
১. প্রথম দিন
এলোমেলো, অস্বস্তিকর আর খাপছাড়া অনেক স্বপ্ন দেখে ত্রপান ইলাই ঘুম ভেঙে আবিষ্কার করল, সে পরিণত হয়েছে একটা মানুষে।
তার বিহ্বলতার সীমা রইল না। ঘুমোনোর আগেও সে ছিল একটি পোকা, রঙিন একটি ফুলের কোলে, ফুলের মধু পান করে প্রায় মাতাল অবস্থায় ঘুমোনোর পর জেগে উঠেই দেখে এই বিপত্তি। সে শুয়ে রয়েছে দেয়ালে সাদা রঙ করা একটি ঘরের আরামদায়ক বিছানায়। বিছানার চাদরে লাল রঙের ফুল তোলা, ঠিক যেমন ফুলটির কোলে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তেমন। জানালার পর্দা গলে ঘরে আলো ঢুকে পড়েছে। মাথার পাশে ঝনঝন করে অ্যালার্ম বাজছে। কীসের অ্যালার্ম সে বুঝতে পারছে না।
দরজা ঠেলে কেউ একজন ঘরে প্রবেশ করল। একটি নারীমূর্তি। নারীটিকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। নারীমূর্তিটি তাকে কিছু একটা বললেন যা বুঝতে ত্রপান ইলাইয়ের দীর্ঘ সময় লেগে গেল। নারীটি বলেছেন, সে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোনো তার মানায় না। অফিসে দেরি হয়ে যাবে।
ইলাই ত্রপানের বিহ্বলতা আরও বৃদ্ধি পেলো। সে একজন পোকা। ফুলে ফুলে দুলে বেড়ানো আর মধু পান করাই তার একমাত্র কাজ। অফিসের বিষয়টি কী? কোনও কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না।
তারপরেও সে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করতে করতে বিছানা ছেড়ে উঠল। বিছানার সম্মুখেই একটা আয়না রাখা। আয়নায় নিজের মুখোমুখি হয়ে দেখল, ওপাশে একটা কুৎসিত প্রাণি দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রাণিটি যে তার অচেনা―তা নয়। মানুষ। স্মৃতির শুরু থেকেই এদেরকে সে দেখে আসছে। তার মতো কিংবা অন্য যেসব পোকা রয়েছে সবাইকে এরা পিষে মারে। প্রতিনিয়ত এদের কারণে ভয়ে ভয়ে জীবন নির্বাহ করতে হতো।
জীবন। হ্যাঁ, জীবন। এতকাল তার জীবন ছিল বিচিত্র। কিন্তু এখন আর তার পিঠে সেই স্বচ্ছ ডানা নেই, যা সূর্যালোকে রঙিন হয়ে ঝিলিক দিত। এখন আছে দুই হাত―যারা সমস্ত কিছু ছুঁতে চায়, কিন্তু কিছুই ধরে রাখতে পারে না। আয়নায় নিজের চোখের দিকে চেয়ে সে খেয়াল করল, পোকার জীবনে তার চোখে ছিল হাজারো অক্ষিকাচ, কিন্তু কোনও প্রশ্ন ছিল না। এখন এই এক জোড়া চোখে শুধুই অগণিত ‘কেন’ ভাসছে। আগে যখন সে ফুলের রস খেতো, তখন কি কখনও ভেবেছিল দৃষ্টির মধ্যে দর্শন লুকিয়ে থাকে? মানুষেরা বলে সময় মূল্যবান। কিন্তু পোকা হিসেবে তার জীবন ছিল কিছু মুহূর্তের সমষ্টি―একটি প্রজাপতির সাথে মিলন, এক ফোঁটা বৃষ্টির স্বাদ, তারপর সব শেষ। এখন ঘড়ির কাঁটা তার বুক ফুটো করে দিচ্ছে―ভবিষ্যৎ নামক সেই ভূতটা কি আসলেই তার পিছু নিয়ে নিল?
অফিসে যাবার জন্য তাকে আবারও তাগাদা দেওয়া হলো। সে মানুষের কিছু পোশাক গায়ে চাপিয়ে বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। তার শীত লাগতে শুরু করল। চারপাশ ছেয়ে রয়েছে ঘন কুয়াশায়। কিন্তু ঘুমোনোর আগেও সে এসবের পরোয়া করেনি। মানুষের জীবন তাহলে এতটা কঠিন? তাদের জীবনে এত শীত? এই কাঠিন্য, এই শীতই কি তাদের কালের পরিক্রমায় এমন নির্মম করে তুলেছে?
