আর্কাইভগল্প

গল্প : দরবেশ ও নগরপিতা : সাব্বির জাদিদ

নগরে ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট বিস্ময়কর এক দরবেশের আবির্ভাব ঘটেছে। দরবেশের মাথায় বিদ্যুৎপ্রভ শুভ্র চুল। আনাভিলম্বিত একই বর্ণের উজ্জ্বল শ্মশ্রু। গায়ে জড়ানো এক খণ্ড সাদা বস্ত্র। যখন তিনি প্রার্থনায় মগ্ন হন, বিস্রস্ত বস্ত্রের ফাঁক গলে কাঁখতলির শুভ্রতা দর্শনার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রার্থনা শেষে যখন তিনি মুখচন্দ্রে হস্ত সঞ্চালন করেন, আঙটির পাথর থেকে বিচ্ছুরিত হয় বিদ্যুৎবিভা। দরবেশের হাতে সাপের ফণার মতো বাঁকা এক লাঠি। শোনা যাচ্ছে—দরবেশ নিজে যেমন অলৌকিক, অলৌকিক তার বাঁকানো লাঠিটাও। সুরমা রঙের লাঠিটা মাটিতে রেখে মন্ত্র পড়লেই নাকি অজগর হয়ে যায়। শুধু কি তাই—লাঠির বাড়ি পড়লে পাথর থেকে ফুল ফোটে। সাগরে আঘাত করলে রাস্তা হয়। অসুস্থের গায়ে স্পর্শ করলে রোগমুক্তি মেলে। দরবেশ কোথা থেকে এসেছেন, কেউ জানে না। কয়দিন থাকবেন, পরবর্তী গন্তব্য কোথায়—তাও জানে না কেউ। শুরুতে অবশ্য কেউ পাত্তা দেয়নি। লোকমুখে অনেক কিছুই শোনা যায়। যাচাই করতে গেলে বেরিয়ে আসে জোচ্চুরি। কিন্তু এই দরবেশ যে জোচ্চর নয়, প্রমাণ হয় দুদিন পরেই।

নগরের কৃষকনেতার পুত্র জঙ্গলে খেলতে গিয়ে সাপের ছোবল খেলে বেশ একটা হুলুস্থূল পড়ে যায় কৃষকপল্লিতে। বৈদ্য-ওঝা-কবিরাজ—কেউই বিষ নামাতে পারে না। বালকের মা আছাড়িবিছাড়ি করে কাঁদে। বাবার বুকের মধ্যে তুফান বয়। বালকের ছোট বোনটা ভাইয়ের মাথার কাছে বসে ভাই ভাই করে ডাকে। মায়ের চোখের পানি, বাবার বুকের পাথর, বোনের মুখের মায়াবি সম্বোধন আর কৌতূহলী জনতার দীর্ঘশ্বাসকে উপেক্ষা করে বালক ক্রমেই নীল হয়ে যেতে থাকে। দুঃখী এবং হতাশ কৃষককুল নিরুপায় হয়ে কলার ভেলা প্রস্তুত করতে শুরু করে। নদীপথে অজানায় ভাসতে ভাসতে যদি বালকের রুহ দেহের মায়ায় প্রত্যাবর্তন করে!

যখন পশ্চিম দিগন্তে ছোপ ছোপ লালিমায় সন্ধ্যা নেমে আসে, যখন বালকের নিথর শরীর ভেলার ওপর রাখা হয়, যখন মায়ের গলাছেঁড়া চিৎকারে নিমগাছের পাখিরা ভয়ে উড়াল দেয়, যখন বাবার বুকের ভেতর থেকে কেবল ভাতের বলক ওঠার শব্দ হয়, যখন ছোট বোন বাতাসে দুলতে থাকা ভাঁটফুলের মতো ফোঁপায়, ঠিক তখন পশ্চিমের লালিমার ভেতর থেকে পৌরাণিক গল্পের ত্রাণকর্তার মতো আবির্ভূত হন দরবেশ। হাতে তার বাঁকানো লাঠি। আংটির পাথরে নূরের ঝিলিক, চেহারায় অপার্থিব সৌন্দর্যের বিভা। গায়েবি প্রত্যাদেশের মতো দরবেশ দূর থেকে আওয়াজ করেন—থামো!

