
কী বিষয় নিয়ে লিখব, ভাবছিলাম। ভাবনারা এলোমেলো হয়ে ছুটোছুটি করছিল মন-আকাশে। কিছুতেই রুল টানা কাগজে একটা অক্ষরও লিখতে পারছিলাম না, আমি এক নবীন লেখক।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে… বাঁ হাত দিয়ে মাথা চুলকাচ্ছিলাম। হঠাৎ কলম নড়ে উঠল। বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের তৃতীয় বর্ণ ‘গ’ লেখার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ‘গল্প’ শব্দটা উড়ে এসে জুড়ে বসল খাতায়। কীভাবে ঘটল এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা!
ভাবনার ঘোরে থেমে আছি। শূন্য চোখে চেয়ে আছি খাতার দিকে। আবার যে কলম চালাব তার তাড়নাও পাচ্ছি না।
‘থেমে আছো কেন?’
হকচকিয়ে গেলাম। কে প্রশ্ন করল? ভেতর থেকে ভয় মোচড় দিয়ে উঠলেও মুখ ফুটে কিছুই জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। বাকরুদ্ধ হয়ে আছি, কলমও অনড় হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখলাম ‘গ-ল-হসন্ত-প’-এর বর্ণ আর যতিচিহ্ন ফুঁড়ে আলোর তরঙ্গ বেরিয়ে আসছে।
আলোর কণারা শব্দতরঙ্গে বদলে গিয়ে জোরালোভাবে বলতে লাগল, ‘কলম চালাও, লিখতে থাকো। আমাকে সৃষ্টি করতে বেশি মাথা ঘামানোর দরকার নেই। তোমার মেধা আর কল্পনার জগৎ থেকে উড়ে উড়ে আসতে থাকবে শব্দ-বাক্য, নানা কাহিনিতে ভরে উঠবে তোমার খাতা।’
বুঝলাম অলৌকিক কোনও শক্তিবলে মস্তিষ্কের ভাণ্ডারে লুকানো অক্ষরমালার ভেতরই গল্পের দেহ-মন সৃষ্টি হয়ে গেছে; জেগে উঠেছে মানুষের মতো। জবানও খুলে গেছে! কী সে শক্তি? প্রশ্ন উড়ে এল মনে।
‘এত সব ভাবারও কোনও দরকার নেই। আমিই গল্প, এখানে উপস্থিত হয়েছি তোমার মনের টানে, তোমার গল্পবন্ধু হয়ে। কাহিনি বা গল্প বলা এক বিষয় আর আমাকে নির্মাণ করা আরেক বিষয়। শত-সহস্র মানুষ গল্প বলতে পারে, লিখতে পারে ক’জন?’
‘আমি কি পারব? আমি তো এক আনাড়ি। জীবনেও গল্প লিখিনি।’
‘নিজেকে হেয় ভাবছ কেন? নিজের ঐশ্বর্য, মেধাভাণ্ডারের দিকে তাকাও। পজিটিভ হও। নিজের ভেতরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলো, আত্মবিশ্বাসী হও। কলম চালাও। চারপাশ থেকে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে থাকো। তোমার ভেতরে উৎসাহ, আকাক্সক্ষা, চাহিদা আর লেখার তাড়না টগবগ করছে। আমি তা দেখতে পাচ্ছি। ইচ্ছাশক্তিকে জোরালো করো, কলম চালাও।’
‘তোমাকে লেখা বা নির্মাণ করার কোনও কলা-কৌশল তো জানি না আমি।’
‘কিছু কলাকৌশল তো আছে, তবে সবাই সেটা রপ্ত করতে পারে না। কেউ কেউ পারে। মনে হয়েছে তুমিও পারবে। কলাকৌশল ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে ক্রিয়াপদের কালরূপ বিষয়ে ভালোভাবে জানতে হবে, তার যথাযথ ব্যবহার শিখতে হবে। ভাষার ব্যবহারও। শুদ্ধ করে লেখার ঘাটতি থাকলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, দক্ষতা বা কৌশল কেউ কাউকে শিখিয়ে দিতে পারে না, লিখতে লিখতে অর্জন করতে হয়। অগ্রজদের রেখে যাওয়া সমকালীন বা ধ্রুপদী সাহিত্য পড়তে পড়তে চোখ-কান খুলে যাবে। দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।’
‘কী বিষয়ে লিখব?’ ভাবনার ভেতর থেকে তেড়ে ওঠা মূল প্রশ্নটা আবার জিজ্ঞেস করলাম।
