
ম্যাম, কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা বিষয়ে বলতে চাই, বলব ?
রিনার ডান পায়ে জুতো পরাতে পরাতে হালকা চালে প্রশ্ন করে মাসুদ। রিনা তীক্ষè দৃষ্টিতে দেখছিল জুতোটা ঠিকভাবে পায়ে লাগলো কি না! জুতোর ব্যাপারে ভীষণ খুঁতখুঁতে। হাঁটার সময় আরাম না হলে সেই জুতো পরতে পারে না। সুতরাং জুতো কেনার সময়ে খুবই সতর্ক থাকে ও।
হ্যাঁ বলুন, মাসুদ ডান পায়ের জুতো পরিয়ে বাম পায়ে জুতো পরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আপনার পা জোড়া খুব সুন্দর।
সঙ্গে সঙ্গে রিনার শরীরের মধ্যে একটা তরঙ্গ ওঠে। অবশ্য পাদুকা বিক্রেতা মাসুদ কিছুই বুঝতে পারল না। রিনা সোজা হয়ে তাকায় বিক্রেতার দিকে। লম্বা চওড়া শরীর। শরীরের রংটা তামাটে। মাথা ভরা ঝাকড়া চুল। বাম হাতে সোনারঙের ব্রেসলেট।
সরি, আপনি কিছু মনে করলেন ? রিনার থমকে যাওয়ায় ভড়কে গেছে মাসুদ। ম্যানেজারের কাছে বিচার দিলে চাকরি চলে যাবে। দোকানটা ঢাকার অভিজাত এলাকায়। আশপাশের লোকজনই ক্রেতা। প্রত্যেকে সামাজিক ও আর্থিকভাবে অগ্রসর, ক্ষমতাশালী। একজন মাসুদের চাকরি গেলে ওদের কারও কিছু যায় আসে না।
নিজেকে সামলে নেয় রিনা, বাকি জুতোটা পরিয়ে দিন আপনি।
ঘাম ছাড়ে শরীর থেকে। মাথা নিচু করে বাম পায়ের জুতো পরাতে থাকে। খুব যত্ন করে রিনার পা ধরে পায়ের মধ্যে জুতোটা পরিয়ে দিয়ে বলে, এখন দাঁড়ান এবং হাঁটুন। দেখুন আপনার পায়ে জুতো জোড়া ম্যাচ করছে কি না!
রিনা নতুন জুতো পায়ে শোরুমের মধ্যে কয়েক পা হাঁটে। পাশে দাঁড়িয়ে দেখে মাসুদ। হাঁটা শেষ করে রিনা বসে আগের জায়গায়, ওই জুতোজোড়া আনুন তো!
এই জোড়া তো খুব সুন্দর ম্যাচ করেছে আপনার পায়ে, ম্যাম। পাশের দেয়াল থেকে জুতো আনতে আনতে বলে মাসুদ।
না,আমার ভালো লাগছে না, আপনি এই জোড়া আমার পায়ে পরিয়ে দেখুন তো! ইতোমধ্যে পায়ের নতুন জুতো খুলেছে রিনা। মাসুদ অন্য জুতো নিয়ে রিনার পায়ের কাছে বসে পরিয়ে দিতে থাকে।
আপনি কী করে বুঝলেন আমার পা জোড়া সুন্দর ? হালকা স্বরে প্রশ্ন করে রিনা।
মাসুদ বুঝতে পারে, জুতো ক্রেতার কাছ থেকে আপাতত ভয়ের কারণ নেই। কিন্তু নিজের অবস্থান পরিষ্কার জানে। সামান্য জুতো বিক্রেতা। এই ছোট চাকরিটাও অনেক পরিশ্রমে জোগাড় করতে হয়েছে। মেসে থাকে। সকাল নটা থেকে দশটার মধ্যে দোকানে আসে। দুপুরে মাত্র ত্রিশ মিনিট খাওয়ার সময় পায়। রাত দশটার দিকে ছুটি। দুটি পায়ের ওপর অধিকাংশ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বছর দুয়েক আগে মাত্র চাকরিতে ঢুকেছে, একটু রয়ে সয়ে থাকতে চায়।
রিনার পায়ে জুতো পরাতে পরাতে হাসে মাসুদ, ম্যাম আমার চাকরিই জুতো পরানোর। জুতো বিক্রি করা। আমি প্রতিদিন প্রায় একশো মেয়ের পায়ে জুতো পরাই। পরাতে গেলেই তো আমি পা দেখতে পাই। তখনই বুঝতে পারি―
হুম, একটু হাসে রিনা। আপনি মনে হয় লেখাপড়া জানেন ?
একটু আধটু জানি, ম্যাম দেখুন তো এই জোড়াও আপনার পায়ে দারুণ মানিয়েছে।
তাই ? রিনা উঠে আবার হাঁটতে শুরু করে। কয়েক কদম হেঁটে ফিরে এসে বসে আগের জায়গায়, এই জুতো জোড়ার রংটা আমার ভালো লাগছে না, আপনি ওই ছাই কালারের জুতোজোড়া আনুন তো।
মাসুদ সামনের তাক থেকে জুতোজোড়া এনে হাঁটুমুড়ে বসে রিনার পাশে। ইতোমধ্যে পায়ের জুতো খুলে পা জোড়া বাড়িয়ে দিয়েছে রিনা। রিনার বাড়ানো পা জোড়া খুব যত্নের সঙ্গে হাতের মধ্যে নিয়ে পেলব ছোঁয়ায় পরিয়ে দেয় মাসুদ। সত্যি, রিনার সাদা রঙের পাকা শবরী কলার আঙুলে গাঁথা পা জোড়ায় জুতো জোড়া চমৎকার মানিয়ে গেছে। মাসুদ নিশ্চিত, এই জুতো পছন্দ না করে পারবে না। কিন্তু মাসুদকে হতাশ করে রিনা বললেন, আর একজোড়া আনুন…
ক্রমাগত রিনা একুশ জোড়া জুতো পরেছে আর খুলেছে। মাসুদ একটু নয়, যথেষ্ট বিরক্ত। কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। জুতোয় জুতোয় চারপাশটা ভরে গেছে। অন্য কলিগেরা মজা পাচ্ছে। ওরা দূর থেকে দেখছে আর হাসছে। ম্যানেজার আবুল মিয়া একবার এসে ঘুরে দেখে গেছে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই, ক্রেতার সন্তষ্টিই সেরা সন্তষ্টি।
কী হলো তোমার ? পিছনে এসে দাঁড়ায় রিনার স্বামী হেদায়েতুর রহমান। বেশ ভারিক্কী ধরনের পেটা শরীর। পেট বের হয়ে আছে বুক থেকে দুই ইঞ্চি। চোখে পুরু লেন্সের চশমা। বাপের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে ছয় বছরের কন্যা, রুমা। রিনার সামনে এতো জুতো দেখে বিরক্ত হেদায়েত, এতো জুতো ?
