
অবশেষে একজন গুনিনের কাছে যেতে মনস্থির করে মাহিন। অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার বিষয়টির ফয়সালা হওয়া দরকার। আদতে কোনও বিষয় নাকি সমস্যা অথবা আউল-বাউল মনের ভুল ? এক দুপুরে বাসে উঠে বসল সে। তিরিশ মিনিটের রাস্তা। এই যাই যাই করে কেটে গেল চল্লিশ-পয়তাল্লিশ মিনিট। এই সময়টুকুতে হাজারও ভাবনা ভিড় করে গেল। সেই সঙ্গে কিছু দৃশ্য আর অস্বস্তি শুঁয়োপোকার মতো সুড়সুড় করেছিল। এমন কিছু নয়, আবার এড়িয়ে যাওয়া যায় না। একটি বিহিত করা দরকার।
বাস থেকে নেমে একরূপ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো মাহিন। শেষে ঠিকানা ভুল হয়েছে নাকি ? মুশা শা রোড নাকি বাড়াই হয়ে কোবাদ মনজিল যেতে হয় ? শাহিন সঠিক তথ্য দিয়েছে তো ? এমন দোলাচলের মধ্যে একজন ভ্যানচালক সামনে এসে দাঁড়ায়।
‘কোঠে যামেন দাদা ?’
‘সেই তো কোথায় যাই! আচ্ছা, এখানে কোবাদ হুজুরের বাড়ি কোথায় ? অনেক আগে একবার এসেছিলাম, এখন তো মনে করতে পারছি না।’
‘কোবাদ কবিরাজ ? সেখন এ্যাঠে নামিলেন ক্যান ? আপনাক বাড়াই যাবা নাগিল হয়।’
‘গ্রামের নাম শিবপুর। এটা মনে আছে। একটা খালের মতো নদী পড়ে রাস্তায়।’
‘হয় হয় মুই বুঝিছ। এ্যাইঠে নহায়। সেখন কী কামোত যামেন ? ওঁয় তো এখন তেমন কাজ করে না।’
‘আমাকে একজন বলল, মুশা শা রোড নামবেন; সেখানে যে কেউ বলতে পারবে।’
‘এ্যাইঠে দুইজনা কাজ করে। একজন বেলাল হোসেন আরেকজন মতিন মাওলানা। কারঠে যামেন ?’
‘কার কাজ ভালো ?’
‘দোনো জনাই কাজ করে। মতিন মাওলানা টাকা বেশি নেয়।’
‘কেমন টাকা নেয় ?’
‘এগুলা দাদা কামের উপর দাম। মতিন মাদরাসাত চাকরি করে। বেলাল বাড়িত থাকি এ্যাইলাই করে।’
‘এদের কাছে জিন আছে নাকি ?’
‘মাইনষে তো কয়। হারা জানো না। আপনি যামেন কার গোড়ত্ ?’
‘আচ্ছা চলেন একজনের কাছে।’
গ্রামের নাম শোলাপুকুরিয়া। রাস্তার ধারে কতগুলো জমিতে ভুট্টার গাছ। রাস্তা সরু ও ভাঙাচোরা এবড়োখেবড়ো। মাহিনের ঝাঁকুনি লাগে। পেটে চাপ বাড়ে। সকালে তেমন নাশতা খাওয়া হয়নি। সাধারণত দুটো পরোটা, সবজি বা ডিমপোচ আর চা খাওয়া হয়। পেটভরতি নাশতার অভ্যেস। তারপর টয়লেট হাজিরা। আজ ট্যাক্স ঠিকমতো হয়নি। পেট ভার ভার লাগে।
একসময়ের গ্রামগুলো ধীরে ধীরে শহরের মতো ইটপাথরের হয়ে যাচ্ছে। এমন কোনও বাড়ি দেখা গেল না যা পুরোটাই খড়ের চাল। ইটের বিল্ডিং। পাওয়ার টিলার। শ্যালো মেশিন। প্রযুক্তি কত দ্রুত মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতির পরিবর্তন করে দেয়। কতটুকু উন্নতি বা কতটুকু নির্ভরতা। মানুষ বাড়ছে। খাদ্য আর আবাসন চাহিদা বাড়তির দিকে ধাবিত। কমে আসছে ফসলি জমি। আবাদ হচ্ছে হাইব্রিড শস্য। আমিষের চাহিদা পূরণে প্রচলন হয়েছে ভিন্ন প্রযুক্তি। আগেকার দেশীয় স্বাদ আর নেই। বিজ্ঞান কি সত্যি এই পরিবর্তন চেয়েছে ? এই বিজ্ঞান যখন মানুষকে যুক্তিবাদী করেছে, মাহিন তখন কোন্ আস্থা কিংবা বিশ্বাসে অলৌকিক প্রত্যাশায় এগিয়ে চলে ? গুনিন কি সমস্যার সমাধান করতে পারে ? সবই নাকি বুজরুকি ? মাহিন মাথা থেকে যুক্তিতর্ক ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইল। তার সমস্যা জটিল। অনেক দিন ধরে পুষে রেখেছে। এবার শেষ দেখা দরকার।
গত প্রায় দুই সপ্তাহ কানে বাজছে একটি কথা। সেদিন উজ্জ্বল দুপুর। তার পরনে নতুন পোশাক। সকাল দশটায় স্নান সেরে নিয়েছে। প্রেস ক্লাবে মিটিং। অ্যাটেন্ড করে বলে-কয়ে ফিরে এসে রেলবাজার যেতে হবে। সেখানে পাটালি গুড় আর জিরা কাটারি চাউল কেনার কথা। আগামীকাল চাউল ভিজিয়ে বাহাদুর বাজারে গিয়ে গুঁড়ো করবে। চাউলের আটা। তারপর একেকদিন ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাকোয়ান কত কি! নবান্নের ষোলোকলা পূর্ণ তবেই হয়।
প্রেসক্লাবে মিটিং-এর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। সভাপতি, প্রধান অতিথি আর বিশেষ অতিথি আসন গ্রহণ করেন। উপস্থাপিকার স্টাইল করে নাম ঘোষণা আর বিশেষণের মাত্রাধিক মাখামাখিতে বিরক্তি আসে। আজকাল এসবই হয়। তুম হামকো হাজি বলেগা হাম তুমকো হাজি বলেগা। কেউ একজন পাশে বসেছিল। অনলাইন পত্রিকার নতুন সাংবাদিক। সে নাক সিঁটকে উঠে অন্য চেয়ারে বসল। তার আগে বাইরে গিয়ে বারবার কেশে গলা পরিষ্কার করে। তার সঙ্গে দু-একটি কথা হলো বটে, কিন্তু অমনভাবে চলে যাওয়ায় অবাক হয় মাহিন। সে কি আজ ব্রাশ করেনি ? করেছে তো! তারপরও কি মুখে দুর্গন্ধ থেকে গেছে ? তার জিনজিভাইটিস হয়েছিল। ডেন্টিস্টের কাছে গেল। মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ে। কখনও সেন্সিভিটি পীড়া দেয়। গরম বা ঠান্ডা খেতে দাঁত শিরশির করে। এক দাঁতে রুট ক্যানেল করা হলো। এখন সকল দাঁত মাড়ি থেকে ঝুলে পড়েছে মনে হয়। ডাক্তার কসমেটিক সার্জারি করে নিতে বলে। বেশ! কেমন খরচ হতে পারে ? খরচের কথা শুনে আক্কেল গুড়ুম! এত টাকা! রুট ক্যানেল অসফল। দাঁত আপরুট করে নিল একদিন। এবার মুখের দুর্গন্ধ থেকে রক্ষা। মনের মধ্যে দুর্গন্ধ থেকে গেল। সে প্রচুর ঘামে। সেখান থেকেও দুর্গন্ধ হতে পারে। অগত্যা আন্ডার আর্ম লোশন ব্যবহার শুরু হলো। তারপরও কেন ? তপতী একদিন বলে,―
‘তুমি গায়ে সাবান দাও না ? এত কেন গন্ধ ?’