‘আদি মানবগোষ্ঠীর যাত্রার শুরু থেকে গল্পের ভাবনা শুরু হয়েছে। প্রতিটি মানুষের সমগ্রজীবন একেকটা বড় আখ্যান, উপন্যাস আর ছোট-বড় অধ্যায়গুলো একেকটা গল্প। জীবনের প্রতিটা বাঁক একেকটি গল্পের প্লট। যাপিত জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা, উত্থান-পতন, চিন্তা-চেতনা, অজানা কৌতূহল, চাওয়া-পাওয়া, জীবন-জীবিকা, আনন্দ-বেদনা, দ্বন্দ্ব- সংঘাত, নিষ্ঠুরতা-হিংস্রতা, ঈর্ষা-হিংসা, ঘৃণা, যুদ্ধবিগ্রহ, বিপ্লব, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, দর্শন, মনস্তত্ত্ব, পারিবারিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসন এবং জীবনের সবকিছুর মধ্যে কিংবা সঙ্গে লুকিয়ে আছি আমি। চোখ-কান খোলা রেখে দেখো, চারপাশ ভালোভাবে প্রত্যক্ষ করো, মনের জানালা তথা পঞ্চইন্দ্রিয় খুলে দাও, দেখবে আপন গতিতে গল্পের আখ্যান সৃষ্টি হয়ে গেছে। লেখার আগ্রহ-উৎসাহের ভিত শক্ত হলে তোমার কলমের নির্দেশে কিংবা কম্পিউটারের কি-বোর্ডে আঙ্গুলের স্পর্শে অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে যাবে।’
‘বাহ। তাহলে তো গল্প লেখা খুব সোজা।’
‘এত তাড়াতাড়ি সব সোজা ভেবো না। লিখতে লিখতে, নিজের লেখার পাঠক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে আগে। অন্যান্য ক্লাসিক উপন্যাস-গল্প পড়ার মধ্য দিয়েও নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে। নিজের সৃষ্টির সমালোচনা করা শিখতে পারলে ভুলগুলো ধরতে পারবে। অদক্ষতা আবিষ্কার করে তা কারেকশন করতে পারবে তখন। লেখালেখির জগতে এগোতে হবে এভাবে। কারও সমালোচনায় দমে যাওয়া চলবে না। সমালোচকদের বন্ধু ভেবে তাঁদের দেখিয়ে দেওয়া ভুলগুলো শুদ্ধ করে নতুন পথ তৈরি করতে হবে। অল্প লিখে তুষ্ট হয়ে সহজে অহংকারী হয়ে যেয়ো না।’
‘ওহ, তুমি তো দেখছি সাহিত্যের ক্লাসিক বোদ্ধাদের মতো কথা বলছ। উপদেশ দিচ্ছ।’
‘যুগে যুগে সমালোচকরা ছিল। কাউকে তারা বর্জন করেছে রাগ-অনুরাগের বশবর্তী হয়ে, কাউকে গ্রহণ করেছে স্বজনপ্রীতির কারণে। কাউকে লেখার গুণে। সাহিত্যের মূলধারার উঁচু চেয়ারে বসে আছে ভেবে, অহংকারী হয়ে উঠবে কেউ কেউ। তারা অন্যকে হেয় করে, তুচ্ছ ভাবে। নিজের লেখা ছাড়া অন্যের লেখাকে ভালো বলতে জানে না। না-পড়ে ভালো লেখাও তারা ছুড়ে ফেলে দিতে চাইবে―এসবের পাশ কাটিয়ে যাওয়া বা ঊর্ধ্বে ওঠা কঠিন। তবু বলে রাখছি, এসব নিয়ে না-ভেবে নিজের মতো লিখে যাও। পরিশুদ্ধ করো নিজের সৃষ্টি, চর্চায় মেতে থাকো, মগ্ন থাকো।’
‘ভয় পেয়ে গেলাম তো!’
‘ভয় পেলে চলবে না। তবে সাহিত্যিক- সমালোচকদের এসব বিষয় জানা থাকা ভালো। তাদের অসম্মান কিংবা অশ্রদ্ধা করা যাবে না। বিষাক্ত সমালোচনায় হতোদ্যম না-হয়ে আপন আলো, মেধা এবং ইচ্ছাশক্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। আগাম উপলব্ধি তোমার ভেতরের হতাশাকে প্রতিরোধ করার কৌশল জোগাবে। মনে রেখো অযৌক্তিক নির্মম সমালোচনা মোকাবিলা করতে না-পারার কারণে অনেক নবীন লেখকের মৃত্যু ঘটে। তবে সমালোচকদের সবকিছুই খারাপ নয়। গঠনমূলক সমালোচনা তোমার ভুলটা ধরিয়ে দেবে। তাঁদের বন্ধু ভেবে তা শোধরাতে হবে। কিন্তু পাঠকই আসল বিচারক। সাধারণ পাঠকের পাশাপাশি নিরপেক্ষ বোদ্ধা পাঠকের উৎসাহ পাওয়াটাও গুরুত্বপূর্ণ। উৎসাহ তোমাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে। ভয় পেয়ো না।’
সাহস বেড়ে যাওয়ায় গল্পবন্ধুকে প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার কি কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, ছোটগল্প লেখার?’
