
গ্রামে গিয়েছিলাম গল্পের সন্ধানে। আমি তো শহরে বড় হওয়া মানুষ। গ্রামের কিছুই চিনি না। তাও যখন গল্প লেখার নেশা পেয়ে বসল, দেখলাম বাংলায় গল্প লিখতে হলে গ্রামে যাওয়া লাগবে। গ্রামে যে আমি একেবারেই যাইনি, তা তো নয়। বহুবারই যেতে হয়েছে। যেতে হয়েছে বলতে, বেড়াতে বা ঘুরতে নয়, গ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। গ্রামের ভেতর দিয়ে না গেলে কোথাও কি যাওয়া যায় ? অবশ্য সেই গ্রাম বলে আজ আর কিছু নেই। আমি বলি ভুল। আমি আর বিভা, তেমন গ্রামই খুঁজে খুঁজে বেড়াই। পেয়েও যাই।
আমি বড় হয়েছি সমুদ্রপাড়ের একটা এলাকায়। এলাকাটার নাম আমি দিলাম লোনাওয়ালা। বাবা তার নিজের কৈশোর শেষ হওয়া রঙচঙে স্বপ্নের দিনগুলি পার হতে না হতেই নাবিক হয়ে চলে গিয়েছিলেন দেশের বাইরে, পশ্চিম পাকিস্তানে। তখন তো দেশ দু খণ্ড। দু খণ্ড থেকে এক খণ্ডে আসতে আগের বারের মতো চেয়ারটেবিলের আলাপে কাজ হলো না। বন্দুক-কামানের বিরুদ্ধে প্রথমে লাঠিসোটা নিয়ে এ দেশের মানুষকে নেমে পড়তে হলো। পড়ে বন্দুকের বিরুদ্ধে বন্দুক গর্জে উঠল। ‘একাত্তরের হাতিয়ার/গর্জে উঠুক আরেকবার’―স্লোগানটা শুনলে আমি সেই দিনগুলিকে দেখতে পাই। যদিও তা আমার জন্মের অনেক আগে।
বাবাকে নজরবন্দি হয়ে প্রায় দুবছর কাটাতে হয়। মা অস্থির হয়ে উঠেছিলেন দেশে ফেরার জন্য। আসলে যুদ্ধের সময়ে বুঝতে পারেননি কী করবেন। আদৌ দেশ স্বাধীন হবে কি না ? না হলে তো করাচিতেই থেকে যেত হতো। সবাই স্বাধীন হওয়ার পরও অনেক করে বলল, হ্যাঁ, উর্দুতেই বলল: কী করবেন গিয়ে ? থেকে যান।
বাবা ওই নজরবন্দি দশার ভেতর, মুজিবকোট বানিয়ে, দিনরাত নামাজ পড়ছেন, দোয়া করছেন শেখ সাহেবের যেন মৃত্যু না হয়। বাংলাদেশের যাতে মুক্তি হয়। সেই লোকটা দেশে ফিরে দেড় বছর বেকার বসে থেকে থেকে একদম মুজিববিরোধী মানুষ হয়ে গেলেন!