ত্রপান ইলাই কোথায়, কোন দিকে যাবে কিছু বুঝতে পারছে না। সেই সাথে পদে পদে হোঁচট লেগেই রয়েছে। রাস্তা পেরোবার নিয়ম জানা নেই, মানুষের সাথে ধাক্কাধাক্কি। মানুষগুলো তাকে দেখছেও কেমন বিচিত্র দৃষ্টিতে, যেন সে কোনও সার্কাস প্রদর্শন করছে।
ত্রপান ইলাই একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। সে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাকে অফিসে যেতে হবে। অফিসের ঠিকানা তার জানা নেই। আপাতত পকেটে থাকা কাগজপত্রগুলো ঘেঁটে দেখা যাক।
২. দশম দিন
আজ ছুটির দিন। সকাল থেকেই কেমন এক অবর্ণনীয় অবসাদ ত্রপান ইলাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। একঘেয়ে কণ্ঠের এক পাখি বিরামহীনভাবে ডেকে ডেকে মনকে আরও উদাস করে দিচ্ছে।
ত্রপান ইলাই বাড়ি ছেড়ে পথে নেমে এল। এই নিঝুম দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছে গেল একটা গাছপালায় ছায়াচ্ছন্ন স্থানে। স্থানটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। সামনে একটা ছোট গেটও আছে। সে গেট খুলে ভেতরে প্রবেশ করল।
কবরস্থান। সে চলে এসেছে কোনও কবরস্থানে। একটি কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করল, মানুষের মৃত্যু কী। পোকার মৃত্যু ছিল পাতার উপর উল্টে পড়া, এক প্রকার প্রাকৃতিক সমাপ্তি। কিন্তু এই পাথরের ফলকগুলো দেখে সে নিজের গভীরে কোথায় যেন এক ধরনের কাঁপন অনুভব করল―এখানে নাম-তারিখ লেখা আছে। সে কি এখন শুধুই একটা নাম, একটা পরিচয়ের বোঝা? সে যখন পোকা ছিল, জীবন ছিল সরল রেখার মতো―ডানার স্পর্শে পাতার রস, অন্ধকারে আলোর টান―এসব। এখন একটু একটু বুঝতে পারছে, মানুষের জীবনে প্রতিটি নিঃশ্বাসই অজস্র প্রশ্নের এক জটিল সমীকরণ।
সে প্রগাঢ় এক মনোযন্ত্রণা বোধ করল। তার পেছনে এখন আর সেই স্বচ্ছ ডানা নেই, যে বাতাসকে ছেদ করে ভেসে যেত নিখুঁত ভঙ্গিতে। এখন দুই হাত দিয়ে সে পৃথিবীকে ছুঁয়ে দিতে পারছে। পোকার জীবনেও কি তার মধ্যে এমন দ্বিধা ছিল? যখন আগুনের লেলিহান শিখায় ঝাঁপ দিত, তখন কি কখনও সে ভেবেছিল ‘পোড়া’ আর ‘প্রজ্বলিত’ হবার মধ্যকার পার্থক্য? পোকার জীবন কেটে যেত ঋতুচক্রের এক ফাঁকে। এখন সে উপলব্ধি করছে প্রতিটি মুহূর্তের হিসেব। সে যখন কীট ছিল, তখন মৃত্যু ছিল শুধু একটি প্রাকৃতিক সমাপ্তি; এখন মৃত্যু ভাবনাই হয়ে দাঁড়াচ্ছে এক অস্তিত্ববাদী যন্ত্রণা। পতঙ্গ থেকে পথিক হবার জন্য মূলত যে মূল্য দিতে হচ্ছে, তা হলো―ডানা ভেঙে পাওয়া দুই হাত, যে হাতে এখন শুধু প্রশ্নের ভার, কোনও উত্তর নেই। মানুষের জীবনে হয়তো কোনও উত্তর থাকে না, এখানে প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড় সত্য।
কবরগুলোর আশেপাশে আগাছার মতো জন্মে আছে কিছু কণ্টিকারী গাছ। গাছে গাছে হলুদ ফুলের সমারোহ। কয়েকটি ফুলকে ঘিরে একটি প্রজাপতি উড়ছে। ত্রপান ইলাইয়ের মনে হলো, প্রজাপতিটি যেন কৌতুহলী দৃষ্টি মেলে তাকে দেখছে। সেও নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল প্রজাপতিটির দিকে। প্রজাপতির চোখে কি সে নিজের পুরোনো জীবন খুঁজছে? প্রজাপতিটিও কি তাকে দেখে ভাবছে―এই ভারী প্রাণিটার ডানাওয়ালা হবার স্মৃতি আছে!
