আর্কাইভগল্প

অন্তরালের বিসর্গ চন্দ্রবিন্দু : ইসরাত জাহান

গল্প

আমাদের দেখা হয়েছিল এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়। সারাদিনের রিমঝিম বৃষ্টিটা হঠাৎ তুমুল বর্ষণে রূপ নেয়ায় বাড়ির সামনে সর্বদা ছায়া দেওয়া বটগাছটি চঞ্চলা কিশোরীর মতো নৃত্যময়ীরূপ ধারণ করে, সঙ্গে মেঘের গর্জনের সঙ্গে বিজলির লুকোচুরি খেলায় সন্ধ্যাটা অন্যদিনের থেকে সেদিন একটু তাড়াহুড়ো করেই এসেছিল। তাইতো চারপাশের স্বাভাবিক পরিবেশটা হঠাৎ ভীতিকররূপ ধারণ করে। গগন দাপিয়ে বেড়ানো বিজলির একঝলক আলোয় মায়াময় মুখখানি দেখেছিলাম।

স্নানরত গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া সকলের শরীর ও কাপড় আর্দ্র হয়ে যায় বৃষ্টির জলের সঙ্গে গাছের পাতার নিবিড় আলিঙ্গনের জলকেলির কারণে। গাছের নিচে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো আসন থেকে দুই কদম দুরে দাঁড়ানো কুকুরটাও একটা সময় হেঁটে চলে যায় বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে, যেন কাজের খুব তাড়া। প্রৌঢ় লোকটি মাথায় ছাতা দিয়ে বসে থাকে গুটিসুটি হয়ে। আর সে, হাতে ছোট ব্যাগটি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিজলির আলো-অন্ধকারের লুকোচুরি মাঝে মুখাবয়ব কিছুটা বোঝা যায়। ভেজা লেপ্টানো কাপড়ে শরীর ভাঁজগুলো প্রকট হওয়ায় আমার দৃষ্টি আটকে ছিল তার পানে। সে ছিল ভাবলেশহীন। আমার দৃষ্টি নির্দিষ্ট হলেও, তার দৃষ্টি ছিল অন্ধকার আচ্ছন্ন সুদূরপানে। আমাকে খেয়াল না করারই কথা। একটু দূরে দোতালা একটি বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে, একজন পুরুষ যদি ভাঁজগুলো দেখে নিজে নিজে সুখ অনুভূতি নেয়ার চেষ্টা করে, তা কখনওই সেই নারীর জানার কথা না। বৃষ্টি কিছুটা দম নেয়ার সুযোগে সে বড় রাস্তার দিকে পা বাড়ায়। ওদিকে ভেতরের ঘর থেকে ডাক আসায় আমিও তাড়াহুড়ো করে নিজেকে সামলে নিই।

‘সাহেব ফোন আসছে’ কথাটি আমার ভাবালু রেশটা কাটিয়ে দেয়। জোসেফের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কথা বলতে বলতে ঘরের ভেতরে ফিরে আসি। তারপরে অন্য কাজে ব্যস্ত করে ফেলি নিজেকে। বৃষ্টি, ভাঁজ আমার মনজগতের কক্ষচ্যুত হয়। দৈনন্দিন কাজের চাপে তখন ঢাকায় আমার অপেক্ষায় অপেক্ষমাণ মানুষগুলোর কথা বেমালুম ভুলে যেতাম মাঝেমাঝে। তবে দিনগুলো ভালো মন্দ মিলিয়ে কেটে যাচ্ছিল।

সরকারি একটি প্রকল্পের প্রজেক্ট কো-অডিনেটর হিসাবে আমি তখন রংপুরে। বাড়ি থেকে শতমাইলের দূরত্ব আমাকে একাকিত্বের সাগরে ডোবাত। তাইতো প্রায়সময় বেরিয়ে পড়তাম গ্রেেমর রাস্তায়, প্রজেক্ট দেখাশোনার কাজে।

