই মেয়েছেলেটা খপ করে দরজার হাতলটা ধরে ঘুরিয়ে দিল।

ছোট ভি কোলে থাকায় এই দড়ি টানাটানির খেলাটা হেরে যাচ্ছিলাম আমি আর এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল আমার খুলির ভিতর গুচ্ছ পাথরের গুলি ঘর্ঘর করে গড়িয়ে চলেছে। ঐটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে জঘন্য মাথা ব্যথা। আর এখানে আর একটা কথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে রাখি, পুরো সময়টা জুড়ে পেটের ভিতরের ঐ গুনগুনানিটা চলছিল একটানা। আমি ভালো মতো বুঝতে পারছিলাম পুরো ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে শেষ হতে চলেছে এবং সেটা আটকানোর জন্য কিছুই করার ছিল না আমার। সে দরজাটা জোর করে খুলে একটা পা আবার ঘরের ভিতর গলিয়ে দিল। আর তখনই আমার ঠিক বুকের নিচেটায় এই হুসহুস করে তাড়ানোর অনুভূতিটা চাগার দিয়ে উঠল। হুস, হুস।

দেখুন, খোলাখুলি বলছি আপনাদের, ঐ আজব দেখতে সাদা মহিলার গায়ে হাত দেওয়ার এক বিন্দু ইচ্ছা ছিল না আমার। কিন্তু যখন সে আমার দরজা থেকে কিছুতেই তার পাটা সরিয়ে নিল না, আমি যতটা জোরে পারি তাকে এক ধাক্কায় বার করে দিলাম। হ্যাঁ, দিলাম আমি। ধাক্কা দিয়ে তাকে আমার দরজা থেকে বার করে দিয়েছিলাম আমি। সে রাস্তার ধারের পায়ে চলার পথটায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছিল। কলমটা এক দিকে ছিটকে গিয়েছিল, ক্লিপবোর্ডটা আরেক দিকে। ঘাগরাটা গুটিয়ে কোমরের কাছে দলা পাকিয়ে উঠে গিয়েছিল। হাতের ব্যাগ থেকে সমস্ত কিছু বের হয়ে ঘাসের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল আর মোজা ছিঁড়ে গিয়েছিল। হাঁটু ছড়ে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল মনে হয়, তবে মরে যায়নি। কাউকে খুন করিনি আমি। ঠিক আছে ? আপনারা বসে বসে তার সঙ্গে কথা বলেছেন, ঠিক ? দিব্যি বেঁচে আছে সে।

প্রতিবেশিদের অনেকে ঘটনাটা দেখতে হাঁ হয়ে থেমে গিয়েছিল, কেউ তাদের উঠানে, কেউ চিঠির বাক্সের সামনে, গাড়ি ঢোকানোর পথের উপর কেউ। দেখি, রাস্তার ওপার থেকে রোদটুপি আর চশমা পরা এক লম্বাপানা সাদা মহিলা উঁকি মেরে তাকিয়ে আছে। সে মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিয়ে গাছে জল দেওয়ার নলটা ঠিকঠাক করে আবার তার ফুলগাছগুলোয় জল দেওয়ার কাজে লেগে গেল। পিয়ন আমাদের বাড়ির সামনের হাঁটা-পথ ধরে কাজ শুরু করেছিল। আমাদের পাশের বাড়িটির দিকে যাওয়ার সময় আমাদের দেখতে পেল সে। আমি তাকে হাত নেড়ে এগিয়ে যেতে বললাম, সে কিছু বললনা। আমি দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিলাম। দুনিয়াজুড়ে সক্কলেই কি এভাবেই দরজা বন্ধ করে দেয় না ? দরজাটা বন্ধ করে, তালা মারে আর ভেবে নেয় যে এইবার তারা সব নিরাপদ হলো, তাই না ?