ত্রপান ইলাই কিছু ভাঙাচোরা দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপা দিয়ে কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এল।
৩. শততম দিন
প্রতিদিন সকালে ত্রপান ইলাইয়ের ঘুম ভাঙে এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে―জীবন কি শুধুই সেই নৈমিত্তিক যাপনের পুনরাবৃত্তি, যার কোনও শেষ নেই? অফিসের লিফটে দাঁড়িয়ে সে হঠাৎ বোঝে―সেও প্রতিদিন একই পাথর গড়ায়, শুধু পাহাড়ের বদলে আছে কংক্রিটের ইমারত। সে বিদ্রোহ করে, অতএব সে অস্তিত্বশীল।
কিছুদিন আগে তার একটা প্রেম হয়েছে। গতরাতে প্রেমিকার সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে হঠাৎ সে ভেবেছিল―এই যে তারা বলছে, চিরদিন এক সাথে থাকবে, অথচ দুজনেই জানে মৃত্যুই একমাত্র নিশ্চিত সত্য। তাহলে এই মিথ্যে বলার অর্থ কী? কে জানে, এই অসঙ্গতিই হয়তো প্রেমের সৌন্দর্য। সে তো আগে শুধু জানতো আলোর দিকে উড়ে যাওয়া―এখন শিখেছে হৃদয় নামক অন্ধকার গুহার দিকেও কখনও উড়াল দিতে হয়। আর সেখানে কোনও পাখা কাজ করে না।
ইদানীং তার ঘুম হয় না। গত দুদিন ধরে ঘুমের ঔষধ খাওয়া শুরু করেছে। ফার্মেসি থেকে ঘুমের ঔষধ কিনতে গিয়ে দেখল, এক যুবক জিজ্ঞেস করছে, কোনটায় বেশি ঘুম আসে? তার চোখে সেই একই প্রশ্ন―জীবন কি এতটাই অসহ্য যে মানুষ ঘুমকেই মৃত্যুর বিকল্প ভাবে? এ জীবন কি পলায়নের জীবন নয়? মানুষ স্বাধীন বলেই কি দিশেহারা আর দিগ্ভ্রান্ত?
আজ সে পথের ধারে এক ভিক্ষুককে টাকা দিতে গিয়ে উপলব্ধি করল, কাজটি কেবলই একটি অর্থহীন বিশ্বে অর্থপূর্ণ হবার নিরর্থক চেষ্টা। তবু এই ছোট্ট নৈতিকতাই হয়তো শেষ পর্যন্ত মানুষের অস্তিত্বের একমাত্র বৈধতা। অস্তিত্বের অর্থ পাথর গড়ানো নয়, পাথরকে গড়ানোর সময় নিজের ভেতর যে সঙ্গীত সৃষ্টি হয়―সেই অবৈধ সুন্দরের সন্ধান করা। একই সাথে অস্তিত্বের সমস্ত ভার বহন করা―প্রশ্ন করতে শেখা, ভয় পেতে শেখা, আর সেই ভয়ের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে নেয়া। অস্তিত্ব, প্রকৃতপক্ষে কোনও সমাধান দেয় না, শুধু প্রশ্ন করতে শেখায়। আর এই প্রশ্ন করার মধ্যেই নিহিত আছে মুক্তির বীজ। কিন্তু মানুষের জীবনে কি মুক্তি বলে আদৌ কিছু রয়েছে? এই জীবন তো সমাজ-সংসারের গেঁড়াকলে বাঁধা, যেখানে পদে পদে দায়িত্ব আর দায়ভারের প্রসঙ্গ।
মাঝে মাঝে তার পোকার জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে যেখানে জীবন চলতো সরল গতিতে। তার ডানার গুঁড়ো এখনও হয়তো লেগে আছে এই মানবচর্মের নিচে। রাতের নিস্তব্ধতায় কখনও কখনও তার মনে হয়, যদি খুব জোরে হাত ঝাপটায়, তাহলে হয়তো আবার ফুটে বের হবে সেই স্বচ্ছ পাখা―যা তাকে নিয়ে যেতে পারে ওই ফুলটির দিকে, যেখানে এখনও তার লার্ভা অবস্থার স্বপ্ন আটকে আছে এক ফোঁটা অমৃতে। কিন্তু অতীত আঁকড়ে ধরে রাখলেও সেখানে ফেরা হয় না―ফেরা যায় না।
৪. সম্ভবত তিনশত চুয়ান্নতম দিন
ত্রপান ইলাইয়ের মাথায় ইদানীং সারাক্ষণ আত্মহত্যার চিন্তা চলে। কী এক অদম্য বেদনা, জীবনের দুর্বিষহ ভার তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে প্রতিনিয়ত। জন্ম ও রূপান্তরিত পুনর্জন্মের টানাপোড়েন তাকে জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তুলেছে। প্রতিদিন পাথর ঠেলে জীবনের পৌনঃপুনিক চক্র ঘোরাতে ঘোরাতে সে বিপন্ন বোধ করে। আজ সে রাস্তায় এক তরুণীকে বলতে শুনল―জীবন এত জটিল কেন?
সে মেয়েটির জুতার ফাঁকে লুকিয়ে থাকা একটি পিঁপড়েকে প্রশ্ন করল তাদের পুরোনো ভাষায়, তুমি কি কখনও তোমার পায়ের নিচের ঘাসটাকে ‘জটিল’ মনে করো?
