আর্কাইভকবিতা

কবিতা

বিমল গুহ

আমার সুন্দর

কতদূর যাওয়া যায় আর- পৃথিবীর প্রান্তসীমায়

পেরিয়ে এসেছি দূরপথ চিম্বুক পাহাড়

নীলগিরি ভুবন মাতানো ঝর্নাজল

বিস্তৃত ফসলের মাঠ

তবু মানুষ যায় দূরে বহুদূরে আরিজোনা স্টেটে

প্রকৃতির ভাস্কর্য শোভা চোখভরে দেখবে আবার। 

আমরাও চোখ মেলে দেখি

ধানশালিকের দেশ ধানিমাঠ ফসলের ঢেউ

প্রকৃতির শোভা

অলীক ডানায় উড়ে-আসা শঙ্খচিল

আমার সুন্দর!


গোলাম কিবরিয়া পিনু

পূর্বাঞ্চল              

আমাকে তুই আমার কাছে

   ফেরত দে! ফেরত দে!

আগের জায়গায় ফেরত দে!

ভূতুড়ে জায়গায় আনলি কেন?

কারসাজিতে ছলচাতুরিতে

    গোলাপজলে উল্টো গন্ধ

গন্ধবণিক দূষণ ছড়ায়

   কী-মন্ত্র আজকে পড়ায়?

কোন বিছুটি লাগছে গায়ে!

নিরাভরণ হচ্ছি শেষে!

চোরাপথে জুয়োচুরি

ফল ধরে না উঠান গাছে

    রোগাক্রান্ত হচ্ছে মাছে!

চোখ বেঁধে আনলি কেন?

মুখও বাঁধা! 

ফেরত দে জন্মভিটায়

    ফেরত দে ধানজমিতে!

জমিতে কেন এত দূষণ!

ভূষণ পরা কোন লোকেরা বাদ্য বাজায়?

     আদ্যজ্ঞান নেই তো তাদের!

সাপের শিস তাদের ধ্বনি!

 ফেরত দে পূর্বাঞ্চল!

  অঞ্চল বিছিয়ে থাকতে চাই!

খোলা বুকে বৃষ্টির ফোঁটা

   ভিজিয়ে তুলে সজীব হয়ে

জলমাটিতে বাঁচতে চাই!

ফেরত দে আমাকে আজ

আমার কাছে! আমার কাছে!


মোস্তফা তারিকুল আহসান

স্বভাবত

দরোজা খোলার পর তিনি আমাকে সুন্দর কাউচে বসতে বললেন

তারপর বললেন, আপনার তো প্রধান সমস্যা ঘুম নিয়ে

তো ঘুম কি একেবারে হয় না, নাকি অল্প?

আমি বললাম, ঘুম  মাঝে মাঝে হয়, বেশির ভাগ সময় নিদ্রাহীন থাকি

ফলে শরীর ভালো লাগে না

তিনি আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, খেতে পারেন না, কাজে মনোযোগ পান না

মেজাজ খিচড়ে ওঠে এই তো? নাকি আর কিছু।

আমি ডান বায়ে তাকিয়ে দেখলাম আর কেউ আছে কি না

কোনার ছ্ট্টো টেবিলে একটা তরুণী লাপটপে টপাটপ লিখে চলেছে

আমি তার দিকে তাকালাম। তিনি বললেন, আমার সহকারি, আপনি যা খুশি বলতে পারেন, ও নোট নেবে।

আমি একটু ভেবে বলতে শুরু করলাম; চোখ বন্ধ করলে নানা দৃশ্য দেখি, সেই সব দৃশ্য আমার সারাদিন পিছু নেয়।

তিনি বললেন, দৃশ্য মানে তো নানান মেয়েদের ছবি তাই না?