যাই হোক, এসব বলে কোনও লাভ নেই। আমার জন্মের অনেক আগের ব্যাপারস্যাপার। কেন তবে বললাম ? আসলে মনে হয়, ওই লেখার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। খুঁজে পেতে গ্রামে যাওয়া। বিভা প্রথম প্রথম গাইগুই করলেও পরে দেখি আমার চেয়ে তার আগ্রহ দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। একটু লম্বা ছুটি মানেই গ্রামের দিকে গাড়ি হাঁকাও।
আমি তো গিয়ে কীভাবে গল্প জোগাড় করব, তাও জানি না। গল্প পড়তে পড়তে যে গল্পের নেশা হলো তাও তো নয়। ঠিক কেন গল্প লিখতে চাইলাম তাও বলতে পারি না। পড়েছি অর্থনীতিতে। সেই মতো পল স্যামুয়েলসনের ‘কুল ব্রেইন অ্যান্ড ওয়ার্ম হার্ট’-এর মানুষও আমি নই। অন্যদের মতোই চাকরি করে খাই। বিভাকে বিয়ে করেছি। বিভা দেখতে সুশ্রী। গ্রামে যেতে যেতে বিভা অন্যরকম হয়ে উঠতে থাকল। অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা বলতে শুরু করল। যেমন বলে, গ্রাম হলো বকের শহর। আর শহর হলো কাকের গ্রাম―কথাটা শুনেই অবশ্য কষে চুমু খেয়েছিলাম। বিভাই কি আমাকে প্রথম বলেছিল, চুমু হলো একমাত্র জিনিস, একজন খেলে দুজনেরই খাওয়া হয় ? বিভাই তো বলবে! আর কারও সঙ্গে প্রেম করার সুযোগ তো হয়নি। কেবল একবার বিদেশে ট্রেনিংয়ে গিয়ে আমার বন্ধু দিদারের বৌ পিউলি, সেও আমার সঙ্গে পড়ত, ডবকা ছুকরি ভাবটা, তার আগের মতোই ছিল। সেই কত বছর চুটিয়ে প্রেম করে বিয়ে। দিদারের সঙ্গে তো কোনও কিছু বাদ নেই, কিন্তু বলে দিদার নিজ থেকে তাকে চুমু খায়নি। এই বলতে বলতে কেঁদেই ফেলে আমাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর হোটেল রুমে আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে আমার প্রতিটা ঘাই সে এত গভীরভাবে নিচ্ছিল। বিস্ময়কর! আমি ট্রেনিং করব না কী করব! যে কদিন ছিলাম, পরে গুনে দেখি, প্রায় পঁয়ত্রিশবার বহুবিচিত্রভাবে পিউলি আমাকে নিংড়ে নিয়ে তবে ছেড়েছে। ট্রেনিংয়ের বারোটা আরেকটু হলে বেজে যেত। পিউলি নিশ্চয়তা দিয়েছিল, কেউ কিচ্ছুটি জানতে পারবে না। উফ ইচ্ছা করে তোমাকে বিয়ে করে বাংলাদেশে চলে যেতে। আমিও বলেছিলাম চলো, তাহলে। কিন্তু পিউলি বলেছিল, বিছানায় আমরা ফিট হলে তুমি আমাকে বেশি দিন সহ্য করতে পারবা না। আমার জন্য দিদার ঠিক আছে। মাপেখাপে সেই পারফেক্ট। তোমারটাও দারুণ সুন্দর বাট… আহা মুখ কালো করো না। তোমার গ্রাথ মানে ঘেরটা দারুণ। আর দিদারের লেন্থ। দুটো একসঙ্গে হলে কী যে ভালো হতো!… আরেকটা মজার কথা বলেছিল, সেটাই বলতে গেলে অবাক করা, জানো দিদার গতকাল নিজ থেকে আমাকে আচ্ছাসে চুমু খেয়েছে।
পিউলির কাছ থেকে তবু পালিয়ে বেঁচেছিলাম। আসার আগে দেখাও করিনি। আর এসে কোনও যোগাযোগই করিনি। সেও করেনি। পরে তো আমি বিভাকে পেয়ে আর দেরিও করিনি। সোজা বিয়ে।
বিভার ভেতরে আবার সব কিছু দু ভাগে বিভক্ত। সাদা ও কালো। কালো আর সাদা। আমি বলি, মাঝখানে ধূসর বলেও একটা ব্যাপার আছে। আলো-আঁধারির। সে বলে, ওটা মাঝেই থাকে। আসল হলো সাদা ও কালো। সাদা হলো সব রং মিলে আর কালো হলো সব রং উবে গেছে।
দেখে মনে হয়েছিল, বিভার ভেতরে কোনও রহস্য নেই। পরে টের পাই বিভা পুরোটাই রহস্যে ভরা। সেই গল্পটাই আজ লিখতে যাচ্ছি।
হ্যাঁ, বিভা ছিল ফিজিক্সের ছাত্রী। চোখে পড়ার মতো সুন্দরী না হলেও চোখে পড়ার মতো ছিল ওর ফিগার―গড়ন গঠন। আরেকটু হলে র্যাম্পে মডেল হয়ে যেতেও পারত। ছিপছিপে লম্বা কিন্তু কোথাও কোনও কিছুর কমতি নেই। প্রথম দেখায় আমার এমনই মনে হয়েছিল ‘ভিভা’কে। তখন নাম বলেছিল ভিভা নয়, নামই ছিল ভিভা।
ভিভা কেন ?
