আর্কাইভগল্প

গল্প : রুনুর চিঠি : ফয়জুল ইসলাম

বছর দশেক আগে তৈরি হয়েছে পল্লবদের এই অ্যাপার্টমেন্ট-বিল্ডিংটা, টিনের চাল দেওয়া পুরানো একতলা বাসাটা ভেঙে ফেলে দিয়ে। সেখানে দোতলায় থাকে পল্লব, নিচতলাতে তার বড় ভাই আরমান আর ওপরের তিনটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দিয়ে রেখেছে তারা। দোতলার দক্ষিণ দিকের বারান্দায় পেতে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে একমনে সিগারেট টানছে আরমান। ‘রুনুর চিঠিটা দরকার! তোর কাছে না রেখে গিয়েছিলাম চিঠিটা, ১৯৭১-এর এপ্রিলে ? মনে আছে ?’― পল্লবকে এই বলে বারান্দায় সে আনমনে তাকিয়ে আছে বাইরে কোথাও।

আরমানের দৃষ্টি অনুসরণ করে পল্লব বুঝতে পারে, তার সহোদর আরমানের চোখ আটকে আছে তাদের বাসার সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা পুরোনো কদমগাছটার দিকে। ষাটের দশকের শেষ দিকে সালামত সাহেবের বাসার দেয়াল ঘেঁষে এই গাছটা লাগিয়েছিল পল্লবের আম্মা। বিকেলের রোদ পড়ে হরিদ্রাভ ফুলে ছাওয়া গাছটা জ্বলছে। সেদিকে তাকিয়ে পল্লবের মনে পড়ে যায়, অনেক দিন ধরে আর কোনও আষাঢ়ে সিদ্ধেশ্বরী জামে মসজিদের পেছনের এলাকাতে তাদের বাসায় আসেনি রুনু। রুনু তার বোন তনিমার প্রিয় বন্ধু। একদা সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল আর ইডেন কলেজে একসঙ্গে পড়েছে রুনু আর তনিমা। এতগুলো দিন পার হয়ে গেল, কৈশোরে পা দেওয়া পল্লবকে ডেকে রুনু আর বলেনি―‘এই যা তো ছেমড়া, গাছে ওঠ―কদমফুল পেড়ে আন কয়টা।’ রাজ্যের আলস্য নিয়ে কখনওই আর প্রতিবাদ জানাতে হয়নি পল্লবকে―‘রুনু আপা শোনো! এই মাত্র বৃষ্টি থামল। গাছটা ভেজা। এখন গাছে উঠলে পড়ে গিয়ে ঠিক হাত-পা ভাঙবে আমার! ঝামেলা করো না তো!’ এই যে এতগুলো বছর চলে গেল, মুচকি হেসে পল্লবকে আর কখনও টোপ দেয়নি রুনু―‘বেবি আইসক্রিম চলবে ?’ আইসক্রিমের লোভে পড়ে তখন বৃষ্টিতে ভেজা কদমগাছে চড়ে ফুল পেড়ে এনেছে পল্লব। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার আগের তিনটে বর্ষাতে এমন করেই রুনু পল্লবকে দিয়ে কদমফুল পাড়িয়েছে। একবার পা পিছলে গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিল পল্লব। ভাগ্যিস হাত-পা ভাঙেনি! তখন অবশ্যি ক্ষতিপূরণ হিসেবে বেবি আইসক্রিমের সঙ্গে পল্লবের পকেটে সিকি-আধুলিও ঢুকেছে কিছু। কত আগেরই না কথা এসব! পল্লবের মনে পড়ছে, কদমফুল নিয়ে পল্লবদের বাসায় ঢুকে একটা কাচের গ্লাসে পানি ভরেছে রুনু তারপর পানিতে ডাঁটাশুদ্ধ কদমফুল ভিজিয়ে আরমানের পড়ার টেবিলে রেখে দিয়ে গেছে সে; এখান থেকে খানিকটা দূরের কালীবাড়ি রোডে নিজেদের বাসাতেও নিয়ে গেছে কিছু। অনুমোদনের হাসিতে কখনও কখনও পল্লবের আম্মা পল্লবের বোন তনিমাকে বলেছে―‘আহা! রুনুর মনে এত মায়া! আমার বাউণ্ডুলে ছেলেটার জন্য কে আর ফুল আনবে ?’ ১৯৭২ সালের পর থেকে সেই রুনু আর পল্লবদের বাসাতে আসেনি। আটচল্লিশ বছর তো পার হয়েই গেল!

এই যে রুনু দীর্ঘ দিন ধরে পল্লবদের বাসাতে আসে না, তার কারণটা এমন নয় যে পল্লবের বোন তনিমা এখন আর সিদ্ধেশ^রীতে থাকে না―হাজার হাজার মাইল দূরের শহর অটোয়াতে সে থাকে, তার জামাইয়ের সঙ্গে। এমন ভৌগোলিক দূরত্ব তো আর সহজে দুজন মানুষের মাঝের সুসম্পর্ককে কমিয়ে বা নষ্ট করে দেয় না! পল্লব মনে করে, তনিমা বাংলাদেশে না থাকলেও রুনুর সঙ্গে পল্লবদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা চালু থাকতে পারত, এমনকি বাড়তেও পারত আরও। জোর সম্ভাবনাটা তো এমনই ছিল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্সপর্ব শেষ করবে আরমান―মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার কারণে যা থমকে গিয়েছিল এক বছরের জন্য; কালক্রমে মাস্টার্সও শেষ করবে সে; সদ্য স্বাধীন দেশে ভদ্রস্থ একটা চাকরি-বাকরি পাবে; তারপর তার সঙ্গে বিয়ে হয়ে যাবে কালীবাড়ি রোডের রুনুর। আরমান আর রুনুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে সামাজিকভাবে অনুমোদন দেবার বেলাতে দুবাসার কারও কোনও আপত্তিই ছিল না। সবচাইতে খুশি হয়েছিল তনিমা। সে ভেবেছিল, পেয়ারের সইকে এবার সারাটা ক্ষণ পাশে পাওয়া যাবে। রুনুর আব্বা বাসেত সাহেব―পল্লবের আব্বার ওয়াপদা-অফিসের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী―তো উচ্ছ্বসিত হয়ে একদা বলেই ছিল―‘দুজনকে কিন্তু খুব মানিয়েছে ভাই! ওদের বিয়েশাদি দিতে পারলে সুখীই হতাম!’ তা শুনে পল্লবের আব্বা স্মিত হাসিতে মন্তব্য করেছিল―‘আপনারা সুখী হলে আমরাও সুখী হই!’ তেমন সুখকর কিছু ঘটেনি শেষ পর্যন্ত। ১৯৭২ সালের অগাস্টের মাঝামাঝি কোনও এক দিনে ঘটেছিল দুর্ঘটনাটা―ইডেন কলেজের ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস শেষ করে লালবাগের সহপাঠী নিনির বাসায় গিয়েছিল রুনু। নিনির কাছ থেকে কোনও একটা বই আনবার প্রয়োজন পড়েছিল তার। কাজ সেরে বিকেলবেলায় লালবাগ থেকে সে রিকশা নিয়েছিল সিদ্ধেশ^রীর বাসায় ফিরবে বলে। তারপরে বলা নেই, কওয়া নেই হাওয়া হয়ে গিয়েছিল রুনু। ব্যাপারটা কী ঘটেছিল সে সম্পর্কে রুনুর বন্ধুদের বিন্দুমাত্র কোনও ধারণা ছিল না।

