আর্কাইভগল্প

গল্প : প্রেম ও প্রতীক্ষার দিনরাত্রি : আহমেদ মাওলা

বসন্তের এক পড়ন্ত বিকেলে আবাসিক হলের দোতলা বারান্দায় বসে মোহাম্মদ হারুনের মনে হলো জীবনটাকে এ পর্যন্ত  সে যেন সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেনি। জীবন অতি কাম্য, অতি উপভোগ্য। তুচ্ছ তেলাপোকাও বেঁচে থেকে জীবনকে উপভোগ করেত চায়। পেতে চায় জীবনের অম্লমধুর স্বাদ। বেঁচে থাকার জন্য একজন মানুষের জীবনে যতটুকু হাহাকার ও আনন্দ থাকা প্রয়োজন, ভালোবাসা ও বেদনার প্রয়োজন, মোহাম্মদ হারুনের যেন তা নেই। উদাসীন, অন্যমনস্ক থেকে সে কেবল এতকাল জীবনকে অপচয়ই করেছে। জীবনের এই ক্ষতি এবং সর্বনাশের কথা চিন্তা করে তার মন বিষন্ন হয়ে পড়ে। অথবা সার্থকভাবে জীবন-যাপন করার জন্য যেসব কলাকৌশল, চালাকি-বদমায়েশি, বোধ-বুদ্ধি থাকা প্রয়োজন, মোহাম্মদ হারুনের তা অনায়ত্তই থেকে গেছে। সত্য-মিথ্যায় ভরা, পাপ-পুণ্যে মেশানো জীবনের শ্রীহীন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে সে ভাবে―এ জীবন তো এরকম হওয়ার কথা ছিল না, অন্য রকম হওয়ার কথা ছিল।

ঝোঁকের মাথায় কাজ করার কোনও অভ্যাস হারুনের কোনও দিন ছিল না। মনের হঠাৎ জেগে ওঠা ইচ্ছাগুলোকে সে চিরকাল সামলে চলার চেষ্টা করেছে। তবে এমন কতোগুলো অসাধারণ জোরালো হঠাৎ জাগা ইচ্ছা মানুষের মধ্যে মাঝে মাঝে জেগে ওঠে যে, সে সব দমন করার ক্ষমতা কারও থাকে না।

সকালে ঘুম থেকে ওঠে সে যেন কিছু ভাবলো না, কোনও কথা বিবেচনা না করে সোজা জয়িতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এত সকালে হারুনকে দেখে জয়িতা অবাক হয়। নিজের ভেতরের কৌতূহলকে যথাসম্ভব গোপন করে তার ভুবনমোহিনী হাসিটি ছড়িয়ে দেয় মুখে। হারুন কোনও ভূমিকা না করে বলে―

‘তোমাকে একটি কথা বলব বলে এসেছি।’

মনের ভেতরটা কেমন করে ওঠে জয়িতার। হাসি-চাপা কণ্ঠে জয়িতা বলে―‘একটি মাত্র কথা ?’

‘হাসির কথা নয় জয়িতা।’

‘তাহলে সিরিয়াস কিছু ?’

কথা বলতে বলতে জয়িতা আড়চোখে তাকায়। খোঁপা ভেঙ্গে চুলগুলো তার কাঁধে ছড়িয়ে পড়ে।

‘সকালবেলা তোমার সঙ্গে তামাশা করতে আসিনি, জয়িতা।’

‘তামাশা নয় ? তবে ঠাট্টা বুঝি ?’

‘আবার হাসছো তুমি ?’

‘একসময় তুমি না বলতে―আমার হাসি দেখলে নাকি তোমার মন জুড়িয়ে যায় ?’

হারুন বলে, ‘সেটা মিথ্যে বলিনি। জয়িতা, আমি ঠিক তোমাকে মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না।’

‘কী করে বুঝবে ? মেয়েমানুষের কত কী যে হয়, সব বোঝা যায় না। স্বয়ং দেবতারাও এ জায়গায় হার মেনেছেন।’