বলে, আমার জন্ম আমেরিকায়। ভিভা লা আমেরিকা―নামে একটা স্লোগান থেকে বাপি এ নাম রেখেছিল। বাপ আমেরিকায় কার এক্সিডেন্টে মারা গেলে ওর মা বিরাট অঙ্কের ক্ষতিপূরণ পায়। সেই ক্ষতিপূরণ পেয়ে মা তার জীবনের ক্ষতি পূরণ করে: তার কিশোরীবেলার প্রেমিককে বিয়ে করে। লোকটা তখন পাড় বেকার। কিছুই করে না। মজার ব্যাপার হলো মায়ের টাকায় সে ব্যবসা করে অল্পবয়সী একটা মেয়ের পাল্লায় পড়ে মাকে ছেড়ে দেয়। এতে মা এতই কষ্ট পেয়েছিল যে, আত্মহত্যা ছাড়া আর গতি ছিল না। কিন্তু আরও মজার ব্যাপার হলো, আমাকে ওই সৎপিতা ও সৎপিতার নতুন বৌয়ের কাছে চলে আসতে হয়। ওরা দুজনেই ভীষণ আদরে আমাকে বড় করে তুলেছিলেন। লেখাপড়ায় কোনও দিকে কোনও কিছুর কোনও অভাব হয়নি। আমার সৎপিতার ঘরের ছেলেমেয়েরা আমাকে তাদের বড় বোন বলেই গণ্যমান্য করে। সে তো তুমি নিজেও জানো।
আমি ভিভাকে বলেছিলাম, আমি কিন্তু তোমাকে বিভাই ডাকি।
এত কষ্ট করে ভি-ভা; পর পর দুটো ভ বলা আমার সহ্য হবে না বলে নয়, আমি ওকে বিভা বলে ডাকি বিশেষ কারণে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এবং সত্যিই ভিভার শরীর থেকে বিশেষ করে ওপর মাথার চারপাশ ঘিরে প্রায় আমি জ্যোতিষচক্রের মতো বলয় দেখতাম।
সে তোমার খুশি। যে নামে ডেকে তোমার মন ভরে, ডাকো।
অবশ্য জানি কারও নাম যদি ছাইতুন হয়, তাকে জয়তুন করতে নেই। নামের প্রতি মানুষের এমন এক প্রেম আছে, যারা বোঝেন, তারা জানেন। তাও আমি ভিভাকে বিভা বানিয়ে নিলাম। আর এখন তো সে পুরোটাই বিভা।
বিভার কাছে প্রায়ই ওর জীবনের এই গল্প শুনে আমার অদ্ভুত লাগে। আমার বাড়িতেই তো আস্ত একটা গল্প পড়ে আছে। সেটা তুলে নিচ্ছি না কেন ?
বিভা খুব নদীর কাছে যেতে পছন্দ করত। তাই বলে বুড়িগঙ্গা নয়। বুড়িগঙ্গা কালো নোংরা পানি মুক্ত হবে, তখন আবার বুড়িগঙ্গায় বেড়াবো।
বিভা নদী ভালোবাসে অথচ জানতাম, মানে বলেছিল যে, ও একদম সাঁতার পারে না। আর আমিও সাঁতার পারি না। এজন্য বিভার সঙ্গে নৌকায় উঠলে সারাক্ষণ আমার বুক দুরুদুরু করে। এই মনে হয় ঝড় উঠবে। আর কিছুক্ষণের ভেতরে নৌকাডুবি হয়ে আমাদের সলিলসমাধি। একদিন হলোও তাই। হতে না হতেই আমি অজ্ঞান। যখন জ্ঞান ফেরে তখন একটা চরের বালুতে আমি, পাশে ভিজে শপশপে হয়ে শুয়ে আছে বিভা। পরে শুনি বিভাই নাকি আমাকে বগলদাবা করে একা সাঁতার দিয়ে পারে তুলেছে! বিভা কিন্তু কিছু বলেনি।
তুমি সাঁতার জানো ? জিজ্ঞাসা আর বিস্ময় মিশিয়ে আমি জানতে চেয়েছিলাম।
না তো!
তাহলে তুমি না কি আমাকে বগলদাবা করে এক হাতে সাঁতার দিয়ে আমাকে পাড়ে তুলেছ ?