পিঁপড়েটি মাথা নেড়ে জানান দিল―সে এখনও সরলতার রাজ্যে বাস করে।
তার এই উত্তর ত্রপান ইলাইকে আরও বেশি বিমর্ষ করে তুলল। সে হয়তো একমাত্র প্রাণি যে দুটি পৃথিবীর সীমানায় দাঁড়িয়ে―যার এক পা পোকাদের রাজ্যে, এক পা মানুষের সভ্যতায়। আর এই বিভক্তিই তার একমাত্র স্বর্গ, একমাত্র নরক।
পোকা থেকে মানুষ হবার এই ক্লান্তিকর যাত্রা, এক দিকে যেন আকাশের মতো অনন্ত, অন্যদিকে যেন প্রতিটি পদক্ষেপে এক একটি নিঃশব্দ যুদ্ধ। পোকার জীবনে সে যখন পৃথিবীর মাটিতে ঘুরে বেড়াত, তখন তার চোখে আকাশ ছিল ছোট, পৃথিবী ছিল এক নিঃশেষিত বলয়, যেখানে কেবল বেঁচে থাকার জন্যই কষ্টের ঘর বাঁধতে হতো। কিন্তু একদিন, সে যখন মানুষ হয়ে উঠল, তখন বুঝতে পারল পৃথিবী এত বড়, আকাশ এত বিশাল, অথচ তার অস্তিত্ব সেই ক্ষুদ্র স্থান থেকে নতুন এক উপলব্ধির দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে।
মানুষ হয়ে ওঠার পর, জীবনের প্রতি এক অদ্ভুত দৃষ্টিকোণ তৈরি হয়েছে তার। পোকার জীবনে বেঁচে থাকাটাই ছিল একমাত্র উদ্দেশ্য, কিন্তু মানুষের চোখে বেঁচে থাকা মানে কী? অস্তিত্বের ভিত্তি কি কেবল বেঁচে থাকা, না-কি তা অপেক্ষাও আরও কিছু রয়েছে? প্রশ্ন একে একে ভর করে হৃদয়ের গহিনে, তাকে ভেঙেচুরে দুমড়ে-মুচড়ে দিতে চায়। অস্তিত্বের গভীরে, জীবনের আড়ালে যেন একটি অনন্ত অনুসন্ধানরত মন তার। প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক অচেনা পথের দিকে নিয়ে যায়, যেখানে এক দিকে অন্ধকার, অন্যদিকে আলো―আর মাঝে মাঝে ভেতরে এক নিঃসঙ্গ শূন্যতা।
জীবন মানে তো শুধু খাদ্য ও আশ্রয় নয়। জীবন মানে অনুভব করা, পৃথিবীকে এক নতুন চোখে দেখা। পোকা যখন নিজেকে বুঝতে পারে না, সে তখন অনুভবের সীমিত জগতে বন্দি থাকে। কিন্তু মানুষ হয়ে, সে অনুভব করতে শেখে আরও গভীরভাবে―আত্মার তাগিদ, মানসিকতার নিত্য পরিবর্তন, মনের অভ্যন্তরের দুঃখ-কষ্ট এবং আনন্দের সমন্বয়ে জীবন বুঝে ওঠার এক নতুন পথ খুঁজে পায়।
তবে এই পথ কি কখনও শেষ হবে? না―মনে হয় না। অস্তিত্বের প্রশ্ন কখনও শেষ হয় না, কারণ জীবন শুধু চলতে থাকে। প্রতিটি পদক্ষেপে নতুন কিছু শিখে, কিছু ভুলে, কিছু উপলব্ধি করে, জীবনের অস্থিরতার মাঝে শান্তি খোঁজার একটা অবিরাম যাত্রাই মানবজীবন।
পোকা থেকে মানুষ হওয়া, এক বিস্ময়কর যাত্রার গল্প। এক সময় সে ছিল ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র, পৃথিবীর উপেক্ষিত কোনও কোণে নিজেকে গোপন করে রাখতে হতো সর্বক্ষণ। সে সময়ে জীবন ছিল এক অন্ধকারে ডুবে থাকা ঘোর, অনুভূতিহীন এক অস্থিরতা। তবে কেমন করে যে সেই অন্ধকার থেকে সে বেরিয়ে এসেছে, তা কিছুতেই স্পষ্ট হয় না। মাঝে মাঝে তার মনে হয়, একদিন হঠাৎ করেই সেই অন্ধকার ভেঙে আলো জ্বলে উঠল―কিংবা হয়তো সরলতার আলো ত্যাগ করে জীবনের জটিল সব ধাঁধার অন্ধকার আড়ালে সে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হলো। সে এখন একজন মানুষ, এক পূর্ণাঙ্গ জীব, নানা প্রশ্নের মাঝে।
কিন্তু জীবনের প্রশ্ন, অস্তিত্বের প্রশ্ন―এসব সহজে মেটে না। কীভাবে সে এখানে? কেন সে অনুভব করে? তার এই চিন্তাক্ষমতা, এই অস্তিত্ব―এসব কি প্রকৃত, না-কি একটি মিথ্যা ঘোর? হয়তো পোকা থাকাকালীন সে জানত না, কখনও কোনও প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু এখন, মানুষ হয়ে, একে একে প্রশ্নগুলো তার সত্তায় মাথাচাড়া দেয়।
