
ওদেরকে কসাই বললে ভুল হতে পারে। এর আগে ওরা কোনও গরু-ছাগল জবাই করেছে কি না―তা জানার উপায় না থাকলেও, এখন দেখে ওদেরকে জাত কসাই বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে ওরা এখন কোনও গরু-ছাগলের মাংস কুটছে না, এই মুহূর্তে ওরা একটি সুন্দরী নারীর দেহকে টুকরো টুকরো করছে।
রেল লাইনের পাশে বাস্তুহারা কলোনি। টিন শেডের ছোটখাট বাড়িতে সুমনারা বসবাস করে। সুমনা তার আসল নাম নয়। সুমনার বাবা জহুর রহমান বিছানা ধরা। তিনি নড়াচড়া করতে পারেন না। প্রাকৃতিক কাজকর্মও সারতে হয় বিছনায়। তার বয়স পঞ্চাশোর্ধ যদিও, দেখলে মনে হয় সত্তর-পঁচাত্তর। তিনি রেল লাইনের পাশে ছোট্ট একটা দোকান চালাতেন। দোকানের বিক্রিবাট্টা এবং সুমনার টিউশনির পয়সা মিলিয়ে সংসারটা কোনও রকমে চলত। সুমনার ছোট আরও দুজন ভাইবোন আছে। বোন রুমানা, ভাই আবদুর রহমান এবং জনম দুখিনী মা।
সুমনা কলেজে পড়েছে, তবে উচ্চ মাধ্যমিকের পর আর পড়তে পারেনি। ছোট বোন রুমানা হাই স্কুল পার হয়নি আর আবদুর রহমান পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে এখন দোকানে বসছে। তবে আবদুর রহমান ছোট বিধায় অনেক সময় অনেক কিছু বুঝে উঠতে পারে না। পাড়া-প্রতিবেশীরা বলাবলি করে খুব বেশিদিন লাগবে না আবদুর রহমান চালাক চতুর হয়ে উঠবে। তবে পাড়া-প্রতিবেশীরা সুমনার বাসায় গিয়ে টিউশনি করাটা পছন্দ করে না। কেন পছন্দ করে না এমন কথা উঠলে তারা বলে সুমনা যদি কদাকার বদখত হতো, তবে একটা কথা ছিল কিন্তু সুমনা দেখতে সুশ্রী, দেহে যৌবনের ঢল নেমেছে, যে কোনও সময় যে কোনও অঘটন ঘটে যেতে পারে। তাছাড়া তাদের এমন কোনও বিত্ত-বৈভব নেই যে, মেয়ের কলঙ্ক মোচন করে ভালো ঘর দেখে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে। সুমনার মা পড়শিদের কথা একেবার ফেলে দিতে পারে না, তবে পড়শিদের কথা শুনলে সংসারে চাকা যে অচল হয়ে পড়বে এ নির্মম সত্য সুমনার মা উপলব্ধি করতে পারেন বিধায় মেয়েকে তিনি মানুষের বাসায় বাসায় গিয়ে টিউশনি করতে বাধা দেন না। তবু তিনি মেয়ের মেজাজ যখন ঠান্ডা থাকে তখন ইনিয়েবিনিয়ে বলতে থাকেন, ‘মা রে সাবধানে চলাফেরা করিস, মাইনষে কইলাম নানা কথা কয়।’
সুমনা যখন প্রশ্নবোধক চিহ্ন ছুড়ে দিয়ে মায়ের দিকে তাকায়, তখন মা আরও নরম হয়ে বলতে থাকেন, ‘গরিবের এক আল্লাহ ছাড়া কেউ নাইরে মা। রাত-বিরাতে একলা একলা চলাফেরা করস, খুব ডর লাগেরে মা, পরানডা সারাক্ষণ লাফায় কী জানি কী হয়! গরিবের তো ইজ্জত ছাড়া কিছু নাইরে মা।’
ভাঙা কাঁকই আর আরশিতে মুখ দেখে চুলে আঁচড় দিয়ে সুমনা একটু গভীরভাবে নিঃশ্বাস ফেলে। ঠিকইতো চারদিকে যে সব খবর প্রতিনিয়ত শোনা যায় তার মতো একজন মেয়ে তো যে কোনও সময় বলির পাঁঠা হয়ে যেতে পারে। সুমনা মাকে আশ্বস্ত করে, ‘মাগো তুমি দোয়া করো কিচ্ছু হইব না। যদি একটা চাকুরি পাই তয় টিউশনি ছাইরা দিব।’