কী আজব! তা কীভাবে হবে ? আমি তো সাঁতারই জানি না।
এই ঘটনার পর গ্রামে গিয়ে আরও বেশি বেশি নদীতে নৌকা নিয়ে বিভার ঘোরাঘুরি শুরু হয়। কোনও কোনও দিন অনেক রাতে, ঘাটে ফিরে নির্জন গ্রামের পথে, আমার হাত ধরে সে গান গাইতে গাইতে হাঁটে। ওকে তখন মনে হয়, অন্য কোনও গ্রহ থেকে আসা মানুষ। সঙ্গে আরও একটা ঘটনা শুরু হয়। বিভা ধুমসে সাদা ও কালো রঙের কাপড়চোপড় পরতে শুরু করে। আর কোনও রং নয়। আগের সব কাপড় ওয়্যারড্রবে পড়ে পড়ে পচতে থাকে।
কালো ও সাদা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি বা জিনসের প্যান্ট বা টিশার্ট, সঙ্গে অবশ্যই ওড়না পরে―সব সাদা-কালো। কখনও পুরো সাদা, কখনও পুরো কালো। কখনও সাদা-কালো মিলিয়ে। যেমন কালো রঙের টি-শার্ট পরল তো সাদা রঙের প্যান্ট। সঙ্গে সাদা রঙের ওড়না। আর বিভা ছিপছিপে লম্বা বলে যে কোনও পোশাকে ওকে অদ্ভুত মানিয়ে যায়। কোমরের নিচে একে ছড়ানো তায় ভরাট অথচ একেবারেই উৎকট নয়, বরং দারুণ মানানসই নিতম্ব আর আপেল ফলের মতো সুগোল ও ভরাট স্তন বিভার দেহে দারুণ একটা ছন্দো-ময়তা তৈরি করে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে বিভাকে দেখি!
তুমি সাদা-কালো পরতে শুরু করলে এত!
বিভা শ্রাগ করে। এমনিই।
আরও একটা বিষয় হলো, শহরে বেশির ভাগ সময় সে কালো পরে। সাদা ও কালো মিলিয়ে পরে, কিন্তু গ্রামে গেলে সবসময় সাদা।
তুমি গ্রামে গেলে সাদা পরো কেন ?
ইচ্ছা করে সাদা বকের ভিড়ে গিয়ে বক হয়ে উড়ে যাই।
কথাটা কেমন জীবনানন্দ জীবনানন্দ শোনায়।
তুমি কি জীবনানন্দ পড়েছো ?
না তো। নাম জানি। পড়িনি কখনও।
বনলতা সেনও না ?
না।
আজকাল কোনও কোনও ছুটির দিনে শহরে কাক উড়লে, বিশেষ করে কোনও জায়গায় কোনও কাক মরলে, ঝাকে ঝাকে কাক যখন আকাশে গোল করে উড়তে উড়তে চক্কর দিতে থাকে; দেখি: আমাদের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিভা সেই দৃশ্য বিভোর হয়ে দেখছে, আর একটা জলের রেখা তার চোখ বেয়ে থুতনিতে গিয়ে বিন্দু হচ্ছে, কখনও টুপ করে, আসলে নিঃশব্দে ঝরে পড়ছে, বিভার সেদিকে খেয়ালও নেই। এমন কি আমি যে বিপুল বিস্ময় নিয়ে ওকে এক ঠাঁয় দেখছি, সেদিকেও বিন্দুমাত্র ভ্রƒক্ষেপ করছে না।
জানি না এসব দেখতে দেখতে আমার গল্প লেখার ইচ্ছাটার জন্ম হলো কি না। বিষয়টা সহজ। আমি এই কথাগুলি কাউকে বলতে পারছিলাম না। বিষয়গুলি যে বলার মতো অস্বাভাবিক বা খুবই তাক লাগানো কিছু, তাও আমার মনে হয় না, তবু এসব ভাবলে মন কেমন করে ওঠে। বিশেষ করে, যেদিন নদীতে নৌকাডুবি হলো, আর বিভা আমাকে বগলদাবা করে, আমার মতো ওজনে বেশ ভারী অজ্ঞান একটা পুরুষ মানুষকে এমন হালকাগড়নের নারী হয়েও বিভা কীভাবে এক নদী সাঁতার দিয়ে কূলে তুলল―ভাবলে আমার কেমন গা ছমছম করে ওঠে―যে বিভা কোনওদিন সাঁতার কাটেনি।
আমার তো সন্দেহ হয় আমেরিকায় অল্প বয়সেই সবাইকে নাকি স্কুলে সাঁতার শেখানো হয়। যেটা আমাদের এখানেও হতে পারত। নদী-নালার দেশ, অথচ সাঁতার না পারা মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। নদী-নালার দেশ, গ্রামে পিচ্চি বাচ্চা-কাচ্চারা এখনও নদীতে যেমন লাফায় ঝাঁপায়, সাঁতার দিয়ে এপার ওপার করে, সেখানে অলিম্পিকে সাঁতারে সোনা পাওয়ার কথা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। ধুরো! দেখো, অন্য দিকে চলে যাচ্ছি!