আমি নীরব রইলাম।

তিনি বললেন, আমরা অনেক খেটেখুটে আপনার একটা প্রোফাইল তৈরি করেছি এবং কেসটা নিয়েছি

দেখি কি করতে পারি।

আমি বললাম, তাহলে তো আপনি সব জানেন আর আমি তো নিজে সব লিখে দিয়েছি আপনার প্রশ্নমালায়।

তিনি বললেন, সব ঠিক আছে। তবে আপনাকে দেখা জরুরি ছিল আর আপনি যা যা বলেছেন সেসব মিলিয়ে দেখা দরকার।

আপনি কুনমিংয়ে ট্রান্সজিট ভিসায় হোটেলে রাত কাটিয়ে ছিলেন মেয়েটার বেবি বেবি চেহারা আপনি ভুলতে পারেন না: সেখানে সেই অষ্টাদশী আপনার নাকে মৃদু আঘাত করে; সেটা ছিল আপনার ব্যর্থতার একটা নমুনা।

আপনি হায়দ্রাবাদ থেকে কোলকাতা ফেরার পথে একসাথে পাশাপাশি সিটে এক মাদ্রাজি মডেলের সাথে একান্তে ছিলেন। তার লাল লম্বা চুল পাওয়া গেছে আপনার জামার সাথে। নমপেনে আপনি রাত কাটিয়েছেন এক নারীর সাথে। দেশের মধ্যে কয়েক ডজন নারীর সাথে আপনার ঘনিষ্ঠ মেলামেশার খবর আমরা জানি। আপনি স্রেফ টাকা দিয়ে সবার মুখ বন্ধ করে রেখেছেন। আমি জানি আপনার অনেক টাকা তবে টাকা দিয়ে  মুখ বন্ধ করা সব সময় সহজ হয় না। আর আমি কেসটা যখন নিয়েছি তখন এর হিল্লে করে ছাড়ব।

আমি চোখ বুজে কাউচে বসে থাকলাম। ডাক্তারকে আমার এফ বি আই-এর বড় কর্মকর্তা মনে হচ্ছে। আমি ভাবতে পারছি না এত বিষয় তিনি কীভাবে জানেন। আমি চোখের ভিতরে নওমি জহরের দুটো ঠোঁট দেখতে পাচ্ছি; সে এগিয়ে আসছে আমার মুখের দিকে। পরক্ষণে দেখলাম, সারা নামের মেয়েটা আমার উরু খামচে ধরছে। আবার দেখলাম নোরাকে, সে জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে আমাকে টানছে বিছানায়। আমি বুঝতে পারছি না; আমি কী জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছি!

ডাক্তার আমার চেতনা ফেরালেন। বললেন, আপনার মস্তিষ্কের সমস্ত কোষ দখল করে আছে অজস্র উত্তেজিত কর্মকাণ্ড। আপনি যা গোপনে করেছেন, ভেবেছিলেন কেউ জানে না, সেটা ঠিক নয়। বস্তুত, সবকিছু জমা হচ্ছে ইথারে, আর আপনার ডিএনএ সাক্ষ্য দেবে সব অপকর্মের। অর্থকড়ি আপনাকে সাহায্য করবে না। আমি আপনাকে সামান্য সাহায্য করতে পারব। তবে চোখের ভেতরে যে ছবি জমা হয়েছে তা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। আমি কিছু টিপ্স দেব, শ্রান্তিদায়ক কিছু ওষুধ দেব। তবে বাঁচার উপায় ক্ষীণ এই যন্ত্রণা থেকে।

আমি তাকিয়ে থাকলাম ডাক্তারের দিকে। এতদিনে নিজের প্রতি খুব ঘেন্না হলো যা আরও আগে হলে ভালো হতো।


মোশাররফ শরিফ

নিজের অন্তর্গত

ভুল ভুল করে ঢোকে আমার ভেতর।

আমি ভুল করে ঢুকি তোমার ভেতর।

দুঃখ ভুল করে ঢোকে আমার ভেতর।

দুঃখ ভুল করে ঢোকে দুঃখের পাথারে।

শব্দ ভুল করে ঢোকে বৃষ্টির ভেতর।

শব্দ ভুল করে ঢুকে পড়ে কবিতায়…

অথচ কবিতা নিজের বৃষ্টি

(শব্দ জানে না তা)।

নরক নাড়িতে ঢুকে পড়ে, ঢোকে শিল্পে।

নারী শিল্প নিঃসন্দেহে, মাতৃত্বে মহান।

বাড়ির ভেতরে ঢোকে সিঁড়ি

প্রবেশ নিষেধ তার তবু।

মানুষ কি ভুল করে ঢুকে পড়ে ভুলের ভেতর?

মানুষ কি ভুল করে ঢুকে পড়ে সিঁড়ির ভেতর?

মানুষ কি ভুল করে ঢুকে পড়ে মৃত্যুর ভেতর?