পীরগঞ্জের মানুষের মুল পেশা কৃষিকাজ। পাশাপাশি টুকটাক ক্ষুদ্র শিল্প নিয়ে কাজ করে কিছু মানুষ। শতরঞ্জি তেমনই একটি শিল্প। মাঝেমধ্যে ওদের ওখানে গিয়ে বসে থাকতাম, ওদের শিল্পকর্মগুলো দেখতাম। নিঃসঙ্গ দিনগুলো কাটছিল ভালোমন্দ মিলিয়ে।

একদিন সকালে অফিসে যাওয়ার তাড়ার মাঝে জোসেফ এসে জানায় এক সপ্তাহের ছুটি লাগবে। শুনে তো আমার মেজাজটা চড়ে যায়। কিছু না শুনে বকাঝকা করার পরে, জানতে পাড়ি ওর বাবা হাসপাতালে ভর্তি, যেতেই হবে। আমার মতো আলসে স্বভাবের মানুষের দেখাশোনার জন্য জোসেফকে অফিস থেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তাই ওর ছুটির কথা শুনে আমি কিছুটা অসহায় হয়ে পড়ি। ওর করুণ দৃষ্টি আমাকে ছুটি দিতে বাধ্য করলেও মনে মনে ভয় পাই। তবে যাবার আগে আমাকে দেখাশোনার জন্য ওর কলোনির একজনকে রান্নাবান্নার জন্য রেখে যায়। যিনি সকাল আসবে, সন্ধ্যায় চলে যাবে। নারী হওয়ায় রাতে থাকতে পারবে না। আমিও মেনে নিয়ে চলে যাই কর্মস্থলে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে নিজের ঘরটাকে অন্যান্যদিনের থেকে কিছুটা অপরিচিত মনে হয়। টেবিলটা পরিপাটি, বিছানা টানটান, কোন ধুলার ছোঁয়া নেই টিভির তাকে। ভালো লাগে ঘরটা। বুঝি নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সহকারীর উপস্থিতির কারণে এতটা পরিপাটি। খেতে বসে আরও ভালো লাগে। জোসেফের কাঁচামশলা গন্ধযুক্ত রান্না নয়, একেবারে কষানো পরিমিত মশলায় রান্না। বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছিলাম সেদিন। কথায় আছে পুরুষকে নমনীয় করার একটা মাধ্যম হলো মজাদার রান্না, অন্যটি কাম। মনে আছে সেদিন খেতে বসে জোসেফকে ভয়ংকর গালাগাল করেছিলাম। ঠিক করি নতুন সহকারীকে দিয়ে জোসেফকে রান্না শেখাব। এভাবে দিন এগোয়, আমি সকালে যাওয়ার পরে সে আসে, বিকেলে আসার আগেই চলে যায়। জোসেফ হয়তো ওভাবেই বলে গিয়েছিল। অফিস থেকে ফেরার পথে মাঝেমাঝে হেঁটে আসি। শরীরটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা। রাস্তাঘাট তখন প্রায় আমার মুখস্থ ছিল। বড় রাস্তার পাশে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ফলের দোকান, এরপরে নতুন গড়ে ওঠা রেস্টুরেন্ট। আমি সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে ধীরে ধীরে হাঁটি। রাস্তায় পড়ে থাকা চিপসের প্যাকেট, ছোটখাটো ইটের টুকরো অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলি মনের আনন্দে। হঠাৎ ডাবের খোলে পা পড়ে আচমকা মচকে যায়। প্রথমে ব্যথাটা সহনীয় থাকলেও রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অসহ্য ব্যথায় পরিণত হয়। ডান পায়ের গোড়ালি ফুলে ঢোল হয়ে যায়। এক কলিগ ডাক্তার নিয়ে এলে টানা সাত দিন পূর্ণ বিশ্রাম দেয় আমায়, সঙ্গে ফোলা পা হার্ট লেভেলের চেয়ে সামান্য উঁচুতে রাখার পরামর্শ দিয়ে যায় ডাক্তার। রাতে ঘুমতে যাবার আগে জোসেফকে আবার ফোন করলে জানায় ওর আসতে আরও পাঁচ দিন দেরি হবে। অফিস কলিগ সে রাতে সঙ্গে থাকে যায়, তারপরও কেমন যেন অসহায় লাগে নিজেকে, জোসেফের কারণে।

