আর্কাইভগল্প

জাদুবাস্তব গল্প : তপতী : হামিম কামাল

যার দিকেই তাকাই, তার মৃত্যুদৃশ্য মনে আসে। শুরুর দিকে যন্ত্রণা হতো। এখন আর আগের মতো কষ্ট হয় না।

এখন মাঝে মাঝে আমার হৃদয় রুক্ষ হয়ে উঠতে থাকলে আমি মনে মনে সামনের কোনও মানুষের মৃত্যুদৃশ্য দেখি। এতে কি পাপ হয় ?

কাল নির্ঘুম-ডাকাতের কবলে পড়েছিলাম। সারারাত বিছানায় ডানকাত-বামকাত আর বালিশ কিলিয়ে ফাঁপিয়ে উল্টেপাল্টে কেটেছে। কারণ―তপতী। গত চারটি মাস তপতী অস্থির করে তুলেছে।

আজ আমি এতো রুক্ষ হয়ে আছি! শরীরের সমস্ত নাড়ি যেন ভেতর থেকে শুকিয়ে উঠছে।

ক্যাম্পাসের দরজায় এই যে গম্ভীর প্রহরী, তার কথাই ভাবা যাক। একরোখা কালো ষাঁড়ের মতো দেখতে উপাচার্যের আলফার্ড গাড়িটিকে দরজা খুলে ঢুকতে দিয়ে, দরজা লাগিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল লোকটা।

নভেম্বরের প্রভাতী রোদ তার পাথরের মতো মুখের পূর্বপাশ আলো করে রেখেছে। সেই মুখে একদিন নিশ্চয়ই নামবে বার্ধক্যের শিথিলতা।

নামবেই।

আমার চোখে ভেসে উঠল, যা ওঠে―

ষাট বছর পরের দৃশ্য। আমি দেখতে পাচ্ছি। চোপসানো চোয়াল আর ঝুলে যাওয়া ত্বকের মানুষটিকে আজকের ত্রিশের বলিষ্ঠ যুবকের সঙ্গে মেলালে চেনা যায় না।

কোটরাগত চোখ দুটোয় ছানি পড়েছে। তেলচিটে ফিরোজা বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছে মানুষটা। বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতাবোধে তার চোখের কোণে জল ধীরে গড়িয়ে পড়ছে।

মানুষটা মারা যাবে আর সাত মিনিট পর।

‘ষাট বছর’ পরে।

আহা, দেখলাম―পৃথিবী তার জন্যে রূঢ়তা আর অবিচারে ভরা হলেও, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বাররক্ষীর চাকরি তাকে সম্মান দিয়েছিল তুলনামূলক। এই ক্যাম্পাসে তার প্রয়াত বড় ভাইয়ের ছেলেটিকে বিনা বেতনে পড়াতে পারার গৌরব তার আপাত দীর্ঘ-জীবনে সম্মানের শেষ পুঁজি।

লোকটার ভেজা কালো চোখের মণিতে কবাটখোলা দরজায় সাদা পর্দা উড়ছে। তার নাতির বয়স আজকের তার মতোন।

এই শীতের সকালেই ছেলেটা দরজা খুলে দৌড়ে ফার্মেসিতে গেল ?

শিথানে পূর্বমুখী জানালা। কবাটের ফাঁক গলে রোদের পাঁচটি সরল রেখা এল ঘরে। একটি সাদা রেখা পড়ল তার শিরাওঠা শ্যামল হাতের ওপর। হাত একটি আরেকটির ওপর তোলা।

এই আলো জীবিত তার কাছে আসা প্রকৃতির শেষ আদর। কী মায়া!

