আর্কাইভগল্প

জাদুবাস্তব গল্প : কে বেশি শক্তিশালী : শাহনাজ মুন্নী

এতদিন পর বাপের বাড়িতে এসেও সঙ্গীতার মন মরা ভাবটা কাটলো না। গাছের বিবর্ণ পাতার মতো কেমন বিমর্ষ হয়ে নেতিয়ে রইল। কারও সাথে ভালো করে কথাও বলল না। তার চিরাচরিত চেঁচামেচি, উচ্চ শব্দে গড়িয়ে পড়া হাসাহাসিও বন্ধ। আমি দুয়েকবার নরম গলায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘মন খারাপ করে কী করবে ? আমাদের তো কিছু করার ছিল না বলো…’

সঙ্গীতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মøান কণ্ঠে বলল, ‘উফ! ভাবলাম কি আর হলো কি ?… আমার এত সাধের ট্যুর প্লান কেমন ভেস্তে গেল! তাছাড়া এতগুলো প্রাণ…’

আমি ওর কথায় চুপ করে থাকি। মনে মনে ভাবি, চিরকাল এমনই তো হয়, মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস।

আসলে সঙ্গীতার অনেক দিনের শখ ছিল পাশের দেশের কাশ্মীরে বেড়তে যাবে। চিরদিন শুনে এসেছে ভূস্বর্গ কাশ্মীর। গুলমার্গ, সোনমার্গ, পহেলগাঁও, গ্লেসিয়ার পয়েন্ট, ডাল লেকে শিকারা ভ্রমণ আরও কত কিছু ইন্টারনেট ঘেটে ঘেটে দেখে একটা দারুণ স্বপ্নছবি মনের মধ্যে গোপনে এঁকে রেখেছে সে। বিয়ের পর হানিমুনের জন্য ওর নাকি মনে মনে প্রথম পছন্দ ছিল কাশ্মীর কিন্তু আমি সে কথা না জেনে ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম আমার প্রিয় জায়গা কক্সবাজারে। নতুন বউ বলে সঙ্গীতা অতো বেশি জোর খাটাতে পারেনি। কিন্তু এখন আমাদের বিয়ের প্রায় এগারো বছর হয়ে  গেছে। সংসারে নয় বছরের মেয়ে শময়িতা যুক্ত হয়েছে। এতদিন নানা ঝামেলায় আমরা সিলেট আর বান্দরবানের বাইরে কোথাও তেমন যেতে পারিনি। এবার সঙ্গীতা গোঁ ধরেছে কাশ্মীর যাবেই যাবে।

সঙ্গীতা আর আমার পাসপোর্টের মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। শময়িতার তো পাসপোর্ট ছিলই না। এবার দৌড়-ঝাপ করে তিনজনের জন্যই ঝকঝকে চকচকে মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট করালাম। সঙ্গীতা মহা উৎসাহে ট্যুর কোম্পানিগুলোর প্যাকেজ ঘাঁটতে শুরু করল। কম খরচে বেশি সুযোগ কোন জায়গায় আছে তাই খোঁজার মধ্যবিত্ত চেষ্টা আর কি!

সঙ্গীতা বলল, এপ্রিল মাসে কাশ্মীর নাকি রঙিন স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। তুষার গলতে শুরু করে, খোলা প্রান্তর আলো করে লক্ষ লক্ষ লাল হলুদ টিউলিপ ফোটে, তাপমাত্রাও থাকে বেশ সহনীয়।  শেষ পর্যন্ত সব দিক বিবেচনা করে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে আমাদের যাওয়ার দিন নির্ধারিত হলো।

নানা হ্যাপা করে ভারতীয় ভিসাও জোগাড় করলাম। ট্যুর কোম্পানি চমৎকার একটা ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজিয়ে দিল। কাশ্মীরের বিভিন্ন লোকেশনে পরে ছবি তুলবে বলে সঙ্গীতা পকেটের দিকে না তাকিযে বেশ দাম দিয়ে ব্র্যান্ডের দোকান থেকে দুটো ফ্যাশানেবল স্কার্ট আর একটা লাল টুকটুকে গাউনও কিনে ফেলল।