সোফা থেকে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে চোখ চালিয়ে দেখতে পেলাম কয়েকজন প্রতিবেশি ঐ মহিলাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে আর তার জিনিষপত্রগুলি কুড়িয়ে বাড়িয়ে এনে দিচ্ছে। সে আবার আমার দরজায় জোরে জোরে কবার ধাক্কা দিল আর চিৎকার করে বলল, ‘আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব।’ তারপর সব একেবারে চুপচাপ হয়ে গেল।

পরে সেদিন বিকেলে আমি আবার রান্নাঘরে ফিরে যাই। ছোট ভি আমার মায়ের দেওয়া একটা খেলনা পুতুল নিয়ে খেলছিল যেটাকে যতবার মেরে শুইয়ে দাও ওটা আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ওঠে। বাক্সগুলো ওর চারপাশে স্তূপ হয়ে আছে, ছবিগুলো দেয়ালে যেখানে যেখানে টাঙাতে চাই সেখানে মেঝেতে উপুড় করে শোয়ানো আছে। আমার আপন লোকেদের মুখের ছবি সেসব। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা পরিবার। এমন পরিবার কটা আছে তোমাদের ?

ছোট ভি খুব মিষ্টি নিশ্চয়ই, বেশির ভাগ বাচ্চাই তাই কিন্তু সেদিন আমি যখন ওকে আধো আধো আওয়াজ করতে আর মুখ থেকে বুড়বুড়ি কেটে ফেনা তুলতে দেখছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল যেন আমার হৃৎপিণ্ডটা আনন্দে বুক ফেটে বের হয়ে আসবে। রান্নাঘরে আমি যখন কাজ করছিলাম, সে আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলছিল, ওর কোঁকড়া চুলেভরা মাথাটা থেকে থেকে দেখা যাচ্ছিল আবার লুকিয়ে পড়ছিল। সে এখন সেই বয়সে পৌঁছেছে যখন সে আর খুব একটা চায় না যে আমি ওকে কোলে তুলে নিই। আমি তার মা। জানি, আমাকে চাই তার কিন্তু আমারও তো তার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আছে ? আরাম ? নিশ্চয়তা ? আমার একটাই চাহিদা―সে বেঁচে থাক। এ কথা ভাবতেই আমার ভিতরটা ভারী হয়ে আসে, আর আমার আগের বাড়ির কথা মনে পড়ে, মিশন ক্রিক, যেখানে আমার ছোটবেলায় খেলাধুলা করেছি আমি, আমার চারপাশে ঘিরে আছে খেটেখাওয়া কালো মানুষেরা, যেন ফলন্ত কালোজামের থোকা, হাসছে, ঝগড়া করছে, ভালোবাসছে, লোগান স্ট্রিটের সেসব দয়ালু প্রতিবেশি এবং তারাও যারা এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।

বাক্স খোলার কাজ বন্ধ রেখে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। জানালা দিয়ে ভেসে আসা রোদ ভাগ করে নিলাম বেড়ালগুলোর সঙ্গে, গ্যারাজের ইঁদুরটার সঙ্গে, এখানে যারা আগে থেকে গেছে তাদের স্মৃতির সঙ্গে। যদি বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকত, ঐ জানালায় দাঁড়িয়েই কাটিয়ে দিতাম আমি, সারাটা দিন বেড়ালদের দেখে যেতাম, একটা বাক্সও আর খুলতাম না। শান্ত নৈঃশব্দ্য, জানালা দিয়ে আসা রোদের স্রোত আমার পেটের ভিতরের গুড়গুড়ানি অনেকটা কমিয়ে এনেছিল, অন্তত এখন সেটাকে আমার বেশ একটা আরামের বা গর্বের কিছু মতো লাগছিল। আমি জানিনা ঠিক কীভাবে এটা আমি বোঝাতে পারি। নিরাপত্তা নয়। এটা নয় যে আমি কোনওভাবে নিরাপদ বোধ করছিলাম কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল যেন ঠিক আছে, সামলে নিতে পারব আমরা।

