আর্কাইভগল্প

মৃত্যুর ক্ষণ : জুলফিকার মতিন

গল্প

লক ডাউন চলছে। অবরুদ্ধ অবস্থা। কাজ নেই কাম নেই, বোধ করি কেবল, একটা ছাড়া। ঘরে ঘরে, তাই, শুরু হয় ফাক ডাউন!                                                          

জহরতুন্নেসার করোনা হয়েছে। চৌদ্দ দিনের আইসোলেসন। ঘরে শিশু সন্তান। এক বছরেরও না। দুধ দিতে পারছে না। ছেলেকে রাখা হয়েছে পাশের ঘরে। দিন-রাত কেঁদেই চলেছে। খাওয়ান যাচ্ছে না কিছুই। পেটে খিদে।

মাতৃ-হৃদয়। কিন্তু কী করবে ? কান্নার আওয়াজ শুনতে শুনতে একেক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জহরতুন্নেসা। ভাবে, ছুটে গিয়ে এখনই ছেলেকে কোলে নিই। স্তন উন্মুক্ত করে দুধ খাওয়াই। ধরবে, ধরুক―করোনা। না খেয়ে খেয়ে মারাই যাচ্ছে। তার চেয়ে খেয়ে মরুক। আমিও মরব, ও―ও মরুক।

জহরতুন্নেসাকে দেখতে আসে জেবুনারা। ছোটবেলা থেকে সই। চলাফেরাতে খুব স্বচ্ছন্দ। নারী-পুরুষ বলে কোনও কথা নাই, সর্বত্রই তার গতিবিধি খুব সহজ। কোনও কেয়ারই করে না। মেয়ে হয়ে এমনটা ঠিক নয়, সে কথা বলার লোকেরও অভাব নাই। কিন্তু জেবুনারার উত্তর একটাই।

সে বলে―মেয়েমানুষ কি পারফিউম। ছিপি খুলে রাখলে বেরিয়ে যাবে সুগন্ধ। নষ্ট চরিত্রের সব পুরুষ। আছে একটা লিঙ্গ। চরিত্রের এতই বল, মেয়ে দেখলেই খাড়া হয়ে যায়! দেখি, খাড়া করেই রাখতে পারিস কতক্ষণ ?                                                            

কিন্তু এখন মুখে মাস্ক। উর্ধাঙ্গ চাদরে জড়ান। চেনাই যায় না। সইয়ের কাছে যাবার তো উপায় নেই। জানালার কাছে এসে দাঁড়ায় জেবুনারা।                                

এমনিতেই অশ্রুতে জহরতুন্নেসার চোখ ভেজাই ছিল। তাকে দেখেই, তা সশব্দ হয়ে ওঠে। কেঁদে কেঁদে বলে―তারাকে দুধ দিতে পারছি না। ছেলেটা আমার মারাই যাবে। কী যে হলো দেশের ? কী ব্যারাম এল ? ঘর থেকেও বেরুতে দিচ্ছে না। যেই কাছে আসবে তাকেই ধরবে।                  

জেবুনারা বলে―সই, সান্ত্বনা দিয়েও লাভ নেই। মুখের কথা বাতাসেই ভেসে যায়। যার অসুখ, কথা শুনে কি তার রোগ সারে ? তা, সই, তোকে কি ওষুধ দিয়েছে ? জহরতুন্নেসা বলে―ওষুধ না ছাই! নাপা না ফাঁপা ? ও ওষুধ, জ¦রও লাগে না, গায়ে ব্যথা হলেও খাই। ডাক্তার লাগে না।                                                   

জেবুনারা বলে―গাঁয়ের লোক সব যে যেখানে ছিল, ফিরে আসছে। তারাই ছড়াচ্ছে। তুই কি, তাদের সাথে পান-দোকতা খেয়েছিস ? শুনছি, দুলাভাই ফিরছে ?  

জহরতুন্নেসা এ বার হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। বলে―আমার সর্বনাশ। কান্না থামিয়ে বলে―সেই করেছে।                                           

তার স্বামী হাসান আালী ছিল ইতালিতে। মাঝখানে দেশে এসেছিল। আবার ফিরে গিয়েছিল। সে-ও প্রায় বছর খানেক। বাঁধিয়ে দিয়ে গিয়েছিল যাবার আগেই। তারই ফল শিশুসন্তান। কিন্তু এখন ঝেটিয়ে বের করে দিয়েছে।                                                                  জহরতুন্নেসা কান্না থামিয়ে বলে―আমি না করলাম, করো না। বার বার না করলাম। ছাড়ল না। করল। আমি বললাম, মুখে কাপড় বেঁধে নাও। তাও শুনল না। আমি চোখমুখ ঢেকে ছিলাম। তাও রাখল না। বলে, চুমাটুমা না খেলে হয় ?                                                

জেবুনারা বলে―থাক। থাক। পুরুষগুলো ও রকমই। বিদেশে মেয়ে সস্তা। কত কী করছে ? আর আমরা ? এখানে ? আমি বলে, দিয়েছি, একদম কাছে আসবে না। যদি কারও কাছে যাও, করোনা গেলে আবার তো বিদেশ যাবেই, তখন আমিও আমার ব্যবস্থা করে নেব।                                        

জহরতুন্নেসার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।

বলে―সই, তাই বলেছিস ?

জেবুনারা বলে―বলব না ? ওর আছে, আমার নাই ?

জহরতুন্নেসা এবার চোখমখু ভালো করে মুছে বলে―তোর কপাল দেখলে হিংসে হয়।

জেবুনারা বলে―কেন, সই ? কপাল তো তোরই। দুলাভাই বিদেশে চাকরি করে। আসার সময় ব্যাগ ভর্তি করে টাকা নিয়ে আসে।

জহরতুন্নেসা ধমকে ওঠে।

বলে―রাখ তো ওসব ? আমার কি হাত-পা খালি রাখবার উপায় আছে ? দেশে আসলেই একটা করে ভরে দিয়ে যায়। দেখছিস না, গণ্ডা খানেক হয়ে গেছে। ওদের কাই-মাই শুনব, না, এ দিক ও দিক তাকাব ?

জহরতুন্নেসা আর এদিক ওদিক কী তাকাবে ?

অতি অল্পকালের মধ্যেই এলাকা ভরে যায় জনসমাগমে। জনশূন্য হবার প্রক্রিয়াটা অবশ্য শুরু হয়েছিল বেশকিছু দিন ধরেই। দেশে তেমন কোনও শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠছে না। রপ্তানিযোগ্য শিল্পপণ্যের তালিকাও খুবই সংক্ষিপ্ত। স্টাপলার মেশিন ও পিন পর্যন্ত আমদানি করতে হয় বিদেশ থেকে। কিন্তু উৎপাদন তা বলে থেমে নেই। আর তা হলো মানুষ। মানব সম্পদ না কি সব চেয়ে বড় সম্পদ! উৎপাদনের ক্ষেত্রে তার শীর্ষস্থান ধরে রাখার প্রতিযোগিতাও সত্যিই ঈর্ষাযোগ্য। সুতরাং একসময় শুরু হয় তারই রপ্তানি। বিদেশে গিয়ে গায়ে-গতরে খাটলে আর কেই বা দেখছে ? বলা তো যাচ্ছে, আমেরিকা থাকি, অস্ট্রেলিয়া-কানাডা থাকি। দুবাই-কাতার-সউদি আরবÑপুণ্যভূমি, ঘাম ঝরিয়ে পাপ ক্ষলন করাটাই বা এমনকি কম ছোয়াবের ? এভাবেই শুরু হয়, এক জন-দুজন করে পুরুষ মানুষের স্বর্ণমৃগের পশ্চাতে ছোটাÑঅভিযাত্রা। বাড়তে থাকে সংখ্যা। কিন্তু তা কেবল পুরুষ মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। যেখানে যেখানে পর্দানসীন সব মহিলারা থাকে, অসূর্যাস্পর্শা করে না রাখলে যেখানে পাপের ভাগী হতে হয়, সে খানে ফকির-মিসকিন হলেও, পুরুষ তো, তাদের কি অন্দর মহলে প্রবেশাধিকার দেওয়া যায় ? অতএব, ওই কার্যকারণ সূত্রে, শুরু হয় মহিলা রপ্তানি। ফলে ওসব দেশের শুধু মহিলাদের ঘরসংসারের কর্মসম্পাদনে পারঙ্গমতা দেখান নয়, পুরুষেরাও তাদেরে বেহেস্তের হুরপরীর বিকল্প বানিয়ে তুলতে বিলম্ব করে না।