‘পুরুষ মানুষের শরীর গন্ধ করে। এতে সমস্যা কোথায় ? তুমি তো আলাদা বেডে শোও।’
‘সেটা নয়। কেমন পচা পচা গন্ধ। তোমার শরীরের কোথাও ঘা-টা হয়নি তো ?’
‘কই তেমন হয়নি তো!’
‘তোমার শরীরে পচা গন্ধ। ইঁদুর-ছুঁচো মরে পচে গেলে যেমন গন্ধ হয়, তেমন।’
মাহিন খুব আহত হয়। নিজের বউ, যাকে এতগুলো দিন-মাস-বছর বুকে আগলে রেখেছে, প্রাণভরে ভালোবেসেছে, কোনওদিন অন্য কোনও নারীর দিকে তাকায়নি, নোংরা চিন্তা করেনি; তার মুখে এমন কথা! মাহিন বাথরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সব কাপড় ছেড়ে দেয়। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। আন্ডার আর্ম আর অন্যান্য এলাকার ভেতর-বাহির খুঁজে খুঁজে পেরেশান হয়, কিন্তু কোথাও কোনও ক্ষতের চিহ্ন পেল না। সে সংযমি মানুষ। কোনও জায়গায় নষ্টিফষ্টি করার প্রশ্ন আসে না। সাহসও নেই। শেষে জননঅঙ্গের গোপন অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেছে নাকি ? সে দিনে দু-বার স্নান অভ্যেস শুরু করল। এক সকালে মেডিকেলে গিয়ে দশটাকায় টিকিট কেটে ডাক্তারের পরামর্শ নিল। চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার পরীক্ষা শেষে কতগুলো ক্যাপসুল লিখে দেয় মাত্র। মাহিন মনের আনন্দে অষুধ কিনতে ছুটে গেল চারুবাবুর মোড়। তারপর ক্যাপসুলের দাম শুনে আঁতকে উঠল। দেশে কবে থেকে অষুধের দাম এত বেশি হয়ে গেছে ? সেই ক্যাপসুল কেনা হলো। তেমন পরিবর্তন পাওয়া গেল না। কেউ একজন পরামর্শ দিল, নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে। সাইনোসাইটিস বা অ্যাট্রোপিক রাইনাইটিসের কারণে শুকনো সর্দি ও মিউকাসের দুর্গন্ধ হয়। রোগী নিজে সেই গন্ধ পায় না, অন্যেরা পায়; সুতরাং পুনরায় ডাক্তার। সেই চিকিৎসা হলো। ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে এটা-সেটা বিবিধ টেস্ট। কোনও জটিলতা নেই। এদিকে অবস্থার পরিবর্তন হলো না। তপতি যখন একটু কাছে আসতে আসতে আঁচলে নাক-মুখ ঢেকে নেয়, মন খারাপ করবে না ভেবে নিয়েও বিষণ্ন হয় মাহিন। সে জিজ্ঞেস করে, –
‘তুমি কি এখনও গন্ধ পাও ?’
‘তোমার খারাপ লাগবে। আমি পচা গন্ধ পাই। মনে হয় মরা মানুষের গন্ধ।’
‘আমার হায়াত তবে শেষ তপতী।’
‘কী যে বলো না! তোমার আগে আমি চলে যাব। তোমার কোলে মাথা রেখে তোমাকে দেখতে দেখতে…।’
‘এমনভাবে বলো না তো! আমার খারাপ লাগে। তুমি আমার চেয়ে সাত-আট বছরের ছোট। মানুষের বয়স হলে মরে। এটাই নিয়ম। তোমার সেই বয়স হয়নি।’
‘কেন আবুল চাচার বউয়ের কত বয়স ? স্ট্রোক করে চলে গেল। মাথার একটা চুলও পাকেনি।’
‘তোমার এসব চিন্তা করতে হবে না। কী সব ফালতু ভাবনা!’
‘আচ্ছা।’
তপতী এই কথা বলতে বলতে কাছে আসে। মাহিন আচমকা উঠে বাইরে বেরোয়। তার গায়ে পচা গন্ধ। এই গন্ধের কারণ কী ? কোন অসুখ ? সে স্বস্তি পায় না। মানুষের সমাজে কীভাবে চলাফেরা করবে তবে ? তখন দিনযাপনের দু-একটি ঘটনা মনে পড়ে যায় আর ভাবনায় জুড়ে দেয় ভয়ংকর অস্বস্তি। একদিন সন্ধেবেলায় তার পায়ের ছাপ পেছন-পেছন শুঁকে শুঁকে অচেনা এক কুকুর হেঁটে আসে। এমন দৃশ্য অন্য জায়গায় আরও দু-একবার ঘটে গেল। ভারি অদ্ভুত! এসব কী ? মাহিন শিউরে ওঠে। মানুষ আর সভ্যতাকে ভয় লাগে। উন্নাসিক হয় মনোযোগ। প্রায় এক বছর আগে চারুবাবুর মোড়ে গিয়েছিল। পুব-উত্তরের রাস্তা অর্থাৎ ঈশান কোণ। দোতলায় মোবাইলে গান লোড করার দোকান। একটি নতুন মোবাইল কেনা হয়েছে। মোবাইলে গান শোনা যায়। এইচডি ভিডিও চলে। কী আশ্চর্য! প্রযুক্তি যে এমন দিন দেখাবে কে জানত!
একজন ত্রিশোর্ধ্ব মানুষ ডেস্কটপ কম্পিউটারে এসডি কার্ড নিয়ে গান-ভিডিও লোড করে দেয়। ন্যূনতম চার্জ তিনশত টাকা। এক জিবির কার্ড কেনা হয়েছে। পিচবোর্ডের মতো পাতলা কয়েক সেন্টিমিটার এতটুকু জিনিসের মধ্যে কয়েক ঘণ্টার গান আর মুভি। সত্যি বিচিত্র! এইসব ভাবনার মধ্যে হালকা হওয়ার বেগ আসে। সেই বেগ চোখের সামনে ওয়াশরুম দেখে আরও তীব্র হয়। মাহিন কাউকে কিছু না বলে সেখানে প্রবেশ করে। কাজ শেষে বের হয়। তখন পুরো দোকানে বিটকেলে দুর্গন্ধ। মানুষটি কম্পিউটার ছেড়ে এদিক-ওদিক-চারিদিক রুম ফ্রেশনার ছড়াতে শুরু করে দেয়। মাহিন বড়ই বিব্রত। এ কী ধরনের কাজ হলো!