এসব ভাবতে ভাবতে বারান্দার চেয়ারে জবুথবু হয়ে বসে থাকা পঁয়ষট্টি বছরের আরমানের দিকে তাকায় পল্লব। অনেক দিন পরে সে যেন মনোযোগ দিয়ে দেখছে তার সহোদরকে! পল্লব দেখতে পায়, উজ্জ্বলতা হারিয়ে খরখরে হয়ে গেছে রূপবানের চেহারা, ত্বকের শ্যামল রঙ পুড়তে পুড়তে ঘন কালো হয়েছে, মাথার চুলের ঘনত্বও কমে গেছে একেবারেই―এখন আর কেউ বলবে না, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে একমাথা দীর্ঘ চুল নিয়ে দুই নম্বর সেক্টরের রণাঙ্গন থেকে সিদ্ধেশ্বরীতে ফিরে এসেছিল আরমান, ঘন দাড়ি-গোঁফ আর দীর্ঘ চুলের আরমানকে তখন দেখতে লাগছিল সুদর্শন বিপ্লবী চে  গেভেরার মতো। আজ বয়স কেড়ে নিয়ে গেছে আরমানের সেই রূপ! পল্লব ভাবে, নিশ্চয়ই জরাকে এড়াতে পারেনি রুনু নিজেও। আরমানের চাইতে মাত্র তিন বছরের ছোট ছিল রুনু। তাছাড়া দীর্ঘ দিন ধরে কোলন ক্যান্সারে ভুগবার কারণে রুনুর সুন্দর চেহারাটা হয়তোবা আরও ভেঙে পড়েছিল! এমনটা ভেবে নেবার পেছনে কারণ আছে বটে। দিন কুড়ি আগে একটা লাশবাহী গাড়ি থেকে আজিমপুর কবরস্থানে নামানো হলো গাঢ় চকোলেট কফিন। কফিনের ভেতরে চিত করে শুইয়ে রাখা হয়েছিল দীর্ঘাঙ্গিনী রুনুর লাশটাকে। রুনুকে তখন দৈর্ঘ্যে আরও লম্বা বলেই মনে হচ্ছিল, আর যেন কফিনের সঙ্গে একবারেই মিশে যাচ্ছিল মুর্দার শরীর―এমনই শুকিয়ে গিয়েছিল রুনু! সব মৃতের শরীর এমন করে কৃশকায় হয়ে যায় না নিশ্চয়ই! মৃত রুনুর পাণ্ডুর মুখমণ্ডলটা অবশ্য আর দেখা হয়নি পল্লবের, মানে, পুরুষদের কাউকেই তা দেখতে দেয়া হয়নি আর কি! পল্লব ভাবে, হয়তো সেখানে স্বাস্থ্যহানির প্রগাঢ় চিহ্নই প্রকাশিত হয়েছিল! এই ভালো হয়েছে যে রুনুর পরিবারের মানুষেরা শবযাত্রীদের রুনুর মুখটা দেখতে দেয়নি। নইলে হয়তোবা তারা আঘাতই পেত! এ কথা সিদ্ধেশ্বরীর সবাই আজও বলবে, রুনুর সুশ্রী মুখমণ্ডল, রেখাজির মতো ডাগর কালো চোখ, তামাটে গায়ের রঙের সৌন্দর্য আর ঝকঝকে হাসির সঙ্গে পৃথিবীর কোনও ক্ষয়েরই নিশ্চয়ই বদল চলে না!

সেদিন গাঢ় চকোলেট রঙের কফিন থেকে বের করা হয়েছিল কাফনের সাদা কাপড়ে মোড়ানো রুনুর মৃতদেহ। ক্যালিফোর্নিয়াতে এই কফিনটার ভেতরেই শোয়ানো হয়েছিল মুর্দাকে, ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে একটা শীতল লাশবাহী গাড়িতে করে সোজা আজিমপুর কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কফিনটা। রুনুকে গোর দেবার জন্য খুঁড়ে রাখা কবরের পাশে শবযাত্রীদের সঙ্গে লাশের অপেক্ষাতে দাঁড়িয়েছিল পল্লব। মুর্দাকে ধরে যখন কবরে নামানো হচ্ছিল তখন বেদনায় ছটফট করে উঠেছিল পল্লব। কবর নামের রহস্যময় এক গহ্বরের পাড়ে দাঁড়িয়ে সে দৃশ্য দেখতে দেখতে তার মনে হচ্ছিল―একটু পরেই কাঁচা বাঁশ, চাটাই আর তাল তাল ভেজা মাটির নিচে আড়াল হয়ে যাবে রুনু আপা। তার সঙ্গে তো আর দেখা হবে না কোনও দিনও! ব্যাপারটা তবে গোলমেলে হয়ে গেল না কি ? নিশ্চয়ই এমন একটা সর্বৈব বেদনার সম্মুখীন হবে না বলেই আজিমপুর কবরস্থানে যেতে রাজি হয়নি আরমান। বাদ জোহরের জানাজা আর দাফনে অংশ নেবার জন্য পল্লব যখন বাসা থেকে বের হচ্ছে তখন সে নিচতলায় গিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো আরমানকে জিজ্ঞাসাও করেছিল, ‘ভাইয়া! কবরস্থানে যাবে না কি ? ভেবে বল।’ একটু চুপ থেকে আরমান উত্তর করেছিল, ‘নাহ্! রুনুকে কবরে নামানো হচ্ছে, মাটির নিচে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে রুনু―এমন মর্মান্তিক দৃশ্য কি চোখে দেখা যায় নাকি ? পারবি তুই সহ্য করতে ?’ ভুল কিছু বলেনি আরমান। তবে আরমান না গেলেও আজিমপুর কবরস্থানে যেতেই হয়েছিল পল্লবকে। দু পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা গত হয়েছে―এটা ঠিক। কিন্তু অতীতের পারিবারিক সুসম্পর্কের কারণেই সামাজিকভাবে মুর্দার প্রতি সম্ভ্রম আর ভালোবাসা তো প্রকাশ করতেই হয়, মন না মানলেও! এজন্যই বেদনায় হৃদয় টুকরা টুকরা হয়ে ভেঙে যাবে জেনেও মুর্দাকে শেষ সম্মান জানাতে বাসা থেকে বের হয়েছিল পল্লব। বের হতেই বাসার মেইন গেটে তার সঙ্গে তার স্ত্রী সাদিয়ার দেখা হয়ে গিয়েছিল। মৌচাক মার্কেট থেকে কেনাকাটা সেরে বাসায় ফিরছিল সাদিয়া। পল্লবকে একাই বের হতে দেখে রিকশার ভাড়া মেটাতে মেটাতে সে বলছিল, আজিমপুর কবরস্থানে যাবার জন্য আরমানকে বেশি চাপাচাপি না করে পল্লব উচিত কাজটাই করেছে। নিজের অস্তিত্বের বড় একটা অংশকে মাটিতে মিশিয়ে দেবার বিপুল আয়োজন চোখে দেখতে পারাটা খুবই কঠিন। পল্লবকে সাদিয়া বুঝিয়ে বলেছিল, এই ভালো যে সেসব মর্মান্তিক প্রস্তুতির ছবিগুলো এবার উঠতে-বসতে আরমানকে খোঁচাতে থাকবে না। ব্যাপারটা এমন: মুর্দার ক্লিন্ন চেহারা, তার নিথর শরীর কোনও জীবিত মানুষের চাইতেও হাজার গুণে শক্তিশালী হয়ে দেখা দিতেই পারে―সাদা কাফনের অন্তরালে টান টান করে শুইয়ে রাখা মুর্দার রহস্যময় শরীর জীবিতের চাইতেও আর বেশি, আরও গভীর সব কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। কবরের পাড়ে দাঁড়িয়ে মুর্দার সঙ্গে সুতীব্র, নীরব সেসব সংযোগ সহ্য করতে পারাটা সোজা কাজ নয়। তার জন্য মনে অনেক শক্তি ধরবার প্রয়োজন হয়। সেটা সবাই পারে না। পল্লব ধারণা করে, সমূলে ধসে পড়বার এ আশঙ্কা থেকেই আজিমপুর কবরস্থানে যেতে পিছপা হয়েছে আরমান।

যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিটা সহযোদ্ধার মৃত্যুই গণযোদ্ধা আরমানকে গভীর বিবমিষার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। পল্লবকে আরমান বলেছিল, ১৯৭১-এর নভেম্বর মাসে দুই নম্বর সেক্টরের নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনীর এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে আরমান অংশ নিয়েছিল কুমিল্লার সালদা নদী কমপ্লেক্স দখলের যুদ্ধে। সেখানে সে দুটো বীভৎস মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছিল। সম্মুখযুদ্ধের একপর্যায়ে তার পাশেই ধানক্ষেতে শুয়ে তাদের কোম্পানির অন্য একটা প্লাটুনের একজন মুক্তিযোদ্ধা এসএলআর চালাচ্ছিল। মুক্তিবাহিনীর চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন পদাতিক সেনা ছিল নাম না জানা সেই মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হেভি মেশিনগানের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল সেই মুক্তিযোদ্ধার শরীর। মুহূর্তের ভেতরেই আরমানের পাশেই মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছিল গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়া তার মাথা, কপাল আর গণ্ডের হাড়হাড্ডি, মাথার ঘিলু, একটা চোখ। মাটির ওপর দিয়ে তার শরীরের তাজা রক্ত গড়িয়ে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল আরমানের ময়লা হয়ে যাওয়া সাদা স্যান্ডো গেঞ্জিটা। তার কিছুক্ষণ পরেই আরমানরা সালদা নদীর বাজার-এলাকাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিল। ফার্ম আপ পয়েন্ট থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের ট্রেঞ্চগুলোর দিকে অ্যাসাল্ট-লাইন ফরমেশনে ছুটে যাচ্ছিল আরমানরা; ৭.৬২ মিলিমিটার এলএমজি, ১২.৭ মিলিমিটার হেভি মেশিনগান আর ২-ইঞ্চি মর্টারের চার্জের আঘাতে মাটিতে ঢলে পড়ছিল আরমানের সহযোদ্ধাদের অনেকেই। তারপর পাকিস্তানি সৈন্যদের ট্রেঞ্চ থেকে ট্রেঞ্চে ছড়িয়ে পড়েছিল হাতাহাতি যুদ্ধ। দু পক্ষের সৈনিকেরাই পরস্পরকে পাশবিকভাবে বেয়োনেট চার্জ করছিল। তখন আরমানদের প্লাটুনের কিশোর যোদ্ধা বুুড়িচংয়ের সাইকেল মেকার নবির পেট বেয়োনেটের তীক্ষè আঘাতে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়। আরমানের পাশেই একজন পাকিস্তানি সৈন্যকে পরাস্ত করবার জন্য ধ্বস্তাধ্বস্তি করছিল রোগাপটকা নবি। সালদা নদী কমপ্লেক্স দখলের যুদ্ধের আগে, গেরিলা অপারেশনের সময়, এভাবে বেশ কজন সহযোদ্ধার মৃত্যু ঘটেছিল আরমানের চোখের সামনেই। কিন্তু চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নাম না জানা পদাতিক সেনা আর বুুড়িচংয়ের নবির মৃত্যুর ভয়াবহতা নিতেই পারেনি আরমান। পল্লবকে আরমান বলেছিল, সালদা নদী কমপ্লেক্স দখলের যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী জিতে যাবার পরে তারা হতাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে খুঁজতে নেমেছিল। তখন তারা দেখতে পেয়েছিল ট্রেঞ্চের ওপরের মাটিতে উপুড় হয়ে ঝুলছে ময়লা, ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা নবির মৃতদেহ। বোঝা যাচ্ছিল, ট্রেঞ্চ থেকে উঠে পড়তে জোর চেষ্টা করেছিল আহত নবি। তীব্র শারীরিক ব্যথায় কুঁচকে ছিল রক্ত আর কাদামাটিতে জড়াজড়ি করে থাকা নবির মুখটা। ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইছিল আতঙ্কে ভরা তার দুটো চোখ। মৃতের বিপন্ন মুখের দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল আরমান। এতই বীভৎস, এতই ভুতুড়ে দেখাচ্ছিল নবির মুখমণ্ডল যা কিনা আরমান কিছুতেই ভুলতে পারেনি। পল্লব মনে করতে পারে, মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফেরবার পরে প্রায়ই রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছে আরমান; পল্লবকে বলেছে, যেন তার পাশে শুয়ে মৃত্যুযন্ত্রণাতে কাতরাচ্ছে ফোর্থ বেঙ্গলের সেই ক্ষতবিক্ষত সৈনিক আর বুড়িচংয়ের নবি, বাঁচবার জন্য আকুতি জানাচ্ছে তারা। এমন আতঙ্ক আর নেবে না বলেই হয়তো মৃত রুনুর মুখমণ্ডল আর শরীরের দিকে চোখ ফেলতে চায়নি আরমান। সব মৃতের মুখ তো আর সৌম্য-শান্ত থাকে না―বীভৎস হয়ে যায়। সব মৃতের শরীর তো আর অপার্থিব দ্যুতি ছড়ায় না। তখন মৃতের পাশে দাঁড়ালে মনে হয়, তমসায় কালো হয়ে যাচ্ছে আশপাশের সব কিছু। মনে পড়ছে, প্রায়শই আরমান পল্লবকে বলত, সে নিজে তার সারা সারাটা শরীর দিয়ে নিহত সহযোদ্ধাদের বিপন্নতা আর মৃত্যুযন্ত্রণা অনুভব করতে পারে। এ কারণেই যুদ্ধ থেকে ফিরবার পরে তার আর ভালো মতো ঘুম হতো না। পল্লবের ধারণা, খুব স্পর্শপ্রবণ মানুষদের পক্ষেই হয়তো অন্যের শরীরের ব্যথা-বেদনা বুঝতে পারাটা সম্ভব। হতেই পারে যে তার ভাইও সে ধরনের একজন নাজুক মানুষ। চোখে না দেখলেও নিশ্চয়ই আরমানকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল অসুস্থ রুনুর মৃত্যুযন্ত্রণার কল্পনা। এক হেঁচকা টানে হৃৎপিণ্ড চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবার ঠিক আগমুহূর্তে রুনু যে উথালি-পাথালি শারীরিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে গিয়েছিল তার আভাস হয়তোবা বিহ্বল করেছিল আরমানকে। রুনুকে গিলে খাবার জন্য হা-করে বসে থাকা রহস্যময় গহ্বরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে নিশ্চয়ই রুনুর মৃত্যুযন্ত্রণা নিজের শরীর দিয়েই আরমানকে অনুভব করতে হতো। হয়তোবা সেই আতঙ্কের বশে, সজ্ঞানেই, কবরস্থানে যাবার ব্যাপারটা এড়াতে চেয়েছে আরমান।

এই মুহূর্তে কদমগাছটার বর্ষাঘন হরিদ্রাভ ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে পল্লব আর ভাবছে, এবার দেখতে হবে, ‘রুনুর চিঠিটা দরকার’―এই অমোঘ একটা বাক্য উচ্চারণ করবার পরে আর কিছু বলে কিনা আরমান। কিন্তু চুপ করেই আছে আরমান। সিগারেট শেষ হলেও মাথা নিচু করেই বারান্দার চেয়ারটাতে ঠায় বসে আছে সে। দু’জনের মাঝে জমে থাকা অচঞ্চল নীরবতাতে অস্বস্তিই হয় পল্লবের। কাজেই এক সময় সে নীরবতা ভাঙতে চায়। আরমানের মুখের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞাসা করে, ‘এবার বলো তো দেখি, রুনু আপা কী লিখেছিল চিঠিটাতে ? এ কথাটা কখনই তোমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি।’

‘ধুর! বাদ দে তো এসব! আর বলি, তোর এত উৎসাহের কোনও প্রয়োজন তো দেখছি না!’ ভয়ানক বিরক্তি নিয়েই পল্লবের প্রশ্নের উত্তর দেয় আরমান।

হাসতে হাসতে গভীর কৌতুকে পল্লব বলে, ‘কীইবা এমন গোপন কথা লেখা থাকতে পারে চিঠিটাতে ? এমন প্রেমপত্র আমিও অনেক লিখেছি, বুঝলে তো―তোমাকে ছাড়া এ জীবন মরুভূমিসম, প্রতীক্ষার দিন আর ফুরোতে চাইছে না, কাল রাতে ঘুম এলই না―এসব কথা কি আর আমি কাউকে লিখিনি নাকি ?’

‘এত ফ্যাচর ফ্যাচর করিস না তো তুই! চিঠিটা খুঁজে বের কর। কোথায় রেখেছিস চিঠিটা ?’ 

ভাবতে বসে পল্লব। একটু ভেবে নিয়ে সে আরমানকে বলে, পুরানো কাগজপত্তরের মাঝেই থাকবার কথা রুনু আপার চিঠিটা, হারিয়ে যাবার প্রশ্নই ওঠে না! সে অতটা ভুলো মনের মানুষই নয়!