তবে মহিলা-পুরুষ মিলে, গায়ে-গতরে খাটুক আর শয্যা-বিলাসিনী সাজুক, সন্দেহ নেই, গ্রাম-সমাজের জন্য এটা ছিল একটা বিপ্লব। একসময় এক গ্রাম ছেড়ে দশ গ্রাম দূরে যেতেও যেখানে দশবার ভাবতে হতো, গামছায় করে চিড়ামুড়ি বেঁধে নিয়ে যেতে হতো, সেখানে এখন বিদেশে থাকা মানেই গ্রামের চেহারাটাই বদলে দেওয়া। কোথায় আর খড়ের ঘর আর ছনের বাড়ি ? টিন তো টিন―এখন-সেখানে শোভাবর্ধন করছে পাকা বাড়ি। জৌলুষ বেড়ে গেছে কাপড়-চোপড়ে। হাটে-বাজারে কেনাকাটাতে তাদের আধিপত্য এখন সর্বজনবিদিত। তাই প্রবাসী কারও ফিরে আসার অর্র্থই হলো সেই পরিবারে উৎসবের জোয়ার বয়ে যাওয়া। কিন্তু এরই পাশাপাশি আরেকটি বিপ্লবও ঘটে যাচ্ছে, প্রায়, নিঃশব্দে।

সেটি আবার দেশের মধ্যে। সাহেবেরা আর কাপড় কাটবে না। দর্জিগিরি করবে না। ছোট কাজ। মুনাফা কম। তার চেয়ে অনেক লাভজনক হলো অস্ত্রশস্ত্র বানান। দুনিয়া দখল হয়ে গেছে, এখন অভিযান হবে আকাশে। স্পেসশিপে চড়ে তার পাহারাদারি না করলে লোকজন শায়েস্তাই বা করা যাবে কীভাবে ? তবে যতই সভ্য হোক, শরীরটা তো ঢেকেঢুকে রাখতেই হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো বানাবে কারা ? সস্তা লেবারেরা। তারা রয়েছে উন্নয়নশীলের তকমা পরিয়ে দেওয়া দরিদ্র দেশগুলোতে। তার মধ্যে এটাও পড়ে বৈ কি ? সে কারণে নতুন এক শিল্পের সস্প্রসারণ দ্রুত ঘটতে থাকে এখানে। কাপড়-চোপড়-যন্ত্রপাতি-সুইসুতো―সবাই তারা পাঠিয়ে দিচ্ছে জাহাজ ভরে। আবার তৈরি হয়ে গেলে নিয়েও যাচ্ছে জাহাজ ভরে। মধ্যবর্তী কিছু লোক, বৃটিশ আমলে যারা দালাল-মুৎসুদ্দি বলে পরিচিত ছিল, তারই একটা নতুন সংস্করণ, ফুলেফেঁপে কোটিপতি হতে হতে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ডে জায়গা করে নেয়ার ব্যবস্থা করে ফেলছে।

এই অভিনব শিল্প―আদর করে যার নাম দেওয়া হয়েছে, গার্মেন্টস বলব, না পোশাকশিল্প বলব―তার সস্তা লেবারেরা আসছে গ্রামগঞ্জ থেকে। সংখ্যাধিক্য মেয়েদেরই। কিশোরী থেকে শুরু করে উদভিন্না নবীনা, মধ্যবয়সিনী―দলে দলে আগমন ঘটেছে। মালিকদেরও সুবিধা হয়েছে, পুরুষদের চেয়ে তাদের মজুরি কম করে দিলেও, বলার কেউ নেই। তবে আর কিছু না হোক, মজুরি কম হলেও, না খেয়ে থাকার হাত থেকে তো কিছুটা রক্ষা! আর বিপ্লবেরর কথাটা উঠেছে এ কারণে যে, মেয়েদের কত কম খরচে কর্মমুখী করে দেওয়া যাচ্ছে! তারাও গ্রামগঞ্জ থেকে উঠে এসে স্বাবলম্বী হয়ে পড়ছে দিনে দিনে।

গার্মেন্টস, না কি, পোশাক শিল্প চলছিল ভালোই। মানুষ রপ্তানি থেকে রেমিটেন্স এসে যেমন দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে সবল করে রাখছিল, গার্মেন্টস থেকে আসা টাকার কার্যকারিতাও তেমনই তার চেয়ে কম ছিল না। মালিকেরাও ছিল ভালো। কিন্তু করোনা এসে তাদেরও ফেলে দিল মহাবিপদের মধ্যে। সংক্রামক ব্যাধি। কারখানাগুলো চালু থাকলে স্বাভাবিক ভাইে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাই সদাশয় সরকার দিল তা বন্ধ করে। আর কারখানা বন্ধের অর্থই হলো হাজার হাজার শ্রমিকদের বেতনও বন্ধ হওয়া। কেবল কি গার্মেন্টস, যাবতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত- হোটেল-রেস্তোরা, ব্যবসা-বাণিজ্যকেন্দ্র অর্থাৎ যেখানে যেখানে জনসমাগমের ব্যবস্থা―সবই দিল ফেলে দিল এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে। কার্যত কর্মহীন হয়ে পড়ল স্বল্প আয়ের মানুষেরা। সুতরাং শহরে থেকে না খেয়ে মরার চেয়ে গ্রামে গিয়ে যদি খাবার সংস্থান হয়, এই আশায় লাখ লাখ মানুষ বেরিয়ে পড়ল। ট্রেনে-বাসে-স্টিমারে-লঞ্চে―কোথায়ও জায়গা নেই। বোধ করি, হাঁটা পথেও উপায় নেই পা রাখবার।

মোমেনা গার্মেন্টস শ্রমিক। না, না, শ্রমিক নয়, খেটে খায় বলে তার কি কোনও সম্মান নেই ? সে এখন কর্মী। গার্মেন্টস কর্মী। শুধু কি গার্মেন্টসে যারা কাজ করে, তারা ? ঘরে ঘরে যারা থালাবাসন ধোয়, মেঝে পরিষ্কার করে, কাপড়-চোপড় ধোয়া থেকে আরও আরও কাজকর্ম করে, তারা গৃহকর্মী। সুইপার-স্কাভেঞ্জার বলে ওদেরকে ছোট করা ঠিক না, তাই তারা পরিচ্ছন্নতা কর্মী। সোজা কথা হল, যারা কর্র্র্ম করে তারাই কর্মী। এভাবেই, আরও আরও হয়ে গেছে―সংবাদকর্মী, যৌনকর্মী, প্রসাধনকর্মী এসব। এতে আপত্তিরও কিছু নেই। ওদের অধিকার-মর্যাদার হিসেব করার তো দরকার নেই, টাকাপয়সা কী পায় তাইবা কী আছে দেখার, চাকর-চাকরানি-দাসীগুলো হলো জমিদার- খানদানদের অহমিকা বয়ে বেড়ানোর শব্দ। এগুলো অচল তো করে দিতেই হবে।

আর দশজনের মতো মোমেনাও এসেছিল গ্রাম থেকে। সাধারণভাবে কারণ একটাই, জীবনধারণের উপায় খোঁজা। তবে অনেকেরই প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন ভিন্ন। আর সেটা কেবল নিজের বেঁচে থাকার জন্য নয়। পরিবারের অন্যদেরও বাঁচিয়ে রাখার জন্য। মোমেনার ঘরে ছোট ছোট তিন সন্তান। স্বামী রুগ্ণ। কাজ করে পরিবারের খাবার জোটাবার মতো শারীরিক সামর্থ তার নেই। তাই মোমেনা অনন্যোপায় হয়েই সন্তানদের রুগ্ণ স্বামীর জিম্মায় রেখে কাজ নিয়েছিল শহরে এসে। সুযোগটা মোমেনার কাছে অবাবিত বলেই মনে হয়েছিল।

গ্রামেরই মেয়ে কুলসুম কাজ করে গার্মেন্টসে। সে ছিল অনেকটা না ঘরকা না ঘাটকা। তিন স্বামীরই সংসার করা হয়ে গেছে তার। টিকতে পারেনি কারও কাছেই। এ জন্য বদনামও হয়ে গেছে, কেমন মেয়ে, ঘর করতে পারে না ভাতারের ? বনিবনা না হতে পারে এক জনের সাথে তাই বলে হবে আর আর জন ? দোষটা নিশ্চয়ই তার। পরিবারও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল তার ওপর। তাদেরও তো সাধ্য-সামর্থের ব্যাপার আছে। তাই এক দিন ‘রাখিব না আর এ জীবন’―প্রতিজ্ঞা করে কুলসুম বের হয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। দিনমান হেঁটে হেঁটে পদ্মা নদীর পাড়ে এসে দেখে ফেরি প্রস্তুত। তার তো ভাবনা চিন্তার কিছু নাই। উঠে পড়ে তাতে। তার মতো নানা বয়সি আরও আরও মহিলারাও ছিল। সে মিশে ছিল তাদের ভিড়ে। ক্লান্তিতে চোখমুখ বসা। ক্ষুধার্ত অবয়ব। এক মহিলা, মরিয়ম তার নাম, বোধ করি, সে তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে মোমেনার অসহায়ত্ব বুঝতে পারে। এ রকম ভাসমান মেয়েদের নারী পাচারকারী দালালদের হাতে পড়াই নিয়ম। এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটে। মরিয়ম সঙ্গে করে তার বস্তিতে নিয়ে আসে। সেটি হলো গার্মেন্টসে কাজ করা মেয়েদের অঘোষিত হাউজিং। দু-চার দিন ধরে মরিয়মের সাথে কারখানায় যেতে যেতে একটা চাকরিও হয়ে যায় মোমেনার। ধীরে ধীরে বোধ হতে থাকে পুরুষ মানুষের সাথে থাকার চেয়ে এ জীবন, সুখের না হোক, স্বস্তির তো বটে।

