ভ্রমণগদ্য : তিন পাগলের হলো মেলা, সুন্দরবনে : মঈন আহমেদ

স্বভাবে অল্প ক্ষ্যাপা আছি জীবনের সকাল থেকে―মা সেটা বুঝেছিলেন হাড়ে হাড়ে, তা না হলে পুরানো কাপড়ের বিনিময়ে কেনা নতুন তামচিনের হাঁড়ি দিয়ে পিঠে এক ঘা বসিয়ে সেটার চকচকে তলানি চ্যাপ্টা করা কিংবা হাতের কাছে কিছু না পেয়ে পাছার তলা থেকে উপবেশনের জন্য নড়বড়ে পিঁড়ির এক ঘা বসিয়ে পিঁড়িটাকে নাস্তানাবুদ করা তো আর এমনি এমনি করতেন না! এখানে একটা কথা বলে রাখা নেহায়াতই উচিত মনে করছি যে, আমি পাঁচ সহোদরার একমাত্র ভাই। অনেক তাবিজ-কবচ আর কান্নাকাটির পরে অন্তরীক্ষের অজানা কোনও দেশ থেকে আমাকে আমার মা-জননী পৃথিবীতে টেনে এনেছিলেন। এখন তো জীবনের সন্ধ্যা পেরিয়ে গভীরতর নিশি যাপন করতে প্রস্তুত রয়েছি।
এই ক্ষ্যাপাকে ক্ষেপিয়ে তুললেন, আমাদের বন্ধুবর বাঘ-মামা মানে সেই সময়কার, জানা মতে অন্যতম কিম্বা একমাত্র বাঘ-বিশেষজ্ঞ, বর্তমানে কানাডা নিবাসী খসরু চৌধুরী। বহুদিন ধরে বায়না ধরে বসেছিলাম তাঁর সঙ্গে সুন্দরবন বেড়াতে যাব―কারণ তিনি তো দুশো বারের অধিক সুন্দরবনে গিয়েছেন, দিনের পর দিন সেখানে অবস্থান করেছেন, বিস্তর অভিজ্ঞতা তাঁর। আরও সঙ্গে যাবে কে ? ওমা! যাবেন পক্ষীবিশারদ ইনাম আল হক!
তিন পাগলের বসবে মেলা, সুন্দরবনে। তাঁরা তো বিশারদ আর আমি তাঁদের যন্ত্রণা।
৭ নভেম্বর, ১৯৯৭ সাল। সকাল নটা নাগাদ বিশেষজ্ঞ দু’জনে ঢাকার মোহাম্মদপুরের শের শাহ সুরী রোডের ভাড়ার বাসার নিচে এসে কলিং বেল টিপে ডাক দিলেন। আমার বরিয়া-বিস্তর তেমন কিছু নাই। চোঙের আকারের একটা ব্যাগ। তাতে একটা প্যান্ট, একটা শার্ট, একটা গামছা একটা লুঙ্গি আর একটা দেড়শ টাকা দামের নতুন কেডস। আর একটা ১০০ চরঢ়বৎং-এর ভরা বোতল।
যাত্রালগ্নেই লাগল বিভ্রাট। তখন তো সবুজ সিএনজি ছিল না―ছিল হাতে স্ট্রোক দেওয়া কালো বেবি-ট্যাক্সি, যেটার অদ্ভুত কাতর আর্তনাদ এখনকার যুবক আন্দোলনকারীরা শোনে নাই। আমাকে দেখে দুজনে একসঙ্গে হা হা করে উঠলেন―আপনার পানি কই ?
মরছি না! পানি দিয়ে কী হবে!
দেখি কী! দুজনে দুটা পানি ভরা ভাণ্ড বা জার, না কী যেন বলে, সঙ্গে বহন করছেন।
বিস্মিত হয়ে বললাম, এই পানি ঢাকা থেকে বহন করে নেবেন! বিশেষজ্ঞ দুজন তো আমাকে অজ্ঞ জানতেনই কিন্তু ইনাম ভাই জানতেন না যে, আমার উচ্চমার্গীয় মউদুদি বন্ধুরা আমাকে বলতেন যে মঈন তো পানি খায় না―তাহলে কী খায় ?
চা কিংবা মদ। মদ মানে হুইস্কি, তাও আবার কাঁচা, নির্জলা!
বললাম, এখন তো যাত্রা করি, খুলনায় গিয়ে একটা ব্যবস্থা করব না হয়। দুজনে আচ্ছা করে শাসিয়ে দিলেন, তাদের ভাণ্ডের পানি আমাকে তারা হারগিস দেবেন না। তথৈবচ।
গাবতলী থেকে বাসে চেপে সন্ধ্যা হবে কি হবে না অবস্থায় প্রাচীন নগরী খুলনায় গিয়ে নামলাম। নাকে সুড়সুড় করে লোবানের গন্ধ নির্বিচারে ঢুকতে লাগল। রাস্তার দুপাশে বুনিয়াদি সনাতনি দোতলা তিনতলা অট্টালিকা। সারাদিন তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। সিদ্ধান্ত হলো আগে রাতের খাওয়া সেরে নিই, তারপর রাত কাটানোর জন্য কোনও হোটেল খুঁজে নেব। বেশ!