‘সরি আমার জানা ছিল না যে, ওয়াশরুম আউট অব অর্ডার। সরি এক্সট্রিমলি সরি।’
‘না না। কয়দিন ধরে সুইপার আসছে না। আপনি বসুন। সিরিয়াল এলে ডাকব।’
মাহিন এরপর দশ-পনেরো মিনিট মাথানিচু করে বসে রইল। সকল দোষ তার। তখনও নাকে দুর্গন্ধ লেগে রয়েছে। উপস্থিত সাত-আটজন মানুষের তির্যক দৃষ্টিতে বড় কুণ্ঠিত থাকে সে। তেমন আরও একটি ঘটনা ঘটল দু-চার দিন পর। বেতন পেয়েছে। মাহিন বিকেলে বাহাদুর বাজার গেছে। সেখানে সুইটমিটের দোকান থেকে চমচম-বরফি-দই নেবে। সে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে যেন তাকে অনুসরণ করে এক-দুই ডজন মাছি উড়ে এলো। মানুষজন টেবিলে-টেবিলে খাচ্ছে। সারা রুমে মাছির ভনভন। এদিকে এসির ঠান্ডা বাতাস। বয়-বেয়ারা কাঁধের তোয়ালে ফেলে রুম ফ্রেশনার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রায়। কেন এমন হয় ? কোথাও বাসে রওয়ানা দিয়েছে। পাশের যাত্রী বারবার নাক টানছে বা কুঞ্চিত করছে। কতই দুর্গন্ধ! তখন তপতীর কথা খুব করে মনে পড়ে যায়। মাহিনের গায়ে গন্ধ। দুর্গন্ধ। সে আসলে অচ্ছুৎ। নোংরা-কদর্য-টক্সিক মানুষ। তার সারা শরীরে দুর্গন্ধ। পচা। মরা মানুষের গন্ধ। মানুষের সমাজে যেতে শুরু হলো কড়া পারফিউম ব্যবহার। আন্ডার আর্মে অ্যান্টি-সোয়েট লোশন। দিনে দুইবার স্নান। তারপরও মনের গন্ধ যায় না। হাসপাতালে ডাক্তার দেখানো হলো। অ্যালোপ্যাথি-হোমিও। কোনও উন্নতি নেই। অবশেষে একদিন ভাবনার সীমারেখায় কী মনে করে গুনিন বা তান্ত্রিকের ভাবনা আসে। অনেক রহস্যময় বিষয় আছে যা বিজ্ঞানের কাছেও পাজেল অর্থাৎ ধাঁধা। সুতরাং সেদিকে একবার চেষ্টা করে দেখা যাক। সেই যে বিজ্ঞাপনের ভাষায় ‘জীবনের শেষ চিকিৎসা।’
যতটুকু রাস্তা পেরিয়ে শোলাকুরিয়া আসা হলো, মাহিন চারিদিক মনোযোগ দিয়ে দেখে, ডিশ ক্যাবলের লাইন চলে এসেছে; এখানে তবে বাড়ি বাড়ি শত শত চ্যানেল বিনোদন ছড়ায়। মানুষজন যথেষ্ট সচেতন। কেউ বলে সেয়ানা। বেশ দূরের পথ। কখনও মেটে রাস্তা। কখনও পিচকালো, তবে সুরকি উঠে যাচ্ছেতাই; প্রচুর ঝাঁকুনি। রিকশা ভ্যান অনেকখানি দৌড়ে চলেছে। চালকের বয়স কত হতে পারে ? মাহিনের মতোই চল্লিশ-বিয়াল্লিশ। মাহিন এক ফাঁকে আন্ডার আর্ম আর হাতের কবজি তুলে গন্ধ নেয়। কোথায়… অস্বাভাবিক তেমন কিছু তো নেই। যার গায়ে দুর্গন্ধ সে নিজে বুঝতে পারে না, অন্যজনে পায়। বেতাল মন এলোমেলো হতে শুরু করে। সেই সুযোগ দেওয়া যাবে না। বিভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে হবে। সে জিজ্ঞেস করে,―
‘রাস্তার কাজ হয় না নাকি ? এত খারাপ!’
‘সউগে মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাজ। বোজেন না ? কী যে মালমশলা দিয়া রাস্তা ঠিক কইরছে, সউগে ভেজাল।’
‘এখনকার মেম্বার-চেয়ারম্যান যতদিন গম আছে, ততদিন কাজ করে। সব জায়গায় এমন অবস্থা। কী আর করা যায়!’
‘বেলাল কবিরাজের সাথোত্ বুঝপড়া করি কি শিবপুর যামেন ? কোবাদের ঠে ?’
‘এখান থেকে কত দূর ?’
‘এই ধরেন ক্যানে তিন-চাইর মাইল। এক ঘণ্টার মতো সমায় নাগিবে।’
‘আচ্ছা আগে বেলাল কবিরাজের সঙ্গে কথা বলি। কী বলে শুনে সিদ্ধান্ত নেব।’
‘হয় হয়। বেলালের বাড়ি আর বেশি দূর নহায়। আসি গেইচি।’
‘আপনি থাকবেন নাকি চলে যাবেন ? ফিরে যাওয়ার ভ্যান পাওয়া যাবে ?’
‘মুই থাকিম।’
‘আপনার নাম কী ? ভ্যানই চালান নাকি অন্য কাজও করেন ?’
‘মোর নাম মজিবর। জমিত রোপা গাড়ি-টাড়ি ভ্যান চালাও। টাকার দরকার নহায় ?’
মজিবরের রিকশাভ্যানে মোটর লাগানো আছে। স্টিয়ারিং অর্থাৎ হ্যান্ডেল ধরে দ্রুতবেগে ভ্যান চালায় না যেন উড়ে যায়। মাহিন চুপ করে বসে থাকে। তারপর একটি পাড়ার মধ্যে এই বাড়ির গলি ওই আঙিনা ঘুরে ঘুরে এসে এক জায়গায় আস্তে দাঁড়ায়।
বড় আকারের একটি বিল্ডিং। সীমানা প্রাচীরের উত্তরে টিনছাপরার ঘর। বেশ বড়। বাঁশবাতার দেয়াল। মাহিন উঁকি দিয়ে দেখে ক্লাসরুমের মতো সাজানো কক্ষ। একজন লোক বুঝি শিক্ষকের ভূমিকায় বসে আছে। টেবিলের উপর দুটো হাত। একটি বাটন ফোন এক কোনায় যত্নে পড়ে আছে। টেবিলের মধ্যখানে পানির বোতল। দোকান থেকে কেনা পানি। টিনছাপরা ঘরের পুবে কিছু দূরে দোকান। ছোট আকারের দোকান। বিবিধ চিপসের কতগুলো প্যাকেট ঝোলানো আছে। মজিবর এগিয়ে এসে বলে,
‘আপনি এ্যাইঠে খাড়ান। কবিরাজ ডাকি নিবি হেনে।’
‘আচ্ছা।’
মাহিনের মনে পড়ে জীবনে দ্বিতীয়বার কোনও গুণিন বা কবিরাজ বা বুজরুকি মানুষের কাছে আসা হলো। প্রথম অভিজ্ঞতা স্মৃতিতে খুব দ্রুত ভেসে ওঠে। সেটিই কোবাদ ফকির। শিবপুর গ্রাম। বাড়াই থেকে উত্তরে চকমুশা হয়ে অনেক দূর হেঁটে যেতে হয়। পাড়ার কাছাকাছি খালের মতো শীর্ণ এক নদী আছে। মরা নদী। সেদিন আশপাশের মানুষজন বিস্ময় ও সন্ধিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। একজন বেঁটে মতো লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,―
‘কোন্ঠে যামেন বা হে ? কার বাড়িত ?’
‘এখানে একজন আছেন না, কোবাদ ফকির।’
‘ও কবিরাজের বাড়ি ? তো চলো ক্যানে, মোরও বাড়ি ওইঠে। কী সমস্যা ? কার ?’
