
পর্ব-১
শেষ পর্বের আগে
তখন বিকেলটা দ্রুত সন্ধ্যার দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। আমি জাকিরের সঙ্গে মাঠেই ছিলাম। সেই সময়ে ক্রিকেট ছিল আমাদের প্যাশন। জাকির তখন বলত, দেখিস একদিন আমি ঠিক শোয়েব আক্তার হয়ে যাব। একদিন আমাদের এইসব ভাবনার চিকন প্রলেপ উবে গিয়েছিল ঠিক শেষবারের মতো যেদিন আমরা প্রাণপণে ছুটে গিয়েছিলাম জাকিরদের ভাড়া বাসার দিকে। সেদিন রুমি এসে জাকিরকে বলেছিল, তোদের বাসায় কী নিয়ে যেন খুব ঝামেলা হয়েছে, দেখলাম অনেক লোকজন। বিষয়টা আমরা তেমন গুরুত্ব না দিয়ে তখনও খেলা চালিয়ে যেতে থাকলাম। কারণ সেটা ছিল দিনের শেষ ম্যাচ, খেলায় আরও দুই ওভার চার বল বাকি ছিল। আবার ওদের এই ম্যাচ জিততে রান প্রয়োজন একুশ। আমি লং-অন এ ফিল্ডিং করছিলাম আর জাকির তার শেষ ওভারটা করছিল। আমাদের মাথায় তখন শচীন টেন্ডুলকার আর শোয়েব আক্তার হওয়ার স্বপ্ন। তাই নির্ঝঞ্ঝাট একটা পরিবারে ঠিক, হঠাৎ কী এমন ঝামেলা হতে পারে সে বিষয়ে আমরা তেমন গুরুত্ব দিলাম না। ভাবলাম জাকিরের মনোযোগ নষ্ট করার একটা ফন্দি এটা। কিন্তু রুমি আরও উদ্যত হয়ে যখন আদেশের সুরে জাকিরকে বলল, তোর মাকে নিয়ে খুব বড় ঝামেলা হয়েছে, শেষে এসে ওর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি ও জাকির কেমন যেন চিন্তাশূন্য হয়ে গিয়েছিলাম। জাকির ওর ওভারটা তখন কোনওমতে শেষ করতেই দুজন ছুট দিলাম জাকিরদের বাড়ির দিকে।
শুরুর পর্ব
জাকিরের সঙ্গে আমার পরিচয় সেই বালকবেলা থেকে। যখন আমরা ট্রাকভর্তি মালামাল নিয়ে সেই খুলনা থেকে রাজশাহীতে এলাম। এসে সরকারি কলোনির ফ্ল্যাটে আমরা উঠলাম। তখন একদিন আমাদের কলোনির পুকুরে গোসল করতে এসে ওর সঙ্গে পরিচয়। ওরা পুকুর এপার-ওপার হবার রেস খেলছিল দেখে আমিও আগ্রহ নিয়ে ওদের দলে ভিড়ে গিয়েছিলাম। ওকে সাঁতারে হারিয়ে দেওয়ায় ওর বিশাল ক্ষোভকে সঙ্গি করে আমার সঙ্গে পরিচয় হয়। তবে আস্তে আস্তে অবশ্য ওর ক্ষোভটা কেটে গেলে আমাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
কলোনির মেইন গেট পার হলেই ওদের বাসা। সাবলেটে বারান্দা লাগোয়া দুটো রুম ভাড়া নিয়ে থাকত। ওর মা রুবি আন্টি একটা এনজিওতে চাকরি করতেন। সাইকেল চালাতে পারতেন, প্রতিদিন স্কুলে যাবার সময় ওনাকে সাইকেলের সামনে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে বের হতে দেখতাম। ওর বাবাকে অবশ্য কখনওই ওদের সঙ্গে থাকতে দেখিনি। কোথায় থাকত তাও জানি না। পরিবার বলতে জাকির আর ওর মা। ওর বাবার কথা বলতেই বলত বিদেশে থাকে। মানে জাকিরও সেটুকুই জানে। কিন্তু আসলে যে তিনি কী করতেন কিংবা কোথায় থাকতেন তা আজও আমার অজানা। অবশ্য সেই বয়সে এই ব্যাপারে আমার