খেতে বসে জানলাম―ইনাম ভাই নিরামিষভোজী। বকা না খাওয়া পর্যন্ত সাধলাম একটা মুরগির রান খাওয়ানোর জন্য। বরফ গলল না। ডিম মাঝেসাজে খান তাও খেলেন না, হয়তো আমার ওপর রুষ্ট হয়ে―নাহ, মনে হয়! জানার জন্য, মনের গহিন থেকে আর সেটা উগরালাম না। ইনাম ভাই আমার মনের পরিস্থিতি বোধকরি বুঝতে পারলেন, বললেন, আমি শুধু ভেজিটেরিয়ানই নই; আমি চামড়ার জুতা কিংবা কোমরের বেল্ট কিংবা পকেটের পার্স কিছুই চামড়ার ব্যবহার করি না। তারপর সামনের প্লেটে সবুজ তাজা কাঁচামরিচ দেখিয়ে বললেন, একটা কাঁচামরিচ খেতে ইচ্ছা করছে যদি আপনি একটু সদয় হন।

এ আবার কেমন কথা! বললেন, একটা মরিচ ভেঙ্গে জিহ্বায় ঠেকিয়ে দেখেন তো মরিচে ঝাল আছে কি না! একটা মরিচ ভেঙ্গে চেখে বললাম, হ্যাঁ এটা নেন, এটায় বেশ ঝাল।
নাহ! আমি তো ঝাল মরিচ খেতে পারি না, আপনি একটা ঝালবিহীন মরিচ খুঁজে দেন।―হইল কিছু! বিশেষজ্ঞের আবদারের ঢঙ দেখেন। এই কথাটা যদি আমি আমার বউকে বলতাম তাহলে কী ভীষণ একটা যে মুখ ঝামটা খেতাম, আহ হারে!
একটা হোটেল ঠিকঠাক করে খসরু ভাইসহ বের হলাম কিছু শুকনা খাওয়া নেওয়া এবং পানির বোতল কেনার জন্য। সাত বোতল ‘মাম’ কিনলাম―ছোট নয় বড়গুলো। এতগুলো বোতলের গলায় দড়ি বেঁধে নিলাম, বহনের সুবিধার জন্য। ফিরে এলাম হোটেলে। এক রুমে তিনজন, তিনটা খাট। মশারি টাঙিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করলাম। রাতে ভালো ঘুম হয় না, সেই চৌদ্দ বছর বয়স থেকে―আলহামদুলিল্লাহ! এখনও সেই রোগ সঙ্গে বহন করছি অন্যান্য আরও দু-একটার সঙ্গে।
মাঝরাতে খুটখাট মৃদু শব্দে ঘুম একেবারেই কেটে গেল। দেখি কি, জমিনে রাখা আমাদের শুকনা খাবারগুলোর উপর হামলে পড়েছে নেংটি ইঁদুরের পরিবার―সর্বনাশ! উঠে সেগুলো মশারির ভিতরে সামলে রাখলাম। ইঁদুরগুলো খেপে গেল―এত বড় স্পর্ধা! তাদের ইজারায় এসে আমার দৌরাত্ম্য তাদের সহ্য হয় কেমনে! আমিও পাহারায় বসে পড়লাম তাদের মাস্তানি ঠেকাতে। শরীরের এদিক-সেদিক তাদের কুটুস-কাটুস কামড় খেয়ে রাত কাটানোর চেষ্টায় মনোযোগী হলাম।
প্রত্যুষে, আমার সঙ্গী বিশেষজ্ঞদ্বয় ঝরঝরা হয়ে বিছানা ছাড়লেন। তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লাম লঞ্চঘাটের উদ্দেশ্যে। প্রায় বারো ঘণ্টার লক্করঝক্কর লঞ্চের যাত্রা।
ইনাম ভাই আমাদের দলনেতা। তিনি নির্দিষ্ট একটা পাখি দেখতে কিংবা পাখিটির ছবি তুলতে সুন্দরবনের পশ্চিম প্রান্তে আমাদের নিয়ে যাবেন। বাঘ-মামা, মানে খসরু ভাইয়ের কোনও ওজর আপত্তি নাই―আর আমি তো অকাট মূর্খ।
লঞ্চ নদীর দু পাড়ের এই-ঘাটে সেই-ঘাটে খাঁচার মুরগির মতো মানুষগুলোকে লঞ্চের পেটে পুরে, ঘাড়ে চাপিয়ে, লেজে তুলে নিয়ে চলল। আমি আনন্দঘন চিত্তে সব কিছু উপভোগ করছি। রোদ যখন তেতিয়ে উঠে শাসানো শুরু করল তখন আমার হুঁশ হলো―বিশেষজ্ঞ বন্ধুদ্বয় গেলেন কই! আবিষ্কার করলাম তাঁরা উভয়ে সারেঙের ছোট রুমে আরামসে বসে আছেন। সেখানে আমার―ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট্ট সে স্থান। আমাকে দেখে তারা এমন তৃপ্তির হাসি হাসলেন নাকি হাসিতে আমাকে ‘সুন্দরবন দেখার ঠেলা বোঝো’ এরকম অবজ্ঞা ছিল―আজ আর মনে নাই। আমার তো উপায় নাই! তাঁরা হলেন নেতা আর আমি একটুকরা তেনা। ইনাম