যতই সে এগিয়ে যায়, ততই যেন বিস্ময়ের গভীরে ডুবতে থাকে প্রাচীন কোনও নগরীর ঘ্রাণ শরীরে মেখে। জীবন কি শুধু প্রজনন আর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই? নাকি কিছু গভীর অর্থও লুকিয়ে আছে, যা সে অনুধাবন করতে পারে না? এসব প্রশ্নের কোনও সঠিক উত্তর নেই, হয়তো কখনও পাওয়া যাবে না। তবু, সে জানে, এই প্রশ্নগুলোর মধ্যেই জীবনের আসল রূপ লুকিয়ে আছে। জীবনের অর্থ হয়তো এমন একটি সফর―যা শুধু প্রশ্নের মাঝে সম্পূর্ণ হয়, এবং সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া নয়, বরং সেই প্রশ্ন করতে পারার পথটাই আসল।
অস্তিত্বের অনুভূতি কি কখনও পূর্ণাঙ্গ হতে পারে? না-কি এটি একটি অসমাপ্ত অসম্পূর্ণতা, যা সব সময় কিছু না কিছু চায়, কিন্তু কখনওই পূর্ণতা পায় না? একে একে ধ্বংস হতে থাকা মুহূর্তগুলোর মাঝে সে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করে―মানুষ শুধু অস্তিত্বের ভেতরে বেঁচে থাকার লড়াই করে, আর এই লড়াইটাই জীবন, এই যাত্রাই মানুষের যাপন।
এই সব অন্তর্দ্বন্দ্ব নিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে হয়ে আর বেঁচে থাকা যাচ্ছে না। ত্রপান ইলাই সিদ্ধান্ত নিল, সে গ্রেগর সামসার সাথে দেখা করবে। এরপর নিজের করণীয় স্থির করবে।
৫. দিনক্ষণের হিসেব নেই
চেক রিপাবলিকের ভিসা পেতে ত্রপান ইলাইকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হলো। এই কাঠখড়ের ধূম্রজালে আটকা পড়ে থেকে থেকেই তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, প্রবল হচ্ছিল আত্মহত্যার প্রবণতা। নিজের এই অনিশ্চিত ঝোঁকের সাথে এখনও সে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এখন গভীর রাত। রাত্রির চক্কর খেতে থাকা প্রলম্বিত প্রচ্ছায়া যেন তার কানে কানে ফিসফিস করে জানিয়ে যাচ্ছে, সে সেই প্রজাপতি যে নিজের রূপান্তরকে বিশ্বাস করতে পারছে না―এখনও প্রতি রাতে সে খুঁজে ফেরে সেই অতীত, যা হয়তো কখনওই ছিল না।
আগামীকাল রাতে তার ফ্লাইট। সেই উপলক্ষে আজ তার বড় বোন (?) এসেছিল বাড়িতে তাকে বিদায় জানাতে। সবাই যখন খোশগল্পে মশগুল, বড় বোনের ছেলেটি এক ফাঁকে তাকে জিজ্ঞেস করল, পোকামাকড় কি কাঁদতে পারে?
সে বলল, তারা কাঁদে বৃষ্টির মতো―সম্পূর্ণ শরীর দিয়ে, কিন্তু কেউ টের পায় না কারণ তাদের চোখ নেই।
মানুষ হবার পর প্রথম দিন যে মানুষটি সকালে তাকে অফিসে যাবার জন্য তাগাদা দিচ্ছিলেন, তিনি তার মা―এ কথা সে বুঝতে পেরেছে সেদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে আসবার পরে। এছাড়া বাড়িতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত এক বৃদ্ধও রয়েছেন যিনি তার বাবা। তারা দুজনেই তার ওপর ভর করে বেঁচে রয়েছেন।
সে কতদিনের জন্য দেশের বাইরে যাচ্ছে, কবে ফিরবে এসব ব্যাপারে কাউকে নিশ্চিত করে কিছু জানাতে পারছে না, যে কারণে মা বেশ চিন্তিত। তা ছাড়া, তাকে সে বলেছেও যে, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যাচ্ছে। অফিসের কথা বললে হয়তো কারও কোনও উদ্বেগ থাকত না। মানুষের জীবনে এসে সে তিলে তিলে উপলব্ধি করছে, এখানে সকল প্রাণ সংযুক্ত, একই সুতোয় বাঁধা। সেই সুতোর নাম স্বার্থ। এখানে কোনও ভালোবাসা যে নেই, তা নয়। তবে সেই ভালোবাসার মাত্রা নির্ভর করে নির্ভরশীলতার ওপরে।
প্রেমিকার সাথে তার বিচ্ছেদ হয়েছে মাসখানেক আগে। সেখানেও কি স্বার্থ ছিল কোনও? তবে সে বিচ্ছেদের পর আয়নার সামনে দাঁড়ালেই যে ঝলসে উঠত মেয়েটির কবিতার মতো বিষন্ন দুই চোখ, বুকের ভেতর চিনচিনে এক ব্যথার তরঙ্গ বইত, গান শুনে মন উদাস হতো―সবই কি অর্থহীন এক অভ্যাস?