প্রহরী মানুষটির জন্য আমার হৃদয় মমতায় আর্দ্র হয়ে উঠল।

মানুষ তার জন্মদিন জানে। মৃত্যুদিন জানতে পারে না, অথচ অসংখ্যবার তাকে পেরিয়ে যায়।

আমি দেয়াল লাগোয়া চায়ের দোকানে বেলকাঠের নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে পড়ি। আমার সামনে দিয়ে আমার সহপাঠীরা হেঁটে যাচ্ছে, ললিত গোলাপের পেলব পাপড়ির মতো মেয়েরা।

‘অরু!’ জীবনের কণ্ঠ শোনা গেল।

আমার বন্ধু জীবন। ওর ওই হলুদ কার্ডিগান আমার খুব পছন্দের। চাদর পরি বলে, নয়ত এই কার্ডিগান আমি নিয়ে নিতাম। ও যে সুগন্ধী ব্যবহার করেছে আমি এর নাম জানি। এই সুগন্ধী রাসায়নিক। কিন্তু ফুলেল একটা ভাব ধরে নিজ দাম বাড়াতে চায়।

জীবন বলল, ‘অরু, আবার তুই মৃত্যু দেখেছিস ?’ অরু আমাকে দেখলেই বুঝে ফেলে। ‘তোকে নিষেধ করেছিলাম।’

ওয়াহিদ ভাই এরই মাঝে কড়া লাল চা বানাতে শুরু করেছে। তার ছেলে পলাশ বসা থেকে উঠে এসে আমাদের হাতে দুটো ধোঁয়া ওঠা কাচের কাপ তুলে দিল।

পলাশের বয়স বারো। পরনে পলাশফুলের মতো লাল শার্ট, কালো প্যান্ট। হাতে চার রঙা উলের মোজা।

‘ভালো আছ পলাশ ?’ জীবন চা হাতে নিয়ে কুশলবাক্য ছুড়ল। বাহুল্য। কারণ পলাশ কখনও প্রশ্নের উত্তর দেয় না। জীবন তবু বলল, ‘কেমন লাগছে বিক্রমাদিত্যকে ?’

‘বত্রিশ সিংহাসন’ নামে এক রূপকথার বই পলাশকে উপহার দিয়েছে জীবন। ঠিক রূপকথাও কি একে বলা যায় ?

এইবার কিন্তু পলাশ আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘জি পরথম সিংহাসনে আছি।’ ওর কণ্ঠটা কোমল। মেয়েলি। ছোটবেলায় দেখেছি, সিনেমায় কিশোর বয়েসী নায়কের গানে কণ্ঠ দিতেন রুনা লায়লা। 

যা হোক, শুনে তাক লেগে গেল। জীবন তাহলে ভুল বাজি ধরেনি। বলল, ‘ফেরার পথে শুনব কিন্তু কী পড়েছ। তখন থাকবে তো ?’ পলাশ উত্তর না দিয়ে টুলে গিয়ে বসল।

জীবন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গত রাতে তোমার ঘুম হয়নি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।’

‘কে বলল। খুব ভালো ঘুম হয়েছে আমার।’

‘উন্মাদ আর খুনিরাই আয়না দেখে না,’ বলল জীবন।

কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। উন্মাদরা হয়তো দেখে না। কিন্তু খুনিরা খুঁটিয়ে আয়না দেখে। মনে এলেও বলতে ইচ্ছা হলো না। এর বদলে বললাম, “আমি বোধহয় উন্মাদ বড়জোর। সম্ভবত খুনি নই। কে জানে। হয়তো, অংশত খুনি। যেহেতু আমি মৃত্যু ‘কল্পনা’ করি।

হ্যাঁ, জেমস ব্লান্টের ইউ আর বিউটিফুল গানের বর্ণনার মতো মেয়েটিকে দেখলে কথা বন্ধ হয়ে আসে, গলা ভার বোধ হয়। তীব্র সুন্দর আর তীব্র বিষাদ খুব কাছাকাছি।

সেদিনের কথা। ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে আমাদের সাধারণ পরিচিতি অনুষ্ঠান ছিল। শিক্ষকরা আদুরে কথাবার্তা বলে যাচ্ছিলেন। জানি এসব কোনওদিন সত্য হবে না। এ দেশে সুন্দর জীবন কখনও আসবে না। অনাদিকাল থেকে চেষ্টাই চলছে। পারবে না বাঙালি। 

কেন তপতী সেই দিন আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল ?

