
তাক-ডুমা-ডুম!
তাক-ডুমা-ডুম!
ঢোলের অস্পষ্ট ক্ষীণ আওয়াজ।
সোনাভান ঠাহর করতে পারে না সত্যি সত্যি সে এই বাজনা শুনলো কি না। শুনলো, না শুনলো না। শুনলো না, শুনলো―এই ধন্দ থেকে সে বেরুতে পারে না। ফলে সে উসখুশ করে। ফলে সে উৎকর্ণ হয়। কিন্তু তাক-ডুমা-ডুম ততক্ষণে হাওয়ার টানে ভেসে গেছে। ফের অস্পষ্ট ক্ষীণ আওয়াজ। এবং সোনাভান ফের শোনা না শোনার ধন্দের ভেতর। ধন্দের ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে সে বেতালা হয়। এই ধন্দ তাকে এতটাই উদভ্রান্ত করে যে, তার ঢেউ খেলানো চিবুক ও ঠোঁটের উপরিভাগে ঘাম জমে ওঠে। জলে ভেজা সাবুদানার মতো বিন্দি বিন্দি ঘাম। ঘামের বিস্তার ম্লান নদীরেখা হয়ে জালালি কবুতরের মতো ছায়া ছায়া স্তনযুগলের মাঝখানে নামে। ক্রমে তা উদর পেরিয়ে নাভিমূলের গভীর গর্ত স্পর্শ করলে সোনাভান কেঁপে ওঠে। সে মৃদু শীতে আক্রান্ত হয়।
তাক-ডুমা-ডুম…
তাক-ডুমা-ডুম…
ঢুলির দুই হাতের নিপুণ আঙুল পলকে এমন বাদ্যি বাজিয়ে যায়। অতি সূক্ষ্ম-মসৃণ-মিহি শব্দ। যেন কার্তিক বা অঘ্রানের ভোরে পতনশীল শিশির কণা। সোনাভানের চক্ষে ওই বাজনার এমন অদ্ভুত আকৃতি মিললে সে খানিকটা স্থির হয়। যদিও এই স্থিরতার কোনও মানে নেই। কারণ সোনাভান খুব ভালো করে জানে, ঢোল বাদ্যির সঙ্গে এই ভোর বা শিশিরের কোনও মিল নেই। সোনাভান যেন জেনে-বুঝেই এরকম ভাবে। অথবা ওই অস্পষ্ট বাজনাকে ধরে ফেলার স্পৃহায় এমন ভাবতে ভালোবাসে। খামোখাই কিছু একটা আকৃতি দিতে চায়। এসবই আসলে ওই শব্দকে নাগালের মাঝে নিয়ে আসার চেষ্টা। হতে পারে ওই অস্পৃশ্য আওয়াজকে চক্ষের কোটরে আটকে ফেলে একবার দেখার চেষ্টা। সোনাভান মাত্র একবার ওই আওয়াজকে দেখতে চায়।
মাস ছয়েক আগেও সোনাভানের এই বাদ্যি-বাজনা নিয়ে মাথার বিষ ছিল না। অবশ্য সে তখন ঢাক-ঢোলের তাল-বেতালের মাঝেও পড়ে নাই। সোনাভান তখন সদ্য মাচায় লতানো পুঁইডগাটির মতো―যার সামনের দিকে বেড়ে যাওয়া আর বেড়ে যাওয়া। তখনও তো বাজান ফজলগাজি ঢুলি মোকাদ্দেসের সন্ধান পায় নাই। ফলে তাক-ডুমা-ডুমের ভুলভুলাইয়ার ভেতরেও সোনাভান হান্দায় নাই। এইটা আসলে তাক-ডুমা-ডুমের ভুলভুলাইয়া না তামাম দুনিয়া কালা করা আন্ধার। সোনাভান এখনও ধন্দের ভেতর। এইটা কি কুনু ভুলভুলাইয়া না আন্ধার ? যুদি আন্ধারই হয় তাও কি এমুন তেমুন