জনতা চমকে উঠে পশ্চিমে তাকায়। পশ্চিমের লালিমা ফুঁড়ে অদ্ভুতদর্শী মানুষটাকে বেরিয়ে আসতে দেখে গা শিরশির অনুভূতি হয় সকলের। মায়ের মন বলে—পারবেন। উনি পারবেন ছেলেকে বাঁচাতে।

ছেলের নিশ্চল শরীর তখন ভেলায় ভাসতে প্রস্তুত। দরবেশ হাটুপানিতে নেমে দশ আঙুলের দশটি আঙটি ছোঁয়ান নীল হয়ে ওঠা ছেলের নাসিকায়। শেষে, লাঠির বাঁকানো ফণা তার বুকের ওপর, যেখানে রুহ থাকে, ঘোরাতেই আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে বালক। যেন এক প্রশান্তিময় ঘুম থেকে জেগে ওঠা তার। জনতা ফেটে পড়ে হর্ষধ্বনিতে—দরবেশ বাবার জয় হোক! দরবেশ বাবার জয় হোক! বাবা-মা লুটিয়ে পড়ে ত্রাণকর্তার কদমে—আপনি সাক্ষাৎ ভগবান। ছেলের জীবনদাতা। দরবেশ বিড়বিড় করেন—জীবন দেওয়ার মালিক ঈশ্বর। আমি অসিলামাত্র।

এরপর দিন যত যায়, নগরে দরবেশকে নিয়ে কিংবদন্তি ছড়াতে থাকে। দরবেশ কোথাও স্থির থাকেন না। তিনি এখানে যান, ওখানে গিয়ে বসেন, আবার হাঁটেন, কখনওবা ধানের পাকা বাইলের ওপর প্রশান্তচিত্তে ইবাদত করেন। বালকেরা দরবেশের পিছু পিছু দৌড়ায় আর আবদার করে—ও দরবেশ বাবা, একটা জাদু দেখাও তো! দরবেশ তার লাঠি মাটিতে রাখেন। অমনি ভয়ংকর এক সাপ হয়ে যায় নিরীহ লাঠিটা। বাচ্চারা ভয় পেয়ে দূরে ছিটকে যায়। কেউ কেউ চিৎকার করে। কয়েকজন কেঁদে ফেলে। দরবেশ সাপটা মুঠোর মধ্যে নেন। অমনি তা আবার হয়ে যায় লাঠি। তখন কাঁদতে থাকা বাচ্চা দুটো ছুটে আসে লাঠির কাছে—আবার সাপ বানাও তো দেখি।

আর সাপ না। সাপ দেখে তোমরা ভয় পাও। এবার অন্য কিছু দেখো।

দরবেশ লাঠি দিয়ে পাথরে আঘাত করেন। পাথর ফেটে কমলা রঙের ফুল ফোটে। বাচ্চারা ফুল নেওয়ার জন্য হুড়োহুড়ি লাগায়। দরবেশ সবার হাতে একটা করে ফুল তুলে দেন।

একজন বলে—ওই যে উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক পাখি, ওগুলো নামিয়ে আনো তো! আমরা খেলব।

দরবেশ বলেন—পাখিদের নিয়ে খেলতে নেই। পাখিরা আকাশের সৌন্দর্য। ওরা উড়ে বেড়াক।

ছেলে নবজীবন পাওয়ার পর থেকেই কৃষকনেতা দরবেশের পেছনে লেগে আছেন। একটাই তার আকুতি—দরবেশ বাবা যেন তার পর্ণকুটিরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। যতদিন খুশি ততদিন। তিনি থাকতে দরবেশ বাবার থাকা-খাওয়ার কোনও চিন্তা নেই।

দরবেশ মুচকি হাসেন—ওরে মূর্খ, আমার অন্নের জোগানদাতা স্বয়ং প্রভু। 

তবু আমার স্ত্রীর বড় সাধ—আপনি আমাদের বাড়িতে আশ্রম খুলুন। তার হাতের সুস্বাদু পাচ্য গ্রহণ করুন। আমরা থাকতে আপনার সেবার কোনও কমতি হবে না। আপনার হাতে আমার ছেলের পুনর্জন্ম হয়েছে।