ওর হাত ধরে ছিল অন্য এক পুরুষ।

হাতাকাটা অথচ গলাবন্ধ কালো ব্লাউজ। ওর শাদা গ্রীবা, স্বাধীন সারসীর মতোন। অন্তিম আকাশের মতো রাণিগোলাপি শাড়ি পরেছিল তপতী। রাশ টানা ঝরনার মতো খোলা চুল। অদ্ভুত যা―একটি ঝিলমিলে নীল হেয়ার-স্ট্রিং, সবসময়, ওর একটি কি দুটি চুলের সঙ্গে বাঁধা।

ওকে দেখলে যেন পুণ্য হয়।

আমি পুণ্য জমাচ্ছিলাম।

পাশে একটি ছেলে, হয়তো ছেলেটি সুন্দর। কিন্তু আমার চোখে কালো স্যুটে তাকে ভীষণ কুৎসিত লাগছিল। তার ঠোঁটে ঈর্ষা ও শ্লেষমাখা হাসি। এ হাসি আমি চিনি। তপতীকে আমি দেখছি তা ছেলেটি লক্ষ করেছে। যেভাবে পিয়নদের পানীয় জলের জন্য ডাকছিল, শিক্ষকদের দিকে নকল বিগলিত হাসি ফিরিয়ে দিচ্ছিল, বোঝা যাচ্ছিল এই ক্যাম্পাস ছেলেটির আগে থেকে চেনা।

হ্যাঁ, ছেলেটি অন্য বিভাগের, কিন্তু আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ।

হঠাৎ তপতীর চুলের ঘ্রাণ নেবার ভান করে ও আমাকে বুঝিয়ে দিল তপতীর সঙ্গে ওর রোমান্ত-রোমাঞ্চের সম্পর্ক।

অনুষ্ঠানের পর এরপর ওরা ক্যাম্পাসের পাশে মুভেনপিক আইসক্রিম পার্লারের সিঁড়ি ধরে নামতে নামতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছিল। দাঁড়িয়ে পড়েছিল তপতীর কারণে।

মেয়েটি দেখছিল আমাকে। কেন ? সেই মুহূর্তে আমি একটি ভুল করে ফেলি। ঈশ্বর! কী দেখছিলাম আমি ? নিশ্চয়ই কেউ অভিশাপ দিয়েছিল। অথচ আমি অভিশাপ বিশ্বাস করি না। অভিশাপে বিশ্বাস করে না এমন কারও ওপরও অভিশাপ ফলে যেতে পারে।

আমি তপতীর মৃত্যু কল্পনা করে ফেলেছিলাম।

দেবদারুর শরীর ভেজা, আধঘণ্টা আগে বৃষ্টি শেষ হয়েছে। বর্ষাকাল। আষাঢ়। আঠারো তারিখ। দেখতে পেলাম, আজ থেকে ঠিক পাঁচ মাস পর পৌষ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে, দুপুরে, যত্নে দরজা লাগাচ্ছে তপতী।

একটা কালো সুতি শাড়ি তার পরনে। লাল হাফহাতা ব্লাউজ। নাকে একটি পান্নারঙা নাকফুল। নাকে এক বিন্দু পান্না ঝিকিয়ে উঠছে। চোখের পাতা ভেজা। জানালা ঘরের উত্তর পাশে।

সিলিংফ্যানের শূন্য স্লট থেকে নেমে এসেছে পাটের সোনালি দড়ি। ফাঁস-আঁটা দড়িটা জানালাপথে মৃদু বাতাসে হিজল মঞ্জুরির মতো দুলছে।

না, হিজল মঞ্জুরি কেন হবে। ছাদ থেকে নেমে এসেছে, যেন সোনাশঙ্খিনীর কুণ্ডুলি।

লকলক করছে!