তেমন কোনও কৌতূহল ছিল না। তাই এসব বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে কোনও আলোচনা কখনওই হয়নি। তখন কেবল ভারত-পাকিস্তান সিরিজে আমাদের উত্তাপ বাড়ত পুরো এলাকায়। আমরাও সেই ম্যাচ নিয়ে সবসময় প্রচুর উৎকণ্ঠায় থাকতাম। ম্যাচ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত চলত কথার লড়াই। আমি ছিলাম ভারতের সমর্থক। শচীন ছিল আমার আইডল। স্কুলের সামনের স্টেশনারি কাম লাইব্রেরিতে আমার নিয়মিত খোঁজ থাকত শচীনের নতুন কোন পকেট কার্ডগুলো এসেছে। ঠিক কোন কোন পোজ নিয়ে শচীন ব্যাটিং করা স্টিকার আমার সংগ্রহে নেই, তা সংগ্রহে আনার তোড়জোড়। আর আমার ঘরভরা ছিল শচীনের পোস্টার। প্রতিটা বইয়ের মলাটের ওপরে লাগিয়ে রাখতাম শচীনের স্টিকার।
জাকির অবশ্য এই পাগলামিতে আমার চেয়ে অনেক ওপরে। ও ছিল পাকিস্তানের সাপোর্টার। ওর একটা নতুন খাতা ভর্তি কেবল শোয়েব আক্তারের ছবি। আমি কেবল একটা দিন ওকে উদ্দেশ করে বলেছিলাম, যত যাই বল ম্যাগ্রা শোয়েব আক্তারের চেয়ে ভালো বোলার। এই কথা বলার কারণে সে সপ্তাখানেক আমার সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলেনি। শেষে অভিমানের পালা ভাঙ্গার জন্য ওর ঘরে থাকা শোয়েব আক্তারের সবচেয়ে বড় ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে ১০০ বার ‘শোয়েব আক্তার ম্যাগ্রার চেয়ে ভালো বোলার’ বাক্যটি বলিয়ে নিয়েছিল। বলা শেষ হলে নতুন করে বন্ধুত্ব শুরুর সোপান হিসেবে ওর খাটের তলা থেকে একটা বক্স বের করে আমার দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, ওয়াদা কর কাউকে বলবি না, তাহলে তোকে আজ একটা নতুন জিনিস দেখাব। আমিও ওর হাতে হাত রেখে ওয়াদা করলাম ‘কাউকে বলব না’। তারপর সেই বক্স থেকে ডান হাত দিয়ে একটা বেগুনি রঙের মাঙ্কিটুপি বের করে হিপনোটাইজ করার মতো করে আমার মুখের উপর নাড়াতে নাড়াতে বলেছিল, এইটা কি জানিস? আমি বললাম মাঙ্কিটুপি। আমার এমন নিশ্চিত জবাবে সে যে মনোঃক্ষুণ্ন হয়েছে তা আমি বুঝতে পারলাম ওর মুখভঙ্গি দেখে। তবে বিষয়টা যে জাকির হজম করতে পারবে না তা আমার জানা ছিল, তাই তো মুখ খুলে বলল, রামছাগল নাকি তুই? এটা যে মাঙ্কিটুপি সেটা তো আমিও জানি। তাহলে জিজ্ঞেস করছিস কেন? এমন একটা বাক্য মনের ভেতর রেখে দিয়ে, অবয়বে ভাবলেশহীন তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। এইসব বিষয় সামলে নিয়ে জাকির আমাকে যে কথাগুলো বলেছিল তার সারমর্ম এই, এই টুপিটার অলৌকিক একটা গুণ আছে জানিস, এই টুপিটা পরে যদি কেউ কোনও ঘটনার কথা চোখ বন্ধ রেখে চিন্তা করতে শুরু করে তবে সে কল্পনায় সেই ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখতে পায়। কিন্তু