আমিও আগেভাগে অফিসে ছুটির জন্য দরখাস্ত মেরে দিলাম। সব কিছু ঠিকঠাক। এতদিনের প্রত্যাশিত স্বপ্নপূরণের সম্ভবনা তৈরি হওয়ায় সঙ্গীতা রীতিমতো উত্তেজিত।

আর মাত্র কয়েকটা দিন, তারপরই আমরা উড়াল দেব।

এমন সময় টেলিভিশনে ব্রেকিং নিউজ হয়ে এল ‘জঙ্গি হামলায় রক্তাক্ত কাশ্মীরের পহেলগাঁও’।

ব্যাস! আমাদের হৃদয়ও একই সাথে রক্তাক্ত প্রান্তরে পরিণত হলো। এতদিনের স্বপ্ন পরিকল্পনা এক ফুয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দেয়ার মতো এক নিমেষে কেউ যেন নিভিয়ে দিল। সঙ্গীতা এমন মুষড়ে পড়ল যেন আকস্মিক টর্নেডোতে ভেঙে পড়া হতভম্ব গাছ।

আমার অফিসের ছুটি আগেই মঞ্জুর হয়ে গিয়েছিল, তাই ভাবলাম কাশ্মীর যখন হচ্ছেই না তখন চন্দনপুর যাই। সঙ্গীতার বাবার বাড়ি মানে আমার শ্বশুরবাড়ি ঘুরে আসি। অন্য সময় বাপের বাড়ি আসার গন্ধ পেলেই চঞ্চল হয়ে উঠত সঙ্গীতা। কতক্ষণে যাবে সে অপেক্ষায় তর সইতো না। বাবার বাড়ির আঙিনায় পা রেখেই সে উৎফুল্ল হয়ে উঠত। হয়ে যেত বিয়ের আগের তেইশ বছর বয়সী আদুরে, দাপুটে তরুণীটি। কিন্তু এবার যেন তার মনের সকল সুর কেটে গেছে, রং গেছে বেরং হয়ে। কিছুতেই তার স্বাভাবিক চেহারাটি ফুটে উঠছে না। সঙ্গীতার এই পরিবর্র্তন সবার চোখেই ধরা পড়ল।

শাশুড়িমা মেয়ের মন ভালো করার জন্য প্রস্তাব দিলেন, ‘চল, গীতু পাথালিয়াতে তোর নানির বাড়ি ঘুরে আসি। মায়ের শরীরটাও বিশেষ ভালো নেই। তোকে দেখতেও চাইছিল।’

এবার যেন একটু উৎসাহ দেখা গেল সঙ্গীতার মধ্যে। পাথালিয়া চন্দনপুরের কাছেই তবে খানিকটা প্রত্যন্ত এলাকায়। দেড় ঘণ্টার বাস যাত্রা। তারপর মাটির রাস্তায় ভ্যানে চেপে পৌঁছাতে মিনিট বিশেক লাগে। আমরা অবশ্য শ্যালকের গাড়িতে চড়েই গেলাম।          