আসল কথায় আসি।
এরপর গ্রামে গিয়ে আরেকটি কাহিনি হলো। সেদিনও রাতের বেলা ঘাট থেকে নেমেছি। অচেনা গ্রাম। নদীর পারে একটামাত্র দোকান। সেটিও আলো নিভিয়ে চলে গেছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার জন্য পুরো গ্রাম অন্ধকার হয়ে আছে। সেদিন পুরো সাদা সালোয়ার কামিজে নৌকা থেকে নেমে এত খুশি ছিল বিভা যে অন্ধকারে ওর চোখ-মুখ ফসফরাসের মতো জ¦লছিল। আমি যথারীতি অবাক হয়ে ওকে দেখছিলাম।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ আমি দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। বিভা তখন অনেকটা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ তার খেয়াল হয়, আমি পাশে নেই, তখন ফিরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
কী ব্যাপার দাঁড়িয়ে গেলে যে! হোয়াট হ্যাপেন ? এনিথিং রং ? আর ইয়ু ফিলিং আনইজি ?
আমি অন্ধকারে বিভার মুখে হাসি দেখতে পাই। যতটা দূরে বিভা গিয়েছিল এগিয়ে, মনে হলো তারও চেয়ে দূরে চলে গেছে, আর যখন সে আমার দিকে এগিয়ে আসছিল, ততটাই যেন পিছিয়ে পিছিয়ে দূরে আরও দূরে, অন্ধকারে একটা বিন্দুমতো হয়ে যাচ্ছিল বিভা! হঠাৎ করে মনে হলো সে উড়ে উড়ে আমার দিকে আসছে, একটা সাদা রঙের বিশাল রাতপাখি সামনে দেখে আমি হুঁশ হারালাম।
তারপর বিভাই গাড়ি অব্দি নিয়ে গিয়েছিল আমাকে একাই কাঁধে করে। ভাবা যায়! গ্রামের চেয়ারম্যান বাড়িতে গাড়ি রাখা ছিল। গ্রামে নেমেই প্রথমে আমরা সেখানের চেয়ারম্যান বাড়ি খুঁজি। সেখানে গাড়ি রেখে তারপর যেখানে যাওয়ার যাই। সেই চেয়ারম্যান বাড়ি ছিল ওই গ্রামের গহিন ভেতরে। নদীর পাড় থেকে অতটা পথ বিভা আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে গেছে! কী বিস্ময়কর।
বিভাকে বলতে পারি না। একদিন কফি খেতে গিয়ে বলি, তুমি দিনে দিনে অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছো।
তাই! ছোট্ট এক উত্তর দিয়ে কফির কাপে মন দেয়।
কিছুক্ষণ পরে সে চোখ তুলে বলে, লোকজন এটাই বলাবলি করে। তোমার আত্মীয়স্বজন বিশেষ করে। কী বলে বলো তো।
কী আর বলে: বিয়ের অনেক দিন তো হলো, আর কত দেরি হবে আমাদের, একটা বাবু হয় না কেন…
ব্রিলিয়ান্ট!