‘কবি-কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি বই লিখেছেন, নাম সাহিত্যের কোনও শর্ত নেই। প্রত্যেক সাহিত্যিক ভিন্ন রকমের শর্তসাপেক্ষেই সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, করে যাচ্ছেন। আপন মেধার গুণে পুরাতন ধারাকে ভেঙে নতুন ধারা তৈরি করবেন লেখক, সাহিত্যের ভেতর থেকে সৃষ্টি করবেন অনন্য ধারা। এভাবে চলতে থাকুক না, অসুবিধা কোথায়? তবে ছোটগল্প নির্মাণ করতে হলে আমার মূল বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে জানতে হবে―সেসব তোমাদের মতো নবীন লেখকরা মাথায় রাখলে ভালো।
‘সহজ করে বুঝিয়ে বলো, প্লিজ।’
‘তাহলে, মনোযোগ দিয়ে শোনো, পৃথিবীতে কঠিন বলে কিছু নেই―সহজ ভাবলে সহজ, কঠিন ভাবলে মহা কঠিন। মূল কথাটা হলো ছোটগল্পে বড় ভাবনার ইঙ্গিত থাকাটা জরুরি, থিম থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ, উজ্জ্বল দিক।’
‘বিশেষ কোনও ফ্রেম বা কাঠামো নির্মাণ করে কি এগোতে হয়?’
‘ভালো প্রশ্ন করেছো। শুরুটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্যের ভাষায় এটাকে বলে এক্সপোজিশন―ভূমিকা বা গল্পের শুরুর বিষয়ে পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা নাটকীয় উপস্থাপনার কথা বলেছেন। শেষটার মধ্যেও চূড়ান্ত পরিণতির বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। গল্প শেষ হওয়ার পরও পাঠকের মনের মধ্যে গুঞ্জরণ চলতে থাকবে। তোমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাই ধরো না কেন―‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। এমন বিষয়টিকে সার্থক গল্পের স্বরূপ হিসেবে তুলে ধরেছেন। শেষে আচমকা একটা চমক দিয়ে পাঠকের চিত্তকে নাড়িয়ে দেওয়ার এই প্রবণতার মধ্যে সাহিত্যের ঐশ্বর্য লুকিয়ে থাকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজেই ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে কি অসমাপ্ত কিছু রেখেছিলেন? অসমাপ্তির কোনও ইঙ্গিত আছে? ‘পোস্টমাস্টার’ কি নৌকার পাল তুলে চলে যাচ্ছেন না? বাস্তবতার নিরিখে তিনি কি জীবনদর্শন দিয়ে যাননি? জীবনঘনিষ্ঠ থিম উপহার দেননি? ‘পৃথিবীতে কে কাহার’ উচ্চারিত বাক্যের মধ্য দিয়ে গল্পের কি একটি শেষ-পরিণতি তৈরি হয়নি? রতন বাড়ির চারপাশে ঘুরছে। আশায় বুক বেঁধে কান্নার প্লাবন বুকের ভেতর দমিয়ে রেখে ঘুরছে আর ঘুরছে―বাবু ফিরে আসতে পারে, এই আশায় শক্তি রতন চরিত্রটিকে সব যুগের অনন্য সৃষ্টিরূপে নির্মিত করে দেয়নি? অর্থের বিনিময়ে মমতার বন্ধনকে কি সে ছিন্ন করেছে? দেয়নি। এখানেই রতন চরিত্র মহান হয়ে বিশ্বসাহিত্যের ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে হিমালয়চূড়ায় উঠে গেছে। বাস্তবতার আলোকে রতন থেকে গেছে আর পোস্টমাস্টার চলে যাচ্ছেন। গল্পের এই মর্মান্তিক শেষ পরিণতির মধ্য দিয়ে পাঠকের নীরব কান্না নীরবেই চলতে থাকবে, যুগ থেকে যুগান্তরে। গল্প শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তার পরিণতি, প্রভাব যুগান্তরের ঐশ্বর্য হিসেবে রয়ে গেছে।’
‘মুগ্ধ হয়ে গেলাম তোমার বিশ্লেষণ শুনে!’
‘কোনও বিষয় আত্মস্থ করতে হলে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়। এটা ভালো। তবে এত সহজে তৃপ্ত আর মুগ্ধ হয়ে গেলে চলবে না, সৃষ্টিশীলতার উত্তরণ ঘটবে না। মুগ্ধতার রোশনি উপহার দেওয়ার জন্য সাধনায় মগ্ন থাকতে হবে, অতৃপ্তিকে তাড়া করতে করতে এগোতে হবে। নাটকীয় উপসংহার তৈরির পাশাপাশি আমাকে নির্মাণ বা গল্পকাঠামো দৃঢ় করতে হলে স্থান-কাল ও ঘটনার মধ্যে ঐক্য মেনে চলতে হবে। মানবজীবনের যে কোনও একটি বিশেষ বিষয়, মুহূর্ত, ভাবনা বা চরিত্রের একটি বিষয় বা দিক উজ্জ্বল হয়ে উঠলে গল্পটি হয়ে উঠবে রসঘন, জীবনঘনিষ্ঠ। রূপক বা প্রতীকের মাধ্যমে অব্যক্ত কথার আড়ালের কোনও বিষয়ের ইঙ্গিত থাকতে হবে। তবে মনে রাখা জরুরি, বাহুল্য বর্জন করতে হবে।’
‘বাহুল্য কীভাবে ধরব?’