গিয়ে দেখি আমার নানি শাশুড়ি তার মেয়ে আর নাতজামাইসহ নাতনি আসবে শুনে সেদিনই রোগশয্যায়, শোয়া থেকে উঠে বসেছেন। যেন তার অসুস্থতা নিমেষে উধাও হয়ে গেছে। নানিশাশুড়ি এমনিতে খুনখুনে বুড়ি, নব্বইয়ের কোঠায় বয়স। মুখে একটা দাঁতও অবশিষ্ট নেই। পিঠ ধনুকের মতো বেঁকে গেছে, চামড়ায় সহস্র ভাঁজ, ঘসা কাচের মতো ঘোলাটে চোখের মণি কিন্তু জ্ঞান বুদ্ধি এখনও বেশ টনটনে। কণ্ঠস্বরও শুনলাম পরিষ্কার। নানিজান আবার আমাকে খুব আদর করেন।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর উঠানে পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদের নিচে মাদুর বিছিয়ে শালা-শালি পরিবেষ্টিত হয়ে বসলাম। খুব স্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করলাম সঙ্গীতা আবার তার আগের মুডে ফিরে এসেছে। হাসছে, গল্প করছে সবার সঙ্গে। চারপাশে নরম বালিশ সাজিয়ে সেসবের ওপর ভর রেখে ছোট্ট শিশুর মতো নানিজান আরাম করে বসেছেন আমাদের সবার মাঝখানে। খুব শান্তির ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। সঙ্গীতা নানির পাশ ঘেষে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করে বলল, ‘ও নানি, তোমার সেই দুই পালোয়ানের গল্প যেইটা ছোটবেলায় বলতা সেইটা আবার বল না…’

এই প্রস্তাবে সবাই হই হই করে সমর্থন দিল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নানি বলো বলো, কতদিন তোমার মুখে গল্প শুনি না…’  

নানি দেখলাম আপত্তি করলেন না, বরং সবার কাছে গুরুত্ব পেয়ে একটু যেন তাজা হয়ে উঠলেন। বালিশে ঠেস দিয়ে কাত হয়ে আধ শোয়া অবস্থায় কাঁপা কাঁপা গলায় গল্প শুরু করে দিলেন, ‘বাইশ মণ আর তেইশ মণ দুই পালোয়ান। তাদের একেবারে গায়ে গায়ে লাগা বাড়ি। প্রতিবেশী যাকে বলে আর কি! কিন্তু তাদের মধ্যে মোটেও সদ্ভাব নাই। খালি প্রতিযোগিতা আর খালি রেষারেষি। এ বলে, আমার শক্তি বেশি তো ও বলে আমার জোর বেশি! একজন চোঁ চোঁ করে নিমেষে এক পুকুরের পানি খেয়ে ফেললে, আরেকজন এক চুমুকে নদীর সব জল পেটের মধ্যে টেনে নেয়। আবার একজন পথের পাশের বটগাছ তুলে দাঁত মেসওয়াক করে তো অন্যজন অশ্বত্থ গাছ দিয়ে দাঁত খিলাল করতে শুরু করে!’ 

সঙ্গীতার এক মামাতো ভাই সানজিদ টিপ্পনি কেটে বলে, ‘হুম! ওটাও বল, একজনের আছে ৫ হাজার ট্যাংক তো আরেক জনের আছে ৪ হাজার ট্যাংক। তাদের দুইজনের ভান্ডার ভর্তি আরও আছে কামান, যুদ্ধবিমান, জাহাজ, রণতরী, সাবমেরিন, ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র আর শত শত পারমাণবিক বোমা। তাই না নানি ?’

নানি কানে ভালো শুনতে পান না। সানজিদের কথাও বোধ হয় ঠিকমতো শুনতে পেলেন না। তাই ওর টিপ্পনী কাটাকে পাত্তা না দিয়ে তিনি চোখ-মুখ নাচিয়ে তার গল্প বলা চালিয়ে গেলেন, ‘একদিন হলো কি, কে কার চাইতে বেশি শক্তিশালী এই নিয়ে তর্ক জুড়ে দিল দুজন। তারপর শক্তি পরীক্ষার ছুতোয় দুই পালোয়ানে শুরু হলো ভীষণ মারামারি। গায়ের সব শক্তি দিয়ে তারা একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের যুদ্ধে মাটি তো মাটি, দশ গেরামের আকাশ বাতাস পর্যন্ত থরথর করে কাঁপতে শুরু করল!’

