
নিউইয়র্কে ১৫ দিনের সফর শেষে আমাদের সরাসরি যাওয়ার কথা ছিল নর্থ ক্যারোলিনার শার্লটে। কিন্তু গেলাম না। নিয়তি নিয়ে গেল ভার্জিনিয়ায়। ওখানে বনের ধারে সারোয়ারের বাসার নির্মম নির্জনতা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার একনিষ্ঠ বাসনা থেকেই কোনও এক শুক্রবার দুপুরে ম্যানহাটান থেকে বাসে চেপে চলে গেলাম। কথা ছিল সঙ্গে যোগ দেবে সন্তোষ, সরোজসহ আরও অনেকে। আমাদের বিরামহীন বাকপ্রবণতায় পাশের বনভূমি পর্যন্ত সরব হয়ে উঠবে, ঝড় উঠবে, গাছেরাও কথা বলবে বৃষ্টির ভাষায়। সব কিছু ঠিকঠাক চলেছে। সারোয়ারের কথার নেশায় বুঁদ হয়ে দুটো রাত কীভাবে কাটিয়ে দিলাম! রোববার সকালে বিদায়ের পালা। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি আমাদের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে একটি ভয়াবহ রাত। সারোয়ারের সঙ্গে টানা আলাপচারিতায় পৃথিবীর যাবতীয় দর্শন থেকে শুরু করে দেশীয় রাজনীতি, রন্ধনশিল্প, সিনেমা, কবিতা, গল্প কিছুই বাদ যায়নি। মানুষের বিশ্বাস, অবিশ্বাস, ধর্ম, নিয়তি নিয়েও কথা বলেছি। ইডিপাসের কথাও এসেছে। ইডিপাস শুনেছিল ওরাকলের ভবিষ্যদ্বাণী। সেই নিয়তি এড়ানোর জন্য নিজের ঘরবাড়ি ছেড়েছিল। আর সেটা ছিল তার ট্র্যাজিক পরিণতির প্রথম পদক্ষেপ। আমারও যেন সেই অবস্থা। কঠিন ভোগান্তি কপালে আছে বলেই নিউ ইয়র্ক থেকে সরাসরি নর্থ ক্যারোলিনা না গিয়ে মাঝখানে দুদিনের জন্য চলে গেলাম ভার্জিনিয়ায়।
১৭ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসির ইউনিয়ন স্টেশন থেকে ট্রেনে রওনা দিলাম নর্থ ক্যারোলিনার শার্লটের উদ্দেশে। দশ ঘণ্টার যাত্রা। বিমানে লাগত দেড় ঘণ্টা। ভাড়াও সমান সমান। মাঝে মাঝে বিমানের ভাড়া ট্রেনের চাইতে কম হয়। আরাম ও বিলাসবহুল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিতে এ যাত্রায় ট্রেন বেছে নিলাম। পথে পথে নগর মহানগরের আধুনিকতা ও প্রকৃতি দেখতে দেখতে যাব এই প্রত্যাশা। যাত্রাপথে পড়বে বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী সব অঞ্চল। ভার্জিনিয়ার আলেক্সান্দ্রিয়া, কোয়ানটিকো, ফেড্রিক্সবার্গ, রিচমন্ড, পিটার্সবার্গ আর নর্থ ক্যারোলিনার রকি মাউন্ট, উইলসন, সেলমা, রালে, ক্যারি, ডারহাম, বার্লিংটন, গ্রিনসবোরো, হাই পয়েন্ট, স্যালিসবারি আর কাননাপোলিশ পার হয়েই তো যাব। তাই একটা দিন পুরোটাই কাটবে নতুন নতুন সব জনপদ, পাহাড়, অরণ্য দেখে দেখে।
ট্রেন চলছে তার নিজস্ব ছন্দে। দিনের আলোয় চোখের সামনে একের পর এক দৃশ্য ভেসে উঠছে। জ্যোৎস্না বলল, তুমি জানালার কাছে বসো। বাইরে তাকাও। লেখালেখির কাজে লাগবে। ভেতরে তাকানোর দরকার নেই। তার এই কথার মর্ম বুঝতে দেরি হয়নি। আমার ডান পাশে ছয় ফুট দীর্ঘ সোনালি চুলের স্বল্পবসনা অনিন্দ্যসুন্দরী এক তরুণী। সে বাইরের প্রকৃতি থেকে আমার দৃষ্টিকে সরিয়ে ভেতরের দিকে নিয়ে আসছে। সেটা অনুধাবন করতে পেরেই বউয়ের এই পরামর্শ। বউকে বললাম, মানুষ চিনতে না পারলে ভ্রমণকাহিনিতে লিখব কী ?