আমি যখন ছোট ছিলাম, মা-বাবার বাড়ির পিছনে যে টিলাটা ছিল সেটায় ওঠার পথটা আমার পক্ষে বেশ লম্বা ছিল। কিন্তু দিনে একবার অন্তত পথের ধারের চারাগাছগুলো পিছনে নোয়াতে নোয়াতে আমি ঐ পথ পার হয়ে টিলাটায় চড়তাম। দুনিয়ার কোথাও নিজের মনে নিজেকে নিয়ে থাকায় কোন অন্যায় নেই। টিলার মাথায় পৌঁছানোর পর আমার মন খুশিতে ভরপুর হয়ে উঠত। ঐখান থেকে আমি দেখতে পেতাম আমার মায়ের বাগান, বাবার ভুট্টাক্ষেত, আমাদের বাড়ি। টিলায় চড়ার লাঠিটা আমি মাথার উপরে পতাকার মতো তুলে ধরতাম যেন আমি একজন অভিযাত্রী, যেমন বাচ্চারা করে আর কি। আমি ভাবতাম আমার বাচ্চারাও এরকমই একটা জীবন পাবে কিন্তু সে আর হওয়ার নয়।

ঐসব গাছ বুলডোজার দিয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে―একটা স্ট্রিপ-মল বানানো হবে বলে। পুরনো খামারবাড়িটা হারিয়ে গেছে। কোন ভুট্টাক্ষেত আর নেই, কোনও বাগানও না। বাবা মারা যাওয়ার পর মা শহরের কিছুটা কাছে উঠে এসেছে, তুলনায় ছোট একটা বাড়িতে মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে, তবে হ্যাঁ, এখনও সে তার বারান্দায় একটা টবে টম্যাটো ফলায়। ‘ঈশ্বর!’ নিজের মনে বললাম আমি আর মনে হলো পিছন দিকে কোথাও একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ শুনলাম কিন্তু নিশ্চিত হতে পারলাম না। মাথার ভিতর থেকে স্মৃতিগুলো ঝেড়ে ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম আমি, ছোট ভি তখনও কার্পেটে নিজে নিজে হামাগুড়ি দিচ্ছে। মাথা ব্যাথা সামলাতে আরও কটা অ্যাসপিরিন খেয়ে নিলাম।

এর একটু পরেই এল সময়টা যখন বাড়িতে পুলিশ এল। আমি ছোট ভিকে তুলে আমার কোলে বসিয়ে নিয়ে দরজায় গিয়ে সাড়া দিলাম।

‘ম্যাম, আমাদের কাছে রিপোর্ট আছে যে এখানে কিছু একটা ঘটেছে,’ প্রথম অফিসারটি বলল, আমার সামনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে, হাতটা তার বন্দুকের উপর রাখা। যে তুমি তোমার হতভাগা গোটা জীবনটায় এমন একটা কিছু করনি যাতে পুলিশের সঙ্গে জড়াতে হয় সেই তুমি কল্পনা করতে পার নিজেকে যখন তোমার দরজায় কোন পুলিশ বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে ?

‘কিছু একটা ঘটেছে ?’ বললাম আমি। ছোট ভি পা দাপাল কিন্তু আমি শক্ত করে ধরে রাখলাম ওকে।

‘আমাদের বলবেন কি, এই বাড়িতে কি করছেন আপনি, ম্যাম ?’ অন্য অফিসারটি বলল। ‘আমরা ফোনে একটা অভিযোগ পেয়েছি।’

‘কি ?’ আমার মুখটা তখন আঁতিপাতি করে শব্দ খুঁজছিল।

‘আপনার মতলবটা কী ?’

‘মতলব ?’ কথাটা বলে আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম এই যেমন এখন তোমার দিকে তাকিয়ে আছি। মানে আমি জানি, তোমার মনে হচ্ছে আমি একটা গবেট, যদিও তিন বছরের কলেজের ডিগ্রি আছে আমার। আমি অবশ্যই জানি মতলব কথাটার অর্থ কি। আমি শুধু ভাবছিলাম যে তাদের আমাকে নয়, আমার তাদের প্রশ্ন করার কথা যে ওদের মতলবটা কী।

আমি যখন থতমত খেয়ে কথা হাতড়াচ্ছি, বয়স্ক পুলিশটি বলল, ‘আমরা চাই যে আপনি বেরিয়ে এসে এই হাঁটা-পথটায় দাঁড়ান।’

‘আর কোন্ কারণে এখানে থাকব আমি ? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। এইটা আমার বাড়ি―বারবার করে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলাম আমি।

‘সে কি করা যাবে, এখানকার কিছু লোক, চারপাশের প্রতিবেশিদের মধ্যে কেউ কেউ মানতে রাজি নয় যে আপনি এখানে থাকেন। কোন প্রমাণ আছে আপনার কাছে ? আর তারা দেখেছে যে আপনি একজন মহিলাকে মারধর করেছেন, বেশি আগেও নয়, আমরা ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাটিকে খুঁজছি।’

‘ক্ষতিগ্রস্ত ?’