হারুনের গা জ্বালা করে। জয়িতার হাসিতে আমন্ত্রণ না অবজ্ঞা, সে বুঝতে পারে না। সাত বছর যাবত নানা খুনসুটিকে সে কেবল প্রশ্রয় দিয়েছে ? জীবনসীমার বহিঃপ্রাচীরে হঠাৎ সে ধাক্কা খায়। মনের বদ্ধ দরজা খুলে সে দেখতে পায় ওপাশে বিস্তৃত আকাশ। কত সম্ভাবনা, কত বিস্ময় তার জন্য অপেক্ষা করছে। চারিদিকে ফাগুনের ঝকঝকে রোদ। বকুল গাছের ঘনছায়ায় হারুন আর জয়িতা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। জয়িতার চোখের দিকে তাকিয়ে হারুন মনে মনে ভাবে―জয়িতাকে ধরে এমন একটি ঝাঁকুনি দেওয়া দরকার যেন তার চোখের বিহ্বলতা, অফুরন্ত  কাতরতা শিশিরের মতো ঝরে পড়ে। কিন্তু না, হারুনের গোপন আকাক্সক্ষা অবদমিতই থেকে যায়। জয়িতা জিজ্ঞাসা করে, ―‘কী কথা যেন বলতে এসেছিলে, এখন চুপচাপ হয়ে আছো কেন ?’

জয়িতার কথায় হারুন যেন সম্বিৎ ফিরে পায়। কিছুটা ইতস্তত করে, দূর দিগন্তের দিকে তাকায়। প্রয়োজনীয় সাহস সঞ্চয় করে। বলবার কথাগুলো একবার গুছিয়ে নেয়। তবু যেন সংকোচ কাটিয়ে ওঠতে পারে না সে। কতোবার সে বলতে চেয়েছে কিন্তু প্রতি বারই জয়িতার মুখোমুখি হলে তার সাজানো কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। দ্বিধার অনেক দেয়াল ভেঙ্গে স্থির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। যেই করে হোক, জয়িতাকে সে প্রপোজ করবেই। কপালে যা-ই থাকুক। তারপর রাত জেগে কতোবার কথাগুলো সাজিয়ে নিয়েছে মনে মনে। কিন্তু এখন তার এরকম হচ্ছে কেন ? তার পা দুটো যেন ভারী হয়ে আছে। সে যেন দাঁড়িয়ে আছে বরফের চাঙের ওপর। জিহ্বা যেন অসাড় হয়ে গেছে। মনের ভেতর ইচ্ছাগুলো ঘূর্ণিঝড়ের মতো তোলপাড় করে। সকল উত্তেজনা প্রশমন করে মোহাম্মদ হারুন সরল, শান্ত  স্বরে উচ্চারণ করে―‘আমি তোমাকে ভালোবাসি জয়িতা।’

আধফোটা একটা গোলাপের কলি জয়িতার হাতে তুলে দেয়। জয়িতা মন্ত্রাবিষ্টের মতো ফুলটা হাতে নেয়। তারপর উত্তরের অপেক্ষা করে না। ধীর পায়ে চলে যায় হারুন।

‘তোমাকে ভালোবাসি’ পৃথিবীর অতি প্রাচীন, অতি নতুন এই কথাটি নিজ কানে শোনার পরও জয়িতার যেন বিশ্বাস হয় না। পৃথিবীর প্রতিটি নারী তার প্রিয় মানুষের মুখ থেকে আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে যে কথাটি শুনতে চায়, শোনার জন্য কান পেতে অপেক্ষায় থাকে, সে মাহেন্দ্রক্ষণটিতে দাঁড়িয়ে জয়িতা যেন অবেশে বিহ্বল। এর উত্তরে কী বলতে হয়, কীভাবে বলতে হয়, কিছুই তার জানা নেই। হয়তো কারওরই জানা থাকে না। প্রেম-ভালোবাসার অভিজ্ঞতা হয়তো এরকমই। সে অপূর্ব অনুভূতি অব্যক্তই থেকে যায়।

প্রেম যে কেবল বিশেষ বয়সের আবেগ নয়, নিছক শারীরিক কামনার বস্তু নয়, এ কথা পৃথিবীর কোনও প্রেমিক-প্রেমিকাই বুঝতে পারে না। কারণ, প্রেমের নিমজ্জন এরকমই। আবেগের অন্ধ উদ্গিরণ কামনার এমন অগ্নি প্রজ্জলিত থাকে যে, বিচার-বুদ্ধি সবই লোপ পেয়ে যায়। তখন ভালোবাসা মানে, দুজনের পাগলামি হয়ে ওঠে। কেউ তখন বুঝতে পারে না, সে স্বাধীন না পরাধীন। স্বাধীন হওয়ার জন্যই যেন প্রেমিক-প্রেমিকা পরাধীনতার শৃঙ্খল পরে নেয়, স্বেচ্ছায়―উল্লাসে।