বিচ্ছেদে মেয়েটির কোনও দোষ ছিল না। নিজের ভেতরকার টানাপোড়েন আর দ্বন্দ্বের দ্বৈধে দোল খেতে খেতে সে যখন আরও বেশি আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠল, নিজেকে নিঃশেষ করে দেবার চিন্তায় যখন সে আচ্ছন্ন ও ঘোরগ্রস্ত, তখন সে নিজেই এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল। মানুষের সবচেয়ে বড় স্বাধীনতা কি এই―নিজেকে নিঃশেষ করে দেবার ক্ষমতা? সেক্ষেত্রে বলতে হয়, মানুষ নিজের মহত্ত্বের দ্বারা অভিশপ্ত।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব―এই কথার মধ্যে যেমন গৌরব আছে, তেমনই আছে এক নিঃসঙ্গ অভিশাপ। মানুষের স্বাধীনতা, চিন্তার মুক্তি, মানুষের বিবেকের জাগরণ―সবই যেন এক দোলাচলের উৎস। একদিকে এগুলো মানবজাতিকে মহত্ত্বের শিখরে পৌঁছে দেয়, অন্যদিকে টেনে নিয়ে যায় বিভ্রান্তির অতল গহ্বরে।
স্বাধীনতা মানুষকে দিয়েছে চিন্তার মুক্তি, দিয়েছে বেছে নেবার অধিকার। কিন্তু আবার এই বেছে নেবার ক্ষমতাই মানুষকে এনে দিয়েছে দ্বিধা, দ্বন্দ্ব ও দায়িত্বের অসীম ভার। কোথায় যাবে, কী বেছে নেবে, কোন পথ সঠিক―এই প্রশ্নগুলো তাকে প্রতিনিয়ত ক্লান্ত করে তোলে। অন্য প্রাণিরা যেমন নিয়ম আর প্রবৃত্তির পথে চলে, মানুষ তেমন নয়। সে প্রশ্ন তোলে, সন্দেহ করে, আর তার এই প্রশ্নই তাকে অস্থির আর বিরামহীন করে তোলে নিজের মনের কাছে―যা একসময় তাকে করে তোলে একা, ক্লান্ত ও ভেতর থেকে শূন্য।
এই শূন্যতা কখনওই পূর্ণ হয় না। কারণ মানুষ নিজের মহত্ত্ব দিয়ে যেমন আকাশ ছুঁতে চায়, তেমনি সে অনুভব করে―তার গন্তব্য অনিশ্চিত। তার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু সে জানে না কোথায় থামতে হবে। তার মহত্ত্ব আছে, কিন্তু শান্তি নেই। এভাবেই মানুষ যেন নিজেরই সৃষ্ট স্বাধীনতা ও মহত্ত্বের জালে আটকে পড়ে রয়েছে। সে মুক্ত হয়েও বন্দি। সে শক্তিশালী হয়েও ভেতরে ভেতরে ভাঙতে থাকা, ক্ষরিত হতে থাকা এক দিগ্ভ্রান্ত আত্মা। তার মুক্তির মধ্যে, স্বাধীনতার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তার চিরন্তন অভিশাপ।
ত্রপান ইলাই এসব ভাবনার জাল থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সারারাত তার ঘুম এল না এক মুহূর্তের জন্যও।
৬. প্রাগে প্রথম দিন
গ্রেগর সামসার বাড়ি খুঁজে পেতে তেমন ঝামেলা হলো না। মানুষ থেকে পোকা হয়ে যাবার এমন দৃষ্টান্ত আর একটি নেই। কাজেই এখানকার সবাই তাকে এক নামে চেনে। প্রথম জনকে জিজ্ঞেস করতেই বাড়ির ঠিকানাসহ কীভাবে সেখানে যেতে হবে সেই নির্দেশনা দিয়ে দিল। ত্রপান ইলাই লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে গ্রেগরের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হলো।
দরজায় অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পরে দরজা খুলে দিলেন এক ধুমসি মহিলা। চোখে প্রশ্ন নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ত্রপান ইলাই ইতস্তত কণ্ঠে জানাল যে, সে গ্রেগরের সাথে দেখা করতে এসেছে।
মহিলা রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেন তৎক্ষণাৎ এবং ক্রুব্ধ স্বরে গ্রেগর সামসার পিণ্ডিপাত করতে লাগলেন। মহিলার বক্তব্যের মূল কথা হলো, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এমন অবিবেচকের মতো কীভাবে পোকা হয়ে যেতে পারল? পরিবারের কথা সে একবারের জন্যও কেন চিন্তা করল না?