‘এক্সপোজিশন বা ভূমিকার পর (যে-বিষয়ে ইতোমধ্যে বলেছি) ঘটনার ভেতর তৈরি হবে কমপ্লিকেশন কিংবা জটিলতা, তার পরের ধাপে আসবে ক্লাইম্যাক্স (থাকলে ভালো, থাকতেই হবে এমন কথা নেই) বা দ্বন্দ্ব-সংঘাত, তারপরেই চূড়ান্ত পরিণতি। এই ধারাটা বুঝতে পারলে প্রেক্ষাপট নির্মাণে বাহুল্য থাকবে না। আগেই বলেছি লেখার পর পাঠক হিসেবে নিজের লেখা বারবার করে, পড়তে পারলে, বাহুল্যটাও নিজের চোখে ধরা পড়বে। শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাস এবং প্লটনির্মাণের বাহুল্য অনেক সময় আমার কাঠামোর মধ্যে দুর্বলতা তৈরি করে দেয়। বর্তমান বিশ্বে বাহুল্যবর্জিত সুসংহত সাহিত্যচর্চা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। দেশের তো বটেই, বিশ্বসাহিত্য পড়তে পড়তে এ বিষয়ে আরও ধারণা লাভ করতে পারবে, গল্পের প্লট নির্মাণে তখন দক্ষ হয়ে উঠবে।’
‘গল্পের প্লট বলতে কী বোঝালে?’
‘প্লট মানে খধহফ ঢ়ষড়ঃ জমির খণ্ডাংশ আর গল্পের প্লট বলতে বোঝায় গল্পের বাঁক, কৌশল, অলংকার, সিকোয়েন্স এসবকে। সার্থক আখ্যান উপস্থাপন করা হয় বিভিন্ন প্লট বা টুইস্টের মাধ্যমে। এজন্যই গল্পের ‘ঢ়ষড়ঃ’-কে গল্পের বা কাহিনির দৃশ্যমান বা ভার্চুয়াল নকশাও বলা যায়। কৌতূহলজাগানিয়া প্লট নির্মাণ পাঠককে টেনে নিয়ে যায়, পড়তে উদ্বুদ্ধ করে, পাঠ-উপযোগী মন ধরে রাখে, মন আকৃষ্ট করে, গভীরে নিয়ে যায়। সার্থক প্লটের ওপরেই গল্পের প্রাণ সঞ্চারিত হয়, শক্ত ভিত রচিত হয়। প্রধান চরিত্রের সঙ্গে মিশে প্লট এগিয়ে নিয়ে যায় গল্পকে। তার অংশীদার হয়ে যান একজন পাঠক।’
‘ধন্যবাদ তোমাকে। তবে সাহিত্যের নানা মতবাদের কথা শুনেছি, মনস্তাত্ত্বিক মতবাদের কথাও। বিষয়গুলো কি জানা খুব জরুরি, সাহিত্য সৃষ্টির জন্য?’
‘জানলে ভালো। জেনে-বুঝে প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হলে আত্মবিশ্বাস বাড়বে, তোমার মেধা সেখানে আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়ে ভেতর থেকে নতুন নতুন ভাবনাতত্ত্বের জন্ম দেবে, নতুন ধারা তৈরি করবে, ক্ষতি কী? জানো। তবে নতুনভাবে গল্প লিখতে বসে সব জানতে হবে তাও বলা যায় না। লিখতে লিখতে সব জেনে ফেলবে নিজের মনের তাগিদেই।’
‘সাহিত্য মতবাদ আর মনস্তাত্ত্বিক মতবাদের মধ্যে কোনও পার্থক্য আছে? সাহিত্যের কোনও স্থায়ী সংজ্ঞা আছে?’
‘অবশ্যই পার্থক্য আছে। তবে কোনও মতবাদই স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে থাকেনি। যুগে যুগে বিভিন্ন মতবাদ গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে, আলোচনা- সমালোচনার মধ্য দিয়ে টিকে আছে, উচ্ছেদ হয়ে যায়নি। কেউ সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয় আর প্রতিটি সাহিত্য মতবাদের মধ্যেই রয়েছে মনস্তাত্ত্বিক মতবাদের ছায়ারূপ। মনের বাইরে সাহিত্যে তেমন কিছু নেই আর এজন্য ইতালিয়ান সাহিত্যতাত্ত্বিক লঙ্গিনাস বলেছেন, ‘সাহিত্য হচ্ছে মনেরই প্রতিধ্বনি।’ তোমাদের বিশ্বকবিও এমন কথা বলে গেছেন।’
‘বেশ। তোমার সঙ্গে কথা বলে ভালোই লাগল। তোমাকে নির্মাণের কলকব্জা সম্বন্ধে জানতে পারলাম। তবে বর্তমান বিশ্বে ছোটগল্পের প্রকরণে কোনও বাঁকবদল হলো কি না, তাও জানার ইচ্ছা হচ্ছে আমার। জানাতে পারবে?’