জয়িতাও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রেমের প্রস্তাব তাকে মোহাবিষ্ট করে, আনন্দিত করে, প্রথমে সে বুঝতে পারে না। তার বান্ধবী সেলিনা, লোপা কিংবা নাছরিন কখনও প্রেমের অভিজ্ঞতার কথা বলেনি। সবাই জানে, লোপার সঙ্গে অপূর্বের প্রেম অনেক দিনের। সেলিনার প্রতি মতিনের গোপন দুর্বলতার কথা কারও অজানা নয়। রাশেদ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নাছরিনকে লাল একটি বেনারসি শাড়ি উপহার দিয়েছে। এসব নিয়ে আড়ালে-আবডালে কতো ইঙ্গিত, হাসি-ঠাট্টা। কিন্তু প্রথম প্রেমে পড়া, প্রেম নিবেদন করার মধুর-মাহেন্দ্রক্ষণ সবাই সযত্নে গোপন করে গেছে।

গোপন প্রেম আছে শাহজাহান আর শবনমের। ওরা মনে করে কেউ কিছু জানে না। আসলে সবাই জানে শবনম আর শাহজাহানের সম্পর্কটা নিছক বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। জারুলতলার ঘাসের ওপর বসে বাদাম খেতে খেতে সেলিনা বলল, ‘ওই দ্যাখ, দ্যাখ, নায়িকার সন্ধানে নায়ক এসে গেছে।’

শাহজাহানের ওপর চোখ পড়তেই শবনমের মুখ আপেলের মতো লাল হয়ে ওঠে।

ব্যাপারটা নাছরিনের দৃষ্টি এড়ায় না। মেয়েরা মেয়েদের মনের খবর খুব সহজে টের পায়। সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে সেলিনার গায়ের ওপর। তারপর বলে, ‘শাহজাহান ভাই বুঝি গন্ধ শুঁকে শুঁকে এখানে এসে হাজির হয়েছেন ?’

শাহজাহানের গায়ে পেস্ট কালারের শার্ট। মাথার চুল যত্নে পাট করা। মুখে হাসি ছড়িয়ে সে বলে, ‘বাগানে ফুল ফুটলে ভ্রমর তো আসবেই।’ মতিন কথাটা মাটিতে পড়তে দেয় না। সে বলে, ‘ফুলের গন্ধে কেবল ভ্রমর আসে না, সাপও আসে বন্ধু।’

বন্ধুদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়। আড্ডা জমে ওঠে। ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ ছেড়ে কথার স্রোত গড়িয়ে যায়―সমাজ, রাজনীতি, দেশ, জাতি, বিশ্বব্যবস্থা কতদিকে!

হারুনের হাতে বেশ কায়দা করে ধরা সিগারেট। মুখ থেকে একগাল ধোঁয়া ছেড়ে একটু কাশে।

তারপর বক্তৃতা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে,―আমরা হচ্ছি আশির দশকের বেড়ে ওঠা অসুখী কিশোর। ওই বয়সে আমাদের দেখতে হয়েছে সামরিক জেনারেলের বীভৎস, ভয়ঙ্কর শাসন। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে দুর্নীতি, সন্দেহ, অবিশ্বাস। কেউ কারও ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। চারিদিকে কেবল গভীর অন্ধকার, অনিশ্চয়তা, কেবল হতাশা। প্রবীণ রাজনীতিকরা তাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, নীতি আদর্শ ভুলে গিয়ে লুটিয়ে পড়ছে নগদ প্রাপ্তির কাছে। বিপ্লবীরা হয়ে উঠছে নীতিহীন নেতার চামচা, ছাত্রনেতাদের চারপাশে উড়ছে টাকা আর ক্ষমতা। মেধা নয়, শিক্ষা নয়, দলীয় পরিচয়ই প্রধান হয়ে উঠছে নিয়োগের প্রধান যোগ্যতা। জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে উচ্চ শিক্ষায়তন। এভাবে চলতে থাকলে একদিন প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারের কাছে হাত পেতে জ্ঞান ভিক্ষা করতে হবে ভাই সকল!

হারুনের বক্তৃতা শুনে সবাই হাত তালি দেয়। মতিন বলে, বক্তৃতাটা এখানে না দিয়ে তুই যদি লালদিঘি ময়দানে দিতি, নির্ঘাত এমপি হতে পারতি। তার কথায় শ্লেষ ঝরে পড়ে। নাছরিন বলল, ‘জয়িতা উপস্থিত থাকলে হারুন ভাই এমন বক্তৃতা দিতে পারত না।’ মতিন হারুনের গায়ে ঠেলা দিয়ে বলে, ‘দোস্ত, হঠাৎ তুই এত সিরিয়াস হয়ে গেলি কেন ?’

