আর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

বিশ্বসাহিত্য : কবিতা : মেরি হাউয়ের গুচ্ছকবিতা

বাংলা অনুবাদ : তমিজ উদ্দীন লোদী

[২০২৫ সনে পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী কবি মেরি হাউয়ের জন্ম নিউ ইয়র্কের রোচেস্টারে ১৯৫০ সালে। তিনি স্যাক্রেড হার্ট কনভেন্ট স্কুল এবং ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসরে পড়াশোনা করেন। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে এমএফএ অর্জন করেন, যেখানে তিনি স্ট্যানলি কুনিটজের অধীনে শিক্ষালাভ করেন―যাকে তিনি ‘আমার সত্যিকারের গুরু’ বলে উল্লেখ করেন।

তাঁর প্রথম কবিতার সংকলন দ্য গুড থিফ (১৯৮৮) ন্যাশনাল পোয়েট্রি সিরিজে নির্বাচিত হয়েছিল, মার্গারেট অ্যাটউডের বিশেষ প্রশংসা নিয়ে, যিনি এটিকে ‘অন্ধকার শিকড়কে অতিক্রম করা আসক্তিমূলক কবিতা’ বলে আখ্যায়িত করেন। এই সংকলনে হাউয়ের ভবিষ্যদ্বাণীমূলক কিন্তু আত্মসন্দেহী কণ্ঠস্বর প্রায়শই বাইবেলীয় ও পৌরাণিক ইঙ্গিতের মাধ্যমে নিজের চিন্তা প্রকাশ করে। আমেরিকান একাডেমি অব পোয়েটসের লাভান ইয়াঙ্গার পোয়েটস প্রাইজে এই বইটি নির্বাচিত করতে গিয়ে কুনিটজ মন্তব্য করেন, ‘তাঁর দীর্ঘ, গভীর শ্বাসের লাইনগুলি মাংস ও আত্মার রহস্যকে স্পর্শ করে, একেবারে সেই নারীর ভাষায় যে আমাদের সময়েরই কিন্তু এখনও পবিত্রতার সঙ্গে যুক্ত।’

১৯৮৯ সালে হাউয়ের ভাই জন এইডস-সম্পর্কিত অসুস্থতায় মারা যান। এজিএনআই সাক্ষাৎকারে হাউ বলেছেন, ‘জনের বেঁচে থাকা ও মৃত্যু আমার শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে।’ হোয়াট দ্য লিভিং ডু (১৯৯৭) জনের প্রতি একটি শোকগাথা, পাবলিশার্স উইকলি দ্বারা সেই বছরের সেরা পাঁচটি কবিতার বইয়ের মধ্যে একটি হিসেবে প্রশংসিত হয়। রূপকের ব্যবহার ছেড়ে হাউ এই সংকলনটিকে ক্ষতির একটি স্বচ্ছ, সহজলভ্য প্রামাণিক দলিল হিসেবে রচনা করেন।

দ্য কিংডম অব অর্ডিনারি টাইম (২০০৮) বইয়ে হাউ ব্যক্তিগত আখ্যান থেকে দূরে সরে আসেন এবং তাঁর ‘আধ্যাত্মিক জীবনের রহস্যময় দিকগুলির প্রতি আসক্তি’-তে ফিরে যান, যেমনটি তিনি এজিএনআই সাক্ষাৎকারে ব্যাখ্যা করেন। এই কবিতাগুলো সম্পর্কে ব্রেন্ডা শগনেসি পাবলিশার্স উইকলিতে লিখেছেন, হাউ ‘রূপককে প্রাসঙ্গিক করে তোলেন এবং বস্তুগতকে আধ্যাত্মিকে রূপান্তরিত করেন।’ হাউয়ের চতুর্থ কবিতার বই ম্যাগডালেন  (২০১৭)। নিউ অ্যান্ড সিলেক্টেড পোয়েমস (২০২৪) পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করে।