ব্রিলিয়ান্টের কিছু নেই। অর্থনীতির জটিল জটিল জিনিস নিয়ে আমাকে কাজ করতে হয়। এডিবি দিয়ে শুরু করে এখন ডাব্লুবিতে কাজ করছি। কাজের সুনামও শুনি। যদিও কোনও নামডাক কেউ করে না। কেউ তো আমার ডাকনামও জানে না। ডাকনামকে নামডাকে পরিণত করাই হলো আড়াল সরিয়ে বিরাট হয়ে ওঠা। অখ্যাতি থেকে খ্যাতিমান হওয়ার যাত্রাপথ―গাড়িতে যেতে যেতে একদিন অফিসের কলিগ খালেদ হোসাইনের একটা ছড়া পড়ে শুনিয়েছিল।
‘নামডাক থাকে কারও কারও
তুমি যদি বড় হতে পারো
তাহলেই হবে নামডাক
ডাকনাম থাক বা না থাক।’
সেদিন তিনি ছড়ার পুরোটাই পড়েছিলেন। শুনে চমৎকৃত হয়েছিলাম।
বিভা সকালে গাড়ি চালিয়ে আমাকে অফিসে পৌঁছে দিয়ে ফের বাড়ি চলে যায়। তারপর গাড়ি নিয়ে বিভার ঘোরাঘুরি শুরু হয়। ঢাকার অভিজাত এলাকায় ওর একটা বুটিক শপ আছে। সেটা দারুণ জমজমাট। কখনও কখনও বিভা নিজে এসে আমাকে আবার বাড়ি নিয়ে যায়। জ্যামট্যাম বেশি হলে, আমার কলিগ, বড় ভাই, বন্ধুও বলতে পারি, আমাকে লিফট দেন। উনি আর আমি একই এলাকায়, ধানমন্ডিতে, একই রাস্তায় কয়েকটা বাড়ির পরে থাকি।
তিনি ইদানীং গাড়িতে ছড়ার বই রাখছেন। মাঝে মাঝে ছড়া পড়ে শোনান। ছড়াগুলো বেশির ভাগ হাসির হয় জানতাম; কিন্তু দেখি এত এত মনখারাপ করা ছড়া আছে! কখনও এর কখনও ওর―সুকুমার রায় থেকে সুকুমার বড়ুয়া। রিটন থেকে আনজীন লিটন। লিটন থেকে অদ্বৈত মারুত শুনি।
হঠাৎ এত ছড়া পড়ছেন ?
ছড়ায়ই জগৎ ধরা। ছড়াগুলি খুব কড়া।
বাহ! এটাও তো ছড়া হয়ে গেল!
আমি বোধ হয় আজকাল রিটনের মতো ছড়াকে ধরাজ্ঞান করি।
ধরাকে সরাজ্ঞান করার চেয়ে এটা ভালো।
তিনি হো হো করে হেসে ওঠেন।
বাহ! আপনিও ছড়া পড়ছেন নাকি আজকাল।
আমি বলতে পারি না, আমি আজকাল গল্প লেখার চেষ্টা করছি, গল্প লেখার কোনও কিছু না জেনে এবং একান্ত গোপনে। বিভাও জানে না। ভোরে উঠে, কেউ কিছু টের পাওয়ার আগে ল্যাপটপ খুলে লিখি। রান্নাঘরে হানুফার মা টুংটাং ঠুকঠাক শুরু করার আগ পর্যন্ত চলে আমার ব্যর্থ চেষ্টা। আবার কেউ কিছু টের পাওয়ার আগে ল্যাপটপ বন্ধ করে দিই।
বিভার সঙ্গে জীবনটা তাহলে আমার ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠেছে। এটা টের পাই। বিভা নিজের ভেতরে কেমন যেন বিভোর থেকেও আবার সব দিকে খেয়াল রাখে। আমাদের কোনও দিকে কোনও অপূর্ণতা আছে বলে তো মনে হয় না। বিছানায় যখনই জিজ্ঞাসা করি, কেমন! বলে, একশোতে দুশো। বিভাই বলে, আজ গেম হবে না কি থাকবে ? খেলার সময় বোঝা যায়, কী মারাত্মক সেক্সি। ও বলে, তুমিও সেক্সি কম না!