সানজিদ বলল, ‘কাঁপবে না ? ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পাশাপাশি ড্রোণ যুদ্ধ শুরু হয়েছে যে! মানুষের আর দরকার নেই, প্রোগ্রাম ঠিক করে দিলে যন্ত্রই গিয়ে একদম জায়গামতো গুচ্ছ গুচ্ছ বোমা ফেলে আসতে পারে! আর ক্ষেপণাস্ত্রের ধাক্কা তো আছেই!’

‘আরও কত রকমের মিসাইল, হাইপারসনিক, ব্যালেস্টিক, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, সেসবের কথাও বলো…’ কলেজ পড়ুয়া পিয়ালি যোগ করল। 

‘এই, তোরা গল্পের মাঝখানে এমন বাগড়া দিচ্ছিস ক্যান, হুম! কিসের সঙ্গে কি মেলাচ্ছিস বলতো ?’

সঙ্গীতা একটু বিরক্ত হয়েই জানতে চাইল।

‘যুদ্ধের সঙ্গে যুদ্ধ মিলাচ্ছি আপা, আর কিছু না! সব যুদ্ধের ছবি তো একই রকম! নানি মাইন্ড করো না, তুমি তোমার গল্প চালিয়ে যাও!’ সানাজিদ বলল।

নানি এবার আরেকটু দম নিয়ে শুরু করল,

‘এদিকে হয়েছে কি, পাশের মাঠেই এক বুড়ি ছাগল চড়াচ্ছিল, একটা দুটো নয়, সোয়া লক্ষ ছাগল…’

‘সোয়া লাখ নয়, শত কোটি বল…’

‘এ্যাঁ…’ নানি সানজিদের ফোঁড়ন কাটার মানে বুঝতে পারেন না। পিয়ালি তখন ভাইয়ের কথা স্পষ্ট করে, ‘হ্যাঁ গো, যখন ওরা দুজন মারামারি করছিল তখন যুদ্ধক্ষেত্রের পাশেই শত কোটি ছাগল নিশ্চিন্তে মাঠে ঘাস খাচ্ছিলো আর জাবর কাটছিল…’

সঙ্গীতা এবার একটু রেগে গিয়ে বলল, ‘গল্পের মাঝখানে তোরা যদি আবার এমন বাঁ হাত ঢোকাস না, তাহলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিচ্ছি! নানি তুমি ওদের কথা শুনো না তো…’

আবার যখন গল্প বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে তখনই নানির ভয়ানক কাশির দমক উঠল। কাশতে কাশতে একেবারে কাবু হয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। চোখে পানি এসে যাচ্ছিল, ফর্সা মুখটা লাল হয়ে যাচ্ছিল। নাতনিরা তার বুক পিঠ চাপড়ে, মালিশ টালিশ করে কাশি থামানোর চেষ্টা করছিল। একজন দৌড়ে গিয়ে এক গেলাস পানি নিয়ে এল। পানি টানি খেয়ে একটু সুস্থির হয়ে, লম্বা করে শ্বাস টেনে নানি আবার তার গল্পের ঝুলি খুললেন। আমরা অবশ্য না করেছিলাম, এই অবস্থায় আর কথা বলার দরকার নেই। কিন্তু নানি নিষেধ শুনলেনই না। আবার বলতে থাকলেন, ‘তো শোন, দুই পালোয়ানের লড়াইয়ের ফলে মাটিতে অনেক জোরে জোরে শব্দ হচ্ছিলো তো, তাই বুড়ির ছাগলগুলো করল কি, ভয় পেয়ে ছোটাছুটি শুরু করল। কয়েকটা তো পালোয়ানদের পায়ের চাপে অক্কা গেল। ছাগলগুলোকে বাঁচানোর জন্য বুড়ি তাড়াতাড়ি সব কটা ছাগল ধরে তার ঝোলার ভেতর ঢুকিয়ে ফেলল।’

আমার মেয়ে শময়িতা এতক্ষণ আমার কোলের কাছে চুপচাপ শুয়ে গল্প শুনছিল, এবার সে সটান উঠে বসল। চোখ বড় বড় করে বলল, ‘সবগুলো ছাগল একটা ঝোলার মধ্যে ? আঁটলো ?’