সকালটা শুরু হয় আমার বিস্ময় দিয়ে। চোখ খুলে দেখি, সেইদিনের বৃষ্টি ভেজা নারী আমার সামনে। অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। গায়ের রং যথেষ্ট চাপা, তবে চোখ দুটো বেশ সুন্দর। কাজল দেয়ায় আরও ভালো লাগে। চুলগুলো উঁচু করে লাল ফিতে দিয়ে খোঁপা করা। শরীরে জংলিছাপার শাড়ি জড়ানো, তবে পরিপুষ্ট স্তন দুটো আমার দৃষ্টি এড়ায় না। শাড়িটা একটু উঁচু করে পরায় পায়ের গোড়ালিতে আটকানো নুপুরটা ভালোভাবে দেখা যায়।

সাহেব হামি মালতি, জোসেফ দাদা মোক কামে দিয়েচে। হামরার পাশের ঘরক। মোক আন্দন কইতে বলইচে, সাহেব কুছু খাবেক ?

আমি মাথা নাড়াতে চলে যায় রান্না ঘরে। আমার কলিগ কিছুটা কৌতুকপূর্ণ হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকায়। বিকেলে আসার কথা বলে কিছুসময় পরে অফিসে চলে যায়। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি। একটা সময় ঘুমিয়ে পড়ি। সারারাত না ঘুমানোর কারণে অনেকটা সময় ঘুমাই। মালতির ডাকে যখন ঘুম ভাঙে তখন বেলা গড়িয়েছে অনেক। ওর হাতে একটা ট্রে, তাতে যে ভাতের আয়োজন বুঝতে অসুবিধা হয় না। শোয়া থেকে উঠে বসতে কষ্ট হওয়ায়, সে এসে সাহায্য করে হাতের ট্রেটাকে পাশে রেখে। উঠে বসার ফাঁকে নিচু হয়ে থাকায় মালতির বুকের কিছুটা অংশ আমার দৃষ্টিগোচর হয়। ভেতরে কেমন যেন একটা স্রোত বয়ে যায়।

প্লেটে সাদা ফটফটে ভাত, লাল মরিচে রান্না করা মুরগি মাংস সেদিন আমার বিস্বাদ লাগে। দুই চামচ খেয়ে মালতিকে ডাকি ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। অস্থির লাগে চারপাশটা। মালতিকে বাসায় ফিরে যেতে বলি, আর জানাই আগামী কাল থেকে যেন পুরুষ কোন সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে আসে। সেটা যে ওর আত্মরক্ষা নয়, আমাকে যে সংযত রাখার জন্য সেটা বুনো মেয়েটা বোঝে না। মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। চায়ে ধোঁয়া ওঠা বিকেলটা নিরামিষ লাগে। মাথায় শুধু একটি দৃশ্য ঘোরে, যা আমার সভ্যতা আমাকে ধিক্কার দেয়, ভেতরের আদিমতা দেয়া উৎসাহ।

পরদিন মালতি একাই আসে, জানায় কেউ আসতে চায় না। সে তার রোজকার কাজে নেমে পড়ে, একটু পর পর এসে জেনে যায় কিছু লাগবে কি না। একাকী আমি একটা সময় ওকে ডাকি গল্প করার জন্য।

তোমার বাড়ি কোথায় মালতি ?