কী করব ? রিনা কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করে, আমার পছন্দ হচ্ছে না। ভাই, এই জোড়া পরিয়ে দেখেন তো―দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে মাসুদ বাইশতম জুতোজোড়া পরায় রিনাকে। পরার পর দাঁড়ায়, তাকায় স্বামীর দিকে, দেখো তো কেমন লাগে ? মানিয়েছে আমার পায়ে ?
অনেক ভালো মানিয়েছে, গম্ভীর গলায় বলে হেদায়েত।
ওকে ভাই, আমি এই নতুন জোড়া পরেই বাসায় যাব। আপনি আমার পুরোনো জুতো নতুন প্যাকেটে ভরে দিন। মাসুদ খুব যত্ন করে পুরোনো জুতোজোড়া নতুন প্যাকেটে ঢুকিয়ে কাউন্টারে যায়। ম্যানেজার খুব গম্ভীরভাবে তিন জোড়া জুতোর বিল গ্রহণ করে। জুতোর দোকানে ঢুকেই হেদায়েত যায় পুরুষদের জুতোর দিকে। দেখেশুনে নিজের জুতা কিনে মেয়ের জন্যও একজোড়া কিনে দিয়েছে। কিন্তু রিনার জুতো কেনা তো হয়নি, একের পর এক জুতো দেখে দেখে নিজের চারদিকে জুতোর পাহাড় তৈরি করেছে। কাউন্টারে টাকা দিয়ে তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে দোকানের বাইরে আসে। একটু দূরে পার্কিং এরিয়ায় এসে গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দেয় ড্রাইভার।
তুমি নিজেকে কী ভাবো ? জুতোর রানি ইমেলদা ? কর্কশ গলা হেদায়েতের―দোকানের প্রত্যেক কর্মচারী তোমার ওপর বিরক্ত। কেউ কেউ হাসছিল। আর দেখেছো, যে ছেলেটা তোমাকে জুতো পরিয়ে দিচ্ছিল, সে কতটা মলিন মুখে তোমাকে জুতো পরিয়ে দিচ্ছিল ? যেখানেই যাও একটা ভজঘট না পাকিয়ে… শেষ করে না হেদায়েত। ড্রাইভারের সামনে অনেক বলা হয়েছে। কিন্তু হেদায়েত যাই বলুক, নির্বিকার রিনা সুলতানা। ওর সারা শরীর জুড়ে বইছে ফাগুনের উদ্দাম হাওয়া।
দুই দিন পরে রিনা সুলতানা আসে জুতোর দোকানে। সবাই অবাক। মাসুদের এরিয়ায় তখন ক্রেতা না থাকায় বসে বসে নখ খুঁটছিল। রিনা সামনে দাঁড়াতেই চমকে ওঠে মাসুদ, আপনি ?
হ্যাঁ। গত পরশুর জুতো জোড়া আমার ননদ নিয়ে গেছে। আমাকে আরও ভালো জুতো দেখান তো। বসে পরে রিনা সুলতানা।
মাসুদ বুঝতে পারে না, ঘটনাটা কী ? আজকেও কি বাইশ জোড়া জুতো দেখাতে হবে নাকি… ভাবনার মধ্যে জুতো এনে সামনে রাখে। গতকাল কয়েক জোড়া নতুন জুতো এসেছে কারখানা থেকে। একের পর এক জুতো পরাতে থাকে মাসুদ, রিনা নতুন জুতো পরে কয়েক পা হাঁটে, ফিরে এসে বসে―পছন্দ হচ্ছে না। আর এক জোড়া আনুন।
ত্রিশ জোড়া জুতো দেখা ও পরানোর পর একজোড়া জুতো পছন্দ করে রিনা সুলতানা। আগের মতোই নতুন জুতো পরে কাউন্টারে টাকা দিয়ে বের হয়ে যায়। হাফ ছেড়ে বাঁচে মাসুদ। কলিগেরা হাসে। ওর মন খারাপ হয়ে যায়। একজন ক্রেতাকেই যদি ত্রিশজোড়া জুতো পরাতে ও দেখাতে হয়…। ছোট চাকরি করলে যা হয় আর কী! আর যাই হোক মাস শেষে বেতন তো পায়। বিক্রির ওপর একটা কমিশনও পাওয়া যায়―দিন খারাপ না। কিন্তু এই মহিলা যদি আবার আসে ? এক ধরনের ভয়ই লাগে মাসুদ আহমেদের।
মাসুদের ভয়কে সত্যি প্রমাণের জন্য চারদিন পরে রিনা সুলতানা জুতো কেনার জন্য আবার হাজির। মাসুদ একের পর এক জুতো দেখায়, পরায়, তিনি হাঁটেন, বসেন, জুতো খোলে মাসুদ, আবার পরায়…। চল্লিশ জোড়া জুতো দেখা ও পরানোর পর রিনা অবশেষে এক জোড়া জুতো পছন্দ করে ও ক্রয় করে চলে যায়। যেহেতু অভিজাত এলাকার অভিজাত নারী, প্রায় নিয়মিত জুতো কেনেন কিন্তু মাসুদের হাতে পরার থেকে জুতো দেখা, পরার একটা বাতিকে পেয়েছে। কিছু বলতেও পারে না ম্যানেজার। বিষয়টা নিয়ে অন্যদের সঙ্গেও আলাপ করেছে কিন্তু কোনও কূলকিনারা করতে পারে না।
পাঁচ দিন পরে রিনা সুলতানা জুতো কিনতে আসে কিন্তু মাসুদ নেই। মাসুদের কলিগ পংকজ এগিয়ে আসে, ম্যাম আসুন। আজকে আমি আপনাকে জুতো দেখাই!