নানি ফোকলা মুখে হেসে বলল, ‘হ্যাঁগো, সোনা আঁটলো! আর বুড়ি সেই ঝোলা কাঁধে করে সোজা চলে গেল যেখানে দুই পালোয়ান যুদ্ধ করছিল সেখানে। তারপর ধমক দিয়ে বলল, ‘এই, তোরা থামবি কি না বল! তোদের কাজে খুব বিরক্ত লাগছে আমার!’ তা পালোয়ানরা কি আর থামে  ? তাদের কুস্তি চলতেই থাকল! বুড়ি তখন দুই পালোয়ানকে ধরে তার কাঁধে তুলে নিল। বলল, ‘নে এখন যুদ্ধ করতে থাক।’

শময়িতা আরও অবাক। আমার দিকে মাথা ঘুরিয়ে সে জানতে চায়, ‘আব্বু, বুড়ির এত শক্তি ?’

সানজিদ তার মোবাইল ফোন সরিয়ে রেখে বলল, ‘অবাক হয়ো না মামা, বড় মোড়লদের কান্ধে বসেই এখন সব যুদ্ধ হয়! তাদের কাঁধ অনেক শক্ত! বড় হলে তুমি সব বুঝবে!’

আকাশে চাঁদের ওপর এক খণ্ড মেঘ ভেসে যাওয়ায় জোসনার আলো প্রায় নিভে যাচ্ছিল। আমি একবার ঘাড় উঁচিয়ে মেঘটাকে দেখলাম। এই মোবাইল জমানায় নানির দীর্ঘ গল্প শোনার আগ্রহ স্বল্প দৈর্ঘ্যে অভ্যস্ত ছেলেমেয়েদের তেমন ছিল না। অনেকেই উঠে যাওয়ার জন্য উসখুস করছিল, কেউ কেউ নানা ছুতায় উঠেও পড়েছিল। কিন্তু নানি যেন এই গল্প বলার মধ্য দিয়ে আবার তার পুরোনো গৌরবময় দিনগুলোতে ফিরে যেতে চাইছিলেন। যেন, এ জগৎসংসারে এখনও যে তার সঞ্চয়ে বলার মতো কিছু অবশিষ্ট আছে সেই প্রমাণ রাখতে শেষ বয়সে তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

‘তারপর কী হলো শোনো, ওই সময় আকাশে একটা শিকারি পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল। বাঁকা ঠোট, ধারালো নখর, চোখে প্রখর দৃষ্টি তার। তার নজর পড়ল মাঠের ওপর ঝুলি কাধে হাঁটতে থাকা বুড়ির ওপর। এক ছোঁ-য়ে সে বুড়ি, তার কাঁধে যুদ্ধ করতে থাকা দুই পালোয়ান আর সোয়া লাখ ছাগলকে নিজের ঠোঁটে উঠিয়ে সাঁই করে আকাশে উড়ে গেল!’

‘তাহলে তো পাখিটার অনেক শক্তি, তাই না বাবা ?’

মেয়ে আবার ছানাবড়া চোখে জানতে চাইল! আমি বললাম, ‘আগে শোনোই না, গল্পটা!’

আমি যে আগে থেকেই গল্পটা জানি সেটা আর বললাম না। অবশ্য যারা শ্রোতা তাদের মধ্যে শময়িতা ছাড়া বাকি প্রায় সবারই গল্পটা জানা। আমিও আমার দাদির মুখে এই গল্পটা শুনেছিলাম। কবি জসীমউদ্দীন ১৯৬০ সালে বাঙালীর হাসির গল্পের যে সংকলন করেছিলেন সেখানেও গল্পটা আছে।

নানি আবার একটু দম নিয়ে নড়েচড়ে বসলেন। সঙ্গীতা তার কাঁধের নিচে আরও একটা বালিশ গুঁজে দিয়ে বলল, ‘তারপর কী হলো নানু ?’