ভাই বুদ্ধি দিলেন ভাত খেয়ে নেবার জন্য। সেই সুবাদে আমিও লঞ্চের হোটেলে একটু বসার জায়গা পেলাম। ভাত আর মাছের ঝোল। আমতা আমতা করে ভাতে ঝোল ঢেলে খেতে গিয়ে তো বমি করে ফেলার উপক্রম। সকালে নাস্তা করেছিলাম, সুতরাং শহরে কর্মস্থলে থাকলে খিদে পেত না বা খেতাম না―এটা নিশ্চিত। কিন্তু এখানে বেশ ক্ষুধা লাগল। বললাম, ডাল দেন―ইচ্ছাটা ডাল দিয়ে ভাত পেটে চালান দেব। ওরে মাবুদ রে! ডাল দেখে মনে হলো নদী থেকে একবাটি পানি তুলে আমাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সন্ধ্যা ঘন হয়ে গেল লঞ্চঘাটে ভিড়তে ভিড়তে। আমার ধৈর্য কুলালো না। বাঙালির সঙ্গে বাঙালিয়ানা দেখাতে পাড়াপাড়ি করে হুড়মুড়ি খেতে খেতে পাড়ে নেমে পড়লাম। এইবার, পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে―লুঙ্গি পরা তাগড়া তিনজন ফাঁড়ির সদস্যের সামনে জেরায় পড়লাম। অনুমতিপত্র চাইল। সেটা তো নাই। অনুমতি যে নিয়ে আসতে হয় সেটাই তো জানি না―মূর্খ না! খপাত করে একজন আমার ডান বাহুটা ধরে ফেলল। মূর্খেরও তো বুদ্ধি থাকতে মানা নাই, তাই না ? বলে বসলাম, আমার সঙ্গে একজন উইং কমান্ডার আছেন। এহ হে রে! দিলাম তো আগুনের মুখে জল ঢেলে―কোন ফাঁকে যে হাতটা শিথিল হয়ে গেছে টের পাইনি। ইনাম ভাই আমার দুর্দশা লঞ্চের পিঠে থাকতেই টের পেয়েছিলেন। তিনি নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মঈন ভাই ?
এখানে বাকিটা আর বর্ণনার দরকার আছে কি ? ফাঁড়িতে বসে চা-বিস্কিটের আপ্যায়ন শেষে আংটিহারায় প্রায়-পরিত্যক্ত ওয়াপদার ডাকবাংলোর দোতলায় আশ্রয় নিলাম। রাতে আর কপালে ভাত জুটল না।
সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম এসেছিল দ্রুত। রাতে যখন ঘুম ভেঙ্গে মনে পড়ল যে, আমি সুন্দরবনের সৌন্দর্য দেখতে এসেছি তখন মশারির ভেতর থেকে গুটি গুটি বেরিয়ে দরজা খুলে দোতলার প্রশস্ত বারান্দায় এসে হকচকিয়ে গেলাম। ঘাটে যখন নেমেছিলাম তখন চারদিকে পানি থইথই করছিল। এখন তো কোনও পানিই নেই। দশ-বারো হাত গভীর খালের তলানিতে বৃষ্টির পানিতে শহরের গর্তগুলোয় যেরকম পানি নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে আকুলি-বিকুলি করে, ঠিক সেরকম, ঠিক ততটুকু হবে হয়তো। ভাবলাম ঘুমের ঘোরে অন্যদিকের দরজা খুলে বেরিয়েছি। যে ভাবা সেই কাজ! পুনরপি ঘরে ঢুকে অন্যপাশের দরজা খুললাম। দঝর ছাই! ওটা তো বাথরুমের দরজা। আবার ফেরত আসলাম খাল দেখার জন্য।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। জুনি পোকারা আমাকে দেখে মনে হয় উৎসবে মাতল। অসংখ্য, অসংখ্য জোনাকি পাড় ঘেঁষে জ্বলছে-নিভছে। গ্রামে-গঞ্জে বিরুতের ঝোপে, নাড়ার মাথায় মাথায় এদের জ্বলতে-নিভতে বিস্তর দেখেছি, কিন্তু এমনতর দেখিনি। মাটি থেকে আকাশে চোখ তুলে চাইলাম। সেখানে নদীর উপরের আকাশ দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এরকম সাজাগোজা আকাশ আর কখনও দেখিনি। অদম্য মশার কামড় খেতে খেতে আর মস্তিষ্কে ধোঁয়া দিতে দিতে প্রায় প্রত্যুষকে ডেকে আনলাম। আকাশটা অন্ধকার থেকে ধীর পায়ে বেরিয়ে প্রথমে ডাঁসা-করমচা রং তারপর ফিরোজা রঙে রূপান্তরিত হতে লাগল। শরৎ-কাকু, সত্যি, অন্ধকারেরও ভুবনমোহিনী রূপ আছে!