কোনও উত্তর নেই । চুপ হয়ে গেল গল্পবন্ধু।
‘প্রশ্নটা কি কঠিন হয়ে গেল?’ অধৈর্য হয়ে আবার প্রশ্ন করলাম।
‘কঠিন নয়। তবে তোমার জিজ্ঞাসা আর উত্তরের পরিধি অনেক বড়। সব সময় বিশ্বসাহিত্যের সবকিছু জানা থাকতে হবে এমন পাণ্ডিত্য আমার নেই, অতৃপ্তি আমাকেও তাড়িয়ে বেড়ায়―কখনও কখনও মনে হয়েছে আমাকে এভাবে লিখলে ভালো হতো কিংবা ওইভাবে লিখলেও চলতো।’ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জবাব দিল গল্পবন্ধু।
‘সরি, তোমাকে বিব্রত করলাম।’
‘বিব্রত হইনি। খুশি হয়েছি তোমার জিজ্ঞাসার গভীরতা দেখে। প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য আমাকে একটু ভাবতে দাও।’
দুই
সাহিত্যের কলাকৌশল নিয়ে কয়েকটি বই ঘাটাঘাটি করছিলাম। হঠাৎ অবচেতনে গল্পবন্ধুর উপস্থিতি টের পেলাম।
সে বলল, ‘ছোটগল্প’ মানে আমাকে নিয়ে বর্তমানে বিশ্বসাহিত্যে চর্চা বেড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ধারা সৃষ্টি হয়েছে―ছোটগল্প হিসেবে একসময় আমার বাইরের রূপ বা আবরণ ছিল মূলত সংক্ষিপ্ত অথচ পূর্ণাঙ্গ জীবনদৃশ্যের উপস্থাপনা, কিন্তু সমকালীন বিশ্বে এসব বৈশিষ্ট্য ও কলাকৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।’
‘ইয়েস। সেই বৈশিষ্ট্যের কথা জানতে চাই।’
‘তোমাকে ধন্যবাদ। কয়েকটি বৈশিষ্ট্য তুলে ধরলাম : কাহিনি সংক্ষিপ্ত হলেও এর মধ্য দিয়ে প্রতিধ্বনিত হয় জীবনের বিশেষ মুহূর্ত, নিবিড়ভাবে জড়িয়ে থাকা গভীরতম অনুভবও। স্মৃতি কিংবা অবচেতন মনের জানালা খুলে টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতার মধ্য থেকে বৃহত্তর অনুভূতি বেরিয়ে আসে। নির্মিত দৃশ্যমান আখ্যানের চেয়েও তখন বেশি গুরুত্ব পায় ভেতর-মনের চাহিদা আর তাই কাহিনি শেষ হয়ে যায় না। বাক্যবিন্যাস কিংবা ন্যারেটিভ থেমে গেলেও আখ্যানের সমাপ্তি কী হতে পারে তা একেক পাঠকের মনে একেকভাবে নাড়া দেয়। এই খোলা-সমাপ্তি পাঠককে ব্যাপক মোচড় দিয়ে বৃহত্তর ভাবনার জগতে ঠেলে দেয় । পাঠক নিজস্ব মেধা বা কল্পনার মাধ্যমে গল্পের শেষ প্রান্তের খোলা জানালা দিয়ে নানা কিছু দেখার সুযোগ পায়, নিজের ভেতরের সত্তাও তখন জেগে ওঠে। এভাবে শেষের অস্পষ্টতা বহু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুযোগ রেখে দেয়। পাঠকে পাঠকে তার উপলব্ধির ভিন্নতা দেখা যায়।’
‘সে তো আমাদের রবীন্দ্রনাথও বলে গেছেন―‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’, বলেছিলে আগেই।’
‘ঠিক বলেছো। রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে ছোটগল্পের বাঁকবদলের সূচনা ঘটে এই ভূখণ্ডে। আরও নানারূপে বিশ্বসাহিত্যকে আলোড়িত করেছেন, করছেন বিশ্বের নানা দেশের শক্তিমান লেখকগণও। যেমন উল্লেখ করা যায়, সমাজে চলমান বাস্তব ঘটনায় জাদু-উপকরণ প্রয়োগের মাধ্যমে জাদুবাস্তব গল্প-উপন্যাস রচিত হচ্ছে কিন্তু ঐতিহাসিক কাল থেকে রূপকথার কাহিনিতে কেবল জাদু-উপকরণ ব্যবহার করেই পাঠককে কল্পরাজ্যে নিয়ে যাওয়া হতো। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের হাত ধরে ল্যাটিন আমেরিকায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠা জাদুবাস্তব ধারাটি তোমাদের দেশেও জনপ্রিয়। চেতন-অবচেতন মনকে একাকার করে দিয়ে সুররিয়ালিজম ধারার গল্পও রচিত হচ্ছে আর সাম্প্রতিক বিশ্বে ফ্যান্টাসি উপকরণ নিয়েও বিপুল জনপ্রিয় বই লেখা হচ্ছে। এ সময়ের একটা প্রজন্মকে তা ঘোরগ্রস্ত করে তুলেছে।’
‘সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহও তো বিশ্বসাহিত্যকে প্রভাবিত করছে। করছে না?’ প্রশ্ন করলাম আমি।
‘অবশ্যই। বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, রাজনৈতিক হানাহানি, মানবনিধন, শরণার্থী ও জলবায়ু সমস্যা, প্রকৃতি ও পরিবেশ ঘিরে নানা ধরনের গল্প নানা কলা-কৌশলের মধ্যে দিয়ে নির্মিত হচ্ছে। যুগে যুগে সমকালীন ঘটনা লেখকদের কলমে উঠে এসেছে। তবু বলা যায় এ সময়ের ন্যারেটিভে ভিন্নতা রয়েছে।’
‘সে-সব ভিন্ন কৌশল নিয়ে কি কিছু বলতে পারবে?’