ঠিক আছে, যাহ! সপ্তায় একদিন তোর বাড়িতে থাকব। তোর স্ত্রীকে গিয়ে বল সংবাদটা। 

সপ্তাহের একদিন মঙ্গলবার দরবেশ কৃষকনেতার বাড়িতে অবস্থান করেন। সেই দিনে বাড়ির স্ত্রীটির চোখ-মুখ বেয়ে উপচে পড়ে আনন্দ। তার হাতের রেখায় লুকোনো রান্নার যত কারিশমা আছে, সবই খুলে খুলে সাজায় দরবেশের খাবারের থালায়। এমন খোদাবন্দ মানুষের সেবাযত্নে স্বর্গ নিশ্চিত।

ওই একদিনই দরবেশকে কাছে পায় নগরবাসী। তাদের কত জিজ্ঞাসা, কত কৌতূহল, কত চাওয়া, কত আবদার, দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত কত না-বলা কথা—অথচ দরবেশের সামনে গেলে সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। যার অলৌকিক নিশ্বাসের মৌতাতে নক্ষত্র খসে পড়ে ঘাসে, পাখিরা নেমে আসে মাটিতে, মাছেরা উঠে আসে ডাঙায়—তার সামনে বাগযন্ত্র বিকল হলে সে দোষ নগরবাসীর না। তবু এক মঙ্গলবারে গৃহকর্তা হওয়ার সাহসে দরবেশের সামনে বঞ্চনার গল্প পাড়েন কৃষকনেতা। জনতার সামষ্টিক ক্ষোভ জমাট বেঁধে তার একলা কণ্ঠে বিদ্রোহের ধ্বনি তোলে। এই নগরের বাবারা ভালো নেই। বিশেষ করে ঘরে যাদের কন্যাসন্তান আছে, তাদের আত্মা কণ্ঠনালির কাছে আটকে থাকে সব সময়। নগরপিতার পেয়াদারা প্রতি রাতে এক একজন মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় নগরভবনে। রাতভর তাদের ওপর চলে অগ্নিবর্ষণ। কেয়ামততুল্য রাতটি কাটানোর পর তারা যখন ফিরে আসে জনপদে, শুধু দেহই ফেরে তাদের, প্রাণ রেখে আসে নগরপিতার বিছানায়। এই অনাচারের বিরুদ্ধে কথা বলবার শক্তি কারও নেই। নগরভবনের গোপন কক্ষে একটি ভয়ংকর কূপ আছে বলে শোনা যায়। নগরবাসী এর নাম দিয়েছে অভিশপ্ত অন্ধকূপ। নগরপিতার সমালোচক অথবা বিরোধীদের শেষ ঠিকানা হয় এই অন্ধকূপ।

বৃত্তান্ত শুনে উত্তপ্ত হয়ে ওঠেন দরবেশ। দশ আঙুলের দশটি আঙটি থেকে অগ্নিলাভা বের হতে থাকে যেন। বাঁকানো লাঠিটা অজগর হওয়ার ইচ্ছায় হাতের মধ্যে মোচড়ামুচড়ি করতে থাকে।

আর ? মেঘ গমগম কণ্ঠে প্রশ্ন রাখেন দরবেশ। তিনি নগরপিতার আরও অপকর্ম সম্পর্কে অবহিত হতে চান।

এবার লোকদের দূরে থাকার ভীতি দূর হয়ে যায়। তারা সমস্বরে বলে—অন্যায্য করের ভারে আমরা বিপর্যস্ত, বাবা। নগরপিতার প্রমোদলীলার যাবতীয় খরচ আমাদের বহন করতে হয়। নগরপিতার লালসার লকলকে জিভ, হোক সেটা ওপরের অথবা নিচের, শান্ত করতে নির্বিচারে ব্যবহৃত হয় আমাদের অর্থ ও কন্যারা…

জনতার অভিযোগ সমাপ্ত হয় না, তার আগেই অর্ধসমাপ্ত খাবারের থালা রেখে আচমকা উঠে দাঁড়ান দরবেশ। তারপর হনহন করে বেরিয়ে যান কৃষকনেতার আশ্রম ছেড়ে। জনতা হয়রান হয়ে চাওয়াচাওয়ি করে মুখ—তারা বেফাঁস কিছু বলে ফেলেনি তো! 