‘পাখি যখন আকাশে উড়ছে তখন এক রাজকন্যা বসেছিল তার দোতলা বাড়ির ছাদে। বসে বসে সে তার ভেজা চুল শুকাচ্ছিল। আর তখনই হঠাৎ আকাশ থেকে কী যেন একটা টুপ করে তার চোখের ভেতর পড়ল! আসলে সেটা ছিল শিকারি পাখির ঠোঁট থেকে খসে পড়া বুড়ি, তার কাঁধে যুদ্ধ করতে থাকা দুই পালোয়ান আর ঝোলাতে ভরা সোয়া লাখ ছাগল।

রাজকুমারীর তো ভারী অস্বস্তি হলো, সে চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, ‘ধুর, চোখে কী পড়ল ?’ 

নানি রাজকুমারীর মতো তার শীর্ণ ডান হাতে বাঁ চোখ কচলানোর অভিনয় করে দেখান।  শময়িতা এবার বিস্ময়ে প্রশ্ন করতেই ভুলে গেল। আমার মনে হলো আমরা যে ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়ালিজমের কথা বলি তা তো এই শত বছরের পুরোনো লোককাহিনিতেই কী চমৎকারভাবে আছে! 

‘রাজকুমারীর চোখ বলে কথা! সারা রাজ্যে হৈ হৈ পড়ে গেল। কি হলো রাজকুমারীর অতো সুন্দর নীল পদ্মের মতো স্নিগ্ধ চোখে। রাজবৈদ্য তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এলেন কয়েক হাজার দুরবিন আর কয়েকশ আতসকাচ নিয়ে…’

‘দুরবিন না, ওটা অনুবীক্ষণ যন্ত্র হবে…’

কেউ একজন বিজ্ঞের মতো বলে। নানি ওই মন্তব্য উড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘তা সে যাই হোক, ওগুলো দিয়ে হাজার চেষ্টা করেও রাজবৈদ্য চোখের ভেতর কিছুই দেখতে পেলেন না। এদিকে রাজকুমারীর চোখের যন্ত্রণাও কমে না। রাজা অস্থির হয়ে হুকুম দিলেন, ‘এখনই আমার রাজ্যের জেলেদের ডাকো! রাজকুমারীর গভীর সমুদ্রের মতো টলটলে চোখের ভেতর জাল ফেলতে হবে!’

জলধর নামে ওই রাজ্যের এক পাকা জেলে তার আড়াই লক্ষ নাতিপুতি নিয়ে এসে রাজকুমারীর চোখে ঝপাৎ ঝপাৎ জাল ফেলতে শুরু করে দিল। সাত দিন সাত রাত্তির অবিরত সেই জাল ফেলা চললো। চোখের এ কোণ থেকে সে কোণ তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। খুঁজতে খুঁজতে সকলেই যখন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত তখনই হঠাৎ জালের কোনায় কী যেন একটা বাঁধলো। জলধর হ্যাঁচকা টান দিয়ে সেই জাল তুলে দুই হাতে মাটির ওপর দিল ঝাড়া। আর তখনই কী একটা যেন ছিটকে পড়ল জাল থেকে। সবাই গিয়ে দেখল, কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে এক বুড়ি, তার ঝোলাতে ভরা সোয়া লাখ ছাগল আর তখনও তার কাঁধে সমানে যুদ্ধ করে যাচ্ছে দুই পালোয়ান।’

এটুকু বলেই নানি আবার হাঁপিয়ে উঠলেন। শ্বাস নিলেন লম্বা করে। মাথাটা এলিয়ে দিলেন পেছনে স্তূপ করে রাখা বালিশের ওপর। সাদা শাড়িতে প্যাচানো দুর্বল শরীরটাও মাদুরের ওপর প্রায় নেতিয়ে পড়ল। আমরা তার অবস্থা দেখে একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম।    

বড় মামা এসে খানিকটা ধমকের সুরেই বললেন, ‘অনেক গল্প বলা হয়েছে, এবার ঘরে এসে বিশ্রাম করো তো মা! তোমার আবার শরীর খারাপ করবে!’