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষের দিকে গেরিলাযুদ্ধের ট্রেনিং নেবার জন্য চুপি চুপি বাসা ছেড়েছিল আরমান। তার আগের দিন রাতে পল্লবের হাতে রুনুর চিঠিটা তুলে দিয়ে আরমান বলেছিল, ‘চিঠিটা হাতছাড়া করিস না কিন্তু! যেখানেই যাস, সঙ্গে নিয়ে যাবি!’ নীল খামে ভরা ছিল চিঠিটা। খামের মুখ গাম দিয়ে আটকে দিয়েছিল আরমান; এও বলেছিল, ‘খবরদার, খামটা খুলবি না!’ পল্লব তখন সিদ্ধেশ^রী বয়েজ স্কুলে সবে ক্লাস সিক্স শুরু করেছে। তেমন কাঁচা বয়সে মানুষের মনে হাজারটা প্রশ্ন থাকে, পল্লবেরও ছিল। কাজেই সে তার সহোদরকে প্রশ্ন করেছিল, ‘কেন খুলব না―শুনি ?’ মৃদু হেসে উত্তর করছিল আরমান, ‘বড়দের অনেক ব্যক্তিগত ব্যাপার থাকে, সেগুলো আর কারও না জানাটাই ভালো।’ তা হতেই পারে―এমন ভাবনা থেকে আরমানের সামনেই একটা জুতোর বাক্সে রাখা বিবিধ কৈশোরিক সঞ্চয়ের ভেতরে রুনুর চিঠিটা রেখে দিয়েছিল পল্লব। তারপরে, ১৯৭১-এর মে মাসের পয়লাতে, পল্লবদের পরিবার নওয়াবগঞ্জ থেকে নৌকাতে চেপে, পদ্মা পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছিল চর ভদ্রাসনে। ওখানেই পল্লবদের দাদার বাড়ি। আর নানা পথে মেঘনা নদী বেয়ে চাঁদপুরে নেমেছিল রুনুদের পরিবার, পরে সেখান থেকে বাসে চেপে তারা চলে গিয়েছিল মাইজদীতে। অপারেশন সার্চ লাইটের তাণ্ডবের পরে সারা দেশে আরও অসংখ্য মানুষকে নির্বিচারে খুন করবে পাকসেনারা, শারীরিক অত্যাচার করবার জন্য তৈরি হবে শত শত টর্চার ক্যাম্প, কত মানুষই না নিখোঁজ হয়ে যাবে বধ্যভূমিতে, নদীর পাঁকে পাঁকে―এমন সব আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল মানুষের মাঝে। তাই অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের অনেক পরিবারই দখলদার পাকিস্তানি সৈন্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসা ছেড়েছিল তখন। বেঁচে থাকবার সেই কৌশলটাই বেছে নিয়েছিল এ দুটো পরিবার। যেটা বলার সেটা হলো―চর ভদ্রাসনে যাবার সময় আম্মার প্রতিবাদের মুখেও পল্লব তার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল জুতোর বাক্সটা যার ভেতরে ছিল বিভিন্ন পদের সিগারেটের প্যাকেট কেটে বানানো তাস, দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত নাদিম-শাবানা জুটির চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন, ক’টা রঙিন মার্বেল, একটা লাট্টু, একটা গুলতি আর রুনুর চিঠিটা। ন মাসের মুক্তিসংগ্রামের সময় মাদারীপুর আর শরীয়তপুরের গ্রাম থেকে গ্রামে যখন মৃত্যুভয়ে তাদেরকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছিল, তখনও তার মূল্যবান সংগ্রহ হারায়নি পল্লব, রুনুর চিঠিটাও নয়। ডিসেম্বরে দেশ স্বাধীন হবার পরে সেসব জিনিস স্থান পেয়েছিল চামড়ার তৈরি ছোট একটা বাক্সে, যেটাতে বই ভরে নিয়ে একদা স্কুলে যেত পল্লব। যুদ্ধশেষে ঢাকায় ফিরে আসবার পরে আরমান আর পল্লবের কাছে রুনুর চিঠিটা ফেরত চায়নি। তবে পল্লব এটুকু বুঝেছিল, মূল্যবান এই চিঠিটা তাকে সযত্নে রেখে দিতে হবে। কেননা চিঠিতে তার সহোদরের ভালোবাসার স্পর্শ রয়ে গেছে, এখানে লুকিয়ে আছে একটা মানবিক সম্পর্কের গোপনীয়তা। ক্লাস টেনে উঠবার পরে সে শান্তিনগর পোস্ট অফিসের কাছের সবুজ লাইব্রেরি থেকে পাতলা বোর্ড আর মোটা কাগজ দিয়ে বানানো সবুজ রঙের একটা ফোল্ডার কিনেছিল। সেখানেই নানা কাগজপত্তরের সঙ্গে রাখা হয়েছিল রুনুর চিঠিটা। নটরডেম কলেজ পার হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকবার পরে জরুরি কাগজপত্তরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে আরও কটা ফোল্ডার কিনতে হয়েছিল তাকে। একুনে সেগুলোর সংখ্যা বারো। পুরোনো এসব ফোল্ডার সে বড় একটা কার্ডবোর্ড বক্সে এখনও যত্ন করেই রেখে দিয়েছে। বক্সটাতে পৃথক একটা কাগজের ফোল্ডারে রয়েছে পল্লবদের চর ভদ্রাসনের জমিজমা আর সিদ্ধেশ্বরীর বাসার দলিলপত্র। বছর তিনেক আগে মারা যাবার আগে পল্লবের হাতে জরুরি এসব কাগজপত্র দিয়ে গেছে আম্মা। নীল রঙের এই ফোল্ডারটা ছাড়া আজকাল আর কোনও ফোল্ডার খুলবার প্রয়োজনই পড়ে না পল্লবের। এসব ফোল্ডারের গাদা থেকে সবচাইতে পুরোনো সবুজ ফোল্ডারটা খুঁজে বের করাটা কঠিন কোনও ঘটনাই নয়। এমন একটা ভাবনা থেকেই তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আরমানকে পল্লব বলে, ‘ভেবো না! চিঠিটা খুঁজে পাওয়া যাবেই। একটা বক্সের ভেতরে পুরোনো সব জিনিসপত্তরের সঙ্গে চিঠিটা রাখা আছে।’

আরমানকে পল্লব আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করলেও দুশ্চিন্তা যায় না আরমানের। ভুরু কুঁচকে সে তার শঙ্কা প্রকাশ করে, ‘ঠিক বলছিস তো ?’

‘হ্যাঁ! বাজি।’

‘তাহলে আজকেই খুঁজে রাখিস চিঠিটা। শুক্রবার ছাড়া তো তুই আবার সময় পাস না!’

ঠিকই বলেছে আরমান। কেননা শুক্রবার বাদে সপ্তাহের বাকি ছ’টা দিন সকালে পল্লব আশুলিয়াতে তার নিজের গার্মেন্টস-ফ্যাক্টরিতে কাজে যায়, ফিরতে ফিরতে সেই রাত দশটা বেজে যায় তার। কাজেই যা করবার আজ রাতের ভেতরেই করে ফেলতে হবে বলে পল্লব স্থির করে। কথা শেষ করে বারান্দা থেকে উঠে নিচতলায় তার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে চলে যায় আরমান। তার স্ত্রী রেহানা তাকে তখন চা-নাশতা খেতে ডাকছিল।

রুনুর অন্তর্ধানের রহস্যটা আজও ভাবায় পল্লবকে। রুনু যেদিন নিখোঁজ হয়ে যায় সেদিন রাতেই রমনা থানাতে গিয়ে রুনুর আব্বা―মতিঝিলের ওয়াপদা অফিসের উপপ্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা বাসেত সাহেব―ডায়রি করেছিল। স্বাভাবিকভাবেই রমনা থানার ইনচার্জ রুনুর আব্বাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কারও সঙ্গে আব্দুল বাসেতের পারিবারিক শত্রুতা আছে কি না। অনেক ভেবেও তেমন কিছু মনে করতে পারেনি বাসেত সাহেব। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল―উটকো কোনও ছেলে আপনার মেয়েকে ফলো করছিল কি ? নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মেয়েদের বেলাতে সাধারণত এসব ব্যাপার জড়িয়ে থাকে। সেই সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না বাসেত সাহেবের। কাজেই রমনা থানার ইনচার্জ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, রুনুর বন্ধুদের সে একবার জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখতে চায়। এ বিষয়ে বাসেত সাহেবের তো কোনও আপত্তিই ছিল না। মরিয়া হয়ে সে কেবল চাইছিল, যে কোনও ভাবেই হোক না রুনুকে ফিরে পেতে হবে, আজই।

সিদ্ধেশ্বরী, মগবাজার আর শান্তিনগরের যেসব তরুণ আরমানের সঙ্গে দুই নম্বর সেক্টরের গণযোদ্ধা হিসেবে যুদ্ধ করেছিল তারা সবাই রুনু নিখোঁজ হয়ে যাবার দিনেই এসে দাঁড়িয়েছিল আরমানের পাশে। ঢাকা শহরে রুনুদের আত্মীয়-স্বজন আর রুনুর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা যখন রুনুর উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনও খবরই দিতে পারল না তখন মাঠে নামল তারা। রাত দশটার দিকে তারা দুটো জিপ আর অনেকগুলো ফিফটি সিসি মোটর সাইকেলে চেপে রওয়ানা হয়েছিল আজিমপুর-লালবাগের দিকে। সশস্ত্র দলগুলো প্রথমে একই সেক্টরের গেরিলা―আজিমপুর কলোনির মোটা মুসা আর লালবাগের আলমগিরের শরণাপন্ন হয়েছিল। লালবাগ থেকে শুরু করে গেন্ডারিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্লাবে গিয়েছিল দুটো দল, আরেকটা দল গিয়েছিল পশ্চিমে কামরাঙ্গির চর এলাকায়। প্রথম দলটার সঙ্গে ছিল আরমান। সেই রাতে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি রুনুকে। এলাকাগুলোর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছিল, ভোজবাজির মতো করে জ¦লজ্যান্ত একজন মানুষ উবে যাবে―এটা তো হতে পারে না! কিন্তু রুনু উবে যাবার ব্যাপারে কেউ কোনও সূত্রও দিতে পারেনি অনুসন্ধানকারী দলগুলোকে।

রুনুর অন্তর্ধানের দ্বিতীয় দিনে তনিমাসহ রুনুর ইডেন কলেজের ঘনিষ্ঠ সহপাঠীরা রুনুর বাসায় গিয়েছিল। রমনা থানার ইনচার্জকে তারা জানিয়েছিল, মাঝে মাঝে একটা আকাশি রঙের ভেসপা অথবা একটা লাল ফিফটি সিসি মোটর সাইকেল কাকরাইল মোড় থেকে ইডেন কলেজ পর্যন্ত রুনুর রিকশার পিছু নিয়েছে বটে। অনুসরণকারী তরুণদের তারা চেনে না। তবে এও বলতে হয়, বেশির ভাগ তরুণীদের পিছে এমন করেই ফেউ লেগে থাকে। তাই ব্যাপারটাকে রুনুর বন্ধুরা তখন মোটেই পাত্তা দেয়নি। এদিকে দ্বিতীয় দিনে আরমানের বন্ধুদের চারটা সার্চ পার্টি ছুটল চার দিকে―দোহার-নবাবগঞ্জ, কমলাপুর-বাসাবো- বাড্ডা, সাভার-মানিকগঞ্জ এবং গাজীপুর-রাজেন্দ্রপুরে। দু দিন পরে তার মুক্তিযোদ্ধা-বন্ধুরা সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের মাঠে জরুরি সভাতে বসেছিল। বিভিন্ন জনের প্রতিবেদন থেকে বোঝা গেল―ঢাকা শহর বা সন্নিহিত এলাকাতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না রুনুকে। এমন উপসংহার কিংকর্তব্যবিমূঢ় বানিয়ে দিল মুক্তিযোদ্ধাদের। তারা ভাবতে বসল―এর পরে আর কী করা যেতে পারে ?