আন্ধার নাহি ? পঞ্চনাগের ফণার তলায় চাপা পড়ে থাকা চাপ-চাপ-আন্ধার। আপাতত তাক-ডুমা-ডুমের ভুলভুলাইয়া অথবা আন্ধারের বক্ষিলারে খায়ের ভেতর সোনাভান আটকা পড়া মাছ-কইন্যা। যে ক্রমাগত লেজ দাপড়ায় আর আছড়ায়। লেজ আছড়ায় আর দাপড়ায়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আছড়া-আছড়ি, দাপড়া-দাপড়ি করেও জলের নাগাল সে পায় না।
সোনাভান কী করবে ? কী করবে সোনাভান ? এই ঢোল-বাদ্যি কানে ঢুকে পড়া মাত্রই আচানক দুনিয়াটাই টাল খেয়ে ওঠে। চক্ষের পলকে কয়লা-কালো-পতঙ্গের ঝাঁক খনি থেকে উঠে আসে। তারপর তাদের অবিরাম ওড়াউড়ি। পতঙ্গের পাখনার হাওয়া-বাতাসের টানে আন্ধার জমে আরও ঘন হয়ে ওঠে। এক্কেবারে ঘোরঘুট্টি যাকে বলে। এবং এক সময় তা কালো চিতার মতো মারাত্মক হিংস্রতা নিয়ে সোনাভানের ঘরে-সংসারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সোনাভানের ঘর তখন আর ঘর থাকে না। ঘরটা তখন বহুদিন ধরে অব্যবহৃত বোঁচা কুয়া। যাতে এক বিন্দু জল আর নাই। ঝড়-বাদল, খরা-শীতে-পলি নাকি বালি জমে জমে হেজে-মেজে যাওয়া। আর সোনাভান লাটিমের মতো চক্কর খেতে খেতে ধুপ করে পড়ে ওই পলি না বালির ওপর। আর পড়েই বুঝতে পারে বালি বা পলির চিহ্নমাত্র নাই। কুয়ার ভেতরে স্তূপীকৃত হয়ে আছে বড়ই না বেল অথবা মান্দারের ঝাঁটা। কাঁটার আঘাতে মুহূর্তে ক্ষত-বিক্ষত সোনাভানের সমস্ত দেহ। সে আর্তনাদ করে ওঠে। কিন্তু কে শুনবে তার চিৎকার ? কত গভীরে যে সোনাভানের এই পতন। সোনাভানের আর্তনাদ তখন যেন তাক-ডুমা-ডুমে রূপান্তরিত হয়। তারপর ঘুরপাক খেতে খেতে হাওয়ার টানে ভেসে যেতে চায়। কিন্তু তাও সম্ভব হয় না। ঢুলি মোকাদ্দেসের নিপুণ বাদ্যি ঢেকে দেয় সোনাভানের আর্তস্বর। কেমন করে যে ঢুলি মোকাদ্দেসের হাত এত দ্রুত চলে ? অথচ বহু যুগ আগে তার পূর্বপুরুষ এই বাদ্যি বাজিয়েছিল। সেই বাজনা এখনও এভাবে রক্তকণায় বোল তুলে যায়!
পাল রাজাদের আমল ছিল তখন। বড় শৌখিন ছিল যশোপাল। রাজার হাউস হলো সমুদ্দুরের সমান মস্ত এক দিঘি শোভা পাবে রাজবাড়ির সামনে। এত্ত বড় দিঘি যে, রানি যেন ঘুম ভেঙেই দ্যাখে রাজবাড়ির সিংহ দরোজায় সমুদ্দুর ঘুমিয়ে আছে। যশোপাল তখন মন্ত্রীকে ডাকে। মন্ত্রী ডাকে সেপাই। আর সেপাই জড়ো করে লোক-লস্কর। লোক-লস্কর জড়ো না করলে দিঘি কাটবে কে ?