কুলসুম উধাও হবার পর, পাড়াতে খুব যে আলোড়ন হয়, তা নয়। কেন না, বছরকাবারী হিসেব নিলে দেখা যাবে, দু-চারজনের হদিস এমনিতেই থাকে না। কে যে কোথায় চলে যায়, তার খোঁজ রেখে লাভই বা কি ? তবে ঘটনা মুখরোচক। গল্প-গুজবের জোয়ার দু-চার দিন পরনিন্দার জগতে বাহার এনে দেয়। কুলসুমের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তবে তা বেশি দূর এগোচ্ছিল না। কেন না, কুলসুমের সঙ্গে সঙ্গে কোনও একজন পুরুষেরও অন্তর্ধান হবার কথা। কিন্তু কোনওভাবেই তাকে সনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তাহলে কি, আত্মহত্যা ? অথবা অন্যভাবে কোনও অপমৃত্যুর একটা ব্যাপার হতে পারে। ভাইয়েরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেও বৃদ্ধ পিতা একটু খোঁজ-খবর করার চেষ্টা করেছিল। শেষপর্যন্ত এটাই সিদ্ধান্ত হয় যে, নারী পাচারকারী দলের হাতে পড়াটাই তার জন্য স্বাভাবিক।

কিন্তু এক বছরের মাথাতেই, বটগাছের নিচে নুরালির চায়ের দোকানের বাঁশের মাচানে বসে ছেলেছোকড়ারা যখন চানাচুর-বিস্কুট-চিপস খাচ্ছিল, আর চেয়ারম্যান-কাউন্সিলারদের কাছে, সামনে ঈদ, তার সওগাতের কত দীর্ঘ তালিকা পেশ করা যায় তাই নিয়ে উচ্চ স্বরে ঝগড়া করছিল, তখন ভটভটি ফিট করা একটা ভ্যানগাড়ি ভাঙা রাস্তায় ঠোক্কর খেয়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে তাদের সামনে থেমে গেল। ‘দেখিলে না হয় প্রত্যয়’―কুলসুম বসে আছে। চোখে গগলস। কাপড়-চোপড়ও আগের মতো মলিন নয়, বরং নতুন। বড়লোকদের মতো হাজার লাখ টাকার না হোক, কিন্তু শাড়ি-ব্লাউজের ডিজাইনও চমৎকার। ইঞ্জিন স্টার্ট নিতে যে সময়টুকু লাগে, সেই অবকাশে কুলসুম চোখের গগলস বাঁ হাত দিয়ে খুলে দিয়ে, ডান হাত ওপরে নাড়িয়ে সবাইকে বলে―কি রে, তোরা ভালো আছিস। আসবি কিন্তু ঈদের দিন ? আর বলবেই বা না কেন ? সব পাড়ার ছেলে। তুইতোকারি সম্পর্ক।―বলেই আবার হাত নাড়িয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে অপসৃয়মান হতে থাকে।

অবশ্য কুলসুমের আয়-উন্নতির ধরন-ধারণ নিয়ে যে কথা ওঠেনি, তা নয়। বলছে বটে চাকরি কিন্তু অনেকেই অনেকভাবে টাকা রোজগার করে, তার মধ্যে সব চেয়ে সহজ হল সন্ধ্যার পর রাস্তায় দাঁড়ান। তবে তার জবাব দিতে কুসুমও সময় নেয়নি। সে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে, পাড়া-প্রতিবেশীরা যাতে শুনতে পায়, এমনভাবে বলেছিল―দেখেছি তো তিন জনকে। আমার আর মর্দা মানুষ দেখার দরকার আছে ?

পাড়ার মেয়েদের সেই বলেছিল―আমার সাথে চল। কত জায়গা থেকে কত জনই তো আসছে। কাজ করলে কাজের অভাব নাই। গায়েগতরে একটু খাটতে হয়―এই যা। হাজার হলেও নিজের কামাই। হাত তো পাততে হয় না কারও কাছে ?

মোমেনা তখনই ঠিক করে কুলসুমের সাথে শহরে চলে আসার। ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে খারাপই লাগছিল তার। কিন্তু তাদেরই ভালো রাখতে এছাড়া আর উপায়ই-বা কী ?

গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেছে। মোমেনারা পাঁচ-সাতজন মিলে ঘর ভাড়া করে থাকে বস্তিতে। তার ভাড়াই বা কি কম ? গার্মেন্টস বুঝি, সোনার ডিম পাড়া হাঁস। যখনই শোনে, সেখানকার চাকরি, ভাড়াও হয়ে যায় ডবল। খাওয়া ও আর আর খরচ তো আলাদা। তাই কারখানা বন্ধ হবার পর একটাই পথ খোলা থাকল―বাড়ি যাওয়া। তাই কত তাড়াতাড়ি হাঁটা দেওয়া যায় সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে সেই প্রস্তুতি নিতে।

মোমেনারও তো বাদ যাবার প্রশ্ন আসে না। কিন্তু সে পড়ে যায় একটু দোটানার মধ্যে। সবসময়ই সে, অল্প অল্প করে হলেও, টাকা জমায়। উদ্দেশ্য একটাই। ছেলেমেয়েরা আছে। ওদের ছেড়ে থাকে। তাই বাড়ি যাবার সময়, হোক না সস্তা, ওদের জন্য কিছু কিছু বেশি জিনিসপত্র নিয়ে যায়। সেসব পেয়ে ওদের হাসিভরা মুখ দেখে আত্মাটা ভরে যায় মোমেনার। কিন্তু এ বার ? এখনও বেতন পাওয়া যায়নি। হাতে তেমন টাকাও নাই। গত মাসে মানুষটার অসুখ বেড়ে যাওয়াতে পাঠাতেও হয়েছিল বেশি। এখন সমস্যা হলো, রাস্তা খরচ যা লাগার লাগবে কিন্তু বাড়ি গিয়েও তো খেতে হবে। কবে মহামারি কমবে, আবার কবে আসা হবে, তার তো কোন ঠিক নাই। তাই, ওদের জন্য জিনিসপত্র নিলে তাতে টান পড়বে ভালই।

ভাবনা-চিন্তা করারও বেশি সময় নাই। নসু মিয়া সৌখিন দোকানদার। চাল-ডাল-পিঁয়াজ-মরিচ―এখানে আসার পর থেকেই তার দোকানে কেনাকাটা। তার বাইরেও অনেক জিনিসই রাখে। একবারে খালি হাতে যাওয়া যাবে না। তাই যা হয়, একটা কিছু নেবার জন্য এসে হাজির হয় সেখানে। দেখে লোকজন নেই। দোকানের ঝাঁপটাও অর্ধেক নামান। সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে মোমেনা। বসে আছে নসু মিয়া। বেচাবিক্রি নাই, হাতে একটা বই। নামাজ শিক্ষার সহজপাঠ। চারিদিকে মৃত্যুর যে বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে পরকালের কথা ভাবাটাই স্বাভাবিক। মোমেনা চেনা মানুষ। আসা যাওয়ার পথে প্রায়ই এটাসেটা কিনে নিয়ে যায়। টাকা না থাকলে বাকি বকেয়াও থাকে। সে হাসে। পান খাওয়া রঞ্জিত মুখের দাঁতগুলো দর্শনযোগ্য নয়।

বড় ছেলের বহু দিনের সখ একটা মাউথ অর্গান। আরেকটি ছেলে আরও ছোট। সে বাঁশিতে ফুঁ দিতে পারে। সে জন্য মাউথ অর্গানের সাথে মিল রেখে তার জন্য নেয় একটা ভেঁপু। মেয়েটার জন্য নেয় চুলের ফিতা আর ক্লিপ। এতক্ষণ তো দোকানের র‌্যাক থেকে জিনিসগুলো বেছে নিচ্ছিল। এবার পিছন ফিরে দেখে নসু মিয়া কখন ঝাঁপটা বন্ধ করে দিয়েছে। একদম টের পায়নি। নসু মিয়া তার জিজ্ঞাসু মুখের দিকে চেয়ে হাসে।

বলে―বন্ধ কর‌্যা দিচি। কহন পুলিশটুলিশ আসে। কিছুই তো খুল্যা রাখবার দিচে না।

বলে আর মোমেনার দিকে এগোয়।

মোমেনা ভাবে, বোধ করি, দাম নেবার জন্য এগিয়ে আসেছে। সে আঁচলের গিঁট খুলে টাকা বের করতে থাকে।

বলে―কত দাম, ভাইজান ?