টিউশনিতেও বিপদ আছে তা সুমনা ইতিমধ্যে জেনে গেছে। হিলভিউতে যে মেয়েটিকে পড়ায় তার বড়ভাই এবং পিতা দুজনের চোখেই সে রিরংসা দেখতে পেয়েছে। বাপটা যেমন তেমন কিন্তু ছেলেটা কিছুতেই বাধা মানতে চায় না। ইচ্ছে করে বাপ-বেটা দুটোকেই জনমের শিক্ষা দিয়ে দেয় কিন্তু মায়ের অভাবের সংসারের কথা মনে হলে টিউশনিটা হারাবার ভয়ে আর শক্তি পায় না। না হলে বাপ-বেটাকে উচিত শিক্ষা দিত। কিন্তু এ কথা গৃহকর্ত্রীর কাছে ফাঁস করাও যাবে না, তখন তিনি হয়তো সুমনাকে ভুল বুঝে তাড়িয়ে দিতে পারেন। আর একটা টিউশনি চলে গেলে আরেকটা টিউশনি জোগাড় করা কী যে কষ্টসাধ্য ব্যাপার তা সে ছাড়া অন্য কেউ জানে না। নতুন করে আরেকটা টিউশনিতে সমস্যা শুরু হয়েছে; ছাত্রের দাদু, নাতনি নাতনি ডেকে গায়ে হাত দিতে শুরু করেছে। এই বৃদ্ধের চোখেও সে পড়েছে। এই ধরনের অনেক কষ্ট তার মনকে বিষিয়ে তোলে। তখন সুমনা কত কিছু ভাবে। ভাবনা তার শেষ হয় না।
মধ্যরাতে বাস্তুহারা কলোনি কাঁপিয়ে ট্রেন যায়। তার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে যায়, এক একবার ইচ্ছে করে ঐ ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে সকল কষ্টের অবসান ঘটাতে, কিন্তু অসহায় বাবা-মার কথা মনে হলে আর সাহস হয় না। বাবার ঔষধ-পথ্য কেনার পরে চাল-ডাল কেনার পয়সা খুব একটা হাতে থাকে না। সারা মাস খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কীভাবে যে চলে, তা মা-ই ভালো জানে, আর কাপড়-চোপড়ের কথা তো বাদ-ই থাক। সবার লেখাপড়া বন্ধ। আবদুর রহমান তাও যা একটা কাজ করছে কিন্তু রুমানাকে কোনও কাজে লাগানো গেল না। অবশ্য রুমানা চাইছে গার্মেন্টসে চাকুরি নিতে। ঘরের বেড়াগুলোও জীর্ণ হয়ে পড়েছে, এদিক-ওদিক ফেঁসে গেছে। মা বড় বড় ফাঁকফোকরে পলিথিন দিয়ে আটকে দিয়েছেন। ঘরে দুইটা রুম। একটা রুমের নড়বড়ে চৌকিতে বাবা-মা থাকে আর অন্যরুমে ওরা ভাইবোন তিনজন। ছোট্ট একটা চৌকিতে দুজন শোয়ার পর আর জায়গা থাকে না। তখন বাধ্য হয়ে সুমনাকে মেঝেতে নেমে আসতে হয়। মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে শোয়া যায়। তা ছাড়া গরমের দিনে মেঝেতে ঠান্ডা অনুভূত হয়। তবে মশার উপদ্রব বেশি। বাস্তুহারার নোংরা পরিবেশ মশা জন্মানোর উত্তম জায়গা। তা ছাড়া বাস্তুহারা কলোনির নিচে রেল লাইনের পাশে রাস্তার সমান্তরাল ময়লার ড্রেন, ঘিনঘিনে পরিবেশ যে কেউ এলে গা রি রি করে উঠবে। এ যেন যেখানে খাওয়া থাকা সেখানেই মল ত্যাগ করা। এই পরিবেশে মানুষের চিন্তা-চেতনার খুব একটা বিকাশ যে হবে না এটা স্বাভাবিক মেনে নিয়ে সুমনা পাড়া-প্রতিবেশীদের নানা কথা বেমালুম ভুলে যেতে চায়। তার