সেই সব লোক-লস্কর পিঁপড়ার মতো পিলপিল করে চলে আর দিন-রাত্তির মাটি কাটে। এত মাটি তারা কাটে তবু যশোপালের মন ওঠে না। মাটি কেটে থুবু করে রাখতে রাখতে উঁচা পাহাড় হয়ে যায়।
রাজা যশোপাল তা দেখে মুখ ফিরিয়ে বলে―
‘সমুদ্দুরের সমান দিঘি চাই। রানি যেন ঘুম ভাঙলেই দ্যাখে সিংহ দরজায় ঢেউ আছড়ে পড়ছে।’
ফলে সেপাই আরও লোক জড়ো করে। তারা মাটি কাটে। মাটি কাটতে কাটতে পঞ্চাশ কুয়ার সমান গর্ত করে ফেলে। পঞ্চাশ থেকে ক্রমে ষাট। সত্তর-আশি করে একশ কুয়ার সমান গভীর গর্ত হলে রাজা যশোপাল ঢুলির দল তালাশ করে। যারা নিপুণ হাতে বাজাতে পারবে ঢোল। তারপর তাদের নামিয়ে দেয় একশ কুয়ার গভীর তলদেশে। ঢুলিদের নামানোর আগে যশোপাল বলে―
‘দিঘির তলায় পৌঁছেই তোমরা জোরে বাদ্যি বাজাবে। উপর থেকে কেউ যদি সে বাজনা না শোনে, তবেই বুঝবো এই দিঘি সমুদ্দুরের সমান।’
ঢুলিদের হাতে বাদ্যি বাজে আর চলে মাটি কাটা। মাটি কাটতে কাটতে গভীর গর্ত হয়। এত গভীর যে, তীরে দাঁড়িয়ে থাকা কারও কানেই ঢোলের বাজনা আর পৌঁছায় না। ততক্ষণে দিঘিতে হুড়মুড়িয়ে জল উঠতে শুরু করেছে। বাজিয়ের দল আর মাটি কাটা লোক-লস্কর উঠে আসতে ব্যর্থ হয়। জলের তোড়ে ডুবে যায় সব। শুধু ভেসে ওঠে সেইসব ঢোল, যা ঢুলিরা বাজিয়েছিল।
ভাসমান ঢোল থেকে অস্পষ্ট-ক্ষীণ-মিহি বোল ওঠে―
‘তাক-ডুমা-ডুম!’
২
ঢুলি আকালু দূরে থাক তার বাপ ঢুলি মোকাদ্দেসও নাকি কষ্মিনকালে ঢোলে বোল তুলে নাই। ঢুলি মোকাদ্দেসের বাপ শাহ গাজি কালে-ভদ্রে ঢোলে হাত দিত। তবে ফি বছর বুদ্ধ পুন্নিতে তার উন্মাদ দশা হতো। সোনা ঢালা চান্দ আর হলদেটে ফানুসের উজ্জ্বল আলোর নিচে ক্রমাগত বোল তুলতো―
‘তাক-ডুমা-ডুম।’
সকাল ফুটি ফুটি করলেই শাহ গাজির ঢোলের বাদ্যি যেত থেমে। তার দুই হাত তখন রক্তে মাখামাখি।
সোনাভান বিয়ে হয়ে আসা অবধি এসবই শুনছে। শাশুড়ি আম্বিয়া খাতুন ঢুলিদের গপ্পো করে রসিয়ে রসিয়ে। সোনাভানের ধারণা আম্বিয়া খাতুন সবকিছু বলে এমন নয়। নিজের ছাওয়াল ঢুলি আকালুরও শাহ গাজির মতো উন্মাদ ঘোর আছে কি না তা সে ঘুণাক্ষরেও বলে না। আম্বিয়া খাতুন না বললেও আকালুর মতি-গতি বেখাপ্পাই ঠেকে। যদিও সোনাভানের সঙ্গে প্রেম-পিরিতির কমতি নাই। শুধু বাপজান মোকাদ্দেস ঢুলির রা-য়ের উপর আকালু কোনও রা করতে পারে না।