‘এই যে আমার ছোটভাইয়ের।’
মাহিনের সঙ্গে ছোটভাই শাহিন। শাহিনের বন্ধু মঈন। মঈন হাতের স্পর্শে কিছু ইঙ্গিত করে। মাহিন চুপ হয়ে যায়। সে আসলে বেশি কথা বলে। তারপর আর কিছুদূর হেঁটে হেঁটে কোবাদ ফকিরের বাড়ি। আশপাশে তেমন বিল্ডিং ঘরবাড়ি নেই, মাটির দেয়াল আর খড়ের চাল; তবে ফকিরের বাড়ি পাকা ইটের। উঁচু-লম্বা প্রাচীর। সাদা চুনকাম করা দেয়ালে উজালা নীল রঙে বিশেষ কিছু লেখা। শুক্রবার-জুম্মাবার ও শনিবার বন্ধ। রবিবার ও সোমবার পুরুষ রোগী। মঙ্গলবার হইতে বৃহস্পতিবার মহিলা ও শিশু রোগী। সকাল নয়টা হইতে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত রোগী দেখা হয়। নামাজের সময় বিরতি। মাহিনের মনে পড়ে, সেদিন ছিল বুধবার। সে কী করবে দ্রুত ভেবে নেয়। শহরের মানুষ। কবিরাজকে বলে-কয়ে ব্যবস্থা করতে হবে। দেয়ালে নির্দেশিত দিনে পুনরায় এত দূর আসা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত শাহিনের এমন কোনও অসুখ নয়, মাথা একটু আউলা হয়ে গেছে মাত্র; কবিরাজের পরামর্শ কী হয় দেখা দরকার। এখন দিনের হিসাব মেলে না। কী করা যায় ? এমন সমস্যার মধ্যে সেই লোকটি হাজির। মাহিন তাকে ডেকে বলে,―
‘ভাই আমরা তো দিনের হিসাব জানি না, আজ এসে পড়েছি; কিছু ব্যবস্থা করা যায় ?’
‘আচ্ছা মুই তাইলে কোবাদোক কও। মোর চাচাত বড়ভাই। নিশ্চয় শুনিবে। আপনারা খাড়ান।’
তারা তিনজন বিশাল এক গাছের নিচে দাঁড়ায়। চমৎকার রোদ। গাছটির পাতাগুলো বেশ বড়। শাল না সেগুন জানা নেই। একসময় শালপাতায় চিড়া-মুড়কির নাড়ু বিক্রি হতো। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পুজোর প্রসাদ বিতরণ হতো শালপাতায়। প্রযুক্তি এসে সে-সবের জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক বা কাগজের ওয়ানটাইম প্লেট-গ্লাস। এদিকে মানুষ পুনরায় ফিরে এসেছে অলৌকিক কাণ্ডকারখানায়। ভৌতিক বিশ্বাস আর জাদুমায়ার কারসাজি। মানুষের সভ্যতা আসলে কী ? ইতিহাস পুনরায় ঘুরে ঘুরে আসে। আবর্তিত হয়। বেঁটে লোকটির নাম মফিজ। সে কোথায় দ্রুত চলে গিয়ে ফিরে আসে। বিশ্বজয় করে এসেছে।
‘কবিরাজ তোমরা রোগী দেখিবে। মুই অনেক চেষ্টা করি কনু। কোবাদ কড়া মানুষ তো।’
‘খুব ভালো করলেন ভাই। আমাদের বাড়ি চল্লিশ কিলোমিটার দূর শহরে। আবার আসতে অনেক কষ্ট।’
‘যাক, আসি যেখন গেইচেন, সেখন আর সমিস্যা নাই। কোবাদ ডাকিবে। এ্যাইঠে থাকেন।’
‘উনি কি মন্ত্রতন্ত্র পড়েন নাকি ?’
‘আসতাগফিরুল্লাহ। শেরকি কাজ করে না। আল্লাহ্র পাক কালাম নিয়া দোয়া তাবিজ। রূকাইয়াহ্ না কী কয়, মুই সঠিক জানো না। তার গোড়ত্ দুইটা জিন আছে।’
‘জিন!’
সেই গাছের ছায়ায় কোত্থেকে একটি বেঞ্চ এসে গেল। তারা সেখানে বসে পড়ে। এখন অপেক্ষা। মাহিন দশ টাকার একটি নোট বের করে দেয়। মফিজ বিগলিত হাসতে হাসতে বলে,
‘মুই এ্যানা তোমার রোগীক আগতে দেখার ব্যবস্থা করি আইসো। দূরের মানুষ।’
‘জি জি, খুব ভালো হয়।’
কোবাদ ফকির বা কবিরাজ বেশি অপেক্ষায় রাখে না। বিশেষ বিবেচনায় ডেকে নেয়। মাহিন একনজরে চারিদিক দেখে নেয়। কোবাদ বয়স্ক মানুষ। সাদা ধবধবে আলখাল্লার প্রান্তসীমায় পায়জামা প্রায় হারিয়ে গেছে। চেহারায় একগোছা কাঁচাপাকা দাড়ি লম্বাটে করে রেখেছে মুখমণ্ডলের কাঠামো। সালাম দেওয়া আর নেওয়া হয়। ছোট আকারের ঘর অথবা আসবাবপত্রে ঠাসা বলে ক্ষুদ্রায়তন মনে হয়। উত্তর দেয়াল ঘেঁষে অনেক লম্বা আর উঁচু টেবিল। তার ওপর বিভিন্ন সাইজ ও রঙের শিশি-বোতল। এক কোনায় বৃহদাকার কলস, মুখ ওলটানো, যা কোবাদের হাতের কাছাকাছি; উঁচু চেয়ার থেকে স্পর্শ করা যায়। সমস্ত ঘরে অচেনা আতরের সুবাস। একগোছা আগরবাতি মধ্যাহ্নের এক-দেড়টায় হালকা ধোঁয়া তুলে আবদ্ধ হয়ে আছে। কয়েকজন মানুষও বেঞ্চে বসে অপেক্ষায়। কোবাদ বলে,―
‘বলেন বাবাজি কী সমস্যা ? রোগী কে ?’