শুধু মাথায় ঘোরে নিজেকে নিরাপত্তার মধ্যে রেখে এই অন্ধগলির ভেতর থেকে একটা সুন্দর পরিবেশে নিজেদের বাসস্থান তুলে নেওয়ার। একদিন এই অসম্ভব কাজটি যে সম্ভব হবে, তা সুমনা মনে মনে টের পায়। রুমানা, আবদুর রহমান একসঙ্গে যখন পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করবে তখন তাদের এই দুর্দিন থাকবে না। এখন ভালোয় ভালোয় আরও দুটো টিউশনি জোগাড় করতে হবে। তাহলে ঐ বুড়ো ভাম আর পিতা-পুত্রের রিরংসার কবল থেকে দূরে সরতে পারবে সে। তা ছাড়া জরুরি ভিত্তিতে একটি চাকরিতে ঢোকা তার জন্য ফরয কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এবার প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা সে যথাযথভাবে সম্পন্ন করেছে। ভাগ্যে থাকলে এই চাকুরিটাও তার হয়ে যেতে পারে। তখন একটি সুন্দর পরিবেশে উঠে যাওয়া তাদের জন্য কোনও ব্যাপার হবে না। আর এই যে বেড়ারঘরটি এটা ভাড়া দিয়ে দেবে। এটুকু ঘর ভাড়া দিলেও এখান থেকে হাজার দুয়েক টাকা আয় হবে। তাছাড়া আবদুর রহমানের দোকানেও ইদানীং ভালো বিক্রি-বাট্টা হচ্ছে। আর রুমানা গার্মেন্টসে চাকুরি নিলে তো কোনও কথাই নেই। কোনও কোনও রাতে সুমনার ঘুম আসে না, কেন আসে না, তা সে বোঝে না কিংবা জেগে থাকার মধ্যেও সে এক ধরনের পুলক অনুভব করে। জেগে জেগে সে অনেক আকাশ কুসুম কাহিনি ফাঁদে আর সেই কাহিনিতে নিজেকে ধুঁকে ধুঁকে কষ্ট দিয়ে অবশেষে বিজয়ী করে আর তখন সুখ সুখ ভাব কল্পনার সুতো বেয়ে আপন হিয়ার ভেতর কুলুক খেলে।
ভাঙা আরশিতে নিজেকে দেখে মাঝে মধ্যে পলক ফেলতে ভুলে গেলে কিংবা ঘরে তৈরি করা অঞ্জনে যখন চোখ রাঙায় তখন এক ধরনের মুগ্ধতা তাকে পেয়ে বসে। সেই মুগ্ধতা সহজে কাটতে চায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত বিকট আওয়াজ তুলে নাজিরহাটগামী ট্রেন না যায়। ট্রেনগুলো যাওয়ার সময় সুমনাকে এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করে নিছক খড়কুটোর মতো। ভূমির ওপর তার অবস্থান খুব যে সংশয়পূর্ণ বা দৃঢ় নয় তা প্রমাণ করে।
সরীসৃপের মতো রাত বেড়ে চলে কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসতে চায় না। কারেন্ট চলে গেছে অনেকক্ষণ তাই অন্ধকারে মশাদের গুঞ্জন ধ্বনি কানের ভেতর তোলপাড় তোলে। লাওয়ারিশ কুকুরগুলো এত বেশি ঘেউ ঘেউ শুরু করেছে, রাত্রির নীরবতা রক্ষা করা দায় হয়ে পড়েছে।