এদিক-ওদিক দিয়ে উড়ে আসা কথাবার্তা বা কানাঘুষা সোনাভান শোনে নাই তাও নয়। আম্বিয়া খাতুনের চোপার কাছে ওই সব নিয়ে কথা পাড়া দায়। ওই সব শোনা কথা কিছু বলার সাহসও সোনাভানের নাই। আকালুর বড় ভাই ঢুলি বারেক্যার বউ বছর না ঘুরতেই হাওয়া। তাও নাকি ছাড়-কাট নিয়েই হাওয়া। সেই থেকে ঢুলি বারেক্যার মাথায় গণ্ডগোল। মাথার গণ্ডগোল সারাতে না পেরে সেও দেশান্তরি হয়েছে। সোনাভান কাউকেই দ্যাখে নাই। বড় জা তারাবুকে না। বারেক্যাকেও না।
আম্বিয়া খাতুনের গপ্পে কখনও তারাবু এসে পড়লে, সে তাকে পানের পিকের সঙ্গেই গিলে ফেলে। কখনও গিলতে না পারলে দুই পায়ের ফাঁকে পুচ করে পিচকি ছিটিয়ে বলে―
‘অ্যাঁ ছ্যাঁ―সোমত্ত মাইয়ানুকগো কিসিম ধরন মুশকিল…।’
সোনাভানের মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়―
‘তারাবুর কিবা কিসিম আছিল গো আম্মা ?’
সহসা আম্বিয়া খাতুনের চক্ষু দুইটা ঝাঁপিয়ে পড়ে সোনাভানের ওপর। চক্ষের আগুনে সোনাভানকে ছাই করে দিয়েও সে ক্ষান্ত হয় না। দাঁতে দাঁত পিষে বলে―
‘তারাবুর কথা দিয়া তুমার কম্ম কী ? নয়া বউ-এহনো হলদি-মিন্দির বাসনায় ভাসতেছো―পুরানা ব্যাপার ধইরা কিয়ের তালাশ চাও ?’
আম্বিয়া খাতুনের মুখ ঝামটা খেয়ে সোনাভান একেবারে এতটুকুন হয়ে যায়। মাথার ঘোমটা বড় করে টেনে নত চোখে দাঁড়িয়ে থাকে। আম্বিয়া খাতুন দুই-তিন ঢোকে পানের পিক গিলে ফেলে বলে―
‘হুইন্যা রাইখো পুরুষ ছাওয়ালের জিদ্দে অয় বাদশা আর মাইয়া ছাওয়ালের জিদ্দে হয় বেশ্যা।’
সোনাভানের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বাদশা-বেশ্যার গোলকধাঁধার চক্কর থেকে সে তখন বেরুতে পারলে বাঁচে। ফলে সে শুধু শুধু নাইতে যাওয়ার ছল করে। প্রচণ্ড গরমে সে কাবু হয়ে পড়েছে এমনও বলে। আম্বিয়া খাতুন অন্যদিকে তাকিয়ে হাই তুলতে তুলতে বলে―
‘যাও, দুইডা ডুব দিয়াই আইস্যা পইড়ো। বউ-ঝিরা ঘাডের চুলবুলানিতেই নষ্ট অয়।’
সোনাভান ধরতে পারে না ঘাডের চুলবুলানি কী জিনিস! তবে বুচির মা, কলিমের বউ, জহুরা বেগম তাকে যা বলে সে সবই হয়তো চুলবুলানি। কিন্তু সোনাভান তো তাদের কাছে কিছু জানতে চায় নাই। তারাই তো হাওয়ায় কথা ভাসানোর মতো করে বলেছে―
‘তারাবু পলাইল কি সাধে নিহি ? অ-মাগো কিমুন বেশরম্যা কতা!’
সোনাভান তখন ভয়ে ভয়ে জানতে চেয়েছে―
‘কিবা কিসিম আছিল তাইনের ?’