সাহেব  মিঠাপুকুরে।

জানায় ওখানকার শঠিবাড়ি নামক স্থানে রয়েছে একটি সাঁওতালপল্লি। পল্লিতে প্রায় ত্রিশ চল্লিশটার মতো ঘর আছে। সেটাই ওর গ্রামের বাড়ি, ও সাঁওতালি। জনসংখ্যার চাপে সেটা এখন একটা বস্তি। তাই কেউ কেউ গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছে পেটের দায়ে বা কোনও রকম মাথাগোঁজার ঠাঁই জোগাড়ে। সবাই দরিদ্র, অধিকাংশই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। জোসেফ মালতির গ্রাম সর্ম্পকে ভাই।

কথার মাঝে দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে, রান্না করে, চা বানায়। আবার দৌড়ে এসে মেঝেতে বসে পড়ে। দুইদিনের ভেতরে আমি ওর দুরন্তপনা স্বভাবটা উপভোগ করতে থাকি। এর ভেতরে পায়ের ফোলা ও ব্যথা কিছুটা কমে। একা একা হেঁটে বারান্দায় যেতে পারি।

চারদিনের মাথায় একদিন জিজ্ঞেস করি বিয়ে হয়েছিল কিনা, কেননা সাঁওতাল নারীদের মতো ওর কপালে সিঁদুর ছিল না। তাই কৌতূহলী মনে প্রশ্ন আসে। আমার কৌতূহলে ওর মুখটা মলিন হয়ে যায়। আমিও চুপ করে থাকি।  হামার ইতুঃ বিহা হইছিল।

ইতুঃ বিহা শুনে কপাল কুঁচকে যায়, জানার দৃষ্টি নিয়ে তাকাই। আমার মুখভঙ্গি দেখে পানসে একটা হাসি দিয়ে মেঝেতে হাটু গুঁজে বসে পড়ে। বলতে শুরু করে ওর বিয়ের গল্প। গ্রামের মাস্তান স্বভাবের এক ছেলে ওকে নানাভাবে জ্বালাতন করত। একদিন হাটে গিয়েছিল সখীদের সঙ্গে। সেখানে সেই ছেলে সিঁদুর পড়িয়ে দেয় হাট ভর্তি মানুষের সামনে। তারপরেও মালতির বাবা মা বিয়ে দিতে রাজি না হলে, একরাতে দলবল নিয়ে এসে তুলে নিয়ে যায় মালতিকে। সাতদিন আটকে রাখে। তারপরে মোড়ল গিয়ে ছাড়িয়ে আনে, বিয়ে দেয়। ওর মুখভারের কারণ বুঝতে পারি বিয়েটা ওর পছন্দসই হয়নি। জানতে পারি সাঁওতালী সমাজে জোর করে বিয়েটাই হলো ইতুঃ বিবাহ। অজানা একটি বিষয় জানার পরে বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম সেদিন।

স্বামী কি করে জানতে চাইলে বলে, ছেড়ে চলে গেছে। পেটের টানে বাবা মাকে নিয়ে রংপুর শহরে এসেছে। বাবা শতরঞ্জির দোকানে আর মা হোটেলে বাসন মাজে। এতদিন মালতি একটা মেসবাড়িতে রান্নার কাজ করত। হঠাৎ একদিন টাকা চুরির অপরাধে ওকে বের করে দেয়। পাশাপাশে সে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করে। জানায় একদিন একজন রুমে ডেকে ছিল, না যাওয়ার কারণে চুরির অপবাদ দিয়েছে। কথা শুনে আমি একটু নড়েচড়ে বসি। বুঝি আমাকেও সর্তক করেছে। ওদিকে জোসেফ আবারও জানায় আরও সাতটা দিন পরে আসবে। শুনে তো আমার মাথায় বাজ পড়ে। সেদিনের পরে থেকে মালতির সঙ্গে কথা বলাটা কমিয়ে দিই। সকালে আসে, চা দেয়, রান্না  করে, ঘর গোছায়, মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে দেখে যায়।