পরের মঙ্গলবার দেখা মেলে না দরবেশের। জনতা ভাবে, হয়তো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত তিনি! তারা দ্বিতীয় মঙ্গলবারের জন্য অপেক্ষা করে। দ্বিতীয় মঙ্গলবারেও লোকালয়ে ফেরেন না দরবেশ। লোকেরা ভাবে—দরবেশ বাবার হলোটা কী! দুই পক্ষ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও দরবেশ বাবা অস্তিত্বে না এলে জনতা হাহুতাশ করতে থাকে। তারা ভাবে—নগরপিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে গিয়ে তারা বোধহয় ঈশ্বরপ্রেরিত এক মূল্যবান উপহার হারিয়ে ফেলল। 

এইসব আফসোস ও হাহুতাশের মাঝে নতুন অভিশাপ নেমে আসে নগরের ওপর। এক সকালে তারা অনুভব করে—খাদ্যপণ্যের দাম তাদের হাতের নাগালে নেই। আগে মুঠোভরা মুদ্রার বিপরীতে থলেভরা খাবার পাওয়া যেত। এখন থলেভরা মুদ্রার বিপরীতে মুঠোভরা খাবারও জোটে না। যারা ফসল ফলায়, সবজি উৎপাদন করে, তাদের কন্যাদের মতো উৎপাদিত খাদ্যশস্যও ছিনিয়ে নিয়ে যায় পেয়াদারা। নগরের অলিতে-গলিতে শোনা যায় দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। মানবশরীর শুকিয়ে কঙ্কাল হয়। মাতৃস্তনে দুধ না পেয়ে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে মরতে থাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। এখানে ওখানে পড়ে থাকে মৃতদেহ। আশরাফুল মাখলুকাতের দেহখাঁচা ধরে টানাটানি করে কুকুর-শেয়াল। চিল-কাক-শকুনের কালো ডানায় ছেয়ে যায় নগরের নীল আকাশ। পচা মাংসের গন্ধে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসে জনপদে। কিন্তু প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মাঝে তৈরি হয় বিরাট ফাটল। মাংসের আশায় ঠোকর দেওয়া তাদের প্রতিটি ঠোঁট হাড্ডির গায়ে ঠকঠক করে বেজে ওঠে।

নগরজুড়ে দুর্ভিক্ষের মাতম চলে, অথচ উঁচু পাঁচিলের ওপাশের নগরভবনে তার কোনও আঁচ লাগে না। নগরপিতার একটাই শুধু অসুবিধা—নগরে নাদুসনুদুস ডবকা মেয়ের অভাব। কারণ, দুর্ভিক্ষে মেয়েদের শারীরিক সুষমা লোপাট হয়েছে। মানবতার এই দুর্দিনে লাঠি হাতে পুনরায় আবির্ভূত হন দরবেশ। জনতা তার পায়ের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে—যিনি কৃষকনেতার মৃত ছেলের দেহে প্রাণসঞ্চার করতে পারেন, তিনি নিশ্চয় ঊষর মাটির গর্ভ থেকে খাদ্যশস্যও বের করতে পারবেন। দরবেশের দয়া হয় মনে। তিনি প্রতি সন্ধ্যায় নগরীর ঝোপঝাড়ে কচুর পাতায় লাঠি ছোঁয়ান, ভোরে পাতার সঙ্গে ঝুলতে দেখা যায় রান্না করা পাখির মাংসের সুস্বাদু সালুন। ফল পাড়ার মতো মাংসের সেই টুকরোগুলো নগরবাসী ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। এমন স্বাদ সে খাবারের, পৃথিবীর কোনও জিহ্বা তা আস্বাদন করেনি। এমন সুবাস সে খাবারের, পৃথিবীর কোনও নাসিকা তা অনুভব করেনি। এমন রং সে খাবারের, পৃথিবীর কোনও চোখ তা অবলোকন করেনি। লোকেরা বলাবলি করে—খোদাপ্রদত্ত এমন একজন দরবেশ যাদের থাকে, তাদের আর দুঃখ-তাপের কী ভয়! সত্যিই, দরবেশের অলৌকিকত্বে দুর্ভিক্ষের সেই ভয়ংকর দিনগুলো হেসেখেলে পাড়ি দেয় নগরবাসী। তারপর এক সময় সুদিন আসে। আকাশ থেকে বৃষ্টি নামে। নগরের মাঠ ফসলের জন্য যুবতী নারীর মতো কামার্ত হয়ে ওঠে। জনতা দরবেশের কাছে গিয়ে বলে, আমাদের আর পাখির মাংসের দরকার নেই। প্রতিদিন একই স্বাদের খাবার খেতে খেতে আমরা বিরক্ত। বৃষ্টি নেমেছে। আমরা মাঠে শস্য ফলাব। আমরা উৎপাদন করব তরকারি, কাঁকড়ি, গম, রসুন, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি।