গভীর রাতে কখন দু চোখ লেগে আসে তা নির্ণয় করা না গেলে দুঃস্বপ্নের হাতে নিজেকে সঁপে দিতেই হয়। সে স্বপ্নে ঘুমানোর আগে চিন্তা আর কল্পনার ছায়াপাত ঘটে বলে নিজের উপর সে খুব বিরক্তবোধ করে। আর তিক্ততায় মন বিষিয়ে উঠলে সে এই ভেবে নিজের ভেতর সাহস সঞ্চয় করে যে, শরীর নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করলে তো এ সমাজে টিকে থাকা সম্ভব নয় কিংবা আজকাল মেয়েরা বাইরে অনেক কাজ করছে তারা তো শরীর নিয়ে এত দুশ্চিন্তায় থাকে না। আর যদি দুশ্চিন্তায় থাকত তবে নারীরা বাইরে এত কাজ কিংবা চাকরিবাকরি করতে পারত না। দু-একটা সমস্যা হলে তার সমাধানও করতে হবে। কিন্তু সুমনার দুঃস্বপ্নে যে পিতা-পুত্র ভিলেন হয়ে আসে তাতে তার আত্মরক্ষা কবচ ক্রমশ দুর্বল হয়ে আসে, বলে তার মনে হয়। তবু সুমনা এই সমস্যার বেড়াজাল থেকে পালিয়ে যাবে না বলে নিজেকে দৃঢ় প্রত্যয়ী করে। সেও এই সমাজের মানুষ, তারও সুস্থ সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার আছে।
তারপরেও কথা থেকে যায়, দুঃস্বপ্ন সারাদিন সুমনাকে হায়েনার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে। শেষ বিকেলে যখন টিউশনিতে যাবার সময় হয় তখন অজানা কারণে সুমনার পা সরতে চায় না। অবচেতন মনে হায়েনার রক্তলোলুপ দৃষ্টি তাকে তাড়া করে বেড়ালেও সে তার কর্তব্যকর্মে বেরিয়ে পড়ে। বাস্তুহারার লাইন দিয়ে হাঁটার সময় ছোটবেলার কথা মনে পড়লে তার প্রজাপতির কথা মনে পড়ে যায়। প্রতিদিন তারা এক ঝাঁক মেয়ে ফরেস্ট গেটের ভেতর ঢুকতো রঙিন প্রজাপতি ধরার আশায়। প্রজাপতিদের পেছনে ছুটতে ভালোই লাগত। আর সবুজ ঘাসফড়িঙের ওড়াওড়ি দেখত বন গবেষণাগার উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে। সেইসব ফড়িং ধরার দিন আর প্রজাপতির পেছনে ছোটার দিন রঙিন হয়ে চোখের অদৃশ্য আয়নায় ভাসতে থাকে। আরেকটি ঘটনা তার জীবনে এখনও সে চোখ বুজলেই ছুঁতে পারে। তখন কেবল শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। পৃথিবীটাই থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল তার সামনে। ভাঙা আরশিতে নিজেকে দেখে আর কিছুতেই তৃপ্তি মিটছিল না। কী এক মুগ্ধতা পেয়ে বসেছিল নিজেই জানে না, এখন মনে পড়লে হাসি পায় কিন্তু বালকের অদ্ভুত স্পর্শের অনুরণন মাথার ভেতর নহর বইয়ে দিলে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে যায় সে।
মামুন এখন ঢাকায় পড়ে। সেখানে হাজারও তরুণীর ভিড়ে তার মতো সুমনার কথা একেবারে ভুলে গেছে নাকি মনে রেখেছে বোঝে না সে। না না, তার প্রথম পুরুষ, সেই সব স্মৃতি কখনওই বিস্মৃতি হতে পারে নাÑ এরকম ভাবনা তার ভেতর আবার স্বস্তি ফিরিয়ে আনে। সেদিনের দুপুরে নিঃসঙ্গ খাটে যখন মামুন প্রথম তার শরীরকে আবিষ্কার করেছিল সে অনুভূতির কথা ব্যক্ত করা যায় না, তা শুধু অনুভব করা যায়। মামুনের কথা ভাবতে ভাবতে সে ফরেস্ট গেট পার হচ্ছিল, ঠিক তখন ছেলেগুলোর নোংরা কথার ছুরি তাকে ফালা ফালা করে ফেলে। চার-পাঁচটা ছেলে কালভার্টটার ওপর দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল, পাশ দিয়ে অবনত মস্তকে সুমনা নীরবে যাচ্ছিল, তখনি কথাগুলো তার কানে আসে।