নসু মিয়া দাম বলে।

মোমেনা দাম দেয়।

বলে―ভাইজান, ঝাঁপটা খুলে দেন। আর তো থাকা যাবে না। দেরি হলে ফেরি মিস হয়ে যাবে।

এ বার নসু মিয়া ঝাঁপ না খুলে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় মোমেনার বাঁ কাঁধ বরাবর। ডান হাতটা কাঁধে রেখে বাঁ হাত দিয়ে তার পাছায় মারে এক চাপড়।

বলে―বাড়ি তো যাবাই। কত দিন তোমার দিকে চায়্যা থাকছি। কবার পারি নাই। শরমের কথা কি কওয়া যায় ? যা ব্যারাম শুরু হচে, যদিল মর‌্যা যাই! এক বার তো সাধটা মিটায়া যাও।

মৃত্যুমুখী মানুষের অন্তিম কামনা! বাহানা ভালোই। মোমেনা দেখে, সে ফাঁদে পড়ে গেছে। সিংহের বল যেন এসেছে নসু মিয়ার শরীরে। সে কোন কিছু বুঝে উঠবার আগেই তাকে চিৎ করে শুইয়ে দেয় আটার না মরিচের বস্তার ওপর।

নসু মিয়া অবশ্য সময় বেশি নেয় না। কাজ শেষ করেই উঠে পড়ে। আবর্জনাদি মুছে ফেলার জন্য টিস্যুর প্যাকেটও এগিয়ে দেয়। বাচ্চাদের জন্য কেনা জিনিসপত্রের প্যাকেটটি নেবার কথা মোমেনার মনেই থাকে না।

মনটা ত্যক্তবিরক্তই ছিল। পথে বেরিয়ে দেখে ভয়াবহ ব্যাপার। অকহতব্য অবস্থা। বৃদ্ধ-যুবা-শিশু-কিশোর―কোন বয়সের কে নেই, বলা যাবে না। ভেদ নেই নারী-পুরুষেরও। বোরখাওয়ালী সেঁটে আছে বেগানা মরদের সাথে। সাথে ছিল মনা। দুজন মিলে বেরিয়েছিল। সারা পথ এক সাথে যাবার সুযোগ আছে। মনার বাড়ি মোমেনাদের তিন-চার গ্রাম পড়ে। বাসে চড়ে যেতে হবে নদীর পারে। সেখানে লঞ্চ-স্ট্রিমার পাওয়া যাবে। কিন্তু হেঁটে হেঁটে স্টান্ডে এসে দেখে বাসে ওঠার কোনও উপায় নাই। একেকটা করে বাস আসছে আর পড়িমরি করে সবাই ছুটছে তাতে গলিয়ে ঢোকার। আর বাসেরই যদি এই অবস্থা হয় তবে লঞ্চ-স্টিমারের দশা তার চাইতে কি ভালো হবে ? ভাড়াও বেড়ে গেছে ডাবল-তিন ডাবল। শেষ কালে এক ব্যাটারি চালিত ভ্যান গাড়ির সাথে চুক্তি হয়। সামনে চারজন, মাঝে চার জন আর পেছনে চারজন―মোট বারোজনের শেয়ার। স্থ’ুলকায়া, কৃশ ও প্রমাণ সাইজ মিলে ওজনে ব্যালান্স হলেও পুরানো ব্যাটারির শক্তি সীমিত। নদীর ঘাটে পৌঁছাতেই বিকেল শেষ। এবার তো প্রতিযোগিতা লঞ্চ-স্টিমারে ওঠার। হাঁসফাঁস করে ঠেলাঠেলি করে একটা লঞ্চের সামনে এসে দেখে সেটা ছেড়ে দিচ্ছে। সরিয়ে নেয়া হয়েছে লঞ্চে ওঠার মই।

এ সময় মনা, এতটাই মরিয়াছিল যে, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে, পাড় থেকে লঞ্চে ওঠার জন্য দেয় এক লাফ। পানিতে পড়ে সখাত সলিলই হত কিন্তু কপাল ভালো, একটা পা পৌঁছেছিল লঞ্চ পর্যন্ত। দেহের ঝোঁকটাও ছিল সে দিকে। লোক গিজগিজ করছে লঞ্চে। একবারে ধারে যারা ছিল, তারা তাকে ধরে ফেলে তুলে নেয় লঞ্চে।

মোমেনা আর করবে কি ? সাহস করে লাফ দিলে পানিতে ডুবে মরা যাবে কিন্তু লঞ্চে আর ওঠা হবে না। সহসাই সে খুব অসহায়ত্ব বোধ করতে থাকে। এই অনিশ্চিত যাত্রায় এক জন সঙ্গিনী তো ছিল। এখন সে একা। চারদিকে জন অরণ্য, কিন্তু সে একা। রাত্রি নেমে আসছে। আশ্রয় বলতে উন্মুক্ত আকাশের নিচে এই উলঙ্গ মাটির পৃথিবী। কিন্তু তা কতটুকু নিরাপদ। ছেলেমেয়েদের কথা মনে হয়। নসু মিয়ার দোকানে ফেলে আসা ওদের জিনিসপত্রগুলোর কথাও মনে হয়। রুগ্ণ মানুষটির কথাও মনে হয়। সত্যি, সত্যি, কি সে বাড়ি গিয়ে পৌঁছাতে পারবে ?

কখন আবার লঞ্চ-স্টিমার আসবে ? এলেও সে কি উঠতে পারবে ? লোক জন দলে দলে ভাগ হয়ে এ দিক বসে আছে। ঝুপড়ি তোলা দোকানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে চা-সিগারেটও খাচ্ছে। ক্ষুধা-তৃষ্ণার কথা যেন সে ভুলে গেছে। হাঁটতে থাকে এ দিক ও দিক। জানে, এটা বিপদজনক। নসু মিয়ার দোকানে হোক, আর রাস্তাতে হোক আর ভিড় ভর্তি মানুষের জটলাতেই হোক, অফ চান্স নেয়া মানবিক পশুদের অভাব নাই।

হঠাৎ মোমেনার কানে ভেসে আসে―চল, চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে। মালগুলো রাতেই পৌঁছে দিতে হবে।

আবছা অন্ধকারে চেহারা ভালো করে দেখা না গেলেও মোমেনার, বোধ হয়, দুটো প্রৌঢ় ধরনের লোক। সঙ্গে একটি তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলেও রয়েছে।

মোমেনা কিছুটা দুঃসাহসী হয়েই এগিয়ে এসে তাদের জিজ্ঞাসা করে―কোথায় যাবেন ?

অযাচিত এই প্রশ্নে ওরা চমকে উঠলেও মেয়েমানুষ দেখে তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না।

ওদের একজন বলে―তাতে তোমার কি ?

মোমেনা নিরুপায় হয়েই বলে―আপনারা কি নদীর ওপারে যাবেন ? আমার লঞ্চ মিস হয়ে গেছে। বড় বিপদে পড়েছি।

মেয়ে মানুষ বলে কথা! আগের লোকটাই অন্য লোকটার নাম ধরে বলে―জুম্মন, নিয়ে নে। মেয়েমানুষ, মালামালের আর কি বুঝবে ? মাঝখান থেকে―বলেই চোখ টেপে। অস্পস্ট আলোতে চোখটেপা বোঝা না গেলেও কথার শূন্যস্থান পূরণ করে নিতে সময় নেয় না, আরেকটি লোক, যার নাম, ইজ্জত।

সে বলে―দেখ, বিপদে পড়েছ, নদী পার করে দিচ্ছি। মনে থাকবে তো উপকারের কথা ?

মোমেনা বিগলিত হয়ে যায়। তাই তো, কথায় আছে, যত মুশকিল, তত আসান―মিথ্যা নয়।

সে বলে―আপনারা আমার পরানের সোদর ভাই, আপনাদের ওপর আল্লা ছাড়া আর কেউ নাই।

ইজ্জত তখন সাথের ছেলেটিকে বলে―চিন্টু, আমরা আগে যাত্যাচি। তুই সঙ্গে নিয়া আয়।

ব্যাটারি চালিত নৌকা। জুম্মন আর ইজ্জত আগেই এসে বসে আছে। মোমেনা ভেবেই রেখেছিল নদী পারাপারের এত চাপ, সেখানে লোকজন তো আরও থাকবে। কিন্তু এসে দেখে, সে একা। মোমেনাকে ওরাও ব্যবহার করতে চেয়েছিল ঢাল হিসেবে। যে মালামাল ওরা নিয়ে যাচ্ছে, পুলিশ এলে মোমেনার পেটে বেঁধে চালিয়ে দেওয়া যাবে গর্ভবতী বলে।

নৌকার ওঠার আগে মোমেনা এক বার ভেবেছিল, একাকী মেয়ে, উঠবে কি না ? আবার না উঠলে, উদ্দেশ্য খারাপ থাকলে, তাদের বল প্রয়োগ করাটাও বিচিত্র নয়। এটাও মনে হয়েছিল, মেরে ফেলেই বা ওদের কি লাভ হবে ? বরং একটা ছোট ছেলের সামনে বাসনা পূরণ, তা হলে কি লজ্জা বলে দুনিয়াতে কিছু থাকবে না ?