বাদল ঘোষ

এক প্রবাসীর স্বীকারোক্তি

(বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন)

বিদেশে যখন কেউ

সাগ্রহে জানতে চায় আমার প্রকৃত পরিচয়Ñ

উত্তরে তখন আমি সগৌরবে বলি:

বাংলা আমার মমতাময়ী গর্ভধারিণী

পিতা বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু আমার পরিচয়!

পৃথিবীর মানচিত্রে যে সবুজ বদ্বীপ-

বঙ্গবন্ধু আজ সেই আশ্চর্য দ্বীপের

জাজ্বল্যমান এক অনন্য বাতিঘর

মহান গৃহের সেই অলৌকিক আলো ছড়িয়ে গিয়েছে বিশ্বময়!

 সেই মোহন আলোয় আমরা আলোকিত আজ

 সেই অমল আলোতে আমরা খুঁজে পাই বাঙালির অস্তিত্বের পরম ঠিকানা

কেউ যখন বিদেশ বিভূঁইয়ে জানতে চায়-

কী তোমার মাতৃভাষা?

সবিনয়ে বলি আমি

বাংলা আমার প্রিয় মাতৃভাষা আর, বঙ্গবন্ধু বর্ণমালা

একদা লিখেছে সেই পরিচয় বীর সন্তানেরা

রক্তাক্ত অক্ষরে

প্রিয়তম ‘বাংলাদেশ’- কার সে অসীম প্রেরণায়?