বুচির মা তখন পরনের সায়া আগলাতে ব্যস্ত। জলের ওপরে তা ঢোলের মতো ভাসমান।
কলিমের বউ সেদিকে তাকিয়ে থেকে যেন নিজেই নিজেকে বলেছে-
‘মুকাদ্দেস ঢুলির খাইসলত কি মইলেও যাইব নিহি ?’
শুনে সোনাভান কেঁপে উঠেছে। আর বুচির মায়ের সায়া-ঢোল থেকে বোল উঠেছে-
তাক-ডুমা-ডুম।
ডুব দিয়ে আসার পরপরই সোনাভান জ্বরে বেহুঁশ।
তার গতরে যেন হাবিয়া দোজখের আগুন জ্বলছে। সে আগুনে পুড়তে পুড়তে সোনাভান চক্ষু মেলে দেখেছে মোকাদ্দেস ঢুলি তার শিয়রে বসা।
আকালুরে নিয়া কী করে সোনাভান ? ওষুধ আনার নাম করে সে যায় তো যায়ই! ফেরার নাম-গন্ধ নাই। প্রচণ্ড জ্বরের তাল-বেতালের মাঝেও ঢোলের বাদ্যি ছাড়া সোনাভানের কানে আর কোনও আওয়াজ নাই।
রক্তচক্ষু মেলে সোনাভান ইতি-উতি আম্বিয়া খাতুনকে তালাশ করে। পান-দোক্তার খুশবু ছুটিয়ে সেও কি ঢুলি আকালুর সঙ্গে উধাও হয়ে গেছে নাকি ?
আকালুর না হয় বোধ-বুদ্ধি কম কিন্তু আম্বিয়া খাতুনের জ্ঞানের নাড়ি তো টনটনা। সে ভাগছে কই ?
সোনাভানের বিয়ের পর থেকেই তো সন্ধ্যার পর আকালু লা-পাত্তাই থাকে। ঢুলি মোকাদ্দেসের নানা টালবাহানায় বাইরে গেলে সে আর ফেরে না। ফেরে না তো ফেরেই না। ভয়ে সোনাভানের প্রাণ ভোমরা ভোঁ ভোঁ করে ওড়ে। কিন্তু পালিয়ে যাবার কোনও পথ সে পায় না। মোকাদ্দেস ঢুলি প্রাণ-ভোমরার একটা পাখনা ছিঁড়ে ফেলে বলে―
‘ও বউ পিঠডা এট্টু মালিশ দিয়া দেও।’
‘খাস তৈলের বোতলডা কি তুমার ঘরে নাহি ?’
‘তুমার পিন্দনের কাপড়ডা দেহি ত্যানা ত্যানা অইয়া গেছে গা। ট্যাকা গুছাইতে পারলেই কিনা দিমুনে।’
‘আকাইল্যাডা বেজন্মা একডা। কাম-কাইজের চেষ্টা চরিত্তি নাইক্কা এক্করে।’
‘হেরে কামে ভেজাইয়া দেওন লাগবো।’
‘বাপের বাড়ির নিগা মন পুড়তাছে নাহি বউ ?’
শর্ষের তেলের মালিশ দিতে দিতে সোনাভান টের পায় মোকাদ্দেস ঢুলির পিঠটা জব্বর টান টান। একেবারে ধনুকের ছিলার মতো। সেখানে কোনও বিষ-বেদনা আছে বলে মালুম হয় না।
হালার আকাইল্যা, তুমার মতলবখানা কী ? বাইরে একবার গেলে ফেরে না তো ফেরেই না। সোনাভানের হাত দুটো শিথিল হয়ে মোকাদ্দেস ঢুলির পিঠের উপর শুয়ে পড়ে। যেন মরা সাপের ট্যালকা গতর। মোকাদ্দেস ঢুলি তখন নিজেই গা ঝাড়া দিয়ে বলে―
‘এট্টু মালিশ দিয়াই দেহি কাবু অইয়া গেলাগা।’
সোনাভান কী বলবে বুঝতে পারে না। মরা সাপ দুটোকে সে নাড়াতে চায়। কিন্তু তারা কিছুতেই নড়ে চড়ে না। মরা সাপ তাজা করার মন্ত্র ওঝা জানে না। কিন্তু সোনাভান সেই মন্ত্রেরই সন্ধান করে। সোনাভান মরা সাপকে জ্যান্ত করতে চায়।
মরারশুকা ঢুলি আকাইল্যা―সেও কি এমুন অবোধ নিহি ? তারাবুর পলায়নের কিসসা সেও কি সোনাভানের কাছে বলে নাই ? বলেছে। সবই সে বলেছে। বুচির মা, করিমের বউ, জোহরা বেগম বলার আগেই সে বলেছে। বলেছে বড় ভাইডা নিরুদ্দেশ চইল্যা গেল!