এতেও শর্ত আছে, একজন মানুষ কেবল জীবনে একবারই এটা ব্যবহার করতে পারবে। আমি উত্তেজনাবশত একবার দেখে ফেলেছি। তাই এ জন্মে আর কোনওদিন দেখতে পারব না। বরং সঙ্গে রাখলে নাকি একের পর এক ঝামেলা শুরু হবে ফ্যামিলিতে। তবু এই জিনিসটা একটা মাস্টারপিস। তাই কোনওভাবেই যেন আমার হাতছাড়া না হয় সেজন্য নিজের কাছে রেখে দিয়েছি। তবে আমাকে যিনি এটা দিয়েছিলেন তিনি বলেছিলেন একবার দেখা হয়ে গেলে অন্যকে দিয়ে দিতে। তা না হলে কেবল নিজের সঙ্গে ক্ষতিই হতে থাকবে। তবু এমন একটা মাস্টারপিস কি সত্যিই হাতছাড়া করা উচিত? বল? তাই সেই আদেশ অমান্য করেই আমি জিনিসটা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছি। কথাগুলো যে নেহাৎই চাপাবাজি তা নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। তবে আপাতত এসব সহ্য না করলে তার আবার বিগরে যাবার সম্ভাবনা আছে দেখে, সেই বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রেখে আপাতত এসব গালগল্প হজম করা ছাড়া কোনও উপায় না দেখে আমি চুপচাপ ওর কথা শুনছিলাম। এর মধ্যে শুক্রবার দুপুরে ওর প্রাইভেট টিউটরকে বাসায় আসতে দেখে আমি বড় অবাক হয়ে ওকে যখন জিজ্ঞেস করলাম এখন কি পড়তে বসবি? তখন ও বলল আরে না। কামরুল আঙ্কেল মায়ের কলিগ, হয়তো অফিসের কোনও কাজ নিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে এসেছে। তাই বলে শুক্রবার? এমন প্রশ্নবোধকে কোনও দীর্ঘ চিন্তার সূত্র না থাকায় এ বিষয়ে আমি জাকিরের সঙ্গে কোনও দিন আর কোনও কথা বলিনি।
আমাকে সেই মাঙ্কিটুপিটা দেখানোর পর আবার যত্ন করে সেই বক্সে রেখে দিল। তারপর আমরা এসব রেখে ওর কালেকশানে আসা শোয়েব আক্তারের নতুন ভিউকার্ড আর স্টিকার দেখতে শুরু করলাম।
দুজন মিলে যখন ওর শোয়েব আক্তার কালেকশন দেখায় বিভোর হয়ে আছি তখন হঠাৎ পেছন থেকে জাকিরের মা এসে বললেন কিরে বাবু আজ খেলতে যাবি না? এ কথা শুনে আমরা দুজনই আকাশ থেকে পড়লাম। এই কড়া রোদের ভেতর মাঠে? এমন একটা অজুহাত দিয়ে যখন আরেকটু সময় এই কালেকশন বিশ্লেষণ করছি ঠিক তখনই হাতের মুঠো থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে আন্টি জাকিরকে দিয়ে বললেন, যা দুজন দুটো কোক কিনে খাস।
তখন আর জাকিরকে পায় কে? হঠাৎই দলছুট মোষের মতো গতি পেয়ে বসল জাকির। তখনই বাহিরে এসে চিন্তা করে আমরা টাকাটা খরচের খাত খুঁজতে থাকি। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়, এই দুপুরে মাঠে ক্রিকেটে না গিয়ে চল আজ ভিডিও গেম খেলি। আজ দুজন দুই হ্যান্ডেলে ১০ টাকায় গেমওভার খেলব। আমাকে উদ্দেশ করে বলে, তুই পাঁচ টাকা ধার নে তাহলে। পরে দিয়ে দিলেই হবে। মনে মনে ভাবলাম এই বুদ্ধির চেয়ে কোক খাওয়াই ভালো আইডিয়া ছিল। তাতে অন্তত এই অর্ধ ধারের হিসাব আসত না। তবে প্রকাশ্যে আমি সহজেই রাজি হলাম। তাই আর দেরি না করে সোজা পথ ধরলাম ভিডিও গেমের দোকানের দিকে। গিয়ে দেখি বুদু ভাই কেবল দোকান খুলেছে, শুক্রবারের বিকেলে এখানে কন্ট্রোল পাওয়া বড় ধৈর্য্যরে কাজ। তবু একদম শুরুতে এসে ভাগ্যদেবী সহায় হওয়ায় আজ এসেই হাতে কন্ট্রোল পেলাম। শুরুতেই গেম ওভার খেলার কাস্টমার দেখে বুদু ভাইও খুশি। একটানা খেলে দুজন মিলে গেম ওভার করে যখন জাকিরের বাসায় ক্রিকেট স্ট্যাম্প আনতে যাই তখনও বাসায় কামরুল আঙ্কেলকে দেখে আত্মহারা হয়ে তাকে আমি বলে বসি, জানেন আঙ্কেল আমরা না আজ দুজন মিলে মোস্তফা গেম ওভার খেলছি। কামরুল আঙ্কেলও প্রতি উত্তরে আন্টির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আমার দিকে ফিরে বললেন, আমরাও আজ গেম ওভার খেলেছি। আমিও সরল মনে প্রশ্ন করে বসি, আঙ্কেল কার সঙ্গে? কেন তোমার আন্টির সঙ্গে। আন্টির চেহারায় রাগের ছাপ, ফর্সা মুখটা হঠাৎ লাল হয়ে গেল। ততক্ষণে জাকির ব্যাট নিয়ে ফিরে এলে আমরা আর দাঁড়িয়ে থাকিনি। সেই গোধূলির শেষ লগ্নে বের হয়ে এসে দেখি কেবলই সবাই মাঠে আসতে শুরু করেছে।
সকাল এবং বিকালে পাড়া-বেপাড়ার অনেকের খেলা থাকে এই কলোনি মাঠে। বিশেষ করে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন বলে মূল পিচ তো দূর-আনাচে কানাচে সার্কেল খেলার জায়গা পাওয়াও দুষ্কর। তাই দুপুর বেলা থেকে স্ট্যাম্প পোতা শুরু হয়। চর দখলের মতো এখানে মাঠের আধিপত্য ধরার অলিখিত নিয়ম এই। যে আগে স্ট্যাম্প পুতে দেবে সে বেলা সেই মাঠে তার একক আধিপত্য। আমরা আজ উত্তর-পূর্ব কোণের মাঠ নিয়ে খেলা শুরু করলাম। প্রথম ম্যাচ বিপক্ষ দল জিতলেও দ্বিতীয় ম্যাচ আমরা জিতে সিরিজে সমতা ফেরাই। শেষ ম্যাচ তাই দুই দলের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এমন সময় রুমি এসে আমাদের সবকিছুতে ঝামেলা উপচে দিল।
শেষ পর্ব
রুমির কথায় ঘাবড়ে গিয়ে আমরা দুজনই ছুটে চললাম জাকিরদের বাসার দিকে। বাসার কাছাকাছি যেতেই দেখি প্রচুর মানুষের ভিড়। এমন অবস্থা দেখে হঠাৎই আমার মনের ভেতর কেমন যেন এক অজানা আতঙ্কের সঞ্চার হলো। আমি কোনওকিছু না বুঝে বোকার মতো ছুটে গেলাম জাকিরের পিছে পিছে। কাছে যেতেই দেখি, কামরুল আঙ্কেলকে বাসার সামনের নিম গাছটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। আর বিচ্ছিরিভাবে শরীর থেকে আলগা হয়ে ছড়িয়ে থাকা শাড়িতে রুবি আন্টির দীঘল চুলগুলো হাতের সঙ্গে পেঁচিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছেন বুলু চাচা। বুলু চাচা এলাকার হর্তাকর্তা। সবাই তাকে মান্য করে চলে। কিন্তু যে অপরাধই করুক না কেন তাই বলে এমন