দুর্ভিক্ষ বিদায় হলো, মাঠে মাঠে ফসল ফলল, কিন্তু নগরবাসী ফিরে পেল না প্রকৃত জীবনের স্বাদ। এখনও তাদের কন্যারা সম্ভ্রম হারায় নগরভবনের বিছনায়, এখনও তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ, অন্ধকূপের ভয়ে এখনও তারা দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমের ঘোরে। এরই মধ্যে ঘনিয়ে আসে নির্বাচনের দিনক্ষণ। নগরের কৃষকেরা একত্র হয় কৃষকনেতার বাড়িতে। নেতাকে তারা নগরপিতার বিপক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে উদ্বুদ্ধ করে। ক্ষমতার পালাবদল না ঘটলে নিপীড়িত কৃষককুলের মুক্তির কোনও পথ নেই।

এই প্রথম কৃষকনেতার কাঁধে হাত রাখেন দরবেশ। মাথা দুলিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন। দরবেশের হাতের স্পর্শে কৃষকনেতার কাঁধ শীতল হয়ে যায়। গরমে শরবত খাওয়ার প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে সারা দেহে। সেই তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। নির্বাচনে তিনি লড়বেন নগরপিতার বিরুদ্ধে। দরবেশ ও সমগ্র কৃষককুল তার সঙ্গে। এই সুযোগ বারবার আসবে না। পিতা হতে পারলে তিনি নগরের চেহারাই বদলে দেবেন। কৃষকের মুখে তিনি হাসি ফোটাবেন। ধর্ষিতাদের দেবেন মর্যাদা। জনগণ এবং নগরভবনের মাঝখানে রাখবেন না বৈষম্যের কোনও পাঁচিল।

দিন যায়। রাত আসে। প্রবল উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার ভেতর ঘনিয়ে আসতে থাকে নির্বাচনের দিনক্ষণ। জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। নগরপিতার পতন ঘটাতে তারা বদ্ধপরিকর। কৃষকনেতার প্রতীকে সিল মারার জন্য প্রস্তুত আছে তাদের স্বাধীন সার্বভৌম আঙুল। আর আছে দরবেশ বাবার আশীর্বাদ। এবার তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবেই।

নির্বাচনের আগের দিন সন্ধ্যায় নগরজুড়ে যখন টালমাটাল অবস্থা, ঠিক তখন দরবেশের অলৌকিকত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় নগরপিতা। দরবেশের মধ্যে কোনও ঐশ্বরিক শক্তি নেই। সবটাই তার জাদুর ভেল্কি। জাদু দেখিয়ে জনগণের মাথা খেয়েছে সে। ভেল্কি দেখানো অমন জাদুকরের অভাব নেই নগরভবনে।

তবে প্রতিযোগিতা হোক। দেখা যাক বিজয়ী হয় কে! 