মাসুদ কোথায় ? উদ্বিগ্ন রিনা সুলতানা।
ম্যানেজার জানায়, ও ছুটিতে ম্যাম। আজকে পংকজই আপনাকে জুতো দেখাবে। মাসুদের চেয়ে পংকজ অনেক পুরোনো। আর জুতোও ভালো চেনে।
রিনা হাসে, আজকে আমি জুতো কিনতে আসিনি। এইদিকে বাজারে আসছিলাম, তাই… বলতে বলতে দরজার দিকে যায়। দোকানের লোকজন হাফ ছাড়ে কিন্তু দরজা থেকে আবার ফিরে আসে রিনা সুলতানা। তাকায় পংকজের দিকে, মাসুদের মোবাইল নাম্বারটা একটু দিন। ওর সঙ্গে আমার জরুরি দরকার আছে।
পংকজ মোবাইল বের করে নাম্বার দিলে রিনা মোবাইলে সেভ করে চলে যায়। ম্যানেজার হতবাক না হলেও একটা অংক কষে। মাসুদ দেখতে হ্যান্ডস্যাম। আর ভদ্রমহিলার হাজবেন্ড কুমিরের ভূরি নিয়ে সামনে সামনে মহিষের মতো হাঁটে। হয়তো মাসুদকে দিয়ে…। গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে ভদ্রলোক।
রাতে বাসায় ফিরে ডিনার সেরে বেডরুমের পাশের ব্যালকনিতে বসে সিগারেট টানছে হেদায়েত। পাশেই বিছানা। বিছানার পাশে বিশাল ড্রেসিংটেবিল। আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে রিনা তাকায় পা জোড়ার দিকে, সত্যি আমার পা জোড়া ভীষণ সুন্দর। পেলব, মসৃণ। সামনের দিকে একটু লম্বা। আঙ্গুলগুলো সরু আর চিকন। পাজোড়া একত্র করলে পদ্মপাতার একটা ইমেজ ফোটে। প্রসাধন সারতে সারতে রিনা ডাকে, এই শুনছো ?
সিগারেটে শেষ টান দিয়ে অ্যাশট্রেতে গুঁজে ভেতরে ঢোকে হেদায়েত, কী ?
তুমি আমার পা জোড়া কখনও দেখেছো ? রিনার কণ্ঠে এক ধরনের মাদকতা।
পা ? বিছনার ওপর বসে হেদায়েত, পা আবার দেখবার জিনিষ হলো ? পা তো নোংরা। তোমরা শালা মেয়েমানুষরা পারোও বটে। পায়ের ম্যানিকিউর না পেডিকিউর করে মাসে মাসে টাকা গচ্চা দাও। দুপুর রাতে এসেছে আমাকে পা দেখাতে… শ্লেষের বিষে রিনা বিষাক্ত প্রজাপতি হয়ে যায়। একদম চুপ। রুমের মধ্যে অনেক আলো কিন্তু ওর মনে হচ্ছে সমগ্র রুমটা অন্ধকারে ডুবে গেছে। ইতোমধ্যে নাক ডাকতে শুরু করেছে হেদায়েত। শ্বাস- প্রশ্বাসের সঙ্গে হাঙ্গরের পেট উঠছে নামছে। রিনা রুমের লাইট অফ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। বাইরে আলো-অন্ধকার, আলোর সৌন্দর্য দেখে মন খারাপটা একটু কমে। বসে চেয়ারে। হঠাৎ নাকে আসে হাসনাহেনার বিলম্বিত গন্ধ। কোত্থেকে আসছে গন্ধ ? বসা থেকে দাঁড়ায় রিনা, সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে মাসুদকে। আবার বসে পরে চেয়ারে, নিজের পা তুলে বাম পায়ের ওপর রেখে আদর করতে থাকে।
দাদি কইতরজান গ্রামের বাড়িতে ছোটবেলায় গোসল করানোর সময়ে বলতেন, আমার হতিনের স্বামীভাগ্য অইবো আসমান জোড়া।
মা শেফালি বেগম হাসেন, আপনের হতিনের ভাগ্য এতো ভালো অইবে ক্যামনে বুঝলেন ?
বৌ দেহো, আমার হতিনের পা দুইডা! কী সোন্দর আর মোলায়েম। দেহো, বয়সের চাইয়া আমার হতিনের পা জোড়া একটু লম্বা না ? আগে রাজরানীগো পাও এই রহম আছিল। দাদি নাতনির পা দুটো নিজের হাঁটুর ওপর তুলে আঁচল দিয়ে মুছে দেন। তখন রিনা কিছুই বুঝতো না। কিন্তু বড় হয়ে, কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময়ে বুঝতে পারে, ওর পা জোড়া সত্যিই সুন্দর! আসলে খুব কাছের কেউ না হলে পায়ের দিকে দৃষ্টি দেয় ? দেয় না। কেউই রিনার পায়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে বলেনি, তোমার পা জোড়া সত্যি সুন্দর! স্বামী কোনওদিন ফিরেও তাকায়নি। আচ্ছা স্বামী, যার কাছে কোনওকিছুই অদেয় নেই, সেই স্বামী কি কখনও আমার মুখ দেখেছে ? মুখ তো দেখেই কিন্তু প্রেমের সুর মেখে গভীর গোপনে কখনও নিরীক্ষণ করেছে ?
হাসি ফোটে রিনার ঠোঁটে, লোকটা স্বামী না পাথর সেটাই তো বুঝলো না বিবাহিত জীবনের এগারো বছরে। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বের হয় রিনার নাক চিড়ে, শেষ পর্যন্ত একজন পাদুকা বিক্রেতা!
হ্যালো ? রিনা সুলতানা ফোন করে মাসুদ আহমেদকে।
ফোন রিসিভ করে মাসুদের বৌ সুলতানা বেগম, আপনে কেডা ?
আমি রিনা সুলতানা। মাসুদ আছেন না ?
আছে, কিন্তু আপনে কেডা ? একটু রুষ্ট গলা সুলতানা বেগমের।
আপনি কে ? মাসুদ আপনার কী হয় ?
উনি আমার স্বামী। আমি সুলতানা বেগম। আপনে কেডা ?
আমি ওনার দোকানের একজন ক্রেতা। আমি নিয়মিত মাসুদের কাছ থেকে জুতো কিনি। আজকেও এসেছি, না পেয়ে ফোন দিলাম। মাসুদ কোথায় ?
মাসুদ নাইতে গেছে।
নাইতে গেছে মানে ?