আচরণ কোনওভাবেই আমি মানতে পারছিলাম না। তখন অবশ্য আমরা বেঁধে রাখার একমাত্র যে অপরাধের দণ্ড বুঝতাম তা হলো চুরি করা। তাই আমার মাথায় তখন যে চিন্তার বিস্তার হলো, তা বুলু চাচার বাড়িতে আবার কী এমন জিনিস চুরি করতে গেল কামরুল আঙ্কেল। আর সে যদি চুরি করেও থাকে জাকিরের মায়ের উপর এমন বেধড়ক পিটুনির সঠিক কারণটা কোথায়? আমার কাছে সে বয়সে এখনকার অনেক সরল অঙ্কও যে বেশ জটিল মনে হতো তা এখন বুঝতে পারি। আমার ভাবনার বিস্তারে তখন যুক্তি দাঁড়াল সে তো কেবল কামরুল আঙ্কেলের কলিগ। শেষটায় কামরুল আঙ্কেলকে আবার কয়েকটা পিটুনি দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিলেন বুলু চাচা, সর্বসম্মতিক্রমে। ভাবনার মাঝে যে সময় আসলে কতটুকু গড়িয়েছে তা আর মনে নেই, কেবল জাকিরের দিকে চোখ ফেরাতেই দেখি দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সবাই তখন ছেলের প্রতি এমন স্নেহার্ত নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকেও তিরস্কার করতে ছাড়ল না। তবে ছাড়া পেয়ে জাকিরের মা জাকিরকে সঙ্গে নিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই কোথায় যেন চলে গেলেন। আর যাবার সময় বলে গেলেন, সপ্তাখানেক পর এসে সব জিনিস নিয়ে যাওয়া হবে। ছাড়া পেয়ে কামরুল আঙ্কেলও সটকে পড়েন।
সপ্তাখানেক পর যেদিন জাকিরেরা সব জিনিস নিয়ে যাওয়ার জন্য ফেরত এল তখন আমি স্কুল থেকে কেবল ফিরেছি, এমন সময় জাকির আমাকে সেই মাঙ্কিটুপির বক্সটা হাতে তুলে দিয়ে গেল। আর বলল, মনে রাখিস মাত্র একবার, সেটা খুব প্রয়োজন না হলে না। তারপর আর কাছে রাখিস না। তা না হলে বড় অমঙ্গল হবে। দেখতেই তো পেলি সব কেমন কড়ায় গন্ডায় মিলে গেল। কারণ পৃথিবী এত আধুনিক হবার পরেও কেন এসব কুসংস্কার মানুষ এখনও বিশ্বাস করে? তবে বিদায়বেলায় আমি এ নিয়ে কোনও কিছুই বলিনি ওকে। যদিও এই জিনিসটাকে আমার এখনও গালগল্পই মনে হয়। তবু বন্ধুর অনুরোধে তা যত্নেই তুলে রাখলাম কেবল জাকিরের দেওয়া জিনিস বলে।
পর্ব-২
শুরু এবং শেষ
তারপর অনেকটা দিন চলে যায়। একটা সময় এই বক্স আর টুপিটার কথা মনেই থাকে না। হঠাৎ একদিন রাতে পাশের ঘরে আব্বা ও আম্মার মাঝে তুমুল ঝগড়ার আওয়াজ শুনতে পাই। আমার কাছে যদিও এসব কিছু ঠিক ভালো লাগে না তবু এমন সবকিছু মাঝে মাঝেই আমাকে সহ্য করতে হয়। আমি শুনতে থাকি এই সংসারে এসে আমার মায়ের জীবনে শত সহস্র না পাওয়ার যন্ত্রণার কথা। আর আব্বার মুখে শত সংগ্রাম করে সংসার টিকিয়ে রাখার গল্প। এভাবেই চলতে থাকে সব। একদিন দেখি আব্বা আম্মার সঙ্গে প্রচুর রূঢ় গলায় কথা বলছে, আমি তখন আমার পড়ার টেবিলের তল থেকে বের করি জাকিরের দেওয়া সেই মাঙ্কি টুপিটা। মাথায় পরে ভাবতে থাকি এদের ঝগড়ার আসল কারণ। চোখ বন্ধ থাকতে থাকতেই কল্পনায় দেখতে থাকি, যেন সবকিছু আমার চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে।