তপতী সেই কুণ্ডুলির দিকে গলা বাড়িয়ে দেবে বলে কাঠের চেয়ারের ওপর উঠে দাঁড়াল। চেয়ারের ওপর মসৃণ বার্নিশ করা কাঠের একটি টুল।

আমি মেয়েটির হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারছি তার চোখের দিকে তাকিয়ে। চোখ দুটো রক্তাভ অ্যানিমোনের মতো! এতো কেঁদেছে মেয়েটি ?

আশ্চর্য, সে জানে কী করে ফাঁস বানাতে হয়! বুঝি বহু আগেও সে বারবার, বারবার আত্মহত্যার চেয়ার থেকে নেমে এসেছিল। 

মেয়েটির শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে জলজ ঘ্রাণ। হঠাৎ মনে হলো গোটা দৃশ্য আমি জলের নিচ থেকে দেখছি। গোটা ঘরটা কোনও সুইমিং পোলের নিচে। ক্লোরিন মেশানো ঘেসো ফিরোজা রঙের স্বচ্ছ জলের নিচে ডুবসাঁতারে আমার চোখ জ্বালা করছিল। দৃশ্য কাঁপছিল।

ঈশ্বর! এতোটা দেখতে হচ্ছে ?

তপতী ফিসফিস করে বলল, ‘শুভ জন্মদিন তপতী!’

টুলটা হেলে পড়ে গেল।

মেয়েটির ঝুলন্ত পা জোড়া আমি দেখতে থাকলাম। আমার চোখ নেই, শরীর নেই, তবু আমি বিস্ফারিত চোখে দেখছি। হায়, দেখছি, অথচ তপতীর পা দুটো ওপরে তুলে ধরে তাকে ফাঁস থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা শক্তি আমাকে দেওয়া হয়নি। কেন ?

 হঠাৎ দেখি কেউ অন্ধকারের পোলো নামিয়ে আনছে। ঘরে একটা দুর্বল হলুদ আলো জ¦লছিল। আমার সামনে একজোড়া ঝুলন্ত পা।

ঘটে গেছে যা ঘটার। জানালার বাইরে কেউ গান গাইছিল।

‘সকাল গাইছে দেখো…’

দৃশ্যটা ভেঙে গেল। আমি যেন আরেক জগৎ থেকে ফিরেছি। এটা আমি কী করলাম ? কী দেখলাম ? কেন দেখলাম ? পা দুটো টলছে। বসে পড়লাম।

তপতীরা সিঁড়ি ধরে নেমে এসেছে। আমি কোনওক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে তপতীর দিকে তাকিয়েছি। ও বলল, ‘দেখো মিকাইল, ছেলেটার কষ্ট হচ্ছে!’

‘চেনো ?

‘ও আমার ক্লাসমেট নিশ্চয়ই। কিন্তু এছাড়াও কোথাও দেখেছি। কোথায় দেখেছি ?’

ভবিষ্যতে দেখেছ। কিন্তু সে কথা বলি কী করে।

মিকাইল বলল, ‘তোমার এসব কৌতুক শুনলে গা জ¦ালা করে।’

‘কৌতুক করিনি। মিকাইল, ওকে ধরবে প্লিজ ? পড়ে যাচ্ছে। এই, তুমি সকালে নাশতা করোনি ?’