মঈন সমস্যার কথা বলে। শাহিন একটি মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। মেয়েটির পরিবার রাজি। সমস্যা হলো এই পরিবার মেনে নেবে না। সেজন্য শাহিন ঘুমের অনেকগুলো ট্যাবলেট খেয়েছে। হাসপাতালে ওয়াশ করা হয় জানাজানি হলে। এখন মাথা আউলা। কখনও ভালো কখনও খারাপ। উল্টো-পাল্টা কথা বলে। রাতে ঘুমোয় না। এখানে-ওখানে পায়চারি করে। অস্বাভাবিক আচরণ।
কোবাদ চেয়ারে বসে সেই বিশাল কলসের উপর কয়েন বা অন্য কিছু দিয়ে তিনবার টোকা দেয়। টুক। টুক। টুক। টোকার কিছুক্ষণ পর অদ্ভুত প্রতিধ্বনি ওঠে। এরপর শুরু হয় কোরআনের কোনও সুরা তেলাওয়াত। কোবাদ তেলাওয়াত শেষ করে মোলায়েম কণ্ঠে বলে,―
‘বাবা এদিকে আসেন। আপনার হাতটা দেন। আপনারা সবাই নিজেদের শরীর টানটান করে রাখবেন না। হালকাভাবে ঢিল দিয়া থাকেন। হাতের মুষ্টি খুলে রাখেন।’
মাহিন কেন জানি নিজেকে তেমনভাবে রাখে। একটি তাবিজ নেওয়া হলো। এক বোতল পানি। কোবাদ ফিসফিস করে পানিতে ফু মেরে দিল। কোনও চার্জ বা ফি নেই। তাবিজের হাদিয়া মাত্র। পাঁচ টাকা পঁচিশ পয়সা। কোবাদ পরিশেষে মন্তব্য করে, ‘শোনেন বাবা, বিবাহ হলো আল্লাহর নিয়ামত। মহান আল্লাহতায়ালা নরনারীকে জোড়া নির্ধারণ করে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। যদি আপনার আকাক্সিক্ষত নারীকে আল্লাহতায়ালা জোড়া মিলিয়ে রাখেন, তবে আপনার বাবা-মা, অন্য যে-কোনও মানুষ বা জিন কারও সাধ্য নাই সেটা ভাঙে। সুতরাং মাথা সোজা রাখেন। মন শান্ত করেন। নামাজ পড়েন। আল্লাহর কাছে পানাহ চান। তিনি সর্বজ্ঞ ও শক্তিমান।’
কোবাদ এরপর উঁচু চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে সজোরে ‘আসতাগফিরুল্লাহ রাব্বি মিন কুল্লে’ বা তওবার দোয়া পাঠ করে। শাহিনকে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মঈন। মাহিনও ওঠে। তখন কোবাদ বলে উঠে,―
‘বাবা আপনি একটু দাঁড়ান। আপনি এ-সব বিশ্বাস করেন না। আমি জানি, নামাজও পড়েন না। আল্লাহ আপনার হেদায়েত দিক। শাফা দিক। বাবা আপনি সন্ধ্যার পর রাতে রাস্তাঘাটে বাইর হবেন না। অন্ধকারে কেউ পেছন থেকে ডাকলে ফিরে দেখবেন না। নামাজ পড়বেন। কোরআন হলো সকল মুশকিলের আসান।’
মাহিন এই কথাগুলো শুনতে শুনতে শিউরে ওঠে। তার খারাপ লাগে। কোনও জায়গায় ভালো কিছু হয় না। দুর্ভাগ্য। সে নিজে এর জন্য দায়ী, অন্য কেউ নয়; সময়-পরিবেশ এবং কেউ হয়তো এমন অন্ধকারে জীবন ঠেলে দিয়েছে। সে আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়। কোবাদ উঁচু চেয়ারে দাঁড়ানো অবস্থায় থেকে মাহিনের মাথায় ডান হাত ছড়িয়ে রেখেছে। এরপর খুব জোরে ফুঁ দিলে চুলগুলো বুঝি দমকা বাতাসে ভেসে যায়। মাহিনের অদ্ভুত অনুভূতি হতে শুরু করে। সে শহরে ফেরার পথে একটিও কথা বলে না।
আজ তেমনই হয়তো অন্য একজনের কাছে এসেছে মাহিন। তার নাম বেলাল হোসেন। শাহিনের পছন্দ মতো বিয়ে হয়েছে। এখন এক ছেলের বাবা। সেই ছেলের বয়সও তো পাঁচ-ছয় হয়ে গেল। কোবাদের সঙ্গে সেই সাক্ষাতের প্রায় এগারো-বারো বছর পার হয়ে গেছে। মাহিন অব্যাখ্যাত আশ্চর্যের কিছু বিষয় ঘটতে দেখে যা কাউকে কখনও বলে না। এমন এক চাকরি, সেখানে অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায়শ রাত হয়ে যায়। পুলিশ লাইন স্কুলের চিকন গলি পেরিয়ে ছোট এক মাঠ। সেখানে দু-চারটি লিচু গাছের ছায়া আলো-অন্ধকারে ভৌতিক লাগে। আশপাশের বাড়ি থেকে প্রসারিত আলো যে ছায়া ফেলে রাখে সেও বড় রহস্যময়। সে শিউরে নির্জন নিরিবিলি রাস্তায় ওঠে। কোনওদিন পেছন থেকে ডাক শোনেনি, তবে কেন জানি কখনও অদ্ভুত উপলব্ধি হয়; কেউ একজন পেছন থেকে দেখছে। সে ভয় পায়। এ হলো তার গোপন কাহিনি। এর সঙ্গে কি তার শরীরে বোটকা গন্ধের সম্পর্ক আছে ? কে জানে একটু বেশি ভেবে নেয় সে। অহেতুক অনর্থক। তারপরও এত চিকিৎসা শেষে যখন তেমন অগ্রগতি হলো না, একবার অন্যভাবে দেখা যাক না কেন ? আপাতত বিজ্ঞানের যুক্তি মনের মধ্যে থাক। আমরা পৃথিবীর কতটুকু জানি বা দেখি ? অনেক কিছুই রহস্যময়। অব্যাখ্যাত গোলকধাঁধা। বিজ্ঞান সকল রহস্যের জট খুলতে পারেনি।
মজিবর দোকানের কাছে ভ্যান রেখে সিগারেট জ্বালিয়ে যতমতো টান দিতে শুরু করেছে। মাহিন এবার টিনছাপরার দরজার কাছে গিয়ে জোরে সালাম দেয়। বেলাল হোসেন চল্লিশ বা তারও কম বয়সী মানুষ। পরনে হাফহাতা শার্ট আর লুঙ্গি। ছাপরা ঘরের তিন দিকের দেয়াল ঘেঁষে বেঞ্চ। সেখানে ছয়-সাতজন বসে আছে। বেলালের সামনে একটি চেয়ার। সেই চেয়ারে পরামর্শপ্রার্থী বসে বুঝতে অসুবিধা হয় না। বেলাল তার কথা শোনে। তারপর চিকিৎসা ও পরামর্শ। মাহিন বেঞ্চের এক কোনায় গিয়ে বসল। এখন সিরিয়াল কখন আসবে কে জানে। সে সামনের কেস বা ঘটনা ও পরামর্শ কী সেটি জানতে মনোযোগী হয়। একজন সাতাশ-আটাশ বছরের যুবক। চেহারায় রাজ্যের হতাশা নিয়ে নিচু গলায় কথা বলছে। কথোপকথনে সেই কাহিনি গোপন থাকছে না। প্রাইভেসি রাখা দরকার। বেলাল বলে,―
‘এখন তাইলে তুমি কী করতে চাও ? বউকে ছাড়ি দিবা ?’
‘আমি চাই, সে আমার কাছোত থাকুক।’
‘তোমার ঘটনা শুনলাম। ঢাকার গার্মেন্টেসে কাজ করো। বউ নিয়া যাবার ব্যবস্থা নাই। বউ তোমার চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক করিছে। এমন বউয়ের সঙ্গে কি ঘরসংসার করতে চাও ?’
‘চাই। আমি ওকে খুব ভালোবাসি। ও যতই দোষ করুক না ক্যান, আমি ওকে ছাড়া বাঁচব না। আপনি ওর মতিগতি আমার দিকে ফিরায়া দেন। ওঁয় য্যান্ তাক ভুলি যায়।’
‘সেখন ভালো করি ভাবো। পরে আবার ছাড়ি দিবা পারবা না।’
‘আমি তাকে ছাড়ি দিব না। এক-দুই মাসে ঢাকাত নিয়া যাব।’
‘তাইলে তো আর সমস্যা নাই। সমস্যার সমাধান হয়া গেল। আমাদের সমাজে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াঝাঁটি মামুলি ব্যাপার। ঝগড়া করে আবার প্রেমও হয়। এ্যারি নাম সংসারের সং। সং বোজেন ? যাক তুমি এ্যালা এক বোতল পানি আনো। দম দিয়া দি। ইনশাআল্লাহ তোমার মনের ইরাদা পূরণ হবে।’
বেলাল এরপর আরবির মতো কিছু আওড়ায়। সে-সব কি কোরআনের কথা ? কে জানে। মাহিনের জানা নেই। যুবকটি একছুটে বেরিয়ে আবার ফিরে আসে। রিফাইন্ড পানির বোতল। বেলাল বোতলের ক্যাপ খুলে দম ধরে ফু দিতে থাকে। একবার-দুইবার করে সাতবার। বোতলে ভেঁপুর মতো শব্দ ওঠে। কে জানে থুতু ভেতরে চলে যায় কি না ? এরপর সকলকে এড়িয়ে ডাক দেয় মাহিনকে।
‘আপনি মনে হয় শহর থাকি আসিছেন। সামনে আসেন। ও বাহে, আগোত্ ইনার সমস্যার সমাধান দেখি। তারপর সবার কথা শোনমো।’
কেউ কোনও কথা বলে না। পুব দেয়ালের বেঞ্চে দু-একজন মহিলা চঞ্চল হয় মাত্র। মাহিন সেদিকে ভ্রƒক্ষেপ না করে চেয়ারে বসে। কোথা থেকে শুরু করবে ? কীভাবে ? এখন যে সব আউলা হয়ে যাচ্ছে।
‘বলেন বড়ভাই। আপনি কী জন্য আসিছেন ? সমস্যা কী ?’