গোছলে গেছে।
মৃদু হাসেন রিনা সুলতানা, ঠিক আছে। গোসল করে এলে বলবেন আমি ফোন করেছিলাম।
আইচ্ছা।
গোসল সেরে ঘরে আসার পর মাসুদ দেখে সুলতানা বেগম ভাত না বেড়ে থম ধরে বসে আছে চৌকির ওপর। হালকা-পাতলা শরীরের সুলতানা বেগম তো রাগে না সাধারণত। হঠাৎ কী হলো ? একটু আগেই গামছা আর লুঙ্গি দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি নাইয়া আহেন। আমি ভাত বারতেছি।
সকালে কচানদী পারে গিয়েছিল মাসুদ। টাটকা মাছ কিনেছে―বাইলা, টেংরা, আর আইরের বাচ্চা। কিছু চিংড়িও পেয়েছে। পুঁইশাক দিয়ে টাটকা মাছ রান্না করেছে সুলতানা বেগম। নতুন সালুনের অন্য ধরনের ঘ্রাণ নাকে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু সুলতানা বেগম গোস্সা করেছে কেন ?
পাশে এসে দাঁড়ায়, হাত রাখে কাঁধে―কী হলো তোমার ?
তোমারে এক মাগী ফোন দিছে ক্যা ?
কে আমাকে ফোন দিয়েছে ? অবাক মাসুদ। ফোনটা হাতে নেয়, একটা আননোন নাম্বার।
কয় তোমার দোকান দিয়া জোতা কেনে…
আমার দোকান কই ? আমি তো অন্যর দোকানে জুতা বিক্রি করি। কত নারী-পুরুষ আসে আমার কাছে, আমি বুঝতে পারছি না।
নাম কইলো রিনা সুলতানা।
আমি চিনি না বউ। তুমি ভাত দাও। আর কে না কে ফোন করেছে, তুমি গাল ফুলিয়ে বসে আছো ? সুলতানাকে জড়িয়ে ধরে, পাগলি একটা!
হাচাই তুমি মহিলারে চেনো না ? শরীরে মোচড় দিয়ে মাথা তুলে আকুল হয়ে প্রশ্ন করে সুলতানা।
বৌকে আদর করে, নারে পাগলি। ভাত দে।
সুলতানা বেগম দ্রুত হাতে গরম ভাত বেড়ে, নতুন তরকারি এগিয়ে দেয়। দুজনে মিলে তৃপ্তির সঙ্গে খায়। খাওয়ার পর বিছানায় গড়াগড়ি করে মাসুদ আর সুলতানা। গড়াগড়ির এক ফাঁকে ঘুমিয়ে যায় মাসুদ কিন্তু সুলতানার চোখে ঘুম আসে না। একটা ফোন ওর ঘুম কেড়ে নিয়েছে। জুতো বিক্রেতাকে কেউ জুতো কিনতে এসে ফোন দেয় ? আর মেয়েমানুষটার গলা তো খুব মিঠা। খুব বিরক্ত নিজের ওপর সুলতানা, বেডি আর মানুষ পাইলো না ? আমার মানুষটার কাছে আইলো জুতা কিনতে ? তাকায় ঘুমন্ত স্বামীর দিকে, কী বলিষ্ঠ শরীর, চওড়া বুক, বুকের উপর হালকা কালো লোম―হু হু কান্নায় হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে সুলতানা স্বামীর বুকের ওপর। ঘুম ভেঙে যায় মাসুদের। জড়িয়ে ধরে সুলতানাকে, কী হয়েছে ?
তোমার ঢাকায় যাওয়ার কাম নাই। দ্যাশ গেরামে একটা কিছু করো।
বুঝতে পারে ফোনটা ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু বুঝতেই পারছে না, কে ফোন করতে পারে ? ওই মহিলা ? যে প্রায়ই জুতো কিনতে আসে ? কিন্তু তাকে তো আমি ফোন নাম্বার দেই নাই। নাম কী তার ? রিনা সুলতানা ? কখনও তো জানার সুযোগ হয়নি। হবেও বা কেমন করে ? তিনি ক্রেতা, আমি সামান্য কর্মচারী জুতোর দোকানের। ক্রেতার নাম আমি জানতে চাইবার কে ?
আমার কতা তোমার কানে যায় না ?
শোয়া থেকে উঠে বসে মাসুদ, হাত ধরে বৌয়ের―তুমি একটা মহিলার ফোন পেয়ে এমন উতলা হলে ? দোকানে আমার কাছে কত মানুষ আসে, আমি নিজের হাতে জুতো পরিয়ে দেই, যাতে পছন্দ করে ক্রেতা―সেই জন্য কত কথা বলি। তুমি তো সবই জানো। আমার উপর ভরসা নাই ?
আছে তো।
তাহলে ?
কিন্তু ভয় হরে তোমারে লইয়া আমার। জড়িয়ে ধরে দু হাতে, তুমি ছাড়া আমার তো কেউ নাই।
হাসে মাসুদ, তুমি ছাড়াও আমার কেউ নাই।
বিকেলে কচানদীর পারে যায় মাসুদ। ভাটির টানে নদীর পানি অনেকটা নিচে নেমে গেছে। পারে দুই পা দুলিয়ে বসে মাসুদ। ফোন করে মোবাইলে, হ্যালো ? আপনি কে আমাকে ফোন করেছিলেন ?
আমি, আমি… আমাকে চিনতে পারেননি মাসুদ ? মহিলার কণ্ঠে আগ্রহ।
না!
আমি আপনার কাছ থেকে জুতো কিনি… আমার নাম রিনা সুলতানা।
জি বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ফোন করেছেন কেন ?
জুতো কিনতে গিয়ে শুনি আপনি ছুটিতে। আপনাকে না পেয়ে জুতো কিনতে না পেরে মন খারাপ হলো খুব। তাই আপনার কলিগের কাছ থেকে নাম্বার এনে আপনাকে ফোন দিয়েছি, আপনি কবে আসবেন ? আমি জুতো কিনব।
অনেক জুতোই তো কিনলেন, আর কত ? আপনি দোকানে গেলে আমার কলিগেরা হাসাহাসি করে ম্যাম। আমি সামান্য জুতো বিক্রেতা। আপনি আমার কাছে আসেন…
হাসেন রিনা সুলতানা, যতোই হাসুক, উপেক্ষা করুক, জুতো আমি আপনার হাত থেকেই কিনব।
কেন ? ঢাকা শহরে কত অভিজাত দোকান আছে…
আছে, নিশ্চয়ই আছে কিন্তু কেউ তো বলেনি আমাকে, আপনার পা জোড়া ভীষণ সুন্দর। একজন বলেছে, সেই একজন আপনি। এবং আপনার কাছ থেকেই আমি জুতো কিনব, পারলে প্রত্যেক দিন।
প্রত্যেক দিন ? চমকে ওঠে মাসুদ আহমেদ।
হ্যাঁ প্রত্যেক দিন।
কিন্তু কেন ? কচানদীর দিগন্ত বিস্তৃত তটরেখায় দৃষ্টি মেলে দিয়ে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে মাসুদ।
কারণ… থেমে যায় রিনা সুলতানা।
হ্যাঁ, কারণটা বলুন।
আপনি যখন আমার পায়ে জুতো পরিয়ে দেন, আমার গোটা শরীর আনন্দে নেচে ওঠে। মনে হয়, আমি নৃত্য করছি ভেতরে ভেতরে।
বলেন কী আপনি ?