হাউ সারা লরেন্স কলেজ, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি এবং এনওয়াইইউ-তে অধ্যাপনা করেছেন। মাইকেল ক্লেইনের সঙ্গে যৌথভাবে তিনি ইন দ্য কোম্পানি অব মাইসলিচিউড: আমেরিকান রাইটিং ফ্রম দ্য এইডস প্যানডেমিক (১৯৯৪) সম্পাদনা করেন। তিনি র‌্যাডক্লিফ কলেজের বান্টিং ইনস্টিটিউট, ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর দ্য আর্টস, গুগেনহাইম ফাউন্ডেশন, একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটস এবং প্রোভিন্সটাউনের ফাইন আর্টসওয়ার্ক সেন্টার থেকে ফেলোশিপ পেয়েছেন। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি নিউ ইয়র্ক স্টেটের পোয়েট লরিয়েট ছিলেন। বর্তমানে নিউ ইয়র্ক সিটিতে বসবাস করেন।]

জীবন্তরা যা করে

জনি, রান্নাঘরের সিংকটা কয়েক দিন ধরে বন্ধ, 

হয়তো কোনও ছুরি-চামচ সেখানে পড়ে আছে। 

ড্রেনও  কাজ করছে না, কিন্তু তার গন্ধটা বিপজ্জনক, 

আর পাত্রগুলোতে জমে থাকা খাবারের স্তূপ 

প্লাম্বারকে ডাকার জন্য অপেক্ষা করছে―যাকে আমি এখনও ডাকিনি। 

এটাই সেই দৈনন্দিন জীবন যার কথা আমরা বলতাম। 

আবার শীত এসেছে: আকাশ এক গভীর, জেদী নীল, 

আর সূর্যের আলো ঢলে পড়ছে বসার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে 

কারণ এখানে হিটিং খুব বেশি চালু, আর আমি তা বন্ধ করতে পারছি না। 

সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে, গাড়ি চালাতে চালাতে, 

বা রাস্তায় মুদিখানার ব্যাগ ফেলতে গিয়ে, ব্যাগটা ফেটে যেতে, 

আমি ভাবছি: জীবন্তরা এটাই করে। 

আর গতকাল, কেমব্রিজের ফুটপাথের নড়বড়ে ইটগুলোর উপর দ্রুত হাঁটতে গিয়ে, 

কফি আমার হাত আর হাতার উপর ছড়িয়ে পড়তে, 

আমি আবারও ভেবেছি, এবং পরে আবার, যখন একটি চুলের ব্রাশ কিনছিলাম: 

এটাই তো জীবন। 

গাড়ি পার্ক করা। শীতে গাড়ির দরজা জোরে বন্ধ করা। 

তুমি যাকে বলতে সেই ব্যাকুলতা। 

যা তুমি শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলে। আমরা চাই বসন্ত আসুক, শীত কেটে যাক। 

আমরা চাই কেউ ফোন করুক বা না করুক, একটি চিঠি, একটি চুমুর 

আমরা চাই আরও, আরও, এবং তারপর আরও বেশি। 

কিন্তু এমন মুহূর্তও আসে, হাঁটতে হাঁটতে, 

যখন আমি কোনও জানালার কাচে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখি, 

ধরা যাক, কোণের ভিডিও স্টোরের জানালায়, 

আর আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এক গভীর মমতা―

আমারই উড়ন্ত চুল, ফাটা ঠোঁট, আর খোলা কোটের জন্য― 

যে আমি কথা হারিয়ে ফেলি: 

আমি বেঁচে আছি। আমি তোমাকে মনে রাখি।

[ এই কবিতাটি তিনি তাঁর মৃত ভাইয়ের উদ্দেশে লিখেছিলেন ]