মিকাইল আমাকে ধরবে না আমি জানি। পরিচিতি অনুষ্ঠানে সে আমার দৃষ্টি অনুসরণ করেছে বারবার, ফুঁসছে তখন থেকেই। তাকে দোষ দেব না। কিন্তু সে যা ভাবছে জগৎ সবার জন্যে সেভাবে চলে না। চলতে নেই। আমি নিজেই সামলে দাঁড়ালাম। মিকাইল বলল, ‘চলে এসো, তপতী।’

চলে যাচ্ছে। আমি তপতীর পা দুটো দেখতে পেলাম। রানি গোলাপি রঙের একজোড়া ব্যালেরিনা ফ্ল্যাট তার পরনে। এতো রুচিস্নিগ্ধা কেন এই মেয়ে ? পায়ের যেটুকু বেরিয়ে আছে, মসৃণ সাদা। বুঝি মোমের তৈরি।

তপতী যেতে যেতে বলছে, ‘মিকাইল, তুমি এতো রূঢ়!’

এরপর এল পৌষ মাস। চলছে প্রথম সপ্তাহ। মাসের শেষে সেমিস্টার ফাইনাল। পরের সপ্তাহে পরীক্ষাপ্রস্তুতির ছুটি শুরু হয়ে যাবে।

এমন সময়ে একটি দৃশ্য চোখে গাঁথল। যা আগে দেখিনি।

তপতীর নাকে একটি পান্না বসানো নাকফুল। পৌষের রোদে ঝিকিয়ে উঠেছে।

সার্কিট ক্লাস শুরু হতে দশ মিনিট বাকি। জীবন চায়ের কাপ রেখে বলল, ‘অযথাই দুশ্চিন্তা করছিস।’

‘তোকে তো সব বলেছিলাম। ভুলে গেছিস ?’

‘পান্নার নাকফুলটাই তো ? ও চুলে ঝিলমিলে হেয়ার স্ট্রিং বাঁধে। যদি নাকফুল পরে কী পরতে পারে তুই অবচেতনে ভেবেছিলি। জাস্ট একটা গুড গেজ। আমি এর বাইরে আর কিছু দেখছি না।’

‘বোধহয় এমন বলতে হয় বলে বললি।’

সার্কিট ক্লাসের পর একটা চল্লিশ মিনিটের বিরতি পেয়ে আমার বুকে আরও ভর চেপে বসে। বুকের ভেতর এই অস্থিরতা আমি কী করে দূর করব রাস্তা জানা নেই। বেঞ্চ ছাড়িনি। তপতী বাইরে করিডোরে হাঁটছে।

পরনে বেগুনি কার্ডিগান, সাদা পাজামা। গলায় রোমশ সাদা মাফলার। রোদের ফুল ঝরছে ওর খোলা হাতে, গালে, কপালে, চুলে। আজ একটুখানি প্রিন্সিপাল করে বাঁধা চুলের সঙ্গে জড়ানো একফিতে ম্যাজেন্টা হেয়ার স্ট্রিং।

এই শৈলী একান্তই তার। তার মনও আমার সঙ্গে আলাপের উপলক্ষ্য খুঁজছে ?

এমন সময়ে করিডোরে মিকাইল উপস্থিত। কতটা পড়াশোনা করে আর কতটা বাদুড় ওড়ায় জানি না। দিন দিন তার চোখ অনেক বেশি কোটরাগত হয়ে পড়ছে।

হয়তো সে আমার সঙ্গে নির্ঘুম রাত কাটানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ওরা কী বলল জানি না।

মেকানিকাল ক্লাসের আগমুহূর্তে তপতী আমার কাছে এল। ‘অরু, যাবে তুমি ?’

‘কোথায় ?’

‘নিচে। চা খাবে ? যদি কোনও আপত্তি না থাকে।’

‘না আপত্তি কী। চলো।’

দুজন একসঙ্গে যখন পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়েছি, তখন মেকানিকালের শিক্ষক এসে সামনের দরজা দিয়ে ঢুকেছেন। অল্পের জন্য দৃষ্টি এড়াতে পেরে আমরা একসঙ্গে হেসে ফেললাম।

একসঙ্গে হেসে ওঠা কী ভীষণ সুন্দর ব্যাপার!