হারুন কথাটার জবাব দেয় না। একবার সেলিনার মুখের দিকে আরেকবার নাছরিনের চোখের দিকে তাকায়।

এই প্রথম হারুন লক্ষ করে, মেয়েদের চোখেরও একটা ভাষা আছে। সে ভাষায় অনেক না বলা কথার ইঙ্গিত থাকে। মুখের ভাষার চাইতে চোখের ভাষার আমন্ত্রণ আরও মোহময়। দূর দিগন্তে, যেখানে আকাশ এসে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে, সেই স্নিগ্ধ শ্যামল ছায়ার মতো মেয়েদের চোখের ভাষা। চোখ দিয়েই মেয়েরা মনের কথা বলে।

হারুন, লোপা, মতিন, সেলিনা, শাহজাহান, জয়িতা, নাছরিন, রাশেদ সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। সাত মায়ের সন্তান, সাত জায়গা থেকে এসেছে। পড়েও ভিন্ন ভিন্ন সাবজেক্টে। মত, পথ, দৃষ্টিভঙ্গি, রুচি ও চাহিদার মধ্যে সবারই স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। পোশাকে, আচরণে অনেক বৈপরীত্য থাকা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে রয়েছে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, সখ্য। তর্ক, দ্বন্দ্ব তাদের মধ্যে হয় না যে, এমন নয়। নদীর ঢেউয়ের মতো সে দ্বন্দ্ব মিটেও যায়। সহপাঠী, বন্ধুর বিপদে, সংকটে আত্মীয়-স্বজনের আগে এগিয়ে আসে বন্ধুরাই।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো হয়ে ওঠে মিনি ক্যান্টনম্যান্ট। প্রতিবাদী মিছিলের ওপর উঠে যাচ্ছে সামরিক ট্রাক। দুর্নীতিকে দেওয়া হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। প্রতিটি অফিসের পিয়ন দারোয়ান পর্যন্ত  অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করা বৈধ কাজ বলে মনে করছে। আগে যেখানে ঘুষ নেয়াটাকে মনে করা হতো গর্হিত, ঘৃণিত অপরাধ, সেখানে আমলা-কামলারা ঘুষ নেওয়াকে বৈধ ও বাড়তি ইনকাম হিসেবে বিবেচনা করে। অবাধে অফিস-আদালতে চলতে থাকে ঘুষের লেন-দেন। ধসে পড়ে সামাজিক মূল্যবোধের সমস্ত স্তম্ভ। স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের চরিত্রের ওপর পড়তে থাকে সেই অবক্ষয়ের কালো ছায়া। ততদিনে সমাজের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে অর্থ। অর্থ কোন পথে অর্জিত হয়েছে, সেই উৎসের খোঁজ কেউ নেয় না। অর্থ যার কাছে আছে, সে হয়ে উঠে সমাজে প্রভাবশালী। এভাবে অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনকারী বড় লোক বলে সমাজে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়।

স্বৈরাচারকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে নামাতে পাপী ও পুণ্যবান, কবি ও কামলা, শ্রমিক ও ছাত্র সবাই আন্দোলনে রাস্তায় নামে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে ছাত্ররাই ছিল অগ্রগামী। এ সময় হঠাৎ একদিন দুই ছাত্রসংগঠনের সংঘর্ষে ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুই ছাত্রাবাসের দুই দিকে অবস্থান নিয়ে দীর্ঘক্ষণ চলতে থাকে বন্দুকযুদ্ধ। ক্রসফায়ারে লুটিয়ে পড়ে সোসিওলজির হুমায়ুন নামের এক সাধারণ ছাত্র। আইআরের ছাত্র শাহজাহান গুলিতে আহত হলে বন্ধুরা সবাই তাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যায়। আহত শাহজাহানকে দ্রুত রক্ত দেওয়া প্রয়োজন। রক্ত দিতে প্রস্তুত অনেকে কিন্তু কারও সঙ্গে ও নেগেটিভ রক্তের মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সেলিনা, হারুন, মুর্তোজা, লোপা, মতিন, নাছরিন ছুটে যায় হাসপাতালে। হারুন হন্তদন্ত  হয়ে ছুটে এসে বলে, ‘ডাক্তার সাব, আমার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। নিন, আমার রক্ত নিন।’ ডাক্তার দ্রুত হারুনকে বেডে শুইয়ে রক্ত নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। নল বেয়ে রক্তের ধারা জমা হচ্ছে ব্যাগে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে লোপা, জয়িতা, মতিন। এই এক আশ্চর্য বন্ধুত্ব। বন্ধুর রক্তে বেঁচে ওঠে শাহজাহান।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, ভিসি হাসপাতালে দেখতে আসেন শাহজাহানকে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়। বিকেল পাঁচটার মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। রণক্ষেত্রের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয় পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায়।