আমাকে শাসিয়ে রাখা হয়েছে সকালবেলায় আমি যদি প্রস্তুত হতে দেরি করি তাহলে বিশেষজ্ঞগণ আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না।
আকাশে তখনও কয়েকটা তারা নিবু নিবু করে মনের গহিনে কষ্ট জাগানোর চেষ্টা করছে। আমি সন্তর্পণে ব্যাগ থেকে গামছাটা নিয়ে দোতলা থেকে নিচে নেমে গেলাম। রাতে জেনেছিলাম এই ওয়াপদার ডাকবাংলো কিংবা সাইক্লোন সেন্টারের পশ্চিম দিকে একটা মিষ্টি-পানির পুকুর আছে। সিঁড়ি বেয়ে নামতেই একজন গৃহবধূকে উনুনে গাল ফুলিয়ে ফুঁ দিতে দেখলাম। আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে তিনি চকিতে আমার দিকে ফিরে তাকালেন। এই সুযোগে জিজ্ঞেস করলাম পুকুরটা কোন পানে। তিনি আমার দিকে একপলক নির্বাক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাম বাহু তুলে নির্দেশ করলেন। নির্দেশমতো আমি চার কদম এগোতেই চোখে পড়ল পুকুর। জলের কাছে গেলাম, কালো স্বচ্ছ জল। তালের গুঁড়ির একটা ঘাটলাও আছে। বাহ! বেশ তো! কিছুক্ষণ মনের আনন্দে জলেকেলি করে যখন সাইক্লোন সেন্টারে ভেজা লুঙ্গিতে গামছা কাঁধে এসে পৌঁছালাম তখন দেখি আমার দুই মহান অভিভাবক ধপ করে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে নিলেন। বিষয়টা না বুঝেই অকপটে অপরাধ স্বীকার করে নিলাম― ক্ষ্যাপাদের ক্ষেপাতে নাই।
জানতে পারলাম মিঠা-পানির এই পুকুরে বনের ডোরাকাটা মামা, সন্তান-সন্ততি নিয়ে ডোরাকাটা মামি, এনারা সকলে তেষ্টা মেটাতে আসেন। এই সময় একটা অর্বাচীন যদি তাদের সামনে পড়ে যায় তাহলে কি তাদের গায়ে শিহরণ দেবে না―তা কী হয়! আমি যে সময় জলে সন্তরণ করছিলাম সেটা নাকি তাদের তেষ্টা মেটানোর উপযুক্ত সময়। ব্যাপারটা লোমহর্ষক―জানলে কী আর আমি যেতাম! লোমহর্ষক বিষয়গুলোকে সমীহ করা কর্তব্য।
রুমে ঢুকে কাপড় পালটাচ্ছি এমন সময় ইনাম ভাইয়ের অসন্তুষ্ট গলার স্বর কানে ঝনঝন করল। এবার আমি তো কুশীলব নই, অন্য কেউ। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে দেখি ইনাম ভাই কড়া স্বরে নির্দেশ দিচ্ছেন, ওটাকে এখনি যেখান থেকে ধরেছেন সেখানে ছেড়ে দিয়ে আসেন।
বিষয়টা হচ্ছে―কেউ একজন শঙ্খচূড়ের দুই-হাত লম্বা একটা শিশু-সাপ ধরে এনেছে বনের ভিতর থেকে। এই শঙ্খচূড় হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিষধর সাপ। দুই বন বিশেষজ্ঞ দেখেই ওর বেহাল অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। পরে রাতে এসে জানতে পারলাম আমরা বনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার অব্যবহিত পরেই বিষাক্ত সাপটি নির্জীব হয়ে পড়ে। তার বিচরণক্ষেত্রে তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার অবকাশ দেয়নি। মনে পড়ে ইনাম ভাই খুব আফসোস করেছিলেন।
সকালের নাস্তা চলে এল। সেই সাত সকালে গরম গরম মোটা চালের-ডালের খিচুরি। থালায় চাল তো যথেষ্টই ছিল কিন্তু চালের সঙ্গে মেশানো পাতের ডালগুলো গোনা যাচ্ছিল। আর কিছুই না―না কাঁচামরিচ, না পেঁয়াজ―কিছুই না। তাতে কী ? তাতেই তৃপ্তি!