‘আমার গায়ে গন্ধ। বোটকা। আমার নিজেরই খারাপ লাগে। আগে পেতাম না। অন্যরা পায়। আজকাল নিজে গন্ধ পাই। ডাক্তার, অ্যালোপ্যাথি বলেন, হোমিও সব চিকিৎসা করিয়েছি। কোনও লাভ হয়নি।’
‘গন্ধটা আমিও পাছি। পচা। এই যেমন ইঁদুর-চিকা মরার পর পচি যায়, তেমন গন্ধ।’
‘মানুষ মরলেও কি এমন গন্ধ হয় ?’
‘ক্যান হবে না ? ইঁদুর আর মানুষের মধ্যে সিস্টেমের কোথায় কোথায় পার্থক্য ? আপনি শিক্ষিত মানুষ। সবই তো জানেন…বোঝেন। আমাক ফের প্রশ্ন করেন ক্যান ?’
‘জি! ভুল হয়ে গেছে।’
‘যাক, মাফ করি দিলাম। আর কখনও এমন প্রশ্ন করিবেন না। আপনি কি বাচ্চা ছইল ? এ্যাটি তামাশা দেখবার আসিছেন ? যাক। আপনার এই সমস্যা কতদিন হইতে ?’
‘এক বছরের বেশি সময় মনে হয়।’
বেলাল হোসেন স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে। কী ভয়ংকর অন্তর্ভেদী চোখ! মাহিন বিব্রতবোধ করে। কেন যে এখানে আসা হলো কে জানে ? এরপর কত টাকা চার্জ নেবে ঠিক নেই। সবই বুজরুকি।
‘শোনেন বড়ভাই, আপনার সমস্যা অনেক আগে থাকি। আপনি টের পান নাই।’
মাহিন চমকে উঠে। সমস্যা পুরোনো হতে পারে। কত দিনের কত বছরের জানা নেই। বেলাল নিষ্পলক তাকিয়ে আছে। মাহিনের ভালো লাগে না। তার ভেতর-বাহির সব পড়ে নিতে থাকে।
‘বাড়ির আশপাশে খুব বড় কোনও গাছ আছে ? বড় বলতে পুরাতন।’
‘অনেক কয়টা আছে। পুরাতন ছিল। বিল্ডিং হচ্ছে। মালিকেরা কেটে ফেলেছে।’
‘আচ্ছা। পুকুর ? যে পুকুরে মানুষ গোসল করে না, কাপড়চোপড় ধোয় না। একেবারে থমথমে পুকুর ?’
‘জি একটা আছে। আমার জন্মেরও আগে থেকে আছে। ওতে একসময় মানুষজন গোসল করত। কাপড় ধুতো। এখন মাছচাষ হয়।’
বেলাল স্থির চোখে খানিক তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে কী ভাবে। তার শরীর কেঁপে ওঠে। স্নায়ুবিকল রোগীর মতো কাঁপতে থাকে। মাহিন কী করে ? সে কি চলে যাবে ? তার হাত-পা নিশ্চুপ হয়ে থাকে। এক মিনিট কি দুই, বেলাল অর্ধনিমীলিত চোখে কাউকে বলতে শুরু করে,―
‘আমার হুজুর, পীর সাহেব, আসসালামু আলায়কুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। অনেক দূর থেকে একজন মানুষ আইছে হুজুর। তার সমস্যার কথা আপনাকে বললাম। এর সমাধান দেন। অনেক কষ্ট পাইতেছেন বেচারা। আপনার দরগায় জোড়া খাসি দেবার নিয়ত করিছে হুজুর। মানুষটাক রোগ থাকি মুক্তি দেন। আল্লাহ পরম সহায়। রাব্বানা আতি না…।’
বেলালের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে খাদে নেমে আসে। মাহিন নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে কখন জোড়া খাসি দেওয়ার নিয়ত করল ? একটি ছাগলের দাম পনেরো থেকে কুড়ি হাজার টাকা। একজোড়ার জন্য তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার। সে কি তামাশা করতে এসেছে ? যত্তসব। এ লোক তো পাঁচশ বা হাজারের নিচে টাকা নেবে না মনে হয়। কে জানে আরও বেশি। অজ পাড়াগাঁয়ে বেশ ভালো ব্যবসা। মানুষ বিশ্বাস করে ঠকে। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। এই প্রবচন সব জায়গায় খাটে না। অগত্যা এসে যখন পড়েছে শেষটুকু দেখা যাক। মাহিন আলগোছে বাইরে বেরোয়। এক শিশি সরষে তেল আর পানির বোতল নিয়ে আসার হুকুম হয়েছে।
‘শোনেন বড়ভাই, গোসলের সময় বালতিতে একটু পানি মিশায়ে নিবেন। তার আগে নাভি আর দুই পায়ের বুড়া আঙুলে এক ফোঁটা তেল। গোসলের পর বুকে-হাতে-পায়ে এক ফোঁটা তেল মাখবেন। ইনশাআল্লাহ সকল বালামুসিবত কালাজাদু বদজিনের আছর কু-দৃষ্টি সব সারি যাবে। আল্লাহ ভরসা।’
মাহিন উঠতে উঠতে হাতে মোড়ানো একশ টাকার দুটো নোট গোপনে দেওয়ার মতো এগিয়ে ধরে। বেলাল কবিরাজ সেটি না দেখেই ছোঁ মেরে নিয়ে পকেটে চালান করে দেয়। শহর থেকে অনেক দূরে গ্রামের একজন গুনিন বা কবিরাজ যদি সারাদিন দশ-পনেরো বা কুড়িজন মানুষের তথাকথিত সমাধান পরামর্শ দেয় আর ন্যূন একশ টাকা গ্রহণ করে, তবে দৈনিক কত আয় হয় ? মাসে ও বছরে ? সহজ অঙ্ক। মাহিনের সেই অঙ্ক কষার প্রয়োজন কী ? তারপরও মনে আসে। সে বাইরে এসে নিশ্বাস টেনে টেনে নিজের শরীরের গন্ধ খোঁজে। আছে কি নেই বোঝা যায় না। মজিবর এগিয়ে আসে। তারপর ভ্যান আর এবড়োখেবড়ো রাস্তা।
ফেরার পথে বাসে বাইরের দৃশ্যাবলি আর ভেতরের মানুষজন দেখতে দেখতে, তাদের কথাবার্তা শুনতে শুনতে গুনিনের শেষ কথা পুনরায় মনে করে নেয়। বেলাল শেষবেলা মৃদুকণ্ঠে ফিসফিস করে বলে,―
‘আপনার উপর বদ জ্বিনের আছর আছে। সে আপনাকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। মজা করে। বোজেন নাই ?’
‘আমি তো একা একা চলি ভাই। কারও সাতপাঁচে নাই।’
‘আপনি এর মধ্যে সবকিছুর রহস্য বুঝতে পারবেন। স্বপ্ন দেখবেন নয়তো চোখের দেখা। ভয় পাবেন না। সাহস রাখিবেন। ভয় পাইলে শয়তান ঘাড়োত্ চাপি বসিবে।’
মাহিন কয়েক দিন জলকল ছেড়ে বালতি ভরতি করে। বোতল খুলে কিছু পানি ঢেলে নেয়। বাথরুমের নিরিবিলিতে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তারপর ভেজা শরীর টাওয়ালে মুছে হালকাভাবে সরষে তেল মাখে। আজকের দিন ভালো যাবে প্রত্যাশা করে। একদিন তপতী জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার! তুমি তো তেল মাখো না। শীতের দিনে বডি লোশন ব্যবহার করো। এই গরমের মধ্যে তেল মাখো কেন ?’