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে আকালু। কান্না ছাড়া কী করতে পারে সে। আকালু কিছু করতে পারে না। কিছু করনের ক্ষেমতা তার নাই। জন্মসূত্রে দায়বদ্ধ বাপের বিরুদ্ধে কী করার থাকে ছাওয়াল পিয়ালের।
সোনাভান চুপচাপ সবার কথা শুনে যায়। শোনে আর ভাবে। ভাবে আর শুনে। ভাবতে ভাবতে একদিন বলে―
‘তারাবুর লাহান আমিও দেশান্তরে চইল্যা যাব।’
সোনাভানের কথা শোনে আকালু স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।
‘এমন কতা তুমি কেমতে বলতেছ সোনামন ? তুমি কেমতে বলতে পারতেছ এমুন কতা ? তুমিও কি খাড়া দজ্জাল হইয়া নাজিল অইছো! তুমি চইল্যা গেলে আমি যে সুতের শ্যাওলা অইয়া যাইব। সোনাভান এমুন আকতা-কুকতা কইও না।’
‘তাইলে ব্যবস্তা কি কও ?’
‘ব্যবস্তা ?’
‘দুই জন মিল্যা নিরুদ্দেশ চইল্যা গেলে কেমতে হয় ?’
৩
ঘরের মইদ্যে দিবানিশি শাওন মাইস্যা ম্যাঘ থই-থই করে। ইস-সি-রে! এমুন তেমুন ম্যাঘ নাহি ? ম্যাঘে সয়লাব ঘরের ভেতরে বিজলি বাত্তিডা টিমটিমাইয়া জ্বলে। য্যান বাদাড়ে ফুইট্যা থাকা গ্যান্দা ফুল। খোশবু নাইকা কিন্তু হইলদ্যা রঙডা মনরে এককরে খুশির গাঙে ভাসাইয়া দেয়।
আকালুকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হতে পেরে সোনাভানের আনন্দের আদি-অন্ত নাই। এমুনই ছোডমোড একটা ঘর। স্যাঁতসেতে আর সারাক্ষণই আন্ধার। কোনও জন্মেও সূর্যের আলো ভেতরে ঢুকবে না। কিন্তু সোনাভানের এসব নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নাই। আরে দুত্তরি আলো নাইকা তো কি অইলো ? আলো ধুইয়া কি পানি খামু নিহি ? মাইনষের স্বোয়াস্তি অইলো বড় জিনিস। স্বোয়াস্তি না থাকলে আলো না আন্ধার তা লাগব কুন কামে ?
কতোটা দূর, কোন মুল্লুকে সোনাভান আর আকালু নিরুদ্দেশ হয়ে এসেছে তার হদিস কেউ জানে না। সোনাভান জানে না। এমনকি আকালুও না।
সন্ধ্যা লাগিয়ে বাসে উঠে ভোর পেরিয়ে তারা নেমে পড়েছিল। অবশ্য না নেমে উপায়ও ছিল না। বাসের গন্তব্য ছিল অতদূরই। বাসটা চলে চলে এতদূর এসে হঠাৎ পাহাড় হয়ে গেল। আর সে চলে না। চলে না তো চলেই না। সারা রাত পর্যাপ্ত ঘুমের পরও আকালু তখনও হাই তুলছে। শুধু সোনাভানের চক্ষে ঘুমের ছিঁটেফোঁটাও ছিল না। আম্বিয়া খাতুনের থমথমে চেহারা ভাসতেই সে শিউরে উঠছিল।
মাইয়ানুকের জিদ্দে অয় বেশ্যা
পুরুষনুকের জিদ্দে অয় বাদশা..