নগরপিতা ঘোষণা দেয়—আগামীকাল নির্বাচনের দিন হবে প্রতিযোগিতা। একই দিনে দুই খেলা—ভোটের এবং জাদুর। জনতা খেলা দেখার ফাঁকে ফাঁকে ভোট দিয়ে আসবে। এতে আনন্দ বাড়বে দ্বিগুণ।

দরবেশ রাজি। সেই রাতে তিনি লাঠির গায়ে হাত বুলিয়ে, চুমু খেয়ে ঘুমাতে যান। পরদিন সকালে ভোটের মাঠের দুই প্রান্তে দাঁড়ায় দুই দল। একদিকে নগরপিতা, অপরদিকে কৃষকনেতা। একদিকে জাদুকর অপরদিকে দরবেশ। রাতারাতি পঞ্চাশজন জাদুকর জড়ো করে ফেলেছে নগরপিতা। তাদের হাতে নানা ধরনের রশি। বিপরীতে দরবেশ একা এবং তার হাতে একটিমাত্র লাঠি। খেলা শুরু হয়। জাদুকররা পালাক্রমে তাদের রশি ছেড়ে দেয় মাটিতে। সেগুলো বাঘ-সিংহ-কুমির-সাপ-হায়েনা হয়ে তেড়ে আসে দরবেশের দিকে। কৃষকেরা ভয়ে আঁতকে ওঠে, কিন্তু দরবেশ নির্ভার। যখন একেকটা জন্তু দরবেশের ছায়ার কাছে চলে আসে, যখন ভয়ে আতঙ্কে নগরের কৃষককন্যারা চোখ বন্ধ করে ফেলে, ঠিক তখন তখনই দরবেশ ছেড়ে দেন হাতের লাঠি। অমনি পাহাড়ের মতো বিশাল এক অজগর হয়ে যায় নিরীহ লাঠিটি। অজগর অলস ভঙ্গিতে হা করে আর জাদুকরদের সকল হিংস্র প্রাণি উড়ে উড়ে ঢোকে তার মুখের মধ্যে। দিনভর চলে এই খেলা। কৃষকেরা দরবেশের সাফল্যে এতটাই আত্মহারা, তারা ভুলে যায় আজ একটি বিশেষ দিন। এই একটি দিনের উদাসীনতায় পাঁচ বছরের জন্য তাদের জীবন আবার আটকে যাবে জুলুমের চোরাবালিতে।

খেলায় খেলায় গড়ায় বেলা। দরবেশের অজগরের কাছে কুপোকাত হয় নগরভবনের বাঘ-সিংহ-হায়েনা। কৃষকেরা দরবেশকে নিয়ে হর্ষ-উল্লাসে মাতে। ঠিক তখন, সূর্যাস্তের আগ মুহূর্তে একজন ঘোষক ঘোষণা দিতে দিতে ছুটে আসে ময়দানে—আজকের নির্বাচনে পূর্বের নগরপিতাই নবনির্বাচিত হয়েছেন। তিনি আপনাদের সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

নারীরা হায় হায় করে ওঠে। যুবকেরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

জনতা বিক্ষোভ শুরু করে। মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে স্লোগান দিতে দিতে তারা নগরভবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। নগরভবনের প্রতিটি ইট আজ ধুলোয় মেশাবে—এমনই প্রতিজ্ঞা তাদের শক্ত চোয়ালে।

পশ্চিম দিগন্তে সূর্য লাল হয়ে উঠলে নগরভবন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসে সশস্ত্র পেয়াদা। তাদের মারমুখী ভঙ্গি এবং আগ্নেয়াস্ত্র ভীতিসঞ্চার করে অপ্রশিক্ষিত, অসংঘবদ্ধ জনতার হৃদয়ে। বাধার মুখে পিছু হটতে গিয়ে তাদের মনে পড়ে দরবেশের কথা। এতদিনে সকল কাজে তারা দরবেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই দুঃসময়ে, পেয়াদারা যখন বজ্র হয়ে নামতে যাচ্ছে তাদের মাথায়, তখন দরবেশকে খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্বাচনী ডামাডোলের ভেতর তারা লক্ষ করেনি, ভোটের ফলাফল ঘোষিত হলে আপন নির্বুদ্ধিতায় বিরক্ত হয়ে মুষড়ে পড়েছেন দরবেশ। প্রাচীন এক আমগাছের ছায়ায় একলা বসে মাটিতে বিষণ্নতা ঝরাচ্ছেন তিনি।

ভিড়ের ভেতর থেকে কেউ একজন চিৎকার করে—দরবেশকে আমগাছের নিচে দেখেছি। চলো তার কাছে যাই। রাজার পেয়াদাদের কবল থেকে কেবল তিনিই আমাদের রক্ষা করতে পারবেন। 