এদিকে সিদ্ধেশ্বরীর মানুষজনদের সামনে প্রকাশিত হচ্ছে চিত্রটা―কোথাও নেই রুনু। কীভাবে সম্ভব সেটা ? এ নিয়ে মানুষজনদের একাংশের মাঝে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে তখন। বিষয়গুলো এমন―রুনুকে কেউ তুলে নিয়ে গেলে তো কোথাও না কোথাও একটা চিহ্ন পড়ে থাকত! তেমন কোনও তথ্য মিলছে না। প্রশ্ন উঠছে―নাকি কারও সঙ্গে ভেগে গেছে মেয়েটা ? এসব সন্দেহ যে সবাইকে প্রীত করছে এমনটা নয়, যেমন, প্রতিবাদ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে―সে কী কথা ? আরমানের সঙ্গে না রুনুর সম্পর্ক রয়েছে ? তবে সে অন্য কারও সঙ্গে ভাগতে যাবে কেন ? বাজে কথা বলবেন না তো! কারও কারও সমালোচনা তখন এমন একটা পর্যায়েও উঠে গেছে যেখান থেকে ভীষণ বিরূপ মন্তব্য আসতে শুরু করেছে―আজকালকার মেয়েদের চরিত্রের কোনও ঠিক আছে নাকি ? দেখো গিয়ে কোথাও ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে! পাকিস্তান-আমলে এসব হয়নি বাপু! কী জামানা যে এল! এমন গর্হিত মন্তব্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে সিদ্ধেশ্বরীর অনেকেই―কেন ? আপনাদের পেয়ারের পাকিস্তানপন্থিরা তবে কী করেছে মুক্তিযুদ্ধের ন মাস ধরে ? আমাদের মেয়েদের জোর করে তুলে নিয়ে গিয়েছিল কারা ? ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান-আর্মির অফিসারদের কাছে কারা আমাদের মেয়েদের দিয়ে এসেছিল ? সেটা কি আপনাদের পাকিস্তান-আমল ছিল না ? এই যে আজকে রুনু উধাও হয়ে গেল সেটা যে আপনাদের মতো মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের তৈরি করা অস্থিরতার অংশ নয় তা কে বলবে ? কাজেই আর কথা বলবেন না আপনারা! এই স্বাধীন দেশে যে আপনাদের মতো বিশ্বাসঘাতকেরা এখনও চলেফিরে বেড়াতে পারছে তার জন্য শোকরগুজারি করেন। এমন ধামকি খেয়ে তখন চুপ হয়ে যাচ্ছে সমালোচনাকারীরা। তবে তাদের ফিসফিসানি থামছে না, যেমন, তারা বলছে―চান্দু! খুব জলদিই আমরা সংখ্যায় তোমাদেরকে ছাড়িয়ে যাব!

রুনুর ছোট ভাই মারুফ এসে আরমানকে জানিয়ে গেল, রুনুদের দাদার বাড়ি মাইজদী বা তার পাশের দাগনভুঁইয়া বা সোনাগাজীর কোনও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও যায়নি রুনু। আঁতিপাতি করে খোঁজা হয়েছে ওদিকটায়। রমনা থানার পুলিশবাহিনীও কোনও খবর দিতে পারছিল না―দেশের আর কোনও থানা থেকে রুনুর খবর আসছে না, বারবার যোগাযোগ করবার পরেও। আরমানদেরকে রমনা থানার ইনচার্জ বলছিল, আশা ছাড়বার ব্যাপার নয় এটা―বরংচ ধৈর্য ধরতে হবে! নিশ্চয়ই রুনুকে ঢুঁড়ে বের করবে তারা! এবার সত্যিই দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়ল রুনুদের পরিবার, তাদের স্বজন, আরমান আর তার বন্ধুবান্ধবরা। আরমানের বন্ধু চয়ন তখন আলাপ করল সারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধারাও খুঁজতে নামল রুনুকে। এদিকে আরমান আর তার বন্ধুরা ঢাকা শহরের আনাচেকানাচে এবং আশেপাশের এলাকাগুলোতে রুনুর অনুসন্ধান চালু রেখেছিল। পল্লবের মনে পড়ে, বিধস্ত আরমানের চেহারার দিকে আর তাকানো যাচ্ছিল না। তার ওপরে দিনে দিনে তীব্র হচ্ছিল মানসিক চাপ আর হতাশা। তার নাওয়া-খাওয়ার কোনও ঠিক ছিল না। দু সপ্তাহেই তার চেহারায় স্পষ্ট করে পড়ে গিয়েছিল পরাজয়ের ছাপ।

এমন একটা ভয়ঙ্কর অস্থির সময়ের মাঝে, অন্তর্ধানের এক মাস মতো পরে, সিদ্ধেশ্বরীতে ফিরে এল রুনু, এক রাতে, কুড়িগ্রাম থেকে। তার ঠোঁট, গণ্ড, চোখ, কপাল, কণ্ঠা আর দু হাতের বাহু থেকে আঙুল পর্যন্ত কোথাও কোথাও ভেসে উঠেছে রক্তমুখী আঘাত, কোথাও আঘাতের দাগ পুরানো হতে হতে কালো রঙ ধারণ করেছে। কারও আর বুঝতে বাকি রইল না, এসব আঘাতের চিহ্ন আসলে প্রমাণ করে যে রুনুর ওপরে ঘটে গেছে শারীরিক অত্যাচার আর তা প্রতিরোধের জোর চেষ্টাও চালিয়েছে রুনু। এমন সব আলামত দেখে মনে হচ্ছিল, হয়তোবা জোর করেই উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রুনুকে। তখন প্রশ্ন উঠল―তাইই যদি হবে তবে কে করেছে এই বদ কাজটা ? কেনইবা করেছে ? পয়লাতেই চেষ্টা হলো বুঝে নিতে, রুনুর কোনও প্রেমিক এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত কিনা। প্রথমত, আরমান বাদে রুনুর যে আর কোনও প্রেমিক নেই সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না কারও। দ্বিতীয়ত, যদি রুনুর কোনও গোপন প্রেমিক তাকে তুলে নিয়ে গিয়েও থাকে তবে রুনুর শরীর এত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাবে কেন ? প্রেমিকেরা যতই বেইমান হোক না কেন তারা সাধারণত ধর্ষকামী হয় না, হলেও এমন গুরুতর পর্যায়ে তারা উঠবে না কখনওই। তবে ? তবে কি প্রেমিক ভিন্ন অন্য কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছিল রুনুকে ? তারা কি মুক্তিপণ চায় ? নাহ! মুক্তিপণ দাবি করছে না কেউই। এসব লাফাঙ্গা তবে কারা ? সেই নিগড় থেকে কীভাবে বেরিয়ে এল রুনু ? নাকি তাকে ইচ্ছে করেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ? প্রশ্নগুলো উত্তরহীনই রয়ে গেল। রুনুও কোনও সহযোগিতা করছিল না। আশপাশের মানুষের প্রশ্নবাণের মুখে সে তখন কেবল বলে চলেছে একই কথা―তোমরা যতই প্রশ্ন করো না কেন, আমি কিছুই বলব না। আমার দুর্ভাগ্য আমারই থাকুক। এসব ব্যাপার নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই না। রুনুর আশপাশের মানুষজন হতাশ হয়ে অনুযোগ জানাচ্ছিল বারবার―সে কী কথা ? মুখ বন্ধ করে রাখলে অপরাধী বা অপরাধীদেরকে ধরা যাবে কীভাবে ? 

রুনুদের কালীবাড়ি রোডের বাসায় গিয়ে আরমান একান্তে রুনুকে অনুরোধ করল, ‘বলো, কে করেছে এই কাজটা ? আমি তার জান খারাব করে ফেলব!’ তখনও দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে উত্তর করেছিল রুনু, ‘না! বলব না। তোমার এত মাতব্বরি করার দরকার নাই। আমার সমস্যা আমাকেই সামাল দিতে দেও।’ রাগে ফুটতে ফুটতে রুনুদের বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল আরমান। বন্ধুদের কাছে অনুযোগ করছিল সে―এ কেমন নিষ্ঠুরতা রুনুর ? ওর কি মাথাটা গেছে ? আরমানকে ধৈর্য ধরতে বলা ছাড়া আর কীইবা করবার ছিল তার বন্ধুদের ?