নৌকা চলছিল ভালোই। বিস্তীর্ণ নদীর জলরাশি প্রাকৃতিক আলোতে জ্যোৎস্নার ফুলঝুড়ি ফোটাচ্ছিল। ওপরের নক্ষত্ররাজি পথ চলছিল সাথে সাথে। মোমেনা এক পাশে বসেছিল গুটিসুটি মেরে। ভালোই লাগছিল তার। নিজেকে এভাবে আত্মনিমগ্ন করে দেখার সময়ই বা কোথায় কর্মকোলাহলময় জীবিকা তাড়িত জীবনে। ঘণ্টা দুই এভাবে চলার পর জুম্মন চিন্টুকে ধমক দিয়ে বলে―ব্যাটারির পাশে বসে থাক। এ দিকে তাকাবি না, একদম।

মোমেনা বুঝতে পারে, তার এ বার সময় হয়েছে উপকারের শোধ দেওয়ার।

জুম্মনই প্রথম আসে। ওদের মধ্যে ওই বেশি বয়স্ক। বোধ করি, এটা তার ‘সিনিয়রিটির প্রিভিলেজ’। মোমেনা বাধা দেবার চেষ্টা করে না। সতীসাধ্বীর গর্ব তো আগেই শেষ হয়ে গেছে। এখন রয়েছে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়াহীন দেহ। তার ওপর ‘পরানের সোদর ভাইরা’ বিবাহবহির্ভূত ভাতারের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হয়। ওদের হয়ে গেলে নির্জীবের মতো শুয়েই থাকে মোমেনা। শুয়েই থাকে। তার পর ভাবে চিন্টুর কথা। সাবালক হয়েছে। ওকেই বা কি হবে স্বাদমুক্ত রেখে ?

এ রকম মোমেনা তো এক জন। আরও আরও মোমেনা আছে, তাদের কারও নাম নুরজাহান, কারও নাম তুর্কি, কারও নাম রউফন, কারও নাম নেছা। তাদের প্রত্যেকেরই ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন হলেও, ফল এক। পথে ভাঙা ভাঙা করে বাড়ি ফেরা। মলিন পরিচ্ছদ। ব্যাগবোচকা ঘাড়ে। নিরানন্দ তাদের এই প্রত্যাবর্তন। যে ভাবে রোগের বিস্তার ঘটছে, মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তাতে তাদের এই কর্মহীন জীবনের পরিসমাপ্তি কি ভাবে ঘটবে, আন্দাজ করেও বলা যায় না। আর এই সমস্যা তো কেবল গার্মেন্টসের নারী কিংবা পুরুষ শ্রমিকদের নয়। ফুটপাতে যারা দোকান পেতে বসত, ফেরি করে বিক্রি করত জিনিসপত্র, লেবার হয়ে স্টেশানে-স্টিমার ঘাটে মোট বইত―যাদের তালিকা কেউ তৈরি করে না, তারা সবাই। যে দু-চারজন কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ত, তারও বেকার। কাজেই, অচিরেই গ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে যাওয়া নানান কিসিমের লোকজনদের দিয়ে আবার পরিপূর্ণ হয়ে যায়। হঠাৎ করেই জনসংখ্যার চাপ বেড়ে যাওয়াতে জিনিসপত্রের যেমন আকাল বাড়ে, দ্রব্যমূল্যও হতে থাকে লাগামহীন।

নুরালীর দোকানে একটি টেলিভিশন আছে। পেটে খাওয়া না থাক, সময় তো কাটাতে হবে। তাই টেলিভিশনের সামনে ভিড় লেগেই থাকে। সেখানে বিদ্বৎজনেরা ক্লান্তিহীন হয়ে বিশেষজ্ঞের মত প্রদান করতে থাকেন। কোনটা করা উচিত আর কোনটা করা অনুচিত, তাই নিয়ে চলতে থাকে বাহাস। ভাবখানা এ রকম যে, তাদের এক দিনের বাদশাহি দিলে এক ফুৎকারে সমাধান করে দেবেন সব সমস্যার! তাদের বুদ্ধি নেয়া হচ্ছে না কেন, তাই নিয়ে হতে থাকে তর্কবিতর্ক। ঝগড়াঝাঁটি পর্যন্ত গড়ায়।

টীকা কবে আসবে, ঠিক নেই। প্রণোদনার ঘোষণা আছে, কার্যকারিতা নাই। চেয়ারম্যান-মেম্বারেরা বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে দেন না, বিদায় করেন রাস্তা থেকেই। কিন্তু তা বলে জীবন যাত্রা থেমে থাকে না। আব্বাস মিয়া, তার নাবালিকা মেয়ের বিয়ে পর্যন্ত ঠিক করে ফেলে।

জেবুনারা গিয়ে হাজির হয় তার বাড়ি।

বলে―আব্বাস ভাই, এইটা কি করতাচেন ?

আব্বাস মিয়া বলে―কেন, ঘরে মেয়ে আছে, তার বিয়া দেওয়া লাগব না ?

জেবুনারা বলে―তা তো লাগবেই। ভাবীর বাপ বিয়া দিছে, আমার বাপও দিছে―আপনিও বাপ, আপনার মেয়ের বিয়ে তো আপনিই দেবেন।

আব্বাস মিয়া বলে―তাই তো দিতাচি।

জেবুনারা বলে―এই মহামারির মধ্যে ?

আব্বাস মিয়া বলে―কী বলতাচ ? মহামারি আছে মহামারির জাগায়। আর বিয়া হব আমার বাড়িতে। কবে মহামারি আছিল না ? তাই বলে হাত-পা গুটায়ে বসে থাকলে চলবে ?

জেবুনারা বলে―স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গ হবে না ?

আব্বাস মিয়া বলে―কে মানতেচে ওসব ? আয়েনুদ্দিন তো কোয়ারেন্টাইন থেকে পালায়া আইসা এহন বিকেল বেলায় ছড়ি হাতে নিয়া বাতাস খায়। কেউ কিছু করতে পারচে ?

জেবুনারা এ বার তার শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে।

বলে―সবই বুঝলাম ভাই কিন্তু আপনার মেয়ে যে ছোট। প্রাইমারিও পাশ হয় নাই। আমাদের কালে না হয় চল ছিল না। কিন্তু এখন লেখাপড়ার কত সুযোগ ?

আব্বাস মিয়া, বোধ করি, তার মনের সমস্ত জোর একীভূত করে এত ক্ষণ কথা বলছিল। কিন্তু জেবুনারার এ কথা শুনে সে কেঁদে ফেলে।

বলে―বোন, আমি আর পারতাচি না। মেয়েটা না খেতে পেয়ে কষ্ট পাবে, আমি তা সহ্য করবার পারমু না। ভালো ঘর থেকে বিয়ে আসছে, আর কিছু না হোক, না খেয়ে তো থাকবে না।

এত বড় সমস্যার সমাধান করার পথ, অন্তত জেবুনারার নাই।

আসলে কোনও সমস্যার সমাধানই জেবুনারার হাতে নাই। কথাবার্তা যাই বলুক আর যতই ঠোঁট কাটা হোক, মানুষের ভালো কবরার একটা মানসিকতা সবসময়েই কাজ করে। সেভাবে দেখলে তার প্রতিপক্ষ হলো গ্রাম সমাজ। সেটা, একসময় তো ছিল অনড়। গ্রামের বাইরে যে পৃথিবী আছে, এই বোধই ছিল না। কিন্তু এখন তো আর তেমন নাই। মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্র বেড়েছে। তারা বাইরে যাচ্ছে। বাইরের মানুষেরা আসছে। ব্যক্তিক অধিকার বলেও একটা জিনিসের চল হয়েছে। স্কুল-কলেজ-লেখাপড়ার বিস্তার ঘটেছে। এনজিওগুলোও কাজ করছে। প্রশাসনিক ইউনিটগুলোও একবারে নাকের ডগার ওপর বসে আছে। ঘটনা যাই ঘটুক, তা খবরের কাগজের খাবার হয়ে দেশ জুড়ে তোলপাড়েরও ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান। সবসময়ই পাঁচ-দশ জন লোক বসে আছে। জটলা পাকাচ্ছে। এই জটলার ভেতর দিয়ে সলাপরামর্শ হোক, দল পাকানোই হোক, এক ধরনের জনমত তৈরি হচ্ছে ফল্গুধারার মতো। পালটে গেছে পোষাক-আসাকও। কিন্তু মূল্যবোধের জায়গাটা রয়ে গেছে আগের মতোই। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সংস্কার-কুসংস্কারেরর স্রোতোধারা আবর্ত পাকিয়ে পাকিয়ে রয়ে গেছে বদ্ধ জলাশয়ের মতোই দুর্গন্ধযুক্ত। নিজেরা যতই প্যান্ট-সার্ট পরুক, আর টেলিভিশনের পর্দায় হাফ-ন্যাংটো মেয়েদের নাচ-গান দেখুক-শুনুক, পর্দাপুশিদার নামে, মেয়েদের কাজে-কর্মে, সুযোগ পেলেই নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে থাকে। এতটুকু মেয়ে,তাকে পর্যন্ত কাপড়ে-চোপড়ে জড়িয়ে বস্তা বানিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে রাস্তায়।

জেবুনারার চলাফেরাও তাদের পছন্দের নয়। কিন্তু জেবুনারার কথা একটাই―আমি কি কারও খাই না পরি, তার হুকুম মেনে চলতে হবে ? ভাত দেবার মুরোদ নাই, কিল দেবার গোঁসাই!

