আর্কাইভকবিতা

গুচ্ছকবিতা : তপন বাগচী

জিদ

জন্মসূত্রে লাভ করা কিছু সুপ্ত জিদ

তোমাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে রোজ কুমারের চোরাস্রোতে

বোঝো নাই, ছিল কিনা অন্তরের নিবিড় তাগিদ

অহঙ্কার মেখে নিয়ে মেতে আছো পৌরাণিক ব্রতে।

উপাস্য তোমার কে যে, সাকার কি নিরাকার, জটে

ডুবে হও একাকার, সঙ্গী হয় নিত্য হাহাকার

শুকোতে দিও না ফুল, কিছু জল রেখে দিও ঘটে।

মস্তকে অমৃত বারি, কজনের ভাগ্যে জোটে আর!

কিছু জিদ থাকা ভালো, কিছু জিদ নিজে দিও বাতাসে পুড়িয়ে

হয়তো বা সুখ পাবে, জীবনের কাছে জিতে গিয়ে।

—————-

বশ

পৃথিবীটা কার বশ ? পৃথিবী টাকার বশ শুনি

এই টাকা কার হাতে, কে ঘুমায় টাকার শয্যায়

তার নামে ধ্বনি তুলি, তুলে ধরি মাথার ওপরে

শ্রুতি বলে―সে হয় রাবণ জানি যে যায় লঙ্কায়!

কেউ কারও বশ নয়, কেউ কেউ হতে চায় ‘বস’

নিজেই নিজের বশ হয়ে আছি আকৈশোর একা

কখনও-বা কারও বশ হতে চাই তীব্র ভালোবেসে

কেবলি বিফল সব, জেগে থাকে শুধু শ্রুতিলেখা।

কী হবে বশ্যতা মেনে, কী হবে খবরদারি শুনে

সময়ের চাকা ঘোরে অনুক্ষণ নিজস্ব নিয়মে

ঘড়ি কি কখনও থামে কারও কোনও হাতের তুড়িতে

দুনিয়া দমের খেলা, মরা-বাঁচা সে-ও দমে দমে।

——————-

উঁচুপাড়া

দূর থেকে পাড়াটিকে উঁচু মনে হয়

একটা সামান্য নিচে ঘোরতর বাঁক

তার নিচে নদী ও জঙ্গল

তার নিচে সমতলে ওড়ে সাদা পায়রার ঝাঁক।

ওপাড়ায় বাস করে একজন নবীন সাধক

বক্ষ তার মধুক্ষরা, ভরন্ত দুপুরে

একটু ইশারা পেলে ছুটে যাই সুতীব্র আবেগে

ঢুকে যাই, মিশে যাই, মিলে যাই গূঢ় অন্তঃপুরে।

উঁচুপাড়া ভালো, তার ঊর্ধ্বমুখী অনন্ত দৃষ্টির

কাছে তীব্র নতজানু পৃথিবী অধীর।

——————

কদমবাড়ি

দেখেছি আষাঢ় মাসে ফুটে আছে কদমের থোকা

মেঘাগমপ্রিয় এই বৃক্ষতলে বাজে শুনি কানুর বাঁশরি

তুমি হে বর্ষার দূত, একের ভেতরে মেলা অজস্র ফুলের

তার ঘ্রাণে ঘাটে আসে জল নিতে রাই-সহচরী।

আমি তো কানাই নই, বসি নাই কদমের ডালে

আমার সকল স্মৃতি জমা আছে কদমবাড়িতে।

যে ঘাটে রাধিকা আসে, সে ঘাটেই যমুনার ধারা

আমি শুধু টান পাই পুঁতে রাখা আমার নাড়িতে।

কোথায় হারিয়ে গেছে অদর্শনে কদমের ফুল

তবু সে কদমবাড়ি, প্রিয় নামে বেপথু বেভুল।

——————-

কাশবন

দূর থেকে ঘন দেখা যায়―এমন কাশের বন

কখনও গেলেও কাছে প্রাকৃতিক ঘনত্ব কমে না

প্রবাদকে মিথ্যে করে মাথাটা উঁচিয়ে বনভূমি

উল্লাসে ঘোষণা করে সকলের কাছে কত চেনা!

কাশবনে ফুল ফোটে, শনিবারে গিয়েছি আগ্রহে

সকলেই জানি শুভ্র কাশফুল শরতের শোভা

বহুবর্ষজীবী এই ছনের প্রজাতি অপরূপ

মেঘসঙ্গ পেয়ে শুভ্র ঘাসের নৃত্য মনোলোভা।

আমাকে ডেকেছে কাশবন তার উন্মুক্ত আসরে

বুকের আসন ছেড়ে ছুটে গেছি শিল্পবাসনায়

আমার ঘরের চালে কাশফুল একা শুয়ে থাকে

মেদুর জ্যোছনা রাতে হাত তুলে ডাকে ‘আয় আয়’।

——————-

পাখি

শান্তিরা কোথায় থাকে, এই প্রশ্ন বুকে নিয়ে

অনেক খুঁজেছি আমি শান্তিকেন্দ্রে, সাধুর ডেরায়

আমাকে ফেরায়

এমন বাসনা নিয়ে কেউ কেউ রয়েছে এগিয়ে।

কত শুত চুনোপুটি ধরা পড়ে জালে

কত যে রাঘব বোয়াল পার পেয়ে যায়

শব্দহীন চুমু খাই অশান্তির গালে

কে নেবে পোড়ার দেশে যাবতীয় দায়!

জানি, দেখি, মুখ বুজে থাকি

দু চোখ উন্মুক্ত রাখি দৃষ্টি অপেক্ষায়

যদি ফাঁকে ধরা দেয় পুরাণের পাখি

কিন্তু হায়! যায় উড়ে যায়!!

—————–

সেতু

দাঁড়িয়ে রয়েছো হাতে শক্ত হাত ধরে

এপার-ওপার আজ নিকট অদূর

বন্ধনও দিতে পারে মুক্তির সুস্বাদ

কেবল শুনছি তার পায়ের নূপুর।

রিনিঝিনি বেজে স্রোতের ত্রিধারা

কান পেতে বসে আছি অধরার প্রতি

সেতু মানে হৃদয়ের সনির্বন্ধ প্রেম

জীবনের শুদ্ধ মানে অবিচ্ছিন্ন গতি।

এই তো দরজা খোলা, বেপর্দা জানালা

চক্ষু মুদে উড়ে যেতে পারি দিগি¦দিক

সময়ের কুলুঙ্গীতে ধরে রাখি স্মৃতি

টিপ্পনী কাটছে বসে বিদগ্ধ রসিক।

দুইটি হৃদয় এক―নিয়তির খেলা

দিনের আলোয় দেখা হবে প্রতিবেলা।

——————–

ঘর

ঘর থাকলেই ঘরণী থাকবে

এ-কথা সত্য নয়

যথারীতি ঘর থাকে হিংস্র দানবের

নগরেও কেউ কেউ গড়ে তোলে ছনের ছাউনি

কেউ তাকে ঘর বলে হিসেবে রাখবে

হতে পারে ভিন্ন পরিচয়

মৎস্যের ঘর থাকে―ঘের

ডেরাকেও ঘর বলে মুনি

কেউ কেউ শব্দ দিয়ে নির্মাণ করেছে শব্দঘর

এই ঘরে বাস করে নিরেট অক্ষর।

—————-

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button