‘ওরে শা-লা, রাম পাছা রে! খাওয়াইতে যায়।’
শরীরটা রাগে বাঁশপাতার মতো তিরতির করে কাঁপতে থাকে, মনে হয় সংলাপদাতার গালে একটা চড় কষিয়ে দেয়। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সংবরণ করে নেয়। এদের বিরুদ্ধে লাগতে যাওয়া বোকামি। কিন্তু মনের ভেতর খুঁতমুত করতে থাকে, এদের কিছু না বললে জ্বালাতন বাড়তেই থাকবে। তবু চলতে হলে এ ধরনের অনেক কিছুই সহ্য করে নিতে হবে। এতসব কথাতেও মনটা শান্ত হয় না। মনে হয় কিছু একটা বলা উচিত ছিল, এমনি এমনি ছেড়ে দেয়া ঠিক হয়নি। গা রি রি করা একটা ভাব নিয়ে শেষ বিকেলে সুমনা টিউশনির দরজায় দাঁড়ায়। কলিংবেলটা দু বার শব্দ করার পর দরজা নিঃশব্দে খুলে যায়।
লোকটা খালি গায়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা থেকে সরে সুমনাকে ঢোকার জায়গা করে দেয়। সুমনা ভেতরে গিয়ে সোজা রিডিং রুমে এসে বসে। পেছনে খুঁট করে দরজা বন্ধ হওয়ার একটা শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে সুমনার ভেতরটা চমকে ওঠে। মনে হয় যেন বাঘের খাঁচার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু সারা বাড়ি নীরব কেন, গৃহকর্ত্রী আর ছেলেমেয়ে এরা কোথায় গেল ? রিডিং রুমের অন্ধকারটা তাড়াতে সুমনা সুইচটা হাতরায়। খুঁজে পেয়ে টিপ দিতেই একটা আলোর বন্যা ঘরের ভেতর প্রবাহিত হয়ে যায়। লোকটা আবার এই রুমে এসে উঁকি দেয়।
‘কী ব্যাপার আংকেল, টিনা নেই।’
সুমনার কণ্ঠটি বুঝি কেঁপে ওঠে। দরজাজুড়ে লোকটার উদোম দেহ পাহাড়ের দোসর আর তাকে মনে হচ্ছে খাঁচায় ধরা হরিণশাবকের মতো। বাঘ বুঝি বহুদিন পরে রক্তমাংসের ঘ্রাণ পেয়েছে। বুকের ভেতর ঢিবঢিব করতে থাকে সুমনার।
‘ওরা সবাই বাইরে গেছে, চলে আসবে। তুমি বসো তোমার সঙ্গে গল্প করি।’
‘না আংকেল আজ উঠি, আমার আরেকটা টিউশনি আছে। অন্যদিন গল্প করব।’
‘আরে ম্যাডাম, কী বলে, অন্যদিন এমন সুযোগ পাওয়া যাবে নাকি! বসো বসো ।’
এই বলে তিনি রিডিং রুমের দরজাও লাগিয়ে দিলেন। এবার সত্যি সত্যি সুমনার সারা শরীর ভূমিকম্পের মতো কাঁপতে শুরু করল।
‘আংকেল প্লিজ আমায় যেতে দিন।’
‘আরে বসো বসো যাবে আর কী!’
একটা হাত ধরে লোকটি আবার তাকে বসিয়ে দেয়। এবার সুমনা লোকটিকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে, ‘আমি কিন্তু আন্টিকে বলে দেব।’
‘তাই নাকি! তোমার আন্টি বিশ্বাস করবে ? বিশ্বাস করবে না। উল্টো তোমাকে দুষবে। বলবে খালি ঘর পেয়ে টাকার লোভে তুমি আমার বিছানায় স্বেচ্ছায় উঠে এসেছো।’
লোকটি ক্রমশ তার জাল গুটিয়ে নিচ্ছে। আস্তে আস্তে শিকার ধরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ভিরু হরিণীর মতো দুরু দুরু বুকে কাঁপছে সুমনা। সকল দুশ্চিন্তা আজই কি ফলতে শুরু করল ?