যা সত্যি তাই বলছি। আমার পা জোড়া সুন্দর―আমি জানি, জানতাম। অনেক সময়ে বাসায় একাই পা দুইখানা একত্র করে তাকিয়ে থাকি। মনে হয়, আমার দুটি পা মিলে একটা পদ্মপাতা। একমাত্র দাদি ছাড়া কেউ আমার পা জোড়াকে ভালোবাসেনি, আপনি ছাড়া।
আপনাকে আর একটা বিষয়ে বলা হয়নি―
কী বিষয়ে বলা হয়নি ? উৎসুক্যের সঙ্গে জানতে চায় রিনা সুলতানা।
আপনার পা জোড়াই কেবল সুন্দর নয়, আপনার মুখটাও সুন্দর। অনেকটা নিস্তরঙ্গ পুকুরে নিঃশব্দে ভেসে যাওয়া পাকা কাঁঠালপাতার মতো আপনার মুখ। চোখ দুটো সকালের ঘাসের উপর টলমলো প্রথম শিশির বিন্দুর মতো অবিরাম সুন্দর। ম্যাম, আপনাকে বলি, সুন্দর কেবল একটি শব্দ নয়, উপলদ্ধির একান্ত নির্যাসও বটে। সবটা মিলিয়ে আপনি অনন্য এক অপরাজিতা!
মোবাইলের এ পাশে স্তব্ধ রিনা সুলতানা।
ম্যাম, রাগ করলেন ?
না, আগে বলুন তো আপনি কে ?
কচানদীর বিকেলের সূর্যের রঙের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া এলোমেলো ঢেউয়ের খলখলানি দেখতে দেখতে মাসুদ হাসে, ম্যাম আমি সামান্য মানুষ। ঢাকার অভিজাত এলাকায় পাদুকা বিক্রেতা মাত্র।
আপনি পড়াশোনা করেছেন কোথায় ?
ম্যাম, আমি তিনবার মেট্রিক ফেল একটা মানুষ।
মানে ?
আমি গণিতে খুব কাঁচা। কাঁচা মানে কাঁচা। অনেক টিচার আমার জন্য রাখা হয়েছিল দরিদ্র কৃষক পিতার পক্ষ থেকে। এ প্লাস বি হোলস্কয়ার-এর ফরমুলা কোটি কোটি বার মুখস্থ করেছি কিন্তু মনে থাকেনি। বিশাল বিশাল সরল অংকের শেষে কেমনে রেজাল্ট শুধু শূন্য হয়, আমি বুঝতে পারি না। কেমনে ঐকিক নিয়মে আমার বন্ধু ও শিক্ষকেরা বড় বড় ও জটিল অংকের সমাধান বের করে মিলিয়ে দেন, মগজে ঢোকেনি। অন্যান্য সাবজেক্ট নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না, গণিতই আমাকে পথে বসিয়েছে। যদিও জগৎসংসার চলে গণিতের নিয়মে, কিন্তু আমি রয়ে গেছি গণিতের বাইরে। তাই জুতোর দোকানে আপনাদের মহামূল্যবান পায়ে জুতো পরাই আর গণিতের সূত্র মুখস্থ করার চেষ্টা করি… এক টানে বলে থামে মাসুদ।
দুই পাশে অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতা।
নীরবতা ভাঙ্গে রিনা, মাসুদ আপনি কি লেখক ? মানে লেখালেখি করেন ?
না ম্যাম।
তাহলে এমন চমৎকার শব্দচয়নে আলাপ করেন কীভাবে ?
আমি শৈশব থেকে বই পড়ি। প্রচুর বইয়ের চরিত্রের সঙ্গে আমার পরিচয়, যোগাযোগ। যেমন ধরুন, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের নায়ক নিতাইয়ের সঙ্গে, ওর প্রেমিক ঠাকুরঝির সঙ্গে, ঝুমুরের সঙ্গে আমার প্রায়ই কথা হয়। হাসান আজিজুল হকের উপন্যাস সাবিত্রী উপাখ্যান-এর অসংখ্যবার ধর্ষণের শিকার নায়িকা সাবিত্রীর সঙ্গে আমার দেখা হয়, মনি হায়দারের একাত্তরের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস― কিংবদন্তির ভাগীরথী―যে কন্যাকে পাকিস্তানি হায়েনারা পিরোজপুরের ক্যাম্পে কেপ্ট করে রেখে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছে, সেই ভাগীরথী দিদির সঙ্গে দেখা হয়…
মাসুদ!
বলুন ম্যাম…
আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আবেগে কাঁপছেন রিনা সুলতানা।
আমি সামান্য মানুষ, আমার সঙ্গে দেখা করে কী করবেন ?
অনেক কথা আছে আপনার সঙ্গে।
আমার ছুটি চারদিনের। আর দুটো দিন বাড়ি থেকে ঢাকায় আসছি। খেয়ে পরে তো বাঁচতে হবে―সংসার আছে।
বুঝতে পেরেছি। কিন্তু ঢাকায় এসেই আপনি আমার নাম্বারে ফোন দেবেন।
দেখি!
দেখি না, ঢাকায় পৌঁছেই আমাকে ফোন দেবেন। নইলে আমি আপনার জুতোর দোকানে গিয়ে বসে থাকব।
কচানদীর পারে সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে হা হা হাসিতে ফেটে পরে মাসুদ, মানুষ আপনাকে পাগল বলবে।
বলুক। সেটা আমার ব্যাপার। আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই―
করুন।
নারীর পায়ের সৌন্দর্য দেখার এই দৃষ্টি ও রুচি কোথায় পেলেন আপনি ?
বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয় মাসুদ আহমেদের, ম্যাম আমি যখন ছোট আমার মা গ্রামে বিয়ে বাড়িতে হয়লা গাইতেন।
হয়লা ?