টুকটাক কথা বলতে চায়, আমি হ্যাঁ না বলে উত্তর দিই। এরমাঝে পা পুরোপুরিভাবে সেরে ওঠি। আটদিন বাসায় থাকার পরে অফিসে যাওয়া শুরু করি। অফিসে গিয়ে শুনি আমাকে নিয়ে সবার হাস্যরস। মালতির সঙ্গে কি হলো, সাঁওতালি নারী আমাকে প্রেমে বাঁধলো কিনা, নানাজনের নানা প্রশ্ন। কেননা নারীর প্রতি আমার আসক্তির কথা সবারই জানা। তাই তারা উদগ্রীব।

বাসায় ফিরে মালতিকে পাই না, আগেকার মতো সাজানো গোছানো ঘরটা পাই, ভালো লাগে। দুদিন আমাদের অদেখার মাঝে কেটে যায়। সেদিন বাসায় ফিরতে একটু দেরি করেছিলাম, পথে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় কিছুটা ভিজে যাই। ঘরের তালা খুলতে গিয়ে দেখি তালা নেই। বুঝি মালতি আছে, ওমনি বুকের ভেতরে কেমন যেন মোচর দিয়ে ওঠে। হয়তো খুশিতে বা ভয়ে। দরজা খুলতেই বলে,

সাহেব ভিজি গেছিছ তো এক্কেবারে।

আজ, যাওনি কেন মালতি ?

কইল থেকে মুই আইসব না, জোসেফ দাদা আইসবে। হামার সঙ্গে তোওক দেখা হবেক না, তাই বসে রইলুম সাহেব।

আর দেখা হবে না, আর আসবে না, কথাগুলো আমার ভেতরটা শূন্য করে দেয়, অস্থির লাগে। মালতি যায়, ছোটে রান্নাঘরে খাবার গোছাতে। আমি নিজেকে গোছাতে পারি না। রান্নাঘরে ওর পাশে দাঁড়াই, মুখ তুলে তাকায় আমার দিকে। সেই মুখের অর্পূব মায়া, চাহনি, নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। চিন্তা লোপ পায়। বিবেক, ভদ্রতা, সভ্যতাকে হারিয়ে মালতিকে বুকের জড়িয়ে ধরি। মালতি কিছুক্ষণ আপত্তি করলেও, একটা সময় আমাকে আশ্রয় দেয়। শরীরে বয়ে চলে কামোষ্ণ রক্তস্রোত। মালতির মুখমণ্ডলে লজ্জার লাল আভা ছড়িয়ে পড়ে, বাঁকা চাঁদের মতো পাতলা ঠোঁট দুটোর কম্পতি হয়, যা আমাকে আরও বেপরোয়া করে দেয়। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, ওষ্ঠধর দুটো ডুবিয়ে দেই ওর অধরে। সেই রোমাঞ্চ ছড়িয়ে পড়ে আমার সারা শরীরের লোপকূপে। মালতির শরীর শিহরনে কাঁপতে থাকে। যুগলচাঁদ দুটোতে আলতো চাপ দিতেই আমার কানে মৃদু আঁচড় টের পাই। তানপুরার সাদৃশ্য যুগল নিতম্ব, গভীর চোখ, সবই যেন কামনীয় হয়ে ওঠে। আমার ঠোঁট, জিহবা তুলি হয়ে মালতির তামাটে শরীরে ক্যানভাসের মতো ছবি আঁকে সারারাত। ঘরের ভেতরে দুজন মানুষের  শিহরণ―শীৎকার আর বাহিরের বারিধারার নূপুরের গুঞ্জন, যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। দুজনে মিশে যাই আড়ষ্টহীনভাবে। যেন অনেকদিনের কামনা ছিলাম দুজন দুজনার। কথা হয় না, শ্বাস-প্রশ্বাসের উষ্ণতা, ওর স্পর্শ পাই। সেই স্পর্শে আবারও কেঁপে উঠি, নীরব হই। অন্যরকম খেলা চলে আমাদের ভেতরে।