আমি তখনও কোন কথা খুঁজে পাইনি। গোল্লায় যাক, আমি এখনও ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার মতো কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছি না। ‘বাড়িটা আমার, এখানে থাকি আমি,’ আবার বললাম আমি।

‘আপনি বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসবেন, প্লিজ ?’

আমি যখন দরজা খুলে বাইরে বের হতে চেষ্টা করছিলাম আমার মনে হল একটা ইঁদুর দেখতে পেলাম এক-দুবার ইতঃস্তত করে একটা সোফার নিচে লুকিয়ে পড়ল। চোখের কোণা দিয়ে দেখেছিলাম আমি তাই এমন হতে পারে যে সবটাই আমার কল্পনা ছিল। কিন্তু আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি, এর আগে গ্যরাজে যে ইঁদুরটা দেখেছিলাম, এই ইঁদুরটাই ছিল। কে জানে কোথা থেকে একটা অমঙ্গল চিহ্নের মত হঠাৎ এসে হাজির হল। অমন সাজানো-গোছানো বাড়ি আর তাতে ইঁদুরের পাল দৌড়ে বেড়াচ্ছে। যদি হাসবার মতো অবস্থা থাকত, আমি নিশ্চিত হো হো করে হেসে উঠতাম কিন্তু এখন আমি চুপ করে রইলাম। ছোট ভিকে নড়াচড়া করে আমার অন্য পাশের কোলের উপর নিয়ে নিলাম আমি। আমার মাথার ভিতর কুয়াশার ঘোর লেগে গিয়েছিল কিন্তু সবচেয়ে মুস্কিল বেধেছিল আমার পা দুটো নিয়ে, কিছুতেই ঠিকমত বা যথেষ্ট তাড়াতাড়ি নড়াতে পারছিলাম না।

‘এক্ষুনি’ বলে উঠল অফিসারটি।

‘আমার বাচ্চাটা… জুতো পরতে হবে আমায়’―বললাম আমি আর তারপর খালি পায়ে আমার ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।

‘কোন মহিলা ছিল এখানে ?’ ওদের মধ্য থেকে কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল। ‘কোনও সাদা মহিলা ?’

‘হ্যাঁ,’ বললাম আমি। ‘সাদা চুলের। বেড়াল মারা নিয়ে কথা বলছিল।’

তুলনায় বয়স্ক অফিসারটি একটা ছোট নোটবইতে কিছু লিখে নিল।

কম বয়স্কটি প্রশ্ন করল ‘কি ঘটেছিল বলবেন আমাদের ?’