‘তার চেয়ে দেখো চুপচাপ আমার প্রস্তাব মেনে নাও, আরও দ্বিগুণ টাকা পাবে।’
কী কুক্ষণেই যে আজ মনের নিষেধ সত্ত্বেও বেরুতে গিয়েছিল। নিজেকে দোষারোপ করল সুমনা।
হাতের মুঠোর ভেতর অনেকক্ষণ ফড়ফড় করল প্রজাপতিটা। কিছুতেই ডানা ঝাপটানি বন্ধ হলো না। লোকটা অনেক চেষ্টা আর ঘাম ঝরিয়ে প্রজাপতিটাকে কব্জা করতে চায়। কাজটা অত সহজ নয়। কিন্তু কিছুতেই লোকটি নিস্তার দেবে না। প্রজাপতিটাকে তার প্রাণবায়ু বের না করলে যেন লোকটি স্বস্তি পাবে না। তাই সুন্দর প্রজাপতিটাকে সে ধরে। ছটফটায় তবু। বুভুক্ষের মতো তাকে দেখে। তারপর আস্তে আস্তে বধ করতে থাকে। প্রজাপতির রঙিন ডানা দুটো ফ্যানের বাতাসে ফড়ফড় করতে থাকে।
মামুনের সেই ঘর্মাক্ত মুখখানা জলভরা চোখের আয়নায় টলমল করতে থাকলে, আর বারবার তার কাকুতিভরা মিনতি কানের কাছে অবিরাম বাজতে থাকল। সুমনা রাগ করো না, আমি তোমায় ভালোবাসি, সুমনা আমি তোমায় ভালোবাসি, সু-ম-না-আ-আ-আ……
কানের কাছে মামুনের এসব কথাবার্তা বহুদূর থেকে ভেসে এলে সে নিজেকে সামলে নেয়। শরীর যখন ঘেন্নায় নিজের কাছে উচ্ছিষ্ট মনে হচ্ছিল তখন তাকে উঠতেই হয়, সাহসটা আবার ফিরে এসেছে। বাথরুমে ঢুকে ময়লা পরিষ্কার করে এসে দেখে লোকটা আর বাঘ নেই, চেহারাটা কাঁচুমাচু করে নিরীহ ইঁদুরের মতো করে রেখেছে। প্রতিটা পুরুষই বোধহয় এমন। বীর্যপাতের পরে এমন নিরীহ আর কেন্নো হয়ে যায়। সুমনা পুরুষ সম্পর্কে অনেক কিছু ভাবে।
তার ব্যাগের ভেতরে কিছু টাকা ভরতে ভরতে লোকটা ব্যাকুল কণ্ঠে বলতে থাকে, ‘তাড়াতাড়ি চলে যাও, ওদের আসার সময় হয়ে এল। সুমনা হাসে, তাই নাকি! আমি তো ভাবছি যাব না, ওরা যতক্ষণ না আসে এখানেই থাকব।’
লোকটি হা হা করে ওঠে, ‘কী বলো ওসব! যাও, যাও। প্লিজ আর কথা বাড়িয়ো না, এই নাও আরও টাকা।’
লোকটা আরও কিছু টাকা বের করে। এবার সুমনা একদলা থু থু লোকটার চোখেমুখে নিক্ষেপ করে হিসহিস করে বলে, ‘বেজম্মার বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তা।’
কুৎসিত গালি শুনেও লোকটার কোনও ভাবান্তর হয় না। কেমন ভীতু ভীতু চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাইরের এই জগৎটাকে আজ অন্যরকম মনে হয় সুমনার। ঘিনঘিনে লাগে নিজের কাছে। হঠাৎ তার পৃথিবীটা যেন মেঘে ঢেকে গেছে। মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কেমন করে এ মুখ দেখাবে সে। সংসারের এই কঠিন পথ কীভাবে পাড়ি দেবে ? মনটা খারাপ হয়েই থাকে, মন ভালো করার মতো কোনও কৌশল আপাতত খুঁজে পায় না সে। তাছাড়া শরীরটা দুর্বল বোধ হয়। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাধা দিতে চেয়েছিল, তাই বুঝি নিজের শরীরটা ভূমিতে আর খাড়া রাখতে পারছে না। লোকটার বয়স কত হবে ? পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশ মনে হয়। এর চাইতে বেশি হবে না। গায়ে অসম্ভব শক্তি। যা হোক শরীরটা এখন নোংরা নোংরা মনে হচ্ছে। এই রাতেরবেলা ঘরে গিয়ে গোসলও করতে পারবে না। সবাই সন্দেহ করবে। হুদা সাহেবের বাসা থেকে বের হতেই কারেন্টটা লাফ দিয়ে চলে গেল কিংবা মনে হলো চারপাশে একটা কালোবিড়াল লাফ মেরে বসল। কী হবে আঁধারে ? আঁধার এখন তার ভয় করছে না। বরং মনে হয় পৃথিবীর সকল আলো ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো।