নানি ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, ‘আরেকটুখানি বাকি আছে!’

‘সেটা আমি বলে দিচ্ছি! তুমি নিশ্চিন্তে ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো!’ সানজিদ বলে।

‘না, না, শোন, আমি বলছি…’ নানি আবার হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে বসেন। তিনি গল্প বলবেনই! যেন এই খোলা আকাশের নিচে মাটির মঞ্চে তিনি একজন পারফর্মার! একজন ধ্রুপদী শিল্পী, যিনি দর্শক-শ্রোতার সামনে অনবদ্য কুশলতায় নিজের শৈল্পিক প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাতে বদ্ধপরিকর।

আমাদের সবার দুশ্চিন্তাকে উড়িয়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে নানি আবার বলতে শুরু করলেন, ‘রাজকুমারীর তো অনেক শান্তি হলো, চোখ থেকে কুটো বের করলে আমাদের যেমন শান্তি হয় তেমন! তো এখন তোরা বল দেখি কার বেশি শক্তি ? কে বড় পালোয়ান ?’

প্রশ্নটা রেখে গল্প শেষ করতে পারার আনন্দে ফোকলা মুখে তৃপ্তির হাসি হাসলেন নানি।

শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো। একজন বলল অবশ্যই রাজকুমারী! একজন বলল, না, জলধর জেলে! কেউ আবার বলল সবচে শক্তি বেশি ওই শিকারি পাখিটির, ওই তো ঠোঁটে করে এত কিছু বয়ে আনলো!

সানজিদ বলল, ‘সবাই থামো, গল্পের শেষ হয়নি, আগে বলো দুই পালোয়ানের যুদ্ধ থামল কীভাবে ? ওরা তো রাজকুমারীর চোখ থেকে বের হয়েও মারামারি বন্ধ করেনি। নিজেদের মধ্যে ঢিসুম ঢুসুম চালিয়েই যাচ্ছিল!’

‘সেটা তুই-ই বল!’ নানি এবার বালিশে গা এলিয়ে বেশ রিল্যাক্স গলায় বলল। তার কণ্ঠে পারফরমেন্স সমাপ্ত করতে পারার আনন্দময় সন্তুষ্টি।

পিয়ালি বলল ‘খুব সোজা। রাজা মশাই দুই পালোয়ানের মাথায় দিলেন দুটি চাটি। সেই চাটি খেয়ে বাইশ মণ আর তেইশ মণ কুপোকাৎ! যুদ্ধও শেষ!’

সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

সানজিদ বলল, ‘আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে দেখা যাবে গল্পের শেষে রাজামশাই দেশবাসীর উদ্দেশে একটা ভাষণ দিচ্ছেন। তিনি অহংকারি গলায় বলছেন, বাইশ আর তেইশের যুদ্ধ আমি একাই থামিয়েছি। আমি শুধু তাদের কানে কানে একটা কথা বলেছি। বলেছি, যুদ্ধ যদি বন্ধ না করো তাহলে দেব সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে। গুষ্টিশুদ্ধ না খেতে পেয়ে মরবে তোমরা। হা হা হা, আমার সেই অব্যর্থ ঔষধে দুই পালোয়ানই ঘায়েল। সুড় সুড় করে যুদ্ধ থামিয়ে তারা নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল। বুড়িও তড়িঘড়ি ঝোলা থেকে ছাগলগুলোকে বের করে মাঠে চড়াতে নিয়ে গেল। এবার তোমরা বলো আসলে শক্তিশালী কে ?’

 সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ   

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button