‘অবশ্যই। শোনো, তোমার জানার আগ্রহ পূরণের জন্য বলছি, ফ্ল্যাশ ফিকশন, মাইক্রোফিকশন, মিনিমালিজম― ডিজিটাল যুগে এসব ধারা বেশ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ৩০০ থেকে ১০০০ শব্দের মধ্যে পূর্ণ গল্প আকর্ষণীয় করে, তোলা হচ্ছে। অল্প শব্দের ‘ফ্ল্যাশ ফিকশন’ (ঋষধংয ঋরপঃরড়হ) হলো ছোটগল্পেরই এক বিশেষ অথচ সংক্ষিপ্ত রূপ। একটি নির্দিষ্ট মুহূর্ত বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে, এক-দুইটি চরিত্রের উপস্থিতিতে হঠাৎ চমকপ্রদ সমাপ্তি ঘটানো হয়। এক কথায় বলা যায়, ফ্ল্যাশ ফিকশনে অল্প কথায় পূর্ণাঙ্গ গল্প তুলে ধরা হয়। ভাষার সংযমও লক্ষণীয়। আবার বাহুল্য বা বিস্তৃত কিংবা ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনার পরিবর্তে অল্প কথায় গভীর অর্থ প্রকাশ করার দক্ষতা ‘মিনিমালিজম’ প্রকরণটিকে সমকালীন পাঠক টানছে। অভ্যন্তরীণ মনোলোক এবং স্ট্রিম অফ কনশাসনেস চরিত্রের মানসপ্রবাহকে অন্যভাবে উপস্থাপন করছে। অবিন্যস্ত কাহিনি, খণ্ডিত গঠন কিংবা কাহিনিহীন বর্ণনাশৈলী গল্পের সময়রেখা ভেঙে ফেলছে। ফ্ল্যাশব্যাক কিংবা ফ্লাশ ফরওয়ার্ডের ব্যবহার গল্পকে অন্যভাবে উপস্থাপন করছে।’
‘ফ্ল্যাশব্যাক তো আগেও ছিল? এখানে নতুনত্বের কী আছে?’
‘বিশ্বায়নের ফলে বিভিন্ন সংস্কৃতির স্বর, সংখ্যালঘু বা নারীবাদীদের কণ্ঠস্বর, আন্তঃপাঠ ও ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি, প্রান্তিক মানুষের জীবন, ছোট ছোট দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে মেলে ধরা হচ্ছে। এসব পরিবর্তন দেখা যায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম, ব্লগ কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। ডিজিটাল টেক্সট কৌশল―হাইপারলিংক (যুঢ়বৎষরহশ), ইন্টারেক্টিভ ন্যারেটিভ (রহঃবৎধপঃরাব হধৎৎধঃরাব), অডিও ভিজ্যুয়াল টুলস ব্যবহারের মাধ্যমেও গল্পের কাঠামো নির্মাণ চলছে। সিনেমাটিক ছোট ছোট দৃশ্য, ডায়ালগ, চিত্রকল্প ব্যবহার করে পাঠকের মনে দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করা হয়। এ ধরনের চলচ্চিত্রিক উপস্থাপনাকে আগে দুর্বল ভাবা হলেও শিল্পশৈলীতে নতুনত্বের কারণে এখন সেভাবে মনে করা হয় না। এসব ব্যতিক্রম। খোলা-সমাপ্তি এবং বর্ণনা কৌশলের মধ্যেও রয়েছে প্রযুক্তির প্রভাব।’
‘দুটো কঠিন বিষয় তুলে ধরেছো― হাইপারলিংক ও ইন্টারেক্টিভ ন্যারেটিভ। বোধগম্য হচ্ছে না। বুঝিয়ে বলো।’
‘ওয়েব বা ডিজিটাল টেক্সটে হাইপার লিংক বেশ পরিচিত। এই লিংকে ক্লিক করলে তা দ্রুত পাঠককে অন্য কোনও পেজ, ডকুমেন্ট, ছবি, ভিডিও বা তথ্যসূত্রে নিয়ে যায়, তথ্যভাণ্ডার কিংবা অভিজ্ঞতা তখন সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।’ বলল গল্পবন্ধু।
‘কোনও উদাহরণ দিতে পারবে?’