সোনাভানের নিরুদ্দেশ যাত্রাপথে আম্বিয়া খাতুনের দাঁতে দাঁত ঘষার আওয়াজ ছাড়া আর কিছু ছিল না। মোকাদ্দেস ঢুলির ঢোলের আওয়াজও যেন কোন ভেলকিতে মিলিয়ে গিয়েছিল।
সোনাভানের কানের মাকড়ি বন্ধক রাখার পর এই ঘরটা তাদের হয়েছিল। মাকড়ি হাতছাড়া হলেও সোনাভান ব্যাজার হয় নাই। কেন ব্যাজার হবে ? কোনওখানেই তখন সেই বোঁচা কুয়াটা ছিল না। ঢোলের বোল-বাদ্যিও ছিল না। আকালু আর সে। সে আর আকালু। সোনাভান এর চেয়ে বেশি কিছু চায় নাই। অথবা এর চেয়ে বেশি কিছু তার চাওয়ারও ছিল না। আন্ধারের ভেতরে ফুইট্যা থাক্কা গ্যান্দা ফুলডা তো সোনাভানই নাহি ? খোশবু তার নাই―না থাউক। মনডা তো খুশির গাঙে ভাসাইয়া দেওন যায়।
তা গ্যান্দাফুল অইয়া ফুইট্যা থাইক্যা না ফুল দেইখ্যাই তিন মাস পার অইয়া গেল। এহন তো দুই মাসের ঘরভাড়া বাকি।
আকালুকে ম্যালাদিন গুঁতাগুঁতি দিয়ে সোনাভান নিজেই নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। দুই মাসের ঘর ভাড়া শোধ করার তাগাদা আকালুর নাই। আকালুকে দেখে সোনাভান অবাক মানে―
‘এও তাইলে এক কিসিমের মানু বটে!’
আকালুর কিসিম আসলে কিরূপ ? সোনাভানের কানে আম্বিয়া খাতুনের দাঁতে দাঁত ঘষার শব্দ―
পুরুষনুকের জিদ্দে অয় বাদশা―
আকালু আসলে কিমুন কিসিমের মানু ? রাগ নাই। দুস্ক নাই। খুশি নাই। বেজার নাই। ভালো-মন্দতে নাই। আবার জিদও নাই। জিদ্দ না থাকলে কেমতে অইবো ? আকালু তুমি কি জিদ্দি না অইয়া বাদশা বনতে পারবা ?
বাদশা তুমি না বনলা। তুমার চক্ষে আমি কি বাদাড়ে ফুইট্যা থাকা গ্যান্দাফুল এহনো ? খোশবু নাই―কিন্তু মনডারে খুশির গাঙে ভাসায় থুয়া যায়।
ঘরের বেবাক ম্যাঘ কি আকালুর চক্ষে হান্দাইয়া গেল নাহি ? নইলে আকালুর চক্ষু আর কিছু দেহে না ক্যান ?
সোনাভান তো আকালুর চক্ষু দুইটা নিয়াই ফের নিরুদ্দেশ অইতে চায়―কিন্তু আকালু য্যান জন্মআন্ধা। তার চক্ষে আর কুনু ভাষা নাই। চক্ষের পাতা দুইটাও আইজকাল নড়ে কি নড়ে না।
‘এও তাইলে এক কিসিমের মানু বটে!’