খেতেই খেতেই জানলাম মাঝি নৌকা নিয়ে এসেছে। দ্রুত আহার শেষ করে যে যার পানি আর শুকনা কিছু খাবার নিয়ে নৌকায় গিয়ে উঠলাম। বৈঠা ঠেলা, ছোট্ট ছই তোলা কোশা নৌকা। ইনাম ভাই সোজা গিয়ে গলুই দখল করলেন। আমারও ইচ্ছা ছিল নৌকার গলুই দখল করে বসার কিন্তু ইচ্ছাটা জানানোর সাহস হয়নি। জানি না ইচ্ছাটা প্রকাশ করলে ইনাম ভাই আমাকে গলুইয়ে বসার সুযোগ দিতেন কি না। দিতেন না মনে হয়। অঘটন ঘটার ভয় দেখিয়ে নিশ্চয়ই আমাকে নিবৃত্ত করতেন। বেশি বড় না, ছোট্ট সে তরী। মাঝি বিশ কি বাইশ বছর বয়সী তাগড়া যুবক। তার মধ্যেও উন্মাদনা আমরা লক্ষ করেছিলাম। সদ্য অবসরে যাওয়া উইং কমান্ডার ইনাম ভাই জল থলথল নদীর বুকে নৌকার কাণ্ডারি। তিনি যেমন যেমন নির্দেশ দেন আমাদের মাঝি মনের হরষে তার নির্দেশ মেনে বৈঠা বায়।
আমাদের পানির আয়োজন দেখে মাঝি বলল, এখানে তো ফরেস্টের একটা চাপকল আছে, সেখানে মিঠা পানি পাওয়া যায়। ইনাম ভাইয়ের নির্দেশে প্রথমেই চাপকলের দিকে আমরা রওয়ানা দিলাম। সুন্দরবনের ভিতরে এমন মিষ্ট সুস্বাদু পানি পাওয়া একটা বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল। আমরা প্রত্যহ প্রথমেই সেই মিষ্ট পানি সংগ্রহ করে বনের এককানি দুকানি খালে খালে ঘুরে বেড়াতাম। তবে নৌকা খালের ভেতরে ঢোকার আগেই ইনাম ভাই আমাকে সাবধান করে দিতেন আমার যেন চাপা উচ্ছ্বাস কিংবা ফিসফিসানি সব বন্ধ থাকে। তারপর একসময় তিনি নিজেই টুকটাক কথা শুরু করতেন, এটা ওটা চেনাতেন, জানাতেন। তখন বুঝতাম― এইবার কথা বলা যাবে।
দুই দিন নাকি তিন দিন হলো এককানি দুকানি খালে খালে ঘুরে বেড়াই কিন্তু আমাকে পাড়ে নামতে দেওয়া হয় না। খালের ভেতর তো ফিসফিসও করা নিষেধ। ফিসফিসানি শুনে পাখি হয়ে যাবে পগার পার আর ইনাম ভাই ছবি তুলতে না পারলে তাঁর এত পরিশ্রম বৃথা যাবে। একদিন এক খালে ঢুকেই ইনাম ভাই পেছন ফিরে সাবধান করে দিলেন। তারপর মাঝিকে ভাটার খালে লগি ঠেলে এগিয়ে যেতে বললেন। যেমন নির্দেশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন কাঁপিয়ে একটা পাখির ডাক শুনতে পেলাম। ধনেশ পাখি। আকারে তার ঠোঁটের তুলনায় বেশি বড় না। উড়ে গেল ডান পাশের বনের ভেতর দিয়ে। ইনাম ভাই পাখির পেছনে ধাওয়া করলেন। নৌকা থেকে নেমে বুট পরে পড়িমরি করে কাদায় হেঁটে হেঁটে দামি জুমলেন্স দিয়ে ছবি তুললেন। তৃপ্তও হলেন মনে হলো।
এই সুযোগে আমি খসরু ভাইকে পটিয়ে পাড়ে ওঠার জন্য নৌকা থেকে নিচে নামলাম। হুড়ুত করে একটা পা হাঁটু পর্যন্ত মাখনের মতো কাদায় তলিয়ে গেল। টাল সামলাতে দ্বিতীয় পা-টাও কাদায় ডুবিয়ে দিলাম। একটু আলোড়ন হয়েছিল। ইনাম ভাই পেছন ফিরে নৌকায় ওঠার জন্য ইশারা করছেন। এই সময় তাঁর দিকে তাকানো মানে আমার আর পাড়ে ওঠা হবে না। তা কী হয়―তাকাবোই না, যাহ!
পা তো আর কাদা থেকে তুলতে পারি না। পা তুলতে গেলে কেডস তলায় আটকে থাকছেÑযন্ত্রণা তো। দুত্তরি ছাই! কেডস ছাড়াই পা তুললাম, পরে হাত দিয়ে টেনে কেডস তুলে নৌকায় রেখে পাড়ের দিকে হাঁটতে লাগলাম। খসরু ভাই আমাকে নিবৃত্ত না করতে পেরে পেছন নিলেন। তাঁর ভয় ছিল আমি যদি বনের ভেতর ঢুকে পড়ি!
পাড়টা বেশ খাঁড়া। কাদা ঠেলে সমতলে ওঠা সহজ নয়। আমার সামনে একটা গাছ দেখতে পেলাম। ভাবলাম গাছের একটা শুকনা ডাল ধরে উপরে উঠব। অদূরে ইনাম ভাই আমার দিকে চেয়ে আছেন―কৌতূহল নিয়ে নয়, চোখে ভীষণ আগুন নিয়ে। সে আগুনে যে-কেউ নির্ঘাত পুড়ে যেত―আমি পুড়েছি তো!
উপরে উঠতে গিয়ে শুকনা ডালটা মট করে ভেঙ্গে গেল। ভাবলাম, যাকগে শুকনা ডালই তো ভেঙ্গেছে কাঁচা ডাল তো আর ভাঙ্গিনি। উপরে উঠে দেখলাম থেকে থেকে বড় বড় ঘাসের থোক। খসরু ভাইও উঠে এসেছেন। বললাম, চলেন একটু ভেতরে যাই। তিনি বললেন, পাগল নাকি!