‘শিওর। কোনও অনলাইন গল্পে ‘সে অন্ধকার গলির ভেতর ঢুকে গেল’ বাক্যের মধ্যে ‘অন্ধকার গলি’ শব্দে ক্লিক করলে পাঠক হয়তো অন্য একটি পেজে চলে গেল যেখানে সেই গলির বর্ণনা দেওয়া আছে। ফলে টেক্সট শুধু সরলরেখায় পড়া হয় না, বরং পাঠককে ইচ্ছামতো এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ করে দেয়। এসব হচ্ছে এ সময়ের আধুনিক প্রযুক্তির ফল।’
‘তাহলে কি লেখকের মৌলিক সৃজনপ্রভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে? এসব লেখাকে মৌলিক সৃষ্টি বলা যাবে?’ প্রশ্ন করতে গিয়ে আমার গলা ভারী হয়ে গেল।
‘ব্রিলিয়ান্ট! ভালো প্রশ্ন করেছো। লেখক তা হুবহু লিখে ফেলবেন না, কিন্তু অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। চরিত্রের প্রয়োজনে, কিংবা বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিবেশকে জীবন্তভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য অভিজ্ঞতাকে আপন আলোয় সৃজন করবেন। সেটা হবে লেখকের দক্ষতা, নিজস্ব সৃষ্টি। অভিজ্ঞতা অর্জন বা অর্জিত জ্ঞান ব্যবহারের মাধ্যমে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব জাগ্রত হয়। তা ব্যক্তির নিজস্ব যৌক্তিক চিন্তাকে শাণিত করে, সমস্যার জটিলতার গিঁট খুলতে সহজ পথ দেখিয়ে দেয়। বোঝাতে পারলাম?’
‘ধোঁয়াশা কাটেনি। তবু বলব, বুঝেছি। তো এবার বলো ‘ইন্টারেক্টিভ ন্যারেটিভ’ বলতে কী বোঝালে?’
‘এমন ধরনের গল্পে পাঠকই গল্পের সঙ্গে মিলেমিশে এগোতে থাকে, অগ্রগতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। কিংবা বলা যায় গল্প কেবল লেখকের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় না, লেখক নিজে পাঠক হয়েও চলমান গল্পের মোড় বদলাতে পারেন, সিদ্ধান্ত বদলাতে থাকেন।’
‘উদাহরণ দাও তো।’
‘চয়েস-বেইজড উদাহরণ―বই বা অনলাইন গেমে পাঠককে জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘তুমি কি গলিতে ঢুকবে? না কি রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে?’ প্রতিটি সিদ্ধান্ত গল্পকে ভিন্ন পথে নিয়ে যায়। বুঝতে পেরেছো? ধোঁয়াশা কি কিছু কেটেছে?’
উত্তর না দিয়ে মাথা চুলকাতে লাগলাম নিজের অজান্তে। তা টের পেয়ে গল্পবন্ধু মরিয়া হয়ে আবার বোঝাতে লাগল, ‘হাইপারলিংক নানা দৃষ্টিকোণ থেকে টেক্সটকে পড়ার সুযোগ দেয় আর ইন্টারেক্টিভ ন্যারেটিভ পাঠককে গল্পের সহলেখক বা অংশগ্রহণকারী করে তোলে।’
‘গেম, ডিজিটাল ন্যারেটিভ, কম্পিউটার গেমে চরিত্রের কাজকর্ম পাঠক, খেলোয়াড়ের পছন্দ অনুযায়ী এগোতে পারে, মানলাম। তবে ব্যক্তিগত সৃজনশীল রচনার ক্ষেত্রে ইন্টারেক্টিভ ন্যারিটিভের তো সেই সুযোগ নেই।’
আমার জবাব শুনে গল্পবন্ধু হুমহাম করে কিছু বলতে গিয়েও বলল না। চুপ হয়ে গেল।
সাড়া না পেয়ে আবার প্রশ্ন করলাম, ‘তোমার সঙ্গে কথার বনিবনা হলো না দেখে অভিমান করলে? চুপ করে আছো কেন?’