আঁধারে কোনও রকমে হাতড়ে চলতে হয়। ঢালু পথ বেয়ে নামতেই সেগুনগাছের আড়াল থেকে তিনজন লোক বেরিয়ে এল। চিৎকার দেবার কোনও সুযোগই পেল না। ভয়ে সুমনা গোঁ গোঁ শব্দ করতে থাকে। চ্যাংদোলা করে ওকে ওরা কোথায় নিয়ে চলল কিছুই সে বলতে পারল না। লোকগুলো কোনও কথা বলছে না। ওর মুখে কাপড় গুঁজে দিয়েছে। কোনও শব্দ বেরুচ্ছে না। আজকের সারাদিনের ছবিটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। কেউ কল্পনাও করতে পারবে না এই মুহূর্তে সে কতো বিপদে আছে।
আচ্ছা, ওর কাছে তো টাকা-পয়সা নেই, হুদা সাহেব কিছু টাকা ব্যাগে দিয়ে দিয়েছেন। ওগুলো নিয়ে ওরা কি তাকে ছেড়ে দেবে ? কিসের জন্য ওরা তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, বদ মতলব হাসিল করার জন্যে, নাকি অন্য কোনও কারণ আছে। এই মুহূর্তে মাথায় কিছুই ঢুকছে না। তবে টাকা-পয়সার জন্য নয়, নিশ্চয়ই ওরা তাকে রেপ করবে। একজনকে যেখানে বাধা দিতে পারেনি, সেখানে তিনজনকে কী করে বাধা দেবে ? আর বেশি বাড়াবাড়ি করলে ওরা যদি মেরে ফেলে ওকে। তাছাড়া এমনও তো হতে পারে রেপ করার পর ওকে ওরা টুকরো টুকরো করে ফেলে দিল। দেহের টুকরোগুলো জোড়া লাগিয়ে কেউ কোনও দিন তার সন্ধান পাবে না। এমন খবর এখন তো হর-হামেশাই পড়ছে। যা হোক ওদের হাতে মৃত্যুর চাইতে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে তাকে। আর বেঁচে থাকলে একদিন না একদিন ঠিকই প্রতিশোধ নিতে পারবে। অন্ধকারের ভেতর নির্মাণাধীন একটা বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে যুবকত্রয়। যে যুবকটি তাকে কাঁধে নিয়েছে সে বেশ সাবধানে পা ফেলছে। দোতলায় উঠে আবর্জনা সরিয়ে ফ্লোরে জায়গা করে তার ওপর নামিয়ে রাখে ওরা সুমনাকে।
‘তোরা চারপাশটা খেয়াল রাখিস।’ যে যুবকটি কথা বলে উঠল তাকে নিমিষেই সুমনা চিনে ফেলল। হুদা সাহেবের ছেলে রোকন। এরা বাপ-বেটা মিলে কি পেল ওকে। এই ছেলের অনেক সাহস। বাসায় প্রতিনিয়ত জ্বালাতন করত, এটা সেটা ইঙ্গিত দিত আর এখন একেবারে তুলে এনেছে। কী ভয়ংকর! সুমনা ভাবতে পারল না। এখন এই যুবকদের কী করে সামলাবে সে ? সে কথা ভাবতে লাগল। আর সামলাতে হলে প্রথমে তাকে কথা বলতে হবে। আর কথা বলতে হলে তার মুখের বাঁধন উন্মুক্ত করতে হবে। নচেৎ পাগলা ষাঁড়টাকে কিছুতেই থামানো যাবে না। এর মধ্যে চামারটা গায়ে হাত দিতে শুরু করেছে।