বউ বলল, কেন ? প্রকৃতি, নগরের সুন্দর সুন্দর ভবন, সেগুলোর স্থাপত্য সৌন্দর্য নিয়ে লেখো। হাসতে হাসতে বললাম, মানুষ ছাড়া ভ্রমণকাহিনি যদি লিখতে হয়, তাহলে চাঁদ কিংবা মঙ্গলগ্রহে যেতে হবে। ওখানে মানুষ নেই।
সে এবার বলল, তোমার বিশ্বাস নেই, চাঁদে গিয়ে তুমি ঠিক ওই চরকা কাটা বুড়িকে খুঁজে বের করবে।
মানুষ আর প্রকৃতি দেখার আনন্দের ভেতর দিয়ে কখন দুপুর গড়িয়ে গেল। সারোয়ারের স্ত্রী নাজমা দুপুরের লাঞ্চ দিয়েছিল। সেগুলো খেলাম শান্তিতে। ট্রেন চলছে সামনে। সময় গড়াচ্ছে। বিকেলের প্রান্তে এসে প্রকৃতি ও মানুষ দেখার উৎসাহ কমতে শুরু করল। সময় গুনতে শুরু করলাম। কখন রাত দশটা বাজবে ? কখন পৌঁছাব ? কখন নিজের বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমের অতলে হারিয়ে যাব। সন্ধ্যার কাছাকাছি। ট্রেন তখন ভার্জিনিয়ার সীমান্ত পার হয়ে নর্থ ক্যারোলিনার রকি মাউন্টের দিকে এগিয়ে চলেছে। গতিও একটু কমেছে। ক্রমশ কমছেই। কমতে কমতে এক পর্যায়ে থেমেই গেল। যেন অতিকায় একটি অ্যানাকোন্ডা চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পথে ঘুমিয়ে পড়েছে। মনে হলো হয়তো সামনে থেকে কোনও ট্রেন আসছে। সিগন্যালের কারণে থেমে গেছে। কিন্তু সময় গড়াচ্ছে। ট্রেনের ঘুম ভাঙার কোনও লক্ষণ নেই। এটা তো কোনও স্টেশন নয়। ট্রেন হঠাৎ থামল কেন ? অজানা কোনও অদৃশ্য হাত চাকার নিচে ব্রেক টেনে ধরল ? জানালার বাইরে বিস্তীর্ণ মাঠ―ভুট্টার খেত, বাতাসে দুলছে লম্বা পাইন গাছের সারি। আগস্টের বিকেল, আকাশে ভাসমান ধূসর মেঘের ফাঁক দিয়ে কখনও আলো এসে রেললাইনকে রুপালি ফিতের মতো চকচক করে তুলছে, আবার কখনও ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। দূরে এক-আধটা কাঠের বাড়ি, সাদা বেড়া দেওয়া আঙিনা, ছাদে রোদ ঝিকমিক করছে। কোথাও ঝোপের আড়ালে ঝিঁঝিঁর নিরবচ্ছিন্ন ডাক। যেন সময় থেমে গেছে এই অচেনা গ্রামীণ নীরবতায়।
আর ভেতরে ? যাত্রীদের চোখে অস্থিরতা। কেউ ঘড়ি দেখছে বারবার, কেউ জানালার কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে অচেনা দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে শান্ত প্রকৃতি, ভেতরে উৎকণ্ঠা।
এরকম একটি মুহূর্ত আসবে ভাবিনি। জীবনের বাঁকের মতো―যাত্রার গন্তব্য সামনে, অথচ পথ এগোচ্ছে না।
অনেকের কাছে জানতে চাইলাম―কেন ট্রেনটি থেমে আছে ? কর্তব্যরত মানুষকেও জিজ্ঞেস করলাম। তারা কেউ জবাব দিতে পারছে না। বয়স্ক এক মহিলা অনেক কিছু বোঝাতে চেষ্টা করল। আমি তার ৯০ শতাংশ বুঝিনি। তার কথায় আঁচ করলাম কোথাও একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই ট্রেন যাচ্ছে না। এ সময় একটা ঘোষণা এল। কিছুই বুঝলাম না। ট্রেনের একজন সার্ভিসম্যানকে পেলাম। তিনিও কোনও তথ্য দিতে পারলেন না।