বঙ্গবন্ধু মিশে আছে আজও নীল শাদা ঐ উন্মনা আকাশে

থাক চির জাগরুক বাঙালির মনে আর নিশ্বাসে বিশ্বাসে।


বদরুল হায়দার

মালতিলতার মন

মালতিলতায় দুলে ওঠে মন। ফুলে ফলে বর্ষার কপালে

উচাটন হাওয়ার অনুকূলে খুঁজি হৃদয়ের মূলধন।

শ্রীচরণ নামের অগোচরে পরমাত্মারা বানের স্নান সেরে

তোমার প্রিয়বরেষু নিরাপত্তার আদরে নিরাশার বাণী নিয়ে

স্মৃতির পাতায় লিখে রাখে আগাম দমন।

চমকে দেওয়া খোলামনে ভোলানাথ সেজে মহামান্য

অনন্যার কাছে জমা রাখি আড়িপাতা প্রলোভন।

কদম বর্ষার কাছে হলুদ বরণ শিখে ভুলে থাকি দুঃখের ব্যাকরণ

নদীমাতৃকতার অবাধ্য উপকূলে তুমি জন্ম দাও অকারণ।

খরার হৃদয় জুড়ে বৃষ্টির অসূরে ভিজে যায় আবেগের

সবুজ বাগান। ঝুমকোলতা অতিথি হয়ে কেয়ার বাসরে

গড়ে আত্মীয়তা। তুমিহীন বৃষ্টি ঝরে টুপটাপ অভিমানে।

আমি আষাঢ় শ্রাবণ ভাদ্র আশ্বিনের লতানো প্লাবনে

ভেসে ডুবে হই মা মাটি ও মানুষের প্রিয়জন।

শ্যাম কালিয়া ভাটির কন্যা তুমি বন্যা জলে ভিজে

প্রেমের সুন্দরবন। মালতিলতার প্রেমে দুলে ওঠ।

অবেলায় জীবন খেলায়

তুমি অবেলায় জীবন খেলায় মেতেছিলে দরিয়া নগরে।

দোলা দেয় মনের উতালা। পালতোলা বেদনার কাফেলায়

চলে ছলকলা। ঘোলাজলে মাকাল ফলের ফলাফল

ডুবে যায় বেলা।

বাংলা ওয়াশে নিরামিষে দোভাষীর রাশিফলে যোগ করো

কাঁচকলা। বান তুফানের আগামী উজানে শুরু হয় পথচলা।

হৃদয় প্রদেশে আগাম চুক্তির দোষে বিলবোর্ডের দৃশ্যত

রোড শোতে তুমি উপভোগ করো দু®প্রাপ্য অমিল।

শিথিল মনের মিলে আমি দরিয়ার দিলে ডুব দিই।

তামাবিলের হৃদয়ে প্রাণের অধিক অন্তমিলে তুমি ঝিলমিলে

রাতের মিছিলে জীবনের আলো খোঁজো।

ঢেউ খেলে মনের মাতালে। এলোমেলো ভাবনার জালে

পিপিলিকা পাখা মেলে তুমি প্রেমের প্রহরী মানো গোজামিলে।

আমি বিলিয়ন ক্ষুধা আর সুধা পান করি তোমার অতলে।


নিলয় রফিক

ছন্দের স্পন্দন 

শাড়ির আঁচল ওড়ে, বেপরোয়া ছন্দের স্পন্দন

বিষাদে প্রস্তুত ঘূর্ণি গুপ্তধন চোখের শহরে

পলির নজর ঘাটে অগ্নিশিখা পিপাসার জল

গুপ্তথাবা বুকফাটে দ্রোহের পকেটে কান্না ঝরে।

ভয়াবহ স্বপ্নলিপি সূর্যদেশে বিষের আকার

বৃক্ষমাটি শূন্যতলা পুরানা আখ্যানে পথে হাঁটে

বাঘের সম্মুখে ঘোরে টানমেরে পরান উড়াল

ক্ষুধার আগুনে মানচিত্র পূর্ণিমার জোয়ারে মাতাল।

আবার উঠেছে ঝড় শীতের মৌসুমে তীব্র ঢেউ

জলোচ্ছ্বাস-মহামারি চোরাগুপ্তে আগামী সংকেত

তারাদের জপমালা ইতিবৃত্তে সূর্যের সন্তান

কচ্ছপ-খরগোশের দৌড়ঝাঁপ, তৃতীয় নয়ন।


বর্ণশ্রী বকসী

বসন্তের রঙ

তোমাদের গাঁয়ের থেকে বেঁকে গেছে যে পথ

সেই পথের ধারে সোনাঝুরি ফুলের ডালায়Ñ

কে যেন লাগিয়ে দিল ফাগুনের রঙিন নির্যাস

অলংকার জুড়ে নেয় প্রকৃতি দুহিতা দুবাহু মেলে।

সেই পথ এগিয়ে গিয়ে শ্যামল দিঘির জলে মেশে

আলুথালু চুল নিয়ে অপরিচিতার উদাসী চোখ

মায়াময় আহ্বান জানায় বৃক্ষ শরীর ছুঁয়ে

সবুজ পদ্মপাতার মাঝে একফোঁটা টলটলে জল…

বড় আশাহত ভেসে যাওয়া মেঘের সুন্দর প্রচ্ছদ

নীহারিকার ইঙ্গিত জেগে থাকে অবিকল বিশ্বাসে

আনত নয়নে সলাজ প্রতীক্ষা মিলনের সুর সপ্তক

ওহে! এমন বসন্ত দিনে যক্ষ খোঁজে মেঘদূত

রঙিন ফাগুয়া আসে রতির বিরহ ব্যথা নিয়ে কন্দর্পসম…


শতাব্দী জাহিদ

বাদী

আমার সব কিছু চলবে আমার মতোও

সব কিছুর একটা নিজস্ব ব্যাখ্যা থাকবে

তোমার কোন যুক্তিকে গ্রহণযোগ্য মনে হলে

ভেবে নিব আমারই তত্ত্ব তুমি কেড়ে নিয়েছ কিম্বা অর্জন করেছ।

দুপুরের উদাস বাতাসে নায়ের তেরপালের সাথে

তোমাকে ভাসতে দেখেছিলুম জল কিনারে।

ফড়িং যেমনি জলে ডুব দেয় আমিও তোমার

প্রত্যাশার কাছে ডুবে যাই নিজস্ব ব্যাখ্যার বাহানায়।

শঙ্কাহীন মানুষ দরিদ্র

আরজ তাদের বিধাতার দুয়ারে

টাকার মাল্য যেন মেঘ ভেঙ্গে নামে দুনিয়ার জমিনে।

আমিও ফরিয়াদের শাস্ত্র বিশ্বাস করি

কুমদী বালুর পথে পায়ের ছাপেছাপে;

তোমাকে মিনতি করি অসীম ক্ষমতার পটে।

কত রজনী পার করেছি খোয়াব জপেজপে

কত সংজ্ঞা বাদ দিয়েছি কত নিয়েছি সঁপে।

তোমার মন দেহের যেন আমি প্রহরী হই

তোমার মৌচাকে যেন আমি ভ্রমর রই।

———————–

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button