আমি তো পাগলই। বিশ গজের মতো একা একা ভেতরে ঢুকলাম। ব্যস ওইটুকুই। পা আর এগোলই না। মনে হলো মাটি যেন চুম্বকের মতো পা দুটা ধরে রেখেছে। দ্রুত ফিরে এলাম। খসরু ভাইয়ের ধড়ে প্রাণ যেন ফিরে এল। খালে নেমে নৌকায় গিয়ে উঠলাম।
আমরা সকালে খিচুরি খেয়ে অভিযানে নামতাম। তখন জোয়ার আসত আবার সন্ধ্যায় যখন জোয়ার আসত আমরা আস্তানায় ফিরে খিচুরি খেতাম। সারাদিন নৌকায় নৌকায় দু একটা বিস্কিট খেয়ে পানি খেতাম। সেদিন ইনাম ভাইকে কিছু খাওয়াতে পারিনি। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিলেন। তাঁর প্রচণ্ড অভিমানের কারণ আমি নিরূপণই করতে পারলাম না। তিনি শিরদাঁড়া খাড়া করে গলুয়ের উপর বসে বসে ছবি তুলতে লাগলেন। একটি মানুষ এমনভাবে শিরদাঁড়া খাড়া করে দীর্ঘক্ষণ কীভাবে বসে থাকতে পারে ? আমার জীবনে আর একজন নারীকে দেখেছি যার শিরদাঁড়া চেয়ারে হেলান দেওয়া কাঠের মতো সর্বক্ষণ লম্বমান থাকত।
ইতোমধ্যে তাঁকে স্বাভাবিক করার জন্য অনেকবার ক্ষমা চেয়েছি। ক্ষমা পাইনি। চুপচাপ খিচুরি খেলাম। খাওয়ার পর বিস্তৃত বারান্দার ধার ঘেঁষে তিনি বসলেন। নিরাসক্ত মানুষ ইনাম ভাই। মাছ-মাংস খান না, পান-সিগারেট-মদ কিছুর প্রতিই তাঁর দুর্বলতা নাই। তথাপি বেহায়ার মতো আবার তাঁর সামনে চেয়ার নিয়ে গিয়ে বসলাম। তিনি একটু নড়ে উঠলেন। ক্ষমা চাইলাম। আশ্বস্ত করলাম আর অবাধ্য হবো না। এবার তিনি মুখ খুললেন, আপনি ডালটা ভাঙলেন কেন ? আমি আপনাকে নিষেধ করছিলাম, ইশারা করছিলাম ডালটা ছেড়ে দিতে তারপরও আপনি ডালটা ভেঙ্গে ফেললেন।
যাক! ক্ষমা পেয়েছি ভেবে স্পর্ধা বেড়ে গেল। প্রগল্ভ হলাম। বললাম, আমি তো জ্যান্ত ডাল ভাঙ্গিনি। ওটা তো মরা ডাল ছিল।
এইজন্য তো রাগ করেছি। কাঁচা ডাল ভাঙলে তো কিছু বলতাম না।
পাগলের প্রলাপ! বললাম, এটা কেমন কথা।
পাখি বিশারদ তো শুধু নন, পাখিপ্রেমীও বটে, বুঝিয়ে বললেন রাগের কারণ। এ-বিষয়ে জ্ঞান তো আমার সীমিত। কাঁচা ডালে পোকা বাসা বাঁধে না। আমি পাখির খাদ্য নষ্ট করেছিলাম―সত্যি তো, আমি অপরাধী।
প্ল্যান হলো পচাব্দী গাজীর সঙ্গে দেখা করতে যাব। আমার তো মতামতের কোনও মূল্য নাই। তাঁরা দুজন মিলে কোনদিন কোথায় যাব, ঠিক করেন। আমি হই হই করে তাঁদের পিছু নিই। আমি আমার মতো আনন্দ করি, রোদে পুড়ি, নদীর পানি গায়ে দিয়ে শীতল হওয়ার চেষ্টা করি। উটপটাং প্রশ্ন করে, কথা বলে তাঁদের কখনও আনন্দ দিই তো কখনও বিব্রত করি। তবে ইনাম ভাইকে তাঁর ছবি তোলার ব্যাঘাত না ঘটিয়ে অবসরে প্রশ্ন করলে তিনি খুব বুঝিয়ে উত্তর দিতেন। আর খসরু ভাই তো আমার একান্ত মনের মানুষ―অনেক সুখ-দুঃখের স্মৃতি আছে আমাদের।

পরের দিন যথারীতি নৌকায় চেপে বসলাম। নৌকা এক জায়গায় নামিয়ে দিয়ে বলল, এখান থেকেই ‘দশ নম্বর সোরা’, গাজীর বাড়িতে পাঁয়ে হেঁটে যাওয়া যাবে। সে সেখানেই আমাদের অপেক্ষা করবে। আমরা যেন পচাব্দীর সঙ্গে দেখা করে সেখানেই ফিরে আসি।
পাড়ে উঠলাম, বাঁধ দেওয়া পথ পেরিয়ে গ্রামে ঢুকলাম। একটা দোকানে জিজ্ঞেস করা হলো। বলল দু ক্রোশ যেতে হবে। হাঁটছি তো হাঁটছি। এবড়োখেবড়ো শুকনা মাটি পেরোতে পায়ের অবস্থা শোচনীয়। এর মধ্যে এক পশলা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে সবাইকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। আমরা হাঁটছি…
ওই যে দুটা তালগাছ দেখা যাচ্ছে সেখানেই পচাব্দী থাকেন। যাক, নিশানা তো একটা পাওয়া গেল। আচ্ছা দু ক্রোশ দূরত্বের হিসাব কেউ জানেন ? গ্রামের একটা সনাতনী হিসাবের প্রচলন আছে ‘দু ক্রোশ’। এই দু ক্রোশের পাল্লায় পড়েছিলাম সেদিন আমি। হাঁটছি তো হাঁটছি―তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে আমাদের হাতছানি দিচ্ছে। দূরত্ব কমে না। আমরা যতই এগিয়ে যাই ওটা মনে হয় মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ততই পেছনে সরে যায়।
একসময় পচাব্দী গাজীর উঠানে গিয়ে উঠলাম। তিনি বাসায় নাই―তিনি তো ফরেস্টে চাকরি করেন, সেখানে তাঁকে পাওয়া যাবে।
কত দূরে ? এই তো দু ক্রোশ হবে!
আমি বলি, ভাই মাফ করে দেন দু ক্রোশ হাঁটার শক্তি আমার নাই―পচাব্দী গাজীকে আমার সালাম।
ইনাম ভাই বললেন, চলেন সেখানে ফরেস্টের বোট বা নৌকায় ফেরা যাবে। কী আর করা। উপায়ও তো নাই―পচাব্দী গাজী আমরা আসছি!