ঠিক এ সময়, যখন দিনের আলো নিভতে শুরু করেছে, আমাদের ট্রেন উল্টো পথে যাত্রা শুরু করল। সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে ধীরে ধীরে, আর আমি বগির ভেতর ছটফট করছি এক অসহায় মানুষের মতো। পাশে বসে আছে আমার বউ জ্যোৎস্না―তার মুখে ভয়ের ছাপ। বুকের ভেতর কেমন একটা শূন্যতা জমে উঠল, তবু মনে মনে স্থির করলাম―যা-ই হোক, আমাকে শার্লট পৌঁছাতেই হবে। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম―ট্রেনটা কি পেছন দিকে ফেরত যাচ্ছে ?
তিনি বললেন, হ্যাঁ।
বললাম―আমার তো শার্লট যেতেই হবে।
এর উত্তরে উনি কী বললেন কিছুই বুঝিনি। তবে আমার ভাবনা ওয়াশিংটন ফেরত যাওয়া যাবে না। শার্লট যেতেই হবে।
ইংরেজি ঘোষণাগুলো কানে আসছিল অস্পষ্টভাবে, একেকটি শব্দ জটলা পাকিয়ে যাচ্ছিল মনের ভেতর। শুধু অস্পষ্ট নির্দেশ, অস্পষ্ট মুখাবয়ব আর এক অচেনা যাত্রার অন্ধকার। প্রকৃতির শান্ত গ্রাম্য স্নিগ্ধতা আর আমাদের অন্তরের আতঙ্ক যেন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল―একই জানালার দুই পাশে।
ট্রেনের ভেতর খুব ঠান্ডা। ঠান্ডা নাকি আতঙ্কে কাঁপতে লাগলাম বুঝতে পারলাম না। এই মুহূর্তে ঠিক কী করতে হবে! অন্ধের মতো পায়চারি করতে লাগলাম ট্রেনের ভেতর। নিজেদের বগির মধ্যে এতক্ষণে অনেক মুখ চেনা হয়ে গেছে। ওরা আমার অস্থিরতা বুঝতে পারছে। তারা শুধু সহানুভূতির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বিনা বাক্য ব্যয়ে হতাশাই প্রকাশ করছে। কেউ বলছে না কী করতে হবে। বগির ভেতর হাঁটছি আর নিজে নিজে পাগলের মতো প্রলাপ বকছি। এক পর্যায়ে একটু চিৎকার করে বলে উঠলাম, এটা কোনও কথা! এতদূর এসে একটা ট্রেন ফেরত যেতে পারে ? তারা কি আমাদের জন্য কোনও ব্যবস্থা করতে পারে না ?
কথাটা বাংলায় বললাম। কেউ বোঝার কথা না। কিন্তু হঠাৎ কেউ যেন আমার কথার জবাব দিল―একদম ঠিক বলেছেন।
যেন কোনও পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার সময় কিছু একটা ধরে বাঁচার অবলম্বন পেলাম।
বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে বললাম―আপনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন ?
তিনি বললেন, হ্যাঁ।
বললাম, আপনি বাংলা বোঝেন ?
তিনি বললেন, আমি বাঙালি।
এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো যেন জীবনটা ফিরে পেলাম। আনন্দে লোকটার মাথাটা টেনে এনে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে বললাম―ভাই, ট্রেন তো ফেরত যাচ্ছে ? এখন কী হবে ?