বরিশাল অঞ্চলে বিয়ের গীত। আমার মায়ের খুব চাহিদা ছিল। দরাজ গলা। আর মা একটু আধটু লেখাপড়া জানতেন। শুনেছি সেই সময়ে তিনি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। হয়লা গেয়ে ভালো টাকা উপার্জন করতেন মা। মা সেই সময়ে পান ও বিড়ি খেতেন।
বিড়ি খেতেন ?
জি ম্যাম। তখন তো দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে সিগারেট ছিল না, পাতার বিড়িই ছিল। আমার বাবাও খেতেন পান-বিড়ি। দেখতাম রাতে বিছানার পাশে ল্যাম্প জ্বালিয়ে দুজনে গল্প করছে, বিড়ি টানছে, পান খাচ্ছে। সেই মা ছোটবেলায়, আমি একমাত্র সন্তান তো, খুব আদর করতেন। বিয়েবাড়িতে হয়লা গাওয়ার সময়ে নিয়ে যেতেন। মায়ের একটা দল ছিল হয়লা গাওয়ার। হালকা নেচে নেচে গাওয়ার সময়ে আমি দূরে বসে দেখতাম মাকে। শুনতাম হয়লা। এখন আর ওসব নেই―বলা যায় আমার মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উজানগাঁও গ্রাম থেকে বিয়ের হয়লা গাওয়া উঠে গেছে। আমার মা আমাকে কোলে নিয়ে হয়লা গাইতেন আর বলতেন―আমার ছেলের জন্য সেই মেয়েকে আনবো বৌ করে, যার পা জোড়া হবে নৌকার মতো লম্বা, যার পায়ে থাকবে আলতার রং, পায়ে রোদ পড়লে বিদ্যুৎ চমকাবে, পায়ের আঙুল হবে কাঁঠালিচাপার মতো মসৃণ আর ভোরের শিশিরের মতো ছন্দ ছড়িয়ে পড়বে, যখন ছেলের বউ হাঁটবে, বউয়ের পায়ের আঙ্গুলের আগায় নেমে আসবে আকাশের নক্ষত্র, জানো বাবু, যে মেয়ের পা লাবণ্যমণ্ডিত সুন্দর সেই মেয়ের মুখও হয় স্ফটিক জলের মতো পবিত্র আর একান্ত নিবিড় সুন্দর। আমার মায়ের বর্ণনায় আপনার পা সম্পর্কে আমি বেশি কিছু বলার সুযোগ পাইনি, কিন্তু সবটা―মানে আপনার পা, আর মুখের সৌন্দর্য মিলিয়ে আপনি অনন্য অপ্সরী।
মোবাইলের ওপাশে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে বাসার বারান্দার চেয়ারে রিনা সুলতানা। বরিশালের উজানগাঁও গ্রামের সন্ধ্যার মতো ঢাকা শহরের অভিজাত এলাকায়ও সন্ধ্যা নেমেছে মন্দ মন্থরে, সেই সন্ধ্যার গাঢ় ছায়ার মধ্যে নিজেকে বিলীন করে দিয়ে বসে আছেন একজন রিনা সুলতানা।
মাসুদ আহমেদের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপের পর মাসুদের কোনও খবর পান না রিনা সুলতানা। ফোন বন্ধ। জুতোর দোকানে যেতে এখন লজ্জা লাগে। যদিও বলেছে, গিয়ে বসে থাকব। কিন্তু জুতোর দোকানে ঢুকলেই মাসুদের কলিগেরা একদম অন্যরকম হয়ে যায়। অদ্ভুত দৃষ্টিতে চোরা চোখে তাকায়। শরীরের ভাষাটাও কদর্য। দোকানের ম্যানেজারের মুখে বাদুরের লম্বা মুখের আদলে এক ধরনের কৃত্রিম লালা দেখতে পায় রিনা সুলতানা, শরীর ঘিন ঘিন করে। পনেরো দিনে অন্তত বিশ হাজারবার ফোন দিয়েছে মাসুদের নাম্বারে, বন্ধ।
বাধ্য হয়ে রিনা সুলতানা জুতোর দোকানে আসেন। আসে পরিচ্ছদটা একটু চেঞ্জ করে। পরেছে কালো সালোয়ার কামিজ। মুখের অর্ধেক ঢেকে দিয়েছে কালো ওড়নায়। প্রথমে দোকানের কেউ চিনতেই পারেনি। কিন্তু ঢুকে যখন পংকজ কুমারের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছে, ঠিকই লহমায় সবাই চিনেছে রিনাকে। কিন্তু রিনা ওদের আচরণে পাত্তা না দিয়ে পংকজকে বলে, আপনার বন্ধুর নতুন মোবাইল নাম্বারটা দিন।
আমাকে নিষেধ করেছে ম্যাম, জটিলতায় না গিয়ে সরাসরি জবাব দেয় পংকজ কুমার।
কেন ? আমি আপনার বন্ধুর কী করেছি ?
আমি জানি না।
আমার প্রতি আপনার বন্ধুর কোনও কৌতূহল নেই ?
আছে বলেই তো নিজেকে লুকিয়েছে।
কেন ? বিস্ময় প্রকাশ করে রিনা সুলতানা।
আপনি আর আমার বন্ধুর মধ্যে কত ব্যবধান, ভেবে দেখেছেন ? আসমান আর জমিন―কখনও একত্র হতে পারে ? দুজনের মধ্যে থেকে যায় কোটি কোটি মাইলের ব্যবধান। আমার বন্ধু মাসুদ আহমেদ, সেটা খুব ভালোভাবে বোঝে।
তাহলে আমার জন্যই আপনার বন্ধু মোবাইল চেঞ্জ করেছে ?
কেবল মোবাইল না চাকরিও ছেড়ে দিয়েছে।
অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পংকজ কুমারের দিকে, চাকরি ছেড়ে দিয়েছে মাসুদ ?
জি।
আমি যাতে আর…
বুঝতেই যখন পারছেন, তখন আমার নিরপরাধ বন্ধুকে রেহাই দিচ্ছেন না কেন ? ওর তো কোনও অপরাধ নেই।
আকুল হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে রিনা সুলতানা, আমার কী অপরাধ ? আমি কেন আপনার বন্ধুকে এক মুুহূর্তের জন্য ভুলতে পারছি না, বলতে পারেন ? আমি জানি, সমাজ বাস্তবতার নিরিখে আমার এই অবস্থান কেউ মানবে না। কোটি কোটি মানুষ প্রশ্ন তুলবে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আমার জীবনবোধের খবর তো তারা রাখে না। রাখে ?