অবশ্য এবার দু ক্রোশ বোধহয় যথার্থ দূরত্ব ছিল। গাজীর বড় ছেলের সঙ্গে খোলপেটুয়া নদী পার হয়ে বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জ অফিসে ফরেস্টের বোট দিয়ে নদী পেরিয়ে অফিসে গেলাম। পচাব্দী অসুস্থ, ঘুমাচ্ছেন। উইং কমান্ডার দেখা করতে এসেছেন। তিনি কী আর ঘুমাতে পারেন। তিনি এসে আমার চেয়ারের পেছনে দাঁড়ালেন। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, বসা অবস্থায় আমার মাথা সমান। আরে বলে কী!
খসরু ভাই আমাকে একবার একটি কাহিনি বলেছিলেন। তাঁরা তিন কী চারজন একটা বাদা পেরোচ্ছিলেন। এমন সময় বাঘ মামা বোধহয় মস্করা করে হালুম হালুম ডাক ছুড়লেন। মামার ডাক শুনে মুহূর্তের অবকাশে কে যে কোথায় গেল খসরু ভাই বলতে পারবেন না। তিনি সামনের একটা ছোট গর্তে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। তারপর কতক্ষণ যে আর মাথা তোলেননি, সেটা আর বলতে পারেননি।
মামার ডাকে এই গাজীর প্রাণবায়ু তো ঊর্ধ্বে পালানোর কথা! ইনি বলে ৬৪-৬৫টা মানু খেকো বাঘ মেরেছেন। গাজী সাহেব যে কী সরল, নরম মনের মানুষ ছিলেন। তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়ে পথের কষ্ট সব ভুলে গিয়েছিলাম আমরা। তাঁকে আমরা ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। চিকিৎসা করানোর জন্য। কিন্তু তাঁকে আমি আর পাইনি। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন শুনেছিলাম―ইনাম ভাইয়ের আমন্ত্রণে, হার্টের চিকিৎসার জন্য।
এমনি একদিন আস্তানায় ফেরার সময় খাসিটানা খালের ভেতর কাঁকড়া শিকারির কাছ থেকে একেকটা থাবার সমান তিনটা কাঁকড়া দেড় শ টাকায় কিনে ফিরলাম। আমার আর খসরু ভাইয়ের নিয়ত খারাপ ছিল। আমাদের কাছে একটা ১০০ চরঢ়বৎং ঝপড়ঃপয ডযরংশু-এর রঙিন বোতল ছিল। নৌকার মাঝি আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, যে, সে কাঁকড়াগুলো বাসা থেকে রান্না করে এনে খাওয়াবে।
খিচুরি খেয়ে সামনে সুরা নিয়ে কতক্ষণ আর অপেক্ষা করা যায়। বোতল উন্মুক্ত করলাম। ইনাম ভাইকে সাধাসাধি করলাম। লাভ হলো না। তিনি সুরা পান করেন না। অবিশ্বাস্য! অবাক হলাম। অগত্যা আমরা দুজন চিয়ার্স করলাম―আমি আর খসরু ভাই।
কিছুক্ষণ বাদে মাঝিকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসতে দেখে পুলকিত হলাম। কিন্তু এ কি! তার হাতে কোনও পাত্র নাই। মেজাজ বিগড়ানোর আগে সে সামনে এসে ছোট টিফিন বাক্সের একটা বাটি সামনে রাখল। বাটিটা না খুলেই জানতে চাইলাম, এটুকুই ? সে সম্মতি জানালো। তারপর চলে গেল। আমি বাটি খুলে দেখলাম ভেতরে সবুজ রঙের হালুয়ার মতো কিছু বস্তু। দু আঙ্গুলের ফাঁকে একটু তুলে মুখে দিলাম। ভর্তার মতো অত্যন্ত সুস্বাদু বস্তুটি মুখে দিয়ে খসরু ভাইকে এগিয়ে দিলাম। তিনি মুখে পুরে আহ উহ করা শুরু করলেন। ঝাল! ভীষণ ঝাল। খসরু ভাই একটু একটু করে দু-একবার মুখে নিয়ে আর খেতে রাজি হলেন না। অবশিষ্টটা আমার ভাগে রয়ে গেল। এত সুস্বাদু কাঁকড়ার রান্না দেশে বিদেশে কোথাও আর দ্বিতীয়বার পাইনি।
আমরা যেখানে অবস্থান করছিলাম তার থেকে দুবলার চর অনেক দূরে ছিল। ইনাম ভাই আমার দাবি মেনে নিয়ে সেখানে যেতে সম্মত হলেন। পরের দিন সকালে ইঞ্জিন নৌকায় একজন গাইড, বিশেষজ্ঞদের পূর্ব পরিচিত দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে সঙ্গে নিয়ে মহা উৎসাহে রওয়ানা দিলাম। এই নদী সেই নদী দিয়ে আমাদের নৌকা সাঁতরে এগিয়ে যেতে থাকল। কী অদ্ভুত সুন্দর সব নদীর নাম, কিন্তু অত নাম এখন আর মনে নাই। আমি আর খসরু ভাই ছৈয়ের ভেতর শুয়ে বসে ছটফট করতে লাগলাম। আর ইনাম ভাই যথারীতি গলুইয়ে শিরদাঁড়া খাড়া করে বসে আছেন। দুরবিন চোখে দেন, কখনও তো ক্যামেরা তুলে উড়ন্ত পাখিদের ছবি তোলেন। একসময় তিনি পেছন ফিরে জিজ্ঞাসু স্বরে দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডলের কাছে জানতে চাইলেন, বৃষ্টি হবে নাকি!