আমার আব্বার কলিগ জাহাঙ্গীর আঙ্কেল, কিছুদিন আগে যার নিঃসন্তান স্ত্রী বিষ খেয়ে মারা গেলেন, তিনি মাঝে মধ্যেই আসতেন আমাদের বাসায়, তারপর মাঝে মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া করতেন আমাদের সঙ্গে। আমি ভাবতাম হয়তো নিঃসঙ্গতা কাটাতে আসতেন, তবু তার মনে চলে অন্য ফন্দি। তিনিই একদিন আম্মুকে এই সংসারে না পাওয়ার ফিরিস্তি গেয়ে শোনাচ্ছেন। ক্রমাগত এই সংসারে না পাওয়ার গল্প শোনাতে শোনাতে তার কান ভারী করে তোলেন। অফিসে নজিরবিহীন দুর্নীতি করে অগাধ সম্পত্তি গড়েও নিঃসন্তান তকমা ঘোচাতে নিজের স্ত্রীকে বিষ প্রয়োগে নিজেই হত্যা করেছেন এমন নির্লজ্জ কর্মের কথাও কী অবলীলায় স্বীকার করছেন আমার ভাবতেই ঘেন্না ধরে যাচ্ছে।
এসব দেখে আমি নিজে থেকে ভীষণ কুঁকড়ে যাই। তারপর তিনি এবার দিতে থাকেন আমার পিতৃহত্যার প্ররোচনা-
ভাবলেশহীনভাবে বলে যান সংসারে না পাওয়ার হিসাব টেনে ঝগড়া বাঁধাবেন। ওর মতো সৎ লোকের এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকবার দরকার নেই। নেহাৎ সৎ বলে আজীবন সুযোগ পেয়েও কিছুই করতে পারলেন না। তারপর ঝগড়া বাড়িয়ে একটা সময় কোণঠাসা করে ওর খাবারে বিষ মিশিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। থানা পুলিশ সব আমি ম্যানেজ করব। ওই আমার বৌয়ের ব্যাপারটা ওরাই সব ম্যানেজ করে নিয়েছে। এ যুগেও এসব কোনও ব্যাপার না, শুধু আপনার জায়গা থেকে আপনি শক্ত থাকবেন। তারপর আমিই না হয় আমার সবকিছু সময় সুযোগ বুঝে দিয়ে দেব, মানে যদি আপনি বাকি জীবনটা আমার সঙ্গে থাকতে চান।
আমি নিস্তব্ধ হয়ে যাই এসব দেখে, তবু চোখ খোলার সাহস পাই না। একটু পর তাদের চিন্তার নিস্তব্ধতা থেকে বের হয়ে এসে দুজনের দুটো শরীর আস্তে আস্তে এক হয়ে যেতে থাকে। আমি আর এসব দেখতে পারি না। একটা টান দিয়ে খুলে ফেলি টুপিটা।
আমার পুরো শরীর ঘেমে নেয়ে যাওয়া অবস্থা। আশেপাশে কী চলছে সেদিকে আমার কোনও নজর নেই। কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছুটা সাহস নিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে আরেকবার মাথায় টুপিটা চাপালাম। কিন্তু এবার আর কোনও কিছুই দেখতে পেলাম না। কয়েক মুহূর্ত এভাবে থাকার পর নিজের উপর প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে চোখটা খুললাম। তখন আমার আলোহীন এই ঘরে ক্ষীণ থেকে প্রকট আকারে ভেসে আসতে শুরু করল এই সংসারে আসার পর আমার মায়ের অনেক কিছু না পাওয়ার আর্তনাদ। আব্বা তখনও চুপ।
সচিত্রকরণ : রজত