রুনুর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু তনিমাও রুনুকে একই অনুরোধ করেছিল―সব খুলে বল হাঁদারাম! এর তো একটা বিহিত হওয়া দরকার। দেখ না, ভাইয়া কেমন ফুঁসছে ? মুদু হেসে উত্তর করেছিল রুনু, ‘থাক না! আমি আর কোনও রক্তপাত দেখতে চাই না।’ তার যুক্তি ছিল, এই যে হাজার মৃত্যুর সম্ভাবনাকে আড়ি দেখিয়ে অক্ষত অবস্থাতে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেছে আরমান। তাকে আবারও বুলেটের ঝাঁকের ভেতরে ঠেলে দেওয়াটা সঙ্গত হবে কি ? তার চাইতে এই ভালো, আরমান অনার্স পরীক্ষাতে বসুক আর সেই ফাঁকে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিক রুনু। রুনুর এই যুক্তি পছন্দ হয়নি তনিমার।

রুনুর অভিপ্রায় জানবার পরে আরও মুষড়ে পড়েছিল আরমান। জগৎ-সংসারকে এড়িয়ে সে নিজেকে আবদ্ধ করতে শুরু করেছিল ঘরের ভেতরে। ঘরের বাইরে যাওয়া বলতে সে কেবল ক্লাস করবার জন্য যাচ্ছিল বিশ^বিদ্যালয়-ক্যাম্পাসে; আর সন্ধেবেলায়, আড্ডা মারতে মন চাইলে, বড়জোর সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের মাঠ পর্যন্ত। সেই সময়টাতে আরমান আর রুনু পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। রুনুর সংবাদ কিছু কিছু মিলছিল তনিমার মাধ্যমেই। আরমানের জন্য সেসব সংবাদ প্রয়োজনীয় ছিল বটে, কেননা তথ্য মানুষকে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে আংশিকভাবে হলেও একটা ধারণা দেয়। কিন্তু তথ্য তো আর মানুষের কাছে অপরের মনের ভেতরে কী চলছে না চলছে তা পুরোপুরিভাবে তুলে ধরতে পারে না! এই খামতিটুকু মেনে না নিয়েই বা উপায় কী ? যেমন, আরমানকে তনিমা জানাচ্ছে: আজকাল রুনুর মাথা ধরছে খুব, মাথায় বড় কোনও আঘাত পেয়েছিল মনে হয়; গিয়ে দেখি বারান্দার অন্ধকারে বসে কাঁদছে রুনু; রুনুকে দেখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন সাইকায়াট্রিস্ট আসবেন আজকে, রুনুর বিষণ্নতার চিকিৎসা হওয়া দরকার ইত্যাদি। এমন সব তথ্য অবশ্য আরও বিক্ষিপ্ত করে তুলছিল আরমানকে। তবে মনের গভীর থেকে সে শুভকামনা করছিল―রুনুর মঙ্গল হোক। কিন্তু একই সময়ে আরমানের মনে জমছিল তীব্র অভিমান―কই ? আমাকে তার নিজের মনের কথা, তার চিন্তাভাবনা জানাবার প্রয়োজন বোধ করছে না রুনু, আমি কেমন আছি না আছি তারও কোনও খবর নিচ্ছে না সে! এটা কি দুঃখজনক নয় ?

আরমানের আব্বা তাকে পরামর্শ দিয়েছিল―যা! কদিন বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আয়। এ পরামর্শ শুনে তনিমাকে বলেছিল আরমান―রুনুর এমন ভঙ্গুুর অবস্থাতে তাকে রেখে কীভাবে দূরে যাই, বল ? রুনু যদি ডাকে ? কখন কী দরকার পড়ে যায় তা কি বলতে পারবে কেউ ? প্রয়োজনে ছুটে যাওয়া যাবে রুনুর বাসায়। সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের মাঠ থেকে দক্ষিণে বড় জোর পঞ্চাশ গজ এগুলেই রুনুদের বাসা। সিদ্ধেশ্বরী বয়েজ স্কুলের পাশের মেঠো পথ ধরে ভেতরে ঢুকলেই কালীবাড়ি মন্দির, তার উল্টো দিকে রুনুদের বাসা―খুব দূরে তো আর নয়!

রুনুর কাছ ছেড়ে আরমান কোথাও গেল না। কিন্তু পরের বছর, মানে, ১৯৭৩ সালের মার্চে গিয়ে দেখা গেল, মাইজদীতে তার দাদার বাড়িতে চলে গেছে রুনু। যাবার আগে তনিমাকে সে বলে গেছে, কবে যে সে ঢাকায় ফিরবে তার কোনও ঠিক নেই। কাজেই আরমান যেন ঠিকঠাক মতো পড়াশোনাটা চালিয়ে যায়। এখানেই শেষ নয়―১৯৭৩-এর শেষ দিকে রুনুদের পড়শি গৌরীর মাধ্যমে তনিমা জানতে পেরেছিল, কদিন আগেই বিয়ে করে ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে গেছে রুনু। তার জামাই সীতাকুণ্ডের মানুষ। সান দিয়েগোর একটা প্রাইভেট কলেজে সে ফিজিক্স পড়ায়। মাইজদীতেই ঘটেছে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। তারপর যেটা ঘটে―চর ভদ্রাসনে তার দাদার বাড়িতে চলে যায় সব কিছুর ওপরে বীতশ্রদ্ধ আরমান। এক ফাঁকে ঢাকায় এসে সে অনার্স পরীক্ষাটা দিয়ে যায়। চেনাপরিচিত মানুষজন থেকে দূরের চর ভদ্রাসনেও সম্ভবত তার মন শীতল হয়নি। তার প্রমাণ মিলল ১৯৭৪ সালে যখন সে অগ্রণী ব্যাংকের রিক্রুটমেন্টে পরীক্ষা দিয়ে ক্যাশ অফিসার পদে যোগ দিয়ে বসল। তার মুক্তিযোদ্ধা-পরিচয়টার কারণে চাকরিতে ঢুকবার বেলাতে অগ্রাধিকার পেয়েছিল সে। তার বন্ধুরা তখন ঢাকাতে জমিয়ে লাইসেন্স-পারমিটের ব্যবসা করছে; রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আর রাজনীতির সুফলের ভাগযোগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে; নিজেদের উচ্চাকাক্সক্ষার মাপে একেবারেই ভাগ না পেয়ে বা কম পেয়ে খুলে বসছে নয়া রাজনৈতিক দল। এদিকে প্রতিদিন নটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংকের কিশোরগঞ্জ শহর-শাখার স্যাঁতসেঁতে একটা রুমে বসে লাগাতার ক্যাশ গুনেছে আরমান; দিনশেষে ক্যাশের হিসাবও মিলিয়ে দিয়েছে অ্যাকাউন্টস সেকশনে। পল্লব লক্ষ করেছে, প্রতিদিন ক্যাশ গোনা আর হিসাব মেলানোর মতো এমন ক্ষয় নিয়ে কোনও খেদই ছিল না আরমানের মনে, বিনিময়ে স্বল্প বেতনে যোগ নিয়েও অভিযোগ ছিল না। আরমান কেবল ফুরিয়ে দিতে চাইছিল ক্লান্ত দিনগুলোকে। আম্মার তীব্র চাপাচাপিতে আটচল্লিশে পৌঁছে সে যখন নড়িয়ার রেহানাকে বিয়ে করে তখনও তার বড় কোনও আকাক্সক্ষা ছিল না। পয়লাতে আম্মার প্রস্তাবের প্রতিবাদ করেছিল আরমান। সে বলেছিল, এসব বিয়েশাদি তার ভালো লাগে না। আর তাছাড়া সে এখন নিজেই রান্নাবান্না করে খেতে পারে, বয়স হলে পানি গড়িয়ে দেবার মতো মানুষেরও ব্যবস্থা করে ফেলাটা খুব সম্ভব। তবে বিয়েটিয়ের এসব জটিল আয়োজনের ভেতরে ঢুকবার প্রয়োজনটা কী ? নাছোড় আম্মা যুক্তি দিয়েছিল, সেটা ঠিক। কিন্তু দেখ, জীবনকে অস্বীকার করেনি রুনু! ক্যালিফোর্নিয়াতে যারা রুনুর বাসায় বেড়াতে গেছে তারা সবাই ঢাকায় ফিরে এসে বলেছে―রুনুর মতো এমন হাসিখুশি মানুষ খুব কমই দেখা যায়! কী চমৎকার গুছিয়ে সংসার করছে সে! কাজেই আম্মা চায়, রুনুর মতো করে স্বাভাবিক একটা জীবনকে গ্রহণ করুক আরমান। যা হবার তা হয়েছে―মানুষের জীবনের সব ক্ষতির তো আর সমাধান মেলে না! আর তা যদি না মানতে চায় আরমান তবে সে নিয়ম মেনে চলুক যেন তার ডিওডেনাল আলসার আর হাই কোলেস্টরলের সমস্যার একটা বিহিত হয়। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে বিয়েতে মত দিয়ে ফেলল আরমান! কিন্তু সংসার থেকে আলগাই রয়ে গেল সে। এভাবেই এবার পঁয়ষট্টিতে পা পড়েছে তার।