কিসিম যাই হোক আকালু এসব গোনা-গনতিতে ধরে না। মেঘের বালিশ শিথান দিয়া সে ঘুমায় আর ঘুমায়। মরার ঘুমে সে মইজ্যা থাহে। আকালুকে নিন্দ পাড়তে দেখে সোনাভানের চক্ষেও ঘুম নেমে আসে। আরে নিন্দ বুঝি হাওয়ার মতো পলকা ? নিন্দের হাওয়ায় সোনাভান বেহুঁশ। সেও তখন নিন্দ পাড়ে আর নিন্দ পাড়ে।
হঠাৎ একদিন ঘুম ভেঙে দ্যাখে আকালু কোথাও নাই। আকালুর মেঘ-বালিশ তেমনি আছে। খালি আকালুর ছায়াডাও আর পাওয়া যায় না। আন্ধার ঘরের গ্যান্দাফুল সোনাভানের খোশবু নাই। এই গ্যান্দাফুল থুইয়া কই গেল আকাইল্যা ? নিন্দের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে কই য্যান ভাইস্যা গেছে হেয়।
তিন দিন তিন রাত পার হলেও আকালু ফেরে না। ঘরে এমুন তরতাজা বউ ফেলাইয়া গেল কই বেবুদ্দ্যা মরদ ? সোনাভানের এত কিছু ভাবলে কি চলে নাহি ? পেটে তার তিন দিন দানা নাই। একবিন্দু পানিও নাই।
সোনাভান হামাগুড়ি দিয়ে দানা-পানি খোঁজে। তন্ন তন্ন করে খোঁজে। কোথাও একদানা শস্যমাত্র নাই। দানা নাই পানি নাই অথচ চক্ষে ঘুম নামে সোনাভানের।
নিন্দ পাড়তে পাড়তেই সোনাভান শোনে―দরজায় ধাক্কা মারে কেডায় ?
আকালু!
কিবা কিসিমের মানুডা তাইলে ফিরা আইছে!
কিন্তু দরজা খোলামাত্রই শব্দ ঝাঁপিয়ে পড়ে সোনাভানের ওপর। দুই কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়ে ঢোলের বিকট আওয়াজ তাকে বিহ্বল করে তোলে। মুহূর্তে ঢোলের সেই অধরা বাজনা সোনাভানের চক্ষুর কোটরে ঢুকে পড়ে।
মোকাদ্দেস ঢুলি খোলা দরজায় দাঁড়ানো।
পান খাওয়া কালো দাঁতের সারি তরমুজের বিচির মতো ঠোঁটের ফাঁকে হেসে আছে। টিমটিমানো বিজলি বাতির আলোয় তরমুজের বিচি আরও কালো দেখায়।
মোকাদ্দেস ঢুলির কাঁধের ওপর দিয়ে সোনাভান দরজার ওপাশটা দেখে। ভয়ানক কালো আন্ধার ছাড়া ওপাশেই বা আর কী থাকে ? সোনাভান কি জানে না অন্ধকার মানেই বোঁচা কুয়া। কুয়ার ভেতরে পতন হলে দেহটাকে আর টেনে তোলা যায় না।
ঢোলসমুদ্দুরের তলায় দাঁড়ানো সোনাভান টের পায় চৌপাশে জল থই থই করছে। মুহূর্ত দ্বিধা না করে সে মোকাদ্দেস ঢুলিকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়। তারপর বেরিয়ে যায় সাপ-খোপে-ভরা অন্ধকারে। দুই হাতে অন্ধকার ঠেলে সরাতে সরাতে সোনাভান বাদাড়ে ফুটন্ত গ্যান্দাফুল হতে চায়। কিন্তু ঢোলের বোল তাকে ফের দিশেহারা করে তোলে। এই বাদ্যি পেছনে ফেলে সোনাভানকে অনেক দূরে যেতে হবে। ফলে সে দ্রুত সাঁতার কাটতে থাকে। এরকম জমাট কালো অতিক্রম করা যাবে কি না তিন দিনের অনাহারি সোনাভান জানে না।
উত্তাল জলরাশির মতো কালো অন্ধকারে খাবি খাওয়া সোনাভান ভেসে থাকার চেষ্টা করে।
সোনাভানকে তখন ভাসমান ঢোল ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না…
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