বিক্ষিপ্ত জনতা ছুটে আসে দরবেশের কাছে। বোকামির অভিঘাত তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি দরবেশ। তখনও তিনি ধ্যানী ঋষির মতো অবনত মস্তকে বসে আছেন মাটিতে। জনতার হট্টগোল ঘোর ভাঙায় দরবেশের। তারা আর্তনাদ করে বলতে থাকে—আমাদেরকে রক্ষা করুন, দরবেশ বাবা। পেয়াদাদের হাতে পড়লে আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব।

ঘুমন্ত সিংহের মতো আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠেন দরবেশ। গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে লাঠির ভরে উঠে দাঁড়ান তিনি। জনতার মাথার ওপর দিয়ে ঘনঘোর দৃষ্টি প্রসারিত করে দেখেন, পঙ্গপালের মতো ছুটে আসছে পেয়াদার দল। তাদের মধ্যমণি খোদ নগরপিতা। দরবেশের চোখ হঠাৎ বিস্ফারিত হয়ে ওঠে। তার ওই চোখের তারায় জ¦লে ওঠে তুর পাহাড়ের আলো। মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তুলে জনতাকে তিনি ইশারা করেন অনুসরণের।

খুব আয়েশি ঢঙে, যেন কোথাও কোনও দুর্যোগ-দুর্বিপাক নেই, কোথাও ঝরছে না কোনও আহত পাখির পালক, এমন ভঙ্গিতে চলতে থাকেন দরবেশ। তার পেছন পেছন চলতে থাকে নগরের কৃষককুল, ভীতি যাদের আপাদমস্তক গ্রাস করে রেখেছে।

সহসা দরবেশের সামনে তিমির পিঠের মতো জেগে ওঠে এক নাব্য নদী, যার ঢেউ পেয়াদার অস্ত্রের চেয়েও ভয়ংকর। জনতা আহাজারি করে ওঠে—পেছনে ঘাতক, সামনে নদী, এখন উপায় ? দরবেশ নির্ভার। নদী থেকে উঠে আসা উছলা হাওয়ায় তার চুল ওড়ে, বস্ত্র দোলে। আলুলায়িত বস্ত্র সামলে তিনি এগিয়ে যান নদীর কাছে। টাখনু ভেজা জলে পা ডুবিয়ে তিনি লাঠি দিয়ে আঘাত করেন নদীর বুকে। অমনি করাতকলের নৈপুণ্যে চড়চড় করে দুই ভাগ হয়ে যায় নদীটি। মাঝখানে রাজপথ। দরবেশ পেছন ফিরে জনতাকে দেখেন। তার ঠোঁটে স্মিত হাসি। তখনও উড়ছে মাথার কাশবন। জাদুকরী সম্মোহনে তিনি আহ্বান করেন—আসো তোমরা। 

জনতার মধ্যে এবার দ্বিধা। এ সত্যিই পথ নাকি গোলকধাঁধা ? রাজার পেয়াদার সঙ্গে তবু যুদ্ধ করা যাবে, কিন্তু জলের সঙ্গে ? তারা দাঁড়িয়ে থাকে স্থির। দরবেশের হাসি এবার প্রসারিত হয়। তিনি একাই পা রাখেন অলৌকিক রাজপথে। তারপর হাঁটতে থাকেন সামনের দিকে। দু পাশের থমকে থাকা জল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে দরবেশের হেঁটে যাওয়া। এরপর আর সন্দেহ করা যায় না। এরপর সন্দেহ করা পাপ। জনতা এবার পড়িমড়ি উঠে আসে অথবা নেমে আসে রাজপথে। হাঁটতে থাকে দরবেশের পিছু পিছু। কেউ কেউ পানির গায়ে হাত বুলিয়ে দেখে—সেগুলো এখন কাচের দেয়াল।