তিনি হেসে হেসে বললেন, কী আর হবে! সবার যা হবে আমাদেরও তাই হবে।
আমি একটু ভড়কে গেলেও ছাড়ার পাত্র নই। বললাম, ভাই ওয়াশিংটন ফেরত যেতে পারব না। শার্লট যেতেই হবে। একটা উপায় দেখুন না।
তিনি অভয় দিয়ে বললেন, আমিও ওয়াশিংটন ফিরে যাব না। দাঁড়ান, চেক করে দেখছি। অস্থির হবেন না। সিটে গিয়ে বসুন। খোঁজ নিয়ে আপনাকে বলছি।
মানুষটি শান্ত মাথায় এত সুন্দর করে বলল, তারপরও আমার অস্থিরতা যাচ্ছে না। নিজের সিটের দিকে গিয়ে আবার ফিরে এলাম তার কাছে। উনি তাকিয়ে হাসলেন―আপনি ভাববেন না। আপনাকে যেভাবে হোক পৌঁছে দেব।
গুগল ম্যাপে আর নানা ওয়েব সাইট ঘেঁটে উনি দেখে বললেন, আপনি পিটার্সবার্গ নেমে যাবেন। ওখান থেকে রাত দশটা পঁয়ত্রিশে একটা বাস যাবে শার্লটে। ওটা ধরবেন। চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগবে।
কিন্তু বাস স্টেশন তো চিনব না। কীভাবে যাব ?
কেন উবারে!
বাংলাদেশে থেকে এসেছি। আমার ক্রেডিট কার্ড উবারে কাজ করে না। এ জন্য আমার এত সমস্যা। আপনি আমাকে একটা উবার ঠিক করে দেবেন ? আমি আপনাকে ক্যাশ ডলার দিয়ে দেব।
উনি হেসে দিলেন―চিন্তা করবেন না। আমিও পিটার্সবার্গে নামব।
এবার সব চিন্তার অবসান হলো। দৌড়ে গিয়ে লাগেজ গোছাতে লাগলাম। তিনি বললেন, পিটার্সবার্গ পৌঁছাতে দেরি আছে, কমপক্ষে দু থেকে আড়াই ঘণ্টা। আপনি শান্ত হয়ে বসুন।
উফ―পিটার্সবার্গ… পিটার্সবার্গ বলে চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে।
ফিরতি ট্রেন রাতের অন্ধকারে চলছে। তেমন গতি নেই। ধীরে ধীরে। অপেক্ষা করছি। একটু একটু খিদাও লেগেছে। আমি তার কাছে গিয়ে কফির অফার দিলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। ক্যান্টিনে যাওয়ার সময় জ্যোৎস্না বলে দিল―তুমি বিল দেবে। খবরদার উনি যাতে না দেন। ভাগ্যিস লোকটাকে পেয়েছ। নইলে আজ কী করতে ?
ক্যান্টিনে দীর্ঘ একটা লাইন। সবাই ডিনার কিনতে ব্যস্ত। কমপক্ষে ২৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এই ফাঁকে মানুষটাকে চিনতে জানতে পারব। খুশি লাগছে। নিজের নাম পরিচয় দিয়ে বললাম, আপনার নামটাই তো জানা হলো না।
বললেন, আমার নাম দেবজ্যোতি লাহিড়ী।
একটু অবাক হয়ে বললাম―দেবজ্যোতি! আপনি দেবদূত হয়ে এলেন আমার বিপদে।
শুনে হাসলেন―আমি মানুষ। আমরা একই ভাষায় কথা বলি। আপনাকে অনিরাপদ রেখে কোথাও যাব না।
যেন প্রচণ্ড গরমে বরফমাখা একটু হাওয়া শরীর ছুঁয়ে গেল। দেবজ্যোতি শান্ত থাকে বিপদে, যুক্তিহীন কথা বলে না। এখানে ফাইজার কোম্পানির গবেষণাগারে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করে। আদি বাস কলকাতায়। এদেশে আছে গত ২৫ বছর ধরে। বয়সে আমার অনেক ছোট। তাকে আর আপনি সম্বোধন করতে ইচ্ছা করছে না। এক কাপ কফির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে দুজনের আলাপে উঠে এল সমসাময়িক পৃথিবীর নানা ঘটনার কথা। উপমহাদেশের রাজনীতি প্রসঙ্গে সে বলল, আসলে জানেন তো, মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান। কিন্তু ঘটনাচক্রে মানুষের চাইতে রাজনীতির ক্ষমতা যদি বেশি হয়ে যায় তবেই গণ্ডগোল। দার্শনিকের মতো কথাটার মধ্যে কী অসাধারণ ইঙ্গিত দিল লোকটা। জিজ্ঞেস করল, চায়ের সঙ্গে কিছু খাবেন ?