গেস্টরুমে রাখা কার্ডবোর্ড বক্সটার একগাদা জিনিসের ভেতর থেকে রুনুর চিঠিটা খুঁজে পেতে পল্লবকে বেগই পেতে হলো! পল্লব ভেবেছিল, সবচাইতে পুরোনো ফোল্ডারে নীল খামে ভরা রুনুর চিঠিটা রাখা আছে। অনেক খুঁজেও সেখানে চিঠিটা পাওয়া গেল না। বাকি ফোল্ডারগুলোতেও চিঠিটা নেই। চিঠিটা তবে গেল কোথায় ? বক্সে ফোল্ডার ছাড়াও রাখা আছে পুরোনো কটা ডায়রি, খাতাপত্তর আর মৃত আব্বা-আম্মার শেষ সময়ে ব্যবহার করা ব্যক্তিগত কিছু জিনিস―ঘড়ি, চশমা, কলম, তসবিহ, কুরআন শরিফ, পানের বাটা, ডায়াবিটিস আর ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্র, ইনস্যুলিন ইঞ্জেকশন, ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট ভরা কৌটো ইত্যাদি। পল্লবের মনে হলো, এসব জিনিসপত্তরের ফাঁকে কোথাও পড়ে থাকতে পারে রুনুর চিঠিটা। সেটা খুঁজে দেখতে হলে নামাতে হবে বক্সের সব জিনিসপত্তর। সেই ঝামেলাটাই নিতে হলো শেষ পর্যন্ত! ফল হলো তাতে―দেখা গেল, বক্সের একেবারে নিচে এক কোনায় লম্বালম্বিভাবে আটকে আছে নীল খামটা। খামটা নিয়ে সে রেখে এল শোবার ঘরের খাটের পাশের সাইড টেবিলের ড্রয়ারে; তারপর মোবাইল ফোনে কল করে আরমানকে জানাল, ‘তোমার জিনিস খুঁজে পাওয়া গেছে। কখন নিবে ? আমি আসব ?’

‘নাহ। তুই থাক। আমিই আসছি।’ এই বলে ফোন রেখে দিল আরমান।

পল্লব ভাবে, এই যে আরমান রুনুর চিঠি নিতে তার অ্যাপার্টমেন্টে আসছে―এটাই বরংচ ভালো। পল্লব চায় না রুনুর চিঠি নিয়ে দু ভাইয়ের আবেগ প্রত্যক্ষ করুক রেহানা ভাবি। এমন তো হতেই পারে, দীর্ঘ দিন পরে রুনুর চিঠিটা হাতে নিয়ে শোকে, বিষাদে ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ল আরমান আর তা দেখে পল্লবও বিচলিত হয়ে পড়ল তখন। আর সেটা যদি রেহানা ভাবির চোখের সামনে ঘটে যায় তবে নানাবিধ প্রশ্ন উঠতেই পারে, আরমান আর রেহানার মাঝে সংঘর্ষ ঘটে যাওয়াটাও বিচিত্র নয়। এমন একটা জটিল পরিস্থিতি ঘটুক তা মোটেই চায় না পল্লব। সে মনে করে, রুনুর মৃত্যু আরমানকে এতটাই বিষণ্ন করে তুলেছে যে এই মুহূর্তে তার পক্ষে আবেগ সংযত রাখতে পারাটা সত্যিই কঠিন।

পল্লবের ফোনকলের দশ মিনিটের ভেতরেই নিচতলা থেকে উঠে এসে হন্তদন্ত হয়ে পল্লবের ঘরে ঢোকে আরমান; ঢুকেই বলে, ‘চিঠিটা দে তো!’ পল্লব তার হাতে চিঠিটা তুলে দিলে চিঠি হাতে নিয়ে চটজলদি বসার ঘরে চলে যায় সে। মিনিট দশেক পরে সেখানে গিয়ে পল্লব দেখতে পায়, সোফায় বসে আরমান একমনে টেলিভিশনের চ্যানেলে চ্যানেলে ঘুরছে। তার থমথমে মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে চিন্তিতই হয়ে পড়ে পল্লব। আরমানকে সে জিজ্ঞাসা করে, ‘ঠিক আছো তো তুমি ?’

‘আমি ঠিক আছি। ভাবিস না।’ তারপর একটু থেমে সে পল্লবকে বলে, আগামীকাল সকালে সে রুনুর কবরটা একটু দেখে আসতে চায়। সময় হবে কি পল্লবের ?

পল্লবের মুশকিল যেটা হয়েছে, আগামীকাল সকালে তার আশুলিয়ার গার্মেন্ট-ফ্যাক্টরিতে ব্রাসেলস থেকে নতুন একজন বায়ার আসবে, সকাল এগারটাতে মিটিং। মিটিংয়ের সময়টা বদল করে নেওয়াটা সম্ভব নয়, কেননা ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে আসা সেই বায়ারের শিডিউল খুবই আঁটোসাঁটো―যেমনটা সচরাচর হয় আর কি! কাজেই সকালে না হোক বিকেলের দিকে সে অবশ্যই আরমানের সঙ্গে আজিমপুর কবরস্থানে যেতে পারবে।

পল্লবের প্রস্তাব মেনে নেয় আরমান। রুনুর চিঠি পকেটে ঢুকিয়ে সে সোফা থেকে উঠে পড়ে নিচতলাতে তার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে চলে যাবার জন্য। তখন পল্লব তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘রুনু আপাকে কে বা কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল তা আর জানাই গেল না, দেখো! এতগুলো দিন পার হয়ে গেল! ভুলেও গেছে সবাই!’

আরমান বলে, তার ধারণা, সেই ১৯৭২ সালে রুনু স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হয়নি। যে বা যারা কাজটা করেছিল তারা দূরেরই কেউ হবে। মগবাজার, সিদ্ধেশ্বরী, শান্তিনগর বা মালিবাগ এলাকার মানুষজনদের এতটা অবিবেচনা বা সাহস থাকবার কথা নয়। যা হোক, সম্ভাব্য অপরাধী বা অপরাধীদের অজানা সেটটা তো আসলে মস্ত বড়! এ কারণেই আরমানরা রুনুর হারিয়ে যাবার ঘটনাটার কোনও কূলকিনারা করতে পারেনি। অনেক সাধ্যিসাধনার পরেও কোনও সূত্র দেয়নি রুনু নিজেও। তো কীভাবে অপরাধী বা অপরাধীদেরকে খুঁজে বের করা যাবে ? আর এত দিন পরে তা জেনেইবা কী ফায়দা হবে পল্লবের ? পিস্তল বের করবে পল্লব ?

‘তা অবশ্য ঠিক!’

‘শোন, এই ক্ষতি আমি মানব না, মানব না করেও তো আটচল্লিশ বছর পার হয়ে গেল! এখন আর এসব কিছু জরুরি বলে মনে হয় না আমার কাছে। বাদ দে তো এসব!’

পরদিন আশুলিয়ার অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে বিকেল প্রায় চারটা বেজে যায় পল্লবের। বাসার নিচেই তার অপেক্ষাতে দাঁড়িয়ে ছিল আরমান। চটজলদি তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে আরমান রওয়ানা দেয় আজিমপুর কবরস্থানের উদ্দেশে। যাত্রাপথে দেখা যায়, আকাশে ঘন হয়ে উঠছে আষাঢ়ের কালো মেঘ। গাড়িটা হাইকোর্ট পার হতেই শুরু হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। এর অর্থ এই যে একটু পরেই দুনিয়া অন্ধকার করে বৃষ্টি নামবে। তখন ইতঃস্তত করতে করতে আরমান বলে বসে, ‘কয়টা ফুল নিয়ে গেলে ভালো হতো না!’

ফুল ? তবে তো ভালোই হতো! কিন্তু সমস্যাটা এই যে শাহবাগ ছাড়া এ দিকটাতে তো ফুলের কোনও কারবারই নেই। আরমান আগে মনে করল না কেন ? তবে তো শাহবাগ দিয়েই আজিমপুরের দিকে এগোনো যেত! এ কথা শুনে আরমান কুণ্ঠিত হয়ে পড়ে; বলে, ‘আচ্ছা! থাক তবে।’

পল্লব যুক্তি দেয়, কবরস্থানেই তো হাজারও বর্ষার ফুল ফুটে আছে, সেগুলো কটা ছিঁড়ে নিলেই তো কাজ হয়ে যায়! কী বলো ? কোনও মন্তব্য করে না আরমান। এত সব বলবার পরেও পল্লবের মনে হয়, রুনু আপার জন্য কটা কদমফুল নিয়ে যেতে পারলে মন্দ হতো না! কদমফুল তো খুব প্রিয় ছিল রুনু আপার! অবশ্য এও ভাববার বিষয় যে মৃত মানুষের আদৌ কোনও পছন্দ-অপছন্দ আর অবশিষ্ট থাকে কি না! প্রিয়জনের কবরে আমরা হয়তো ফুল দিয়ে আসি স্রেফ আমাদের নিজেদের ইচ্ছাপূরণের জন্যই!