ত্রপান ইলাই বুঝতে পারল এই মহিলা গ্রেগরের মা। সে তাকে শান্ত হবার জন্য সময় দিয়ে মনে মনে প্রমাদ গুনতে লাগল। ছেলের প্রতি মহিলার যে দুর্দমনীয় আক্রোশ তাতে তিনি তাকে শেষ পর্যন্ত গ্রেগরের সাথে দেখা করতে দিতে রাজি হবেন কি না সেই ব্যাপারে তার এখন যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে।
কিন্তু তিনি রাজি হলেন। গ্রেগরের ঘরের দরজা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, যাও, বাপু, তুমি নিজে যা পারো করোগে। আমি ওই বদমাশটার মুখও দেখতে চাই নে।
ত্রপান ইলাই ধীরে ধীরে দরজা খুলে গ্রেগরের ঘরে প্রবেশ করল। এক অদ্ভুত ধূসর কক্ষে জানালার ফাঁক গলে ম্লান আলো ভেতরে ঢুকে পড়েছে। গ্রেগর সামসা, তার বিকৃত শরীর নিয়ে একটি ছায়ায় বসে আছে। ত্রপান ইলাইকে ভেতরে আসতে দেখে তার চোখে বিস্ময়, মুখে কিছুটা বেদনার রেখা খেলা করতে লাগল। তার দিকে নির্নিমেষে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সহসা গ্রেগর বলে উঠল, তুমি কে? মানুষের চেহারা, কিন্তু শরীরে অদ্ভুত কেমন যেন চেনা গন্ধ।
ত্রপান ইলাই বলল, ঠিকই ধরেছ, আমি এক সময় পোকা ছিলাম। গন্ধটা এখনও রয়ে গিয়েছে। তবে আমি এখন মানুষ। ধীরে ধীরে এই রূপ পেয়েছি।
গ্রেগর থতমত হয়ে বলল, মানুষ হয়েছ? যেখানে আমি―আমি তো মানুষ ছিলাম, আর এক সকালে জেগে দেখি―পোকায় পরিণত হয়েছি।
আমার ক্ষেত্রে ঠিক উল্টোটা ঘটেছে। আমি জন্মেছিলাম পোকার জীবন নিয়ে। অকস্মাৎ একদিন দেখলাম মানুষের শরীরে আটকা পড়েছি। এরপর নিজেকে গড়েছি, মানুষের ভাষা শিখেছি, মন বোঝার চেষ্টা করেছি।
তবে? তবে মানুষ হয়ে কী পেয়েছ? সম্মান? ভালোবাসা? স্বাধীনতা?
সে এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল, না। বরং পেয়েছি বিচ্ছিন্নতা, আত্মদ্বন্দ্ব, জীবনের টানাপোড়েন আর দায়িত্বের শৃঙ্খল। তুমি?
আমি মানুষ ছিলাম। কাজ করতাম, সংসার চালাতাম। তবু একদিন সবাই মুখ ফিরিয়ে নিল। শরীর বদলালো বটে, কিন্তু যা ভাঙল―তা ছিল বিশ্বাস, সম্পর্ক, আর নিজের অস্তিত্ব।
তুমি কি মনে করো, আমরা উল্টো পথে হাঁটলেও একই ফল পেয়েছি?
হয়তো। হয়তো মানুষের রূপ নয়, মনটাই আসল। তুমি মানুষ হয়েও একা, আবার আমি পোকা হয়েও নিঃসঙ্গ। এখন তোমার সঙ্গ পেয়ে একটু শান্তি পাচ্ছি।
আমার ভেতরকার অন্তর্দ্বন্দ্ব আমাকে ঘুমোতে দেয় না, বিজাগতিক এক অস্থিরতায়, বিপন্নতায় দোল খাই সারাটি ক্ষণ। আত্মহত্যার চিন্তা বিষাক্ত কর্কটের মতো আমার মস্তিষ্কে জেঁকে বসেছে। এ থেকে আমার পরিত্রাণ কোথায়, গ্রেগর?
মৃত্যুতেই একমাত্র পরিত্রাণ।
কিন্তু তোমার মতোই আমিও সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমি আত্মহননের পন্থা বেছে নিলে সেটাও হবে পরিবারের বিশ্বাস ভাঙার মতো, সম্পর্ক, দায়িত্ব আর অস্তিত্ব থেকে স্বার্থপরের মতো মুখ ফিরিয়ে নেওয়া। তোমার পরিবার তোমার সাথে যা করেছে, নিজের পরিবারের সাথে সেটা করা কি আমার উচিত হবে?
না। এ মানবতাকে হত্যা করা।
তবে?