বললাম―খাবো, কিন্তু বিল আমি দেব। কিন্তু সে নাকচ করে দিল। খাবার আনতে গিয়ে দেখি ট্রেনের ঝাঁকুনি নেই। চলছে না। ট্রেন আবার বন্ধ। এভাবে চলল অনেক্ষণ। দেবজ্যোতি বলল―পিটার্সবার্গে নেমে কোনও কাজ হবে না আর। দেরি হয়ে গেছে। কোনও বাস পাবেন না। আমি অনেকক্ষণ চেষ্টা করলাম একটা রেন্টাল কার নিতে। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না।
এখন কী হবে ?
রিচমন্ডে নামব। তারপর ওখান থেকে একটা রেন্টাল কার নিয়ে বাড়ি যাব।
আপনাদের বাড়ি কোথায় ?
রালে।
রালে! আমি অবাক হলাম। এই সেদিন রালেতে বন্ধু আমজাদের বাড়িতে দুই দিন বেড়িয়ে এলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেখানকার প্রকৃতি, ঐতিহ্যবাহী ও ঐতিহাসিক সব স্থাপনার কথা। আমজাদ আমাদের নিয়ে সেসব জায়গায় ঘুরিয়েছে। মনে পড়ল উইলিয়াম বি আমস্টিড স্টেট পার্কের কথা। সেখানকার ঘন বন, শান্ত জলাশয় আর পাহাড়ি পথের কথা। শরতের হালকা বাতাসে পাতার রং বদলানো, রিডি ক্রিক হ্রদের ধারে অবিরাম পাখিদের ডাক, চারপাশে সুন্দর বনভূমি, হাইকিং ট্রেইল, ঘাসে ভরা প্রান্তর, বুনোফুল আর পাখির কলতান মিলে চমৎকার পরিবেশ ছিল সেখানে। এরকম একটা অস্থির সময়ে মনে পড়ে গেল সেই শান্ত জলাশয়ের কথা। কিন্তু আমার মনটা এখন অশান্ত। মনে হচ্ছে যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্রে আছি। আমজাদ আমাকে ইউ এস নর্থ ক্যারোলিনা যুদ্ধ জাহাজে নিয়ে গিয়েছিল। নদীর তীরে বসিয়ে রাখা বিশাল জাহাজটি ইতিহাসের এক জীবন্ত সাক্ষী। কামান, টাওয়ার, ধাতব কাঠামোর বিশালতা দেখে মনে হয়েছিল মানুষকে মারার জন্য মানুষের কী বিশাল আয়োজন। সূর্যাস্তের আলো জাহাজের ধাতব রঙে প্রতিফলিত হয়ে আশ্চর্য এক রহস্য তৈরি হয়েছিল সেদিন। রালের স্মৃতি আমার কাছে খুব উজ্জ্বল। ওখানকার ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ে গথিক স্থাপত্যের নিদর্শন, ডিউক ক্যাপেল এবং বিচিত্র ফুল ও গাছের বাগানে একটা পুরো দিন কাটিয়েছিলাম। ক্যাম্পাসে শিক্ষা, সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক শান্তির এক অপূর্ব সম্মিলন। ঘুরতে ঘুরতে মনে হয়েছিল এখানকার প্রতিটি কোণ, প্রতিটি পথ যেন গল্প বলছে।
জ্যোৎস্নাকে বললাম―ওরা তো রালেতে যাবে।
সে উৎফুল্ল হয়ে বলল, ওখানে আমজাদ ভাইয়ের বাসা। তুমি আগে তাড়াতাড়ি আমজাদ ভাইকে ফোন করো। দেখো উনি আছেন কি না।
আমজাদ ফোন ধরে সব কথা শুনে বললেন, একটা শর্তে আসতে পারেন। এখানে কমপক্ষে দুদিন থাকতে হবে।
ট্রেন চলতে শুরু করে। দেবজ্যোতির আশপাশে আমি ঘুর ঘুর করছি। যাতে আবার হাতছাড়া হয়ে না যায়। আমার উদ্বেগ দেখে সে তার পরিকল্পনার বিস্তারিত বলল। রিচমন্ড ট্রেন স্টেশন থেকে কোনও রেন্টাল কার পাওয়া যাবে না। তাই রেল স্টেশন থেকে যাব এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে রেন্টাল কার নিয়ে যাব রালেতে। আমজাদ ভাইয়ের ঠিকানাটা দিয়ে তাকে বললাম, দেখুন তো আপনার বাসা থেকে এই ঠিকানা কত দূর ? সে