‘আচ্ছা, দেখো তো, আমার গায়ে পচা গন্ধ আছে ? আমি তো পাই না।’
তপতী একেবারে কাছে এসে হাতের পরে হাত তুলে নেয়। জোর নিশ্বাস টেনে শোঁকে। আলগোছে শার্ট তুলে পিঠের গন্ধ নেয়। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বলে,―
‘কই ? আমি তো শুধু তেলের গন্ধ পাচ্ছি।’
‘অ কে।’
‘এই শোনো, তুমি মন খারাপ করো না। পুরুষ মানুষের গায়ে একটু গন্ধ থাকে। এই যেমন পাঁঠার গায়ের মতো। হি হি হি!’
‘আমি কি পাঁঠা ?’
‘বিচিত্র কী ? পুরুষমানুষ হলো পাঁঠা। হি হি হি!’
‘বেশ!’
‘আহা! তুমি এসব টেনশন বাদ দাও তো। কার্বলিক অ্যাসিড দেয়া সাবান ব্যবহার করো। সব জার্ম দূর হবে। ত্বকের মৃত কোষের কারণে গন্ধ হয়। এ আর এমন কি! পারফিউম তো ব্যবহার করো। এ-সব নিয়ে মনে ইনফেরিঅরিটি কমপ্লেক্স এনো না।’
‘অ কে ম্যাম।’
এভাবে দিন কয়েক কেটে গেল। মাহিন মনে মনে সামান্য স্বস্তি পেতে শুরু করে। তারপর পুনরায়। সেদিন সন্ধেয় অফিস থেকে ঘেমেনেয়ে ফিরছে। আকস্মিক দমকা বাতাসে পচা গন্ধ ভেসে এলো। মাহিন তখন আবর্জনার স্তূপ পেরিয়ে যাচ্ছে। শহরের সিস্টেম যেমন, মানুষজনও কম কীসে ? রাস্তা জুড়ে যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। কী সকাল আর কী রাত। এগুলোই পায়ে পায়ে নিজেদের ঘরদোরে পৌঁছে যায়। এইসব ভাবনার মধ্যে কয়েকদিনের ফুর্তি বাতাসে মিলিয়ে গেল। তার শরীর থেকে দুর্গন্ধ আসছে। সে হলো দুর্গন্ধ মানুষ।
সেই রাতে ভয়ংকর স্বপ্ন হানা দিল। তার প্রতি রাতের ঘুমে আজব কিসিমের স্বপ্ন আসে। কোনওদিন পরীক্ষার হলে প্রশ্নপত্র নিয়ে ঘামছে, প্রশ্ন কমন আসেনি; সে লিখতে পারছে না। দোতলা থেকে নিচে নামার বা ওঠার সিঁড়ি দেখা যায়, কিন্তু কোনও ধাপ নেই; অথচ তাকে উপরে যেতে কি নিচে নামতে হবে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, আচমকা বৃষ্টি এসে গেল; সে ভিজে একশা। তার পরনে একটুকরো কাপড়ও নেই। একেবারে ন্যাংটো। কখনও দিনেদুপুরে আকাশে ভেসে ভেসে উড়ে যাচ্ছে। এক ছাদ থেকে অন্য কার্নিশে বসছে। সে হলো কাক। আচ্ছা, পৃথিবীতে এত পাখি থাকতে কাক হলো কেন ? সে তো দোয়েল-ময়না-টিয়া পছন্দ করে। সে-সব হয় না কেন ? স্বপ্নের মধ্যেই হিসাবনিকাশ শুরু হয়। তারপর দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর। তার ঘুম হয় না। এপাশ-ওপাশ করে রাত পেরিয়ে যায়।
সেই রাতে স্বপ্ন দেখে মাহিন। সেটি স্বপ্ন নয়, বাস্তব ঘটনার দৃশ্যায়ন; সে ঢাকা যাচ্ছে। পরিবারের বড়ছেলেকে অনেক দায়িত্ব নিতে হয়। চাকরির চেষ্টা চলছে। সে লিখিত পরীক্ষা দেয়। কখনও ভাইভা। সে কুড়ি ইঞ্চি সাইজের এক স্যুটকেসে দু-একদিন থাকার মতো কাপড় আর ভাইভার প্রস্তুতি হিসেবে বইপত্র নেয়। ওতেই স্যুটকেস ভারী হয়ে যায়। একতা এক্সপ্রেস রাত এক-দেড়টায় বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌঁছে। এই সময় ভালো নয়। মধ্যরাত থেকে ফজরের আজান পর্যন্ত ভূত-প্রেত-অপদেবতা-জিনের দাপুটে সময়। সে এই জানা কথা ভেবে নিয়ে এগিয়ে যায়। মানুষজন সমাজে কত কথা ছড়িয়ে রাখে! সব কথা বিশ্বাস করতে হয় না। তারপর ফেরি। ফেরি যমুনা নদী বেয়ে ওপারের তিস্তামুখ ঘাটে যেতে তিন থেকে সাড়ে তিন বা চার ঘণ্টা সময় নেয়। এই সময়টুকু বড় অস্থির লাগে।
মাহিন ফেরিতে কেক খায়। কেক রঙে রঙে প্রগাঢ় হলুদ আর এক-দুই দিনের বাসি। এরপর এককাপ চা নেয়। কখনও পান খেতে ইচ্ছে করে। সে পান খায় না। এক রাতে ফেরিঅলার কাছে থেকে পান নিয়েছিল। মিষ্টি সুপারির বদলে জরদা অথবা কে জানে কী দিয়েছে, তার মাথা ঘোরে, প্রচণ্ড বিবমিষা পায় যেন পড়ে যাবে; তখন থেকে পান না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য আসক্তি নেই। সে ফেরিতে হেঁটে বেড়ায়। এদিক থেকে ওদিক, নিচতলা থেকে উপরে; কত জায়গায়। নদীর জলে প্রচণ্ড ঢেউ। একসময় সাঁতার শিখেছিল। ফায়ার ব্রিগেডের অপরিষ্কার স্থির জলের পুকুরে স্কুল ফাঁকি দিয়ে দাপাদাপি। সেই সাঁতার সঠিকভাবে শেখা হয়েছে কি না সন্দেহ থেকে যায়। এখন মনে আছে কি না জানা নেই। ফেরি ডুবে যায় না ? যদি ডুবে যায়, তখন কীভাবে উদ্ধার পাবে ? নদীর জলে কী স্রোত! ভয় লাগে। সে সত্যি সত্যি সাঁতার ভুলে গেছে।
সে এমন ভাবনার মধ্যে স্যুটকেস হাতে হেঁটে হেঁটে বড় কোনও লম্বা রুমে এসে দাঁড়ায়। গোডাউন টাইপের আবছা অন্ধকার পরিসর। সেখানে চার-পাঁচজন লোক দাঁড়িয়ে ও বসে আছে। তাদের কারও গায়ে চাদর। কারও জ্যাকেট। মাফলারে জড়ানো চেহারা। মাঘের প্রচণ্ড শীত। নদীর ছায়ায় ঘনীভূত কুয়াশা। অবশ্য ফেরিতে মানুষজনের ভিড়ে তেমন শীত লাগে না মাহিনের। সে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে লিখিত পরীক্ষার কথা ভেবে নেয়। একটি চাকরির স্বপ্ন। আগামী দিনের পরিকল্পনা। এমন বেছুট ভাবনার মধ্যে সহসা চমকে উঠে। কোথায় এলো সে ? মানুষগুলোর চেহারা ঠিকমতো দেখা যায় না। মাহিন তবু কেন জানি নিশ্চিত হয়, তাদের চোখে-মুখে বিষাদ ছায়া; ক্লান্ত অবসন্ন দৃষ্টি। তারা কোথাও লাশ নিয়ে যাচ্ছে। মেঝের উপর মৃতদেহ বহন করার খাটিয়া। তার উপর কালো জমিনে সোনালি হরফে আরবি লেখা বাণী আলোছায়ায় ঝকঝকে উজ্জ্বল। একগোছা আগরবাতি খুব চিকন ধোঁয়া তুলে তুলে উপরে মিশে যাচ্ছে। অপার্থিব সুগন্ধ। মাহিন চমকে উঠে। কোন ভুলে এই রুমে এসে গেল সে ? মানুষগুলো একটুও শব্দ করে না। একটিও কথা বলে না। পাথরের মতো রাতের নিশ্চুপ দেয়ালে স্থির তাকিয়ে আছে। মাহিনের যে কী হয়, জেনে নেওয়ার অসম্ভব আগ্রহ বা কৌতূহল; সে জিজ্ঞেস করে,―
‘কে মারা গেছেন ?’