— —– ——- —–

পোস্টস্ক্রিপ্ট

যা আমরা পৃথিবীর সাথে করেছি, তাই করেছি আমাদের মেয়েদের সাথে 

এক এক করে। 

যা আমরা গাছের সাথে করেছি, তাই করেছি আমাদের বৃদ্ধদের সাথে 

লাঞ্চ রুমের দরজায় হুইল চেয়ারে স্তূপ করে রেখে। 

যা আমরা আমাদের মেয়েদের সাথে করেছি, তাই করেছি আমাদের ছেলেদের সাথে 

যারা তাদের মায়ের জন্য চিৎকার করে ডাকছে। 

যা আমরা গাছের সাথে করেছি, যা আমরা পৃথিবীর সাথে করেছি, 

তা-ই করেছি আমাদের ছেলেদের সাথে, আমাদের মেয়েদের সাথে। 

যা আমরা গরুর সাথে করেছি, শূকরের সাথে, ভেড়ার সাথে, 

তা-ই করেছি পৃথিবীর সাথে, কসাই করে দুধ দোহন করেছি তাকে। 

আমাদের মধ্যে কয়জন জানত পাখির ডাকের অর্থ কী 

অথবা আগুন কী বলতে চাইছিল? 

আমরা পৃথিবী থেকে নিয়েছি, নিয়েছি আর নিয়েছি, আর পৃথিবী 

মনে হলো আপত্তি করে না 

যতক্ষণ না আমাদের একজন মেয়ে চিৎকার করে বলল: এটা ছিল 

ঠিক তোমার চোখের সামনে, ঠিক তোমার দৃষ্টির আগে 

আর তুমি দেখতে পাওনি। 

বাতাস লাল হয়ে গেল। সমুদ্রে  দাঁত গজাল। 

—- —— —— ——-

চেইনস

শোনো, কোথাও না কোথাও সব সময় একটা চেইনস’র আওয়াজ থাকে, 

ড্রিলের তীক্ষè চিৎকার, কেউ হয়তো কিছু গড়ছে 

বা ভেঙে ফেলছে, লোহায় লোহা জড়ো করছে। 

প্রায় সবখানেই মানুষের ইচ্ছার শব্দ, 

ইঞ্জিনের গর্জন, ব্লেডের ঘর্ষণ, চাকার শব্দ, 

হাতুড়ির ঠকঠক, মেরামতের আওয়াজ। 

কাউকে ক্রুশে পেরেক দিয়ে আটকানো, কাউকে শেকল দিয়ে বাঁধা, 

কাউকে দড়ি দিয়ে ঝোলানো: শোনো: দড়ির চিঁ-চিঁ আওয়াজ: 

আরও হাতুড়ির আঘাত। 

‘ওর নিজের বন্দুক দিয়েই ওকে মেরে ফেলো,’ একজন নারী চিৎকার করে বলল, 

‘ওর নিজের বন্দুক দিয়েই ওকে মেরে ফেলো।’

আমরা কী তৈরি করেছি? আমরা এখন কী তৈরি করছি? 

আর কে বা কী আমাদের এমন বানিয়েছে যে আমরা এমন সব জিনিস তৈরি করি যা আমরা করেছি ও করছি? 

আমরা ছোট হয়ে যাচ্ছি―আমরা জিনিস ভাঙি, 

তারপর একে অপরের দিকে ফিরে এমন কিছু চাই যা কোনও মানুষ দিতে পারে না।

—- —– —– —– ——

পার্সিফোনি  

আমার মা জানে সবই এই আঁধার-জগৎ সম্বন্ধে। 

তার ভান করার কোনও দরকার ছিল না ভয় পাবার। 

বীজকে ফেটে উঠতেই হবে; 

অত গভীরে পুঁতলে পচন ধরে যায়। 

আমার মা একজন দেবী; আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। 

কিন্তু আমার স্বভাবই হলো প্রকৃতির স্বভাব। 

যেমন সব জীবিত বস্তু, আমিও বিদীর্ণ হবার জন্যই জন্মেছি, 

ফুটতে, শোষিত হতে, ভক্ষিত হতে, 

হেলতে, বাঁকতে, শুকোতে, 

আর মরতে, মরতে, মরতে, মরতে―যতক্ষণ না মৃত্যু আসে।

—- —- —– ——

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button