আজিমপুর কবরস্থানের মূল ফটকে পৌঁছবার আগেই ঝড়ো বাতাস দিয়ে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামে। গাড়িতে ছাতা ছিল না বলে দরজা খুলে এক দৌড়ে মূল ফটক পার হয় পল্লব আর আরমান, তারপর উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত শেডে তারা উঠে পড়ে। তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে যেতে চায় না বলে মূল ফটকের কাছের এ জায়গাটায় ভিড় করে আছে কবরস্থানে আসা মানুষজন। তাদেরকে এড়িয়ে শেডের নিচ দিয়ে উত্তরে নিউ মার্কেটমুখী গেটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পল্লব আরমানকে জিজ্ঞাসা করে, এই তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কী করে রুনুর কবর পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে ? বৃষ্টিটা ধরে আসা পর্যন্ত শেডে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলে ভালো হয় নাকি ?

আরমান উত্তর দেয়, ‘বৃষ্টিতে ভিজে গেলে কী আর এমন ক্ষতি হবে, বল ? তুই শেডে দাঁড়িয়ে থাক না হয়!’

কী করবে তা ভেবে পায় না পল্লব। এদিকে বৃষ্টির তেজ বাড়ছে আরও। শেড থেকে পঞ্চশ গজ মতো পশ্চিমে কবরস্থানের সীমানা-দেয়ালটা ঘন বৃষ্টিতে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। আরমানকে পল্লব জানায়, ও দিকটাতেই রুনুর কবর। শেডের মাঝামাঝি গিয়ে বাম দিকের সরু একটা রাস্তা ধরে পৌঁছাতে হবে সেখানে। এই বলে কিছু দূর এগিয়ে রুনুর কবরটার নিশানা স্থির করে পল্লব; ডান হাতের তর্জনী তুলে নির্দেশ করে জায়গাটা; তারপর আরমানকে বলে, ‘ঐ যে! মেহগনি গাছটা দেখছো না ? ওটারই ছায়াতে কবরটা।’

‘চল, যাই তবে।’

পল্লব ভাবে, শার্ট-প্যান্ট-জুতো-মোজা ভিজে গেলে কিইবা যাবে-আসবে! শুকিয়ে নিলেই হলো। ঘড়িটা ভিজবে না কেননা সেটা ওয়াটারপ্রুফ। রইল বাকি মোবাইল ফোন। সেটাকে রুমালে পেঁচিয়ে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিলেই চলবে। কাজেই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সে কংক্রিটের সরু পথটা ধরে আরমানের পিছু পিছু পশ্চিমে হাঁটতে থাকে।

যদিও আকাশ ভেঙে সুন্দর বৃষ্টি নামছে কিন্তু কবরস্থানের কোথাও এক ফোঁটাও উল্লাস নেই। মৃত প্রিয়জনদের সঙ্গে বন্ধন ধরে রাখবার জন্য কবরস্থানে আসা দশনার্থীরা সমাহিত এখানে―কেউ আওয়াজ করছে না; তারা যাওবা কথা বলছে দু-একটা, তাও ফিসফিসিয়ে। কান না পাতলে শোনাই যাচ্ছে না সেসব কথাবার্তা! এদিকে অভিব্যক্তিহীনভাবে দমকা বাতাসে দুলছে ছোট-বড় গাছগুলো, তাদেরও কোনও প্রাণ নেই যেন!  মনটা ধরে আসে পল্লবের।

টগর, শিউলি, রজনীগন্ধা আর লাল জবা গাছের মতো করে বৃষ্টির ধারাতে তুমুলভাবে ভিজে যাচ্ছে আরমান আর পল্লব। তবু খুবই ধীর পায়ে রুনুর কবরের দিকে হাঁটছে আরমান। তার কোনও তাড়া নেই যেন! পল্লবকে সে বলে, ‘আব্বা-আম্মার কবর থেকে খুব দূরে নয় রুনুর কবরটা, নানুর কবরের কাছেই। মেহগনিটা তবে ল্যান্ডমার্ক। আগে ওখানে মস্ত বড় একটা শিরিষ ছিল―মনে আছে তোর ?’ মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেয় পল্লব। এসব কথাবার্তার মাঝে তারা পৌঁছে যায় নবীন মেহগনির গোড়ায়। রুনুর কবরের শিথানের দিকটাতে গিয়ে দাঁড়ায় তারা দুজনে। বৃষ্টির হল্লাতে এবার তারা ভিজে যেতে থাকে আরও।

কবরটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরমান। হয়তো সে তার প্রিয় মানুষ রুনুকে নিয়ে ভাবছে―জীবিত রুনু কেমন ছিল দেখতে, সে কেমন করে হাঁটত, কেমন করে কথা বলত, কতটুকু উষ্ণতা ছিল তার, কতটুকু রাগ ছিল, কেমন করে সে হাসত―এসবই হয়তোবা। পল্লব জানে, এগুলো তার নিজের অনুমান মাত্র―সহোদরের মনের খবর সে পড়বে কী করে ? আরমানের চোখ ভেঙে অশ্রু গড়াচ্ছে কিনা বৃষ্টির দৌরাত্ম্যের কারণে বোঝা যাচ্ছে না সেটাও। পল্লব কেবল দেখতে পাচ্ছে, আরমানের চুল বেয়ে নেমে আসা অবিরল বৃষ্টিধারা নিচে গড়াচ্ছে তার কপাল চোখ, গণ্ড, নাক, ঠোঁট ছাপিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই তার হাতের তালু-পিঠ দিয়ে সে তা মুছে ফেলবার চেষ্টাও করছে বারবার। অশ্রু যদি কিছু আরমানের চোখ গলে নেমেও থাকে, এই জোর বৃষ্টিতে তার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে মুখমণ্ডলে জেগে থাকবার কথা নয়। তবে এও ঠিক যে, অনেক সময় মানুষের খুব ওজনদার বেদনা শুকিয়ে যায় মনের গহিনেই!

রুনুর কবরে বসানো তাজা ঘাসের বেডে, রুনুর শিথানে দু’টো গন্ধরাজ শুইয়ে দেয় আরমান। পাশের কোনও কবরের ওপরে গজিয়ে ওঠা গাছ থেকে সে ফুল ছিঁড়ে নিয়েছে। তারপর সে পল্লবকে বলে, ‘এক জীবনে অনেক কষ্ট করতে হলো রুনুকে! এতটা না হলেও পারত!’ এই বলে সে তার পকেট থেকে বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে যাওয়া নীল খামটা বের করে। খাম থেকে বের হয় দীর্ঘ আটচল্লিশ বছর আগে লেখা রুনুর চিঠিটা। আঁড়চোখে পল্লব দেখতে পায়, লাল রঙের চিকন রুল টানা সাদা কাগজে অল্প কিছু লাইন লেখা আছে, নীল কালিতে। কাগজটার গুটিগুটি হরফগুলো বৃষ্টিতে ভিজে ধুয়ে-মুছে যাচ্ছে, কাগজ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে নীলচে পানি, কাগজটা নেতিয়ে পড়ছে ক্রমশ। সে দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আরমান। খানিক পরেই হরফ মুছে গিয়ে শূন্য হয়ে পড়া চিঠিটা আরমান কায়দা করে ভরে ফেলে ভিজে যাওয়া নীল খামে; তারপর রুনুর কবরের ঘাসের গালিচায় শুইয়ে রাখা গন্ধরাজগুলোর নিচে সে রেখে দেয় খামটা। 

আরমানের চোখে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে পল্লব, ‘পারলে তুমি ?’ কিন্তু সে অনুযোগের কোনও উত্তর দেয় না আরমান। রুনুর কবরের শিথান থেকে ধীর পায়ে কবরস্থানের শেডের দিকে হেঁটে যায় সে। তাকে অনুসরণ করে শেডে ওঠে পল্লব। তারা হাঁটছে দক্ষিণে―মূল ফটক বরাবার। বৃষ্টিতে একবারে ভিজে গেছে তারা দুজনেই! নিজেদের মুখমণ্ডল থেকে পিড়পিড় করে নামতে থাকা বৃষ্টির পানি হাতের তালুতে তারা মুছে ফেলবার চেষ্টা করছে।

আগে বাড়তে বাড়তে আরমানকে ফের জিজ্ঞাসা করে পল্লব, ‘বলো না, চিঠিটাতে রুনু আপা কী লিখেছিল!’

গম্ভীর আরমান উত্তর দেয়, ‘তেমন কিছুই না আসলে। মামুলি ব্যাপার এসব। বাদ দে তো!’

এর পরে তো আর কোনও ওজর চলে না!

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button