ইঞ্জিন বোট তখন ‘বল’ নদী পার হচ্ছে। গাইড রোদের তাপ থেকে বাঁচার জন্য লম্বা ডাঁটঅলা বয়সের ভারে ন্যূব্জ ছাতি বন্ধ করে আকাশের এ-মাথা সে-মাথা পর্যবেক্ষণ করে বললেন, মনে হয়।
দিগন্তজোড়া আকাশ তখন মেঘমুক্ত নীলে নীল। শুধু পশ্চিমের দূর প্রান্তে একখণ্ড ধূসর মেঘ থমকে আছে।
গাইডের সায়সূচক কথা শুনে খসরু ভাইকে বললাম, দুটাই পাগল!
খসরু ভাই ‘চুপ’ বলে মিহি ধমক দিয়ে বললেন, আপনি সুন্দরবন সম্পর্কে কিছু জানেন ?
তা তো জানি না।
শাসালেন, ইনাম ভাই শুনলে আবার কিন্তু মাফ চাইতে হবে আপনাকে।
দু-চার-পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে সামনে আর একটা নদী দেখতে পেলাম। গাইড বললেন ওই নদী পেরোলেই দুবলার চর।
মাঝি পরামর্শ করল গাইডের সঙ্গে। কীভাবে নদী পাড়ি দেবে। সরাসরি নাকি বামে বাঁক নিয়ে মোহানা পেরিয়ে― তারপর ওপারের আর একটা নদীতে যাবে। তারপর সেটা পাড়ি দেবে দুবলার চরে যাওয়ার জন্য। গাইড সাহেব মাঝিকে বাঁয়ে চলে যেতে বললেন। সেই মতো মাঝি বাঁক নিয়ে কিছুদূর গিয়ে বড় নদীটি পাড়ি দেওয়া শুরু করল।
আমরা যখন নদীর মাঝখানে তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। ঢেউ ফুলে উঠল। আমাদের নৌকা বড় নদী পেরিয়ে শাখা নদীতে গিয়ে পড়ল। আমরা তখন দুবলার চরের পুব দিকে, নদীর ওই পাড়ে দুবলার চর।
নদীতে ঢেউ ফুঁসে উঠেছে। ঢেউয়ের বাড়ি থেকে নৌকাটা বাঁচানোর জন্য একটা এককানি খালে ঢুকল। পাড়ের গাছগুলো শিকড়বাকড় বের করে বাতাসে মাতলামি করছে। কোন সময় জানি উপুড় হয়ে পড়ে নৌকায়। আবার লগি ঠেলে নদীতে আসল নৌকা। কিন্তু নদী পাড়ি দিতে একটু মিনমিন করল। আমি তাকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করলাম। খসরু ভাইয়ের ঘোর আপত্তি―নদী পার করা যাবে না। ইনাম ভাই জিজ্ঞেস করলেন, লাইফ জ্যাকেট এনেছেন। তাঁর কথায় আমি তো বেকুব বনে গেলাম।
আমাদের দুবলার চরে যাওয়া হয়নি। আমরা যে পথে এসেছিলাম তার বিপরীতে ঘুর পথ বেয়ে ফেরা আরম্ভ করলাম। ফেরার পথে ইনাম ভাইয়ের দুরবিন দিয়ে একটা মাথা উঁচু করা পাতাবিহীন নেড়া গাছের মাথায় বাংলার সর্ববৃহৎ পাখি, মদনটাক দেখলাম। আরও একটা পাখি দেখেছিলাম― শিকরা, ইনাম ভাইই চিনিয়েছিলেন। পাখিটি বেশি বড় নয়। উড়ন্ত অবস্থায় অন্য পাখিদের শিকার করে। আমাদের মাথার উপর থেকে নিজের আকারের প্রায় একটা টিয়াকে ধরে উড়ে নদীর ওপাড়ে চলে গেল।
আমি ডবল টেইল ড্রঙ্গো দেখেছি। কুমির, উদ, শূকর, হরিণ দেখেছি। বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছি। বড় বড় ঘাস আর গোলপাতার সৌন্দর্য দেখেছি। দু চোখ ভরে নির্জন নিবিড় সবুজ বন দেখেছি। রাতের তারা-ভরা আকাশ দেখেছি। আর দেখেছি হতবাক করা জোয়ার-ভাটার খেলা।
পরের দিন আমরা যখন খুলনার দিকে ফেরত আসছি তখন লোকজন, ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ ছোট-বড় লঞ্চে হই-হুল্লোড় করে হিরণ পয়েন্টের দিকে যাচ্ছে। কারণ হিরণ পয়েন্ট থেকে সূর্য গ্রহণ দেখবে―সেখান থেকেই সবচেয়ে ভালো সোলেমান রিং দেখা যাবে। তথ্যটা জেনে মনটা চুপসে গেল।
ফিরতি পথে ইনাম ভাই নতুন পরিকল্পনা করেছিলেন। ঢাকা থেকে আমরা হেঁটে হেঁটে সিলেট যাব―বিভিন্ন গ্রামে থাকব, নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হব, তাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করব। গ্রামে গ্রামে অজানা বাড়িতে রাত কাটাব। পাখির ছবি তুলবেন ইনাম ভাই আর আমরা দু চোখ ভরে বাংলা মায়ের রূপ দেখব। কিন্তু সে পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন হয়নি।
পরবর্তী সময়ে খসরু ভাইকে রাজি করাতে পারিনি। আমাদের আর পদব্রজে সিলেট যাওয়া হয়নি।
দুই পাগলে কি আর মেলা জমে!
লেখক : কথাশিল্পী