ম্যাপ চেক করে দেখল দুই বাসার দূরত্ব তিরিশ মিনিটের। দুর্যোগ কাটছে ভেবে শান্তি পেলাম। ফিরতি যাত্রার ট্রেনটি পিটার্সবার্গ পার হয়ে রিচমন্ডে পৌঁছাল রাত ১১টার পর। রিচমন্ড স্টেশন থেকে রেন্টাল কার পাওয়া যাবে না। দেবজ্যোতি সিদ্ধান্ত দিল, তার স্ত্রী পৌলমী এবং কন্যাকে নিয়ে সে উবারে গাড়িতে এয়ারপোর্ট যাবে। আর আমরা দুজন আমাদের ভারী লাগেজ নিয়ে আরেকটা উবারে এয়ারপোর্ট যাব। সেখানে অ্যারাইভাল জোনে অপেক্ষা করব। আর তারা রেন্টাল কার নিয়ে আমাদের তুলে নেবে। সবাই মিলে রালের উদ্দেশে যাত্রা করব। উবারের চালক উজবেকিস্তানের আহামাদ আলী ২০ মিনিট গাড়ি চালিয়ে আমাদের নামিয়ে দিয়ে মুহূর্তে কোথায় যেন চলে গেল। তখন আমাদের শরীরে শক্তি নেই। লাগেজগুলো কোনও রকমে টেনে শেডে এসে ধুপ করে বসে পড়লাম একটা চেয়ারে।
এটা রিচমন্ড এয়ারপোর্টের অ্যারাইভাল জোন। গাড়ি আসছে। দূর থেকে আসা বিমানযাত্রীদের নিয়ে চলে যাচ্ছে। আমরা অপেক্ষা করছি। আমাদেরও নিয়ে যাবে। এক মিনিট, দুই মিনিট। এভাবে পনের মিনিট। আমি ফোন করলাম। তিনি বললেন, অপেক্ষা করুন।
রাত গভীর হচ্ছে, তিন নম্বর টার্মিনালের অ্যারাইভাল জোনের স্থায়ী চেয়ারে বসে আছি। চারপাশে ফ্লোরোসেন্ট আলো ঝলমল করছে, বাতাসে হালকা কোলাহল―কারও ফোনের বিপ, দূরের গাড়ির শব্দ এবং মাঝে মাঝে ল্যান্ডিং বিমানগুলোর হালকা গর্জন। কিন্তু সবই দূরে, অচেনা এবং রাতের নিঃসঙ্গতার মধ্যে কেমন ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছে।
আমরা ক্লান্ত, অবসন্ন, ক্ষুধার্ত। শরীর ভারাক্রান্ত, অনিশ্চয়তার জালে আটকা পড়ে আছি। জ্যোৎস্নার চোখে অস্থিরতা ও হতাশা। সব মিলিয়ে শরণার্থীর হৃদয় কেমন হয় তা অনুভব করলাম।
এমন সময় বজ্রপাতের গর্জন শুনলাম। আকাশ ও মাটি কেঁপে উঠল, বজ্র-বিদ্যুতের আলো যেন ভেতরের সব উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাকে পৃথিবীর সামনে স্পষ্ট করে দিল। বৃষ্টি শুরু হলো―ছাদ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে, হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে দু-একটা কোমল পানীয়ের পাত্র, টিস্যু। তুফানের সঙ্গে গাড়ি পার্কিং লটে ঝাপটা মারছে বাতাস, ঝাঁকুনিতে আমরা একে অপরের দিকে তাকাই, ভয় আরও বেড়ে গেছে।
বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা, প্রতিটি বজ্রপাতে অন্তর কেঁপে উঠছে। বাইরে গাড়ির হেডলাইট, বিমানের ল্যান্ডিং লাইট এবং বাতাসে ভেসে আসা বৃষ্টির শব্দ―সব মিলিয়ে রিচমন্ড এয়ারপোর্টের রাতকে এক অদ্ভুত, ভয়ঙ্কর, কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে প্রাণবন্ত মনে হচ্ছে।
দুজন একসঙ্গে বসে আছি―একটি চেয়ারে, অনিশ্চয়তার ভেতর অপেক্ষা করছি। মনে মনে বলছি, এই ভয়াবহ রাত পার হয়ে ঠিকই রালেতে পৌঁছাব। বজ্রপাত, বৃষ্টি, তুফান―সবকিছুকে পেছনে ফেলে, একে অপরের পাশে থাকার শক্তিই আমাদের ধরে রেখেছে। আমি ফোনে দেবজ্যোতিকে একটা মেসেজ দিলাম―ভাই কী কারণে দেরি হচ্ছে ?