সুমনা কিছু বলার চেষ্টা করল কিন্তু গোঙানির শব্দ ছাড়া আর কিছু বের হলো না। দু হাত পেছনে নিয়ে শক্ত করে বাঁধা। কোনওরকম প্রতিরোধ গড়ে তোলাও সম্ভব নয়। এখন কী করবে সে কোনও কিছু ভেবে পেল না। তবে যতক্ষণ শ্বাস আছে ততক্ষণ সে লড়ে যাবে। একটা না একটা উপায় নিশ্চয়ই বেরিয়ে যাবে। একই দিনে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে পিতা-পুত্রের হাতে সে ধর্ষিত হতে চায় না। জ্বলে উঠল পাশের বিল্ডিংগুলোর আলো। সে আলোয় এখানটায়ও বেশ আলোকিত হলো। এবার রোকনের চোখে চোখ পড়ল, আবছা আলোয় সুমনা দেখল ছেলেটির চোখে কামনা কেমন চকচক করছে। তবে এখন সে চোখে বারবার ইঙ্গিত করতে পারল যে, সে কিছু বলতে চায়। জানোয়ারটা তার কথা বুঝল বোধহয়। আস্তে আস্তে মুখের বাঁধন আলগা করতে লাগল আর তখন সে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলল, ‘যদি চিৎকার দেও তইলে ছুরিটা পেটের মধ্যে চালান করে দেব।’
সুমনাও ছেলেটিকে আশ্বস্ত করে যে, সে চিৎকার দেবে না। ছেলেটি এবার তার মুখের ভেতর থেকে কাপড়ের পুটলিটা বের করে নেয়।
তারপর রোকন বলে, ‘কী কইতে চাও কইয়া ফেলাও।’ সুমনার চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছিল কি না বোঝা না গেলেও সারা মুখে একটা ভয়ের ছাপ অজান্তে জেঁকে বসেছিল। রোকন বলল, ‘যাই কও, চোখের পানি আমারে দমাইতে পারব না।’ রোকনের একটা হাত সুমনার গাল ছুঁয়ে থাকে। নরম মখমলের বলের মতো টিপতে থাকে সে।
সুমনা খুব ধীরস্থিরভাবে কথাটা বলে, ‘আজ বিকালে আমি তোমার বাবার বিছানায় শুয়েছি, অবশ্য ইচ্ছায় নয়, অনিচ্ছায়। এরপর তোমার যদি রুচিতে না বাধে তবে আমার বলার কিচ্ছু নাই।’
এবার বোধহয় সুমনার চোখ দিয়ে অশ্রুর ফোয়ারা ছুটল আর রোকনের উদ্ধতভঙ্গির ওপর কে যেন লবণের ছিটা দিয়ে দিল। সে এখন সংশয়ের দোদুল দোলায় দুলছে!
তাই দেখে সুমনা বলল, ‘ভয় নেই আমাকে বেঁধে রেখে তোমার বাবার কাছে জিজ্ঞেস করে এসো। কথা দিচ্ছি আমি পালাব না। আজ বিকালে যখন বাসায় টিনাকে পড়াতে যাই আর তখন তোমার বাবা জোর করে আমাকে বিছানায় তুলে নেয়। আমাকে টাকাও দিয়েছে, ইচ্ছে হলে ব্যাগ খুলে দেখতে পারো।’
মলিন ব্যাগটার দিকে অঙ্গুলি সংকেত করল সুমনা। রোকনের চোখজোড়া ধক ধক করে উঠল, আচমকা সুমনার গালে একটা চড় বসিয়ে রোকন বলল, ‘খানকি মাগি! কথা আর খুঁইজ্যা পাস না। আমার বাপরে নিয়া কুকথা কস ?’
তারপর দীর্ঘক্ষণ কোনও শব্দ শোনা যায় না। লোডশেডিংয়ের বদৌলতে আকাশে চাঁদ ঝলসানো রুটির মতো ঝুলতে থাকে। কেউ হয়তো তখন ভাবতে পারে সুন্দর এই চাঁদটার পৃথিবীতে কী দরকার ছিল। যুবকদের লালসায়, জিহ্বার লোলে তখন মুরগির ভাজা লাল রান দুলতে থাকে। আর যুবকরা চেঁচাতে থাকে, ‘দেখছোস চাঁদ একটা না দুইটা। আজকে ওই চাঁদ দুইটারে কাইট্টা কুচি কুচি কইরা খামু।’
মৃদু আলোতে প্যান্ট-শার্ট পড়া যুবকদের তখন মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হয়, ওরা চাঁদের রক্ত পান করা কতিপয় হায়েনা।
সচিত্রকরণ : রজত