এরই মধ্যে একটা ঘটনা তার কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে এল। প্রণোদনার চাল-গম-ডাল-তেল দেওয়া হলো ইউনিয়নে ইউনিয়নে। মেম্বার-চেয়ারম্যানেরা সেগুলো আবার বরাদ্দ দিচ্ছে গ্রামে গ্রামে। এই বরাদ্দের মধ্যে আবার তাদেরও বরাদ্দ রয়েছে। এমপি ইলেকশন করতে অত টাকা না লাগলেও চেয়ারম্যান-মেম্বার হতে তার চার-ছআনা তো লেগেছে। এসব বরাদ্দের ভেতর থেকে নিজেদেরটা বরাদ্দ করে না নিলে খরচ উঠবে কোথা থেকে ? তাই তাদের চেষ্টা ছিল কি করে কম পরিমাণ বিতরণ করা যায় ? পরে তার একটা হিসেব বানিয়ে কাগজে-কলমে মিলিয়ে দিলেই বা পায় কে ?

প্রণোদনা আসার পর তারা নিয়ম করল, এই সাহায্য এসেছে অসহায় গরিব মানুষদের জন্যে। যারা গ্রামের বাইরে থাকে, চাকরি-বাকরি করে, তারা তো চাকুরে। তাদের তো সাহায্যের দরকার নাই। তারা পাবে না।

এই কথা শুনে মোমেনাদের তো মাথায় হাত। তারা যে কর্মহীন হয়ে এসেছে, আবার কবে কর্ম ফিরে পাওয়া যাবে, তার কোন নিশ্চয়তা নাই। গুজব ইতিমধ্যে গ্রামেও ছড়িয়েছে।―ক্যানসেল হয়ে গেছে না কি অর্ডার! আর অর্ডার যদি ক্যানসেল হয়েই গিয়ে থাকে তবে মালিকেরা কি ঘরের টাকা খরচ করে পোষাক বানিয়ে নিজেদের বউঝিদের পরাবে ? দল বেঁধে তারা গিয়েছিল দেনদরবার করতে। চেয়ারম্যান-মেম্বারেরা তা বুঝতেই রাজি না। কাজের কাজ তো কিছু হয়ইনি, উপরন্তু শুনতে হয়েছে অশ্রাব্য-অশ্লীল কথা।

চেয়ারম্যান সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে―বেহায়া মেয়েগুলো এখানে এসেছে কেন ? চাকরি করে―না, ঢলাঢলি করে ? ওখানে না হয় তোদের ইজ্জৎ-আব্রু বলে কিছু নাই। কিন্তু এখানে এসব চলবে না।

এ কথা শুনে তো ব্রহ্মচাঁদি গরম হয়ে যায় জেবুনারার। কিন্তু সে মাথাটা নিজেই ঠাণ্ডা করে।

খুঁজে বের করে আশেক, জনাব আলী আর মুসিকে।

ওরা তখন বসেছিল গ্রামের শতবর্ষী বটগাছটার তলে। ছোটবেলায় আসতে তো ভয় হত। ডালপালা ছড়িয়ে রেখেছে চার দিকে। তার প্রান্ত নুয়ে পড়েছে মাটিতে। মূল কাণ্ডের বাইরেও যে শাখা কাণ্ড, তার অনেকগুলোর ভেতরই খোড়ল হয়ে গেছে। পাহাড়ের গুহার মধ্যে যেমন ঢুকে পড়া যায়, এসব খোড়লের ভেতরটাও তেমনই। শুয়ে থাকা যায়। কত দিন ভেবেছে, সাহস করে এক বার রাতে এসে ঘুমুলে কেমন হয় ? কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। কেন না, ভূত-প্রেত না থাকতে পারে কিন্তু তার ভয়টা তো আর মিথ্যা নয়। বিশেষত নানা গল্প-গাথা ঘিরে রেখেছে বটগাছটিকে। সব চেয়ে বৃদ্ধ আতরালী, বলে, বয়স একশ বিশ, কিন্তু তা, না হলেও নব্বই তো বটেই, সে-ও বলে, তার ছোট বেলায় গাছটাকে না কি সে এমনই দেখেছে।

সময়টা দুপুর। গাছটি যত প্রাচীন আর যত ভীতিপ্রদই হোক, বিছিয়ে রেখেছে শীতল ছায়া। ওরাই বা করবে কি ? স্কুল-কলেজ বন্ধ। ওদেরকেও চলে আসতে হয়েছে। কিন্তু শান্তিমতো থাকতে পারছে কই ? হাটে যাক আর বাজারে যাক, আর চায়ের দোকানে বসুক, অন্যরা যে যার মতো গল্পগুজব যাই করুক, ওরা গেলেই পরিণত হয় আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে।

―ক্যারে বা আর কি স্কুল কলেজ খুলবে ?

―আর কদ্দিন বাকি আছিল লেহাপড়া শ্যাষ হওয়ার ?

―সুখেই তো ছিলা ওহানে। বাপ টাকা পাঠাত, ফুর্তি-ফার্তি তো কম কর নাই ? ক্যামন ঠেকতাচে এহন ?

―লাইন-টাইন দিচিলা বোধ হয়! মন খারাপ করে ?

এমনিতেই একটা বিপর্যয়কর অবস্থা ―সারা দেশের, সারা পৃথিবীর। তুচ্ছাতিতুচ্ছ হয়ে গেছে ব্যক্তিমানুষের চাওয়া-পাওয়া। জীবন যে পদ্মপত্রে জল, নিজেদের বেলাতেই এসে তা যে সার্বজনীন ভাবে প্রতি মুহূর্তে ধরা পড়তে থাকবে, তা ছিল বোধগম্যতার বাইরে। সুতরাং সহ্য করা যায় এ সব কথাবার্তা ? কাজেই, ওরা চায়, যতটা পারা যায় লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে।

শুধু কি তাই ? খেতে বসে বাপ-মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারে না ভালো করে। খাওয়ার সময় বাদ দিয়ে ত্রিসীমানাতে আসে না বাড়ির। তার অর্থ যখন তখন পড়তে চায় না বাবা-মার সামনে। কেন না, ওদের দেখলে তারাও হয়ে পড়ে হতাশাগ্রস্ত। লেখাপড়ার খরচও তো মেলা। প্রাইভেটে পড়াতে হলে তো অনেকের জমা-জমি বিক্রি। প্রত্যাশা একটাই, সব পূরণ হয়ে যাবে, যদি একটা চাকরি জোটে। এখন তো মনে হয়, শেষ হবে না লেখাপড়াই। সুতরাং সন্তানাদির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাদের বাকি জীবনটাকেই করে তুলছে তমসাচ্ছন্ন। ঘোষণাও হয়েছে, অন লাইনে ক্লাস শুরু হওয়ার। কিন্তু গ্রামে থেকে সে সুযোগ নেবে কি করে ?

মানুষ তো নিশ্চুপ থাকতে পারে না। তাই কথা বলতে হয়। বটবৃক্ষের পত্রপল্লবিত ছায়াময়তা, সাধারণত প্রলুব্ধ করে ঘুমকেই। এই দুর্বিপাক ওদের জীবনকে ছিন্নভিন্ন না করে দিলে, হয়ত সেটাই হত স্বাভাবিক। কিন্তু যে নিরুপায় ক্রোধ ওদের মনে স্থিত হয়ে রয়েছে, তার প্রকাশ না ঘটিয়ে গত্যন্তরই বা কি ?

সেদিনের খবরে এসেছে এক হাসপাতালের কথা। গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার মালিক সহ অনেককে। সেখানে করোনা টেস্টের ভুয়া সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছিল। তার জন্য নেয়াও হচ্ছিল গলাকাটা টাকা। কদিন আগেই এক প্রতিষ্ঠানের কেচ্ছা বেরুল, কম দামে মাস্ক নিয়ে এসে শুরু করেছে পুকুর চুরি। মৃত্যু যেন এই সব বদমায়েসদের কাছে হয়ে এসেছে মহোৎসব। সেই উৎসবের রঙে রাঙিয়ে নিচ্ছে নিজেদের চেহারাসুরত।

আশেক বলছিল সে কথাই―এরা কি মানুষ ? কত ডাক্তার জীবন বাজি রেখে চিকিৎসা করছে। মারাও যাচ্ছে। আর এরা ? মাঝে মনে হয়, কেন যে এ দেশে জন্মেছিলাম ?