বিশ্ববিদ্যালয় তিন মাস ধরে বন্ধ। কবে খুলবে কেউ বলতে পারে না। ছাত্রছাত্রীরা ভায়াবহ সেশনজটের কবলে। কারও কারও চাকরির বয়স অতিক্রম হওয়ার পর্যায়ে চলে এসেছে। প্রজন্মের মধ্যে বটবৃক্ষের মতো গভীর হতাশা। পরিবারে বোঝা হয়ে উঠছে অনেকে। পাঁচ বছরের একাডেমিক ইয়ার, শেষ করতে সাত বছর লেগে যাচ্ছে। জীবনের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো সময়, সময় যেন ফুরায় না।

আকস্মিকভাবে হল বন্ধ ঘোষণার পর হারুন প্রথমে গিয়ে ওঠে চাচাতো ভাই আবদুল লতিফের বাসায়। মনে ক্ষীণ আশা ছিল বিশ্ববিদ্যালয় খুললে আবার গিয়ে হলে উঠবে। কিন্তু মাসখানেক পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে না, তখন হারুন গিয়ে ওঠে কাঁঠালবাগানের এক মেসে। জুটিয়ে নেয় দুটো টিউশনি। বাড়িতে বাবার কাছে টাকা চাইতে এখন তার লজ্জাই করে। হারুনের বাবা পেশায় স্কুল শিক্ষক। গ্রামে তার ছোট ভাইবোন সবাই লেখাপড়া করে। কষ্টেসৃষ্টে চলে তাদের সংসার। ভালো রেজাল্ট করার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে ইংরেজি বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবে পাস করে বের হবে, কবে দায়িত্ব নেবে সংসারের, সে কথা ভাবে হাঁপানি রোগী মজিদ মাস্টার। মায়ের অশ্রুসিক্ত করুণ মুখের কথা মনে পড়তেই হারুন চঞ্চল হয়ে ওঠে। তার দিকে চেয়ে আছে অনেকগুলো মুখ।

সে সংসারের দায়িত্ব নিতে চায়। সবার মুখে হাসি ফোটাতে চায়। কিন্তু সময় হয়ে যায় তার বৈরী। তবু সে স্বপ্ন দেখে। একদিন হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। বাস্তবের যে অংশ স্বার্থপর অমার্জিত তার সঙ্গে স্বপ্নের একটা দূরত্ব আছে। বিরোধ আছে। অসহ্য বাস্তবের সঙ্গে সে আপস করতে চায় না। তাই তার সঙ্গ, নিঃসঙ্গতার রূপ নেয় সময়। তার প্রেম প্রতীক্ষার প্রহর গোনে। শবনম হয়ে ওঠে তার স্বপ্নের নায়িকা। রাতে বিছানায় শুয়ে গভীর রাত পর্যন্ত মোবাইল টিপে, এপাশ ওপাশ করে, শেষ রাতের দিকে ক্লান্ত হয়ে তন্দ্রার কোলে ঢলে পড়ে। হারুনের কাছে দিন-রাত্রির মধ্যে কোনও তফাৎ নেই।  স্বপ্নের ভেতর সে দেখে পৃথিবীর পেটের ভেতর সিঁড়ির মতো একটা পথ নেমে গেছে নিচের দিকে, কেউ যেন তাকে বলল―‘যাও’।

সে অনুগত শিশুর মতো দুুরুদুরু হৃৎপিণ্ড নিয়ে সিঁড়িতে পা রাখল। চারিদিকে পড়ে থাকা বিক্ষিপ্ত ইট-কাঠ, অট্টালিকার ধ্বংসের স্তূপ, মনে হলো কোনও অভিশপ্ত নগরীর নির্জন রাজপথে দাঁড়িয়ে আছে সে। যেন ঘুমের ঘোরে, গভীর অন্ধকারে অবলুপ্ত নগরী ময়নামতির শালবন বিহারের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছি ?

ভয় পেয়ে দৌড়াতে শুরু করল কিন্তু তার পা এক চুলও সরলো না। তার সামনে বিশাল দেয়ালে নৃত্যপর নারীর নাচের মুদ্রা, হরিণের বাঁকা মুখ, দারুচিত্রখচিত সিংহদরোজা। কানের কাছে শব্দ ধ্বনিত হলো―‘হা হা হা হা হারুন!’

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button