করিডোরে আমরা রোদ কেটে হাঁটছি। শীতের রোদের মতো রোমন্ত আর কিছু কি আছে ? পাশাপাশি হাঁটছি ঠিকই, কিন্তু দুজনই যেন শূন্য কাপে চা খাচ্ছি।

করিডোর শেষে দেয়ালিকার সামনে দাঁড়াল তপতী। ‘অরু, জীবন আমাকে সবই বলেছে।’

তপতী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আছে। ‘আর আমি জীবনকে আমার কথাগুলো না বলে পারিনি। ও বলেছে নিশ্চয়ই ? তুমি নির্ঘাৎ আমাকে অনেক ঘৃণা করছ ?’

আমি আকাশ থেকে পড়ছি। বললাম, ‘কিছু বলেনি আমাকে জীবন। কী হয়েছে ?’

‘তোমার দেখা পরিণতিই আমাকে ডাকছে। মিকাইল-আমি একসঙ্গে আপেল কেটে খেয়েছি ? বুঝতে পারছ ?’

‘আপেল ? আদম আর ইভের আপেল ?’

আপেল কেটেছি, এবং ঈশ্বর ডাকলে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে বলেছি, ‘না ঈশ্বর, আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না, আমরা নগ্ন! আরও অনেক কিছুই…’

আমি নিথর। বললাম, ‘তুমি যা ভালো মনে করেছ, করেছ। এ নিয়ে পুড়ছ কেন।’

তপতী ম্লান হাসল।

আমি মিকাইলের মৃত্যুও দেখেছি। তপতীর মতোই নিজ জন্মদিনকে মৃত্যুর দিন হিসেবে বেছে নেবে। আর সেটি অবর্ণনীয় যন্ত্রণাভোগের এগারতম বছরে।

তপতী আশ্রয় নিয়েছিল ভারের। মিকাইল আশ্রয় নেবে ধারের। এবং আমি বিস্মিত ব্যথিত হয়ে তার মৃত্যুনিথর চোখের জলের রঙ দেখেছি, নীল। অর্থাৎ তপতীকে সে সত্যিই ভালোবাসত। 

ঈশ্বর। কী এক খেলায় মেতেছি।

আমি যা কল্পনা করছি তাকে সত্য ভেবে ভেবে একসময় আমি পুরোমাত্রার বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ব। আর সেই বিকারগ্রস্ততাকে ছোবলে ছোবলে চিকিৎসার অতীত করে তুলবে পান্নার নাকফুলের মতো কিছু।

কেন ওটা তপতীর নাকে এল ? 

দুজন লিফটে উঠলাম। গোমড়ামুখে অপারেটর ছেলেটা টুলের ওপর বাঁকা হয়ে বসে আছে। তপতীকে লক্ষ করে চশমা ঠিক করল।

‘নাকফুল পছন্দ তোমার ?’ বলি আমি। তপতী বলল, ‘মিকাইলের ভালো লাগে।’

এ নিয়ে আর প্রশ্ন অবান্তর।

চায়ের দোকানে গেলাম। দোকানে ওয়াহিদ ভাই আর তার ছেলে পলাশ ছাড়া খদ্দেরও কেউ নেই। ওয়াহিদ ভাই আমাদের দেখে সকালের মতোই মুখে কৌতুকি হাসি টেনে চা বানাতে বসলেন।

আমরা বেলকাঠের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলাম। তপতী তার কোমল সাদা মাফলার গলায় নতুন করে জড়িয়ে নিয়েছে।

পলাশ নিজ থেকেই পরিষ্কার একটি কাচের গ্লাসে তপতীর জন্য পানি নিয়ে এল। তপতী হেসে নিতে নিতে বলল, ‘থ্যাংকস!’

বিস্ময় নিয়ে আমার দিকেও তাকাল। এই সৌজন্য তপতী আশা করেনি। টঙে সে কখনও আসেনি। তপতী গ্লাসে ছোট চুমুক দিয়ে বলল, ‘আমি চা পানের আগে এক গ্লাস পানি খাই। কী করে মিলে গেছে ?’