মুসি বলে―নিজের কথা এখন আর আমি ভাবি না। যারা মারা যাচ্ছে, তাদেরও তো জীবনের দাম ছিল। মৃত্যুর কথা ভাবলে জীবনটা কত তুচ্ছ হয়ে যায়।

জনাব আলী বলে―বুঝলি, আমার জীবনের ফিলসফি এখন বদলে গেছে। চার দিকে কেবল রব উঠেছে, কত ক্ষতি হয়ে গেল। কত সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য মারা যাচ্ছে মাঠে। পড়াশোনা শেষ করে ভদ্রলোক হয়ে চাকরি খুঁজে বেড়ান হচ্ছে না। বাড়ির মধ্যে বসে থেকে থেকে ছেলেমেয়েরা ফ্রিজে রাখা টিকটিকির মতো সাদা হয়ে গেল। চারদিকে কেবল, গেল। গেল। তাই আমিও ঠিক করেছি, কত দূর গেল, বসে বসে তাই দেখব।

তবে জীবনের এই অসারত্ব প্রমাণের প্রস্তাবনা বাস্তব রূপ নেবার আগেই, সে খানে এসে হাজির হয় জেবুনারা।

বলে―ছোট ভাই, তোমরা যে পড়তে যাও, তোমাদের সাথে মেয়েরা পড়ে না ?

এ কথা শুনে ওদের মনটা উদাস হয়ে যায়। কী সব ছিল সেসব দিন! পড়াশোনা তো পড়াশোনা, গল্পগুজব না থাকলে কি তা হয় ? আহারে যেমন চাটনি লাগে, পড়াশোনাতে তেমনই হলো আড্ডা। ক্লাস থেকে বেরিয়েই ছায়া খুঁজে বসে পড়া। না হলে হাঁটতে হাঁটতে চিৎকার-চ্যাঁচাঁমেচি করা। আর কিছু না হলে চা-শিঙাড়া খাওয়া। বন্ধ হয়ে গেছে সেসব। এখন ওরা যেন স্বর্গ থেকে বের করে দেওয়া আদম সন্তান। কিন্তু সে আক্ষেপ জেবুনারার সামনে করে লাভ কি ?

তবে মেয়েরা ওদের সাথে পড়ে কি না, এ প্রশ্ন করার মাজেজা কি হতে পারে, তা তাদের কিছুটা চিন্তাতে ফেলে দেয়। এর সাথে কোনও উটকো কোনও বিপদ জড়িয়ে আছে কি না, সেটাও ভাবে। কেন না, জেবুনারার গতিবিধি সর্বত্র। কোথায়ও খারাপ কিছু শুনে এসেছে কি না, কে জানে ?

তাই জবাব কি দেবে, এই নিয়ে তিন জন মুখ চাওয়া-চাওয়ই করে।                        

জেবুন্নেসা বলে―এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছ কেন ? তোমর―মেয়েরা তো একসঙ্গে পড়। তোমাদের সাথে পড়ে বলে ওরা কি বেহায়া ?                                                               

আশেক বলে―না, না, তা কেন হবে ?

জেবুনারা বলে―তা হলে বল, গার্মেন্টসে যারা কাজ করে খায়, তারা কি বেহায়া ?

মুসি বলে―ঘটনাটা একটু খুলে কন তো আপা ?

জেবুনারা তখন আদ্যোপান্ত বলে। তার পর ওদের কাছে প্রশ্ন রাখে―তোমরাই কও, নিজেরা খায় চাল চুরি করে, গম চুরি করে। আর এ দিকে এরা না খেয়ে মারা যাবে, তা কি হয় ? তোমরা লেখাপড়া জানা ছাওয়াল-পাওয়াল। খবরের কাগজে দেখি, কথায় কথায় মিছিল কর, স্লোগান দাও। এখানেও মিটিং কর। দাবি আদায় কর।

তবে বলাটা যত সহজ, কাজটা তত সহজ না। গ্রামের পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয় জ্ঞাতিগোষ্ঠী দিয়ে। বিচারও হয় না ন্যায়-অন্যায়ের বাটখারায়। কে কোন গোষ্ঠীর লোক, দেখার বিষয় সেটাই। চুরি করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়লেও, তার পেছনে দাঁড়াবার লোকের হয় না অভাব। সে যাই করুক, আমার লোক―এটাই হলো শেষ কথা। আর হবেই-বা না কেন ? যারা প্রভাবশালী, কায়েমি স্বার্থের যারা সুবিধাভোগী―তারা নিজেরা তো আর ফেরেশতা নয়। শক্তি দেখিয়ে তাদের অবৈধ জিনিস বৈধ করতে হয়। আছে তো তো নানা ফন্দিফিকির। লোক চাই তার জন্য। এখন আপদেবিপদে তাদের রক্ষা করবার দায়িত্ব নিতে হবে না ?

আরও বিপদজনক ব্যাপার হলো, জাতীয় রাজনীতিরও সম্প্রাসারণ ঘটেছে গ্রামে। চুলোয় গেছে আদর্শ-ফাদর্শ। এখানেও জ্ঞাতিগোষ্ঠীর হিসাব। এখানেও কিনশিপ। এক গোষ্ঠীর লোক যদি করে এক দল। তবে প্রতিপক্ষ গোষ্ঠীর লোককে তার উল্টো দল করতেই হবে। এ ভাবেই বিভক্ত হয়ে গেছে গ্রামীণ জীবন। সর্বত্রই দলাদলি। খেতের আল কাটা থেকে শুরু করে পাকা ধানের জমির দখল নেয়া যেন নিত্যনৈমিত্তিকের কাজ। দাঙ্গা-হাঙ্গামা-মারামারি―থানাপুলিশ-মামলামোকদ্দমা এখন আর কোনও খবরই না।

তাছাড়া দলাদলির ব্যাপারটা তো এখন সারা দেশে এক ঘোরতর নেট ওয়ার্ক তৈরি করে রেখেছে। ইউনিয়ন কমিটি, উপজেলা কমিটি, জেলা কমিটি, নগর কমিটি, মহানগর কমিটি ইত্যাদি―ধাপে ধাপে স্থাপত্য বানিয়েছে পিরামিডের। সরকারি দল হোক, আর বেসরকারি দল হোক, ঘটনা সবারই এক। এক চুনাপুঁটি নাড়লে রাঘব বোয়াল পর্যন্ত এসে হাজির হয়। আবার নেতারও শেষ নাই, তাই নেতাগিরির জায়গা তো ভরাট করতে হবে।

এসব কথা বিবেচনা করলে তাই চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বিরুদ্ধে খুবই কঠিন ব্যাপার। ওরা চুরি করলেও দলীয় ইমেজ বাঁচানোর জন্য তাদের নির্দোষিতা প্রমাণ করার প্রতিযোগিতাতে ওদের নেতারা লাফিয়ে পড়বে হা-হা রবে। নৈতিক শক্তি বলে একটি সার্বজনীন বিষয় আছে। কিন্তু তার কার্যকারিতা সময়-সাপেক্ষ। বিশেষত জেবুনারাদেরও যদি একটা দল থাকত তা হলেও না হয় কথা ছিল। কিন্তু ওরা তো অসংগঠিত। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের প্রতিপক্ষ দল আছে সত্যি। তারাও কম শক্তিশালী নয়। ইলেকশনে তো প্রায় হারিয়েই দিয়েছিল, এখন যে চেয়ারম্যান, তাকে। তবে প্রথম যে প্রশ্ন হলো তা হলো, তারা যুক্ত হবে কি না ? তাদেরও তো হিসেবের ব্যাপার আছে। এলাকায় ও রকম চাকরিজীবী আর কজন ? তাছাড়া এর সাথে জড়িয়ে গেছে মেয়েদের পর্দাপুশিদার ব্যাপার। এখন এসব ‘বেহায়া’ মেয়েদের জন্য কিছু করা, ব্যাখ্যা তো অন্য রকম দাঁড়াতেই পারে। তখন বিষয়টা কালার নেবে গ্রাম্য দলাদলিতে। খেতে না পাওয়া মেয়েগুলো আউট হয়ে যাবে দৃশ্যপট থেকে। দ্বিতীয়ত চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। এ কাজে, তারাই বা কম যায় কীসে ? অবস্থা ঘোরতর হলে, দু-চার বস্তা চাল তাদের দিয়ে দেওয়াতে তো আর ক্ষতি নাই।

জনাব আলী ঘাড় চুলকায়।

বলে―জেবু আপা, মিছিল-মিটিং করে সুবিধা হবে না। আপনাকে তো দেখতেই পারে না, টার্গেট হয়ে যাব আমরাও।

জেবুনারা বলে―ভয় পাচ্ছ ?

মুসি বলে―রাগবেন না ? জনাবের কথার যুক্তিটা আমি বুঝতে পেরেছি।

জেবুনারা বলে―এখানেও যুক্তি ? বল, কী যুক্তি ?

মুসি বলে―আপনি তো শহরে থাকেন না তাই অনেক কিছুই জানেন না।

জেবুনারা বলে―ঠিক আছে জানি না। জানাও ?