আমি একেবারে গোড়া থেকে শুরু করেছিলাম কিন্তু তারপর আমার মনে হলো আমার পেটের ভিতরের গুনগুনানিটা এবার আমার শরীর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে। আমি বেড়ালগুলোর কথা ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, সিকামোর গাছের তলায় রৌদ্রধারায় যারা নেচে চলেছে, কারণ আসলে আমার মনকে যা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তা হলো আমার পেটের ভিতর গুনগুনানিটা যেটা ক্রমাগত বাড়ছিল আর দাপাদাপি করছিল। আমি ইতিহাসের কথা বললাম, আমার পুর্বপুরুষদের কথা, আমার মায়ের কথা। আমার বিয়ের গল্প করলাম, আমার ছেলেমেয়েদের জন্মের কথা বললাম। আমি ক্লিভল্যান্ডের পার্কের ছেলেটার কথা বললাম, একটা খেলনা বন্দুক তুলে ধরেছিল বলে যাকে গুলি করা হয়েছিল। আমি ওদের শিকাগোর সেই বিখ্যাত গায়কের কথা বললাম যে একের পর এক অল্প বয়সি কালো মেয়েদের ধর্ষণ করে গেছে আর কেউ তাকে একটা কিছু বলেনি। আমি তাদের টেক্সাসের জেলের ভিতরে মারা যাওয়া মহিলাটির কথা বললাম। ‘আপনারা ভালোমতন জানেন যে মহিলাটি আদৌ কোন আত্মহত্যা করেনি,’ বললাম আমি। আরও বললাম, ‘আর সেসব কালো মায়েরা, কী হবে তাদের ?’ আমি তাদের মিনেসোটার সেই তিন বছর বয়সি বাচ্চা মেয়েটার কথা বললাম যে নিজের চোখের সামনে মায়ের বয়ফ্রেন্ডকে পুলিশের গুলিতে খুন হয়ে যেতে দেখেছে। ‘এই জন্যই কালো লোকেরা সাদা লোকেদের বা পুলিশকে বিশ্বাস করে না’―বললাম আমি। আমি যখন কালো মেয়েদের জরায়ুর ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা সেই গুনগুনানির কথায় এসেছি, অফিসাররা একে অপরের মুখের দিকে তাকালো। একজনকে দেখে মনে হলো অবাক হয়ে গেছে। আরেকজনের মুখে সেই বোকা বোকা নকল হাসি, যেমনটি দেখা গিয়েছিল কভিংটনের সাদা ছেলেটির মুখে যখন সে সেই বয়স্ক মূলনিবাসী আমেরিকানটির সঙ্গে কথা বলছিল। ‘কভিংটন, কেন্টাকি,’ বললাম আমি। কভিংটন নিয়ে কথা বললাম আমি, কেন্টাকি নিয়েও। আমি নিজেও কেন্টাকির মেয়ে। তুমি জানতে সেটা ? আমি কথার পর কথা বলে গিয়েছি। কিন্তু যখন আমি দম নেওয়ার জন্য থামলাম একটু, বয়স্ক অফিসারটি আমায় বলল, ‘ম্যাম, বলতে বাধ্য হচ্ছি, বাচ্চাটিকে নামিয়ে রাখুন আপনি।’ সে এমনভাবে কথাটা বলল আমায় যেন আমি একটা কুকুর, কোন মেয়েমানুষ নই।

‘এখানে নামিয়ে দিন তাকে,’ অন্যজন বলল, ‘আমি তাকে নিয়ে নিচ্ছি।’

আমি জানি, তোমাদের মনে হবে আমি মাথা-খারাপ, পাগল, কিন্তু আমি তা নই। আমি আর একটা কথাও বলিনি, কিন্তু আমি আমার ছোট ভিকে নামিয়ে রাখতে যাচ্ছি না। দরকার হলে ওর বাবা আর বোন ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি ওকে আমার কাছে আগলে রাখব। আমি ওকে আগলে রাখব যতদিন না কালো মানুষদের রাস্তায় রাস্তায় মরে পড়ে থাকা বন্ধ হচ্ছে। আর ঠিক এই সময়েই আমার ভিতরের গুঞ্জনটা এত বিশাল হয়ে উঠল যা আমি এর আগে কখনও শুনিনি। আমি অনুভব করতে পারছিলাম, আমার জরায়ু থেকে বের হয়ে ওটা এখন আমার সারা শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আর তারপর আমার শরীর থেকে বের হয়ে এসে কালবৈশাখীর ঝড়ের মতন ভাসতে ভাসতে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের মাথার উপর, গোটা পাড়ার উপর, পুরো দেশের উপর। আর তখন একটা পুলিশের হাত তার বন্দুকের উপর আর অন্য পুলিশটা বলে যাচ্ছে, ‘ম্যাম, আবারও বলছি, ছেলেটাকে মাটিতে নামিয়ে রাখতে হবে আপনাকে, এক্ষুনি।’

কিন্তু নামিয়ে রাখিনি আমি। আমার বাচ্চাকে কখনও আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে দিচ্ছি না। অন্তত যতদিন না আমার নিজের লোকেরা সবাই মুক্ত হচ্ছে।

 টেনেসি, যুক্তরাষ্ট্রে থেকে

সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button