তবু কোনও সাড়া পেলাম না।
মরিয়া হয়ে আবার বলতে লাগলাম ‘দেখো, অর্ধসমাপ্ত অনুভূতি নিয়ে তোমার সঙ্গে কথোপকথন থামাতে চাই না। আঘাত না-দিয়েই বলতে চাই, তোমার কথায় উপকৃত হয়েছি; তবে পুরোপুরি মন ভরেনি। তুমি তো জানো ধ্রুপদী সাহিত্যেও শক্তিমান লেখকগণ অনন্য ভাষাশৈলী ব্যবহার করে চরিত্রদের অভ্যন্তরীণ মানসলোকের দৃশ্যমান প্রতিচিত্র উপহার দিয়ে গেছেন, চলমান জীবনকে চিত্রায়িত করে গেছেন, সেলুলয়েডের ফিতার মতো সাজিয়ে গেছেন জীবনের নানা ঘটনা-অনুঘটনা। অক্ষর আর বাক্যের গঠনশৈলীর মধ্য দিয়ে পাঠককে সে-সব আড়ালচিত্র দেখার সুযোগ করে দিয়ে অনবদ্য সাহিত্যশিল্প উপহার দিয়ে গেছেন। তাঁরা অমর হয়ে আছেন।’
‘হ্যাঁ। তোমার কথায় যুক্তি আছে, মানলাম। তবে সহজভাবে বলা যায়, ধ্রুপদী ছোটগল্প ছিল অখণ্ড কাহিনি এবং আবেগের শিল্প আর সমকালীন ছোটগল্প হলো খণ্ডিত বাস্তবতা ও ভাবনার শিল্প।’ কথা শেষ করে চুপ হয়ে গেল গল্পবন্ধু।
তিন
হঠাৎ বুঝলাম মাথার ভেতর গল্প লেখার নতুন নতুন আইডিয়ার বুদবুদ উঠছে। চোখ বুঁজে আছি। বোঝার চেষ্টা করছি আইডিয়ার ধরন, প্রকরণ।
‘দেখলে তো, জানা-বোঝা ও পড়ার কোনও বিকল্প নেই। কতভাবে তুমি অভিজ্ঞতা অর্জনের চেষ্টা করলে। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে কত কিছু জানলে। আমাকে নির্মাণের কলাকৌশল নিয়ে রচিত নানা ধরনের বইও ঘাঁটাঘাঁটি করলে। কোনও কোনও বিষয়ে একমত না-হওয়া সত্ত্বেও প্রশ্ন করলে, নিজের কথাও বললে।’ হাসিখুশি মনে নীরবতা ভেঙে বলল গল্পবন্ধু।
‘ও। তুমি ফিরে এসেছো? আমাকে ছেড়ে যাওনি? আরও কিছু কি বলতে চাও?’
‘পড়ো, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করো। পড়ো, পড়ো। শক্তিমান লেখকদের লিখনশৈলী আত্মস্থ করো। তবে তাদের হুবহু অনুসরণ করা চলবে না। নিজের জন্য আলাদা পথ নির্মাণ করো, সৃজন কোরো। তাহলে দেখবে আমার দেহ-কাঠামো ও মানসলোক থেকে অন্য রোশনি বের হচ্ছে আর তা তোমাকে গল্পকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দেবে। তোমাকে তখন ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।’
‘তোমার উপদেশের সারকথা কী?’
‘বুঝতে হবে লেখার উদ্দেশ্য কী, গল্প কেন লিখছো? মূল বার্তা কী? গল্পের মূল উপাদান―কাহিনি, চরিত্র, প্রেক্ষাপট, সংঘাত, থিম―বিষয়ের স্বচ্ছতা সৃষ্টি হলো কি না, লেখা শেষে খুঁজে দেখতে হবে কিংবা লেখার আগে তা মাথায় রাখতে হবে। পাশাপাশি সজাগ থাকতে হবে গল্পের দৃষ্টিকোণ ও শৈলী বিষয়ে―উত্তম/তৃতীয় পুরুষ, ভাষা, আবহ―এসব দিকেও।
‘প্লট গঠন―ঘটনা সাজানো (ক্রমিক/ ফ্ল্যাশব্যাক), ক্লাইম্যাক্স ও টুইস্ট, গতি নিয়ন্ত্রণ এবং চরিত্র নির্মাণে সচেতন থাকা ভালো; বাস্তবসম্মত চরিত্রের বিকাশ বা পরিবর্তনের যৌক্তিক উপস্থাপনা থাকা প্রয়োজন।’
‘দৃশ্যায়ন ও সংলাপ পাঠকের মনে নতুন চিত্র তৈরি করে, তথ্য পরিবেশন ও আবেগের প্রকাশ ঘটায়। ভাষাশৈলী ও আবেগ প্রকাশে রূপক, উপমার ব্যবহার যথাযথ হতে হবে। পাঠক হিসেবে নিজের লেখাকে নিজেই সম্পাদনা করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দেওয়ার যোগ্যতা থাকা জরুরি, বাক্যের ব্যবহার ও সিকোয়েন্সে ধারাবাহিকতা ঠিক করাও গুরুত্বপূর্ণ।’
‘অনুশীলনের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়াতে হলে ধ্রুপদী গল্প বিশ্লেষণ, ছোট কাহিনির মাধ্যমে চরিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড সৃজন করা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত সমাধানের প্রাজ্ঞতাও গল্পের শৈলী উন্নত করে; নিয়মিত চর্চা দক্ষতা বৃদ্ধি করে।’
‘তোমাকে ধন্যবাদ, প্রিয় গল্পবন্ধু। আমার ভেতরে জেগে উঠে অন্তরকে আলোকিত করেছো। বন্ধুর মতো আমার আত্মার চোখ খুলে দিয়েছো। চেষ্টা করব তোমাকে ভালো কিছু উপহার দিয়ে নিজের করে ধরে রাখতে। কথা দিচ্ছি প্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগেও তুমি টিকে থাকবে অন্য আলোরূপে। ভালোবাসা তোমার জন্য।’
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও মনোশিক্ষাবিদ
সচিত্রকরণ : রজত