ঘাবড়ে যায় পাদুকা বিক্রেতা মাসুদ আহমেদের বন্ধু পংকজ কুমার, আপা আমি এতো সব ক্যামনে জানব ?
তাহলে মাসুদের নাম্বার দিন।
অসহায় পংকজ মোবাইল নাম্বারটা দেয় রিনা সুলতানাকে। রিনা নাম্বার নিয়েই ফোন দেয় মাসুদকে। রিং বাজে কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করে না। দোকানে দাঁড়িয়ে কয়েকবার ফোন দেয় রিনা, কিন্তু প্রতিবার একই রেজাল্ট, ফোন বাজে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। রিনা সুলতানা বিষন্ন হয়ে পড়লেও শেষ পর্যন্ত দেখার প্রতিজ্ঞা করে আবার দাঁড়ায় পংকজ কুমারের সামনে, আপনার বন্ধুর বাসা চেনেন ?
চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করায় দুর্বল চিত্তের পংকজ কুমার মাথা নাড়ায়, চিনি।
চলুন।
ম্যানেজারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে পংকজ দোকানের বাইরে আসে, সঙ্গে রিনা সুলতানা। বাইরে এসে একটা যন্ত্রচালিত রিকশা নেয় পংকজ। মুখ কুঁচকে যায় রিনা সুলতানার, এটায় চড়বো ?
হ্যাঁ, গলি তো। এটাই চলে… রিকশায় উঠে বসে পংজক। বাধ্য হয়ে অনেক কষ্টে রিকশায় উঠে বসে রিনা। চলতে শুরু করে রিকশা। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রধান রাস্তা পরিত্যাগ করে যন্ত্রচালিত রিকশা ঢুকে যায় একটা গলিতে। গলির মধ্যে ঢুকেই রিকশাঅলার পাখা গজায়। আরও দ্রুত ছুটতে শুরু করে পথের উঁচু নিচু জায়গা আর নালা পার হয়ে। রিনা বিভ্রান্ত―রিকশাটা এমন চলছে কেন ? পংকজ নির্বিকার কিন্তু বিপন্ন রিনা সুলতানা। হাত বাড়িয়ে দেয় পংকজের দিকে। পংকজ সসম্মানে হাতটা ধরে।
আর একটু হলেই পড়ে যেতাম উল্টে, এতো জোরে চালায় কেন ?
বলতে বলতে রিকশা গলি ছেড়ে একটা উপগলির মধ্যে ঢুকে যায়। সেই উপগলির মধ্যে একটাই রিকশা ঢুকতে পারে, এতো ছোট এঁদো গলি। বড় বড় বিল্ডিং নেই রাস্তার দু পাশে তেমন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘরবাড়ি, কিছু গাছপালাও দেখা যায়। রিনা বুঝতে পারে, শহর পার হয়ে শহরতলীতে ঢুকেছে রিকশাঅলা। চলতে চলতে খোলামেলা একটা জায়গায় যন্ত্ররিকশা থামে। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর পার হয়ে আসতে আসতে রিনা সুলতানার কোমর ধরে গেছে। দ্রুত নামে পংকজ। রিকশা থেকে নেমে হাত বাড়ায় পংকজ। হাত ধরে নামায় রিনা সুলতানাকে। চারদিকে খোলামেলা দেখে ভালো লাগে, কোমরের ব্যথা অনেকটা ভুলে যায়। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে একতলা দোতলা বাড়ি। অনেকগুলো মাটি ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করার জন্য মাথা তুলেছে মাত্র।
কয়েক গজ দূরের একটা আধাপাকা ঘর দেখিয়ে পংকজ বলে, ওটাই মাসুদের বাসা। আপনি যান। আমি গেলাম―এক লাফে পংকজ কুমার রিকশায় উঠে বসে। সঙ্গে সঙ্গে রিকশা চালাতে শুরু করে ড্রাইভার। মুহূর্ত মাত্র, রিনা একলা হয়ে যায়। এলাকার নামটাও জানেন না। অথচ লোকটা ফেলে রেখে চলে গেল ? কিন্তু ভয় পেলে চলবে না, রিনা সামনে পা বাড়ায়। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ না হলেও ভেজানো। রিনা দরজায় টোকা দিয়ে ধাক্কা দেয়। দরজার সামনে দাঁড়ানো মাসুদ আহমেদ, পাদুকা বিক্রেতা। রিনাকে নিজের বাসার দরজার সামনে দেখে কেবল বিস্মিত নয়, বিমূঢ়ও। মুখে কোনও কথা সরে না। দুজনে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে মুহূর্ত ধরে। মাথার ওপর দিয়ে বিকট শব্দ করে একটা বিমান উড়ে যাওয়ার পর নিজেই দরজা ঠেলে উপরে ওঠে রিনা, আমাকে বসতে বলবেন না ?
আসুন, ভেতরে আসুন… মাসুদ সরে ভেতরে ঢোকে। ভেতরে আসবাবপত্র তেমন কিছু নেই। মাঝারি একটা রুম। তিনদিকে বড় বড় জানালা। উত্তর ও পশ্চিম দিক খোলা। প্রচুর বাতাস আসছে জানালা পথে। তারপরও মাথার উপর একটা ফ্যান ঘুরছে প্রাণপণে। ঘরটা সাজানো, পরিপাটি। বড় একটা খাট। বসার আর কিছু নেই। রিনা খাটের ওপর বসে। বাতাসে চুল উড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। মাসুদের মনে হচ্ছে, গভীর বনের মধ্যে একটা লাল ডানার প্রজাপতি উড়ছে।
মাসুদ ?