একটু পর উত্তর এল―গাড়ি পেতে সমস্যা হচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে না। অপেক্ষা করুন।
অপেক্ষাই তো করছি। আর তো কিছুই করতে পারছি না। এত রাতে এয়ারপোর্টের বাইরে অপেক্ষা করছি। আমার মেয়ে অনন্যা নর্থ ক্যারোলিনায় উদ্বেগে না ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে রাত। বাংলাদেশে এখন দিনের বেলা। আমার ছেলেটি জানেই না তার বাবা-মা এখন ঘোর বিপদে।
একটা মেসেজ এল। দেবজ্যোতি লিখল―গাড়ি পাচ্ছি না। হোটেলেই থাকতে হবে।
লিখলাম―এত রাতে হোটেল পাব ?
নিশ্চয়ই পাব।
আমি অনুরোধ করে বললাম―ভাই, তাহলে একই সঙ্গে আমাদেরও হোটেলে নিয়ে যান।
দেবজ্যোতি আবার সান্ত্বনা দিয়ে লিখল―ভয় পাবেন না, একই হোটেলে থাকব।
জ্যোৎস্না বলল, আমজাদ ভাইয়ের পরামর্শ নাও। ভয় করছে। গাড়ি পাওয়া যাবে না―এটা একটা কথা হলো ?
আমজাদ ভোরে অফিসে যায়। ঘুমিয়ে পড়েছে―ঘুম জড়িত কণ্ঠে বলল, রালেতে পৌঁছেছেন ?
সব কথা বুঝিয়ে বললাম। তারপর জানতে চাইলাম―উবারে রিচমন্ড থেকে রালেতে যাওয়া যাবে কি না ?
আমজাদ বলল, এত দূরে যাবে না। রেন্টাল কার পাওয়াও কষ্টকর। যদি না পান, কী আর করবেন। কোনও হোটেলে উঠে যান।
আবার বসে রইলাম কয়েক ঘণ্টা আগে পরিচয় হওয়া একটা মানুষের জন্য। এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ সে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
ধৈর্য আর শক্তি একেবারে শেষ বিন্দুতে এসে পৌঁছেছে। আমিও বাকরুদ্ধ। মনে মনে ভাবলাম। এই চেয়ারে বসেই রাত কাটিয়ে দেব। ঠিক এমন সময় পেছন থেকে দেবজ্যোতির কণ্ঠ শুনতে পেলাম। হতাশ এবং কিছুটা ক্লান্ত। বললাম, এখন কী হবে ? সে বলল, বড় একটা উবার ডেকে হোটেলে নিয়ে যেতে বলব। পাঁচ মিনিট পর উবার এল।
দেবজ্যোতিকে বললাম―এই উবার চালককে একবার অনুরোধ করে দেখেন। সে আমাদের রালেতে নিয়ে যাবে কি না।
দেবজ্যোতি বলল―তাকে তো এখানকার হোটেলে যাওয়ার জন্য বলেছি।
হোটেলকে আমরা যে টাকা দেব সেগুলো সে নিক। তারপরও বাড়ি চলে যাওয়া উত্তম হবে।
উবার চালককে সবকিছু বুঝিয়ে বললে সে রাজি হয়ে গেল। বলল―তোমরা এই রাইডটা ক্যানসেল করো।
হোটেল পর্যন্ত যাওয়ার রাইড ক্যানসেল করে তার সঙ্গে ৪০০ ডলারের চুক্তি করে লাগেজ নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। বৃষ্টিও থেমে গেল। মধ্যরাতে আমজাদকে ফোন করে জানালাম―আমরা আসছি।