গ্রেগর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বিষাদময় কণ্ঠে বলল, তুমি কাফকার সাথে দেখা করো। তিনি হয়তো তোমাকে কোনও পথ বাতলে দিতে পারবেন।
৭. কাফকার সাথে দেখা
ত্রপান ইলাই যখন কাফকার সাথে দেখা করতে গেল তখন তিনি অসুখে শয্যাশায়ী। ডোয়ার ডায়ামান্ট কিছুতেই তাকে তাঁর সাথে দেখা করতে দেবেন না। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি অস্ট্রিয়ায় চলে যাবেন কিয়ারলিং স্যানেটোরিয়ামে চিকিৎসার জন্য। তাঁর যক্ষ্মা এখন মারাত্মক পর্যায়ে। উপায়ান্তর না দেখে ত্রপান ইলাই ডোয়ার ডায়ামান্টকে নিজের জীবনের ঘটনা খুলে বলল। তারপরেও তিনি সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকে নিরীক্ষা করে অবশেষে রাজী হলেন। তবে বারবার করে তাকে নিষেধ করে দিলেন, ফ্রানৎসকে যেন কথা বলতে না দেওয়া হয়। সে নিজের বক্তব্যটুকু পেশ করেই যেন তাঁকে একা ছেড়ে দেয়।
সে সম্মতি জ্ঞাপন করে কাফকার ঘরে প্রবেশ করল। তিনি বিছানায় শুয়ে ছিলেন। হাড্ডিসার শরীর, ফ্যাকাসে মুখ, থেকে থেকেই কাশি হচ্ছে। চোখ দুটি নীমিলিত। কাশির শব্দ বাদ দিলে, হঠাৎ দেখে মনে হবে একটি নিথর শব শুয়ে রয়েছে।
সে একটি চেয়ার টেনে নিয়ে তাঁর বিছানার পাশে বসল। চেয়ার টানতে গিয়ে শব্দ হয়ে গেল। সেই শব্দ শুনেই হয়তো তিনি চোখ মেলে তাকালেন। মানবচক্ষুর কোটরে যেন জ্বলজ্বল করছে কোনও জীবন্ত প্রেতের আশাহত দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতেও প্রশ্ন ফুটে উঠল।
ত্রপান ইলাই সংক্ষেপে তার জীবনোপাখ্যান প্রকাশ করল। তিনি মনোযোগ দিয়ে সব শুনলেন। এরপর টেবিলের দিকে আঙুল নির্দেশ করলেন।
তিনি যে কাগজ-কলম চাইছেন তা বুঝতে ত্রপান ইলাইয়ের কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল। যখন বুঝতে পারল, শশব্যস্ত হয়ে কাগজ-কলম নিয়ে কাফকার দিকে এগিয়ে দিল।
কাফকা কাঁপা হাতে কিছু একটা লিখতে লাগলেন। কী লিখছেন তা সে অপর দিক থেকে বুঝতে পারছে না, তবে ফ্রানৎসের লেখা শেষ করতে দীর্ঘ সময় লাগল। এরপর তিনি কাগজটি তার দিকে এগিয়ে দিলেন। সেখানে লেখা―তুমি নিজেকে শেষ করে দিও না। সবই মানবজীবনের প্রাপ্তি যার জন্য জগতের প্রতিটি প্রাণ লোভাতুর হয়ে থাকে আর তা ছাড়া, প্রতিটি মানুষই মাতৃগর্ভের অন্ধকারে একটা পর্যায় পর্যন্ত পোকা অবস্থাতেই থাকে। গ্রেগরের সাথে আমি অন্যায় করেছিলাম। তার প্রতিদানই হয়তো পাচ্ছি। আর কোনও পাপের ভার বহন করার শক্তি আমার নেই। শোনো, জীবন মৃত্যুর মতোই সুন্দর। তবু এই জীবন যদি তোমার কাছে নিতান্তই দুর্বহ বলে মনে হয়, তবে তুমি লেখো। মানুষ হয়ে ওঠার বেদনা লেখো। আর মনে রেখো―প্রতিটি মানুষই একেকটা পোকা ছিল কোনও না কোনও সময়।
পড়া শেষ করে সে দেখল, ফ্রানৎস আবার চোখ বন্ধ করেছেন। সে নিঃশব্দে তাঁর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। ডোয়ার ডায়ামান্টের কাছে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ প্রকাশ করে নেমে এল খোলা আকাশের নিচে।
হ্যাঁ, কাফকা ঠিকই বলেছেন―তাকে লিখতে হবে। লিখতে হবে নিজের কথা, জনমানব ও জনহীনতার কথা। লিখতে হবে ব্যথা-বিনিদ্রা-বিষাদ ও বিপন্নতার কথা। নিজেকে নির্ভার করার, জগতের সমুদয় প্রাণের দুঃখ-কষ্টে ব্যথিত হবার এবং একই সাথে তা থেকে মুক্তি পাবার জন্য লেখার মতো শক্তিশালী এবং আলোকিত মাধ্যম আর কিছুই হতে পারে না।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