আচ্ছা সেক্সি শব্দটার পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গ হয় না। বাংলাও হয় না। আবার এটা তো ক্লীবলিঙ্গও না। তবে কি উভয়লিঙ্গ ? কী জানি! একদিন সকালে গল্প লিখতে গিয়ে পুরোনো হারানো আমার বাংলা ব্যাকরণজ্ঞান চাগিয়ে উঠলেও আমি লেখায় নজর দিই। বেশি ব্যাকরণ লেখার জন্য ভালো না―অন্তত এটুকু টের পাই।
মাঝে মাঝেই বিভা কিছু রান্না করে, বিশেষ করে ছুটির দিনে। কখনও কখনও আমি। যদিও আমাদের বাসায় দুজন কাজের মানুষ আছেন। একজন রান্নার, অন্যজন বাড়ির কাজ করার। তাদের পেছনেই ত্রিশ হাজারের মতো চলে যায়।
যাই হোক, একদিন অবশেষে একটা আসল গল্প লেখার রসদ পাই; আর সেটাও গ্রামে গিয়ে এবং বিভা ছাড়া একা বাড়ি ফিরে এসে। এ ঘটনাটা অল্পতে বলি।
সেদিন যে গ্রামে গিয়েছিলাম, সেখানে নদীর পাড় ঘেঁষা এলাকাটায় বক আর বক। একসঙ্গে এত বক আমি জীবনে এর আগে দেখেছিলাম কি না মনে পড়ে না। বিভার সেদিন সব সাদা। সঙ্গে ব্যাগটা পর্যন্ত সাদা। সেদিন একসঙ্গে এত বক দেখে বিভা তো খুশিতে পাগল। কী করবে বুঝতে পারে না।
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমি একটা গাছের নিচে বসেছি। একটু অন্যমনে ছিলাম। হঠাৎ দেখি দু হাত দু পাশে ছড়িয়ে ঠিক পাখির মতো উড়ালের ভঙ্গিতে বিভা বকের ঝাঁকের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। আর কী আশ্চর্য ও গেলে তো বকের ঝাঁকে সাড়া পড়ে বকগুলির পালিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু আমি দেখলাম বিভা দৌড়াতে দৌড়াতে উড়তে শুরু করেছে। উড়তে উড়তে বিভা একটা বিরাট বক হয়ে ওই বকেদের ভিড়ে গিয়ে নামল। একদম ডানা গুটিয়ে মিশে গেল।
এই দৃশ্য দেখার সময় জানি না আমাকে কেউ দেখলে কেমন দেখতেন! এমন নির্জনতায় এই গ্রামে এমন একটা জায়গায় আমি কী করব, কী বলব, বুঝতে পারি না। তারপর সন্ধ্যা অবধি বসেছিলাম। বিভার ফেরার কোনও নাম নেই।
আমার কেমন জানি লাগতে থাকে। কী কী শঙ্কা আশঙ্কা―একটা সময় পর রীতিমতো আতঙ্ক চেপে ধরে। কিন্তু কোনওভাবেই বিভা ফেরে না। সেদিন কত লক্ষবার ফোন করেছি। বিভা ধরেনি। কেটেও দেয়নি। একদম চার্জ ফুরিয়ে যাওয়ার আগে শেষ ফোনটা বিভা ধরে। তখন অনেক রাত। বিভা বলে, চিন্তা করো না। বাড়ি যাও। আমি আসছি।
মানে কী…
বলার মান.. অবধি ফোন কেটে যায়।
আমি গাড়িটা খারাপ চালাই না বলে হয়তো সে-রাতে ঠিকমতো বাড়ি ফিরেছিলাম। গাড়ি চালাতে চালাতে এও টের পাই: বারবার মন কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম না। চোখের সামনে রাস্তা দেখব কী! বারবার বিভার সেই দু হাত ছড়িয়ে দৌড় আর দৌড়াতে দৌড়াতে বকের পালে মিশে যাওয়া দৃশ্যই দেখছিলাম। হত বিহ্বল হয়ে বাসায় ফিরেছি, বলতে গেলে গভীর রাতে। কটা বেজে ছিল কে জানে। রাত তিনটা হতে পারে। বাসায় ঢোকার একটু পরেই কলিংবেল বেজে ওঠে।
আমি উড়ে গিয়েই দরজা খুলি।
দরজায় বিভা দাঁড়িয়ে। পরনে কালো সালোয়ার-কামিজ।
মানে কী! যাওয়ার সময় পরেছিলে সাদা সালোয়ার-কামিজ!
কী বলো! যেতে দাও… আমাকে একরকম ঠেলে সে ভেতরে ঢোকে। বসার ঘরে সোফায় হাতের ব্যাগটা রেখে বলে, আরে বোকা ব্যাগের ভেতরে ছিল।
ব্যাগটাও আমি খেয়াল করি। সেটাও কালো ব্যাগ। তাহলে!
ততক্ষণে বিভা ঘরের ভেতরে চলে যায়।
কালো ব্যাগটা একটু ফুলে আছে। ভেতরে কি সাদা সালোয়ার-কামিজ গুঁজে রাখা ?
আমি কালো ব্যাগটা থেকে চোখ সরাতে পারি না।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