মুসি বলে―সরকারি দল বলেন আর বিরোধী দল বলেন, মিছিল-মিটিং করার জন্য লোক নিয়ে আসে ভাড়া করে। দেখেন না, খালি প্রেস কনফারেন্স হয়। নিজেরা নিজেরা বসে থাকে আর ছবি ছাপা হয় কাগজে। পাতা ভরে যায় বক্তৃতা-বিবৃতিতে। লোক পাওয়া গেলে কি, প্রেসম্যানদের ডেকে আনতে হয় ? তখন তো তারা নিজেরাই চলে আসত গুরুত্ব বুঝে―ওর কথা কেড়ে নিয়ে জনাব আলী বলে―জেবু আপা, এখানে মিছিল-মিটিং করার লোক কই ? ভাড়া করার টাকা পাব কোথায় ? সাধাসাধি করে কিছু লোককে আনলেও আনা যেতে পারে কিন্তু যখন দেখবে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বিরুদ্ধের ব্যাপার, তখন তারাও, দেখবেন হয়ে যাবে হাওয়া।

এসব কথা শুনে অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে জেবুনারা।

সে বলে―লাগবে না লোক। আমরা চারজনই দাঁড়াব ফেস্টুন-প্লাকার্ড নিয়ে মুসি বলে―জেবু আপা, কেবল দাঁড়িয়ে থাকলেই তো হবে না, কাজের কাজ কতটা হয়, সেটাও তো চিন্তা করতে হবে।

এতক্ষণ আশেক চুপ করেই ছিল। কিন্তু মনে হয় হঠাৎ করেই সে একটা আইডিয়া পেয়ে যায়।

সে বলে―জেবু আপা―আমার একট কথা শুনুন। মুসি, জনাব―তোরাও শোন। আমি জানি, আমার কথা হাসিরই খোরাক হবে। তবু বলছি, সমস্যা তো কর্মহীনদের সাহায্য করা। সবাইকে তো সাহায্য করা আমাদের সাধ্যের বাইরে। কিন্তু কিছু মানুষ, যাদের কিছুতেই চলছে না, খেতে পর্যন্ত পাচ্ছে না, তাদের দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা তো আমরা করতে পারি। এজন্য আমরাই না হয়, ভিক্ষা করতে নামব। নিজেদের বাড়ি থেকে, যা পারি দেব, যারা অবস্থাপন্ন তাদের কাছে যাব। সাহায্য কতটুকু হবে, জানি না। কিন্তু এভাবে মানুষের বিবেককে যদি জাগ্রত করা যায়, এটাও কিন্তু একটা বড় কাজ।

এ বার মুসি বলে―জেবু আপা, লেখাপড়া যাই করি, একটা জিনিস আমার কাছে ইদানীং খুব হাস্যকর হয়ে উঠেছে। তা হলো, দাবি ছাড়া আমরা যেন আর কিছু করতে পারি না। আর এই দাবি হলো রাষ্ট্রের কাছে। আর রাষ্ট্রও দেখছে, সব যখন আমাকেই দিতে হচ্ছে তখন আমাদের কি করে নতজানু করে রাখা যায়, বের করছে তার ফন্দি-ফিকির। এভাবে রাষ্ট্র হয়ে উঠছে সর্বগ্রাসী। আর রাষ্ট্র মানে কি ? এটা তো একটা আইডিয়া-কনসেপসন। তার বাস্তব প্রয়োগ ঘটছে রাষ্ট্রের জনগণের দ্বারা। আর ফাঁকিটাও এখানেই। কারণ রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে একটি গোষ্ঠীর দ্বারা। তারা রাষ্ট্রের নামে মানুষের অধিকারই বলি আর ব্যক্তির স্বাধীনতাই বলি, তা নিচ্ছে কেড়ে। এটা ঠিক, এখন জীবনের যে ব্যাপ্তি, তাতে বিচ্ছিন্ন থাকা সম্ভব না। একটি রাষ্ট্রও একক ভাবে চলতে পারে না। তার পরও নিজেদের পায়ের ওপর আমরা যদি দাঁড়াতে পারি, নিজেদের রিসোর্স যদি নিজেরাই তৈরি করতে পারি, তা হলে অন্তত পক্ষে স্বস্তির জীবনটা তো আমরা ফিরে পাব।

জেবুনারা বলে―তাহলে তোমরা কি করতে চাও ? জনাব আলী বলে―আর বক্তৃতার দরকার নাই। আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। এখন থেকেই আমরা কাজ শুরু করি। বাড়ি বাড়ি যাব। যার কাছ থেকে সাহায্য নেয়ার, নেব। যাকে সাহায্য দেওয়ার দেব।

ওদের কাজ শুরু হয়। পাড়ার আরও আরও ছোট-বড় ছেলে এসে যুক্ত হতে থাকে। একটা অভাবিত উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এভাবেও যে কাজ করা যেতে পারে, এই বোধই ছিল সুপ্ত। এখন মনে হয়, খুলে গেছে তার অর্গল।

ইতোমধ্যে মহামারি ধারণ করতে থাকে ব্যাপক আকার। হার যেমন বাড়তে থাকে সংক্রমণের, পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও হয়ে ওঠে ঊর্ধ্বমুখী। শহরাঞ্চলে প্রকোপ বেশি, কিন্তু গ্রামাঞ্চলেও শুরু হয় বাড়াবাড়ি। আর হবেই বা না কেন ? কর্মজীবী, পুরুষ হোক আর নারী হোক, ছিল শহরে, ভালো। তাদের বসতও ছিল সেখানে। রোগ-শোক, যেটাই ঘটুক, তাদের সেখানে রেখেই মনিটারিং করা যেত। গার্মেন্টস-দোকান-হোটেল ইত্যাদি মিলিয়ে যারা কাজ করে, তাদের সুমারি করা কি এতই কঠিন কাজ কিংবা বস্তিতে বস্তিতে যারা থাকে, তাদের একটা হিসেব থাকবে না ? আবার যারা ভ্রাম্যমাণ তাদের নতুন করে না ঢুকতে দিলেই হরতা। কিন্তু সেসব না করে কোন পরিকল্পনা ছাড়াই সবাইকে ঝেড়ে করা হলো বিদায়। রোগ তো ছোঁয়াচে। সুতরাং দেশ জুড়ে তা বিস্তৃত করে দেওয়ার ব্যবস্থাও হলো অতি চমৎকার! ফল ভিড়-ভাট্টার ভেতর দিয়ে মেশামেশি করে যারা এসেছে আবার এসেই স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে বহু দিনের অদর্শনের খায়েশ মিটিয়েছে, তাদের তো সিরিয়াল ডাইরেক্ট। এছাড়া সংক্রমণের আরও বহু পন্থা আছে। সুতরাং প্রত্যক্ষ হয়ে উঠতে থাকে মৃত্যুরোগ। কার করোনা পজিটিভ আর কার নেগেটিভ, তার বোঝার কোনও উপায় নাই। টেস্ট করাতে হলে যেতে হয় শহরের হাসপাতালে। গ্রামের লোক গা করে না। সাধ্যসামর্থের মধ্যেও পড়ে না। খুকখুক করে কেশে বেড়ায়। যত্রতত্র নাক ঝাড়ে।  তাই রোগের প্রকোপ বাড়ে বই কমে না। প্রত্যেক দিনই জ¦রগ্রস্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আম্বর আলী-তাম্বর আলীরা, ভিখুল্লাÑকাল্লুরা, এক এক করে গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। ভয়ও ধরে যায় অন্যদের মনে। যারা সুস্থ আছে বলে নিজেরা মনে করছে, তারা আর কেউ কারও কাছে ভেড়ে না। চিকিৎসাপত্র অপ্রতুল। আশেকেরা নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারে, অসুখ আর কতটুকু কাবু করবে কিন্তু অসুস্থরা মারা যাবে না খেয়েই। কিন্তু উপায় তো শুধু মুষ্ঠিভিক্ষা।

এ দিকে জহরতুন্নেসা তো আইসোলেশনেই আছে। কাহিল হয়ে পড়ছে শরীর। বাড়ির লোকেরা যে যখন সময় পায়, কোলে করে ছেলেটাকে তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখে। এখন তার একটাই কাজ, তা হল, মাই টিপে টিপে বাটিতে বাচ্চার জন্য, যতটুকু পারা যায়, দুধ বের করে দেওয়া। দুর্বল হাতে টিপতে পারে না। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে বের হয়ে আসা অশ্রু বাটিতে যেটুকু দুধ বেরিয়েছে তা পাতলা করে দেয়।

আর বলে―এটুকু দুধ খেয়ে বাচ্চা কী আর বেঁচে থাকতে পারে ?

জেবুনারা, যত কাজই থাক, রোজই যায় তাকে দেখতে। সেদিনও গিয়েছিল। ছেলেটা ছিল কোলে। অস্তগামী সূর্যের শেষ আভা নিরুত্তাপ দীপ্তি ছড়াচ্ছিল। সেই সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল, ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য মায়ের শেষ আকুতি। জেবুনারার সামনেই, বাচ্চার জন্য মাই টিপে দুধ বের করতে করতে ঢলে পড়ে জহরতুন্নেসা।

করোনাতে গ্রামে এটাই প্রথম মৃত্যু।  

সচিত্রকরণ :  শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button