সারারাত দুজনে শুয়ে শুয়ে নিরবতাকে উপভোগ করি। মালতি আমাকে ওদের বার্ষিক উৎসব ‘সোহরাই’-এর কথা বলে। ওই উৎসবে সব মেয়ের সঙ্গে দলবদ্ধভাবে নাচবে, আমাকে ওর নাচ দেখাবে। শীতের শেষে ‘বাহা’ উৎসব, জনপ্রিয় দাসাই উৎসবের কথা বলে। কথা শুনতে শুনতে একটা সময় আমি ঘুমিয়ে পড়ি। মাঝরাতে ঘুম ভাঙার পরে মালতিকে পাশে পাই না। ক্লান্ত শরীরে উঠে আর দেখা হয় না, কোথায় মালতি ?

সকালে ঘুম ভাঙে জোসেফের চ্যাঁচামেচিতে। আমি নাকি সারারাত দরজা খুলে ঘুমিয়েছি। নিজেকে আবৃত করে উঠে দাঁড়াই। চোখ দুটো মালতিকে খোঁজে নীরবে। সেই থেকে শুরু হয় আমার খোঁজা। জোসেফের কাছে জানতে পারি স্বামীর কাছে চলে গেছে। স্বামীর কাছে চলে যাওয়ায় মনে মনে খুশি হই। তবে মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে মালতিকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হয়। সেই ইচ্ছে আবার মনের ভেতরে ডুবিয়ে দিয়ে, অন্য ভাবনায় আবেশিত হওয়ার চেষ্টা করি।

একটা সময় আমার বদলির আদেশ আসে। যাবার আগে একদিন কথায় কথায় জোসেফকে মালতির কথা বলে, দেখা করতে চাই। আর কিছু সাহায্য করতে চাই। জোসেফ কপাল কুঁচকে জানায়, মালতি এক চ্যাংড়ার সঙ্গে ভেগে দিনাজপুর চলে গেছে। খারাপ লাগে বুনো মেয়েটার জন্য।

রংপুরে পাঠ চুকিয়ে ঢাকায় আসার পরে, মা বাবা আমার বিয়ের আয়োজন করে। আমিও এত দিনের অলিগলির পথ ছেড়ে সংসারে মন দিই। দিনে দিনে নিজেকে শামুক বানিয়ে ফেলি। বাসায় ফেরার পথে  দুধ কিনতে ভুলে গেলে বকা শুনি। বুনোফুলের গন্ধ ভুলে শহুরে সুবাসে নাক ডুবাই। তবে মাঝরাতে বৃষ্টি এলে খুব মনে পড়ে, হাতড়ে বেড়াই মেটে সুন্দরীকে। 

আজও বৃষ্টিমুখর দিন, স্কয়ার হাসপাতালে এসেছি অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে। হঠাৎ স্কয়ার হাসপাতালের ক্লিনার এক নারীকে আমার মালতির মতো মনে হয়, কাছে গিয়ে তাকাতেই বলে ওঠে―

ভালো আছিস সাহেব ? হামাক চিনতে পাইরেসিস ?

আমি হঠাৎ প্রাপ্তির আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। কিছু বলে ওঠার আগে, পিছন থেকে শহুরে বাতাসের ডাকে না চেনার ভান করে চলে আসি। মনে ভেতরে বয়ে চলে অন্য এক যুদ্ধ। অনেকদিনের কাক্সিক্ষত কিছু খুঁজে পাওয়ার পরে তার স্বাদ আস্বাদন না করার বিষাদ আমার মনকে ভারী করে তোলে। ঠিক করি আগামীকাল আবার যাব স্কয়ারের ওই ফ্লোরটায়। রাত ফুরিয়ে সকাল আসে, আমি এসে অপেক্ষা করি বুনোফুলের জন্য। সময় পেরিয়ে যায়, আমার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না।

একটা সময় নিজকেই নিজে প্রশ্ন করি, আমার এই প্রতীক্ষা কিসের ? শুধুই কি অনুরক্তি নাকি যৌনতা!

সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button