জনতা যখন মাঝনদীতে, নগরপিতা ও তার পেয়াদারা নদীর কূলে এসে দাঁড়ায়। দরবেশ ও জনতার ওপর তারা এতটাই ক্ষিপ্ত, পরিণতি না ভেবে তারা পিছু নেয় জনতার। আর তখন পূর্বের ভয় পুনরায় ফিরে আসে জনতার মাঝে। নদীর বুকে রাস্তা রচিত হতে দেখে তারা ভেবেছিল, এই পথই তাদের মুক্তির উপলক্ষ্য। কিন্তু ঘাতকের দলও যখন সেই রাস্তা ব্যবহারের সুযোগ পায়, তখন আর মুক্তির কোনও আশাই অবশিষ্ট থাকে না। কেউ কেউ দরবেশের কাছে গিয়ে আক্ষেপ করে—ওরাও তো আসছে! আজ সব অভিযোগের বিপরীতে দরবেশ শুধু হাসেন।

জনতা কি একটু বিরক্ত হয় ? তারা ফাটল ধরা হৃদয় নিয়ে দরবেশের সঙ্গে পার হয় নদী। সূর্য ডোবে। পাখিরা ব্যস্ত কিষানির মতো ঘরে ফেরে। দূরে কোনও এক রাখাল বালক বিষাদের বাঁশি বাজায়। আর পেছনে শোনা যায় উন্মত্ত সৈন্যদের হুংকার—ধর ওদের। সবগুলোকে খতম কর।

জনতা যখন নদীর ওপারে গিয়ে দাঁড়ায়, নগরপিতা ও সৈন্যরা তখন মাঝনদীতে। কৃষকদের কেউ কেউ আর্তনাদ করে—এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে বেঘোরে প্রাণ খোয়ানোর চেয়ে ঘরের মাটি কামড়ে পড়ে থাকাই ভালো ছিল। এখানে আমাদের লাশটাও হয়তো শেয়াল-কুকুরের পেটে যাবে। শিশুরা কাঁদে। শিশুর মায়েরা আহাজারি করে। এ সময় আবার দৃশ্যপটে হাজির হয় দরবেশের লাঠি। সৈন্যদের অবস্থান দেখে নিয়ে দরবেশ নদীর বুকে লাঠির ঘাই মারেন। অমনি দু পাশের থমকে থাকা জল কলকল শব্দে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে। জলের আলিঙ্গনের মাঝে সলিল সমাধি হয় নগরপিতা ও তার সৈন্যদের। পথ মিশে যাওয়ার পরও নগরপিতার অন্তিম আর্তনাদ জলের ওপর ভেসে থাকে অনেকক্ষণ। কিন্তু সেই আর্তনাদ শোনবার মতো ধৈর্যশীল কোনও হৃদয় পাওয়া যায় না নদীতীরে।

উল্লাসে ফেটে পড়ে জনতা। দরবেশের অনুকম্পায় অবশেষে মুক্তির দিশা মিলল তাদের। মুক্তির দিশারী দরবেশকে পারলে তারা মাথায় তুলে নাচে। আকাশে তারা ফোটে। নদীর কূলে ঘাসের গন্ধ ছোটে। কয়েকটি বাদুড় ওড়াউড়ি করে নীল সামিয়ানার নিচে। উল্লসিত জনতা ক্লান্ত হয়ে এক সময় বসে পড়ে ঘাসের মাদুরে। তখন তাদের ঘরের কথা মনে হয়। ঘরের গবাদি পশুর কথা মনে হয়। লাউয়ের মাচা আর মটরশুটির কথা মনে হয়। এখনই তাদের ঘরে ফেরা দরকার। এতক্ষণে নিশ্চয়ই শেয়াল এসে উৎপাত শুরু করেছে মুরগির খোঁয়াড়ে। তারা দরবেশকে অনুরোধ করে—দরবেশ যেন নদী চিরে ঘরে ফেরার রাস্তা বানিয়ে দেয়। কিন্তু এত উপকারী দরবেশ, যিনি জালেমের হাত থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করেছেন, তিনি এবার বেঁকে বসেন রাস্তা বানাতে।

জনতা হায় হায় করে ওঠে—তাহলে আমরা ঘরে ফিরব কীভাবে ?

দরবেশ গমগমে কণ্ঠে বলেন—তোমাদেরকে জুলুম থেকে রক্ষা করেছি। এবার নিজের পথ নিজেই নির্মাণ করে নাও।

অন্ধকারে পা বাড়ান দরবেশ। একটু পর নিকষ আঁধারে দরবেশের জাদুকরী আংটির চলন্ত আলোই দেখা যায় শুধু।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button