বলুন।
আপনি বসুন আমার পাশে।
দ্বিধা আর প্রবল সংকচ নিয়ে রিনার পাশে বসে মাসুদ আহমেদ। কী করবে বা কী বলবে মাসুদ বুঝে উঠতে পারছে না। একদিকে অপার সুখ―আমার সন্ধানে এক অপূর্ব সুন্দর নারী এসেছে আমার নিম্নবর্গীয় বাসায়। অন্যদিকে, আমি এই অপূর্ব সুন্দর নারীকে লইয়া কী করিব ? কোথায় রাখিব ? যেখানেই রাখিব, এই নারী আগুন হইয়া জ্বলিয়া উঠিবে। এবং আমাকেসহ নিজেও পুড়িয়া ছারখার হইয়া যাইবে।
মাসুদ, আপনি যেদিন আমার পায়ে জুতো পরাতে পরাতে পায়ের সৌন্দর্য সম্পর্কে বলছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে আমার শরীরে মনে চেতনে আগুন জ্বলে উঠেছিল। এবং আপনি বিশ্বাস করবেন কি না―সেই আগুন এখনো প্রবহমান। আপনার মায়ের মতো আমার দাদী কইতরজান বলতেন, আমার পায়ের সৌন্দর্য আমাকে রাজরানি করবে। বড় হওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম, সত্যি আমার পা জোড়া ভয়ানক সুন্দর। ট্র্যাজেডি কী জানেন, পা তো থাকে জুতো, শাড়ি, সালোয়ারের আড়ালে কেউ দেখে না। কারও চোখে পড়ে না। আমি কত মেয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখেছি―বিকৃত পা। অনেক সময়ে আড্ডায় আমি পা জোড়া বের করে রেখেছি, কেউ একজন দেখুক, বলুক একজন―রিনা তোমার পা জোড়া সুন্দর। আমি মরমে মরে যেতাম। দুঃখে বেদনায় কাতর থাকতাম। ভাবলাম, বিয়ের পর নিশ্চয়ই বর বলবে। কিন্তু … যাক ওসব বলে আপনাকে বিব্রত করতে চাই না। জুতো আমি একটু বড় হওয়ার পর থেকেই কিনি। কত দোকানি আমার পায়ে জুতো পরিয়ে জুতোর বিচিত্র মাহাত্ম্য বর্ণনা করে করে জুতো গছিয়ে দিয়েছে। অনেকবার এরকম হয়েছে―দুই দিন পরার পর জুতোর তলা খুলে গেছে। অজস্র অজস্র জুতো আমি কিনেছি, দুটি আলমারি ভরা আমার জুতোয়। অজস্র জুতো ফেলে দিয়েছি অথবা কাজের মানুষদের দিয়েছি। বুঝতেই পারছেন, জুতোর প্রতি আমার আগ্রহ কত ব্যাপক। হাজার হাজার জুতো কেনার পরও একমাত্র আপনি ছাড়া কেউ বলেনি, বলবে কী করে, নারীর পায়ের সৌন্দর্যের ইতিহাসটাই তো জানে না, আপনিই বলেছেন, আপনার পা জোড়া সুন্দর। বলেছেন, আপনার পা জোড়ায় অন্ধকার রাতে আলো জ্বলে। আপনার পায়ের নখে নক্ষত্র চুমু খায়… এখন আমি এই পা জোড়া আর আমার মনে করি না!
তীব্র আবেগ আর অনুরাগে রিনা সুলতানা নিজের মনোলোগ প্রকাশ করে তাকিয়ে থাকে মাসুদের দিকে। মাসুদের মন প্রাণ শরীর অশরীরী আবেগে ভেতরে ভেতরে লাভার মতো গলতে থাকে, নিজেকে মনে হয় দিল্লির আকাশছোঁয়া কুতুবমিনার। যদিও দিনের তীব্র আলো চারদিকে খাঁ খাঁ বুকের মতো চিতিয়ে আছে কিন্তু মাসুদের মনে হচ্ছে, চারদিকে অন্ধকার রাত। পায়ের নিচে বালুর বিস্তার। সেই বালুর মধ্যে রিনা সুলতানার সুডৌল পা জোড়া লুকিয়ে রেখে বলছে, মাসুদ আমার পা জোড়া খুঁজে দাও।
কোনও প্রতিক্রিয়া নেই আপনার ? কণ্ঠে মাধুর্য আর বেদনা মিলিয়ে বলে রিনা, আমি এতো কষ্ট করে এলাম আপনার কাছে!
পা জোড়া তো আপনার, আমি কী করব বুঝতে পারছি না! মাসুদ নিজের কণ্ঠস্বর চিনতে পারছে না। মনে হচ্ছে ওর গলায় অন্য কেউ বলছে।
আমি আমার পা জোড়া বহন করতে পারছি না, সব সময়ে মনে হয়, আমার পা জোড়ার মালিক আপনি। আপনাকে আমি পা জোড়া দিতে এসেছি… গলায় কান্না নেমেছে রিনা সুলতানার। অনুগ্রহ করে আমার পা জোড়া গ্রহণ করুন, আমাকে দয়া করুন…
রিনা সুলতানার কান্নায় প্লাবিত মুখটা অপূর্ব সুন্দর লাগছে মাসুদের কাছে। রিনার হাতটা ধরবার জন্য কেবল নিজের ডান হাতটা তুলেছে, খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় সুলতানা বেগম। সুলতানা বেগমের হাতে একটা গামলা, গামলায় দুটি প্লেট, একটা গ্লাস, একটা ছোট জগ। দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরটা দেখে সুলতানা বেগম চমকে ওঠে, হেই মাইয়াডা না তো ?
রিনা সুলতানা নিজেকে সামলে তাকায় দরজায় অপেক্ষারত সুলতানা বেগমের দিকে, মাসুদের বৌটা তো দারুণ সুন্দরী! অপরূপ সারল্যের সৌন্দর্য প্রকাশ পাচ্ছে ওর হালকা পাতলা শরীর থেকে। পায়ের স্পঞ্জ জুতো রেখে রুমে প্রবেশ করে সুলতানা বেগম। রিনা সুলতানা তাকিয়ে দেখে, মাসুদের বৌয়ের পা জোড়া ওর পায়ের চেয়েও সুন্দর, সুডৌল, স্বচ্ছ দৃষ্টির মতো পরিষ্কার পায়ের চামড়া। পায়ের আঙুলগুলো মাটির সঙ্গে আলিঙ্গন করা দশটি বিন্দু বিন্দু গ্রহ, যারা প্রতিদিন পৃথিবীকে ছুঁয়ে জানিয়ে দেয় মানুষের অন্তহীন প্রেমের উৎস! পায়ের গোড়ালি যেন অব্যক্ত সুরের মহিমায় হাঁটার শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সকল ভর নিয়ে, অসীম আলিঙ্গনের আশায়। মাসুদের বৌয়ের পা এক জোড়া প্রাচীন শিলালিপি।
রিনা সুলতানা বনাম সুলতানা বেগম পরস্পর তাকিয়ে দেখছে। মধ্যখানে তৃতীয় মানুষ মাসুদ আহমেদ গলে যাচ্ছে অগ্নিলাভার স্রোতে, একটু একটু করে।
সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