কেউ জবাব দেয় না। তারা বুঝি শুনতে পায়নি অথবা প্রপেলারে জলের গুঞ্জনে ঢাকা পড়ে গেছে জিজ্ঞাসা। মাহিন না জেনে যেতে পারছে না। তার পা জমে গেছে। সে পুনরায় প্রশ্ন ছুড়ে দেয়।
‘কে মারা গেছেন ? আপনারা কোথায় যাবেন ?’
‘একজন মেয়ে। কলেজছাত্রী। আত্মহত্যা করেছে।’
‘আহা! কেন ?’
‘সে একজনকে ভালোবাসত। অভিভাবকেরা তার সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি নয়। বিষ খেয়েছে। পাঁচ-দশ মিনিটেই শেষ।’
‘আহা রে!’
পৃথিবীতে এত ভালোবাসা, এত মায়া, এত প্রেম; ঈশ্বর এই কয়েক দিনের জীবনে সেখানে কেন এত কান্না ছড়িয়ে রেখেছেন ? মাহিন জলদগম্ভীর কথোপকথনের সীমারেখায় ঝুলে থাকে। সে বেরোতে পারে না। মেয়েটি নিশ্চয়ই অতীব সুন্দরী। সে কি তার মতো মায়াবতী, মাহিন যাকে খুব আপন করে চেয়েছিল ? মাহিনের মনের ক্যানভাসে একজনের মুখচ্ছবি জেগে ওঠে। সে রিমু। মাহিন আজও ভালোবাসে। তার জন্য একমুহূর্তে জীবন ছেড়ে দিতে পারে। ভালোবাসা এমনই। যেখানে যুক্তি নেই। নেই লাভক্ষতির হিসাব। একমাত্র ভালোলাগা আবেগ এগিয়ে নিয়ে যায়। একজন অপরজনের সঙ্গী হয়ে সবকিছু ছেড়ে দেয়। এই মেয়েটি কে ?
মাহিন চমকে উঠে। তার শরীর ঘেমে গেছে। সে বেডে উঠে বসে। আজ অনেক অনেক দিনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি স্বপ্ন হয়ে কেন দেখা দিল ? সেও তো দশ-পনেরো বছর পেরিয়ে যায় যায়। রিমুর হাসি হাসি মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। তার মায়াবি চোখ। জলতরঙ্গের সুরে সুরে স্বপ্নীল কথা। রিমু আজ কোথায় ? মাহিন সে-সময় অনেকগুলো সিøপিং পিল খেয়েছিল। তারপর ঘুমের রাজ্য, ঘুম শুধু নির্বোধ ঘুম; সে আলোছায়া টানেলের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায়। তার ঘুমের মধ্যে অপলক জেগে থাকে রিমু। শিয়রে বসে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দেয়। সে একদিন কিছু না বলে হারিয়ে গেল। তারপর জীবন থেমে থাকে না। মাহিন বিয়ে করল। তপতীর প্রেমে নিজের বুকের খাঁ-খাঁ শূন্যতা ভুলতে চাইল। সন্তানের পিতা হলো। আজও কখনও কখনও শুক আর সন্ধ্যাতারার মতো ফেলে আসা দিন উঁকি মেরে দেখে নেয়। রিমু হেসে হেসে কথা বলে। কেমন আছে জেনে নিতে চায়। মাহিন মরেনি, মন মরে গেছে; তার জীবন মৃত মানুষের শোকগাথার মতো নিশ্চুপ কথোপকথন।
ওইদিন সন্ধেরাতে অফিস থেকে ফেরার সময় মনে হয় কেউ পেছন-পেছন অনুসরণ করছে। তার প্রায় নিশ্চুপ পদশব্দ শোনা যায়। নূপুরের মৃদু ঝুনঝুন। কোনও হালকা ছায়া একপাশ থেকে অন্যপাশে দ্রুত ছুটে যায়। সেই সঙ্গে গন্ধ। মৃত মানুষের গন্ধের মতো ? সে সঠিক উপলব্ধি করতে পারে না। কোথায় বুঝি দুর্বোধ্য ছায়া ছায়া গোলকধাঁধা অন্ধকার। আগরবাতি যেমন পুড়ে পুড়ে মৃত আকাক্সক্ষার মধ্যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। মাহিন অনেক অনেক আগে এমন গন্ধ ফেরিতে পেয়েছিল। কতগুলো চা-পাতার খালি কার্টন বুঝিয়ে দেয় মানুষের তীব্র আকাক্সক্ষার মৃত্যু হয় না। প্রত্যাশা ফুরোয় না। তাকে জনম জনম ধরে শূন্যতা কাঁদায়।
মাহিন সাইকেল থেকে নেমে ডানে-বামে আর পেছনে তাকায়। আশপাশের বাড়িঘর থেকে আবছা আলো ছড়িয়ে পড়েছে। রাতের অন্ধকার পুরোপুরি দূর হয়নি। সে ছায়া বা কাউকে খোঁজে। কেউ কি কিছু বলতে চায় ? সে কি আমগাছের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে ? সেই মেয়েটি কিংবা কোনও অতীত, যে কি না ভালবাসার মানুষকে না পেয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েছিল ? কে সে ? মাহিন একবার নিজের জীবন কেড়ে নিতে চেয়েছিল। তার স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার মৃত্যু হয় সেদিন। হায়! তার চোখ ঝাপসা হয়ে যায় সহসা। রিমু তুমি কোথায় ? আমায় কেন ছেড়ে গেলে ? মাহিন সেদিনই মরে গিয়েছিল।
গাছের পেছনে একটুকরো সাদা কাপড় হাওয়াতে ওড়ে। সেটি কাপড় নাকি আটকে থাকা পলিথিন বোঝা যায় না। মাহিন কী করে ? সেদিকে এগিয়ে যাবে ? মানুষ অতীত থেকে পালাতে পারে না। এক জন্ম থেকে অন্য জন্ম, আরও জন্ম; জন্মান্তর ধরে চলতে থাকে মৃত আকাক্সক্ষার পরিপূরণ। আলোর অনুসন্ধান। মাহিন কোথায় পালায় ? সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। ক্রমশ ঘোরের মধ্যে ডুবে যায়। ডুবে যায়। সে সেখানে তল পায় না।
আকস্মিক লোডশেডিং এসে অন্ধকার আরও ঘনীভূত করে দেয়।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