রাত গভীর, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। গাড়ির হেডলাইট চালু করে মহাসড়ক ধরে এগুচ্ছে চালক, চারপাশে অন্ধকার। আন্তঃরাজ্যের প্রশস্ত লেনগুলো নিঃসঙ্গ অতিকায় সাপের মতো। শহরের ঝলমলে আলো দূরে মিলিয়ে গেছে, আর আমাদের গাড়ি একান্তে রাতের পথে নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে ছুটছে।
পাশে ঝোপঝাড়। দূর থেকে দেখলাম একটা হতচকিত হরিণ রাস্তা পার হতে গিয়ে আবার বনের দিকে ফিরে গেল। রাতের পাখিদের ডাক, মাঝখানে হালকা বালি মাটির ওপর চাকার আওয়াজ। গাড়ির ভিতরে নীরবতা, শুধু আমার শ্বাস আর হুইল ঘোরার শব্দ। জ্যোৎস্না সামনে বসে অস্থির চোখে মহাসড়ক দেখছে, আর আমি চেষ্টা করছি তার আতঙ্ক কমাতে―মনে মনে বলছি, আমরা ঠিকই রালেতে পৌঁছাব।
প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি উঁচু-নিচু ঢাল যেন অন্তরে এক অজানা উত্তেজনা জাগিয়ে তুলছে। হেডলাইটের আলো সড়কের সীমা আলোকিত করছে, কিন্তু দূরের অন্ধকারে সবই রহস্যময়। মাঝে মাঝে ছোট্ট গ্রামীণ রাস্তা মহাসড়কের পাশে মিলিয়ে আসছে।
রিচমন্ড থেকে রালেতে যাওয়ার এই গভীর রাতের পথ―মহাসড়ক, অচেনা বাঁক, অন্ধকারের মাঝে ছড়ানো অদ্ভুত শান্তি―সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল এক নতুন পৃথিবীর সন্ধানে চলছি, যেখানে ভয়, সৌন্দর্য এবং প্রত্যাশা একসঙ্গে মিশে আছে।
রালেতে আমজাদের বাড়ির দরজায় বড় করে লেখা আছে ‘বাংলাদেশ’। সে বলে, প্রতিদিন ঘর থেকে বের হওয়ার সময় এটা দেখে বের হই। আবার যখন বাসায় ফিরি এটা পড়ে ঢুকি।
বিপদের সময় পরিচয় দেবজ্যোতির সঙ্গে। তার বউয়ের নাম পৌলমী। পালামৌ-এর সঙ্গে কেমন যেন ধ্বনিগত মিল আছে। পৌলমী নামটি বলার সঙ্গে সঙ্গে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণবই পালামৌ এর কথা মনে পড়ে। আজকের এই বিড়ম্বনার কাহিনি দিয়ে ভ্রমণ কাহিনি কি হবে ? জানি না। গাড়ি থেকে নেমে যুবা দম্পতিকে বিদায় দেওয়ার সময় বলেছিলাম―বিপদে বন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায়। তোমরা সত্যি সত্যি বিপদের সময়েরই বন্ধু। বেশি কথা বলার সময় নেই। আফগানি গাড়ির চালক মাহামুদ তাড়া দিচ্ছে। ওদের বাড়ি থেকে গাড়ি বাঁক নেওয়ার সময় মনটা মোচড় দিল। প্রায় ২৫ মিনিট পর আরেক বাড়িতে গিয়ে দরজায় বাংলাদেশ লেখা দেখে খুশিতে চোখের জল এল। তখন ঘড়িতে ভোর চারটা।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