‘ও আরও অনেক কিছু জানে।’ বললাম আমি। ‘ও বিক্রমাদিত্যের গল্প জানে। ছবি রঙ করতে জানে।’

তপতী বিস্মিত। ‘বিক্রমাদিত্য! ভেবেছিলাম এই নামগুলো তো বুঝি মরেই গেছে।’

‘জীবন এদের বাঁচিয়ে তুলছে। জীবনের কাজই তো হলো বাঁচিয়ে তোলা।’

‘তোমার কাছ থেকে গল্প শুনব পলাশ!’ বলল তপতী।

পলাশ মাটির দিকে তাকিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুলটাকে শুঁয়োপোকার মতো চালাতে থাকল ফুটপাথে। সংকোচে লজ্জায় সে একটা জমাট রক্তপলাশ হয়ে গেছে।

তপতী বলল, ‘আমাকে শোনাবে না ?’

পলাশের হয়ে আমিই বলে দিলাম, ‘সন্ধ্যার সময় শোনাবে। যখন জীবন আসবে।’

‘ঠিক আছে। আমি তখনই শুনব।’

‘তুমি তো রোজ বিকালেই চলে যাও। মিকাইল আসবে নিতে।’

‘আজ যাব না।’

তপতী হাসছে যেন অনেক দিন হাসেনি।

ভাবছি, জীবন এতোটাও সুন্দর ? তপতী হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা তোমাকে আমি কোথায় দেখেছি বলো তো ?’

‘ভবিষ্যতে দেখেছ।’

কিন্তু যে ভবিষ্যতে তপতী আমাকে দেখেছে, সেই ভবিষ্যত আমাদের আজকের বৈঠককে গণনায় ধরেনি। সুতরাং মুক্ত ইচ্ছায় ভবিষ্যৎ বদলে গেল। আমাদের কি আর দেখা হবে সেক্ষেত্রে ?

পরীক্ষা করে দেখার লোভ সামলাতে পারছি না।

তপতী চায়ে চুমুক দিচ্ছে। আমি চুমুক দিলাম তার শেষ দৃশ্যে। আবারও। 

চারপাশের পরিবেশ বদলে গেল। তপতী শীর্ণ হাতে একটি চায়ের কাপ ধরে আছে, একটা বারান্দায়। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। একটি রিকশাওয়ালা সেই বৃষ্টির ভেতর পা চালিয়ে যেতে যেতে ঘণ্টি বাজিয়ে চলেছে ক্রিংক্রিং ক্রিংক্রিং।

তপতীর নাকে পান্নার নাকফুল নেই।

ঘণ্টি বাজাতে বাজাতে যাওয়া রিকশা দেখিয়ে তপতী বলছে, ‘দেখো মিকাইল ? কী ছেলেমানুষ! তাই না ?’

মিকাইল বলল, ‘তোমার চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে পাগলী!’

তপতী বলল, ‘খুব ইচ্ছে করছে তোমার কাঁধে মাথা রেখে, এই বৃষ্টির ভেতর মরে যেতে।’

মিকাইল বলল, ‘ছিহ, কী বলছ এসব ?’ তারও কণ্ঠস্বর গাঢ়। তপতীকে কাছে টানে মিকাইল। চায়ের কাপ মেঝেতে নামিয়ে রাখে।

‘আমার কোলে বসবে তপতী ?’ তপতী কিশোরীর মতো মাথা দোলায়।

মিকাইল তার স্ত্রীর হালকা দেহটি তুলে ধরে। আহত কপোতীর মতো তপতী, মিকাইলের ওমে বুকে মাথা রাখে। বৃদ্ধা। শুভ্রকেশ।

মিকাইল জানে না, কিন্তু আমি জানি। তপতী এবার সত্যিই চলে যাবে।

মৃত্যু এতো সুন্দর! এতোটাই!

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button